কেনাকাটা: জুতো
বাজারে কেনাকাটা করতে গিয়ে যে সব লোক মনে করে যে তাদের বুদ্ধি দোকানদারের থেকে কিছু কম নয়, তারা আর যাই হোক বুদ্ধিমান লোক মোটেই নয়।
আমাদের সর্বানন্দ দত্তও খুব একটা বুদ্ধিমান লোক নন এবং সে কারণেই তিনি যে বাজারে গিয়ে পদে পদে ঠোক্কর খাবেন, তাতে আর সন্দেহ কী।
সর্বানন্দের গত দু’বছরের জুতো কেনার অভিজ্ঞতার কথা বলি।
জুতো কেনা বছর কয়েক হল ভারী ঝকমারি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পুজোর মরশুমে কোনও কোনও জুতোর দোকানে এত বড় লাইন হয় যে চাল, চিনি, কেরোসিনের জন্যও অতবড় কিউ দেখা যায় না। একমাত্র ফুটবলের ফাইনাল বা ক্রিকেটের ওয়ান ডে ম্যাচের লাইনের সঙ্গে তার তুলনা হয়।
সর্বানন্দের সকালের বাজার আছে। দুপুরের অফিস আছে, সন্ধ্যাবেলার আড্ডা আছে। রবিবার ও ছুটির দিনের গ্যাঞ্জাম আছে। লাইন দেওয়ার সময় তাঁর নেই। সেই জন্যে রেশন কার্ড থাকা সত্ত্বেও এবং পাড়ার দোকানে কেরোসিন তেল এলেও লাইন বাঁচানোর জন্য তিনি ব্ল্যাকে ভাল দামে কেরোসিন কেনেন। অবশ্য সর্বাণীকে সেটা বুঝতে দেন না, তা হলে গোলমাল হবে।
সুতরাং লাইন দিয়ে জুতো কেনার কথা সর্বানন্দ ভাবতেও পারেন না। কলকাতার সাবেকি চিনেপাড়ার জুতোর দোকানে কিন্তু ভিড় তেমন নেই। পুজোর সময় বলে দু’-চারজন ক্রেতা অবশ্য আছে, কিন্তু গাদাগাদি, ঠেলাঠেলি নেই।
ভিড় এড়ানোর জন্য, গত বছর পুজোতেই, এক বন্ধুর পরামর্শে সর্বানন্দ চিনেবাজারে জুতো কিনতে যান। সেখানে প্রথমেই তাঁর একটা বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
সর্বানন্দ জানতেন না চিনে দোকানের ঐতিহ্য, সেখানে কেনাকাটা মানেই দামদর এবং সে এক অবাস্তব ব্যাপার। পাঁচশো টাকা দাম চাওয়া জিনিসের কেউ সরাসরি দুশো টাকা দাম বললে সে জিনিসটা পাবে না। কিন্তু সময় দিয়ে খেলিয়ে খেলিয়ে কথা কাটাকাটি করে সেটার দাম দেড়শো টাকায় নামিয়ে আনা খুব কঠিন নয়।
সর্বানন্দ যখন দোকানে বসেছিলেন, তাঁর পাশের ভদ্রলোক একজোড়া নিউকাট পছন্দ করে, জুতোর দাম জানতে চাইলেন।
প্রৌঢ় চৈনিক চর্মকার, স্থূলদেহী, গায়ে কালো হাতকাটা স্যান্ডো গেঞ্জি, অধমাঙ্গে গোলাপ ফুলের ছাপ দেওয়া চিত্রবিচিত্র হাফপ্যান্ট (বর্তমান নাম বারমুডা) কুতকুতে চোখে এবং নির্বিকার মুখে বলল, ‘এইত হান তেলেত লুপিক (এইট হান্ড্রেড রুপিস)।
দামের বহর দেখে সর্বানন্দ তখনই দোকান থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলেন কিন্তু সেই মুহুর্তে শুনতে পেলেন, বিচক্ষণ ক্রেতা বলছেন, ‘ওয়ান হান্ড্রেড টেন রুপিস।’
ঘটনার গতিক দেখে সর্বানন্দ রঙ্গস্থল থেকে পলায়ন করলেন না। অপেক্ষা করতে লাগলেন। এর পরেই তাঁর পালা।
সর্বানন্দকে নতুন লোক দেখে হাসি মুখে অভিনন্দন জানিয়ে চিনে দোকানদার ‘নাইন হানতেলেত’ থেকে শুরু করল, সর্বানন্দ কেমন মরিয়া হয়ে উঠলেন, সর্বানন্দ বললেন, ‘থ্রি হানড্রেড’। চিনেটি একটু দাম নামাল বলল, ‘ছিক (সিক্স) হানতেলেত’। সর্বানন্দ সঙ্গে সঙ্গে নিজের দামও কমিয়ে দিয়ে বললেন, ‘টু হানড্রেড।’
খদ্দের আগের দাম থেকে নেমে যাওয়ায় চিনেটা চমকিয়ে গেল, এ রকম সে আগে দেখেনি। সে আরেকটু কমিয়ে পাঁচশো টাকায় নামল এবং সঙ্গে সঙ্গে সর্বানন্দ দাম কমিয়ে বললেন, ‘ওয়ান হান্ড্রেড সিক্সটি সিক্স রুপিস সিক্সটি সিক্স পয়সা।’ আসলে সর্বানন্দ মনে মনে স্থির করে নিয়েছেন যে চিনেটা যা বলবে আমি তার এক তৃতীয়াংশ বলব। চিনেটা হতবাক হয়ে আত্মসমর্পণ করল। আর বিশেষ দামদরের মধ্যে না গিয়ে তিনশো টাকায় জুতো জোড়া রফা করল।
জুতো জোড়ার হয়তো দাম খুব বেশি লাগল না কিন্তু এই জুতোজোড়া সর্বানন্দের পক্ষে খুব সুখকর হয়নি। তাঁর লাগে আট নম্বর জুতো, কিন্তু ধড়িবাজ চিনেটা আট নম্বরের অভাবে একটা ছোট সাইজের সাত নম্বর জুতো গছিয়ে দিল। বলল, ‘নরম চামড়ার জুতো, পায়ে দিতে দিতে ছেড়ে যাবে।’
সেই এক সাইজ কম জুতা পায়ে দিয়ে পুরো এক বছর সর্বানন্দ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটেছেন। তাই এবার সর্বানন্দ প্রতিজ্ঞা করেছেন ছোট সাইজের জুতো কিনবেন না, বাক চাতুরিতে প্রতারিত হবেন না।
সেই একই দোকান, একই দোকানদার। দোকানদারের অবশ্য গত বছরের কথা মনে আছে, তাই আর দরদামের মধ্যে না গিয়ে তিনশো টাকাতেই জুতোর দাম রফা হল। কিন্তু এবারও আট নম্বর নেই। চিনেটা এবার একটা নয় নম্বর জুতো গছাল।
এ জুতো জোড়া টাইট হয়নি বটে কিন্তু ভীষণ ঢলঢলে হয়েছে। সেদিন সকালে তাড়াতাড়ি বাজারে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ পেছন থেকে কে একজন চেঁচালেন, ‘দাদা আপনার জুতো জোড়া এখানে রয়ে গেল, কখন পা থেকে আলগা হয়ে বেরিয়ে গেছে টেরও পাননি।’
রাতে ক্ষতিটা হল, নতুন জুতো জোড়া গচ্চা গেল। পানশালা থেকে বাড়ি ফিরে দেখেন পায়ে জুতো নেই, কোথায় পড়ে গেছে কে জানে?