কেউ পাপী নয়

কেউ পাপী নয়

শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন যে, নিজেকে ‘পাপী’ ভাবতে নেই, ক্ষুদ্র মনে করতে নেই। বলছেন: যে কেবল বলে ‘আমি পাপী’ ‘আমি পাপী’ সেই শালাই পড়ে যায়! বরং বলতে হয়, আমি তাঁর নাম করেছি, আমার আবার পাপ কি, বন্ধন কি! (১-৭-১) একদিন ঠাকুর ব্রাহ্মভক্তদের সামনে ধর্মপ্রসঙ্গ করছেন। হঠাৎ একজন বলে বসেছেন: আমি তো ঘোর পাপী, কেমন করে আমি বলব যে, ঈশ্বর আমার ভিতরে আছেন? ঠাকুর বিরক্ত হয়েছেন এই কথা শুনে, বলছেন: ঐ তোমাদের পাপ আর পাপ! এ সব বুঝি খৃষ্টানী মত? আমায় একজন একখানি বই (বাইবেল) দিলে। একটু পড়া শুনলাম; তা তাতে কেবল ঐ এক কথা—পাপ আর পাপ! (১-১২-৪) খ্রীষ্টধর্মের একটা মূল কথা হচ্ছে পাপ বোধ। খ্রীষ্টানরা বলেন আদি পাপ—original sin। অ্যাডাম আর ইভ সৃষ্টির প্রথম নর-নারী। তাঁরা স্বর্গোদ্যানে ছিলেন, সুখে ছিলেন। ভগবান বলেছিলেন: এই স্বর্গোদ্যানের সমস্ত গাছের ফল তোমরা খেতে পার—কিন্তু ঐ যে গাছটা আছে, জ্ঞানবৃক্ষ, ওটার ফল কখনও যেন খেও না। বেশ আছেন তাঁরা। ভগবান বারণ করে দিয়েছেন, কাজেই ঐ জ্ঞানবৃক্ষের ফল তাঁরা খান না। শয়তান এদিকে কু-মতলব আঁটছে। খ্ৰীষ্টধর্মে এই ‘শয়তানের’ কল্পনা আছে। হিন্দুধর্মে আমরা বলি, একই শক্তি ভাল-মন্দ, শুভ-অশুভ এই দুয়ের পিছনে। কিন্তু খ্রীষ্টধর্ম অনুযায়ী যা কিছু ভাল তার কর্তা হচ্ছেন—ভগবান। আর যা কিছু মন্দ তার কর্তা হচ্ছে—শয়তান। শয়তানের কাজ হল সবসময় ভগবান যা করতে চান তার উলটো জিনিস করা। সেই শয়তান এসে ইভকে বোঝাল: তোমরা ঐ জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাচ্ছ না—তোমরা জান না যে কি জিনিস তোমরা হারাচ্ছ। ভগবানের কথা শুনো না—খেয়ে দেখ কি সুন্দর ফল। শয়তানের প্রলোভনে প্রথমে ইভ খেলেন সেই ফলের অর্ধেকটা, তার পরে অ্যাডামকে দিলেন বাকীটা খেতে। এতদিন তাঁদের কোন দেহবুদ্ধি ছিল না, উলঙ্গ হয়ে থাকতেন। ঐ ফল খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের দেহবুদ্ধি এল, তাঁরা গাছের আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে রইলেন। ভগবান এসে ডাকছেন: অ্যাডাম, ইভ, তোমরা কোথায়? গাছের আড়াল থেকে তাঁরা সাড়া দিচ্ছেন: এই যে আমরা এখানে। ভগবান বললেন: তোমরা সামনে আসছ না কেন? তাঁরা বললেন: কি করে আসব, আমাদের পরনে যে কোন কাপড় নেই! ভগবান বললেন: অ্যাঁ! তার মানে, তোমরা নিশ্চয়ই ঐ নিষিদ্ধ ফল খেয়েছ! আমার অবাধ্য হয়েছ তোমরা! স্বর্গে তোমরা আর থাকতে পারবে না। পৃথিবীতে গিয়ে জন্মগ্রহণ কর। স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে তাঁরা পৃথিবীতে এসে জন্মালেন। —এই হচ্ছে original sin, আদি পাপ। আমরা পৃথিবীর মানুষ অ্যাডাম আর ইভের বংশধর। তাঁদের সেই যে পাপ, আমরা সবাই তার অংশীদার। আমরা সবাই পাপী। সেই পাপ থেকে আমাদের উদ্ধার করতে পারেন যীশুখ্রীষ্ট— Jesus the Christ। যীশু কথার অর্থ হচ্ছে ত্রাণকর্তা, পাপ থেকে আমাদের উদ্ধার করবার জন্য ভগবান তাঁকে পাঠিয়েছেন। ঈশ্বরের পুত্র তিনি। খ্রীষ্টানদের মতে—The only begotten son of God—একমাত্র ঈশ্বরপুত্র। তাঁকে যদি ভজনা করি, একমাত্র তাহলেই আমরা পাপ থেকে উদ্ধার পেতে পারি। এছাড়া আর কোন উপায় নেই। এই হচ্ছে খ্রীষ্টানদের মত।

হিন্দুদের দৃষ্টিটা কিন্তু অন্যরকম। হিন্দুরা বলেন: হ্যাঁ, মানুষ ভুল করে, অন্যায় করে, যেগুলোকে আমরা পাপ-কাজ বলি, মানুষ অনেক সময় তাতে লিপ্ত হয়—কিন্তু সেটা একটা সাময়িক অবস্থা। তার যে প্রকৃত স্বরূপ, সেটা হচ্ছে এই যে, সে নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত আত্মা। জ্ঞানপথে আমরা বলি সবার মধ্যে এক ব্রহ্ম, এক সচ্চিদানন্দ বিরাজ করছে। আর ভক্তিপথে আমরা বলি, সবার মধ্যে এক ভগবান বিরাজ করছেন। যে ভাষাতেই বলা হোক না কেন, মূল বক্তব্য এই যে, আমার যে বর্তমান অবস্থা, যে অবস্থায় আমার মধ্যে এত সঙ্কীর্ণতা, এত ক্ষুদ্রতা, এত সীমাবদ্ধতা—এটা আমার স্থায়ী অবস্থা নয়। এটা একটা passing phase—এই অবস্থাটা এসে গেছে, চলে যাবে দুদিন পরে। আরোপিত জিনিস একটা। যেমন আকাশ মেঘে ঢাকা। আমরা দেখছি, ধূসর আকাশ। কিছুক্ষণ পরে মেঘ কেটে যাবে, তখন আকাশের যেটা আসল রং, নীল রং—সেটা আমরা দেখতে পাব। আমাদের অবস্থাও ঠিক তাই। আমাদের যে প্রকৃত শুদ্ধ রূপ, সেটার উপরে যেন একটা আবরণ পড়েছে। কিন্তু সেই আবরণ একদিন না একদিন উঠবেই। আমি যদি চেষ্টা না করি তাহলেও উঠবে। কারণ সেটাই তো আমার স্বরূপ—সেই স্বরূপে আমি পৌঁছবই। নদীর যেমন গন্তব্যস্থল সমুদ্র, সেখানে সে পৌঁছবেই। পাহাড়-পর্বত, গ্রাম-গঞ্জ সবকিছুর মধ্যে দিয়ে পথ করে নিয়ে সে একদিন সমুদ্রে পৌছবেই—কিছুই তার গতিরোধ করতে পারবে না। আমরাও ঠিক তাই—আমাদের স্বরূপে আমরা পৌঁছবই। কেউ সোজা পথে, কেউ হয়তো অনেকটা ঘুরে-ফিরে। যদি সজ্ঞানে চেষ্টা করি, তাহলে তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারব। আর যদি চেষ্টা না করি, তাহলেও পৌঁছব—তবে একটু দেরি হবে, তার জন্য হয়তো আমাকে একটু বেশী কষ্ট সহ্য করতে হবে। স্বামীজী এই প্রসঙ্গে আলোচনা করে বলছেন যে, আমাদের সমস্ত কর্মপ্রচেষ্টার পেছনে প্রেরণা হচ্ছে এই মুক্তিলাভের ইচ্ছা। মুক্তিলাভ অর্থাৎ আমাদের যে স্বরূপ সেটা উপলব্ধি করা, আমি যে ব্ৰহ্ম সেটা বুঝতে পারা। তার প্রমাণ হচ্ছে আমরা কেউ আমাদের নিজের নিজের অবস্থায় সুখী না। একটা অভাববোধ সবসময় আমাদের ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে। ঐ অভাববোধ থেকে মুক্তি পাবার জন্য চোর চুরি করছে, যে দরিদ্র সে টাকার পেছনে ছুটছে, যে সন্ন্যাসী সে ঈশ্বরকে ডাকছে। যে চুরি করছে বা যে টাকার পেছনে ছুটছে—সে মুক্তির ঠিক পথটা খুঁজে পায়নি। তাই তার দেরি হবে একটু—কিন্তু একদিন না একদিন সেও পথ খুঁজে পাবে এবং শেষে সেই লক্ষ্যে পৌঁছবে। আর যে সন্ন্যাসী সে ঠিক পথে আছে, তাড়াতাড়ি সে তার স্বরূপে পৌঁছতে পারবে।

কাজেই, পাপ-পাপ অত করতে নেই। পাপ দূর করবার উপায় হল নিজের শুদ্ধ-স্বরূপের কথা চিন্তা করা, বাঁধন ছেঁড়ার উপায় হল মুক্তির কথা চিন্তা করা। যা আমি ভাবি, আমি তা-ই হয়ে যাই। কখন আমি অন্যায় করি? কখন আমি ভুল করি? যখন নিজেকে ঈশ্বর থেকে ভিন্ন মনে করি, যখন ‘আত্মবিস্মৃত’ হই আমি। আত্মবিস্মৃতি মানে কি? যখন আমার প্রকৃত পরিচয় ভুলে যাই। আমরা সবাই আমাদের প্রকৃত পরিচয় ভুলে গেছি। ঠাকুরের সেই যে গল্প আছে: এক সিংহের শাবক, সে ভেড়ার পালে ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছে, ভেড়ার মতোই সে ঘাস খায় আর ‘ভ্যা ভ্যা’ শব্দ করে। একদিন ভেড়ার পালে সিংহ পড়েছে। ভেড়ারা পালাচ্ছে, সিংহশিশুও ভয়ে পালাচ্ছে। তখন, যে সিংহ ভেড়াদের তাড়া করছিল, সে দেখল—আরে, এ তো দেখছি একটা সিংহ ভেড়ার সাথে ছুটে পালাচ্ছে! তখন সে সেই সিংহশিশুকে জোর করে ধরে আনল। এনে একটা পুকুরের কাছে নিয়ে গিয়ে বলল: ঐ দ্যাখ্‌, জলে ছায়া পড়েছে দ্যাখ্—তুইও যা আমিও তা। সিংহশিশু এতক্ষণ ভয়ে কাঁপছিল। কিন্তু জলের দিকে তাকিয়ে সে দেখল, তাই তো, সে-ও তো সিংহ। তৎক্ষণাৎ সে সিংহের মতো গর্জন করে লাফাতে লাফাতে জঙ্গলে চলে গেল। বস্তুত, আমরা ক্ষুদ্র হই যখন নিজেদের ক্ষুদ্র মনে করি। সিংহশিশু ততক্ষণই ভেড়ার মতো আচরণ করছিল যতক্ষণ সে নিজেকে ভেড়া মনে করছিল। আমরাও ঠিক তাই। যখন আমরা নিজেদের ছোট মনে করি, ক্ষুদ্র মনে করি, দুর্বল মনে করি—তখনই আমরা দুর্বল হয়ে যাই। স্বামীজী বলছেন: ‘The remedy for weakness is not brooding over weakness, but thinking of strength.’—দুর্বলতা দূর করবার উপায় এই নয় যে, সবসময় দুর্বলতার কথা চিন্তা করতে হবে। দুর্বলতা দূর করার উপায় হচ্ছে শক্তির কথা ভাবা, সাহসের কথা চিন্তা করা।

হ্যাঁ, আমার মনে হয়তো কখনও কখনও অত্যন্ত নীচু চিন্তা আসে। একটা ঘরেও তো হঠাৎ একটা দুর্গন্ধ ঢুকে পড়তে পারে। সেজন্য কি সেই দুর্গন্ধটা ঘরের একটা চিরকালের ধর্ম হয়ে দাঁড়াল? দুর্গন্ধ এসেছে, কেন এসেছে জানি না—একটু পরেই চলে যাবে আবার। আমার মনে সাময়িক একটা মলিনতা এসেছে কিন্তু তা চলেও যাবে আবার। তা নিয়ে অত মাথা ঘামানোর দরকার নেই। তাছাড়া, যেমন একটা মলিন চিন্তা আমার মধ্যে এসেছে, আবার তো দেখি কত উচ্চ চিন্তাও আমার মধ্যে আসে। এমন মহৎ চিন্তা আমার মধ্যে আসে যে নিজেকে তখন মানুষ বলে মনে হয় না—মনে হয় আমি যেন দেবতা হয়ে গেছি। এই যে মহৎ চিন্তাটা আমি করছি—এটা সত্য নয়? আমার পড়ে যাওয়াটা সত্য হল, আর আমি যে ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালাম সেটা সত্য না? একটাকে যদি স্বীকার করি, আর একটাকেও তো তাহলে স্বীকার করতে হয়। আমাদের শাস্ত্র, আমাদের সমস্ত ধর্মগ্রন্থ বলছে যে, এই যে তুমি উঠে দাঁড়াচ্ছ, এই যে তুমি উচ্চ চিন্তা করছ—এটাই বড় সত্য। তুমি এইটা বিশ্বাস কর। বিশ্বাস কর যে, তুমি আরও বড় হতে পার, বড় হতে হতে তুমি অসীম হয়ে যেতে পার, মহৎ হতে হতে তুমি মহত্তম হতে পার, উঁচুতে উঠতে উঠতে তুমি উচ্চতম পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পার। তোমার মধ্যে সাময়িক একটা অপবিত্রতা এসেছে—তার মানেই এই নয় যে তুমি অপবিত্র। অপবিত্রতাটা যেন একটা পোশাক, একটা আবরণ। তোমার পোশাকটার হয়ত রং চটে গেছে, দেখতে খারাপ হয়ে গেছে—তার মানে এই নয় যে, তুমি দেখতে খারাপ। পোশাকটা তুমি খুলে ফেল, তাহলেই দেখবে, তুমি যা তুমি তা-ই আছ। তুমি নির্মল, তুমি শুচি, তুমি চির-সুন্দর। আমাদের উপনিষদে বলছে: ‘শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্ৰা আ যে ধামানি দিব্যানি তস্থূঃ’—সমস্ত বিশ্বে যারা আছ, তোমরা অমৃতের সন্তান সবাই—তোমরা শোন আমার কথা। ‘অমৃতের সন্তান’ বলছেন সবাইকে! স্বামীজী বিদেশে গিয়ে সেখানকার লোকদের সম্বোধন করছেন: Children of Immortal Bliss—অমৃতের পুত্র তোমরা। বলছেন: পাপী তোমরা? কে বলল তোমরা পাপী? মানুষকে পাপী বলাই সবচেয়ে বড় পাপ। ‘Sinners! It is a sin to call a man so.’ আমি তোমাদের কিছুতেই ‘পাপী’ বলব না—আমি বলব তোমরা ‘অমৃতের সন্তান’। আর যাঁরা তাঁর কথা শুনছেন তাঁরা ভাবছেন: এ একটা নতুন অভিজ্ঞতা, একটা যেন মুক্তির আস্বাদ পেলাম আমরা, যেই ভাবলাম যে আমরা পাপী নই।

স্বামীজী বলছেন: ‘Vedanta believes in only one sin, only one in the world, and it is this: the moment you think you are a sinner or anybody is a sinner, that is sin.’—বেদান্ত শুধু একটিমাত্র পাপ স্বীকার করে। সেটা কি? নিজেকে ‘পাপী’ ভাবা বা অন্য কাউকে ‘পাপী’ মনে করা—কারণ, ‘From that follows evey other mistake or what is usually called sin.’—অন্য যা কিছু ভুল আমরা করি বা প্রচলিত অর্থে যাকে আমরা ‘পাপ’ বলি সেগুলি এ থেকেই আসছে। স্বামীজী বলছেন: তুমি হয়তো তোমার জীবনে অনেক ভুল করেছ, কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামিও না। ‘Take a long look at your past life.’ অতীতের দিকে অনেক দূর ফিরে তাকাও। ‘If your present condition is good, it has been caused by all the past mistakes as well as successes.’ যদি দেখ তোমার বর্তমান খুব সুন্দর তাহলে জানবে এই সুন্দর বর্তমানের মূলে তোমার অতীত সাফল্য এবং ব্যর্থতা দুই-ই রয়েছে। —আমাদের জীবনে ভুলভ্রান্তিরও বিরাট ভূমিকা আছে। ভুলভ্রান্তি থেকেও আমরা শিক্ষালাভ করি। স্বামীজী তাই বলছেন: ‘Glory be unto success! Glory be unto mistakes!’ সাফল্যের জয় হোক। ভুলভ্রান্তি ব্যর্থতা—তারও জয় হোক। ‘Do not look back upon what has been done.’ —যা হয়ে গেছে তা নিয়ে মাথা ঘামিও না। ‘Go ahead!’ —এগিয়ে চল, চরৈবেতি।

আর একটা বড় সুন্দর কথা বলেছেন স্বামীজী। বলছেন: তোমরা আদিপাপের কথা বল। আদম আর ইভ ঈশ্বরের অবাধ্য হয়ে স্বর্গচ্যুত হলেন এই পাপটাকেই তোমরা ধরছ। কিন্তু তারও আগে আছে যে ‘আদি পুণ্য’, এই পাপ করার আগে যে-অবস্থায় ছিলেন তাঁরা, সেটাকে কেন নিচ্ছ না তোমরা? তাঁরা পাপ করলেন সেটাকেই অত গুরুত্ব দিচ্ছ, কিন্তু তার আগে পর্যন্ত তো তাঁরা শুদ্ধ ছিলেন, নিস্পাপ ছিলেন—সেটাই তো আদি-অবস্থা—সেটাকে তোমরা গুরুত্ব দিচ্ছ না কেন? বলছেন: ‘Be not deluded by your religion teaching original sin, for the same religion teaches original purity. When Adam fell, he fell from purity. Purity is our real nature, and to regain that is the object of all religion.’ স্বামীজী একটা কথা বারবার করে বলতেন যে, মানুষের মধ্যেই পূর্ণতা রয়েছে, সেই পূর্ণতার বিকাশ করার নামই হচ্ছে শিক্ষা। ‘Education is the manifestation of the perfection already in man.’ আর ধর্মের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে স্বামীজী বলছেন যে মানুষের মধ্যে দেবত্ব রয়েছে, সেই দেবত্বের বিকাশসাধনের নামই ধর্ম। Religion is the manifestation of the Divinity already in man.’ সেই দিক দিয়ে দেখতে গেলে শিক্ষা এবং ধর্ম সমার্থক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পূর্ণতা আর দেবত্ব—একই জিনিসকে দুরকমভাবে বোঝাচ্ছেন স্বামীজী। প্রকৃত শিক্ষক কি করবে? সে কখনো ছাত্রকে বলবে না যে, তোমার দ্বারা কিছু হবে না। বরং বলবে যে, হ্যাঁ, তুমিও পারবে, তোমার মধ্যে অনন্ত শক্তি রয়েছে। সেই শক্তিটা ঢাকা পড়ে আছে শুধু। স্বামীজী বলছেন; কেউ কাউকে শেখাতে পারে না। শিক্ষক যেন মনে না করে যে সে তার ছাত্রকে কিছু শেখাচ্ছে। পূর্ণতা ছাত্রের ভিতরেই রয়েছে। শিক্ষকের কাজ শুধু সেই পূর্ণতার বিকাশের পথে যে বাধা রয়েছে তাকে দূর করে দেওয়া। এই পূর্ণতারই আর এক নাম দেবত্ব, আর এই যে পাপ বলছি, অন্যায় বলছি, মলিনতা বলছি—সেই দেবত্বের বিকাশের পথে এগুলি সব বাধা। যিনি প্রকৃত ধর্মগুরু, তিনি আমার মলিনতার জন্য, আমার অন্যায়ের জন্য, আমাকে দূরে সরিয়ে রাখেন না। আমাকে তিনি কাছে টেনে নেন, আমার মধ্যে বেশী মলিনতা, তাই আমার প্রতি তাঁর বেশী সহানুভূতি। আমার সেই মলিনতা দূর করে আমার অন্তর্নিহিত দেবত্ব বিকাশে তিনি সাহায্য করেন। আমার মধ্যে যে দেবত্ব আছে, তার সম্বন্ধে তিনি আমাকে সচেতন করে দেন। আমরা উপনিষদে দেখি: তত্ত্বমসি শ্বেতকেতো—শ্বেতকেতু, তুমিই সেই। ওঠো, জাগো তুমি। তোমার স্ব-স্বরূপে তুমি প্রতিষ্ঠিত হও। নিজের দৈবী স্বরূপকে উপলব্ধি কর। তুমি হয়তো তোমার অতীত আর বর্তমানকে দেখে নিজেকে অপদার্থ মনে করছ। কিন্তু তুমি অপদার্থ নও, কেউ অপদার্থ নয়। সবাই ইচ্ছে করলে পারে নিজেকে সুন্দর করতে, নিজের যে শুদ্ধ স্বরূপ তাতে উপনীত হতে।

স্বামীজী বলছেন: খুব নিষ্ঠুর অপরাধী, সেও যখন তার শিশুপুত্রকে আদর করে, তার মুখে স্নেহ-ভালবাসার ছবি ফুটে ওঠে। ঐ স্নেহ-ভালবাসা তাহলে তার মধ্যেই রয়েছে, বাইরে থেকে তো আসেনি। বাইরে থেকে কোন জিনিস আসতে পারে না। হয়তো তার উপর নিষ্ঠুরতার একটা সাময়িক আবরণ পড়েছে। সেই আবরণ যতই গভীর হোক না কেন একদিন না একদিন সেই আবরণ দূর হতে পারে, একদিন না একদিন সে হয়তো সৎ হবে, সুন্দর হবে—তার জীবনের গতি পালটে যাবে। আমরা শুনি, দস্যুরাজ রত্নাকর—তিনি বাল্মীকি হয়ে গেলেন। অঙ্গুলিমালের ঘটনা শুনি আমরা। ভয়ঙ্কর নরঘাতক। একের পর এক নবহত্যা করে যাচ্ছে আর নিহত লোকগুলির আঙুল দিয়ে মালা করে গলায় পরে রয়েছে। তাই তার নাম হয়েছে অঙ্গুলিমাল। কেউ তাকে দমন করতে পারছে না, রাজাও না। শেষে বুদ্ধদেব গেলেন তার কাছে। বুদ্ধদেব গিয়ে তাকে কৃপা করলেন, তার জীবন রূপান্তরিত হয়ে গেল—সন্ন্যাসী হয়ে গেল সে। এইরকম ঘটনা কত ঘটে। চিরদিন মানুষ একরকম থাকে না। আজ যে খারাপ কাল সে ভাল হয়ে যেতে পারে, আজ যাকে দেখছি দুর্বল, হীনবীর্য—কালই হয়তো দেখব সে সব দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। এক মুহূর্তে মানুষের জীবনের গতি ওলট-পালট হয়ে যেতে পারে, হয়ে যায়ও। একটা কথা, একটা ঘটনা, একটা গান—সামান্য একটা উদ্দীপন, অন্যের কাছে তা সামান্য, কিন্তু আমার কাছে তা-ই হয়ত অসামান্য হয়ে দাঁড়াল—আমার মধ্যে যে ঘুমন্ত দেবত্ব আছে, তাকে হয়তো তা জাগিয়ে দিল, সেই মুহূর্ত থেকে আমি রূপান্তরিত হয়ে গেলাম, নতুন মানুষ হয়ে গেলাম আমি। লালাবাবু পালকি করে যাচ্ছিলেন, যেতে যেতে শুনলেন ধোপার মেয়ে তার বাবাকে বলছে: বাবা, বেলা যে পড়ে এল, ‘বাস্‌নায়’ আগুন দেবে না? বাস্‌না হচ্ছে শুকনো কলাপাতা। লালাবাবু ভাবলেন: তাই তো, আমারও তো বেলা শেষ হয়ে গেল, দিন ফুরিয়ে এল, আমি তো এখনও আমার কামনাবাসনায় আগুন দিলাম না? ব্যস্, পালকি থেকে নেমে তিনি সংসার ত্যাগ করে চলে গেলেন। এরকম হয়ে থাকে। এ যেন নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ। একটা জলস্রোতের মুখে বহুদিন ধরে একটা পাথর চাপা ছিল। কেউ সেই পাথরটা তুলে নিল—জলস্রোত মুক্ত হয়ে চলতে লাগল। এও যেন ঠিক তাই। কে যেন আমার উপর থেকে আবরণটা সরিয়ে নিল, আমার যে ‘প্রকৃত আমি’ তাঁকে চিনতে পারলাম, আমার জীবনটার মোড় ঘুরে গেল—আমি অন্যরকম হয়ে গেলাম। আমি অসৎ ছিলাম—সৎ হয়ে গেলাম, নিষ্ঠুর ছিলাম—প্রেমিক হয়ে গেলাম, ছিলাম ঘোর স্বার্থপর, এখন আমি এমন হয়েছি যে পরের জন্য প্রাণ দিতে পর্যন্ত কুণ্ঠিত হই না। ঠাকুর একটি গল্প বলতেন: এক চোর রাত্রে চুরি করতে গেছে, গিয়ে ধরা পড়ে পড়ে অবস্থা। লোকজন তার পিছু নিয়েছে। তখন সে আর কি করে? গায়ে ছাই-টাই মেখে সাধু সেজে বসে রইল। গ্রামের লোকেরা তাকে চিনতে পারল না। রটে গেল যে, বিরাট এক সাধু এসেছে গ্রামে। দলে দলে লোক এসে তাকে প্রণাম করছে, ফল-মূল নিয়ে আসছে—আরও কতভাবে ভক্তি-শ্রদ্ধা করছে। তখন সে মনে মনে ভাবল: আমি কপট সাধু, তাতেই এত সম্মান পাচ্ছি। যদি সত্যি সত্যি সাধু হই, তাহলে না জানি আরও কত সম্মান পাব। সত্যি সত্যিই সাধু হয়ে গেল সে। গেছিল চুরি করতে, কিন্তু সাধু হয়ে গেল। পওহারীবাবার বাড়িতে যে-চোর চুরি করতে এসেছিল, তার জীবনে কিন্তু এরকমই ঘটেছিল। রাত্রি বেলা সে ঢুকেছে পওহারীবাবার ঘরে। জিনিসপত্র চুরি করে সে যখন পালাচ্ছে পওহারীবাবা জেগে উঠেছেন। আর সেই চোর ভয় পেয়ে জিনিসপত্র ফেলে রেখে পালিয়েছে। এদিকে পওহারীবাবা কিন্তু ঐ জিনিসপত্র নিয়ে চোরের পিছন পিছন ছুটছেন আর বলছেন: প্রভু, তুমি কৃপা করে এসেছিলে আমার ঘরে, তুমি কেন এগুলি ফেলে রেখে চলে গেলে? পওহারীবাবার দৃষ্টিতে সে চোর নয়, তাঁর ইষ্ট, স্বয়ং ভগবান। অনেক দূরে গিয়ে সেই চোরকে ধরলেন তিনি, তার হাতে সেসব জিনিস গছিয়ে দিয়ে তারপর নিশ্চিন্ত হলেন। এদিকে পওহারীবাবার এইরকম ব্যবহার দেখে চোরের মনে অনুতাপ এল। সেদিন থেকে সে চুরি করা ছেড়ে দিল, সাধু হয়ে গেল সে। স্বামীজী যখন পরিব্রাজক জীবনে হিমালয়ে ঘুরছিলেন, তখন সেই সাধুর সাথে দেখা হয়েছিল তাঁর। প্রথমে জানতেন না স্বামীজী তাঁকে। তাঁর সৌম্যমূর্তি দেখে স্বামীজীর মনে হয়েছিল যে, তিনি খুব উন্নত ধরনের সাধু। তারপর কথাবার্তা বলতে বলতে যখন তিনি জানলেন যে এই সেই ব্যক্তি যে পওহারীবাবার ঘরে চুরি করতে গেছিল, তখন খুব অবাক হয়ে গেলেন স্বামীজী। অনেক রাত পর্যন্ত স্বামীজী তাঁর সঙ্গে কথা বললেন। কথাবার্তা বলে স্বামীজী নিশ্চিত হলেন যে, তিনি সত্যি সত্যিই আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে অনেকদূর এগিয়ে গেছেন—খুবই উন্নত ধরনের মানুষ তিনি।

পরবর্তীকালে সেইজন্যই স্বামীজী বলতেন যে, পাপীদের মধ্যেও সাধুত্বের বীজ লুকিয়ে থাকে। একটা কথা প্রচলিত আছে: ‘No saint without a past, no sinner without a future.’ সাধুরও একটা অতীত আছে, আর যে পাপী তারও ভবিষ্যৎ আছে। আমরা কত মহাপুরুষের জীবনী পাই, যাঁদের অতীতে কত দুর্বলতা ছিল—সবকিছু অতিক্রম করে তাঁরা শেষ পর্যন্ত সকলের আদর্শস্থানীয় পুরুষ হয়েছেন, অতীতের সব কালিমা দূর করে তাঁরা জ্যোতির রাজ্যে পৌঁছেছেন, জ্যোতির্ময় হয়েছেন, শুদ্ধ, পবিত্র হয়েছেন, মহৎ হয়েছেন, সাধু হয়েছেন। আবার আজকে যাকে দেখছি খারাপ, কাল সে ভাল হয়ে যায়। আমাদের শাস্ত্রেও সেইজন্য দেখছি কত সব আশার কথা। গীতাতে ভগবান বলছেন: ‘অপি চেৎ সুদুরাচারো ভজতে মামনন্যভাক্ সাধুরেব স মন্তব্যঃ’—অত্যন্ত দুরাচারী, সে-ও যদি অনন্যভাবে আমাকে ভজনা করে, তবে তাকে সাধুই মনে করতে হবে। আবার বলছেন: ‘সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ। অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।’ সবকিছু পরিত্যাগ করে তুমি একান্তভাকে আমারই শরণাগত হও, আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করে দেব। বৃহদ্বিষ্ণুপুরাণে বলছে:১০ ‘নাম্নোহস্য যাবতী শক্তিঃ পাপনিৰ্হরণে হরেঃ। তাবৎ কর্তুং ন শক্লোতি পাতকং পাতকী জনঃ’—হরিনাম করলে যতটা পাপ ক্ষয় হয়, ততটা পাপ করার ক্ষমতা সবচেয়ে যে পাপী, তারও নেই। আর একটা শ্লোকে বলছে: মহাপাতকযুক্তোহপি ধ্যায়ন্ নিমিষম্ অচ্যুতম্ পুনস্তপস্বীভবতি।’—মহাপাতক, সে-ও যদি একবার ভগবানের কথা স্মরণ করে, তাহলে সে আবার তপস্বী হয়ে যায়, সমস্ত পাপ তার ধুয়ে মুছে যায়। রামপ্রসাদ গাইছেন: কালী নামে পাপ কোথা, মাথা নাই তার মাথাব্যথা। অনলে দাহন যথা, হয় রে তুলারাশি—কালীনাম করেছি, আর তো দেখতে পাচ্ছি না, যে আমার মধ্যে কোন পাপ আছে। কি করে থাকবে? মাথাই নেই তার আবার মাথাব্যথা? যিনি সমস্ত পাপ দূর করে দেন, তাঁর নাম আমি করেছি—পাপ আর থাকবে কি করে? আগুন যেমন এক নিমেষে রাশি রাশি তুলো পুড়িয়ে ফেলতে পারে, তেমনি ভগবানের নাম করলে পুঞ্জীকৃত পাপ এক মুহূর্তে দূর হয়ে যায়। আবার গাইছেন রামপ্রসাদ:

আমি ‘দুর্গা’ ‘দুর্গা’ বলে মা যদি মরি।

আখেরে এ দীনে, না তার কেমনে, জানা যাবে গো শঙ্করী।।

নাশি গো ব্রাহ্মণ, হত্যা করি ভ্রূণ, সুরাপান আদি বিনাশি নারী।

এসব পাতক, না ভাবি তিলেক, ব্রহ্মপদ নিতে পারি।।

—মা, আমি হয়তো অত্যন্ত গর্হিত সব কাজ করেছি, তবুও আমার কোন ভয় নেই, আমি ঠিক উদ্ধার হয়ে যাব—যদি একান্তভাবে তোমাকে স্মরণ করতে করতে আমি প্রাণত্যাগ করি। এসব কথা বলছেন মানুষের মনে আশা জাগানোর জন্য। অন্যায় করতে প্রশ্রয় দিচ্ছেন না। শুধু বলছেন: যদি তুমি অন্যায় করেও থাক, তাহলেও মনে কোরো না যে তোমার আর কোন আশা নেই। আশা আছে তোমার। সবসময় তোমার সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। Never too late. তুমি এটা বিশ্বাস কর। প্রতিজ্ঞা কর যে, যা করেছ তা আর করবে না। নিজেকে বিশ্বাস কর, ঈশ্বরে বিশ্বাস কর। এইবার তুমি মাথা উঁচু করে পথ চল। হয়তো তার পরেও দু-চার বার পড়বে তুমি। তাতে কি হয়েছে? একটা দীর্ঘ পথে চলেছি আমি—দু-চার বার হোঁচট খাব না? হোঁচট তো খাবই! কিন্তু আবার উঠব আমি। আবার চলব। এগিয়ে যাব।

স্বামীজী বলতেন:১১ সবসময় কাউকে তার ভুল-ত্রুটির কথা মনে করিয়ে দিলে তার ক্ষতি করা হয়। যেসব বাবা-মা ছেলেমেয়েদের বলে ‘এটার কিছু হবে না—বোকা, গাধা’—সেই ছেলেমেয়েরা অনেক সময় সেরকমই হয়ে যায়। আর যদি ছেলেমেয়েদের উৎসাহ দেওয়া হয়, ভাল বলা হয়—তাহলে সত্যি সত্যিই তারা ভাল হয়। কারণ, Negative thought মানুষকে weak ক’রে দেয়। Positive ideas দিতে পারলে সাধারণ মানুষ হয়ে উঠবে ও নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখবে।’ ঠাকুরের উদাহরণ দিয়ে বলছেন:১২ ‘যাদের আমরা হেয় মনে করতুম, তাদেরও তিনি উৎসাহ দিয়ে জীবনের মতি-গতি ফিরিয়ে দিতেন।’ কাজেই, নেতিবাচক জিনিসটার দিকে অত জোর দিতে নেই—ইতিবাচক কিছু আছে কিনা দেখতে হয়। ঠাকুর তাই বলছেন: তোমাদের কেবল পাপ, পাপ, পাপ! পাপের কথা এত বল কেন তোমরা? ঈশ্বরের কথা বল। বলছেন: হাততালি দিলে যেমন পাখিরা গাছ থেকে উড়ে যায়, তেমনি হরিনাম করলে দেহবৃক্ষ থেকে পাপ-পাখিরা সব উড়ে যায়। যীশুখ্রীষ্টের জীবনে একটা ঘটনা আছে। এক মহিলাকে অনেক লোক তাড়া করেছে। মহিলাটি দুশ্চরিত্রা, তাই সবাই তাকে শাস্তি দেবে, ঢিল ছুঁড়ে মারবে তাকে। যীশু দেখলেন এই দৃশ্য। দেখে বললেন: থাম। তোমাদের মধ্যে যে জীবনে কোন দিন কোন অন্যায় করনি, সে প্রথম ঢিলটি ছুড়বে। সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। এমন কেউ নেই সেখানে যে কোন দিন কোন অন্যায় করেনি। যীশু তখন তাদের চলে যেতে বললেন আর সেই মহিলাকে দু-একটা সদুপদেশ দিয়ে বিদায় দিলেন। ধর্ম বা ধর্মগুরু—তাঁরা এই করেন। মানুষকে ক্ষমা করেন। ক্ষমা করেন অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে নয়, মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।

আমাকে একজন প্রশ্ন করেছিলেন: সর্বভূতে তো ঈশ্বর আছেন, স্বামীজী বললেন, God the wicked, God the sinner—দুষ্ট নারায়ণ, পাপী নারায়ণ। এই যদি হয়, তাহলে আমার বাড়িতে একজন চোর এসে আমার চোখের সামনেই যদি চুরি করে, তাহলে তাকে ছেড়ে দেব কি? কারণ, সে তো নারায়ণ। নারায়ণকে আর পুলিশে দিতে যাব কেন? পওহারীবাবা যেমন চোরের হাতে গিয়ে জিনিসপত্র দিয়ে এসেছিলেন, আমিও সেরকম করব নাকি? চোরের কাজে আমি কি সাহায্য করব? —এই প্রশ্ন। এটা মনে রাখতে হবে যে, পওহারীবাবা যা করতে পারেন, আমরা সাধারণ লোক তা পারি না। পওহারীবাবা সিদ্ধপুরুষ, সর্বভূতে তিনি ঈশ্বর দর্শন করছেন—তাঁর কাছে চোর চোর নয়, নারায়ণ। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিতে তো চোর চোরই। আমরা জোর করে বলতে পারি, চোর নয়, নারায়ণ। কিন্তু সেটা কথার কথা হয়ে যাবে আমাদের ক্ষেত্রে। আমাদের জন্য ঠাকুরের সেই মাহুত-নারায়ণ আর হাতী-নারায়ণের গল্পটা। এক সাধুকে তার গুরুদেব শিখিয়ে দিয়েছেন: সব নারায়ণ। এর পরদিনই সে পাগলা হাতীর মুখে গিয়ে পড়েছে। মাহুত বলছে: পালাও, পালাও। কিন্তু সে সরছে না। সদ্য সদ্য সে যা শিখেছে, তাই সে প্রয়োগ করে ছাড়বে। হাতীকে জোড়হাতে প্রণাম করছে: হে প্রভু, হে নারায়ণ। আর হাতী এসে তাকে শুঁড়ে জড়িয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। একেবারে ক্ষতবিক্ষত অবস্থা। ধরাধরি করে তাকে আশ্রমে নিয়ে আসা হল। গুরুদেব সব শুনে বললেন: বাপু, হাতীর মধ্যেই তুমি শুধু নারায়ণ দেখলে, মাহুতের ভিতরে যে নারায়ণ আছে সেটা তুমি বুঝলে না? মাহুত-নারায়ণ তো তোমাকে পালিয়ে যেতে বলেছিল, তার কথা শুনলে না কেন তুমি? বাস্তবিক, ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ‘মাহুত-নারায়ণ’ আর ‘হাতী-নারায়ণে’র মধ্যে তফাতটা রাখতে হয়। সবাই নারায়ণ, সবার মধ্যেই এক তিনি—সাধুর মধ্যেও যেমন, অসাধুর মধ্যেও তেমন। কিন্তু সাধুর সঙ্গে যে ব্যবহার চলে অসাধুর সঙ্গে সেই ব্যবহার চলে না। ঠাকুর বলছেন: ‘আপো নারায়ণঃ’—জল নারায়ণ। ঠিক। কিন্তু কোন জলে পুজো হয়, কোন জল খাওয়া চলে, আবার কোন জলে শুধু পা ধোওয়া চলে। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তফাতটা রাখতেই হবে। না হলে সমাজ চলবে না, সভ্যতা চলবে না, সৃষ্টি চলবে না।

প্রথমত আমি চেষ্টা করব চোর যাতে আমার জিনিসপত্র চুরি করতে না পারে। এই নয় যে, আমার জিনিসপত্র সব আলগা রাখব—কারণ সব তো নারায়ণ—কে আর নেবে? তা নয়, সাবধানে থাকব, কেউ যাতে চুরি করতে না পারে দেখব। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন: ‘ভক্ত হবি তো বোকা হবি কেন?’ কী অদ্ভুত কথা! ছোট্ট কথা—কিন্তু খুব ব্যবহারিক তাৎপর্য আছে। আমি ভক্ত, তার মানে এই নয় যে সবাই ভক্ত। যারা অসৎ তাদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা আমাকে রাখতে হবে। তাছাড়া, আমার জিনিসপত্র যদি আমি যথেষ্ট সাবধানে না রাখি, তাহলে আমি অনেক সময় অন্যের ক্ষতিও করে থাকি। আমার ঘরে টাকা-পয়সা আমি তালা চাবি না দিয়ে রেখে দিয়েছি—একজন তা জানতে পেরে সুযোগ বুঝে সেই টাকা নিয়ে গেল। সে নিশ্চয়ই অন্যায় করল—কিন্তু তাকে এই অন্যায় করতে আমিও তো একটু সাহায্য করেছি। আমিই তো টাকা-পয়সা অরক্ষিত অবস্থায় রেখে তাকে প্রলুব্ধ করেছি। স্বামীজী আর হরি মহারাজ (স্বামী তুরীয়ানন্দ) জাহাজে করে আমেরিকা যাচ্ছেন। হরি মহারাজ তাঁর কেবিনের দরজা খুলে বাইরে গেছেন, হয়তো সমুদ্র দেখছেন। স্বামীজী এসে দেখেন যে, হরি মহারাজের দামী ঘড়ি পড়ে আছে টেবিলের উপরে—একদম অরক্ষিত অবস্থায়। স্বামীজী খুব অসন্তুষ্ট হলেন। হরি মহারাজকে ডেকে বললেন: হরিভাই, তোমার কোন্ অধিকার আছে মানুষকে এইভাবে প্রলুব্ধ করার? গরীব মানুষ এরা। এরা এখানে ঘোরাফেরা করছে, তাদের চোখের সামনে এরকম একটা দামী জিনিস তুমি ফেলে রেখেছ? এরা প্রলুব্ধ হবে। এদের কেউ যদি এটা তুলে নিয়ে যায়, তাহলে তাকে আমি কোন দোষ দেব না। সে তো আর সাধু নয়। ধরা পড়বার ভয় যদি না থাকে, তাহলে সে কেন চুরি করবে না? সেটাই তো স্বাভাবিক।১৩ —কাজেই, প্রথমত আমাদের সাবধানে থাকতে হবে, যাতে সে চুরি করতে না পারে। আমার আচরণ যেন অন্যের মধ্যে যে দুর্বলতা আছে সেটাকে উদ্দীপিত করতে না পারে। এটাও আমার কর্তব্য। যে দুর্বল, যে অন্যায়-প্রবণ—তার প্রতি এটাও আমার কর্তব্য। কিন্তু তার পরেও সে যদি চুরি করে বা কোন একটা অন্যায় করে—তবে নিশ্চয়ই তাকে আমি শাস্তি দেব, দুষ্ট-নারায়ণের সঙ্গে দুষ্ট ব্যবহারই করব। তবে সঙ্গে সঙ্গে এই তত্ত্বটাও মনে রাখব যে, সে-ও নারায়ণ। তার মধ্যেও সেই দেবত্ব বা ব্রহ্মত্ব সুপ্ত আছে। উপযুক্ত সুযোগ পেলে, উপযুক্ত সময় পেলে সে সেই দেবত্বকে পরিস্ফুট করতে পারে। এবং যদি আমার সাধ্যের মধ্যে তার জন্য করবার মতো কিছু থাকে—তাহলে যথাসাধ্য চেষ্টা করব, সে যাতে ভাল হয়, সে যাতে সুন্দর হয়। আর যদি আমার করণীয় কিছুই না থাকে, তার জন্য অন্তত ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব আমি। কোন অবস্থাতেই তাকে আমি ঘৃণা করব না। না, তা করতে পারি না আমি। তার মধ্যে যে নারায়ণ আছেন, যে নারায়ণ তার প্রকৃত স্বরূপ—তাঁকে আমি কখনই অসম্মান করতে পারি না।

ভিকটর হুগো-র Les Miserables-এ জা ভালজাঁর চরিত্র আছে। অত্যন্ত দরিদ্র। ঘরে তার বিধবা বোনের ছেলেমেয়েরা রয়েছে, খেতে পাচ্ছে না—সকাল থেকে উঠে চিৎকার করছে: খেতে দাও, খেতে দাও। সে কি করবে? তার হাতে কোন পয়সা নেই, কোন কাজ সে পাচ্ছে না। রাস্তায় বেরিয়ে হঠাৎ সে দেখল তার সামনে একটা দোকানে গরম গরম রুটি সাজানো রয়েছে। সে গিয়ে একটা তুলে নিল—ধরা পড়ল। শাস্তি হল তার। দুরে এক জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হল তাকে। —সেখানে গিয়ে দাঁড় টানতে হবে জাহাজের। কতদিন ধরে সে দাঁড় টানছে এইভাবে, একদিন পালাবার চেষ্টা করল, আবার ধরা পড়ল, আরও শাস্তি বেড়ে গেল। আবার পালাবার চেষ্টা করল, আবার ধরা পড়ল, শাস্তি আরও বেড়ে গেল। এইভাবে উনিশ বছর কাটানোর পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হল। বাইরে সবাই জেনে গেছে: একজন মারাত্মক অপরাধী ছাড়া পেয়েছে, সবাই সাবধান। সবাই তাকে দেখে ভয় পাচ্ছে। কোন সরাইখানায় তাকে ঢুকতে দিচ্ছে না, কোন বাড়িতে গেলে মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে। অত্যন্ত ক্লান্ত সে, ক্ষুধার্ত। সব জায়গায় বিতাড়িত হয়ে শেষে একজন বিশপের কাছে সে আশ্রয় পেল। বিশপ তার সম্বন্ধে সব জানতেন। তবুও তিনি তাকে যত্ন করে খেতে দিলেন, ভাল ঘরে শুতে দিলেন। কিন্তু রাত্রিবেলায় সে ঐ বিশপের ঘর থেকেই একটা জিনিস চুরি করে পালিয়ে গেল। পরদিন সে ধরা পড়ল। কয়েকজন লোক তাকে ধরে বিশপের কাছে নিয়ে এল। কিন্তু বিশপ তাকে বাঁচিয়ে দিলেন, বললেন: ও তো এটা চুরি করেনি। ও গরিব, তাই আমি নিজেই ওকে এটা দিয়েছি। এই ঘটনায় তার জীবনের মোড় ঘুরে গেল। অপরাধী ছিলেন, মহৎ মানুষ হয়ে গেলেন তিনি। তাঁর আর্থিক অবস্থাও ভাল হল। প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন—কিন্তু সব অর্থ অন্যকে দিয়ে দেন। লুকিয়ে লুকিয়ে গরিব-দুঃখীদের বাড়িতে গিয়ে টাকা-পয়সা রেখে আসেন। সকলের উপকার করে বেড়ান। শহরের সবাই তাঁকে ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে। শেষে তাঁকে সেই শহরের ‘মেয়র’ করে দিল তারা। —মানুষের জীবনেই এরকম রূপান্তর সম্ভব। আজকাল আমরা দেখতে পাই, বিভিন্ন দেশে আইন কত উদার হয়ে গেছে। একজন হয়তো প্রচুর অপরাধ করছে— অনেক সময় তাকে মনস্তাত্ত্বিকদের কাছে পাঠানো হয়। অর্থাৎ এই যে সে অপরাধ করছে—এ অপরাধ নয়, একটা ব্যাধি। ব্যাধিগ্রস্ত লোককে আমরা যেমন সহানুভূতি সহকারে দেখি, ব্যাধির নিরাময়ের জন্য চেষ্টা করি—এও ঠিক তাই। অপরাধীকে ভালবাসা হয়, স্নেহ দেওয়া হয়, সে যাতে তার অতীতটাকে মুছে ফেলতে পারে তার সুযোগ দেওয়া হয়। আমরা একটা কথা শুনি যে, পাপকে ঘৃণা কর, পাপীকে নয়। এ সব কিছুর পিছনে কিন্তু ঐ একই দৃষ্টিভঙ্গি যে, মানুষের বর্তমান বা অতীতটাই সব নয়। মানুষের একটা সুন্দর সত্তা রয়েছে। মানুষ চেষ্টা করলে, ঠিকমতো সুযোগ পেলে—সেই সুন্দর সত্তাকে বিকশিত করতে পারে। কোন বাধাই দুরতিক্রম্য নয়। প্রবল্ ইচ্ছাশক্তি থাকলে কি করে যেন সব বাধা সহজ হয়ে আসে। অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলে মানুষ। কাজেই, কাউকে বলতে নেই: অপদার্থ, তোমার দ্বারা কিছু হবে না। স্বামীজী একদম পছন্দ করতেন না এ ধরনের কথা। কাউকে যদি বারবার সবাই বলে যে ‘তুমি খারাপ’— তাহলে সে সত্যি সত্যিই ভাবতে শুরু করে যে সে খারাপ। আমরা যে hypnotism বা সম্মোহনের কথা শুনি— এও যেন ঠিক তাই! স্বামীজী সেইজন্যই বলেছেন: লোককে পাপী বলাই মহাপাপ। কারণ, পাপী বলতে বলতে আমি তাকে ভাবতে বাধ্য করি যে, সে পাপী। এর থেকে চরম অনিষ্ট মানুষের আর কিছুতেই হতে পারে না। স্বামীজী সেই প্যাট-এর গল্প বলছেন। প্যাট একজন আইরিশ যুবক। তার নিজের দেশে সবাই তাকে সব সময় বলেছে: প্যাট, তোর কোন আশা নেই, তুই জন্মেছিস গোলাম, থাকবি গোলাম। দিনরাত সবার কাছে এই কথা শুনতে শুনতে প্যাট-এর ধারণা হল সত্যিই বুঝি সে তাই। স্বামীজী বলছেন: এইভাবে প্যাট-এর ভিতরে যে ব্ৰহ্ম আছেন, তিনি সঙ্কুচিত হয়ে গেলেন। তারপর সেই প্যাট এল আমেরিকায়। প্রথম প্রথম তার দৃষ্টিতে ভয়, চালচলনে আড়ষ্টতা। ধীরে ধীরে সে দেখল, এ এক আলাদা জগৎ। এখানকার সমস্ত পরিবেশ যেন তাকে বলছে: প্যাট, তুইও মানুষ, আমরাও মানুষ, মানুষেই তো সব করেছে। তুইও ইচ্ছা করলে অনেক কিছু করতে পারিস। কয়েকদিন পরেই দেখা গেল, প্যাট-এর চালচলনে সেই ‘ভয়’ ভাব নেই, আড়ষ্টতা নেই, মাথা উঁচু করে সে চলছে। স্বামীজী বলছেন: যেই প্যাট নিজেকে শ্রদ্ধা করতে শিখল, অমনি তার মধ্যে সুপ্ত শক্তি জেগে উঠল। ব্রহ্ম বিকশিত হয়ে উঠল তার মধ্যে। —আমাদের শাস্ত্রে বলছে; নিজেকে দুর্বল অক্ষম অযোগ্য ভাবার অর্থ হচ্ছে ‘আত্মহনন’। আত্মহত্যার নামান্তর সেটা। সেই আত্মহত্যার দিকে আমি যেন কাউকে ঠেলে না দিই। আমার চিন্তা, আচরণ বা কথাবার্তা যেন এমন না হয় যাতে তার ফলে অন্যের মনে সামান্যতম হীনম্মন্যতা জাগতে পারে। বস্তুত, এটা লক্ষ্য করা যায় যাঁরা সত্যিই মহৎ মানুষ, উন্নত চরিত্রের মানুষ—তাঁরা কখনও অন্যকে ছোট করে দেখেন না। ছোট তারাই করে, যারা নিজেরাই ছোট। শ্রীশ্রীমা বলছেন: লোকে নিজের মনটাকে আগে দোষী করে। তাই সে অন্যের দোষ দেখে। যীশুখ্রীষ্ট, বুদ্ধ, চৈতন্যদেব, এঁদের সবার জীবনে দেখি এই ক্ষমা, এই উদারতা। এত নির্মল তাঁদের দৃষ্টি যে দোষ দেখেন না তাঁরা, পাপ দেখেন না। সবাইকে তাঁরা পরম প্রেমে আলিঙ্গন করেন। পওহারীবাবার কথা আগে বলেছি। শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যেও তাই দেখছি। নটী বিনোদিনীকে কৃপা করছেন। গিরিশ ঘোষকে কৃপা করছেন। এমন পাপ নেই যা সে করেনি, তবুও ঠাকুর কৃপা করছেন তাঁকে। একদিন গিরিশ ঘোষ উদ্ভট একটা আবদার করলেন ঠাকুরের কাছে। নেশা করেছেন তখন। বললেন যে, তোমাকে আমার ছেলে হয়ে জন্মাতে হবে। ঠাকুর বললেন: সে আমি পারব না। তোমার ছেলে হতে যাব কোন্‌ দুঃখে? গিরিশ ঘোষ তখন নেশাগ্রস্ত—রাগের মাথায় যা-তা গালাগালি দিতে লাগলেন ঠাকুরকে। অশ্রাব্য সব গালিগালাজ। ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে ফিরে এলেন, সবাই বলছে: আর যাবেন না পাষণ্ডটার কাছে, এরকম করে অপমান করল আপনাকে! কিন্তু ঠাকুর ঠিক তার পরদিন গিয়ে হাজির হলেন গিরিশের বাড়িতে। গিরিশ ঘোষ তখন তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়েছেন। কাঁদতে কাঁদতে বলছেন: ঠাকুর, আজকে যদি তুমি না আসতে, তাহলে বুঝতাম যে তুমি অবতার নও। এখনও তোমার নিন্দা স্তুতি সমান জ্ঞান হয়নি। স্বামীজী বিদেশে আছেন, তাঁর কাছে চিঠি গেল এখান থেকে: শুনে দুঃখিত হবে, ঠাকুর যে ঘরে থাকতেন সেই ঘরে এখন পতিতা রমণীরাও যাতায়াত করে। স্বামীজী উত্তর দিলেন: নিশ্চয়ই যাবে তারা ঠাকুরের ঘরে। পতিতের উদ্ধারের জন্যই তো তিনি এসেছিলেন।—ঠাকুরের সম্বন্ধে একটা গান আছে:

তুমি কাঙাল বেশে এসেছ হরি কাঙালে করুণা করিতে হে,

প্রেম বিতরিতে মরুসম চিতে, পতিত জনে তারিতে হে।।

—দুঃখে, বঞ্চনায়, লাঞ্ছনায় যাদের জীবন মরুভূমির মতো হয়ে গেছে— তাদের জন্য ভালবাসা নিয়ে তুমি এসেছ, যারা নীচে পড়ে আছে, তাদের উপরে তুলবার জন্য তুমি এসেছ। মা বলছেন: ঠাকুর কি কেবল রসগোল্লা খেতেই এসেছিলেন?— এসেছিলেন তো এইজন্যই। আর, মায়ের নিজের জীবনেও দেখছি তাই। একজন মহিলা এসে মাকে বলছেন: মা, আমি এমন অন্যায় করেছি যে, তোমার ঘরে ঢোকবার যোগ্যতাও আমার নেই। মা তাকে দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলছেন: সে কী! অন্যায় করেছ তো কি হয়েছে? আমি তোমাকে মন্ত্র দেব। তাঁকে মন্ত্র দিলেন মা, কৃপা করলেন তাঁকে। বলছেন: শরৎ যেমন আমার ছেলে, আমজাদও তেমনি ছেলে। শরৎ হচ্ছেন স্বামী সারদানন্দ—ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ। আর আমজাদ হচ্ছেন গ্রামের মুসলমান ডাকাত। —এঁরা দুজনেই সমান তাঁর চোখে। আর এটা কথার কথা নয় তাঁর ক্ষেত্রে। সত্যিই তিনি ছেলের মতো দেখছেন আমজাদকে। কত আদর যত্ন করছেন তাঁকে। সবাই আপত্তি করছে—একে এতটা প্রশ্রয় দেওয়া কেন? তবুও তিনি করছেন। এমন নয় যে, তিনি আমজাদের দুষ্কর্মের কথা কিছু জানতেন না। সব জানতেন, সব জেনেশুনেও তিনি তাঁকে আদর যত্ন করছেন। বলতেন: ‘আমি সতেরও মা, অসতেরও মা।’ ‘ভাঙতে সব্বাই পারে, গড়তে পারে কজনে? (মন্দলোককে) নিন্দা ঠাট্টা করতে পারে সব্বাই, কিন্তু কি করে যে তাকে ভাল করতে হবে, তা বলতে পারে কজনে?’ বলছেন: ‘আমার ছেলে যদি ধুলোকাদা মাখে, আমাকেই তো ধুলো ঝেড়ে কোলে নিতে হবে?’ ‘আমাদের ঐজন্যেই আসা।’ —জগৎকে ভাল করতে, অসৎকে সৎ পথে তুলতে, পাপীকে পাপমুক্ত করতে এঁরা শরীর ধারণ করেন। স্বামীজী বলছেন:১৪ যখন আমার কুড়ি বছর বয়স তখন এমন গোঁড়া ছিলাম যে, যে ফুটপাথে থিয়েটার সেই ফুটপাথ দিয়েই হাঁটতাম না। অথচ এখন আমি (স্বামীজীর বয়স তখন তেত্রিশ) পতিতা রমণীদেরও ঘৃণা করতে পারি না— তাদেরকে তিরস্কার করার কথা পর্যন্ত আমার মনে ওঠে না। স্বামীজী বিদেশ থেকে ফেরার সময় কায়রো গেছেন। সঙ্গে তাঁর বিদেশী শিষ্য-শিষ্যারা আছেন। একদিন রাস্তায় ঘুরছেন তাঁরা—হঠাৎ স্বামীজী ভুল করে একটা রাস্তায় ঢুকে পড়েছেন, যেখানে পতিতা রমণীরা থাকেন। একটু পরেই স্বামীজী বুঝতে পারলেন, কোথায় এসেছেন। এক জায়গায় কয়েকজন রমণী বসে ছিল। স্বামীজী তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন। প্রথমে তারা স্বামীজীকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করছিল। কিন্তু পরমুহূর্তেই তারা বুঝতে পারল, ইনি এক অসাধারণ পুরুষ। তারা এসে তাঁর পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে তাঁর কাপড়ের প্রান্ত চুম্বন করছে আর বলছে: ইনি ভগবানকে জেনেছেন, ইনি ভগবানকে জেনেছেন। আর স্বামীজীর দু-চোখ দিয়ে তখন জল পড়ছে তাদের প্রতি সহানুভূতিতে। স্বামীজীর সঙ্গীরা যখন তাঁকে খুঁজতে খুঁজতে সেখানে এসে পৌঁছলেন, অবাক হয়ে গেলেন এই দৃশ্য দেখে। বস্তুত, ধর্মের সার্থকতা এইখানেই যে, ধর্ম কাউকে তুচ্ছ করে না, অযোগ্য বলে দূরে ফেলে দেয় না। মানুষের মধ্যে আশা জাগায় ধর্ম। ধর্ম একথাই বলে যে, তোমার অভ্যুদয় হোক। যেখানে আছ সেখানেই তুমি থেমে থেকো না। সেখান থেকে এগিয়ে চল। সেইজন্য দেখা যায় যে প্রকৃত ধর্মগুরু যাঁরা তাঁরা কোন কিছু ভাঙেন না, কাউকে নিন্দা করেন না। সকলের প্রতি অপার সহানুভূতি তাঁদের। যে যেখানে আছে সেখান থেকেই টেনে তোলেন তাদের। তাঁরা যে কথাগুলি বলেন সবার জন্য তার উপযোগিতা আছে। সবার তাতে অধিকার। শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীশ্রীমা, স্বামীজী বা শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যান্য সন্তান—এঁরা যা প্রচার করেছেন, তা কোন বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য নয়। এমন নয় যে, যে শুদ্ধাত্মা—শুধু তার জন্য এই ধর্ম, আর যারা তা নয় তারা এর অযোগ্য। তা নয়। সবার জন্য। এই ধর্ম আমাদের প্রত্যেকের জন্য। এক্ষুনি শুরু করতে পারি আমি। এটা ঠিক নয় যে, আমি আর শুরু করতে পারব না। Never too late. কখনও যেন না ভাবি যে, আমি দুর্বল, অক্ষম, পাপী। ঠাকুর নিষেধ করছেন নিজেকে পাপী ভাবতে। রাজা মহারাজ বলছেন:১৫ যত বড় পাপই হোক না কেন, মানুষের চোখেই তা বড়, ঈশ্বরের কাছে সে সব কিছুই নয়। কাজেই, নিজেকে পাপী ভাবতে নেই সব সময়। স্বামীজী বলছেন: পাপ কথাটা বলতে চাই না আমি। ‘পাপের’ বদলে বলব ‘ভুল’।—মানুষ পাপ করে না, ‘ভুল’ করে। কিন্তু ভুল করা তো মানুষেরই ধর্ম। মানুষ ছাড়া আর কে ভুল করে? বলছেন: গরু কখনও চুরি করে না, দেয়াল কখনও মিথ্যে বলে না—মানুষই ভুল করে, মানুষই আবার দেবতা হয়।— সেই দেবতা হব আমরা। আর ‘হব’ই বা বলছি কেন? আমরা তো সবাই দেবতা আছিই। তবে সেই দেবতা এখন ঘুমিয়ে আছেন আমাদের মধ্যে। ঘুম ভাঙাব তাঁর, নিদ্রিত দেবতাকে জাগিয়ে তুলব। আমাদের প্রত্যেকের জীবনের সেইটাই লক্ষ্য।

আকর-তালিকা

 । C. W., Vol. II, 1976, p. 300

 । শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্, ২/৫

 । C. W., Vol. I, 1962, p. 11

 । Ibid., Vol. VIII, 1959, pp. 126-27

 । Ibid., Vol. VII, 1964, p. 418

 । Ibid.. Vol. Iv, 1962, p. 358

 । Ibid.

 । গীতা, ৯/৩০

 । ঐ, ১৮/৬৬

১০। উদ্ধৃতঃ হরিভক্তিবিলাস, সনাতন গোস্বামী, ১১/৩৪২

১১। বাণী ও রচনা, ৯ম খণ্ড, ১৩৮৪, পৃঃ ১৭৬

১২। ঐ

১৩। উদ্বোধন, ৬৬ বর্ষ, পৃঃ ১২১

১৪। পত্রাবলী, ৬/৭/১৮৯৬ তারিখের চিঠি

১৫। ধর্মপ্রসঙ্গে স্বামী ব্রহ্মানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলিকাতা, ১৩৮৪, পৃঃ ৫৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *