কেউ নিষেধ শোনে না
১৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৯০:
গত রাতে একদম ঘুম হয়নি। আজ তাই উঠতে দেরি হয়ে গেল। বেলা ন’টার সময় উঠে দেখি ইন্দ্ৰ তখনও ঘুমোচ্ছে। আমাদের দু’জনের তাঁবু পাশাপাশি। গোলোকেরটা একটু দূরে। সেখানে ও আর ওর এক সাগরেদ, যে ভটভটি চালিয়ে নিয়ে এসেছিল, শুয়েছে। ইন্দ্রকে বিরক্ত না করে নিজেই চার কাপ কফি করলাম। গোলোককে ডাকতে গিয়ে দেখি ওরা তাঁবুতে নেই। কাল রাতে যে ভটভটি করে এই দ্বীপে এসে পৌঁছেছি সেটা পাশেই নোঙর করা ছিল। কিন্তু সকালে উঠে থেকে সেটা দেখতে পাচ্ছি না। গোলোক আর ওর সাগরেদ কি তাহলে ওটা নিয়েই কোথাও গেছে? হবে হয়তো! ওদের তিন কাপ কফি ফ্লাস্কে রেখে নিজের কাপটা নিয়ে আরাম করে তাঁবুতে বসে ডায়েরি লিখছি। এমনিতে আমি যে প্রতিদিন লিখি তা নয়। কিন্তু অভিযানে বেরোলে এটা আমার একটা আবশ্যিক কাজ। আমার অদ্ভুত অভিজ্ঞতাগুলোর সামান্য অংশও যেন ভুলে না যাই। বয়স হলে যখন আর অভিযানে বেরোতে পারব না, তখন এগুলো পড়েই আমার দিন কাটবে।
আমরা যেখানে আছি, সেটা উড়িষ্যা উপকূলের পারাদীপ বন্দর থেকে আশি মাইল পূর্বে সমুদ্রের উপরের একটা দ্বীপ। এই দ্বীপটার অস্তিত্ব যে আছে, সত্যি বলতে আমার জানা ছিল না। জুলাই মাসে পুরী বেড়াতে গিয়েছিলাম আমি আর ইন্দ্র সপরিবারে। মাঝে মাঝে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকেও বেড়াতে না নিয়ে গেলে সংসারজীবন থেকে বিতাড়িত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। আমার আর ইন্দ্রর উদ্ভট অভিযানগুলো নাহলে বিড়ম্বিত হয়ে পড়বে। সেখানেই পরিচয় গোলোকের সঙ্গে। গোলোক বংশানুক্রমে নুলিয়া। পুরীর সমুদ্রতটে ও আর ওর পরিবারের কয়েকজন পর্যটকদের সমুদ্রস্নান করতে সাহায্য করে। বেশ ভালো বাংলা জানে। আমাদের স্ত্রীরা ছেলে মেয়ে নিয়ে সমুদ্রে নেমেছিল। আমি আর ইন্দ্র পাড়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলাম, ঠিক তখনই গোলোক এসে দাঁড়িয়েছিল আমাদের সামনে। নুলিয়া লাগবে কিনা জানতে চেয়েছিল। আমি অবশ্য এক কথায় দূর করে দিচ্ছিলাম। তখনই একটা অদ্ভুত প্রস্তাব দিয়েছিল সে। একটা পরিত্যক্ত দ্বীপ আছে। সরকারের পক্ষ থেকে সে দ্বীপে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু কিছু টাকার বিনিময়ে সে নিয়ে যেতে পারে আমাদের। আমি আর ইন্দ্র একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। আমাদের ভেতরের অভিযাত্রী সত্তা নড়েচড়ে উঠেছিল। গোলোককে একটা সিগারেট দিয়ে ওর কাছ থেকে শুনেছিলাম সব।
ফিরোজ শাহ তুঘলক যখন উড়িষ্যা আক্রমণ করেছিলেন, তখন বহু হিন্দু মন্দির ধ্বংস করার পর উড়িষ্যার এক লক্ষ হিন্দুকে সপরিবারে আটক করে নিয়ে যান সমুদ্রের বুকে এই নির্জন দ্বীপে। সেখানে সুলতানের বেতনভুক কর্মচারীরা তাঁদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালায়। সম্ভবত তাঁরা সুলতানের ইসলাম গ্রহণের দাবি মেনে নেয়নি। প্রবল অত্যাচারে মৃত্যু হয় সেই মানুষগুলোর। তাঁদের স্ত্রী সন্তানেরাও এই নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি। বলা হয়, রক্তে ভেসে গিয়েছিল এই দ্বীপ। সেই অবস্থায় দ্বীপ ত্যাগ করে চলে যান সুলতান ও তাঁর অনুচরেরা। তারপর কোনও এক সময় থেকে এই দ্বীপ ভুতুড়ে বলে পরিচিত হয়। সেটা ঠিক কবে থেকে তা গোলোক বলতে পারেনি। আবার অনেকে বলে, ফিরোজ শাহ তুঘলক উড়িষ্যার মন্দিরগুলি লুট করে এত সোনাদানা সম্পদ আহরণ করেছিলেন যে সেগুলি বয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। এই দ্বীপেই সেগুলো কোথাও লুকনো আছে। এই মতে বিশ্বাসী কিছু অভিযাত্রী বিভিন্ন সময়ে গোপনে এই দ্বীপে এসেছে গুপ্তধন খুঁজতে। কিন্তু তারা কেউ আর ফেরেনি। কয়েকজনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে অদ্ভুত অবস্থায়। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাদের মৃত্যুর কারণ বোঝা যায়নি। এর পরেই সরকার থেকে এই দ্বীপে আসা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়।
১৩৫৯ সালে ফিরোজ শাহ তুঘলকের উড়িষ্যা আক্রমণের ঘটনা যে ঐতিহাসিক সত্য, তা আমরা জানি। কিন্তু এই ঘটনা সত্যি মিথ্যে যাই হোক, একটা নিষিদ্ধ দ্বীপে অভিযানটা বেশ রোমাঞ্চকর হবে সন্দেহ নেই। সেই মুহূর্তেই গোলোকের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। ঠিক হল, সবকিছু প্রস্তুত করে আমাদের ফোনে খবর দেবে সে। আমরা ওকে অগ্রিম কিছু দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু গোলোক রাজি হয়নি। বলেছিল, আগে পৌঁছাই, তারপর ওসব হবে। এতে ওর উপর আমাদের ভরসাটা আরও জোরদার হয়েছিল। সত্যিই খবর দিয়েছিল গোলোক। আর আমরাও সময় নষ্ট না করে ওর পথনির্দেশ অনুসরণ করে চলে এসেছি উড়িষ্যার এই জনহীন দ্বীপে। অবশ্য পারাদ্বীপে রাতের অন্ধকারে ভটভটি নিয়ে অপেক্ষা করছিল গোলোক। আমরা তাতে চড়ে বসা অব্ধি পথের খবর জানি। বাকিটা আমাদের কাছেও অজানা। কাল অনেক রাতে এসে পৌঁছেছি এই দ্বীপে।
যাই দেখি গোলোক ফিরল কি-না!
বিকেল ৫:১০:
আমাদের ভটভটি যে লোকটি চালিয়ে নিয়ে এসেছিল, সে ভোরবেলায় ভটভটি নিয়ে চলে গেছে। পাড়ে দাঁড় করানো ভটভটি কোনওভাবে পুলিশের চোখে পড়লে নাকি বিপদ হয়ে যাবে। কাজেই আপাতত এই দ্বীপে আমরা তিনজন। গোলোক বলে দিয়েছে তিনদিন পর রাতের দিকে এসে আমাদের নিয়ে যাবে ভটভটির চালক। তাই সই। এই দ্বীপে নেমেই একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি, এখানে কোনও নেটওয়ার্ক নেই। কাজেই মোবাইলগুলো সুইচ অফ করে রেখে দেওয়াই শ্রেয় মনে করেছি আমরা। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর গোলোকের সঙ্গে বেরিয়েছিলাম দ্বীপটা ঘুরে দেখতে।
গোলোকই আমাদের রান্না করে দিচ্ছে। সঙ্গে আনা সামান্য চাল, আলু, ডিম ফুটিয়ে পেঁয়াজ কাঁচালঙ্কা সহযোগে দুবেলা খাওয়া চলছে আমাদের। ব্রেকফাস্টে মুড়ি বাদাম দিয়ে কাজ চালাচ্ছি। মাত্র তো দিন তিনেকের ব্যাপার। তবে গোলোক বলেছে, এখানে নাকি জঙ্গলে বনমোরগ পাওয়া যায়। যদি ধরতে পারে, তবে একদিন অন্তত বনমোরগের ঝোল রেঁধে দেবে। আমি আর ইন্দ্র তাই শুনেই খুশি হয়ে গেছি। যাই হোক, দুপুরে বেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে কিছুদূর গিয়ে আচমকাই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল গোলোক। পকেট থেকে একটা চার ভাঁজ করা কাগজ বের করে ভাঁজ খুলে মেলে ধরল নিজের দুহাতের তালুতে। যেন দিক ঠিক করে নিতে চাইল। আমি আর ইন্দ্র মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিলাম, ঠিক তখনই গোলোক তাকাল আমাদের দিকে।
“এইখান দিয়েই যেতে হবে আমাদের। পশ্চিমে, সেখানে একটা বহু পুরনো লাইটহাউস আছে। তার আশেপাশেই জায়গাটা।”
ইন্দ্র অবাক হয়ে বলল, “কোন্ জায়গার কথা বলছ? কোথায় যাব আমরা?” গোলোকের চোখ চকচক করে উঠল, “বুঝলেন না? সম্রাটের গুপ্তধন! এটাই তার ম্যাপ।”
আমি আর থাকতে না পেরে বললাম, “তোমার মাথায় দোষ আছে গোলোক। এত সহজ গুপ্তধন পাওয়া? তোমার হাতের ঐ কাগজটা মানচিত্র? তা সেটা কে বানাল শুনি? আর এত সোজা হলে এর আগে কেউ সন্ধান পায়নি ওই গুপ্তধনের?”
“কে বলল পায়নি? কিন্তু যারা পেয়েছে, তারা আর ফিরে আসেনি।”
ইন্দ্র ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “দাঁড়াও দাঁড়াও। ফিরে আসেনি মানে?”
গোলোক মুচকি হেসে বলল, “লুকিয়ে চুরিয়ে অনেকেই আসে আপনাদের মতো। লোভ বড় খারাপ জিনিস বাবু। তাদের মধ্যে কেউ কেউ শেষ পর্যন্ত খুঁজেও পেয়েছিল জায়গাটা। কিন্তু গুপ্তধন নিয়ে ফেরা হয়নি আর। প্রায় ছিবড়ে হয়ে যাওয়া দেহ পাওয়া গেছে তাদের। ঠিক যেন কিছুতে শরীরের সবটুকু রক্ত মজ্জা জলীয় অংশ শুষে খেয়েছে। তাদের মধ্যে একজনের পকেটে পাওয়া গিয়েছিল এই ম্যাপটা।”
আমি এতক্ষণ শুনছিলাম। এবার আর না পেরে বলে উঠলাম, “এসব ব্যাপারে আমাদের থাকার দরকার নেই গোলোক। আমরা একটা নতুন জায়গা দেখতে এসেছি। তিনদিনের ব্যাপার। তারপর চলে যাব। আমরা কোনও গুপ্তধনের সন্ধানে আসিনি। কাজেই তুমি এসব ছাড়ো। দ্বীপটা একটু ঘুরে দেখে তাঁবুতে চলে যাব।” গোলোক যেন আকাশ থেকে পড়ল, “আপনারা সত্যিই গুপ্তধনের গল্প শুনে আসেননি?”
“অবশ্যই না।”
হতাশা ফুটে উঠল গোলোকের মুখে। মানচিত্রটা ভাঁজ করে পকেটে ভরে রাখল আবার। তারপর হাঁটতে শুরু করল সামনের দিকে।
এই ঘটনাটা মনে হল লিখে রাখা দরকার। এছাড়া যখন ফিরছি, কয়েকটা অদ্ভুত ধরনের গাছ চোখে পড়ল। মাটি থেকে সামান্যই উচ্চতা গাছটার। কাণ্ড বলে প্রায় কিছুই নেই। কিন্তু শুকনো সরু ডালের মতো পাঁচটা শাখা। দেখে মনে হবে বুঝি বা গাছটা মরে গেছে। সম্পূর্ণ কালো রং। কোনও পাতা নেই, ফুল-ফল কিচ্ছু নেই। জঙ্গলের মাঝে খানিক দূরে দূরেই এক একটা এই গাছ দেখলাম। গোলোককে জিজ্ঞেস করলাম ও কিছু জানে কিনা গাছটার ব্যাপারে, ও মুখ গোঁজ করে মাথা নাড়ল। বুঝতে পারছি, গুপ্তধনের বিষয়টায় খুবই মনক্ষুণ্ণ হয়েছে বেচারা।
রাত ৮:০৫:
বাধ্য হলাম আর একবার ডায়েরিটা খুলে বসতে। আজ বিকেলে জঙ্গল থেকে ফেরার পর তাঁবুতে শুয়ে বিশ্রাম করছিলাম। সমুদ্রের উপরে হলেও চড়া রোদ্দুর আর প্রচণ্ড গরম। এতক্ষণ হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ইন্দ্র তিন কাপ চা বানিয়ে একটা গোলোকের হাতে ধরিয়ে বাকি দু কাপ নিয়ে আমার তাঁবুতে এসে বসল। গোলোক সেই থেকে খুব দরকার ছাড়া কথা বলছে না। যদিও ঘুরিয়ে দেখিয়েছে জঙ্গলটা। সেটা করতে ও বাধ্য। টাকা নিয়েছে আমাদের কাছে। আমি শোয়া, আর ইন্দ্র আধশোয়া হয়ে গল্প করছিলাম। হঠাৎ আমার চোখে পড়ল আমার তাঁবু থেকে সোজা বাইরের দিকে তাকালে দ্বীপের যে অংশটা চোখে পড়ে, সেখানে একটা কিছু নড়ছে। তখনও অন্ধকার নামেনি। রোদ পড়েছে মাত্র। কাজেই স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি। সাপখোপ নয় তো? নড়াচড়াটা একটু কিলবিলে গোছেরই মনে হল। আমি ধড়মড় করে উঠে বসতেই ইন্দ্ৰও উঠে বসল। আমি যেদিকে তাকিয়ে আছি, সেদিকে মাথা উঁচু করে দেখার চেষ্টা করে বলল, “কী?” আমি তখনও দেখার চেষ্টা করে চলেছি। কিন্তু না, আর কিছু তো চোখে পড়ছে না। এত ভুল দেখলাম? নাঃ হতেই পারে না। ইন্দ্রকে বললাম, “চল তো, দেখি। কিছু তো একটা নড়তে দেখেছি আমি।”
ইন্দ্র আর আমি তাঁবু থেকে বেরিয়ে সাবধানে গেলাম ওই জায়গাটায়। গিয়েই থমকে গেলাম। সেই গাছটা। এটা এখানে কোথা থেকে এল? আগে তো বেশ কয়েকবার এখান দিয়ে ঘোরাঘুরি করেছি। এখান থেকে সমুদ্রের ভিউটা বেশ পরিষ্কার বলে প্রায়ই সিগারেট খেতে আমি আর ইন্দ্র এখানে এসে দাঁড়িয়েছি। উঁহু, না, ছিল না। দু’জনেই একেবারে নিশ্চিত। মাটি থেকে মাত্র তিন আঙুল মতো উঁচু। পাঁচটা শুকনো ডালের মতো ছড়ানো শাখা আকাশের দিকে মুখ করে আছে। পাতা-ফুল-ফলের কোনও চিহ্ন নেই। কালো রঙের গাছটাকে দেখলেই কেমন অস্বস্তি হয়। দু’জনেই একটু ঘাবড়ে গিয়ে তাঁবুতে ফিরলাম। গোলোককে বলে কোনও লাভ নেই। ও তো বলেছে ও চেনে না এই গাছ। তাঁবুতে ফিরে আবার আধশোয়া হয়ে দু’জনে গল্পে ফিরতে চাইলাম। কিন্তু দু’জনের কারো কপাল থেকেই ভাঁজ সরছিল না।
আচমকা ইন্দ্র বলে উঠল, “তুই কী নড়তে দেখলি তখন?” গাছটা দেখে এত অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে, এই কথাটা মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল। সত্যি, কী নড়তে দেখলাম আমি?
১৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৯০:
গতকালের মতো বর্ণময় দিন আমার জীবনে বড় একটা আসেনি। সারাদিন সময় পাইনি ডায়েরি লেখার। তাই আজ ভোর ভোর উঠে লিখতে বসেছি। ইন্দ্ৰ এখনও ওঠেনি। ও উঠলেই আবার বেরিয়ে পড়তে হবে। আজকের দিনটা আমাদের নিয়তি স্থির করবে। যাক গে, আজকের কথা পরে হবে। আগে গতকালের ঘটনাবলী লিখি।
বেশ ভোরে একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। নিঃসন্দেহে এটা ভটভটির শব্দ। কিন্তু সে তো পরশু সকালে আসার কথা। আজ কেন? লাফ দিয়ে উঠলাম। তাঁবু থেকে বেরিয়ে দেখি ইন্দ্র দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে। আমিও গিয়ে দাঁড়ালাম ওর পাশে। একটা ভটভটিই বটে। তবে সেটা আসছে না, যাচ্ছে। অর্থাৎ এই দ্বীপ ছেড়ে পারাদীপের দিকে যাচ্ছে। ঠিক বুঝলাম না ব্যাপারটা। ইন্দ্রকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে? এরা কারা?”
ইন্দ্র আমার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে পিছন ঘুরে ফিরতে লাগল তাঁবুর দিকে। আমি তখনও অন্ধকারে। সদ্য ঘুম ভেঙে উঠেছি। কিছুই বুঝতে পারছি না। ইন্দ্র আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল গোলোকের তাঁবুর কাছে। তাঁবু ফাঁকা। কোথায় গেছে গোলোক? কী দেখাতে নিয়ে এল ইন্দ্ৰ? গতকালও গোলোক ওর তাঁবুতে ছিল না। পরে জেনেছিলাম, ওর বরাবরের অভ্যেস ভোরে উঠে হাঁটতে বেরনো। আজও হয়তো তাই গেছে। আমি সেটা বলাতে ইন্দ্ৰ খেঁকিয়ে উঠল।
“চোখটা খোল গাধা। ওর কোনও জিনিসপত্র দেখতে পাচ্ছিস?”
এবার ভালো করে লক্ষ্য করলাম, সত্যিই গোলোকের তাঁবু ফাঁকা। তার মানে….
“তার মানে আমরা যা ভাবছি তাই। গোলোক পালিয়েছে।”
পালিয়েছে? কিন্তু কেন? আর তার থেকেও বড় প্রশ্ন হল, এবার আমরা ফিরব কী করে?
সঙ্গে থাকা পাওয়ার ব্যাঙ্ক অন করে মোবাইলগুলো চার্জে বসালাম। দ্বীপে কোনও প্রান্ত থেকে নেটওয়ার্ক মেলে কিনা চেষ্টা করে দেখতে হবে। এছাড়া সমুদ্রে যাতায়াত করার সময় কোনও মাছধরা ট্রেলার বা লঞ্চ যদি চোখে পড়ে তবে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য আমার একটা মোটামুটি লালের কাছাকাছি রঙের জামা একটা লম্বা গাছের ডালের মাথায় লটকে পাড় ঘেঁষে পুঁতে দিলাম। আর কী করা যেতে পারে মাথায় আসছিল না। গোলোকের কথায় বিশ্বাস করে দুম করে চলে আসাটা আমাদের বড় ভুল হয়ে গেছে। মনে পড়ছিল মায়ের কথা— ‘এই অভিযানে যাওয়ার নেশা তোকে একদিন বিপদে না ফেলে!’ বউও অনেক বারণ করেছে, রাগ করেছে, তবু কথা শুনিনি। সঙ্গে থাকা জল আর খাবার দাবারে দু’জনের টেনেটুনে দিন পাঁচেক চলতে পারে। তার মধ্যে কিছু একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। নইলে যে কী হবে তা ভেবে উঠতে পারছি না। গোলোক সম্ভবত আমাদের কাজে লাগিয়ে গুপ্তধন খুঁজতেই এসেছিল। দ্বীপে আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়া ইত্যাদির খরচ তো নেহাত কম নয়! সেগুলো আমাদের টাকায় হয়ে যাবে এটাই ওর উদ্দেশ্য ছিল। তাছাড়া আমরা লেখাপড়া জানি, আমাদের বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে গুপ্তধন খোঁজা সহজ হবে, এসবও ভেবেছিল বোধহয়। এরকমও হতে পারে, গুপ্তধন পেলে আমাদের খুন করে এখানেই ফেলে রেখে চলে যেত। বাইরের পৃথিবীর কেউ আর কোনওদিন আমাদের খোঁজ পেত না। ভাগ্যিস ওর গুপ্তধন খোঁজার প্রস্তাবে সম্মতি দিইনি। তাই অন্তত প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টাটুকু করতে পারছি। তবে আদৌ শেষ অব্ধি বাঁচব কিনা জানি না।
মোবাইলগুলো চার্জ হতেই দু’জনে দু’দিকে বেরিয়ে পড়লাম। কোথাও কি নেটওয়ার্ক পাব না? অন্তত দুর্বলতম একটা টাওয়ার পেলেও হবে। মনে মনে ইষ্টদেবতার নাম স্মরণ করে বেরিয়ে পড়লাম। ঘণ্টা দুই ঘোরাফেরা করে নিরাশ হয়ে তাঁবুতে ফিরে দেখলাম ইন্দ্ৰ খানিক আগেই ফিরে এসেছে। আমার মুখ দেখেই বুঝে নিল আশাব্যঞ্জক কিছু ঘটেনি। আমিও তাই। কারণ তেমন কিছু হলে দেখা হওয়া মাত্রই ও চেঁচিয়ে উঠে জানাত। দুজনে দু’কাপ কফি নিয়ে বসলাম। এই দু’দিনে একটাও যাত্রীবাহী অথবা মাছ ধরা ট্রেলার বা লঞ্চ দেখতে পাইনি। হয়তো এদিকটা যাতায়াতের রুট নয়। কিন্তু তাই যদি হয়, তাহলে কি এই দ্বীপে পচে মরাই আমাদের ভবিতব্য? সকাল থেকে দু’কাপ চা ছাড়া কিছুই পেটে পড়েনি। ইচ্ছেও করছে না। বাচ্চাদুটোর মুখ খুব মনে পড়ছে।
‘একটা উঁচু জায়গা পেলাম জানিস। একটা টিলা ধরনের উঁচু জায়গা। সেখান থেকে নিশ্চয়ই টাওয়ার মিলত।”, ইন্দ্রের কথায় মাথায় একটা প্ল্যান এল, “জঙ্গলের ভেতরে গিয়ে একটা উঁচু দেখে গাছে ওঠার চেষ্টা করলে হয় না?”
“হুম, ভাবিনি তা নয়। তবে অভ্যেস নেই। পড়ে হাত-পা ভাঙলে কী হবে ভেবে দেখেছিস?”
একেবারে সত্যি কথা। বিপদের উপরে বিপদ ডেকে এনে লাভ নেই। কিন্তু এখানেই তাহলে সব পথ বন্ধ? আস্তে আস্তে হতাশা গ্রাস করছে দু’জনকেই। হঠাৎ একটা কথা মনে আসতেই প্রায় একই সঙ্গে দু’জনে ধড়মড় করে লাফিয়ে উঠলাম। কয়েক সেকেন্ড দু’জন দু’জনের মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। তারপর হেসে উঠলাম। কি কাণ্ড! বলে না, বিপদে পড়লে মানুষের মাথার ঠিক থাকে না? এত সহজ সমাধান হাতের কাছে থাকতেও এতক্ষণ সেটা মনে পড়েনি? লাইটহাউস। গোলোকের সঙ্গে আগের দিনই তো জঙ্গলের সেই জায়গাটা দেখে এসেছি, যেখান থেকে সে বলেছিল লাইটহাউসে যাওয়া যায়। আমরা তো সেই চেষ্টাই করে দেখতে পারি। লাইটহাউসের যা উচ্চতা হয়, সেখান থেকে মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। ইন্দ্ৰ তখনই যেতে চাইছিল। আমি বাধা দিলাম। তখন অনেক বেলা হয়ে গেছে। জঙ্গলে অন্ধকার নামলে মুশকিলে পড়ব। তাছাড়া খিদেটা জানান দিচ্ছিল এবার। পরদিন বরং সকাল সকাল বেরিয়ে পড়া যাবে। ইন্দ্রও বুঝল ব্যাপারটা। মনের কোণে সামান্য আশার সঞ্চার হয়েছে। তাই একটু যেন শান্তি অনুভব করছিলাম।
রাতে আলু সেদ্ধ ভাত খেয়ে শুতে যাওয়ার আগে সিগারেট ধরিয়ে সমুদ্রের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। ইন্দ্র খুব ক্লান্ত হয়ে শুতে চলে গেছে। আকাশে বেশ বড়সড় একটা চাঁদ উঠেছে। চারিদিক ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় যেন ধুয়ে দিয়েছে। সমুদ্রটাকে কেমন অপার্থিব লাগছে। ঘোর লেগে যাচ্ছে চোখে। মাটিতেই বসে পড়লাম। ফুরফুরে হাওয়ায় চোখ বুজে আসছে। জানি তাঁবুর বাইরে ঘুমোনো সুরক্ষিত নয়। কিন্তু ভেতরে যেতে ইচ্ছে করছে না। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কিনা জানি না। আচমকা চটকা ভাঙল একটা কোলাহলে। একসঙ্গে অনেক লোকের গলার স্বর। মেয়ে-পুরুষ সম্মিলিত আর্তনাদ। এত মানুষ এখানে কোথা থেকে এল? এই দ্বীপ জনহীন বলেই তো জানি। দু’দিনে তো কম ঘুরলাম না, কোথাও একজন মানুষেরও দেখা মেলেনি। তাহলে কোথা থেকে ভেসে আসছে এই আর্তনাদ? তাহলে কি নির্জন নিস্তব্ধ দ্বীপে সমুদ্রের হাওয়া বয়ে আনছে অন্য কোনও দ্বীপের শব্দ? কিন্তু তা যদি হয়, তবে কতদূরের শব্দ বাতাস এভাবে বয়ে আনতে পারে? নাকি কাছেপিঠেই আছে কোনও মনুষ্যবসতি? উঠে দাঁড়ালাম। কান পেতে বোঝার চেষ্টা করলাম কোন্ দিক থেকে ভেসে আসছে শব্দ। নাহ, কোনও ভুল নেই, এই দ্বীপেরই জঙ্গলের মধ্য থেকে আসছে আওয়াজটা। একবারও মনে হল না ইন্দ্রকে ডাকা দরকার। এমনকি যাওয়ার পথে আমাদের তাঁবুগুলোও চোখে পড়ল না। নিশিতে ডাকা মানুষের মতো হেঁটে গেলাম জঙ্গলের দিকে। আমি কি নিজের চেতনায় ছিলাম? থাকলে কি রাতের অন্ধকারে অজানা দ্বীপের জঙ্গলের ভেতরে একা প্রবেশ করতাম? এ প্রশ্নের উত্তর নেই আমার কাছে। শুধু জানি, হাঁটতে হাঁটতে উপস্থিত হলাম জঙ্গলের মাঝখানে একটা ফাঁকা জায়গায়, যেখানে বড় গাছ কম, গুল্ম ঝোপ বেশি। আলখাল্লার মতো পোশাক আর উলটনো বাটির মতো টুপি পড়া কয়েকজন লোক সেখানে দাঁড়িয়ে। সবারই কোমরে ঝুলছে অস্ত্রশস্ত্র। একজন বিশালদেহি লোক মাঝখানে দাঁড়ানো। ঊর্ধ্বাংশ অনাবৃত, লোমশ দেহ। হাতে এক বিশালাকৃতি খাঁড়া ধরনের অস্ত্র। মাটিতে অনেকটা হাড়িকাঠের মতো জিনিস, তবে অত নিচু নয়। বেশ উঁচু। কয়েকজন লোক মিলে কোথা থেকে এক একজন লোককে ধরে আনছে। যাদের আনছে, তারা এদের থেকে চেহারায় ও পোশাকে সম্পূর্ণ আলাদা। পোশাক প্রায় নেই বললেই হয়। পরনের এক চিলতে কাপড় কোনওক্রমে লজ্জা রক্ষা করছে। গায়ের রং ঘোর কালো। শীর্ণ চেহারা। হাতদুটো সামনের দিকে শক্ত করে বাঁধা। ধরে নিয়ে আসার সময় ছটফট করছে লোকগুলো। চিৎকার করছে। জঙ্গলের ভেতর থেকে ভেসে আসছে আরও বহু মানুষের আর্তনাদ। সম্ভবত তাদের ওখানেই কোথাও বন্দি করে রাখা হয়েছে। নারী পুরুষের আর্তনাদে ভরে উঠেছে আকাশ বাতাস। যে লোকটিকে ধরে আনা হল, তাকে এনে দাঁড় করানো হল সেই হাড়িকাঠের সামনে। তাহলে কি লোকটিকে বলি দেওয়া হবে? কারা এরা? কেনই বা বলি দেওয়া হচ্ছে একে? কী অপরাধে এই শাস্তি? আমি যে ওখানে উপস্থিত, তা যেন বুঝতেই পারছে না কেউ। সম্পূর্ণ আলাদা পোশাক আশাকে দাঁড়িয়ে আছি আমি। মনে হচ্ছে, একটা যুগান্তরের মানুষ আমি। কিছুতেই খাপ খাচ্ছি না এখানে। আরে! একি! অনিচ্ছুক লোকটাকে টানতে টানতে এনে সেই হাড়িকাঠে তার একসঙ্গে বাঁধা হাতদুটোকে তুলে দেওয়া হল হাড়িকাঠে। চোখের পলক পড়তে যেটুকু সময় লাগে, তাঁর মধ্যেই লোমশ খালি গায়ের লোকটার এক কোপে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল কবজি থেকে হাত দুটো। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল। লোকটা মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগল। গলা থেকে বেরিয়ে এল তীব্র গোঙানি। মাটিতে খসে পড়া হাতের পাঞ্জা দুটো তিড়িংবিড়িং লাফাচ্ছে। একসময় লোকটা আর তাঁর ছিন্ন হাত-দুয়েরই ছটফটানি বন্ধ হয়ে এল। রক্তের সমুদ্রে পড়ে থেকে স্থির হয়ে গেল লোকটা। বোঝাই যাচ্ছে, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণই তার মৃত্যুর কারণ। কোনও সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ এ দৃশ্য দেখে স্থির থাকতে পারে না। আমিও পারলাম না। হড়হড় করে বমি করে ফেললাম। কিছুক্ষণ পর যখন ঘুরে তাকালাম, তখন পুরো দৃশ্যটাই যেন ম্যাজিকের মতো মুছে গেছে চোখের সামনে থেকে। অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি আমি। ঝিঁঝিঁপোকার তীব্র আওয়াজে কান বন্ধ হওয়ার জোগাড়। অকস্মাৎ ভয়ে আমার বুক শুকিয়ে গেল। একা একা এ কোথায় চলে এসেছি আমি! ছুট মারলাম তাঁবুর দিকে।
হাঁফাতে হাঁফাতে তাঁবুর সামনে এসে পৌঁছে দেখি পৃথিবী আগের মতোই শান্ত কোথাও কোনও শব্দ নেই। দুধের মতো জ্যোৎস্নায় আলোকিত চরাচর। সমুদ্রের স্থির জলে চাঁদের আলোর প্রতিফলন। আমি কেমন হতভম্বের মতো নিজের তাঁবুতে ঢুকে শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসার আগে পর্যন্ত খেয়াল করলাম, আমার তাঁবুর বাইরের অংশে ছাদ থেকে দেওয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে মাকড়সার মতো, অথচ বেশ বড় মাপের কোনও পোকা অথবা প্রাণী। কিছুক্ষণ আগে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া দৃশ্যাবলী এতখানিই কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে ফেলেছিল আমাকে যে, বেরিয়ে দেখার সাহস বা ইচ্ছে কোনওটাই হল না। তাঁবুর গায়ের নড়াচড়া লক্ষ্য করতে করতে কখন যেন দু’চোখ ভরে নেমে এল ঘুম।
২০ শে সেপ্টেম্বর, ১৯৯০:
এটাই হয়তো আমার লেখা শেষ এন্ট্রি। এ যাত্রা আর স্ত্রী সন্তানদের দেখতে পাব কিনা জানি না। আজ সকালেও যখন ঘুম থেকে উঠেছিলাম, জানতাম না আজকের দিনটা আমাকে কী দেখাতে চলেছে।
আজ ভোরে উঠেই আমি আর ইন্দ্র বেরিয়ে পড়লাম লাইটহাউসের সন্ধানে। যাওয়ার পথে আমরা আলোচনা করছিলাম, এই লাইটহাউস নিশ্চয়ই সেই ফিরোজ শাহ তুঘলকের ঘটনার অনেক পরে নির্মিত। কারণ, ফিরোজ শাহ তুঘলক উড়িষ্যা আক্রমণ করেছিলেন ১৩৫৯-এ, আর ভারতবর্ষের প্রথম লাইটহাউস তৈরি হয় তাঁর বেশ কয়েক শ’ বছর পরে ১৯০০ সালে। তাঁর একটাই অর্থ হয়। অন্তত বিংশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত এ দ্বীপে মানুষের যাতায়াত ছিল। তারপরেই কোনও কারণে, গোলোকের তত্ত্ব যদি সত্যি হয় তাহলে গুপ্তধনের সন্ধানে আসা মানুষজনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পরই সরকার থেকে এ দ্বীপে আসা নিষিদ্ধ করা হয়। এমনও হতে পারে, কোনও অজানা কীট পতঙ্গ কিংবা জানোয়ারের আক্রমণেই তাদের মৃত্যু হয়েছে, এমনটাও ভাবা হয়েছিল। যদিও এত আইন জারি করেও লুকিয়েচুরিয়ে লোকজনের আসা যে বন্ধ করা যায়নি, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ তো আমরাই।
যাই হোক, গোলোকের বলা দিকনির্দেশ অনুসরণ করে বেশ কয়েক মাইল হেঁটে যেতেই দূর থেকে চোখে পড়ল লাইটহাউসের চূড়া। চূড়া অর্থাৎ চারিদিকে কাচের আচ্ছাদন দেওয়া গম্বুজের মতো অংশ। সেটা দেখেই উৎসাহ যেন দ্বিগুণ হয়ে গেল আমাদের। তাড়াতাড়ি পা ফেলে যত দ্রুত সম্ভব পৌঁছনো গেল লাইটহাউসের সামনে। লাইটহাউসের চারিদিকে ঝোপঝাড় প্রচুর। একেবারে সমুদ্রের ধারে অবস্থিত লাইট হাউসটার ভগ্নপ্রায় অবস্থা দেখে বেশ দমে গেলাম। এটার ভেতরে প্রবেশ করা মোটেই ঠিক হবে না। যে কোনও সময় উপরে যাওয়ার লোহার সিঁড়ি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে পারে। নোনা হাওয়ার জন্যই সম্ভবত সেগুলো প্রায় ঝুরঝুরে হয়ে এসেছে। ওগুলোর পক্ষে আমাদের ওজন নেওয়া কতটা সম্ভব, তাতে সন্দেহ দেখা দিল। সেক্ষেত্রে উঁচু থেকে পড়ে হাত-পা কেন, মাথা ঘাড় সবই ভেঙে যেতে পারে। কিন্তু ইন্দ্র কথা শুনতে চাইল না। ও বরাবরই একগুঁয়ে। ওর ধারণা হয়েছে, এর উপরে উঠলেই আমরা মোবাইল নেটওয়ার্ক পাব। কিন্তু আমার এবার তাতেও সন্দেহ হতে লাগল। কাছাকাছি কোনও মোবাইল নেটওয়ার্ক কোম্পানির টাওয়ার থাকলে তবে তো! কিন্তু ইন্দ্র মনে করল, এসব আমার উপরে না ওঠার বাহানা।
“তুই তাহলে নীচে দাঁড়া। আমি দেখে আসছি।” বলে ইন্দ্র ভেতরে ঢুকে পড়তেই আমিও ওর পিছু নিলাম। এক যাত্রায় পৃথক ফল হওয়া কোনও কাজের কথা না।
লোহার ঘোরানো সিঁড়ির ধাপগুলো ছোট ছোট। বেশিরভাগই ভাঙা। কোনওমতে আস্তে আস্তে বুঝে বুঝে পা ফেলে উপরে ওঠা গেল। ইন্দ্র আর আমি দু’জনেই অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করতে লাগলাম নেটওয়ার্ক পাওয়ার। বিভিন্ন জায়গা থেকে ঘুরে ঘুরে চেষ্টা করেও আমরা সফল হতে পারলাম না। ইন্দ্রকে দেখে মনে হচ্ছিল ও যে কোনও সময়ে কেঁদে ফেলবে। আমারও কম চিন্তা হচ্ছিল না। আমাদের মুক্তির শেষ আশা ছিল এটাই। বাইরের দিকে চেয়ে দেখলাম বেশ মেঘ করেছে। সমুদ্রের মাঝখানে বসে এত মেঘ জমতে দেখার অভিজ্ঞতা এই প্রথম লাইটহাউসের উপরে চারিদিক কাচে ঢাকা ঘরে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল যেন কালো মেঘ নেমে এসে আমাদের গ্রাস করবে যে কোনও সময়। কাচের ভাঙা অংশ দিয়ে হু হু করে সামুদ্রিক হাওয়া প্রবেশ করছে। মেঘের কানফাটানো গর্জনের সঙ্গে আকাশের এপার ওপার চিরে ফেলা বিদ্যুৎ চমক। মনে হচ্ছিল, গোটা পৃথিবীতে আমি আর ইন্দ্র ছাড়া আর কোনও প্রাণী নেই। এই বিশাল ভয়ঙ্করের সামনে দাঁড়িয়ে বাক্যহারা হয়ে পড়লাম দু’জনেই
কয়েক মিনিটের মধ্যে বৃষ্টি নামল। চারিদিক আচ্ছন্ন করে আমাদের হৃৎস্পন্দনের গতি দ্রুততর করে তুলল বৃষ্টির শব্দ। আচমকা যেন তাল কাটল প্রকৃতির এই জলসার। মেঘের গর্জন, বৃষ্টির শব্দ ভেদ করে কানে এসে পৌঁছল একটা খচর মচর শব্দ। শব্দটা প্রায় একসঙ্গেই দু’জনের কানে গেল। উপরে ওঠার সিঁড়ির দিক থেকে আসছে শব্দটা। দু’জন দু’জনের দিকে চাইলাম। তাহলে কি বৃষ্টি থেকে বাঁচতে কোনও হিংস্র জন্তু ঢুকে পড়েছে লাইটহাউসের মধ্যে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের সন্ধানে? সম্ভাবনাটা মাথায় আসতেই আমাদের শরীরের রোম খাড়া হয়ে গেল। আমাদের সঙ্গে কোনও অস্ত্র নেই। মশালজাতীয় কোনও কিছু নেই যাতে আগুন জ্বালিয়ে ভয় দেখাতে পারি। কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে তো চলবে না। আশেপাশে তাকিয়ে কয়েকটা শুকনো গাছের ডাল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না। তাই সই। অন্তত ভয় দেখানোর চেষ্টাটুকু করা যাবে।
দু’জনে দুটো ডাল হাতে নিয়ে প্রস্তুত হলাম। শব্দটা আরও জোরে হচ্ছে। নাঃ, এ কোনও একটা প্রাণীর পায়ের শব্দ বলে তো মনে হচ্ছে না। তাহলে কি অনেকগুলো শেয়াল জাতীয় প্রাণী? ইন্দ্র বাঁ হাত দিয়ে আমাকে অপেক্ষা করার ইশারা করে আস্তে আস্তে এগোতে লাগল সিঁড়ির দিকে। ঠিক দরজার মুখে যেখান থেকে সিঁড়ি শুরু সেখানে গিয়ে থমকে গেল ইন্দ্ৰ। মুখটা ভয়ে বিস্ময়ে ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে। হাত থেকে খসে পড়ল গাছের ডালটা। প্রচণ্ড আতঙ্কে ওর গলা চিরে বেরিয়ে এল আর্তনাদ। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। ইন্দ্র আমার দিকে চেয়ে শুধু হাত নাড়ল। স্পষ্টতই বারণ করছে এগোতে। হঠাৎ আমার চোখে পড়ল ওর পায়ের দিকে। একটা কালো স্রোত যেন গ্রাস করছে ওর পা। খুব দ্রুততার সঙ্গে উঠে আসছে ওর পা বেয়ে উপরের দিকে। মেঘের অন্ধকারে দেখা যাচ্ছিল না ভালো করে। তবু দেখে মনে হল, অতিকায় কিছু মাকড়সার দল। আস্তে আস্তে উঠে আসছে ইন্দ্রর কোমর পেট বুক বেয়ে গলার দিকে। ইন্দ্র পাগলের মতো চিৎকার করছে। আমি কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। আচমকা বিদ্যুৎ চমকে উঠল। আর সেই আলোতে দেখলাম…. ইন্দ্রর মুখ মাথা ঢেকে ফেলেছে… না, মাকড়সা নয়, সেই গাছের দল। সেই গাছ, যা আমরা দেখেছিলাম জঙ্গলের মধ্যে, আমাদের তাঁবুর কাছে। আমি সেদিন ঠিকই দেখেছিলাম। ওটাই নড়ছিল। ওটা গাছ নয়, জ্যান্ত কিছু। ইন্দ্র পড়ে গেছে মাটিতে জানি আমাকে কাপুরুষ মনে হচ্ছে, তবু আমি কিছুই করতে পারলাম না। বরং বলা ভালো, ভয় আমাকে এক পা এগোতে দিল না। ইন্দ্রর সারা শরীরে এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে কালো কালো অদ্ভুত পাঁচ পাওয়ালা প্রাণীগুলো। ইন্দ্রর গলা দিয়ে আর কোনও স্বর বেরোচ্ছে না। ওর শরীরে কোনও নড়াচড়াও চোখে পড়ছে না। আমি জানি না, আমি কী করব! কয়েক মিনিট, না কয়েক ঘণ্টা আমি জানি না। তাকিয়ে দেখলাম, ইন্দ্রর দেহটা পড়ে আছে মেঝেতে। উপুড় হয়ে। ঐ প্রাণীগুলো নেই। একটাও না। যেমন আচমকা এসেছিল, তেমনই চলে গেছে। আমি এগোলাম। আস্তে আস্তে ইন্দ্রর পাশে বসে সোজা করে দিলাম ওর দেহটা। মনে হল, একটা তুলোর পুতুল। কোনও ওজন নেই। আরে! এ কি! এটা কি ইন্দ্ৰ? মনে হচ্ছে ইন্দ্রের মমি। চোখের কোটরে চোখ নেই, দুটো গর্ত। গাল তুবড়ে ঢুকে গেছে ভেতরে। আমি একটা আর্ত চিৎকার করে ওকে ছেড়ে উঠে পড়লাম। পালাতে হবে। নইলে আমিও ওর মতো… কিন্তু কোথায়? কোথায় পালাব? বাইরে অক্লান্ত বর্ষণ। কিন্তু এখানে আর এক মুহূর্তও নয়। আমি উঁকি মেরে দেখলাম অন্ধকার সিঁড়ি। কিন্তু নিঃশব্দ। প্রাণীগুলো নেই। প্রাণপণে ছুটলাম। বাইরে বেরিয়ে একবারও পিছন ফিরে তাকালাম না। বৃষ্টির ফোঁটা তিরের মতো বিঁধছে আমার গায়ে। তবু তখন আমাকে কেউ থামাতে পারত না।
দৌড়তে দৌড়তে কখন এতটা পথ পেরিয়ে তাঁবুর কাছে পৌঁছে গেছি জানি না। বৃষ্টিটা ধরেছে। কিন্তু আকাশে এখনও ঘন মেঘ। বোঝাই যাচ্ছে, আর কিছুক্ষণের মধ্যে আবার নামবে। ইন্দ্রর তাঁবুটা ফাঁকা পড়ে আছে। আড়চোখে একবার সেদিকে তাকিয়ে নিজের তাঁবুর দিকে পা বাড়ালাম। পা বাড়াতেই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম কিছুতে পা জড়িয়ে। কোনওমতে উঠে দাঁড়িয়ে দেখতে গেলাম, কিসে পা বেধে পড়ে গেলাম! দেখামাত্রই গায়ের রক্ত জল হয়ে গেল। সমুদ্রের দিক থেকে যে রাস্তাটা আমাদের তাঁবুর দিকে আসছে, সে রাস্তাটা ঢেকে আছে সেই পাঁচ পা-ওয়ালা কালো কালো মাকড়সার মতো দেখতে প্রাণীগুলোয়। হালকা হালকা নড়ছে পাগুলো, যেন নাগালের মধ্যে কিছু এলেই ধরে ফেলবে। আমার পা বেয়ে উঠে আসছিল একটা। আমি প্রবল ঝটকায় সেটাকে মাটিতে ফেলে দিলাম। ধপ করে মাটিতে পড়েই পাঁচ পায়ে ভর করে সেটা মিশে গেল দলের মধ্যে। আমি এক ছুটে তাঁবুতে ঢুকে তাঁবুর পরদা ফেলে এঁটে বন্ধ করে দিলাম।
ঠিক মধ্যিখানে বসে কাঁপছি আর ডায়েরি লিখছি এখন। মনে আর বিন্দুমাত্র আশা নেই বেঁচে ফেরার। তবে যেভাবেই হোক, আমি আমার ডায়েরিটাকে রক্ষা করবই। যদি কখনো এ ডায়েরি কারো হাতে পড়ে, তবে বাইরের পৃথিবী যেন জানতে পারে এ দ্বীপের রহস্য। ফিরোজ শাহ তুঘলকের ধর্ম পরিবর্তনের দাবি আর অত্যাচারের কাছে মাথা নোয়ায়নি যে মানুষগুলো, তাদের হাত কেটে ফেলা হয়েছিল। রক্তক্ষরণে মারা গিয়েছিল তারা। তাদের পার্থিব দেহগুলো নষ্ট হয়ে গেলেও কাটা হাতগুলো আজও জীবিত। তাদের উপরে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিয়ে চলেছে সম্পূর্ণ মানবসভ্যতার বিরুদ্ধে। আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলছে, ওই প্রাণীগুলো আসলে ওই মৃত মানুষগুলোর হাত। এই দ্বীপের প্রকৃতি তার রেসিডিউয়াল হন্টিং আমার সামনে পুনরাভিনয় করে আমাকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আমি বোকা। আমি তার সাবধানবাণী অগ্রাহ্য করেছি। তাই আজ ইন্দ্রকে মরতে হল। আমার ভাগ্যে কী আছে জানি না। কিন্তু আমি এই ডায়েরি নষ্ট হতে দেব না।
আরে, ওগুলো কি? গত রাতেও লক্ষ্য করেছিলাম এই নড়াচড়া। আমার তাঁবুর ছাদ আর দেওয়াল ভরে গেছে কালো কালো পাঁচ আঙুলে। ওরা ঢুকতে চাইছে। ভেতরে। তাঁবুর ভেতরে। আর যদি একবার ঢুকে পড়ে…! নাঃ আমার ডায়েরিটা! কোথায় লুকাই!
১২ই জুন, ২০২২:
প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক আদিত্য মহান্তি গতকাল রাতে বসে শেষ করেছেন ডায়েরিটা। তারপর আর ঘুম আসেনি তাঁর। আজ সকালে আসার কথা তাঁর প্রিয় ছাত্র গৌতমের। অন্তত চার দশক আগের এই ডায়েরিটা গত সপ্তাহে একটা মাছধরা ট্রেলারের জালে মিলেছে। একটা মোটা পলিথিনে মুড়ে সিলিকন টেপ দিয়ে শক্ত করে বাঁধা ছিল। যে দ্বীপের কথা এতে আছে, তার কথা জানেন আদিত্যও। ডায়েরিটা পাওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে নির্বাচিত করা হয়েছে এই রহস্য ভেদ করার জন্য। সত্যিই কোনও অজানা প্রাণী? নাকি এই ডায়েরির কথাই ঠিক? গৌতমকে নিয়ে তিনি একবার যেতে চান সেই দ্বীপে, রহস্য উন্মোচনে।