চতুর্থ খণ্ড (স্নেহের দীপঙ্কর আচার্য এবং সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়)
পঞ্চম খণ্ড (বন্ধুবর স্নেহপ্রতিম শ্রী নিতীশ রায় ও বউদিকে)
4 of 6

কেউ ঘুমোয় কেউ জাগে

কেউ ঘুমোয় কেউ জাগে

আমার এক পাগলা বন্ধু ছিল। বদ্ধ পাগল নয়। কোনও কোনও ব্যাপারে সাধারণের চেয়ে অসাধারণ। ভূত-প্রেতে বিশ্বাসী, অথচ ভীতু নয়। দিনে অলস। রাতে ভীষণ কর্মক্ষম। যত রাত বাড়ে, ততই তার কাজের ঘটা বাড়ে। বেশির ভাগ রাত সে জেগেই কাটাত। তখন সে এক আনন্দময় মহাপুরুষ। মুখ-চোখের চেহারাই পালটে যেত। আমাদের যেমন দিন শেষ হলেই মন খারাপ হয়ে যায়, বিশেষত শীতকালে, তার তেমনি রাত শেষ হলেই মন খারাপ হয়ে যেত। বিমর্ষ হয়ে পড়ত। বলত, আবার সেই ক্যাটকেটে রোদ উঠবে। খাখা করে কাক ডাকবে। সারা পৃথিবী জেগে উঠে ক্যাচোর ম্যাচোর শুরু করবে। এমন রাত-বিলাসী মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। শুনেছি কারুর কারুর স্বভাব-চক্র এই রকম বেসুরে বাঁধা থাকে। কেউ দিবসের প্রাণী, কেউ রাতজাগা প্রাণী, অনেকটা প্যাঁচা অথবা বাদুড়ের মতো। মহাপুরুষরা বলছেন, ঘুম একটা অভ্যাস। নিদ্রাকেও জয় করা যায়। নেপোলিয়ান রণস্থলে ঘোড়ার পিঠেই অল্প একটু ঘুমিয়ে নিতেন। রোমেলও তাই। মহাত্মা গান্ধী ঘণ্টা কয়েক মাত্র বিশ্রাম নিতেন।

আমার সেই পাগলা বন্ধু হিসেব করে দেখিয়েছিল, চব্বিশ ঘণ্টার আটঘণ্টা কর্মস্থালে, তিনঘণ্টা পথে দু-ঘণ্টা স্নান আহার কাপড়জামা ধোলাই হ্যামা, ত্যামা, আটঘণ্টা, ঘুম। একুশ ঘণ্টা এইভাবে গেল, হাতে রইল আর মাত্র তিন ঘণ্টা। সেই দুর্লভ তিনটি ঘণ্টা ও খেয়ে নেবে পরিবার পরিজন প্রতিবেশী। তাহলে তোমার নিজের জন্যে রইল কী? দিন গেল বৃথা কাজে রাত্রি গেল নিদ্রায়। ঘুমিয়েই জীবনের অর্ধেক পরমায়ু ক্ষয় হয়ে গেল।

কখনও কখনও পূর্ণিমা রাতে সে আমার কাছে ছুটে আসত, ‘কী রে আজ রাতেও তুই ঘুমোবি না কি? ‘হাই তুলতে তুলতে বলতুম, ‘বেশ ঘুম পাচ্ছে, এবার শুলেই হয়। ‘তুই এমন চাঁদিনী রাতেও ঘুমোবি? তোর কী কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই রে? পূর্ণিমা রাতে কেউ ঘুমোয়! অমাবস্যার রাত হলে কিছু বলার ছিল না। শ্রীকৃষ্ণ বেঁচে থাকলে এমন রাতে কী করতেন বলত? যমুনার তীরে গিয়ে কদমগাছের তলায় বসে বাঁশিতে ফুঁ দিতেন।’

‘কাল অফিস আছে ভাই। আমি তো আর কৃষ্ণ নই। আমার জন্যে কোনও যশোদা শিকেতে ননী ঝুলিয়ে রাখবেন না। খেটে রোজগার করতে হবে।’

‘সে তো আমাকেও হবে।’

তারপর তার করুণ মিনতি, ‘আজ আর ঘুমোসনি। জানিস জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে এক বৃদ্ধ খাজাঞ্চি ছিলেন। দোতলার বারান্দায় চাঁদের আলো লুটিয়ে আছে জাফরির জালিকাটা ছায়া নিয়ে। আস্তে আস্তে চোরের মতো ঘরের দরজা খুলে তিনি বেরিয়ে এলেন। মাঝরাত। নিস্তব্ধ পৃথিবী। চারপাশে চাঁদের আলোর ফিনিক ফুটছে। এপাশে ওপাশে তাকিয়ে দেখলেন কেউ কোথাও নেই। ধেইধেই করে নাচতে লাগলেন। স্থূল শরীর। মেঝেতে কাছা-কোঁচা লুটোচ্ছে। সর্ব অঙ্গে চাঁদের আলো মেখে তিনি ধাপুস ধুপুস নাচছেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে একদিন ধরা পড়ে গিয়েছিলেন। ‘আপনি নাচছেন কেন?’ ‘কী করব বাবা, আমার যে বড় নাচ পাচ্ছে।’ সেই প্রৌঢ় চন্দ্ররসিক খাজাঞ্চির মতো আমারও নাচ পায়। মানুষ চাঁদের দেশ থেকে ঘুরে এল আর আমরা একটা রাত জেগে কাটাতে পারব না!’

রাত না জাগলে রাতের রহস্য বোঝা যায় না। গভীর রাতে পৃথিবীর আর এক রূপ। দিনে আমরা কথা বলি, কাজ করি। রাতে পৃথিবী কথা বলে। নিজের ইতিহাস লিখতে বসে। অনেক বয়েস হল। কোটি-কোটি সন্তানের জননী। কোল কখনও খালি হয় না। যে আকাশে শান্তির শ্বেত পায়রা উড়ছে, সেই আকাশেই বিষাক্ত ছাতা মেলেছে পারমাণবিক বিস্ফোরণের তেজস্ক্রিয় বস্তুকণা। সবাই পৃথিবীর সন্তান, কেউ দানব, কেউ দেবতা।

 সেদিনও ছিল পূর্ণিমার রাত। আমি আর আমার বন্ধু, দুজনে বসে আছি গঙ্গার ধারে পোড়ো ঘাটে। পাশেই একটি শিবমন্দির। সামনে বয়ে চলেছে বৈশাখের গঙ্গা। পরপারে মন্দিরের চুড়ো আকাশ ছুঁয়ে আছে। কেউ কোথাও নেই। চারপাশ নির্জন। মাঝে মাঝে বাতাসে চাঁদের আলো ঝলসানো গাছের পাতা থিরথির করে কাঁপছে। দুজনে বসে বসে ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবছি। আজ গেলে কাল কী হবে, কাল গেলে পরশু কী হবে? দুজনেই তখন বেকার। পালতোলা একটা নৌকো দক্ষিণ থেকে উত্তরে ভেসে গেল রাজহাঁসের মতো। ওপারের কোথাও পেটা ঘড়িতে দশটা বাজল। ভাবছি এবার উঠতে হবে। এমন সময় পেছনের ডালে বসে চ্যাঁ, চ্যাঁ করে একটা প্যাঁচা তিনবার ডেকে উঠল। ডাকের সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত এক কাণ্ড হল। আমাদের চোখের সামনে ধীরে ধীরে একটা যেন কুয়াশার আঁচল নেমে এল। এপার ওপার সব একাকার। শরীর পাথরের মতো ভারী। নড়বার চড়বার ক্ষমতা নেই। পলতে-ফুরোনো বাতির মতো চেতনার দীপ নিবে গেল। আর জানি না। কী যে কী হয়ে গেল। আমাদের চেতনা যখন ফিরে এল, তখন দেখি আমাদের কোমর পর্যন্ত জলের তলায়। জোয়ার এসে গেছে বহুক্ষণ। নদী শ’খানেক হাত ওপরে উঠে এসেছে। একেবারে টুইটম্বুর। ঢেউয়ের তালে তালে আমাদের শরীর ডাইনে বামে দুলছে। আচ্ছন্ন ভাব কাটতে আর একটু দেরি হলেই আমরা ভেসে চলে যেতুম। ওপারের পেটা ঘড়িতে ঢংঢং করে দুটো বাজল। নিটোল গোল একটি চাঁদ পশ্চিমে ঢল নিয়েছে। জল যেন তরল কাচ। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে জোয়ারের স্রোত ছুটছে। ঘাটের পইঠেতে ঢেউ এসে উথলে পড়ছে। অদ্ভুত তার শব্দ। নদী যেন রাতের সঙ্গে কথা বলছে। দূর থেকে বাতাসে স্পষ্ট ভেসে এল, বলো হরি, হরি বোল।

আমরা দুজনে কোনও মতে উঠে দাঁড়ালুম। পায়ে চটি জোড়া আর পায়ে নেই। শরীর তখনও বেশ ভারী। জামাকাপড় ভিজে সপসপে। চেতনা তখনও আচ্ছন্ন। পরস্পরের মুখে একই প্রশ্ন—কী হল বলো তো? কী হয়েছিল বলো তো?

আজও সে প্রশ্নের জবাব মেলেনি। রাতের সব রহস্যের জবাব দিনের ভাণ্ডারে নেই। দিনে দৃষ্টি যদি এক মাইল দৌড়ায়, রাতে মাত্র হাতখানেক। যেখানে কোনও রহস্যই নেই, সেখানেও রহস্য থইথই করে।

গভীর রাতে একটি মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তের অভিজ্ঞতা আজও মন থেকে মুছে যায়নি। সাবেক কালের পুরোনো একটা বাড়ির ছাদে আমরা দুজনে বসে আছি। মাথার ওপর রাতের আকাশ থমথম করছে। চাঁদির টুকরোর মতো একগাদা তারা। কোনওটা স্থির, কোনওটা দপদপ করছে। নীচে দোতলার একটি ঘরে যমে মানুষে টানাটানি চলেছে। ওই বাড়ির বড় মেয়ে রাখী তিন মাস হল অসুস্থ। সেদিন ছিল খুব বাড়াবাড়ির দিন। একটু আগেই দেখে এসেছি, মাথার কাছে অভিজ্ঞ দুজন ডাক্তার বসে আছেন। অক্সিজেন চলছে। ঘরে, বাইরের বারান্দায়, থামের অন্ধকার আড়ালে আত্মীয় স্বজনেরা কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে। ফিসফিস কথা। একটুআধটু চুড়ির শব্দ, মাঝে সাঝে। ঘরে কখনও হট ওয়াটার ব্যাগ যাচ্ছে। কখনও বেরিয়ে আসছে জলের পাত্র। তাতে ভাসছে ইনজেকশানের খালি অ্যাম্পুলস। এই সব দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে আমরা দুজনে ছাদে চলে এসেছি। সকলেই যেন অপেক্ষা করছেন। মহামান্য একজন কেউ আসবেন! অত্যন্ত প্রতাপশালী নিষ্ঠুর অথচ মাননীয়। যাঁর আগমনকে সহজে কেউ ঠেকাতে পারে না। যাঁর কাছে কৃপাভিক্ষা অর্থহীন।

রাখী খুব গুণী মেয়ে ছিল। সুন্দরী। একই গুরুর কাছে আমরা গান শিখতুম। মাসছয়েক আগে মহাজাতি সদনের অনুষ্ঠানে গান গেয়ে খুব নাম করেছিল। মঞ্চে ওঠার আগে আমার কাছে তার লেডিজ কোট, আর হাতব্যাগ রেখে গিয়েছিল। দুর্লভ সম্পদের মতো বুকে ধরে বসেছিলুম। আমার সে বয়েসটা একটু গোলমেলে ছিল। সামান্য বাতাস। কী একটু সৌরভ, কী এক চিলতে চাঁদের আলো, কী একটু মিষ্টি হাসিতে মনের দরজা খুলে যেত। একটা পথ এগিয়ে যেত দূর থেকে দূরে। নদী, পর্বত, জল, উপত্যকা পেরিয়ে সোনালি কোনও এক দিগন্তে।

অন্ধকার নির্জন ছাদে আলসের ওপর বসে আছি। রাত হেঁটে চলেছে, জরার দিকে। ছাদটা রাখীর খুব প্রিয় ছিল। আলসেতে হেলান দিয়ে দুপুরে চুল শুকত। গ্রীষ্মের রাতে মাদুর বিছিয়ে গুনগুন করে গান শোনাত। টবে টবে বেল আর রজনীগন্ধা গন্ধ ছড়াত। মাঝে মাঝে হেসে উঠত জলতরঙ্গের সুরে।

সেই সব মুহূর্তের কথা ভাবছি। মন বড় বিষণ্ণ। এই রাত তারা নিয়ে ঘুরে ঘুরে আসবে। চাঁদ চিরকাল এসে উঠবে শুক্লপক্ষের আকাশে। সবই থাকবে। থাকব না আমি, থাকবে না রাখী। অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসছে। মন ঘোলাটে হয়ে উঠছে চিন্তায়। অন্যের পরমায়ু হরণ করে আর একজনকে বাঁচাবার কায়দা তান্ত্রিকরা শুনেছি জানতেন। ছেলেবেলায় সিঁটিয়ে থাকতুম যেই শুনতুম আজ রাতে নিশি ডাকবে। মুখকাটা একটি ডাব হাতে মাঝরাতে পাড়ায় হেঁকে যাবে অমুক আছ অমুক। যে উত্তর দেবে, কে? অমনি ডাবের মুখটি চাপা দিয়ে দেবে। একজনের প্রাণ চলে এল ডাবের জলে। সেই উজল খেয়ে বেঁচে উঠবে আর একজন। আমি রাখীর জন্যে সে বয়েসে প্রাণ দিতে পারতুম।

ছাদে বিশাল একটা টব ছিল। টবে মনসা গাছ। দেড় মানুষ সমান ঝাঁকড়া হয়ে উঠেছে। হঠাৎ সেই দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলুম। সাদা মতো কে একজন দাঁড়িয়ে। ভালো করে তাকাতেই দেখি রাখী দাঁড়িয়ে আছে, সাদা সিল্কের শাড়ি। এলো চুল একেবারে সুস্থ, উজ্জ্বল চেহারা। রোগের কোনও চিহ্ন নেই। আনন্দে বুক ছলকে উঠল। রাখী, তুমি ভালো হয়ে গেছ? পর মুহূর্তেই নীচে কান্নার রোল উঠল। মনসা গাছের দিকে তাকিয়ে দেখি, কেউ কোত্থাও নেই। রাখী চলে গেল। সেই যে গেল আর এল না। অথচ আমি এখনও বেঁচে আছি।

আমাকে যে রাত জাগতে শিখিয়েছিল, সেও আর নেই। সঙ্গীহীন আমি জেগে থাকি। কখনও শুনি পাখির ছানা করুণ সুরে ডাকছে। কোথাও একটা গরু একবার মাত্র ডেকেই আবার ঘুমিয়ে পড়ল। শিশু কাঁদছে ককিয়ে ককিয়ে। মা ঘুম-জড়ানো সুরে ভোলাবার চেষ্টা করছে।

আকাশের একেবার উত্তর-সীমায় এই গভীর রাতে হিমালয় জেগে আছে। শিখরের পর শিখরের তরঙ্গ। ক্ষুদ্র মানুষ যখন চার দেওয়ালের নিরাপদ আশ্রয়ে, সাত বাই চার খাটে, তখন বিশাল শব্দ, হিমবাহ নেমে আসছে। গোমুখী থেকে গঙ্গা নেমে আসছে সধূম স্রোতে। বিদ্যুৎ ঝিলিক মারছে। কোথাও একটি পাহাড়ি নদী নুড়ি-পাথরের সঙ্গে প্রাণের কথা কইতে কইতে ছোট, চরণের কবিতা লিখতে লিখতে এগিয়ে চলেছে নিরুদ্দেশে। গহন অরণ্যে একটি মৌচাকে মধু তৈরি হচ্ছে। এখানে আমি যখন জেগে তখন অন্য কোনও এক শহরে অনিকেত এক বৃদ্ধ ভীষণ শীতে হেঁটে চলেছে। জানে না কোথায় যেতে হবে। পৃথিবী নিদ্রাতুর, পাথরের দেওয়াল-ঘেরা জলাশয়ে চাঁদ নেমেছে অবগাহনে। দেহাতী মা সেই চন্দ্রমুখ দেখে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। গত শীতে কোল খালি করে তার শিশুটি চলে গেছে। এ যেন তারই মুখ। রাত আছে তাই ফুল ফোটা আছে। ধানে দুধ জমে রাতে। রাত আছে তাই যোগীরা আছেন। ভোগী যখন বেহুঁশ, যোগী তখন মহাকালের সঙ্গে হাত মেলান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *