কেনারাম

কেনারাম

গিরিজাবাবু নাকি?

যে আজ্ঞে। আমি গিরিজা পুততুণ্ডই বটে। তা আপনি? আমাকে চিনবেন না। আমার নাম করালী ঘোষ। ভীমপুরে সাত পুরুষের বাস।

অ, তা ভালো কথা। এখানে কী কাজে আগমন?

কাজে তেমন কিছু নয়। গোরু খুঁজতে বেরিয়েছি।

গোরু খুঁজতে এত দূর! ভীমপুর তো না হোক চোদ্দো—পনেরো মাইল দূর হবে। বাড়ির আশেপাশেই খুঁজে দেখুন, হারানো গোরু পেয়ে যাবেন।

গোরু হারালে তো হারানো গোরুর কথা ওঠে মশাই। আমার যে গোরু হারায়নি।

তা হলে যে বললেন, গোরু খুঁজতে বেরিয়েছেন।

তা অবশ্যি ঠিক। গোরু খুঁজতে বেরোনো বটে। তবে কিনা সেটা হারানো গোরু নয়।

তবে কি গোরু কিনতে বেরিয়েছেন নাকি?

আজ্ঞে না। আমাদের গোয়ালে বারোটা গোরু। গোশালায় আর তেমন জায়গাও নেই কিনা। গোরু গোঁজা খোঁজা আমার একটা নেশা বলতে পারেন।

গোরু খোঁজার নেশা। এরকম তো কখনো শুনিনি মশাই। ওরকম নেশা আবার হয় নাকি?

ঠিকই বলেছেন। গোরু খোঁজার অভ্যাসকে ঠিক নেশাও বলা যায় না বটে।

ভালো কথা, আপনি দেখছি আমার নাম জানেন। কিন্তু আমি তো তেমন কেষ্টুবিষ্টু মানুষ নই! নামটা জানলেন কী করে?

ওই পুবের মাঠে একটা বেশ নধরকান্তি সাদা রঙের গোরু দেখে লোকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, গোরুটা কার।

তা একজন নস্করবাবু বললেন, গোরুটা গিরিজাবাবুর। সঙ্গে এও বললেন, চামার মশাই, চামার। আটটা গোরু দু—বেলা না হোক বিশ কিলো দুধ দিচ্ছে, তবু পঁচিশ টাকার এক পয়সা কমে দুধ বিক্রি করবে না।

বটে! নস্করের এতবড়ো সাহস!

চেনেন নাকি নস্করবাবুকে?

কে না চেনে নচ্ছারটাকে? মোটে আধসের করে দুধ নিত, তাও তিন মাসের টাকা বাকি। ছ—মাস ঘুরে তাগাদার পর তাগাদা দিয়ে তবে চার কিস্তিতে টাকা আদায় করা গেছে। ওর মুখ দেখলে পাপ হয়।

তা হতে পারে। তবে কিনা নস্করবাবু আমাকে বিশুর চায়ের দোকানে এক ভাঁড় চা খাইয়েছেন। সঙ্গে দুটো কুকিস বিস্কুট।

তাতে কী মাথা কিনে নিয়েছে নাকি? চা আর বিস্কুটেই কাত হয়ে পড়বেন না যেন। কেনারাম নস্কর অতি ধুরন্ধর লোক। মতলবের বাইরে এক পয়সা খরচ করার পাত্র নয়। সেবার পাত্রপক্ষ ওর মেয়েকে দেখতে এসে ট্যারা বলেছিল বলে মিষ্টির প্লেট তুলে নিয়ে গিয়েছিল সামনে থেকে।

এঃ, এ তো মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়া। নাঃ, এ কাজটা কেনারাম নস্কর মোটেই ভালো করেননি। তা কেনারামবাবুর মেয়ে সত্যিই ট্যারা নাকি?

ট্যারা বলতে ট্যারা! বেজায় ট্যারা মশাই। তার ওপর বেঁটে, কালো, দাঁত উঁচু। ওই কেনারামের মতোই চেহারা!

বলেন কী মশাই! তা হলে কী আমি দিনে—দুপুরে ভুল দেখলুম! কেনারাম নস্করকে তো আমার দিব্যি ফরসা বলেই মনে হল! আর বেঁটে তো নন। দিব্যি লম্বা চেহারা! ট্যারা কিনা সেটা অবিশ্যি ভালো করে লক্ষ করেনি। নয় বলেই যেন মনে হচ্ছে।

তা সে যাই হোক, কেনারাম মানুষ মোটেই ভালো নয়। ওর সঙ্গে আপনি মোটেই মেলামেশা করতে যাবেন না যেন! এই গাঁয়ে তো একঘরে।

গোরু খুঁজতে বেরিয়ে কী মুশকিলে পড়া গেল মশাই।

কেন, মুশকিলটা কীসের?

প্রথম মুশকিল হল, মানুষের খিদে—তেষ্টা বলে একটা ব্যাপার আছে। তারপর ধরুন, পেটপুরে খেলে দুপুরে আমার বড্ড ঘুম পায়, তার ওপর নরম বিছানা না হলে আমার মোটে ঘুমই আসে না। তা কেনারামবাবু পই—পই করে বলে দিয়েছেন আজ মধ্যাহ্নভোজনটা যেন আমি তাঁর বাড়িতেই সারি। কিন্তু আপনার কথা শুনে তো বড়ো দমে গেলুম মশাই। কেনারাম নস্কর যে এত খারাপ লোক তা জানা ছিল না আমার। কিন্তু মধ্যাহ্নভোজটা কী তা হলে আজ উহ্য রাখতে হবে!

গিরিজাবাবু ফুঁসে উঠে বললেন, তার মানে! উহ্য রাখলেই হল? গাঁয়ের একটা মান— ইজ্জত নেই? বলি কেনারাম কী—ই বা খাওয়াত আপনাকে শুনি? মোটা চালের ভাত, পাতলা জলের মতো ডাল, পুঁটি মাছের ঝোল আর বড়োজোর একটুকরো লেবু।

এত খারাপ?

তবে আর বলছি কী। চলুন, আমার বাড়িতে চলুন। সরু চালের ভাত, গাওয়া ঘি, বেগুন ভাজা, সোনা মুগের ডাল, মাছের মুড়ো, পাঁঠার মাংস, একবাটি পায়েস, চলবে তো?

কষ্টেসৃষ্টে চলে যাবে। তবে কিনা ডালের পাতে একটু ভাজাভুজি না হলে আমার চলে না।

খুব—খুব। গাছে বকফুল—কুমড়ো ফুল আছে। তাই দিয়ে বড়া। তারপর পটল আছে, কুমড়ো আছে, আর চাই কী আপনার? আসুন তো মশাই। লজ্জা করবেন না।

আহা, এত উতলা হবেন না। বেলাও বেশি হয়নি। মাত্র পৌনে বারোটা বাজে। মহাজনেরা কী বলেছেন জানেন তো! ভাবিয়া করিয়ো কাজ, করিয়া ভাবিয়ো না।

আহা, কান জুড়িয়ে গেল। মহাপুরুষরা যে কত ভালো ভালো কথা বলেন তার হিসেব নেই। তা করালীবাবু, কথাটা উঠল কেন?

না, ভাবছিলাম কেনারাম নস্করের মতো একজন কেষ্টবিষ্টু মানুষকে চটানোটা উচিত হবে কিনা।

কেষ্টবিষ্টু! কেনারাম আবার কেষ্টবিষ্টু হল কবে?

এই যে কানাঘুষো শুনলুম তাঁর নাকি তিনতলা বাড়ি, বিরাট আমবাগান, তিনশো নারকেল গাছ, দুশো বিঘে ধানী জমি আর হিমঘর আছে।

ফোঁপরা মশাই ফোঁপরা। বেলুন দ্যাখেননি? লাল—নীল—সবুজ, দিব্যি নিটোল আকৃতি। হাওয়া বের করে দিলেই একটুখানি। কেনারামও তাই। ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখুন গে, সব মর্টগেজে বাঁধা আছে।

আপনি তো মুশকিলে ফেলে দিলেন মশাই। কেনারামবাবুর ছেলে সাতকড়ির সঙ্গে যে আমার মেয়ের বিয়েরও একটা প্রস্তাব আজ সকালে দিয়ে বসলেন উনি!

বলেন কী? ওই গিদধরের ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন? মাথা খারাপ হল নাকি আপনার? তার চেয়ে হাত—পা বেঁধে মেয়েকে জলে ফেলে দিন তাও ভালো।

তবে তো চিন্তার কথা হল মশাই!

তা তো বটেই। ভালো করে চিন্তা করুন। তবে বলে রাখি, মেয়ের বিয়ে দিতে চাইলে আমারও উপযুক্ত পুত্র আছে। বিএ পাশ, স্কুলের মাস্টার, দিব্যি কার্তিক ঠাকুরের মতো চেহারা।

সে তো বুঝলুম। কিন্তু আরও একটু কথা আছে।

কী বলুন তো।

কেনারামবাবু বললেন, এক পয়সা পণ নেবেন না, দানসামগ্রী দিতে হবে না, শুধু শাঁখা—সিঁদুর দিয়ে বিয়ে দিলেই চলবে। শুনে তো আমার চোখে জল এল। এই কলিযুগেও এমন মানুষ আছে।

আছে মশাই আছে। কুমিরের চোখের জলকে বিশ্বাস করবেন না। কেনারাম নিশ্চয়ই অন্য মতলব এঁটে রেখেছে। আর পণের কথা বলছেন? পণকে তো আমি গো—মাংস বলে মনে করি। আর দানসামগ্রী! ছিঃ, ওসব কী ভদ্রলোকেরা নেয়?

গিরিজাবাবু আপনি আমাকে ছলনা করছেন না তো!

আরে না মশাই, না। কথা একেবারে পাকা। নড়চড় নেই। শুধু ওই কেনারামটার সঙ্গে মেলামশো করবেন না যেন।

আজ্ঞে, সে আর বলতে! চলুন মধ্যাহ্নভোজটা সেরেই ফেলি। বেলা অনেক হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *