কেউ দশে, কেউ ছয়ে, কেউ পাঁচে
গেরো দেওয়া, সেলাই করা, পরদা গুটানো, দোরবাক্স চাবি দিয়ে বন্ধ করা— এসব বারণ করেছিলেন। কেন বারণ করেছিলেন ঠাকুর! যে ত্যাগ করবে, তার এইসব সাধন করতে হয়।
ঠাকুর সাধনের কথা বলছেন। যাঁরা সংসারে থাকবেন আধা বিষয়ী হয়ে তাদের জন্য একরকম ব্যবস্থা। অত কঠোর করতে পারবে না। রাখতে পারবে না। বারে বারে ভাঙবে। করবে আবার করবে না। সে বড় সাঙ্ঘাতিক। না ঘরকা, না ঘাটকা। তখন এও যাবে, ওও যাবে। হয়ে যাবে ভণ্ড। বকধার্মিক। এঁদের জন্য ঠাকুরের ঢালাও নির্দেশ—”না গো! তোমাদের সব ত্যাগ করতে হবে কেন? তোমরা রসেবশে বেশ আছ। সা-রে-মা-তে। তোমরা বেশ আছ, নক্স খেলা জান? আমি বেশি কাটিয়ে জ্বলে গেছি। তোমরা খুব সেয়ানা। কেউ দশে আছ, কেউ ছয়ে আছ, কেউ পাঁচে আছ। বেশি কাটাও নাই। তাই আমার মতো জ্বলে যাও নাই। খেলা চলছে—এ তো বেশ। সত্য বলছি, তোমরা সংসার করছ এতে দোষ নাই। তবে ঈশ্বরের দিকে মন রাখতে হবে। তা না হলে হবে না। এক হাতে কর্ম কর, আরেক হাতে ঈশ্বরকে ধরে থাক। কর্ম শেষ হলে দুই হাতে ঈশ্বরকে ধরবে।’
যাঁরা সংসারে ঢুকে পড়েছেন তাঁদের সংখ্যাই বেশি, তাঁদের জন্য ঠাকুরের নরম প্রেসক্রিপশন। আধা ছানার মণ্ডা। সংসারে তোমার কর্তব্য আছে। ফেলে পালালে চলবে না। আমি অমন কাজ সমর্থন করি না। নদের হাট বসিয়ে এখানে এসে মাদুর বিছিয়ে নাক ডাকাবে! বলবে, সমাধি প্র্যাকটিস করছি! অর্ধচন্দ্র দিয়ে বিদায় করে দেব। মেয়ের বিয়ে দিয়েছ, ছেলেকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়েছ, স্ত্রীর ভরণপোষণের ব্যবস্থা করেছ, সংসার তোমাকে ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট দিয়েছে, তাহলে এস, তোমাকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করি।
মৃত্যুর জন্য আবার প্রস্তুতি কি! পড়ব আর মরব।
তাই নাকি? বৎস, পুনর্জন্মের কথা ভাব। মৃত্যুর সময় যা ভাববে তাই হবে পরের জন্মে। ভরতরাজা হরিণের কথা চিন্তা করতে করতে দেহত্যাগ করেছিলেন, পরের বার এলেন হরিণ হয়ে।
সাধু মরণে সাবধান!
কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে সাধুর আস্তানা। ভক্তপরিবৃত। উপদেশাদি। রোজ কোথা থেকে এক পাগলী আসে, হাসতে হাসতে শুধু একটি কথাই বলে যায়—বাবা মরণে হুঁশিয়ার! সাধু বুঝতে না পেরে রেগে যান। অবশেষে অন্তিমকাল এল। চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। নজর গেল চালের বাতার দিকে। এক জোড়া নতুন চপ্পল গোঁজা রয়েছে। কোন এক ভক্তের উপহার। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। নাভিশ্বাস উঠছে। ক্ষণিক চিন্তায় ঘুরে গেল—আহা! জুতোটা আর পরা হলো না। সাধু চলে গেলেন।
অনেকদিন পরে। সেই দশাশ্বমেধ। একটি মুচি একপাশে বসে জুতোয় পেরেক ঠুকছে টুকটুক করে। সেই পাগলী—কি গো সাধু, কি বলেছিলাম, মরণে হুঁশিয়ার! শুনেছিলে?
জন্ম জন্ম ধরে সংস্কার তৈরি করতে হয়। কে জন্মায়? জন্মায় সংস্কার। বিজ্ঞানে তার নাম হয়েছে জিন। ঠাকুর বারেবারে বহুভাবে বলেছেন—হুঁশিয়ার! সংস্কার তৈরি কর। সংস্কার-দোষে মায়া যায় না। অনেক জন্ম এই মায়ার সংসারে থেকে থেকে মায়াকে সত্য বলে বোধ হয়।
সংস্কার সম্পর্কে কোন দ্বিমত থাকতে পারে না। ঠাকুর আরো দৃঢ়ভাবে বলছেন, কেউ সুস্থ-সবল মনের অধিকারী, কেউ দুর্বল-রুগ্ন মনের অধিকারী। কেন? কেউ উদার, কেউ সঙ্কীর্ণ, কেউ স্বভাব-সাধু, কেউ খল, কেউ জন্মবিষয়ী, হিসেবী, সন্দেহপ্রবণ, কেউ মুক্ত, শুদ্ধ, বুদ্ধ অপ্রমত্ত। কেন?
রুগ্ন মনের চারটি লক্ষণ—(১) উপাসনার আনন্দ পায় না, (২) ঈশ্বরকে ভালবাসে না, (৩) শিক্ষার নয়নে বস্তু দেখে না এবং (৪) জ্ঞানের কথা যা শ্রবণ করে তার মর্ম ধারণা করতে পারে না।
ভাগবত পাঠ হচ্ছে, বলছে—কি ব্যাজোর ব্যাজোর করছে! তত্ত্বকথা হচ্ছে ঠাকুরের ঘরে! বন্ধু তন্ময় হয়ে শুনছে, আরেক জন খোঁচাচ্ছে—চল না, চল না। শেষে বলছে—আমরা তাহলে যাই। মানুষ দেখলেই ঠাকুর চিনতে পারতেন— ভিতরে কি আছে, কে আছে। যেই বুঝতেন, অঙ্কট-বঙ্কট, সহজে হবে না, জল এত ঘোলা, যে নির্মলি ফেললেও থিতোবে না, তখন তাদের জন্য ব্যবস্থাপত্র— যাও, রাসমণির টেম্পল দেখ, গার্ডেন দেখ।
ঠাকুর কি তাহলে নির্দয়! না। হবে, সকলেরই হবে। তবে কত জন্ম পরে হবে নির্ভর করছে আকাঙ্ক্ষার ওপর। ইচ্ছা চাই। অহেতুকী কৃপা কারো কারো ভাগ্যে জুটতে পারে, তাঁরা হলেন কৃপাসিদ্ধ। তাঁদের কথা ভিন্ন। মাস্টারমশাইকে বোঝাচ্ছেন বিদ্যাসাগরমশাইয়ের উদাহরণ দিয়ে—চালচিত্র একবার মোটামুটি এঁকে নিয়ে তারপর বসে বসে রঙ ফলায়। প্রতিমা প্রথমে একমেটে, তারপর দোমেটে, তারপর খড়ি, তারপর রঙ-পরে পরে করতে হয়। ঈশ্বর বিদ্যাসাগরের সব প্রস্তুত, কেবল চাপা রয়েছে। কতকগুলি সৎকাজ করছে, কিন্তু অন্তরে কি আছে তা জানে না। অন্তরে সোনা চাপা রয়েছে। অন্তরে ঈশ্বর আছেন—জানতে পারলে সব কাজ ছেড়ে ব্যাকুল হয়ে তাঁকে ডাকতে ইচ্ছা হয়।
ইচ্ছা হয়। এই ইচ্ছাই হলো উপায়। কি আছে অন্তরে জানতে হবে। ঠাকুর মাস্টারমশাইকে বলছেন : “অন্তরে কি আছে জানবার জন্য একটু সাধন চাই। গুচ্ছের পড়লে কি হবে! অনেক জানার নাম অজ্ঞান। এক জানার নাম জ্ঞান। অর্থাৎ এক ঈশ্বর সত্য সর্বভূতে রয়েছেন। তাঁর সঙ্গে আলাপের নাম বিজ্ঞান- তাঁকে লাভ করে নানাভাবে ভালবাসার নাম বিজ্ঞান।”
কেম্পিস বলছেন : “Give up this passionate desire for knowlege, because it distracts you and leads you astray.” ঠাকুরের কথা— অনেক জানার নাম অজ্ঞান। কেম্পিস বলছেন : “The soul is not satisfied by words in their thousands, whereas a good life sets the mind at rest, and a pure conscience gives assurance before God.”
মাস্টারমশাইয়ের প্রশ্ন হলো : “সাধন কি বরাবর করতে হয়?”
ঠাকুর বলছেন : “না, প্রথমটা একটু উঠেপড়ে লাগতে হয়। তারপর আর বেশি পরিশ্রম করতে হবে না। যতক্ষণ ঢেউ, ঝড়, তুফান আর বাঁকের কাছ দিয়ে যেতে হয় ততক্ষণ মাঝির দাঁড়িয়ে হাল ধরতে হয়—সেইটুকু পার হয়ে গেলে আর না। যদি বাঁক পার হলো আর অনুকূল হাওয়া বইল তখন মাঝি আরাম করে বসে, হালে হাতটা ঠেকিয়ে রাখে, তারপর পাল টাঙাবার বন্দোবস্ত করে তামাক সাজতে বসে। কাম-কাঞ্চনের ঝড়তুফানগুলো কাটিয়ে গেলে তখন শান্তি।”
যদি প্রশ্ন করি—ঠাকুর! এই ঘোরতর প্রতিযোগিতার যুগে ঈশ্বর অনুধ্যানের সময় কোথায়! কুব্জারা তো সবসময় কু বোঝাচ্ছে, রাই পক্ষে কেউ নেই।
ঠাকুর সঙ্গে সঙ্গে কড়া উত্তর দেবেন—তোমার যদি তাই মনে হয় তাহলে আমার কাছে এসে পাকামো করো না। তোমার সার্কেলে যাও। তুমি ঈশ্বরচিন্তা করবে কি করবে না, সেটা তোমার হাতে নেই। তিনি যদি মনে করেন, তোমার বাপ করবে। জাত সাপে ধরলে তিন ডাকেই শেষ।
জগতের ছয়শ কোটি মানুষ কি তোমার কথায় চলবে? যারা আত্মচিন্তা, মোক্ষচিন্তা করবে তারা সবকালেই করবে। যুগনির্ভর নয়, জীবননির্ভর। শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে দুর্যোধন, দুঃশাসনও ছিল। হিটলার আর আইনস্টাইন একই ঘড়ি দেখতেন। শ্রীচৈতন্যের অদূরেই জগাই-মাধাই। তেলোভেলোর মাঠে জননী সারদা ও দস্যু সাগর সর্দার। দেবী দুর্গা ও মহিষাসুর একই মঞ্চে। একই ছুরি—সার্জেনের হাতে জীবন, দস্যুর হাতে মরণ।
ঠাকুর বলছেন, তাঁর লীলা। অন্ধকার না থাকলে আলোর মহিমা বোঝা যায় না। দুঃখ না থাকলে সুখ বোঝা যায় না। ‘মন্দজ্ঞান’ থাকলে তবে ‘ভালজ্ঞান’ হয়। আবার খোসাটি আছে বলে তবে আমটি বাড়ে ও পাকে। আমটি তয়ের হয়ে গেলে তবে খোসা ফেলে দিতে হয়। মায়ারূপ ছালটি থাকলে তবেই ক্রমে ব্রহ্মজ্ঞান হয়। বিদ্যামায়া অবিদ্যামায়া আমের খোসার মতো। দুইই দরকার।
এই জগতে বিদ্যামায়া, অবিদ্যামায়া—দুইই আছে; জ্ঞান-ভক্তি আছে আবার কামিনী-কাঞ্চনও আছে। তাঁর ইচ্ছা যে খানিক দৌড়াদৌড়ি হয়, তবে আমোদ হয়। অন্নচিন্তা চমৎকারা, কালিদাস হয় বুদ্ধিহারা। জগতের দুই খণ্ড—সংখণ্ড, অসৎখণ্ড। দুই মেরু। যে যে-খণ্ডে থাকে। এস্কিমোকে মরুভূমিতে আনা যায় না, মরুভূমিকে ইগলুতে ঢোকানো যায় না।
যেমন, একটি বেল। খোলা আলাদা, বীজ আলাদা, শাঁস আলাদা একজন করেছিল।
বেলটি কত ওজনের জানবার দরকার হয়েছিল। এখন শুধু শাঁস ওজন করলে কি বেলের ওজন পাওয়া যায়? খোলা বিচি শাঁস সব একসঙ্গে ওজন করতে হবে। প্রথমে খোলা নয়, বিচি নয়—শাঁসটিই সার পদার্থ বলে বোধ হয়। তারপর বিচার করে দেখে—যে-বস্তুর শাঁস সেই বস্তুরই খোলা আর বিচি। আগে ‘নেতি নেতি’ করে যেতে হয়। জীব নেতি, জগৎ নেতি—এইরূপ বিচার করতে হয়। ব্রহ্মই বস্তু, আর সব অবস্তু। তারপর অনুভব হয়, যার শাঁস তারই খোলা- বিচি, যা থেকে ব্রহ্ম বলছ তাই থেকে জীবজগৎ। যাঁরই নিত্য তাঁরই লীলা। তাই রামানুজ বলতেন, জীবজগৎবিশিষ্ট ব্রহ্ম। এরই নাম বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ।
আধার দেখে, ‘নাউয়ের ডোল’টি দেখে যেই মনে হতো ভাল বাদ্যযন্ত্র হবে, তখনই কাছে ডেকে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ উপদেশ দিতেন : “গেরো দিও না, সেলাই করো না, পরদা গুটিও না, দোর-বাক্স চাবি দিয়ে বন্ধ করো না। কাকে তুমি বাঁধতে চাও! বিষয় অথবা সম্পর্ক! সেলাই করে পরবে! কেন কৃপণতা!” দুখচেটে সংসারীর প্রতি অসীম ঘৃণা ছিল তাঁর। পরদা ঝুলেই থাকে। মনকে কেন গুটোতে চাইছ? প্রসারিত কর। পরদার ওপাশে জগৎ- সংসারের কিচির-মিচির, এপাশে তোমার নিভৃত মনের সাধনা। আর তালাচাবি! সে কি—সঞ্চয়, সম্পদ, বিষয়ভাবনা, ভয়, গোপনীয়তা, সন্দেহ, সঙ্কীর্ণতা, অহঙ্কার, তামসিকতা, ব্যাঙের আধুলি। নিজের ভার নিজে নিলে তোমার ভার তিনি নেন কি করে!
কেম্পিস বললেন : “Feed me, for I come hungry to your door; melt my coldness with the fire of your love, and with the brightness of your presence make my darkness light… for you are my only food and drink, my love and joy, my sweetness and all my good.”