কেন
ঠাকুর সাহস করে আপনাকে একটা প্রশ্ন করি। অসন্তুষ্ট হবেন না। আপনি বললেন : “খুব ব্যাকুল হয়ে কাঁদলে তাঁকে দেখা যায়। মাগ-ছেলের জন্যে লোকে এক ঘটি কাঁদে; টাকার জন্যে লোকে কেঁদে ভাসিয়ে দেয়; কিন্তু ঈশ্বরের জন্যে কে কেঁদেছে, ডাকার মতো ডাকতে হয়।” আপনি গান ধরলেন : “ডাক দেখি মন ডাকার মতো কেমন শ্যামা থাকতে পারে।” গান শেষে বললেন : “ব্যাকুলতা হলেই অরুণ উদয় হয়। তারপর সূর্য দেখা দেবেন। ব্যাকুলতার পরই ঈশ্বরদর্শন। তিন টান একত্র হলে তবে তিনি দেখা দেন-বিষয়ীর বিষয়ের উপর, মায়ের সন্তানের উপর, আর সতীর পতির উপর টান।” সেইখানেই আমার অভিমান। তিনি আমার মা। শ্যামা মা। নির্জনে বসে আমি মাকে বললুম : “মা, তুমি আমাদের কেমন মা? কতকাল ধরে সেই একই কথা শুনে এলুম—আমি তোকে দুঃখ দোব, জ্বালা-যন্ত্রণা দোব, তোর সবকিছু কেড়ে নোব, কেন? না, তাহলে তুই আমাকে ডাকবি। ‘যে করে আমার আশ, আমি করি তার সর্বনাশ’।” বা, কথা! আমি যদি তোমার ছেলে হই, তাহলে তুমি আমাকে কাছে ডাকবে না কেন! তোমার সামান্য কৃপায় তো আমার মন ঘুরে যেতে পারে। দেহ যখন দিলে, তখন দেহের প্রয়োজনে তো আমাকে জীবিকা খুঁজতেই হবে। হা অন্ন! হা অন্ন! এতো মা তোমারই খেলা। অন্ন-চাহিদা দিয়েই তো পাঠালে। পাশাপাশি পাঠিয়ে দিলে অন্নদাতা। তোমার সৃষ্টির প্রয়োজনেই তুমি পুরে দিলে সংসার-বাসনা। সংসারের প্রয়োজনেই বিবাহ। বিবাহ মানেই সন্তানাদি। আমার ইচ্ছেতে তো কিছু হয়নি মা। সবই তোমার ইচ্ছে। সাধকই তো বলেছেন—আমি যন্ত্র তুমি যন্ত্রী। তুমি আমাকে সংসারের চক্রে ফেলবে। দাসত্ব করাবে। হা অন্ন, হা অন্ন করে দিগ্বিদিকে ছোটাবে। তারপর তুমিই আমাকে সংসারবদ্ধ জীব বলে ঘৃণা করবে। সেভাবে তোমাকে ডাকা হলো না বলে সরে থাকবে। এ তোমার কেমন বিচার! আমার জাগতিক মা কি আমাকে দিনান্তে ডেকে ঘরে তুলতেন না! আমার জন্যে ব্যাকুল হতেন না! আমি ভুলে থাকলেও তিনি তো আমাকে ভুলতেন না। আর তুমি জগৎ-মাতা হয়ে এই ব্যবস্থা করলে যে, আমাকে যতরকম বিপদে ফেলে আমাকে দিয়ে গলা ছেড়ে কাঁদাবে। আমার জীবিকা টলমল হবে, পুত্র-কলত্র অকালে চলে যাবে, মামলা- মোকদ্দমা, চূড়ান্ত অপমান, সবই আমাকে সহ্য করতে হবে। সব হারিয়ে সর্বহারা হয়ে আমি তোমাকে ডাকব। তাতেও তোমার কৃপা হবে কিনা কে জানে! এমনই অনিশ্চিত ব্যাপার। তখন সাধকরা বলবেন—এক জন্মে কি হয় বাবা! কত জন্ম সাধনা করলে তবেই না মাকে পাওয়া যায়! আবার এও শুনলুম, মিনমিনে আস্তিকের চেয়ে নাস্তিক ভাল। শত্রুরূপে ভজনা। কংসের মতো, মহিষাসুরের মতো, রাবণের মতো। আমার বড় অভিমান মা তোমার ওপর। একবারও কি আমার কথা তোমার মনে পড়ে না! তাহলে সাধক কেন বললেন—কুপুত্র যদি বা হয়, কুমাতা কখনো নয়। আমার জাগতিক মাতা যদি আমার প্রতি উদাসীন হতেন, জগৎ কি তাঁকে ক্ষমা করত। আর তুমি জগৎ- মাতা বলে সবকিছুর ঊর্ধ্বে! তোমার বিধানই বিধান, আর আমার অভিমান ভেসে যাবে? সারাটা জীবন আমি অনাথের মতো ঘুরব? সংসারের খিদমত খেটে যাব। খারাপ যাকিছু হবে, সবই আমাকে ভেবে নিতে হবে, তোমার পরীক্ষা। চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলতে হবে, মা, সবই তোমার পরীক্ষা, তুমি যা করছ সবই আমার মঙ্গলের জন্যে। সাধক বলবেন—”মাকে হেরবো বলে ভাবনা তোমরা কেউ কর না আর।/সে যে তোমার আমার মা শুধু নয়, জগতের মা সবাকার।/ছেলের মুখে মা, মা বুলি শুনবে বলে শিবরানী/আড়াল থেকে শোনে, পাছে দেখলে যদি না ডাকে আর।” কি সুন্দর! সারা জীবন আমি ছটফট করব, আর তুমি আড়াল থেকে দেখবে। কারণ দর্শনমাত্রই আমার ডাকা বন্ধ হয়ে যাবে। তুমি একবার দেখা দিয়ে দেখ না, আমার অবস্থাটা কি হয়!
ঠাকুর আপনিই বলুন। আপনারও তো এই একই অভিমান হয়েছিল। রামপ্রসাদকে দেখা দিলি মা, আমাকে দেখা দিলি না বলে, মায়ের হাতের খড়্গা নিয়ে নিজের জীবন বলি দিতে চেয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ওই এক রোকে মায়ের দর্শন পেলেন। তারপর কি হলো আমরা সবাই জানি। টাকা মাটি হলো, মাটি টাকা হলো। আপনি পরমপুরুষ, আমি শুধুই পুরুষ। তাহলে অহৈতুকি কৃপা কথাটা কোথা থেকে এল? বৃষ্টিধারায় পৃথিবী স্নাত হয়, তার জন্যে পৃথিবীকে তো সাধনা করতে হয় না। তার সুন্দর ব্যবস্থা তো তিনিই করে রেখেছেন সৃষ্টিকালে। তিনের চার ভাগ জল করলেন আর একের চার ভাগ স্থল। সূর্যকে এনে বসালেন গ্রহরাজির মাঝখানে। স্থল যেই উত্তপ্ত হলো বাতাস উঠে গেল ওপরে। জলকণা নিয়ে বাতাস ছুটে এল জলভাগ থেকে। জলকণা উড়ে গেল মেঘের পেখম মেলে। ঊর্ধ্বাকাশের শৈত্যে জমে বিদ্যুতের স্পর্শে নেমে এল বারিধারা হয়ে। কাল থেকে কালান্তর এই আবর্তনই চলবে। বিজ্ঞানের হাতে পৃথিবীকে তুলে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত। কিন্তু আমাদের জীবন! কৃপাধারা কেন আসে না অযাচিত। আমাদের জীবনও তো সংসার-কটাহে উত্তপ্ত হচ্ছে নিয়ত, মন উড়ে যাচ্ছে বিষয় থেকে। বিষয় মনে হচ্ছে বিষ। অবিরত মন বলছে—মা তুমি কোথায়? বলছে—মন চল নিজ নিকেতনে/সংসার বিদেশে, বিদেশীর বেশে ভ্রম কেন অকারণে।/বিষয়-পঞ্চক আর ভূতগণ সব তোর পর কেউ নয় আপন।” তবু মা আসেন না। ক্ষণিকের তরেও না।
ঠাকুর আপনি বললেন : “বিড়ালের ছানা কেবল মিউ মিউ করে মাকে ডাকতে জানে। মা তাকে যেখানে রাখে, সেইখানেই থাকে—কখনো হেঁসেলে, কখনো মাটির ওপর, কখনো বা বিছানার ওপর রেখে দেয়। তার কষ্ট হলে সে কেবল মিউ মিউ করে ডাকে, আর কিছু জানে না। মা যেখানেই থাকুক, এই মিউ মিউ শব্দ শুনে এসে পড়ে।” তাই যদি হয়, তাহলে আর কবে তিনি আসবেন! অবিরতই তো মিউ মিউ করছি। আপনি বলেছিলেন, ঈশ্বর মন দেখেন। মনে-মুখে এক হতে হবে। সে পরীক্ষাও দিতে রাজি আছি। “আর কবে দেখা দিবি মা! হর মনোরমা! দিন দিন তনুক্ষীণ, ক্রমে আঁখি জ্যোতিহীন।” আরেকটা জীবনও তো চলে গেল।
মা যদি সংসারী জীবকে এলে দেন তাহলে তারা তো আরো নষ্ট হয়ে যাবে। মায়ের সংসারে মা কেন গোছাবেন না! কেন মা আমাকে শাসন করে পথে আনবেন না! জীবনের পর জীবন নষ্ট হতেই থাকবে। তারপর একজীবনে আমি মায়ের দর্শন পাব। আপনি বললেন : “তাঁকে চর্মচক্ষে দেখা যায় না। সাধনা করতে করতে একটি প্রেমের শরীর হয়—তার প্রেমের চক্ষু, প্রেমের কর্ণ। সেই চক্ষে তাঁকে দেখে, সেই কর্ণে তাঁর বাণী শুনা যায়। আবার প্রেমের লিঙ্গ যোনি হয়। এই প্রেমের শরীরে আত্মার সহিত রমণ হয়। ঈশ্বরের প্রতি খুব ভালবাসা না এলে হয় না। খুব ভালবাসা হলে তবেই তো চারিদিকে ঈশ্বরময় দেখা যায়। খুব ন্যাবা হলে তবেই চারিদিক হলদে দেখা যায়। তখন আবার ‘তিনিই আমি’ এইটি বোধ হয়।”
ঠাকুর, সবটাই আমার দিকে। আমাকে হতে হবে। মা কেন হওয়াবেন না?