কেঁচো খুঁড়তে সাপ – সুপ্রিয়কুমার বিশ্বাস

কেঁচো খুঁড়তে সাপ – সুপ্রিয়কুমার বিশ্বাস

ঘরে ঢুকে কঙ্কণ চৌধুরীর কাণ্ড দেখে তো আমি অবাক। দেখি, ও ওর নড়বড়ে টেবিলখানায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে নোংরা এক কাগজে কি সব হিজিবিজি আঁকছে।

সমস্ত ঘরটা অগোছালো। এলোমেলো বিছানা। টেবিলে একরাশ ফাইল। ফাইলগুলো সাদা ফিতে দিয়ে বাঁধা। ফাইলের পাশে লম্বা এক দড়ি। ঘরের আরেক কোণে কয়েকজোড়া ক্লাইম্বিং বুট ও তুষার গাঁইতি।

কঙ্কণ চৌধুরীর পরনে রাতের পোশাক। চুল উষ্কোখুষ্কো। দেহে রাত জাগার ক্লান্তি। অথচ দিনকতক আগে যখন ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তখন আক্ষেপ করে ও বলেছিল, বুদ্ধির গোড়ায় মরচে পড়ে গেল বন্ধু। শান দেওয়ার মতো কোনো জিনিস পাচ্ছি না।

রহস্যসন্ধানী এই বন্ধুটির জন্য যথেষ্ট দুঃখ হয়েছিল আমার। মনের মতো কাজ না পেয়ে বেচারা ছটফট করছে। সেদিন তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলাম, দুঃখ কোরো না বন্ধু। কথায় বলে, চৈত্র মাস মরা মাস। একটু ধৈর্য ধরো, বুদ্ধির চমক দেবার মতো সুযোগ নিশ্চয় পাবে।

আমার কথা এত তাড়াতাড়ি ফলবে ভাবতে পারিনি। কঙ্কণ ওর মনের মতো কাজ পেয়েছে। রাত জেগেও তাই ওকে ভারি উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। দুপুরে স্নানাহার কিছুই হয়নি। অথচ ওকে দেখে তা বোঝার উপায় নেই। বুঝলাম, একটা জটিল ব্যাপার নিয়ে কঙ্কণ খুব ব্যস্ত। কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝলাম না, ওই ছেঁড়া কাগজটাতে এমন কি আছে যে কঙ্কণ তার পারিপার্শ্বিক সমস্ত অবস্থা ভুলে বসে আছে? আমি এসেছি, অথচ ওর খেয়াল নেই। নকশাগুলো নিয়ে এমনই মগ্ন, যেন ওতে ভারতের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। ঘরেও এমন সব জিনিস দেখলাম, যা ওর ঘরে অন্তত বেমানান। ক্লাইম্বিং বুট, তুষার গাঁইতি, রক ক্লাইম্বিং রোপ। পাহাড়ের সঙ্গে কঙ্কণের কোনো সম্পর্ক ছিল, তা আমার জানা ছিল না। তার ওপর ওই সব বিদঘুটে নকশা।

ঠাট্টা করে বললাম, এক্সপিডিশনে যাচ্ছো বুঝি?

কঙ্কণ সে কথার কোনো জবাব না দিয়ে টেবিল থেকে হিজিবিজি আঁকা নোংরা কাগজখানা হঠাৎ আমার চোখের সামনে মেলে ধরল। বলল, কিছু বুঝছিস?

অক্ষমতা জানিয়ে বললাম, না।

কঙ্কণ তখন নকশার এক জায়গায় আঙুল দেখিয়ে বলল, এই যে এটা দেখছিস, এটা ছিল ওদের বেস ক্যাম্প। আঙুলটা খানিক ওপরে উঠিয়ে বলল, এইখানটায় ওরা প্রথম শিবির গড়েছিল। এই যে এটা, এটা ওদের দ্বিতীয় শিবির। আঙুলটা একটু সরিয়ে নিয়ে বলল, থার্ড ক্যাম্প বসেছিল এখানে। আর এটাই ছিল শেষ ক্যাম্প। এই যে দূরে খাদ মতো দেখছিস, এইখানে ক্যাপ্টেন হারিয়ে গিয়েছিলেন। পাশে একটু তফাতে ঢিবির মতো দেখছিস, ওইখানেই ওরা ইয়েতি দেখেছিল।

আমার তো মাথা ঘোরার যোগাড়। এসব কি বলছে কঙ্কণ? প্রথম শিবির—দ্বিতীয় শিবির….ইয়েতি—ওর মুখ থেকে এ সবই নতুন শুনছি। অথচ কিছুই ও ভেঙে বলছে না। রহস্য কাহিনীর মতো এক বিরাট ধাঁধায় ফেলে রেখে দিয়েছে।

কঙ্কণের হাতে এখন ফাইলের পাশে রাখা সেই লম্বা দড়িটা। দড়িটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কি যে দেখছে, ওই জানে। একসময় ওই দড়িখানাই আমার সামনে নিয়ে এল : দেখ তো ভালো করে, কিছু দেখতে পাস কিনা!

ভালো করে দেখে বললাম, জমাট বাঁধা লাল রং।

উঁহু, লাল রং নয়। রং কখনো জমাট বাঁধে না।

তবে?

রক্ত।

রক্ত!—অবাক হয়ে বললাম, দড়িতে রক্ত এল কি করে?

সেইটেই তো আসল ভাবনা বন্ধু। কঙ্কণ একগাল হেসে বলল, রক্ত যদি না থাকত, তবে কোনো সমস্যাই হত না। রক্তটাই সব গোল বাধাল। এখন এটাকে কোনোমতে অ্যাকসিডেন্ট বলতে পারছি না। লীনার ধারণাই শেষ পর্যন্ত ঠিক হল, এটা মার্ডার।

কঙ্কণের হেঁয়ালির অর্থ তখনও আমার কাছে দুর্বোধ্য। এভারেস্ট….অ্যাকসিডেন্ট…. ক্যাপ্টেন….লীনা—এরা কে? কি এদের পরিচয়? মাউন্ট এভারেস্টের সঙ্গে এদের সম্পর্কটাই বা কি?

কঙ্কণ আমার দিকে চেয়ে হেসে ফেলল। বলল, কি, বুঝতে পারলি না তো?

মাথা নেড়ে অক্ষমতা জানালাম। কঙ্কণ তখন টেবিলে রাখা ফাইলখানা আমার হাতে দিয়ে বলল, এটা পড়। সব প্রশ্নের জবাব পাবি। আমি বরং একটুখানি ঘুরে আসি।

কোথায় যাবে?

এই দড়িটার ব্লাড টেস্ট করাতে হবে। তারপর ভৌমিকের সঙ্গে একবার দেখা করা দরকার। কতগুলো জরুরি কথা আছে। শোন তুই কিন্তু চলে যাসনে, তোকেও দরকার হবে।

দড়ি নিয়ে কঙ্কণ চলে গেল। হাতে রাখা ফাইলখানা খুলে বসলাম। ইঙ্গ—ভারত যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত মাউন্ট এভারেস্ট অভিযানের এক করুণ কাহিনি—

কঙ্কণ এ কাহিনির নাম দিয়েছে : ‘দুর্ঘটনা না হত্যা?’

সকাল থেকে আর সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। চারিদিকে ঘন কুয়াশা। দু’হাত দূরের জিনিস চোখে পড়ে না। অত্যন্ত সন্তর্পণে ওদের পা ফেলতে হচ্ছিল। অথচ কাল যখন ওরা নামচে বাজার থেকে রওনা হয়েছিল, তখন আকাশ পরিষ্কার ছিল। কোথাও একটুকরো মেঘের চিহ্ন ছিল না। ডেনেস খুশি হয়ে বলেছিলেন, যদি দিনকয়েক এমন আবহাওয়া থাকে, তবে আমরা এভারেস্টে উঠতে পারবই। ‘পারবই’ কথাটা তিনি অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলেছিলেন। তার কারণ আছে। শেরপারা বলেছিল, জুলাই—আগস্ট মাসে এমন পরিষ্কার আকাশ পাওয়া ভাগ্যের কথা। তখন হিমালয়ে নেমে আসে বর্ষা। হিমালয়ের বর্ষা বড় অস্বস্তিকর। একবার শুরু হলে থামতে চায় না। হিমালয় তখন দুর্গম, অজেয়।

এদিক দিয়ে ডেনেস ভাগ্যবানই বটে। ঈশ্বর তাঁর প্রতি সদয় হয়েছেন। এখনো পর্যন্ত কোনো অঘটন ঘটেনি। সবাইকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। শেরপারাও খুশি।

মেঘমুক্ত আকাশে বিরাট থালার মতো চাঁদ উঠেছিল। পূর্ণিমার চাঁদ। চারিদিকে জমাট বাঁধা বরফের স্তূপ। আর তাতে অঝোর ধারায় জ্যোৎস্নার প্লাবন। কঠিন বরফেও যে এত সৌন্দর্য থাকতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল। হিমালয়ের রূপই বুঝি এই রকম। প্রকৃতি এখানে তার অজস্র সম্ভার নিয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকে। এ ডাককে অস্বীকার করার উপায় নেই। এ যেন নিশির ডাক। একবার যে এর ডাক শুনেছে, না এসে পারেনি। ছুটে এসেছে। প্রকৃতির রূপ—সুধা পান করেছে আকণ্ঠ। তবু তৃপ্তি পায়নি, আবার এসেছে। একবার নয়, বারবার।

কঠিন বরফ স্তূপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে হিমালয়ের পুরুষ—সিংহ মাউন্ট এভারেস্ট। সেই মুহূর্তে তাকে অত্যন্ত শান্ত দেখাচ্ছিল। ঠিক যেন কোনো ধ্যান—মগ্ন ঋষি পার্থিব জগৎকে ভুলে প্রকৃতির কোলে তপস্যায় রত। অনন্ত কালের তপস্যা তাঁর।

ডেনেস শ্রদ্ধা জানালেন মাউন্ট এভারেস্টকে। মনে মনে বললেন, তোমার তপস্যা ভাঙতে এসেছি গিরিরাজ। ক্ষমা কোরো আমাদের।

এ সবই কালকের ঘটনা।

আজ সকালে, অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত। কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেছে। এর সঙ্গে রয়েছে তুষার ঝড়।

এক নিমেষে ডেনেসের আশা হতাশায় পরিণত হয়। কাল যে কথাটা জোর দিয়ে বলেছিলেন, আজ আর তেমন করে বলতে পারেন না। একটা সন্দেহের দোলায় দুলতে থাকেন তিনি।

আসলে তিনি জানেন না, হিমালয়ের ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। কেননা, প্রতি মুহূর্তে এ রূপ বদলায়। সকালের সোনালি আকাশে মুহূর্তে কালো মেঘ এসে জমাট বাঁধতে পারে। কোনো নিশ্চয়তা নেই। বৈচিত্র্য ভরা হিমালয় তাই যত বেশি সুন্দর, তার চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর।

সকালে এলভিন ও প্রবাল গিয়েছিল ১নং শিবিরের সন্ধানে। ফিক্সড রোপ লাগিয়ে প্রথমে আইস এক্স দিয়ে ধাপ কেটে কেটে ওরা এগিয়েছিল। সময় লেগেছিল অনেক। পরিশ্রমও যথেষ্ট। কিন্তু এত পরিশ্রমও ফল দেয়নি। সামনে ছিল বরফের খাড়া প্রাচীর। শিবির স্থাপন অসম্ভব। ফিরে আসতে হয়েছিল সবাইকে। অতি সন্তর্পণে ধীর গতিতে ওরা নামছিল। হঠাৎ এরই মাঝে উঠল তুষার ঝড়। প্রথমে পেঁজা তুলোর মতো, তারপর বিরাট বিরাট বরফের চাঁই। দেহের ভারসাম্য রাখা কঠিন। চোখ ঝাপসা হয়ে উঠেছে। এলভিন ও প্রবাল হোঁচট খেয়েছে। পড়েছে কঠিন বরফের ওপর। শেরপারাও পারে নি দেহের ভারসাম্য রাখতে। পানাং দোরজের গায়ে গিয়ে পড়েছে। ফলে একাধিকবার ফিক্সড রোপে টান পড়েছে। সবচেয়ে কষ্ট হয়েছে প্রবালের। এই তার প্রথম পর্বতাভিযান। দার্জিলিং মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে বেসিক ট্রেনিং নেবার পর ডাঃ কোহলির পরামর্শে এই অভিযানে অংশ গ্রহণ করে। কিন্তু এভারেস্ট ওকে নিরাশ করেছে। প্রথম ধাক্কায় প্রবাল আহত। তাই হতাশাটা ওর বেশি। এলভিন কথা না বললেও ওর চোখে মুখে নৈরাশ্যের চিহ্ন। শুধু নিরাশ হয়নি দোরজে, পানাংএর মতো শেরপারা। এরা হিমালয়কে দেখেছে বহুবার, বহুরূপে। এর চেয়েও সাংঘাতিক বিপদে এরা নির্ভয়ে নিজেদের কর্তব্য করে গেছে। মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়েও অবিচল ও সংযত থেকেছে। তাই প্রতিটি অভিযানে এদের প্রয়োজন অপরিহার্য। এরা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষতে জানে। পর্বতারোহীরা যখন সাহস হারায়, তখন এরাই সাহস যোগায়। বিপদে—আপদে সর্বক্ষণ ‘সাহেবের’ অনুগত থাকে। এদের বাদ দিয়ে হিমালয় অভিযান বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

দোরজে প্রবাল ও এলভিনকে আশ্বাস দিয়ে বলেছে, ঘাবড়ানে কি কোই বাত নেহি সাব। পহাড় মে অ্যাইসা হোতাহি হ্যায়। দেখিয়েগা সব ঠিক হো যায়েগা।

কিন্তু সব ঠিক হয়নি। চার ঘণ্টা প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করেও ওরা হেরে গিয়েছিল। জীবনকে মৃত্যুর কাছে বন্ধক রেখে ফিরে এসেছিল, একরাশ ক্লান্তি নিয়ে।

ডেনেস কিন্তু অবাক হননি। এভারেস্টকে তিনি চেনেন। এই নতুন নয়। বহুবার বহু অভিযাত্রীকে এভারেস্ট ফিরিয়ে দিয়েছে। ১৯২০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত যতগুলো অভিযান হয়েছে, তার প্রত্যেকটিতে এসেছে প্রচণ্ড বাধা। মর্মান্তিক সে কাহিনি। কেউ জীবন হারিয়েছে, কেউ পাগল হয়েছে, কেউ পঙ্গু হয়েছে আমৃত্যু। তবু হিমালয়ের আকর্ষণকে উপেক্ষা করতে পারেনি। যুগ যুগ ধরে অভিযাত্রী এসেছে। হিমালয়কে দু—চোখ ভরে দেখেছে। আবার এসেছে, একবার নয়, বারবার। যারা হেরে ফিরে গিয়েছে, তারা এসেছে পরের বার নতুন উদ্যমে, নতুন উৎসাহে।

ডেনেসও তাই এসেছেন। হিমালয় প্রেমিক মাইক ডেনেস। এ অভিযানের দলনেতা। শক্তসমর্থ চেহারা। লম্বাটে গড়ন। দাড়ি—গোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। নীল রঙের উজ্জ্বল চোখদুটোতে আত্মবিশ্বাসের ভাব পরিস্ফুট। এর সঙ্গে রয়েছে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। এই হল তাঁর আজকের পরিচয়। ভারতে ব্রিটিশ রাজত্বকালে গোয়েন্দা বিভাগের জবরদস্ত অফিসার ছিলেন। বাংলাদেশে তখন সন্ত্রাসের যুগ। জেলায় জেলায় ইংরেজ অফিসার খুন হচ্ছে। বাংলার ঘরে ঘরে প্রাণ উৎসর্গ করার প্রতিযোগিতা চলছে। বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত, দীনেশ গুপ্ত বাঙালি ছেলের কাছে রূপকথার নায়ক। গোটা বাংলায় তারা আগুন জ্বালিয়েছে। সে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র দেশে। ইংরেজ গভর্নমেন্ট দিশেহারা। ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় করার মতো যাকে পাচ্ছে জেলে পুরছে। তবু ক্ষান্তি নেই। বিপ্লবীরা যেন রক্তবীজের ঝাড়। মাটিতে রক্ত পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন বিপ্লবী জন্ম নিচ্ছে। অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত সব এক একজন স্নিগ্ধপুরুষ। নতুন মৃত্যুকে ভয় নেই। শত্রু নিধনে হাত কাঁপে না। নির্ভীক পুরুষ—সিংহ।

সেদিন ছিল রবিবার। ডেনেস সানডের ছুটি উপভোগ করছেন তাঁর বাংলোয় বসে। এমন সময় আলতাফ গাড়ি নিয়ে এসে হাজির। আলতাফ যা নিবেদন করল তার সারমর্ম এই যে, ভোর নাগাদ যখন বন্দীদের প্রাতঃকৃত্যের জন্য সেল থেকে বাইরে নিয়ে আসা হয়, ঠিক তখনই বন্দিরা অতর্কিতে পুলিশকে আক্রমণ করে।

আলতাফের কথা শুনে ডেনেস মনে মনে হাসলেন। কারণ তিনি এ যাবৎ দেখে এসেছেন পুলিশই বিনা প্ররোচনায় গুলি চালাতে অভ্যস্ত। বন্দীদের যেভাবে রাখা হয়, তাতে আক্রমণ করা দূরে থাক, আত্মরক্ষা করাটাই কঠিন ব্যাপার। সেক্ষেত্রে তারা পুলিশকে আক্রমণ করে কি করে?

ডেনেস মুখে কিছু বললেন না। আলতাফের কথা মন দিয়ে শুনলেন। আলতাফ জানাল, কয়েদিরা জেলারের ঘরে ঢুকে টেলিফোনের তার কেটে দেয়। সুপারকে মারধোর করে। বাধ্য হয়ে টমাস সাহেব গুলি চালাবার আদেশ দেন। কিন্তু তার আগেই দুশমনের গুলিতে প্রাণ হারান।

ডেনেস অবাক না হয়ে পারলেন না। বন্দিদের হাতে পিস্তল আসে কি করে? তবে কি কোনো সুড়ঙ্গপথে—

কিন্তু আলতাফ সে সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে বলল, দুশমনেরা পুলিশের কাছ থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নিয়েছিল।

এতক্ষণে ডেনেস পরিষ্কার বুঝলেন, পুলিশই প্রথম গুলি চালিয়েছিল। তিনি আর দেরি না করে জামা—কাপড় পরে রাজশাহি জেলে এসে পৌঁছোলেন। কিন্তু ততক্ষণে হাঙ্গামা শেষ। একজন হাঙ্গামাকারী বাদে সবাই ধরা পড়েছে। টমাসের বুকে গুলি লেগেছে। তার অত্যাচারী মুখটা কেমন পাংশুটে দেখাচ্ছে।

সেই দিন সন্ধেয় কমিশনারের বাংলোতে মিটিং বসল। ফেরার হয়েছে পরিতোষ রায়। উত্তরবঙ্গের দুর্ধর্ষ বিপ্লবী। টমাসকে ওই গুলি করেছে। সাতদিন ধরে রাজশাহি আর মালদহে অনুসন্ধান চালিয়েও ওর খোঁজ পাওয়া গেল না। যেন হাওয়ায় উবে গেছে। লোকটার নাকি কি সব অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। যে কোনো ছদ্মবেশ ধারণে তার জুড়ি মেলা ভার। ছ’ বছর ধরে গোয়েন্দা পুলিশের নজর এড়িয়ে লোকটা খুন—রাহাজানি করে আসছিল। ধরা পড়ল দলের একজনের বিশ্বাসঘাতকতায়। কিন্তু ইংরেজ গভর্নমেন্টও ওকে ধরে রাখতে পারল না। টমাসকে গুলি করে পালিয়ে গেল।

এমনি করে ছ’ মাস কেটে গেল। হঠাৎ একদিন গোপনসূত্রে খবর পেয়ে ডেনেস দলবল নিয়ে এলেন দার্জিলিংয়ের টাইগার হিলে। এইখানেই দেখলেন এভারেস্টকে। হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টকে। চোখ ঝলসানো রূপ। এ রূপের তীব্র আকর্ষণ। এ আকর্ষণকে উপেক্ষা করতে পারলেন না ডেনেস। মনে মনে সঙ্কল্প করলেন, এভারেস্টের শীর্ষে তিনি আরোহণ করবেন। এভারেস্টের ঔদ্ধত্যকে পদানত করবেন। তিনি হবেন বিশ্বের প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী বীর।

তিনদিন অপেক্ষা করার পর দেখা পেলেন পরিতোষ রায়ের। সাত হাজার ফুট উঁচুতে লড়াই হয়েছিল মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট। শেষে বুকের রক্ত দিয়ে পরিতোষ রায় প্রমাণ করল স্বাধীনতার ইতিহাসে সে অমর। ডেনেসও মুগ্ধ হলেন তার বীরত্ব দেখে। লড়াইয়ে তাদের পক্ষে একজন পুলিশ নিহত ও তিনজন আহত হল। ডেনেস ভেবেই পেলেন না, ওই পাতলা ছিপছিপে লোকটার এত সাহস, এত প্রাণশক্তি কোথায় লুকিয়ে ছিল। আসলে ডেনেস তো জানেন না, মানুষের পুরুষত্ব থাকে মনে, দেহে নয়। মনই পারে পুরুষত্বের আগুন জ্বালাতে। দেহ নিমিত্ত মাত্র।

সাবাস বীর! মনে মনে শ্রদ্ধা জানালেন তিনি। দুঃখ করলেন, এই মহান বিপ্লবীর অকালমৃত্যুর জন্য। অথচ উপায় নেই। এটা তাঁর ডিউটি।

আর তাঁর এই ডিউটির জন্য তিনি পেলেন পুরস্কার। তাঁর প্রমোশন হল। কিন্তু তখন চাকরির প্রতি মোহ হারিয়েছেন তিনি। শয়নে—স্বপনে শুধুই এভারেস্ট। ডেনেস স্বপ্ন দেখেন। সাফল্যের স্বপ্ন।

রাজশাহিতে ফিরে এলে কমিশনার সাহেব তাঁকে ডেকে পাঠালেন।

সেদিন সকালবেলা। দরজা ঠেলে কমিশনারের ঘরে ঢুকলেন ডেনেস।

গুড মর্নিং স্যার।

কমিশনার স্মিথ ইঙ্গিতে তাঁকে বসতে বললেন। কয়েকটা জরুরি ফাইলে সই করে তিনি প্রথমে গোয়েন্দা অফিসারটিকে ভালো করে লক্ষ করলেন। তারপর অত্যন্ত শান্ত গলায় বললেন, কনগ্র্যাচুলেশন অফিসার। তোমার প্রমোশন হয়েছে।

ডেনেসের কাছ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে স্মিথ বিস্মিত কণ্ঠে শুধোলেন : তুমি কি অসুস্থ?

নো স্যার।

তবে?

আমি আর চাকরি করব না।

সেকি! চাকরি করবে না! বাট হোয়াই? কোথাও বেটার চান্স পেয়েছ?

নো স্যার।

দেন?

আমি এক্সপিডিশনে যেতে চাই।

এক্সপিডিশন! স্মিথ যেন আকাশ থেকে পড়লেন। অবাক হয়ে বললেন, শেষে তুমি পাহাড়ে চড়বে? হাউ হরিবল। ভালো করে ভেবে দেখো ডেনেস। এই বয়সে ওসব করতে যেও না। বিরাট ভবিষ্যৎ পড়ে রয়েছে তোমার সামনে।

ডেনেস এর কোনো প্রত্যুত্তর দিলেন না। রেজিগনেশন লেটারটা টেবিলের ওপর রেখে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

অভিযাত্রীদের পদধ্বনি শোনার সঙ্গে সঙ্গে ধ্যানমগ্ন এভারেস্ট হঠাৎ জেগে উঠল। ক্রোধে তার সমস্ত দেহ কাঁপছে। চক্ষু রক্তবর্ণ। তার ভারী নিশ্বাসে ঝড় উঠল। শুরু হল প্রচণ্ড আক্রমণ। প্রলয়ঙ্কর রূপ নিয়ে সে নেমে এল বেস ক্যাম্পে। ঠান্ডা বাড়ছে। হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। সেই সঙ্গে তুষার ঝড়। বিরাট বিরাট বরফের চাঁই আছড়ে পড়ছে পাহাড়ের ওপর। প্রচণ্ড সে আওয়াজে কান পাতা দায়।

উধম সিং এয়ার ম্যাটট্রেস থেকে ঝুঁকে টেন্টের বাইরে তাকাতেই এক ঝাঁক বরফের কণা মুখে এসে লাগে। বরফ তো নয়; যেন একটা চকচকে ধারালো ছুরি।

পিটার ব্র্যান্ডির বোতলে চুমুক লাগাল। কিন্তু দেহে তাপের কোনো লক্ষণ দেখতে পেল না। সমস্ত শরীরটা যেন বরফে জমে গেছে।

পাশের তাঁবুতে রয়েছে মাইক ডেনেস, তার কন্যা লীনা ডেনেস। দুই শেরপা পানাং ও লাকপা।

বাইরে হাওয়ার কাঁপনে তাঁবুর পর্দা দুলছিল। বরফ কুচি তাঁবুতে আছড়ে পড়ছে। এভারেস্ট আজ ধ্বংসের নেশায় মেতেছে। তার রাজ্যে অনধিকার প্রবেশের জন্য মহাতপস্বী কাউকে রেহাই দিতে চান না। অচিনপুরের দৈত্যের মতো তার বজ্রহুঙ্কারে সমস্ত পাহাড় কেঁপে উঠছে। সেই রণহুঙ্কারে ঝড় ওঠে প্রকৃতির রাজ্যে। ভীষণ সে ঝড়। ঝড়ের সঙ্গে সোঁ সোঁ আওয়াজ।

লীনা চোখ বুজে প্রকৃতির এই সঙ্গীত শুনতে থাকে। এই সঙ্গীত যেমন মধুর, তেমনই ভয়ঙ্কর।

এই সময় কোহলি ভারী পোশাক পরে তাঁবুতে এলেন। কোহলিকে দেখে ডেনেস উঠে বললেন, এসো ডাক্তার।

কোহলি এলে ডেনেসকে খানিকক্ষণ পরীক্ষা করলেন।

ওরা কেমন আছে ডক্টর?—ডেনেস চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন।

প্রবাল ও এলভিনের শারীরিক অবস্থা তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছিল। কোহলি হেসে বললেন, কিছু করার নেই ক্যাপ্টেন। পাহাড়ে এলে এমন ঘটবে বহুবার। এখন থেকে চিন্তা করলে কোনোদিনই ওপরে উঠতে পারবে না।

ডেনেস কোনো জবাব দিলেন না। চুপ করে রইলেন। ডাক্তার সরে এসে লীনার কপালে হাত রাখলেন। তাঁর হাতের ছোঁয়া পেয়ে লীনা চোখ খুলল।

কেমন আছো?

ডোন্ট ওরি ডক্টর। আমি এত শিগগির মরছি না।—লীনা হেসে বলল।

ডাক্তার কোনো জবাব দিলেন না। হাসলেন মাত্র।

রাত এগারোটা।

ঝড়ের দাপট ক্রমশ কমে আসছে। সোঁ সোঁ আওয়াজটা আর নেই।

লীনা ঘুমুচ্ছে। ডেনেসও নিদ্রামগ্ন।

আবছা অন্ধকারে পিটার চুপি চুপি তাঁবুতে প্রবেশ করল। চোরের মতো সমস্ত তাঁবুটাকে এক নজর বুলিয়ে লীনাকে বারকয়েক ধাক্কা দিল। চোখ খুলে সামনে পিটারকে দেখে লীনা বিস্মিত কণ্ঠে বলল, তুমি এখানে!

তোমার সঙ্গে কথা ছিল।

এত রাত্রে?

হ্যাঁ।

বেশ, বলো।

এক্সপিডিশনের ওপর আমার ভরসা নেই।

ফিরে যাও।

আমি তোমায় নিতে এসেছি।

তোমার কি মাথা খারাপ হল পিটার? পাহাড়ের নীচে বসে পালাতে চাও? কাপুরুষ কোথাকার!

লীনার ভর্ৎসনায় কান না দিয়ে পিটার বলল, আসলে তুমি আমায় পছন্দ কর না, আমি জানি। রেসের জকি বলে তুমি আমায় ঘেন্না করো।

তুমি বড্ড বেশি কথা বলো পিটার। আমরা এক্সপিডিশনে এসেছি, লাভসিন করতে নয়। প্লিজ, গেট আউট। নইলে ড্যাডিকে ডাকব।

লীনার অপমানকর মন্তব্যে পিটারের চোখ জ্বলে ওঠে। নিঃশব্দে সে বেরিয়ে আসে। তার রাগটা কিন্তু লীনার ওপরে নয়, আসলে সে ডেনেসের ওপর বরাবর খাপ্পা। লীনাকে সে এর আগে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছে। লীনা জবাবে বলেছে, বাবার মতো আদায় করতে। ডেনেস পিটারের প্রস্তাবে রাজি হয়নি। ফিরিয়ে দিয়েছে তাকে। তাই তার রাগটা ডেনেসের ওপর। আসলে পিটার জানে না, লীনাই বাবাকে সব শিখিয়ে দিয়েছে। আর এও জানে না, রেনেলের সঙ্গে লীনার একটা সম্পর্ক আছে। সম্পর্কটা হৃদয়ের। ও ভাবে, ডেনেস মরলে লীনা বিয়েতে অমত করবে না। কিন্তু ডেনেস যেন অমর। বহুবার মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছে সে। সেবার লিভারপুলে গাড়ির ধাক্কায় বাঁ পায়ে আঘাত পেয়েছিল। সাতদিন জ্ঞান ছিল না। তবু বেঁচে গেল। নদী সাঁতরাতে গিয়ে স্রোতে একবার ভেসে গিয়েছিল, কিন্তু অপদার্থ একটা লোক তাকে বাঁচিয়ে দিল। আপসোসে মরে যাচ্ছিল পিটার। এই রাগে গির্জায় যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু ঈশ্বর তাতেও তার সহায় হননি। পিটার তাই আজও ডেনেসের মৃত্যুর প্রহর গোনে।

সকালের দিকে আবহাওয়া বদলে যায়। নীল আকাশে সোনালি সূর্যকিরণ। কোথাও একটুকরো মেঘের আভাসমাত্র নেই। মাউন্ট এভারেস্ট মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কালকের সেই রুদ্রমূর্তি যেন হারিয়ে গেছে। আজ সে শান্ত। ধ্যানমগ্ন।

প্রবাল ও এলভিন খানিকটা সুস্থ। কাল ছিল দুঃস্বপ্নের রাত্রি। চারিদিকে জমাট বাঁধা অন্ধকার। ঝড়ের দাপটে প্রতি মুহূর্তে তাঁবু ছিঁড়ে যাবার ভয়। নামদিয়াম, দোরজে তাঁবুকে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। কেননা, হিমালয়ের খোলা আকাশে রাত কাটানোর অর্থ মৃত্যু। ওদিকে তাপমাত্রা ভীষণভাবে কমে যাচ্ছিল। প্রবাল রায় ও এলভিনের গায়ে ছিল তিনটে করে পোশাক। মাথায় পশমের টুপি। স্লিপিং র‌্যাগের নরম গদিতে শুয়েও দুজনার চোখে ঘুম ছিল না। প্রবালের নাক দিয়ে জল গড়াচ্ছিল। এলভিন পা তুলতে পারছিল না। আঙুলগুলো অবশ হয়ে পড়েছিল।

বেড টি স্যার।

তামাংয়ের হাত থেকে চায়ের মগটা টেনে নিয়ে এলভিন চিৎকার করে বলে উঠল, লং লিভ তামাং।

প্রবালও সুর মেলাল, লং লিভ।

তামাং ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে হাসতে থাকে। বিদেশি সাহেবদের সঙ্গে এই তার প্রথম পর্বতাভিযান। দু—একটা ইংরেজি ছাড়া বেশি কিছু বোঝে না। এর আগেও সে অভিযানে এসেছিল, তবে সব দেশি সাহেবদের সঙ্গে। তারা ইংরেজি বলত কম। হিন্দিতে হুকুম করত। তাই হিন্দিটা ভালো বোঝে তামাং।

শুনো।—এলভিন তামাংকে ডেকে বলল, দোপহর কা লাঞ্চ—সুপ আউর রোস্ট। সমঝা?

তামাং মাথা নেড়ে বুঝতে পেরেছে জানায়। ও চলে যেতে প্রবাল ও এলভিন উঠে পড়ে। আজ তারা বেস ক্যাম্পেই থাকবে। ক্যাপ্টেন লীনা, রেনেল, উধম সিং, দোরজে ও নামদিরামকে সঙ্গে নিয়ে ২ নম্বর শিবিরের পথ খুঁজতে চলে গেছেন। রয়েছে প্রবাল, এলভিন, তামাং এবং ডাক্তার কোহলি।

কোহলির এটি দ্বিতীয় পর্বতাভিযান। এর আগে সতপন্থ অভিযানেও তিনি একজন সদস্য ছিলেন। সুগঠিত দেহ। ডেনেসের চেয়ে বছর কয়েকের ছোট। ফর্সা রং। সর্বদাই খুশ মেজাজে থাকেন।

কোহলি এসে দুজনকে পরীক্ষা করলেন। দুজনের পিঠ চাপড়ে বললেন, চিয়ার আপ মাই বয়। তোমরা দুজনে এখন সুস্থ। আশা করি, কাল আমরা ওপরে উঠতে পারব।

প্রবাল ও এলভিন কিন্তু অতটা আশাবাদী নয়। এলভিনের মনে এখনও সন্দেহ। এভারেস্টকে কাল সে চিনেছে। সুন্দর অথচ বীভৎস। ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলাচ্ছে। সামনে বর্ষা। হিমালয়ের তখন রুদ্রমূর্তি। একটানা অবিশ্রাম বৃষ্টি চলে। পথ দুর্গম। এ পথে তখন কেউ আসে না। মৃত্যুকে সেধে কে আর আনতে চায়। অথচ ক্যাপ্টেন তাই করেছে। সুদূর লন্ডন থেকে আসতে সময় লেগেছে অনেক। তাছাড়া এদেশ এখন তাদের গোলাম নয়। এভারেস্টে উঠতে গেলে হুকুমনামা চাই। প্রথমে ভারত সরকারের এবং পরে নেপাল সরকারের। এই অনুমতিপত্র পেতে বহু সময় ব্যয় হয়েছে। এরপর সরঞ্জাম চাই। তাতেও গেছে খানিকটা সময়। এর মধ্যে হিমালয়ে বর্ষার আগমনী সঙ্গীত বেজে উঠেছে। পাহাড়ি বর্ষায় মৃত্যু আনে। বরফের ধস নামে। পথ পিচ্ছিল। এলভিনের আশঙ্কা, এ অভিযান পরিত্যক্ত হতে পারে। সফল হবে না তাদের পরিশ্রম। এভারেস্ট এবার তাদের ফিরিয়ে দেবে। একথা সে কাল ক্যাপ্টেনকে বলেছিল, ক্যাপ্টেন কোনো জবাব দেননি। কোহলি আজ সে কথার উত্তর দিলেন। বললেন, জানো, মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে হতাশা আর ক্ষোভ। একে এড়িয়ে চলতে শেখো। শুরুতেই হতাশ হলে ওপরে উঠবে কি করে? তোমরা পুরুষ। তোমরা হবে সাহসী, চঞ্চল। মৃত্যু একদিন আসবেই। সেদিন তো আর পালিয়ে বাঁচতে পারবে না। তবে আজ কেন ভয়ে পালাতে চাও?

ডাক্তার নিজের বুকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, আমার দিকে তাকিয়ে দেখো, তোমাদের চেয়ে বয়সে কত বড়। তোমাদের মতো চাঞ্চল্য আর প্রাণশক্তি আমার নেই। তবে কিসের মোহে এখানে এসেছি? পাহাড় আমায় নিশ্চয় অর্থ দেবে না! তবু এসেছি কেন, জানো? হিমালয়কে আমি ভালোবাসি। তোমরা এভারেস্টের ভয়ঙ্কর রূপ দেখেছ, দেখোনি তার ধ্যানমগ্ন শান্ত সৌম্যমূর্তি। এভারেস্টের পবিত্রতাকে তোমরা উপলব্ধি করার চেষ্টা করোনি। মিথ্যেই কলঙ্ক এনেছ।

আমি মিলিটারিম্যান,—ডাক্তার বলে চললেন, জীবনের অধিকাংশ সময় যুদ্ধক্ষেত্রে কাটিয়ে দিলাম। দেখেছি, যুদ্ধের বীভৎসতা। মাত্র কয়েক গজ দূরে শেল ফেটেছে। মুহুর্মুহু মেশিনগানের আওয়াজ। আহত সৈনিকের আর্তনাদ। এরই মাঝে আমি কাজ করেছি। পালাবার তো কথা কখনও ভাবিনি। একটা ঘটনা বলি : সেবার এক আহত সৈনিককে হাসপাতালে আনা হল। বারুদে তার হাত পুড়ে গেছে। ডান হাত উড়ে গেছে বোমার আঘাতে। কিন্তু তখনও সে চেঁচাচ্ছে, আমায় ছেড়ে দাও। আমায় লড়াইয়ে যেতে দাও।

আমার হাত ধরে অনুনয় করে বলেছে, ডাক্তার, আমায় কেন ধরে রেখেছ? আমি তো আর বাঁচব না, আমায় যেতে দাও। মরার আগে অন্তত একটাকে মেরে মরি।

আমি বলেছি, তুমি লড়বে কি করে? তোমার ডান হাত নেই, বাঁ হাত পুড়ে গেছে।

সৈনিক তৎক্ষণাৎ আমার ওপর রেগে গিয়ে বলেছে, কে বলল আমার হাত নেই? বাঁ হাত পুড়ে গেছে তো কি হয়েছে! এই হাতেই আমি গুলি চালাব।

আমরা তাকে যেতে দিইনি। ডাক্তারের ধর্ম পালন করেছি। কিন্তু বাঁচে নি ও। শেষ রাত্রে মারা গিয়েছিল। তখন শুধু ভেবেছি, কেন ওকে ছেড়ে দিলাম না। ও তো সত্যিই বাঁচত না। তবু মরার আগে অন্তত একটা শত্রুকে মারতে পারত। অথচ সে সুযোগ আমরাই তাকে দিলাম না। আজও মনকে বারবার এই প্রশ্নই করি। কেন তাকে ধরে রাখলাম। সে প্রশ্নের জবাব নিজেও খুঁজে পাইনি। মিলিটারি থেকে অবসর গ্রহণের পরও নিজেকে গুটিয়ে নিলাম না। এলাম প্রকৃতির মাঝে। হিমালয়ের আঙিনায়। এটাও একটা যুদ্ধক্ষেত্র। তবে এ লড়াইয়ে সুখ আছে। আনন্দ আছে। এখানে মরেও অপার শান্তি।

একটানা অনেকক্ষণ বলে কোহলি থামলেন। সিগারেটটায় শেষ টান দিয়ে, সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ডাক্তার প্রবালকে উদ্দেশ করে বললেন, তুমি এত তাড়াতাড়ি হতাশ হবে, ভাবতে পারি নি। তোমার বাবা একজন মহান বিপ্লবী ছিলেন। সারাটা জীবন দেশের জন্য লড়াই করেছিলেন। কখনও তো ভয় পাননি। তাঁর ছেলে হয়ে তুমি ভয় পাও কি করে?

রাগ কোরো না প্রবাল। কোহলি প্রবালের গম্ভীর মুখের দিকে চেয়ে বললেন, আমি শুধু তোমায় স্মরণ করে দিতে চাইছিলাম, তুমি কোন ঘরের ছেলে। তোমার বাবা দুর্ধর্ষ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। কতগুলো ক্ষমতালোভী মানুষের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। তোমাকেও লড়তে হবে। প্রকৃতির সঙ্গে। লড়াই মানেই তো জীবন। সংগ্রামকে অস্বীকার করা মানে, জীবনকে অস্বীকার করা। জীবনকে অস্বীকার করলে তোমার রইলটা কি?

প্রবাল চুপ করে থাকে। কোনো জবাব দেয় না। আসলে ডাক্তারের কথাটা তো মিথ্যে নয়। বাবা ছিলেন এক দুর্ধর্ষ বিপ্লবী। প্রায় সাত বছর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিহত হলেন মেদিনীপুর থেকে বহুদূরে দার্জিলিংয়ের টাইগার হিলে। বাবাকে আবছা মনে পড়ে প্রবালের। বাবাকে সে খুব কমই দেখেছে। মেদিনীপুরের বাড়িতে মা রাত জেগে বসে থাকতেন। বাবা ফিরতেন না। তার বদলে পুলিশ আসত। বাবার খোঁজে। না পেলে ঘরের আসবাবপত্র ভেঙেচুরে তছনছ করত। কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ করত।….সেটা ছিল সন্ত্রাসের যুগ। আর প্রবালের বাবা ছিলেন তার অগ্রদূত।

আসার সময় টাইগার হিলের সে জায়গায় গিয়েছিল প্রবাল। সেখানে তার বাবার নামে কোনো শহিদ—বেদি নেই। বাবার অপরাধ শত্রু—নিধনে তিনি হাতে আস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন, যা ছিল অহিংসার পরিপন্থী। তাই আজও তার বাবা অজ্ঞাত রয়ে গেলেন। স্বাধীন দেশের অনেকেই আজ তাঁকে চেনে না। অনেকক্ষণ ওই জায়গায় দাঁড়িয়েছিল প্রবাল। আসার সময় একমুঠো মাটি তুলে নিয়ে এসেছিল।

ডাক্তার চলে গেলে এলভিন বিস্মিত কণ্ঠে বলে, তোমার বাবা বিপ্লবী ছিলেন? টেররিস্ট? ও গড, তাহলে সাবধানে থাকতে হবে। তুমি শেষে….

তার কথা বলার ধরন দেখে প্রবাল হেসে উঠল। বলল, ভয় নেই এলভিন। বাপের কোনো গুণই আমি পাইনি। দেখছ না, কেমন কাপুরুষ। পাহাড়ে উঠতেই ভয় পাচ্ছি, অথচ বাবা এক বৃহৎ সংগ্রামে অনায়াসে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। ভয় তাঁকে কোনোদিনই স্পর্শ করতে পারেনি। নির্ভীক ছিলেন। আমার মতো কাপুরুষ ছিলেন না।

প্রবালের আত্ম—বিশ্লেষণের জবাবে এলভিন হয়তো কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই তামাং এসে জানাল, ওপর থেকে দুজন লোক আসছে।

এলভিন ও প্রবাল তাঁবুর বাইরে আসে। দূরে পাহাড়ের গায়ে দুটি অস্পষ্ট বিন্দু দেখা যায়।

কে হতে পারে এলভিন?

উধম সিং আর রেনেল।

ক্রমশ বিন্দুদুটো বড় হতে থাকে। এখন আর তেমন পরিষ্কার আকাশ নেই। সূর্যদেব মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় মেতেছেন। এভারেস্ট তাই কখনও অস্পষ্ট, কখনও উজ্জ্বল।

মূর্তিদুটো সামনে আসতেই এলভিন হতাশ কণ্ঠে বলে, শেরপা।

কেয়া খবর নিমা?—প্রবাল জিজ্ঞেস করে।

নিমা পকেট থেকে একটা চিঠি বার করে এলভিনের হাতে দেয়। চিঠিখানা লিখেছে লীনা। চিঠিখানা পড়ে এলভিনের চোখমুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে।

কি ব্যাপার এলভিন? কোনো খারাপ খবর নেই তো?

এলভিন চিঠিখানা পকেটে পুরে বলল, লীনা অসুস্থ। ওখানে রেনেল আছে। ক্যাপ্টেন উধম সিং দোরজে আর নামদিয়ামকে নিয়ে আরও ওপরে গেছেন।

এতক্ষণে পানাং কথা বলে। এলভিনকে উদ্দেশ করে ও বলল, সাব, সবেরে দেখে এসেছি, মেমসাহেবের থোড়া বুখার ছিল। রেনেল সাহেব বলল, ঘাবড়ানে কা কোই বাত নেহি।

সেই জন্যই তো আমার ভাবনা। এলভিন বলল, লোকটা একটা ইডিয়ট। মেয়েদের সম্মান করতে জানে না। লীনা একা আছে। শেষে….

রেনেল সম্বন্ধে প্রবালেরও অভিজ্ঞতা আছে। নারী—দুর্বলতার জন্য বহুবার তাকে জখম হতে হয়েছে। তবুও স্বভাব পাল্টায়নি। দার্জিলিং থেকে রওনা হবার পরই লীনাকে নিয়ে সে বড্ড বেশি ব্যস্ত থেকেছে। অবশ্য এ ব্যাপারে কেউ কম যায় না। পিটার, এলভিন দুজনেই সমান। এলভিন সুযোগ পাচ্ছে না, তাই। ঈর্ষায় জ্বলছে। অথচ এরা এসেছে মাউন্ট এভারেস্ট জয় করতে। হিমালয় মানুষের মনকে পবিত্র করে। উদার করে। অথচ এরা নোংরা প্রেমের খেলায় মেতেছে। লীনা—রেনেল যা খুশি করুক না, তাতে ওদের কি? তাছাড়া লীনা রেনেলকে পছন্দ করে। তাতে এলভিনের রাগের কি আছে?

প্রবালের এসব অসহ্য লাগে, তবু সে সহজ হওয়ার ভঙ্গিতে বলে, ডোন্ট ওরি এলভিন। লীনা দুর্বল নয়। রেনেলকে ও ঠিকই শায়েস্তা করতে পারবে।

প্রবালের সান্ত্বনায় এলভিন খুশি হয় না। নিঃশব্দে তাঁবুতে গিয়ে প্রবেশ করে।

দুপুরের দিকে আকাশে কালো মেঘের রাজত্ব। এভারেস্ট আবার অশান্ত হয়ে ওঠে। হঠাৎ একটা প্রচণ্ড আওয়াজে শেরপারা আতঙ্কে কেঁপে ওঠে। সমস্বরে চেঁচিয়ে বলে, এভাঁলাস। বরফ ধস। বিরাট বিরাট বরফের চাঁই আছড়ে পড়ছে। সবচেয়ে ওপরে ছিলেন ডেনেস এবং উধম সিং। নীচে দুজন শেরপা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে। সম্বিত ফিরে পেতেই ওরা দুজন অত্যন্ত দ্রুতগতিতে নীচে নামতে থাকে। ডেনেস আইস এক্সে ভর দিয়ে এগোবার চেষ্টা করেন। কিন্তু অসম্ভব। পথ দুর্গম। এদিকে বরফের ঝড় এসে তাদের ভিজিয়ে দিতে থাকে। প্রকৃতির সঙ্গে চলে মানুষের লড়াই। এভারেস্ট ক্রোধে ফুঁসছে। ডেনেসের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। শেরপারাও দ্বিধাগ্রস্ত। তারা ডেনেসের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। লোকটা ভয়ানক জেদি। শেরপারা মৃত্যুভয়ে ভীত নয়। তবু মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গোঁয়ার্তুমি তারা একদম সহ্য করতে পারে না। চাপা অসন্তাোষ ওঠে ওদের মাঝে। ব্যাপারটা উধম সিং বোঝে। ডেনেসের খুব কাছে এসে সে বলে, স্যার, চলুন আমরা ফিরে যাই।

নো! ডেনেস গর্জে ওঠেন : ওপরে উঠতেই হবে যে কোনো মূল্যে। হারি আপ!

উধম সিং ক্যাপ্টেনের আদেশে ওপরে উঠতে চেষ্টা করলেও, মনে মনে সে এ ব্যবস্থা মেনে নিতে পারছিল না। লোকটা ভয়ানক জেদি। যা ঠিক করবে, তাই করবে। এ সম্পর্কে কারও মতামত সে শুনবে না। অথচ অধিনায়কের সবচেয়ে বড় কর্তব্য, দলের স্বার্থ রক্ষা করা। পাহাড়ে এসে ডিক্টেটরশিপ চলে না। এখানে সবার জীবন একসূত্রে বাঁধা। যেমন খুশি চললে হবে না। কিন্তু একথা ডেনেসকে বোঝাবে কে? নিজের সিদ্ধান্তে অটল। সেখানে কারও মত নেই। তা ছাড়া লোকটার একটা জিনিস লক্ষ করেছে উধম সিং। নেটিভদের প্রতি তার অসম্ভব ঘৃণা। উধম সিংকে সামান্য একজন ভৃত্য মনে করেছে। যা হুকুম করবে, তাই যেন করতে হবে। উধম সিংয়ের অসহ্য লাগে এ গোলামি। একথা সে একবার ডাক্তার কোহলিকে বলেছিল। কোহলি হেসে বলেছিলেন, রাগ কোরো না উধম। লোকটা ওই রকম। ভীষণ একগুঁয়ে। তোমাকে ওর সঙ্গে মানিয়ে চলতে হবে।

অসম্ভব! উধম সিং প্রতিবাদ জানিয়েছিল।

ভুলে যেও না, এ অভিযানের লিডার সে।

কিন্তু তাই বলে….

ওর কথা না শুনলে, নীচে নামার পর তোমার বিচার হবে। সব সময় মনে রাখবে, তোমার হাতে দেশের সম্মান। এমন কিছু করবে না, যাতে দেশের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়।

এরপর উধম সিং কোনো কথা বলতে পারে নি, চুপ করে ছিল। ভাবছিল, ভারত সরকারের ঘোষণার কথা। ভারত সরকার ঘোষণা করেছেন, এ অভিযানে যদি কোনো ভারতীয় সফল হতে পারে, তবে তাকে বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হবে। সে পুরস্কারের পরিমাণ দশ হাজার টাকা। উধম সিং এই পুরস্কারের আশায় আছে। তাই সে তাড়াহুড়ো না করে অত্যন্ত ধীরে সুস্থে এগোতে চায়। কিন্তু সে কাজে ডেনেস স্বয়ং বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভারেস্ট জয় করতে হলে ডেনেসের মতো এভারেস্টকে জয় করতে হবে আগে। তাই উধম সিং ক্ষুব্ধ।

রেনেল লীনার কপালে হাত রাখল। সামান্য জ্বর আছে। তবে সকালের চেয়ে অনেক কম। সন্ধের মধ্যে হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে।

লীনা তখনও চোখ বুজে ছিল। ও ঘুমুচ্ছে মনে করে রেনেল হাত সরিয়ে নিতেই লীনা হঠাৎ হাত চেপে ধরল। চোখ খুলে বলল, কি দেখলে?

জ্বর।

কত?

নিল।

কি করে বুঝলে?

আমি তোমার মনের খবর জানি ডার্লিং।

তুমি কিচ্ছু জানো না,—লীনা উঠে বসে বলল, স্বয়ং ঈশ্বর মেয়েদের মনের খবর জানতে পারেন না। তুমি জানবে কি করে? তুমি তো সামান্য মানুষ মাত্র।

এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে নিয়ে লীনা হঠাৎ বিস্মিত কণ্ঠে বলল, তুমি এখানে যে বড়! ওপরে যাওনি?

তোমার ড্যাডি পাহারায় রেখে গেছেন। রেনেল শান্ত কণ্ঠে বলল।

লীনা লজ্জা পেয়ে বলল, কী বিশ্রী ব্যাপার বলো তো? সবাই কি ভাবছে!

কেউ কিছু ভাবছে না। তুমি নিশ্চিন্তে বসো।

আমার জন্য তোমরা কত কষ্ট পাচ্ছ। তোমাকে এখানে থেকে যেতে হয়েছে।

তোমার ড্যাডি আজকে ওপরে না গেলেই পারতেন।

ড্যাডির ওপর তোমার খুব রাগ, তাই না রেনেল?

কে বলল?

আমি জানি। তুমি চাও না, তোমায় ফেলে কেউ এগিয়ে যাক। তাহলে ওদের নাম হবে।

মিথ্যে কথা।

আমি তোমায় চিনি ডার্লিং।

লীনা রেনেলকে বহুদিন আগে থেকেই চেনে। তখন ওরা কেমব্রিজের স্টুডেন্ট। রেনেলের একরাশ সোনালি চুল আর নীল চোখের তারায় লীনা নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। সেই বয়সটা ছিল স্বপ্ন দেখার বয়স। বিচিত্র স্বপ্ন। বাস্তবের সঙ্গে এর মিল খুঁজে পাওয়া মুস্কিল। লীনাও রেনেলকে নিয়ে স্বপ্ন দেখত—সুখস্বপ্ন।

তবুও বরাবর রেনেলকে কেমন দুর্বোধ্য মনে হয়েছে লীনার। রেনেল উচ্চাভিলাষী। অথচ পরিশ্রম করতে নারাজ। রেনেল কল্পনায় স্বর্গ রচনা করে। কিন্তু বাস্তবের মুখোমুখি হলে পিছিয়ে পড়ে। লীনা এটা বরদাস্ত করতে পারে না। কল্পনা মানুষকে দুর্বল করে। যে পুরুষ বাস্তবকে এড়িয়ে চলে, দুঃখ, লাঞ্ছনা যে পুরুষকে স্পর্শ করে না, সে পুরুষই নয়। নারীরা কল্পনাবিলাসী নয়। কারণ তারা পুরুষনির্ভর। আর পুরুষকে একা চলতে হয়। এই একাকী পথে তাকে বহু দুঃখ, অপমান সইতে হয়। তাই বলে থামলে চলবে কেন? এগোতে হবে সমস্ত বাধাকে ডিঙিয়ে।

এ কথা রেনেল বিশ্বাস করতে চায় না। একদিন কথাচ্ছলে বলেছিল, ও এভারেস্ট জয় করবেই। যত বাধাই আসুক না কেন।

লীনা রেনেলের এ আত্মবিশ্বাসে, খুশি হয়েছে। সাহস জুগিয়েছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। রেনেল এর বেশি এগোয়নি। এভারেস্টের কথা ভুলে গিয়েছিল অল্প দিনের মধ্যেই। লীনা তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। উত্তেজিত করেছে। রেনেল আবার জেগেছে। এসেছে নেপাল—হিমালয়ে। কিন্তু এভারেস্টকে দেখে তার মাথা ঘুরে গেছে। জিনিসটা সহজ হবে ভেবেছিল। কিন্তু এক নম্বর শিবির গড়তেই তিনদিন চলে গেল। রেনেল এখন হতাশার রোগে ভুগছে। ওর স্পষ্ট ধারণা হয়েছে, এভারেস্ট জয় অসম্ভব। এই তিনদিনে ও তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। প্রবল তুষার ঝড়, বিক্ষিপ্ত হিমপ্রপাত, আর কনকনে ঠান্ডা, এই তিনের আক্রমণে রেনেল পর্যুদস্ত। এখন সে ফিরতে চায়। এভারেস্ট তার প্রাণশক্তি কেড়ে নিয়েছে। এখন পালাতে পারলেই বাঁচে। শুধু পরিশ্রমই নয়, একরাশ অর্থ জলের মতো খরচ হয়েছে। সেকথা সে এখন স্পষ্টভাবে লীনাকে জানাল। আক্ষেপ করে বলল, শুধু শুধু টাকাগুলো জলের মতো খরচ হচ্ছে।

তা এলে কেন? লীনা বিদ্রুপ করে বলল।

আমি তো আসতে চাই নি। তুমিই তো আনলে।

খুব ভুল হয়ে গেছে। তখন কি জানতাম, তুমি এত কাপুরুষ।

কাপুরুষের কথা নয়। আমি ভাবছি টাকার কথা। শুধু শুধু এতগুলো টাকা জলে গেল।

লীনা রেগে গিয়ে বলল, তুমি তো বানিয়াদের মতো কথা বলছ রেনেল।

লীনার অপমান গায়ে না মেখে রেনেল বলল, আমি যে বানিয়াই ডার্লিং। টাকাই আমাদের প্রাণ।

বেশ, সব টাকা আমি ফেরত দেব।

কি করে? সব টাকা তো ড্যাডির নামে আছে। তিনি না মরলে তুমি তো একটা কানাকড়িও পাবে না।

তুমি আমার ড্যাডির মৃত্যু কামনা করো?

রাগ কোরো না ডার্লিং। পাহাড় বড় নির্মম। চারদিকে বিপদ। কে জানে, হঠাৎ কোনো অ্যাক্সিডেন্টে তোমার ড্যাডি….

রেনেলের কথা শুনে লীনা চমকে ওঠে। রেনেলের চোখে—মুখে সে লক্ষ করে ভয়ঙ্কর এক অশুভ ইঙ্গিত। রেনেল অর্থ—পাগল, লীনা তা জানে। টাকা ছাড়া সে কিছু বোঝে না। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে তার আচরণ এমন অদ্ভুত লাগে যে, মনে হয় স্বার্থের জন্য সে খুন পর্যন্ত করতে পারে। এ প্রসঙ্গে লীনার মনে পড়ে যায় লিভারপুলের সেই ঘটনাটা। সেদিনও রেনেল এমন করে বলেছিল।

এক্সপিডিশনে আসার দিন সাতেক আগেকার কথা—

লিভারপুলে তাদের ছোট্ট বাগানটায় লীনা ও রেনেল বসেছিল। খানিকটা দূরে ডেনেস এলভিনের সঙ্গে এক্সপিডিশন সম্বন্ধে কথাবার্তা বলছিলেন। বাগানের এই নির্জন জায়গায় রেনেল হঠাৎ লীনাকে খুব কাছে টেনে বলল, ডার্লিং, আমার কিছু টাকার দরকার। বাজারে অনেক দেনা হয়ে গেছে। এক্সপিডিশনে যাওয়ার আগে সব শোধ করে দিতে চাই।

কিন্তু আমি টাকা কোথায় পাব?

সেকি! তোমার ড্যাডির এত টাকা, তুমি বলছ টাকা কোথায় পাব?

ওসব এখন আমার নয় রেনেল, ড্যাডির।

তুমি পাবে না?

ড্যাডির মৃত্যুর পর।

অ্যাঁ!—রেনেল হতাশ কণ্ঠে বলল, সে তো অনেক দেরি। তারপর হঠাৎ কি ভেবে বলল, অবশ্য ক্যাপ্টেনের বয়স হয়েছে। এই বয়সে পাহাড়ে চড়া। শেষে একটা অ্যাক্সিডেন্ট….

সেদিনও লীনা রেনেলের চোখে এমন ভয়ানক ইঙ্গিত দেখেছিল। একটা গোপন কিছু করার চক্রান্ত। ড্যাডির কথা ভেবে লীনা ভয়ে শিউরে ওঠে।

সন্ধের খানিক পরে ডেনেস—উধম সিংরা ফিরে এল। প্রত্যেককে অত্যন্ত ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। রেনেলকে কিন্তু প্রফুল্ল দেখায়। এক ধরনের মানুষ আছে, যারা নিজেরা খুব বেশি পরিশ্রম করতে রাজি নয়, অথচ অন্যেরা পরিশ্রম করে সাফল্য লাভের চেষ্টা করলে ঈর্ষা করে। এমনই বিদঘুটে ওদের চরিত্র। রেনেল তেমনি এক অসাধারণ চরিত্রের মানুষ। তাই সে খানিকটা উৎফুল্ল হয়ে বলল, কি হল ক্যাপ্টেন? পারলে না?

অসম্ভব! ডেনেস হতাশ কণ্ঠে বললেন, কাল বরং একবার চেষ্টা করা যাবে।

কাল আমি যাব। আপনার রেস্ট দরকার ক্যাপ্টেন।

ডেনেস খানিকক্ষণ রেনেলের দিকে চেয়ে রইলেন। উচ্চাভিলাষী এই যুবকটিকে তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। মৃদু কণ্ঠে বললেন, আমি জানি, তুমি খুব তাড়াতাড়ি বড় হতে চাও। অথচ কষ্ট করতে রাজি নও। তোমার এই ব্যস্ততার জন্য তুমি কোনো কাজ ঠিকমতো করতে পার না। সব কিছুর একটা সময় আছে রেনেল। তুমি সে সময়টুকুও অপেক্ষা করতে রাজি নও। অথচ এক্সপিডিশনে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ধৈর্য।

রেনেল কোনো উত্তর না দিয়ে ধীর পদক্ষেপে তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা সত্ত্বেও তার সমস্ত শরীরটা গরম হয়ে ওঠে।

আবহাওয়া পরিষ্কার হতেই প্রবাল ও এলভিন ১ নম্বর শিবিরে এসে পৌঁছল। এর খানিক পরে ডেনেস, লীনা, এলভিন এবং দুজন শেরপা নিয়ে ২ নম্বর শিবিরের সন্ধানে বেরোলেন।

আকাশে কালো মেঘের ছায়া। উঁচু—নীচু হিমপ্রপাতের গা বেয়ে তুষার এবং বিরাট বিরাট চাঁই নীচের দিকে বিপুল বেগে নেমে আসতে থাকে। হিমপ্রপাতের গায়ে অসংখ্য ফাটল। সাবধানে না চললে দুর্ঘটনা অনিবার্য। দুর্ঘটনার অর্থ মৃত্যু। অথচ এই সব ফাটলকে এড়িয়ে যাবার উপায়ও নেই। যমদূতের মতো পাহাড়ের প্রতিটি খাঁজে এর অবস্থান। ওরা আইল—এক্স দিয়ে ধীরে ধীরে ধাপ কেটে এগোতে থাকে। কাল যে জায়গায় ডেনেস বাধা পেয়েছিলেন, তার খানিকটা ওপরে নতুন শিবির গড়া হল। ইতিমধ্যে সন্ধে নেমেছে।

ওরা পাঁচজন ক্লান্ত। ডেনেসের পা অসাড় হয়ে এসেছে, ঠান্ডায় কাঁপতে থাকেন ক্যাপ্টেন। পাহাড়ি ভাষায় কোল্ড স্ট্রোক। লীনার গলা শুকিয়ে গেছে। এই মুহূর্তে গরম জলের অত্যন্ত দরকার। লীনা স্টোভ ধরাবার চেষ্টা করল। কিন্তু পিন নেই। ভুল করে তারা নীচে ফেলে এসেছে। এই সামান্য ভুলের জন্য লীনা নিজেকে দুষতে থাকে। তদারকির ভার তার ওপর ছিল। এখন এতগুলো প্রাণীর জীবন। সবই এই গরম জলের ওপর নির্ভর করছে। লীনা কি করবে, ভেবে পায় না। দোরজে, পানাং মুখ চাওয়া—চাওয়ি করে। ডেনেস নিশ্চল অবস্থায় এয়ার ম্যাটট্রেসের ওপর পড়ে থাকে। তাঁর করণীয় কিছু নেই।

এলভিন এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি। এবার সে আইস—ব্যাগ থেকে রামের বোতল বার করল। নিজে খানিকটা গলায় ঢেলে বোতলটা লীনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও ডার্লিং, এক চুমুক খাও।

যদিও পিপাসায় গলা ফেটে যাচ্ছিল, তবুও লীনা রাম গলায় ঢালতে পারল না। বোতলটা সে ডেনেসের দিকে এগিয়ে দেবার চেষ্টা করল, কিন্তু এলভিন বাধা দিল। বোতলটা কেড়ে নিয়ে বলল, নো ডার্লিং। বোতলে অল্পই রাম আছে। শুধু তুমি আর আমি।

লীনা প্রথমে কথাটা বিশ্বাস করতে চাইল না। এলভিস এতটা স্বার্থপর হবে, ওর ধারণার বাইরে।

ড্যাডি অসুস্থ এলভিন। রামের খুব দরকার। শান্ত কণ্ঠে লীনা বলল।

তোমার ড্যাডির বয়স হয়েছে ডার্লিং। ওকে হিমালয়ে শান্তিতে ঘুমোতে দাও।

চমকে উঠল লীনা। এ কি কথা শুনছে সে?

এলভিন হঠাৎ লীনার হাত চেপে ধরল। মুখের কাছে মুখ এনে বলল, আই লাভ ইউ ডার্লিং।

ইডিয়ট! লীনা প্রচণ্ড জোরে এলভিনের গালে এক চড় কষাল।

চড় খেয়ে এলভিনের ফুর্তি যেন দ্বিগুণ ভাবে বেড়ে গেল। সে জোর করে লীনাকে চুমু খেল।

ডেনেস শুয়ে শুয়ে এতক্ষণ সব দেখছিলেন, কিন্তু আর পারলেন না। উঠে বসবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু মাথাটা ঘুরে উঠল। চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলেন। শেষে না পেরে বিছানায় শুয়ে শুয়েই চিৎকার করে বলে উঠলেন, এলভিন, মনে রেখো, এ এক্সপিডিশনে আমি লিডার। তুমি আমার মেয়েকে অপমান করেছ। নীচে নামলে, এর জন্য তোমায় কঠিন শাস্তি পেতে হবে।

ক্যাপ্টেনের কথা শুনে এলভিন হেসে উঠল। ডেনেলের খুব কাছে এসে কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করে বলল, তোমার আর নীচে নামতে হবে না ওল্ড ম্যান। তার আগেই শেষ হয়ে যাবে। ডেথ!—মুখে বাকি রামটুকু ঢেলে দিয়ে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে আসে সে।

ততক্ষণে দোরজে বরফ গলা জল গরম করে কেটলিটা লীনার হাতে দিল। গরম জল পেয়ে ডেনেস অনেকটা সুস্থ বোধ করলেন। কিন্তু তাঁর ভয়টা গেল না। লীনার মাথায় হাত রেখে বললেন, তোকে নিয়েই আমার ভয় লীনা।

তুমি চিন্তা কোরো না ড্যাডি। এখন বরং ঘুমোবার চেষ্টা করো।

ডেনেসও বহুবার ঘুমোবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পোড়া চোখে ঘুম নেই। এলভিন, পিটারকে তিনি আর বিশ্বাস করতে পারেন না। এলভিনের ভয়ঙ্কর রূপ কিছুক্ষণ আগে দেখলেন! পিটার ও রেনেলের মনোভাব তিনি বোঝেন। এই তিনজনে মিলে তাঁর বিরুদ্ধে এক গভীর চক্রান্তে লিপ্ত। ডেনেস তাই সন্দেহ করেন। এই সন্দেহের কারণও আছে।

এক্সপিডিশনে আসার দিনসাতেক আগেকার কথা।—ডেনেস বাগানে বসে চা খাচ্ছেন। এমন সময় পিটার এসে হাজির। পিটারের একটা গুণ আছে, তার বক্তব্যে কোনো আড়ম্বর নেই। সে যা বলে সোজাসুজি বলে। সময় অপচয় করে না। চেয়ারে বসেই, কোনো ভূমিকা না করে সরাসরি সে বলল, আমার কিছু টাকা চাই, ক্যাপ্টেন।

টাকার ব্যাপারে ডেনেস বড্ড হিসেবি। অযথা সে পয়সা হাতছাড়া করতে রাজি নয়। তাই সে বিরক্তির সুরে বলল, এখন আবার টাকা কেন?

এক্সপিডিশনে যাচ্ছি। বিদেশ—বিভুঁই জায়গা, কিছু কেনাকাটা করতে হবে তো!

কত চাই?

পাঁচশো।

তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে পিটার?

মাথা আমার ঠিকই আছে ক্যাপ্টেন।—পিটার সহজ ভঙ্গিতে বলল, আমি আমার প্রাপ্য টাকাই চাইছি।

ডেনেস তৎক্ষণাৎ একটা চেক লিখে পিটারের হাতে দিয়ে বললেন, এই শেষ কিন্তু। এরপর আমায় আর বিরক্ত কোরো না।

তা হয় না ক্যাপ্টেন। রেস থেকে যে টাকা তুমি পেয়েছ, তার অর্ধেকও আমায় দাওনি। অথচ সে রকমই কথা ছিল। যতক্ষণ না সমস্ত টাকা পাচ্ছি, ততক্ষণ এই রকমই চলবে। অবশ্য যদি তুমি লীনাকে আমার হাতে দাও, তবে টাকার কথা বেমালুম ভুলে যাব। কথা দিচ্ছি।

পিটারের প্রস্তাব শুনে ডেনেসের মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। তিনি রাগে কাঁপতে থাকেন। মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না।

পিটার ডেনেসের মনোভাব বুঝতে পারে। তবু সংযত কণ্ঠে বলে, লীনা কিন্তু রাজি আছে ক্যাপ্টেন। শুধু তুমি মত দিলেই হয়।

গেট আউট। ডেনেস গর্জে উঠলেন।

পিটার চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। যাওয়ার সময় বলে গেল, তুমি বেঁচে থাকতে, জানি, কোনোদিন লীনাকে পাব না। অথচ লীনাকে আমার চাই; যে কোনো মূল্যে। এর জন্য যদি তোমাকে খুন করতে হয়, তাতেও রাজি।

পিটার চলে গেলেও ডেনেসের বিরক্তি ভাবটা কাটে না। ছেলেটার স্পর্ধা দেখে তিনি আশ্চর্য হয়ে যান। তাঁকে শাসিয়ে গেল। ডেনেস ঠিক করলেন, এক্সপিডিশন থেকে ফিরে এসে এর একটা বিহিত অবশ্যই করবেন।

চা শেষ করে একটা সিগারেট ধরালেন তিনি। একমুখ ধোঁয়া ছাড়তেই দেখলেন এলভিন আসছে। বিরক্তিতে ডেনেসের ভ্রু কুঁচকে আসে। এলভিন কাছে আসতেই দাঁত—মুখ খিঁচিয়ে বললেন, তোমারও বুঝি টাকার দরকার?

এলভিন সোল্লাসে শিস দিয়ে উঠল, আশ্চর্য, আজকাল জ্যোতিষ চর্চা করছ নাকি ক্যাপ্টেন? আজকে সত্যিই আমার টাকার দরকার।

আমি আর এক পয়সাও দিতে পারব না।

দেবে না?

না। তোমার কোনো টাকা আমার কাছে নেই।

সেকি! এলভিন বিস্মিত কণ্ঠে বলল, নগদ দশ হাজার পাউন্ড। বেমালুম ভুলে গেলে?

না ভুলিনি এলভিন, সব মনে আছে। দুরবস্থায় পড়ে তোমার কাছ থেকে ধার নিতে হয়েছিল। তুমি আমায় সেদিন টাকা দিয়ে যে উপকার করেছ, তা আমি কোনোদিনই ভুলব না।

বেশ, টাকা না দাও, সেই উপকারের প্রতিদান দাও।

কি প্রতিদান?

তোমার মেয়েকে আমি চাই ক্যাপ্টেন।

কিছুক্ষণ অগে পিটারও এমন আব্দার করেছিল। ডেনেস ভাবেন, এরা মানুষ না জানোয়ার? সারা ইংলন্ডে আরও তো মেয়ে রয়েছে, তবে লীনাকে নিয়ে এরা এত অস্থির কেন?

কি ভাবছ, ক্যাপ্টেন?

ও কথা আর মুখে এনো না এলভিন। ডেনেস ধমকের সুরে বললেন, তোমার মতো সুদখোর দালালের হাতে আমি আমার মেয়েকে সঁপে দিতে পারি না।

এলভিন এর উত্তরে হেসে বলল, আমায় দালালই বলো আর সুদখোরই বলো, প্রয়োজন হলে আমার কাছেই তো আসো।

আর আসব না। আমার এই কটেজ ছাড়া স্থাবর—অস্থাবর সমস্ত মিলিয়ে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডের বেশি আছে। সবই তুমি পাবে।

কবে?

আমি মারা যাবার পর।

তা হলে তো তোমায় খুব শিগগির মরতে হচ্ছে ক্যাপ্টেন। নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠল এলভিন।

আজ যখন এসব কথা ভাবেন ডেনেস, তখন তার চোখে ঘুম আসে না। তিনি নিজেকেই দুষতে থাকেন। কাদেরকে নিয়ে এসেছেন এক্সপিডিশনে! অথচ এমনটা তিনি চাননি। রেনেল, এলভিন, পিটার তিনজনেই দক্ষ পর্বতারোহী। আল্পস পাহাড় জয় করেছে তিনজনেই। এদের সাহস দেখে তিনি এখানে নিয়ে এসেছেন। ভেবেছেন, হয়তো হিমালয়ে গেলে এরা সব বদলে যাবে। তখন শুধু এক্সপিডিশনের চিন্তা। কিন্তু তিনি দেখলেন, তাঁর ধারণা ধূলিসাৎ করে তিনজনে নোংরা খেলায় মেতেছে। উপলক্ষ্য লীনা।

লীনাকে তিনি আনতে চাননি, কিন্তু লীনা শোনেনি। নিজে গিয়ে দূতাবাস থেকে অনুমতিপত্র নিয়ে এসেছিল। ডেনেসের কোনো বাধা টেঁকে নি। কিন্তু হয়তো লীনাকে না আনলেই ভালো হত। দলে এমন করে ভাঙন ধরত না। সামান্য একজন মেয়ের জন্য সাহসী তিন পুরুষ কেমন ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে, ডেনেস নিজের চোখেই দেখছেন।

ঈশ্বরের সৃষ্টিটা বড়ই অদ্ভুত। নইলে যে নারীকে তিনি অবলা করে রেখেছেন, সেই নারীর চোখে দিয়েছেন অগ্নিবাণ। এই অগ্নিবাণে প্রলয় নামে। সৃষ্টি ধ্বংস হয়। কতগুলো বোকা পুরুষ এই চোখে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনে। পুরুষত্ব জলাঞ্জলি দিয়ে নোংরা প্রতিযোগিতায় নামে। যার শেষ হয় করুণ পরিণতিতে।

ডেনেসেরও আশঙ্কা, হয়তো এভারেস্টে এমন কোনো করুণ পরিণতি অপেক্ষা করে আছে। তাতে কে যাবে, কে জানে? হয়তো রেনেল, হয়তো পিটার, হয়তো বা এলভিন। কে সে?

সন্ধের দিকে একজন শেরপা ১নং ক্যাম্পে চিঠি নিয়ে এল। ডেনেসের চিঠি। মেঘ কেটে গেছে। পিটার যেন দলবল নিয়ে ওপরে আসে।

পরদিন সকালে ১ নম্বর তাঁবু গুটিয়ে অভিযাত্রীরা ২ নম্বর ক্যাম্পের দিকে যাত্রা করল। কিন্তু ২নং ক্যাম্পে পৌঁছে দেখল, ক্যাম্প শূন্য।

পরদিন আবার যাত্রা। সবার মনে একটা অস্থিরতার ভাব। আকাশ জুড়ে মেঘের রাজত্ব। প্রচণ্ড হাওয়া শুরু হয়েছে। কুচি কুচি বরফ চোখে ঢুকছে। হাওয়ার গতি যত বাড়ে, ওদের চলার বেগ তত কমে আসে। ওরা সবাই হাঁপাচ্ছে। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। একটু পরেই পাহাড়ের বুকে অন্ধকার নেমে আসবে।

সারাটা দিন ওরা হেঁটেছে। এখন ক্লান্তিতে আর পা উঠতে চাইছে না। তার ওপর পিঠে কয়েক মণ বোঝা। ফলে পনেরো মিনিটের রাস্তা পেরোতে ওদের পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় লাগছে।

দাজু হেরনুস।

তামাং হাত দিয়ে সামনের দিকে দেখাল। মাত্র কয়েক গজ দূরে ডেনেসের তাঁবু। খুব তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে মিনিট দশেকের মধ্যে তারা ডেনেসের তাঁবুর সামনে এসে দাঁড়াল।

রাত আটটা।

যুদ্ধে বিধ্বস্ত কয়েকজন রণক্লান্ত সৈনিক এয়ার ম্যাটট্রেসে চুপচাপ শুয়েছিল। ডেনেস আকাশ—পাতাল ভাবছেন। প্রকৃতি তাঁদের ওপর বিরূপ। তুষার ঝড়ের বিরাম নেই। তার ওপর হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। ডেনেসের সব আশা শেষ হয়ে গেছে। এভারেস্ট বড় নির্মম। গুটিকয়েক অভিযাত্রীর সঙ্গে আজ সে শক্তি পরীক্ষায় মেতেছে। অথচ এদের সামর্থ্য কতটুকু। ডেনেস কোহলিকে সেই কথাই বললেন। কোহলি কিন্তু এখনও আশাবাদী। তাঁর বিশ্বাস, এভারেস্ট জয় করা অসম্ভব নয়। শুধু চাই সাহস আর ধৈর্য। তাই তিনি ক্যাপ্টেনকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, এখনই মুষড়ে পড়ছ কেন? যথেষ্ট সময় আছে।

না, ডাক্তার, আর সময় নেই।—ডেনেস হতাশ কণ্ঠে বললেন, সামনে বর্ষা। তারপর দলের অনেকেই অসুস্থ। কোন ভরসায় ওপরে উঠব?

কোহলি মৃদু হেসে বললেন, এই সামান্য বিপদে হাল ছাড়লে তো হবে না। তুমি অন্নপূর্ণা অভিযানের কথা জান না। কি সাংঘাতিক বিপদে সেই অভিযাত্রীরা পড়েছিল, তা জানলে তুমি হয়তো কোনোদিন এ পথে আসতে না। অথচ তাদের মনোবল, সাহসই শেষ পর্যন্ত তাদের জিতিয়ে দিল। তারা ফিরে এল নিরাপদে। আর তোমরা? অর্ধেক রাস্তাও পেরোওনি, এরই মধ্যে নিরাশ হয়ে বসে আছো। তোমরা ভেবেছিলে, সকালে রওনা হয়ে সন্ধের মধ্যে মাউন্ট এভারেস্ট জয় করে বসে থাকবে। তাই না? এতই যদি সহজ হত, তবে এত পরিশ্রম ও এত কষ্ট সহ্য করে মানুষ এ পথে আসত না।

এতক্ষণে লীনা মুখ খুলল। দলের প্রতি একবার বিরক্তি ভরা দৃষ্টি চালিয়ে ও বলল, ওদের কথা ছেড়ে দাও ডাক্তার। গায়ে পুরুষের চামড়া থাকলেই পুরুষ হওয়া যায় না। এদেরকে তুমি পুরুষ ভেবো না। প্রথম থেকেই একটা নেগেটিভ মনোভাব নিয়ে এরা এখানে এসেছে। কিন্তু তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো, ওরা যদি না যায়, তবে আমি একাই চেষ্টা করব।

সত্যি, পারবে? ডাক্তার উৎসাহিত হয়ে বললেন।

চেষ্টা করতে দোষ কি!

সাবাস।

উঁহু, সাবাস নয়। তুমি অন্নপূর্ণা অভিযানের কথা বলো ডাক্তার। তারা অন্নপূর্ণা জয় করতে পেরেছিল?

পেরেছিল।—ডাক্তার বললেন, উঠতে তেমন কষ্ট হয়নি। কিন্তু নামার মুহূর্তে এসেছিল দুর্যোগ। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষার লড়াই।

তা হলে লড়াইয়ের কথা বলো।

বেশ, শোন তাহলে। ডাঃ কোহলি শুরু করলেন, অন্নপূর্ণা অভিযানের রোমাঞ্চকর সেই অধ্যায়—

অন্নপূর্ণার শীর্ষে আরোহণের পর মরিস যখন নীচের ক্যাম্পে ফিরে এল, তখন তুষার—ক্ষতে তার হাত শক্ত কাঠ হয়ে গেছে। হাতে কোনো শক্তি নেই। এদিকে সারা রাত ধরে তাঁবুতে চলল অন্নপূর্ণার প্রচণ্ড আক্রমণ। তুষার ঝড় শুরু হয়েছে। প্রচণ্ড সে ঝড়। যেন হাজার হাজার দৈত্য বজ্র হুঙ্কারে পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসছে। দুই তাঁবুতে দুই মৃতপ্রায় মানুষকে শুশ্রূষা করছে টেরি আর রেবুফা। মরিস ও বিঁকতের অবস্থা শোচনীয়। বিঁকতের পা ফুলে গেছে। জুতো ঢুকছে না। অথচ খালি পায়ে নীচে নামা মানে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা। কিন্তু তাই বলে ওপরে থাকাও তো চলবে না। টেরি সে সমস্যার সমাধান করে দিল। নিজের পায়ের বড় জুতোটা বিঁকতকে দিল। আর বিঁকতের ছোট জুতো নিজে পরে নিল। পা সোজা করার জন্য সামনের দিকটা কেটে দিল। এ এক দুঃসাহসিক ব্যাপার। বন্ধুর জন্য নিজের বিপদ ডেকে আনা হয়তো হিমালয়েই সম্ভব।

পরদিন আরও নীচে নামার কথা। ঠান্ডা প্রচণ্ড ভাবে বাড়ছে। সূর্যের আভাস মাত্র নেই। চারিদিকে ঘন মেঘ। কুয়াশাচ্ছন্ন পথ। দু—হাত দূরের মানুষকে দেখা যাচ্ছে না। কথা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। অস্পষ্ট। এই অবস্থায় অসুস্থ মরিস ও বিঁকতকে নিয়ে রওনা হল টেরি ও রেবুফা। কিন্তু সন্ধের দিকে ওরা পথ হারাল। ক্যাম্পের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সকলে মিলে চিৎকার শুরু করল, হেলপ, হেলপ! তাদের চিৎকার পাহাড়ে প্রতিধ্বিনিত হয়ে ফিরে এল, কোনো উত্তর পেল না।

হিমালয় বড় নিষ্ঠুর। তার দয়া নেই। তার রাজ্যে অনধিকার প্রবেশ করলে, সে কাউকে ক্ষমা করে না। বাধা দেয় প্রচণ্ড ভাবে।

শুরু হল তুষার ঝড়ের দাপট। টেরির পায়ে তুষার—ক্ষত শরু হয়েছে। তার পা দ্রুত পঙ্গু হয়ে আসছে। টেরি তার পা’কে সক্ষম করতে অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কখনও পায়ে মালিশ করছে। হাত দিয়ে পা ঘষে গরম রাখার চেষ্টা করছে। কখনও আঙুল টিপে দেখছে, তাতে প্রাণ আছে কিনা ও বিঁকতের অবস্থাও শোচনীয়। লাশনালের মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে।

দিন শেষ হয়ে এল। এল সন্ধ্যার আঁধার। পাহাড়ে অন্ধকার বড় ভয়ঙ্কর। এ এক কালরাত্রি। অভিযাত্রীরা রাতকে বড় ভয় করে। চব্বিশ হাজার ফুটের কাছাকাছি, উঁচুতে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা মানে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা। কিন্তু উপায় কি?

গর্ত করে বাস করা অসম্ভব। মরিস একরকম পঙ্গু। কোনো কিছু করার ক্ষমতা নেই। বিঁকতের অবস্থাও তথৈবচ। লাশনাল অর্ধ উন্মাদ। টেরি একা কি করবে?

এদিকে তুষার ঝড়ের প্রকোপ বাড়ছে। খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর। বেশিক্ষণ দাঁড়ালে মৃত্যু অনিবার্য। হঠাৎ সামনে একটা ফাটল দেখে উল্লসিত লাশনাল অগ্র—পশ্চাৎ বিবেচনা না করে নেমে পড়ল। ওর দেখাদেখি সবাই নামল। উত্তাপ বাঁচাতে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে রইল। কথা পর্যন্ত বলতে সাহস করল না। পাছে উত্তাপ বেরিয়ে যায়। অথচ তারা কঠিন বরফের ওপর শুয়ে আছে। ওপরে বরফের আস্তরণ। পাশে বরফের দেয়াল। সে এক বীভৎস ব্যাপার। রেবুফার পা আবার জমতে শুরু করেছে। মরিস নিশ্চল। সে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। লাশনাল বিড়বিড় করে আবোলতাবোল বকে চলেছে। একমাত্র টেরির তখনও আশা, সে বাঁচবে। তাই সে আপন যন্ত্রণা ভুলে লাশনালের সেবা করছে, কখনও মরিসের হাত—পা ম্যাসেজ করছে। সে নিজেও অভুক্ত। তিনদিন কিছু পেটে দেয়নি। কিন্তু তাতে তার ভ্রূক্ষেপ, নেই দক্ষ হাতে সবার সেবা করে চলেছে।

বাইরে অন্নপূর্ণা ফুঁসছে। দেবী অন্নপূর্ণা। যে অন্নপূর্ণা ঘরে ঘরে অন্ন যুগিয়েছেন। এনেছেন শান্তি। সন্তানের হাহাকারে যিনি স্থির থাকতে পারেননি, সেই অন্নপূর্ণাই আজ অগ্নিমূর্তি ধারণ করলেন।

মৃত্যুপথযাত্রীর করুণ আবেদনেও তাঁর হৃদয় গলল না। উন্মাদিনী হয়ে উঠলেন তিনি। শত শত টন বরফ পড়তে লাগল। বরফের স্রোত বয়ে চলল। সকালের দিকে বিরাট বরফ—ধস গুহার মধ্যে গিয়ে পড়ল। বরফে ঢেকে গেল অভিশপ্ত অভিযাত্রীরা। টেরি রঙিন চশমা খুলে রেখেছিল। বরফ ধসে সে চোখ হারাল। টেরি এখন সম্পূর্ণ অন্ধ। রেবুফা আগেই অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সব আশা গেল। সকালের দিকে মরিস বাঁচবার যে ক্ষীণ আশা দেখেছিল, তাও গেল। কিন্তু আশ্চর্য টেরির মনোবল। সে যেন মৃত্যুকে উপেক্ষা করে এগোতে চায়। প্রথমে সে মরিসকে দড়ি দিয়ে টেনে বের করল। এরপর লাশনালকে ওঠাল। লাশনাল তখনও প্রলাপ বকছে। মরিস জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছে। বহুবার সে টেরিকে বলেছে, কেন আমায় শুধু শুধু বয়ে নিয়ে যাচ্ছ। এখানে ফেলে যাও।

টেরি শোনেনি সেকথা। বলেছে, বাঁচলে আমরা সবাই এক সঙ্গে বাঁচব, মরলে একসঙ্গে মরব। তোমায় একলা ফেলে যাব কেন?

মৃতপ্রায় মানুষগুলো সকালে ঘণ্টা দুয়েক পরিশ্রমের পর অবশেষে তাঁবু খুঁজে পেল। তাঁবুতে ফিরে সবিস্ময়ে দেখল, কাল পথ হারিয়ে ওরা যখন অন্ধের মতো এদিক—ওদিক ঘুরছে, তখন তাঁবু মাত্র দু’শ গজ দূরে। ভাগ্যের কি চরম পরিহাস!

শেরপারা সাহায্যের জন্য এগিয়ে এল। মরিস শেরপার কাঁধে ভর দিয়ে নীচে নেমে এল। রেবুফা হাঁটছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। মুখ পুড়ে কুৎসিত হয়েছে। এরপর লাশনাল। সে অন্ধ। দুজন শেরপার কাঁধ ধরে যখন ও নামছিল, মনে হচ্ছিল সে যেন নেশা করে হাঁটছে।

এরপর রয়েছে টেরি। শেরপাকে আশ্রয় করে সে পথ চলছে। সেও অন্ধ হয়েছে। তাকে চেনা মুসকিল। আগের চেহারা আর নেই। এ যেন টেরির প্রেতাত্মা।

এদিকে মরিসের তুষার—ক্ষত পচতে শুরু করেছে। যত নীচে নামবে, ততই পচবে। কারণ নীচে গরম। ডাক্তার আর দেরি করলেন না, মরিসের স্বার্থেই দেহের কয়েকটি অংশ বাদ দিতে বাধ্য হলেন। প্রথমে আঙুল গেল। এরপর হাত গেল। পা গেল। মরিসের গগনভেদী আর্তনাদে কান পাতা দায়। সমস্ত পাহাড় সে কান্নায় কেঁপেছে। চোখের জল ফেলেছে দলের লোকেরা।

কোহলি থামলেন। সমস্ত তাঁবুতে নিস্তব্ধতা নেমে এল, কারো মুখে কোনো কথা নেই। কোহলি হঠাৎ যেন তাদের পুরুষত্বকে চরমভাবে আঘাত হেনেছেন। তাদের যে ইন্দ্রিয় চেতনাহীন অবস্থায় শায়িত ছিল, আজ সে ইন্দ্রিয়কে ডাক্তার জাগিয়ে তুললেন। সেই প্রবল জাগরণের ঢেউ বিবেক পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছল। তাই লজ্জায় সে মুহূর্তে কেউ কোনো সাফাই গাইবার চেষ্টা করল না।

মাইক ডেনেস অতি সন্তর্পণে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলেন। বিশ্বাসঘাতক এভারেস্টকে দু’চোখ ভরে দেখবার চেষ্টা করলেন। ডেনেসের স্বপ্ন ভেঙে গেছে। অথচ একদিন এভারেস্টের স্বপ্ন দেখে চাকরি ছেড়েছিলেন।

সে আজ দু—যুগ আগেকার কথা।

সেদিন চাকরি ছেড়ে দিলেও এক্সপিডিশনের ব্যবস্থা করতে পারেননি। দেশ থেকে টেলিগ্রাম পেয়ে ছুটে গিয়েছিলেন লন্ডনে। কিন্তু তাঁর ভাগ্য বিরূপ। প্রিয়তমা স্ত্রীকে বাঁচাতে পারেননি। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে তাঁর স্ত্রী প্রাণত্যাগ করেছিলেন।

সদ্যোজাত কন্যাকে বুকে নিয়ে স্ত্রীর শোক ভুলতে চেয়েছিলেন ডেনেস। তবুও প্রতিটি প্রয়োজনীয় মুহূর্তে স্ত্রীর অভাব বড্ড বেশি অনুভব করতেন। যে পাহাড়ের আকর্ষণে তিনি চাকরি ছেড়েছিলেন, তার মোহময়ী রূপও ভুললেন। কন্যা লীনার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেললেন। লীনাকে মানুষ করার কথা ভাবলেন। লীনা বেপরোয়া ধরনের মেয়ে। দুরন্ত প্রকৃতির। যেখানে বিপদ, সেখানে তার আগ্রহ বেশি। মা—হারা মেয়েকে ডেনেস কিছুতেই শাসন করতে পারতেন না, স্ত্রীর মুখখানা ভেসে উঠত। মায়ের মুখখানাই পেয়েছে মেয়ে।

সেবার ডাক্তারের পরামর্শে ডেনেস লীনার সঙ্গে সুইজারল্যান্ডে এলেন স্বাস্থ্যোদ্ধারের আশায়। লীনা তখন কেমব্রিজের ছাত্রী। এখানেই ডেনেস আল্পসকে দেখলেন। মধ্যাহ্নের সূর্যালোকে আল্পস যেন যীশুর প্রতিমূর্তি। আল্পসের পবিত্রতায় ডেনেস নিজেকে হারিয়ে ফেললেন। পুরোনো আকাঙ্ক্ষাটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। কৌতূহল বয়সের বাধা মানে না। সংকল্প যৌবন—বার্ধক্য দেখে না। ডেনেস পাহাড়ে চড়ার ট্রেনিং নিলেন। লীনাও বাবার উৎসাহে বেসিক ট্রেনিং নিল। ট্রেনিং নেবার মাস তিনেকের মধ্যে এক অভিযাত্রী দলের সঙ্গে দুজন আল্পস পর্বত জয় করলেন। সেই শুরু। এরপর ইউরোপের কয়েকটা ছোটখাটো পর্বতশৃঙ্গ জয় করার পর তাদের মনোবল বেড়েছে। তারা আরও উঁচুতে উঠতে চেয়েছে—অনেক উঁচুতে। বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টে—তাই এই অভিযান।

অভিযানের ফল দেখে ডেনেস হতাশ হয়ে পড়েছেন। কোহলি দলে সাহস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ডেনেস জানেন সব বৃথা। কোহলির গল্প সে অস্বীকার করে না। কিন্তু তার চেয়েও ভয়ানক গল্প তার জানা আছে। সে গল্প মাউন্ড এভারেস্টের নৃশংসতাকে নিয়ে। এই এভারেস্টের বুকে একদিন হারিয়ে গেছিল ম্যালেরি আর আরভিন। দুঃসাহসের ইতিহাসে আজও যারা অমর।

সেটা ১৯২৪ সালের ঘটনা।

ম্যালেরি দ্বিতীয়বারের জন্য এভারেস্টে এল। প্রথম অভিযান চরম বিপর্যয়ের মধ্যে অসম্পূর্ণ অবস্থায় শেষ হয়েছিল। বেপরোয়া ম্যালেরি বিন্দুমাত্র না ঘাবড়ে আবার এল হিমালয়ের আঙ্গিনায়। এভারেস্টের পদপ্রান্তে। কিন্তু এভারেস্ট ম্যালেরিকে ভালো মনে নিতে পারল না। বেসক্যাম্প থেকে শুরু হল প্রচণ্ড আক্রমণ। প্রচণ্ড ঠান্ডায় সদস্যরা জমে যেতে লাগল। ম্যালেরির কথা বন্ধ হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে দুজন শেরপা ঠান্ডায় মারা গেল।

এর মাঝে নর্টন ও সোমার ভেলের ২৮০০০ ফুট উঁচুতে উঠল বিনা অক্সিজেনে। এ এক অভাবনীয় সাফল্য। এর আগে বিশ্বে কেউ বিনা অক্সিজেনে এত উঁচুতে ওঠেনি। ম্যালেরি তখন অসুস্থ।

নর্টন ও সোমার ভেলের সাফল্য দেখে পরদিন অসুস্থ শরীর নিয়ে সে যাত্রা করল। সঙ্গে নিল আরভিনকে। ওরা ৫ নম্বর শিবির ছেড়ে আরও ওপরে উঠতে লাগল। বহুক্ষণ তাদের কোনো খোঁজ না পেয়ে ওডেল খুঁজতে বেরোল। কিন্তু চারদিকে সাদা বরফ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না। দুপুরের দিকে ওডেল দূরে দুটো কালো বিন্দু দেখতে পেল। ও—দুটো বিন্দু ম্যালেরি ও আরভিন ছাড়া আর কারো নয়। ওরা ধীরে ধীরে এভারেস্টের শীর্ষের দিকে এগোচ্ছিল, অত্যন্ত সন্তর্পণে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে। এরপর ওডেল ওদের আর দেখতে পেল না। একরাশ কালো মেঘ এসে সমস্ত কিছু ঢেকে ফেলল। আর দাঁড়িয়ে থাকা নিরর্থক ভেবে ওডেল ৪ নম্বর তাঁবুতে গিয়ে ঢুকল।

সে রাত্রে ম্যালেরি ও আরভিন ৪ নম্বর তাঁবুতে ফিরল না। ওডেল ভাবল, রাত বেশি হয়ে গেছে ভেবে নিশ্চয় দুজনে এল না।

সকালের দিকে খুশি মনে ওডেল রওনা হল। ওর স্থির বিশ্বাস, ম্যালেরি এভারেস্ট শীর্ষে আরোহণ করেছে। এতক্ষণ হয়তো নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। কিন্তু ৫ নম্বর তাঁবুর দরজা খুলতেই দেখল, তাঁবু ফাঁকা।

এবার ওডেল ভয় পেল। বাইরে প্রচণ্ড হাওয়ার বেগ। বরফের স্রোত বয়ে চলেছে চতুর্দিকে। সারা রাত্রি ওডেল চিন্তায় কাটিয়ে দিল। ঠিক করল পরদিন ৬ নম্বর তাঁবুতে যাবে। সারাটা রাত্রি আবোল—তাবোল চিন্তায় কেটে গেল। কখনও ভেবেছে, ওরা অবশ্যই ৬ নম্বর ক্যাম্পে আছে। কাল পরিশ্রান্ত হয়ে নীচে নামেনি। হয়তো বা আরভিন আহত। কিংবা প্রচণ্ড হাওয়ার দরুন নীচে নামার সাহস পায়নি। আসলে ওডেল নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। যদিও তার মনে তখনও ঝড় বইছিল।

পরদিন ৬ নম্বর ক্যাম্পে গিয়ে দেখল ক্যাম্প শূন্য। ওরা কেউ ফেরেনি। ভয়ে ওডেল, ম্যালেরি ও আরভিনের নাম ধরে চিৎকার করতে লাগল। কিন্তু সব বিফলে গেল, কোনো প্রত্যুত্তর এল না। চিৎকার পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল মাত্র। ওডেল পাগলের মতো খুঁজে বেড়াল, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না।

সেই যে তারা হারাল, আর কোনোদিন ফিরল না। আজও ম্যালেরি রহস্য থেকে গেছে। বহুজন বহুমত পোষণ করেছে, কিন্তু কেউ ম্যালেরি রহস্যের কিনারা করতে পারেনি।

ডেনেস ম্যালেরির কথাই ভাবেন। ভাগ্যবিড়ম্বিত এক কর্মঠ পুরুষ। মৃত্যুকে এরা ভয় পায় না। সমস্ত ঝড়ঝঞ্ঝা হাসিমুখে বরণ করে। বিপদ এদের বিচলিত করে না। বরং বিপদে এরা আনন্দ পায়। লড়াই করার খোরাক জোটে।

অথচ ডেনেস জানেন, তাঁদের দলে ম্যালেরির মতো সাহসী যুবক নেই। সব অপদার্থ। ঈর্ষাকাতর। এরা হিমালয়ে আসার উপযুক্ত নয়। যাদের মনে রয়েছে পাপ, তারা মহৎ কাজ করবে কি করে? ডেনেস ভরসা পান না। এভারেস্ট জয় অসম্ভব, একথা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন। রোজ শত শত টন বরফ ধসে পড়ছে। আঘাতের পর আঘাতে বিপর্যস্ত অভিযাত্রী দল।

ডেনেস নিজের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেললেন। ক্রুদ্ধ বাতাসের সোঁ সোঁ আওয়াজ তাঁর হতাশাকে আরো বাড়িয়ে তুলল।

ডেনেস অন্যমনস্ক ভাবে এভারেস্টের দিকে চেয়ে রইলেন। ভাবলেন, যদি ম্যালেরির মতো তিনিও এভারেস্টের বুকে হারিয়ে যান।

ঠিক সেই সময় ভেনেসের অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে একটা হিমশীতল হাত অতি সন্তর্পণে তার কাঁধ স্পর্শ করল। ডেনেস চমকে পিছনে মুখ ফেরাতেই ভয়ে তাঁর মুখখানা কাগজের মতো ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। ডেনেস অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন, ইয়েতি!

তাঁর ডাক হাওয়ায় ভেসে তাঁবুতে এসে পৌঁছল। সবাই ছুটে তাঁবুর বাইরে এল। ডেনেস ততক্ষণে নীচে গড়াতে শুরু করেছেন। তাঁর পা অসাড়। এমন জোর নেই যে পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ান। ক্লাইম্বিং দড়িটা পাহাড়ের কোণে আটকে যায়। দড়ি ধরে ঝুলতে থাকেন ডেনেস। তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসে। সর্বাঙ্গে রক্ত। পায়ের হাড় সরে গেছে। তবু হার মানতে চান না তিনি। মরিয়া হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে থাকেন।

কিন্তু কতক্ষণ? একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়লেন তিনি। ইয়েতি এগিয়ে এল। দড়িতে হাত রাখতেই ডেনেস চিৎকার করে উঠলেন, হেলপ—হেলপ।

শব্দ লক্ষ্য করে ওরা ছুটতে থাকে। একরাশ উৎকণ্ঠা ওদের চোখে—মুখে। সবচেয়ে চিন্তিত কোহলি। তিনি জানেন, ক্যাপ্টেন বড্ড ইমোশনাল। না, গল্পটা তার বলা উচিত হয়নি। ভগবান না করেন, যদি কিছু হয়, তবে কোহলি নিজেকেই দুষবেন।

শব্দ লক্ষ্য করে যখন তারা লক্ষ্যস্থলে এসে পৌঁছোল তখন ডেসেলের রক্তাক্ত মৃতদেহটা পাহাড়ের গা বেয়ে অতল খাদে গড়িয়ে পড়ছে।

দূরে তুষারে ঢাকা মনুষ্যাকৃতি এক দানব পাহাড়ের খাঁজে গিয়ে আত্মগোপন করল।

বিস্মিত অভিযাত্রীরা ভয় পেয়ে সমস্বরে বলে উঠল, ই—য়ে—তি! ততক্ষণে লীনা জ্ঞান হারিয়েছে।

তদন্ত

ফাইল পড়া শেষ হতেই দেখি, কঙ্কণ ফিরে এসেছে। পাশের চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিয়ে ও বলল, কিছু বুঝলি?

খুন—খারাবির কোনো চিহ্নই তো দেখতে পেলাম না।

কেন?

সবাই ইয়েতি দেখেছে। আর এটাও স্পষ্ট, ইয়েতির ভয়ে ক্যাপ্টেন পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়েছেন।

ব্যস, হয়ে গেল। তাই না? কঙ্কণ মুচকি হেসে বলল।

তা ছাড়া আর কি?

বন্ধু, আমরাও তোর কথা ধরে নিতাম, যদি লীনা স্বয়ং এটাকে মার্ডার না বলত।

মানে?

মানে—লীনা ব্রিটিশ অ্যাম্বাসিতে গিয়ে প্রথম অভিযোগ করে, তার ড্যাডিকে নাকি হত্যা করা হয়েছে।

কিন্তু ইয়েতি?

ও ওসব বিশ্বাস করে না।

স্ট্রেঞ্জ!

নো স্ট্রেঞ্জ। ভারি বুদ্ধিমতী মেয়ে। ও কমপ্লেন না করলে, সকলেই ধরে নিত এটা একটা সিম্পলি অ্যাক্সিডেন্ট।

একটু অবাক হয়ে বললাম, তুমিই বা কি করে এটাকে মার্ডার বলছ?

ডিবে থেকে একটা পান বার করে মুখে দিয়ে কঙ্কণ বলল, প্রমাণ আছে বন্ধু। বিনা প্রমাণে কঙ্কণ চৌধুরী কোনো কথা বলে না। কিছুক্ষণ আগে তোকে যে দড়িটা দেখিয়েছিলাম, মনে আছে তো?

সেই রক্তওয়ালা দড়ি তো?

ইয়েস।

দড়িটাকে ভালো করে দেখেছিস তো?

কেন বলো তো?

ভালো করে লক্ষ করলে দেখতে পেতিস, দড়িটার মাথাটা মসৃণ ভাবে কাটা। অর্থাৎ যদি ক্যাপ্টেন দড়ি ছিঁড়ে নীচে পড়তেন, তবে এমন মসৃণভাবে দড়ি ছিঁড়ত না, এবড়োখেবড়ো ভাবে ছিঁড়ত।

তাহলে বলতে চাও, দড়ি কেটে দেওয়া হয়েছে?

গুড। এই তো বুদ্ধি খুলেছে। ঠিক ধরেছিস, দড়ি কাটা হয়েছে। মানে, মার্ডার। তুষার মানব কখনই ছুরি দিয়ে দড়ি কাটতে যাবে না নিশ্চয়। হত্যাকারী যখন দড়ি কাটছিল, তখন ডেনেস বাধা দিয়েছিলেন। ফলে ছুরি তাকেও রেহাই দেয়নি। ডেনেসের যেমন হাত কেটেছে, তেমনি অসাবধানতাবশত হত্যাকারীরও হাত কেটেছে। ফলে দড়িতে দুজনারই রক্ত।

কিন্তু হত্যাকারী কে?—কথাটা হঠাৎ মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল।

কঙ্কণ চৌধুরী পিকদানিতে পিক ফেলে একগাল হেসে বলল, ওরে পাঁঠা, যদি তাই জানতাম, তবে এত পরিশ্রম কেন?—সত্যি, শালা তুই একটা গর্দভ।

গালাগালি হজম করে বললাম, তোমার কাকে সন্দেহ হয়?

ভালো করে গল্পটা পড়েছিস তো?

নিশ্চয়।

তবে তুই বল দেখি, কে খুন করতে পারে?

এলভিন, পিটার বা রেনেলও হতে পারে।

কেন?

খুন করার মোটিভ তিনজনেরই আছে। রেনেল অর্থপিশাচ। এলভিন ও পিটার নারীলোভী। আর এই তিনজনেরই একমাত্র বাধা ডেনেস। সুতরাং—

কিন্তু বন্ধু তিনজনে মিলে নিশ্চয় খুন করেনি। করেছে একজন। এখন প্রশ্ন—কে সে?

তোমার কি ধারণা? পাল্টা প্রশ্ন করলাম আমি।

ওসব ধারণা—টারণার কথা বাদ দাও বন্ধু। তার চেয়ে বরং আয়, তিনজনের অতীত নিয়ে আলোচনা করি। প্রথমে ধর এলভিন, বয়স তিরিশ হবে। রোদে পোড়া তামাটে রং। কটা চোখ।

ইউরোপে পাহাড়ে চড়ার ট্রেনিং নেয়। পেশায় সুদখোর দালাল। ডেনেস এর কাছে বিস্তর ধার নিয়েছেন। এলভিন পয়সার বদলে লীনাকে চায়। কিন্তু ডেনেসের ঘোর আপত্তি। সুতরাং—

এরপর পিটার—রেসের জকি। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি লম্বা। কম কথা বলে। অথচ যা বলে অত্যন্ত স্পষ্ট বলে। সেও লীনার পাণিপ্রার্থী। ডেনেস এর বিস্তর টাকা ফাঁকি দিয়েছে। এখন পিটার টাকার বিনিময়ে লীনাকে চায়। কিন্তু ডেনেস রাজি হয় না। সুতরাং—

সবশেষে রেনেল। পেশায় পাইলট। পর্বতারোহী সংস্থার সদস্য। দীর্ঘদেহী। স্বাস্থ্যবান। মাথায় একরাশ সোনালি চুল।

রেনেলের একটা ভুল ধারণা ছিল—ডেনেস নাকি অগাধ সম্পত্তির মালিক। লীনারও সেই রকম বিশ্বাস ছিল। ডেনেস ওই রকমই একটা আভাস দিয়েছিলেন। রেনেল লীনাকে ভালোবাসলেও আসলে সে ছিল অর্থলোভী। সে চেয়েছিল ডেনেসের সম্পত্তি। কিন্তু লীনা যেদিন জানাল, ড্যাডির মৃত্যু ছাড়া সম্পত্তির কানাকড়িও পাওয়া যাবে না। তখনই রেনেল প্রমাদ গুনল। সুতরাং—

কঙ্কণ চৌধুরী থামতেই বললাম, ডেনেস লোকটাও খুব সুবিধের ছিল না।

ধড়িবাজ দি গ্রেট। সবাইকে নিয়ে খেলতে চেয়েছিল বুড়ো।

শেষে নিজেই মলো।—হেসে বললাম।

হেসো না বন্ধু, এখনো অনেক কাজ বাকি আছে।—কঙ্কণ চৌধুরী হঠাৎ উঠে পড়ে বলল, একটা খসড়া তৈরি করতে হবে। তার আগে আয়, ঘরটা পরিষ্কার করে নিই।

কঙ্কণ চৌধুরীর এ কথা শুনে অবাক না হয়ে পারলাম না। এ যে ভূতের মুখে রাম নাম, কঙ্কণ চৌধুরী করবে ঘর পরিষ্কার?

সেকথা বলতেই কঙ্কণ যেন রাগ করেছে এমন ভঙ্গিতে বলল, কেন, এতদিন অভদ্র ছিলাম বুঝি?

পুরোপুরি না হলেও, খানিকটা তো ছিলে।

আমার কথা শুনে ও হেসে ফেলল। তবে তা ক্ষণিকের জন্য। হাসির ফোয়ারা থামিয়ে মাথা চুলকে বলল, ভদ্র আর অভদ্রের তর্ক করার সময় নেই এখন। নে হাত লাগা।

কঙ্কণ চৌধুরীর ঘরটা ভদ্রস্থ করতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগল। কম পরিশ্রম নাকি! মাস ছয়েকের ধুলো ঝাড়া। নোংরা বিছানার ওপর আলমারি থেকে বার করে সুন্দর চাদর পেতে দিলাম। একটা বেঞ্চি বারান্দায় নিয়ে গিয়ে রাখতে হল। ওখানে অতিথিরা অপেক্ষা করবেন। বহু পুরোনো একটা ঝাঁটা দিয়ে কয়েক বছরের জমা ধুলো বাইরে ফেলে দিলাম। ডাস্টবিনে নোংরাগুলো ফেলতেই পাশের বাড়ির এক ফচকে মেয়ে হঠাৎ বলে উঠল, দু—বছর পরে আজ ডাস্টবিনে ময়লা পড়ল। কি দরকার ছিল বাপু ফেলার।

ওপরে তাকাতেই খিলখিল হাসি।

ঘর সাজানো শেষ হতে চেয়ারে বসে জুত করে সিগারেট ধরালাম।

এক কাপ চা হলে হত।

চা এখন হবে না বন্ধু, কেলোকে ফুল আনতে পাঠিয়েছি।

বিস্মিত কণ্ঠে বললাম, কি ব্যাপার বলো তো, এত ঘটা করে ঘর সাজাচ্ছ যে?

কঙ্কণ চৌধুরী নির্বিকার ভাবে বলল, বিদেশি বন্ধুরা যাতে নিন্দা না করতে পারে, সেই জন্যই এই ব্যবস্থা। বুঝতেই পারছিস, আমাদের দেশের যাতে বদনাম না হয়, তা আমাকে নিশ্চয় দেখতে হবে।

বাঃ, এই তো খাঁটি দেশপ্রেমিক। তোমার মতো সবাই যদি বুঝতে শিখত, তবে স্বাস্থ্যদপ্তর বলে কোনো দপ্তর রাখার প্রয়োজনই হত না।

আমার ঠাট্টা গায়ে না মেখে কঙ্কণ বলল, কথা না বলে, খাতা—পেন্সিল নিয়ে বস দেখি। খসড়া লিখতে হবে।

কিসের খসড়া?

কতগুলো প্রশ্নের।

প্রশ্ন? কাকে করবে?

যারা আসবে।

কারা আসবে?

যাদের ডেকে পাঠিয়েছি।

আর থাকতে না পেয়ে রেগে গিয়ে বললাম, এ সময় ঠাট্টা ভালো লাগছে না কঙ্কণ। হেঁয়ালি ছেড়ে আসল কথা খুলে বলো, নইলে এই চললাম—

উঠে পড়তেই কঙ্কণ চৌধুরী হাত ধরে বসাল। তারপর তো হেসেই খুন। হাসতে হাসতেই বলল, যাঃ, তোর তো দেখছি মেয়েদের মতো রাগ। আচ্ছা বাবা, ক্ষমা চাইছি! নে, বোস।….এই যে কেলো এসে গেছে। এবার চা পাবি।

কেলো ফুল নিয়ে ঢুকল। কঙ্কণ আলমারি থেকে বহু পুরোনো এক ফুলদানি বার করে ওতে ফুলগুলো সাজিয়ে রাখল।

কেলো চা করতে রান্নাঘরে যেতেই আমি প্রশ্নটা আবার করলাম, কারা আসছে, বললে না তো?

যাদের কথা কিছুক্ষণ আগে পড়লে।

তার মানে পিটার, এলভিন, রেনেল, লীনা, প্রবাল, উধম সিং, কোহলি, এরা?

রাইট।

শেরপাদের বাদ দিলে কেন?

ওরা প্রয়োজন হলে প্রাণ দিতে জানে, নিতে জানে না।

এ তো বুঝলাম, কিন্তু খসড়াটা কি?

লেখ—, কঙ্কণ খানিক ভেবে নিয়ে বলল, প্রথম প্রশ্ন : কি ধরনের শব্দ শুনেছিলেন? দ্বিতীয় প্রশ্ন : কি দেখলেন? তৃতীয় প্রশ্ন : ইয়েতি দেখেছেন? চতুর্থ প্রশ্ন : কি রকম দেখতে? পঞ্চম প্রশ্ন : এর আগে কোনো অভিযানে গিয়েছিলেন? ষষ্ঠ ও শেষ প্রশ্ন : সেই অভিযানে এ দলের কেউ ছিল?—ব্যস!

মাত্র এই ক’টা প্রশ্ন?

তবে কি আরও চাও?

বারে, বিস্তর প্রশ্ন আছে। রেনেলকে টাকার সম্বন্ধে, পিটার ও এলভিনকে লীনার সম্বন্ধে—

অবান্তর প্রশ্ন।

কেন?

সব প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা।

কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন আছে।

বলো।

থানা থাকতে, এখানে কেন ওদের ডাকলে?

বিশেষ একটা উদ্দেশ্য আছে।

কি উদ্দেশ্য?

তোমাকে এই মুহূর্তে জানাতে পারছি না বলে, আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।

এরপর কোনো প্রশ্ন করা চলে না। কেলো চা দিয়ে গেল। কঙ্কণ চৌধুরী চায়ে চুমুক দিয়ে তাগাদার ভঙ্গিতে বলল, তাড়াতাড়ি চা শেষ করে নে। ওরা এসে পড়লে ঝামেলা হবে। অত লোককে চা খাওয়ানোর পয়সা আমার নেই।

কঙ্কণ চৌধুরী স্বভাবতই কৃপণ স্বভাবের। সহজে পয়সা খরচ করে না। আমি না বললে, এ বাড়িতে কোনোদিন চা জোটে না। স্বেচ্ছায় কঙ্কণ চৌধুরী চা খাওয়াবে, একথা কোনোদিন কল্পনাও করি না।

চা শেষ হলে কঙ্কণ তড়িঘড়ি কাপগুলো রান্নাঘরে দিয়ে আসে, কেলোর জন্য অপেক্ষা করে না। তারপর রান্নাঘর থেকে আনা ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে টেবিলটা ভালো করে মুছে নেয়। ততক্ষণে সিঁড়িতে কয়েক জোড়া পায়ের শব্দ।

ওই ওরা এসে পড়ল।—কঙ্কণ চৌধুরী খুব দ্রুত রান্নাঘরের দিকে ছুটল।

প্রথমে ঢুকলেন পুলিশ ইন্সপেক্টর ভৌমিক। ওঁকে বিলক্ষণ চিনি। বহুবার সাক্ষাত হয়েছে—এই বাড়িতেই।

এরপর যাঁরা প্রবেশ করলেন, তাঁদের কাউকে আমি চিনি না। সাদা চামড়ার লোক আছেন, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ ভারতীয়ও আছেন। বিদেশিদের চোখে—মুখে একটা বিরক্তির ভাব। তাদের অত্যন্ত অসহিষ্ণু দেখাচ্ছে, কেমন যেন একটা যুদ্ধং দেহি ভাব।

বন্ধুটি কই? ভৌমিক জিজ্ঞেস করল।

এই যে এসে গেছি। হাত মুছতে মুছতে কঙ্কণ বলল।

কি করছিলে কিচেনে?

বার্লি খেয়ে এলাম।

বার্লি! ভৌমিক অবাক হয়ে বলল, জ্বর—টর হয়েছে নাকি?

ওই রকমই।

কই দেখি। ভৌমিক কঙ্কণ চৌধুরীর কপালে হাত রাখল : কই, গা তো ঠান্ডাই।

না ভাই, আগে থেকে সাবধান হওয়াই ভালো। কঙ্কণ শান্ত কণ্ঠে বলল।

তা ভালোই করেছ, সময়টা তো ভালো নয়।

ভৌমিক ব্যাপারটা বুঝতে না পেরেই কথাগুলো বলল। আসল ব্যাপারটা তো আমরা জানি। অতগুলো লোকের যাতে চা করতে না হয়, সেজন্য কঙ্কণ চৌধুরী এই ফন্দিটা আঁটল। এখন ভৌমিক নিশ্চয় চা খেতে চাইবে না।

এই যে এঁরা এসে গেছেন। আগন্তুকদের দেখিয়ে ভৌমিক বলল, আসতেই চায় না, জোর করে নিয়ে এলাম। এখন তুমি সামলাও। ওরা তো আজই দেশে ফিরতে চাইছে।

ওঁদের বসতে বলে কঙ্কণ চৌধুরী ভাষণ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, আমি জানি, আপনারা দেশে ফেরার জন্য অধৈর্য হয়ে পড়েছেন। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। কতদিন দেশ ছাড়া। ঘরের কথা মনে পড়বে বৈকি। তবুও অন্তত কর্তব্যের খাতিরে আপনাদের আর একটা দিন অপেক্ষা করতে হবে। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আগামী কাল হত্যাকারীকে আপনাদের সামনে হাজির করতে পারব।

রিয়েলি?—লীনা যেন বিশ্বাস করতে চাইল না।

সেন্ট পারসেন্ট সত্যি, ম্যাডাম। এ বান্দার যেমন কথা, তেমনি কাজ।

ডু ইউ নো, হু ইজ দ্য কালপ্রিট? রেনেল দাঁড়িয়ে উঠে বলল।

অফকোর্স।

হু ইজ দ্যাট ইডিয়ট?

সরি, ফ্রেন্ডস। এই মুহূর্তে তার নাম বলতে পারছি না।

হোয়াই? পিটার হঠাৎ গর্জে উঠল।

আমার হাতে কোনো প্রমাণ নেই।

সমস্বরে একটা হাসির রোল উঠল। লীনা তো হেসেই খুন : প্রমাণ নেই। অথচ কি করে বলছ, কালপ্রিটকে তুমি জান?

বিকজ, দ্যাট প্রুফ ইজ দেয়ার। কঙ্কণ চৌধুরী বন্ধ আলমারির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল।

কোহলি কঙ্কণ চৌধুরীর হেঁয়ালি বুঝতে না পেরে বললেন, আপনার ব্যাপার কিছুই তো বুঝতে পারছি না মিস্টার ডিটেকটিভ? একবার বলছেন প্রমাণ নেই, আর একবার বলছেন, প্রমাণ ওই আলমারিতে আছে।

ইয়েস ডাক্তার। প্রমাণ আছে, আবার নেই।

হোয়াট ডু ইউ মিন? উধম সিং ক্ষেপে গিয়ে বলল।

ধৈর্য ধরে বসুন, সব বলছি।—পকেট থেকে পানের ডিবে বার করে একটা পান মুখে পুরে দিয়ে কঙ্কণ চৌধুরী খানিক দম নিল।

ঘরের মধ্যে তখন একটা চাপা অস্থিরতা। কেউ এই পাতলা ছিপছিপে ডিটেকটিভকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সবচেয়ে ব্যস্ত রেনেল, এলভিন ও পিটার। ওরা কিছু একটার আশঙ্কা করছে যেন। কীসের আশঙ্কা? মুখোশ খুলে যাবার?

পিকদানিতে পিক ফেলে কঙ্কণ চৌধুরী তার লাল টুকটুকে ঠোঁটে সামান্য হেসে আলমারিটা দেখিয়ে বলল, ওই যে আলমারিটা দেখতে পাচ্ছেন, ওতে রয়েছে হত্যাকারীর জন্য ফাঁসির দড়ি। ওই দড়িতেই রয়েছে ক্যাপ্টেন আর হত্যাকারীর উভয়েরই রক্ত। (কঙ্কণ চৌধুরী হঠাৎ কেন যে মিথ্যে কথা বলল বুঝতে পারলাম না।) এ দড়ি কাল যাবে ফোরেনসিক ল্যাবরেটরিতে। দু—গ্রুপের রক্ত নেওয়া হবে। যার রক্তের সঙ্গে ওই গ্রুপের রক্ত মিলে যাবে, সেই হবে হত্যাকারী।

ইমপসিবল! কোহলি হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে বললেন, আই অ্যাম এ ডক্টর—আমি জানি, একই রক্তের গ্রুপ বহু মানুষের থাকে। তাহলে কীভাবে ধরব হু ইজ দ্য কালপ্রিট?

ডোন্ট ওরি ডক্টর, যদি একই গ্রুপের রক্ত আপনাদের অনেকেরই থাকে, তবে সেক্ষেত্রে অন্য পথও আছে। বাট আই কনফার্মড হত্যাকারীর রক্ত যে গ্রুপের, অন্য কারও গ্রুপের সঙ্গে তা মিলবে না। কারণ হত্যাকারীর রক্ত নীলচে ধরনের।

রেনেল কঙ্কণের এই উক্তি শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, কি করে বুঝলেন, ওটা হত্যাকারীর রক্ত? ক্যাপ্টেনেরও তো হতে পারে।

নো। কারণ, নীলচে রঙের জমাট বাঁধা রক্তটা পাওয়া যায় দড়ির আগায়। আর ডাক্তারের রক্ত দড়ির মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত। অর্থাৎ হত্যাকারী যখন দড়ি কাটছিল, তখন ক্যাপ্টেন বাঁচার আশায় মরিয়া হয়ে বরফ খণ্ড দিয়ে বারবার হত্যাকারীকে আঘাত করতে থাকে। ফলে হত্যাকারীর আঙুল কেটে যায়। এবং বাকি যে অংশ পাহাড়ের ওপরে ছিল, তার ওপরের দিকে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। ক্ষিপ্ত হয়ে আততায়ী ডেনেসের হাতে ছোরা চালায়, ফলে ডেনেসের রক্ত ফিনকি দিয়ে ওপরে ওঠে। সেজন্য পাহাড়ে শায়িত দড়ির মাঝামাঝি অংশে সে রক্ত ছিটকে পড়ে। আর কিছু রক্ত হত্যাকারীর পোশাকে পড়ে। অবশ্য সে তা লক্ষ করেনি। করলে সাবধান হয়ে যেত নিশ্চয়।

হু ইজ দ্যাট কালপ্রিট? সমস্বরে দাবি উঠল।

সরি বন্ধু। কঙ্কণ চৌধুরী বিনীত ভাবে বলল, আজ আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কারণ ওই আলমারিতে সেই অভিশপ্ত দড়ি এবং হত্যাকারীর পোশাক আছে। কাল সকালে তা টেস্টে পাঠাব। বিকেলের মধ্যেই সব জানাতে পারব আশা করি।

আজকে কেন নয়? রেনেল বিরক্তি ভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করল।

আজকে সন্ধেয় আমাকে জরুরি কাজে কৃষ্ণনগর যেতে হচ্ছে। অ্যানাদার মার্ডার কেস। কাল সকালে ফিরব।

সমস্ত ঘরটায় একটা হতাশার ভাব নেমে আসে। আর একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করলাম, সবাই সবাইয়ের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সবার মনে হয়তো একটাই প্রশ্ন, হু হিজ দ্যাট কালপ্রিট।

ফ্রেন্ডস—, কঙ্কণ চৌধুরীর গম্ভীর গলা ভেসে এল : নাউ আই ওয়ান্ট টু স্টার্ট মাই ডিউটি। আপনারা বাইরে গিয়ে বসুন। এক এক করে যখন ডাকব তখন আসবেন।

বাট হোয়াই? উধম সিং খেঁকিয়ে উঠল।

ফর ইনকোয়ারিং—সাম কোশ্চেনস অনলি।

ও ডিটেকটিভ।—লীনা যেন পাগল হয়ে যাবে এমন ভঙ্গিতে বলল, তোমার মতলবটা কি বলো তো? এইমাত্র বললে ইউ আর কনফার্মড। হু ইজ দ্য কালপ্রিট। আবার এখন বলছ, ইনকোয়ারি। হাউ হরিবল।

নো হরিবল ডার্লিং। কনফার্মড হলেও ভেরি মাচ কনফার্মডের জন্য এর প্রয়োজন আছে।

ও—কে।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ঘর খালি হয়ে গেল। ঘরে আমি, কঙ্কণ চৌধুরী ও ভৌমিক রইলাম।

নোটবই খুলে বলো বন্ধু।—কঙ্কণ আমাকে আদেশের ভঙ্গিতে বলল।

ভৌমিক এতক্ষণ চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসেছিল। কঙ্কণ ওকে তাগাদা দিয়ে বলল, বাইরে যাও ভৌমিক, এক এক করে ওদের ডেকে নিয়ে এসো।

ভৌমিক চলে যেতেই বললাম, তোমার ব্যাপার—স্যাপার আমিও তো কিছু বুঝতে পারছি না কঙ্কণ। বললে, দড়ি আলমারিতে আছে। অথচ আমি জানি, দড়ি ভৌমিকের কাছে আছে।…. আবার বলছ, সন্ধের সময় কৃষ্ণনগর যাবে। কিন্তু আমি জানি, আজ তোমার বাইরে যাবার কোনো প্রোগ্রাম নেই। আসল ঘটনাটা কি বলো তো? তোমার কথার মাথা—মুন্ডু কিছুই তো বুঝতে পারছি না।

সবই যদি বুঝতিস, তবে লোকে আমার কাছে না এসে তোকে নিয়েই পড়ত। তা যখন করে নি, তখন ধরে নে, তোর আর যা কিছু থাক, আমার মতো বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি নেই।

এর পর আর কি বলি? মুখ ব্যাজার করে বসে রইলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে ভৌমিক রেনেলকে নিয়ে প্রবেশ করল। কঙ্কণ চৌধুরী ইঙ্গিতে রেনেলকে বসতে বলল। রেনেলের চেহারায় বিরক্তির ভাব।

কি ধরনের শব্দ শুনেছিলেন?—রেনেল বলতেই কঙ্কণ চৌধুরী প্রথম প্রশ্ন করল।

হেলপ, হেলপ।

কি দেখলেন সেখানে?

ক্যাপ্টেন পাহাড় থেকে নীচে গড়িয়ে পড়ছেন।

ইয়েতি দেখেছেন?

হ্যাঁ।

কি রকম?

রেনেল খানিকক্ষণ ভাবল। সেই তুষার মানবের চেহারাটা মনে আনার চেষ্টা করল।

কি হল?—কঙ্কণ সময় নষ্ট করতে চায় না।

রেনেল এলোমেলো চুলে আঙুল বুলিয়ে নিয়ে বলল, ছোটখাটো একটা দানবের মতো।

এর আগে কোনো এক্সপিডিশনে গিয়েছিলেন?

আলপসে।

এ দলের কেউ ছিল তখন?

ইয়েস, ক্যাপ্টেন।

ও—কে। ইউ মে গো।

রেনেল চলে যেতেই পিটার প্রবেশ করল। তার চোখে—মুখে অবজ্ঞার ভাব পরিস্ফুট।

কঙ্কণ তাকেও একই প্রশ্ন করল : কি ধরনের শব্দ শুনেছিলেন?

হেলপ, হেলপ।

কি দেখলেন সেখানে?

ক্যাপ্টেন খুব দ্রুত পাহাড়ের নীচে হারিয়ে যাচ্ছেন।

ইয়েতি দেখেছেন?

ইয়েস।

কি রকম দেখতে?

একটা ছোটখাটো চলমান দানব যেন।

এর আগে কোনো এক্সপিডিশনে গিয়েছেন?

ইউরোপের এক পাহাড়ে। নামটা মনে পড়ছে না।

এ দলের কেউ সঙ্গে ছিল?

ইয়েস, ক্যাপ্টেন।

এলভিন যখন এল, তখন তাকে কেমন জড়োসড়ো দেখাচ্ছিল। মুখমণ্ডলে এক আশঙ্কার ভাব। কঙ্কণ চৌধুরী তাকেও ওই প্রশ্ন করল : কি ধরনের শব্দ শুনেছিলেন?

হেলপ হেলপ।

কি দেখলেন সেখানে?

একটা ভারী বস্তু পাহাড় থেকে নীচে গড়িয়ে পড়ল।

সেটা কি ক্যাপ্টেনের লাশ?

বলতে পারি না।

ইয়েতি দেখেছেন?

ইয়েস।

কি রকম দেখতে?

বলতে পারব না।

কেন?

অস্পষ্ট দেখেছি।

সবাই স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে, আপনি দেখতে পেলেন না কেন?

দেরিতে পৌঁছেছিলাম।

অস্পষ্ট, কেমন দেখলেন?

একটা ছোটখাটো ফড়িং—দৌড়ে পালিয়ে গেল।

ওর বলার ধরন দেখে সবাই হেসে উঠলাম। ইতিমধ্যে এলভিন রেগে ফায়ার হয়ে গেছে। মুখ—চোখ কুঁচকে বলল, আপনারা বিশ্বাস করছেন না? না করুন, ক্ষতি নেই।

কঙ্কণ চৌধুরী ওকে শান্ত করার জন্য তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না, না, আমরা কেউ আপনার কথা অবিশ্বাস করছি না।

আলবৎ করছেন।—এলভিন তেমনি রেগে বলল, যদি আর কিছু প্রশ্ন থাকে করুন, নইলে চললাম।

এলভিন ওঠবার উপক্রম করতেই কঙ্কণ চৌধুরীর বাধা দিয়ে বলল, অনলি ওয়ান কোশ্চেন। এর আগে কোনো এক্সপিডিশনে গিয়েছেন?

ইয়েস, আলপসে।

এ দলের কেউ সঙ্গে ছিল?

ক্যাপ্টেন।

থ্যাঙ্ক ইউ।

এলভিন চলে যেতেই আবার হাসির তুফান উঠল। ভৌমিকের হাসি তো থামতেই চায় না। হাসতে হাসতেই সে বলল, শেষমেশ লোকটা একটা ফড়িং দেখল? তাও আবার এভারেস্টে।

হাসির দমকে ঘরখানা ফেটে যাবার জোগাড়। বাইরে কিন্তু চাপা গুঞ্জন।

কঙ্কা তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, নেক্সট।

প্রবাল রায় প্রবেশ করল। খর্বাকৃতি। শ্যামলা রঙের ছেলে।

আপনি কি ধরনের শব্দ শুনেছিলেন? কঙ্কণ সেই পুরোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল।

হেলপ, হেলপ।

কি দেখলেন সেখানে?

ক্যাপ্টেন দড়ি ছিঁড়ে নীচে পড়ছেন।

ইয়েতি দেখেছেন?

হ্যাঁ।

কি রকম দেখতে?

বিশালাকার এক দৈত্যের মতো।

এর আগে কোনো এক্সপিডিশনে গিয়েছেন?

নো।

আচ্ছা, আসুন।

প্রবালের পর শিখ যুবক উধম সিং প্রবেশ করল। দীর্ঘাকৃতি। যুবকটির মধ্যে একটা চাপা অস্থিরতা রয়েছে দেখলাম।

আপনিও নিশ্চয় শব্দ শুনেছিলেন? কঙ্কণ চৌধুরী প্রশ্ন করল।

ইয়েস।

কি রকম শব্দ?

একটা আওয়াজ : হেলপ, হেলপ।

দৌড়ে এসে কি দেখলেন?

ক্যাপ্টেন অসহায় অবস্থায় নীচে তলিয়ে যাচ্ছেন।

ইয়েতি দেখেছেন?

হ্যাঁ।

কি রকম দেখতে?

মনে হল একটা কুঁজো লোক দেহে একরাশ বরফের বোঝা নিয়ে হেঁটে চলেছে।

এর আগে কোনো এক্সপিডিশনে গিয়েছেন?

নো।

শিখ যুবকের প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে প্রৌঢ় শিখ প্রবেশ করলেন। ডাক্তার কোহলি। কোহলির বয়স হলেও বেশ শক্তসমর্থ। লম্বা লোক। গলার স্বরে দৃঢ়তা।

কঙ্কণ চৌধুরী হঠাৎ ওঁকে অন্য ধরনের প্রশ্ন করল। বলল, ক্যাপ্টেন কি অসুস্থ ছিলেন ডাক্তার?

তার হার্ট উইক ছিল।

আপনি ইয়েতি দেখেছেন নিশ্চয়। কি রকম দেখতে?

একটা চলমান ছোটখাটো বরফের স্তূপ যেন।

সবশেষে এল লীনা। কঙ্কণ চৌধুরী আবার তাকে আগের মতোই প্রশ্ন করল। উত্তরে লীনা জানাল, হেলপ—হেলপ শব্দ শুনে সে যখন বাইরে গেল, তখন ক্যাপ্টেন নীচে গড়িয়ে পড়ছে। দড়িতে তার পা আটকে গেছিল। ক্যাপ্টেনের চোখে—মুখে তখন আতঙ্ক ভাব ছিল। হ্যাঁ, লীনা ইয়েতি দেখেছে। কয়েক হাত দূরেই সে ছিল। তুষারে ঢাকা বেঁটেখাটো একটা জীব।

কঙ্কণ চৌধুরী এই সময় প্রশ্ন করল, সত্যিই কি ইয়েতি? মানুষ তো হতে পারে?

আশ্চর্য কিছু নয়। লীনা বলল, তখন ড্যাডির জন্য ভীষণ চিন্তিত ছিলাম, ইয়েতিকে যাচাই করার সুযোগ পাইনি।

জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হবার পর কঙ্কণ চৌধুরী ওদের বুঝিয়ে—সুঝিয়ে বিদায় করল। তারপর খানিকক্ষণ ভৌমিকের সঙ্গে গোপন শলাপরামর্শ করল। হাত—পা নেড়ে কঙ্কণ বক্তৃতার ভঙ্গিতে অনেক কিছু বলে গেল—যার মাথা—মুন্ডু কিছুই বুঝলাম না। মিনিট পনেরো পরে ভৌমিককে বিদায় করে আমার সামনে এসে দাঁড়াল : নে, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। সন্ধে হয়ে এল। কৃষ্ণনগরের গাড়ি ধরতে হবে।

স্টেশনে পৌঁছে দেখি, কৃষ্ণনগর লোকাল ছাড়ার মুখে। দৌড়ে ট্রেনে চড়তেই ট্রেনখানা চলতে শুরু করল। এতক্ষণ কঙ্কণ একটা কথাও বলেনি, আমিও জিজ্ঞেস করিনি। জানতাম, জিজ্ঞেস করলে কোনো উত্তর পেতাম না। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে—ওই জানে।

গাড়ি ব্যারাকপুরে এল। নৈহাটি ছাড়ল। কঙ্কণ নির্বিকার। কিন্তু কাঁচরাপাড়া আসতেই ও আমাকে হাত ধরে টেনে নামাল। মুখ থুবড়ে পড়তে গিয়েও বেঁচে গেলাম। অস্ফুট কণ্ঠে একটা মুখখিস্তি করে উঠলাম। কিন্তু কে কার কথা শোনে। কঙ্কণ হাত ধরে ব্যস্ততার সঙ্গে বলে উঠল, শিগগির চল বাবা, ওভারব্রিজ পেরোতে হবে। ওই দেখ, নীল সিগন্যাল দিয়েছে।

আমাদের ডাউন ট্রেনটা প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যাচ্ছে, ওদিক থেকে একটা আপ ট্রেন আসছে। কঙ্কণ চৌধুরী পেটে গুঁতো মেরে বলল, দৌড়ো হতভাগা, এই ট্রেনটা মিস হলে ঝাড়া দেড় ঘণ্টা। কোনো কাজই হবে না।

দৌড়তে দৌড়তে বললাম, তুমি না বলেছিলে, কৃষ্ণনগরে কোনো মার্ডার কেসে যাচ্ছ? তা এখানে নেমে পড়লে যে?

স্রেফ ধাপ্পা, কৃষ্ণনগরে কোনো কাজই নেই।

তবে এ নাটক করলে কেন?

প্রয়োজন ছিল।

ব্যস, কঙ্কণ চৌধুরী চুপ, মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইল। কিসের নাটক, কেনই বা এত হেঁয়ালি? এসব প্রশ্ন করা বৃথা, এখন ও কোনো উত্তরই দেবে না। বসে বসে পান চিবুচ্ছে, আর আকাশের তারা গুনছে।

শিয়ালদহ স্টেশনে গাড়ি থামতেই দেখলাম, ভৌমিক প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে। কঙ্কণ চৌধুরী গাড়ি থেকে নেমে ওকে কাছে ডাকল, ফিসফিস করে বলল, সব ঠিক আছে তো?

বিলকুল। সাদা পোশাকে পুলিশ আছে। এখনও পর্যন্ত কেউ আসেনি।

এত তাড়াতাড়ি আসবে না। কঙ্কণ হেসে বলল, নিশাচরেরা গভীর রাতে আসে। বুঝলে?

তিনজন মিলে কাইজার স্ট্রিটে কঙ্কণ চৌধুরীর কোয়ার্টারে এলাম। রাত আটটা। ভৌমিক রাস্তার মোড় থেকে সাদা পোশাকের একটা পুলিশকে ডেকে এনেছিল। তালা খুলে আমরা ভেতরে ঢুকলাম। কয়েক ঘণ্টা আগে এখানেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। বাঁ দিকে সেই আলমারি। সেখানে তথাকথিত প্রমাণ আছে। ভেতরে ঢুকে চাবিটা সেই সাদা পোশাকের পুলিশের হাতে দিয়ে কঙ্কণ বলল, বাইরে থেকে তালা দিয়ে দেবে।

ভৌমিক তার সঙ্গে আর একটা কথা জুড়ে দিল, তালা দিয়ে নিজের জায়গায় চলে যাবে। হুইসিল পেলেই চলে আসবে।

লম্বা এক স্যালুট ঠুকে সেই সাদা পোশাকের পুলিশ বাইরে তালা লাগিয়ে অন্তর্ধান করল।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কঙ্কণ ঘরের সমস্ত আলো নিভিয়ে দিল। মৃদু কণ্ঠে বলল, ওর আসার সময় হল, আমাদের খুব সতর্কভাবে অপেক্ষা করতে হবে।

কিন্তু কোথায় ও, ওর টিকিরও পাত্তা নেই। এদিকে সময় আর চলতে চায় না। এক একটা মিনিট, এক একটা যুগ মনে হচ্ছে। শীতকাল। তাই মশার উপদ্রবটা কম। নইলে এতক্ষণ উঃ—আঃ কিংবা খটাস—মশা মারার শব্দ শুরু হয়ে যেত। তবু এই শবরীর প্রতীক্ষা। একমাত্র কঙ্কণ ছাড়া আমি আর ভৌমিক যথেষ্ট অস্বস্তি বোধ করি।

পরিণতি

রাত তখন সাড়ে এগারোটা।

বাইরে একটা খুট করে শব্দ শুনতে পেলাম। অত্যন্ত ধীরে ধীরে।

মাঝে আবার বিরতি। যে কেউ তালা খোলার চেষ্টা করুক না কেন, খুব সতর্কতা অবলম্বন করছে। খুব ঠান্ডা মাথায়, ধীরেসুস্থে।

এমনি ভাবে কাটল মিনিট পনেরো। তারপর আস্তে আস্তে দরজা খুলল। বাইরে—ঘরে সমান অন্ধকার। অতি সন্তর্পণে একটা অস্পষ্ট ছায়া ঘরে প্রবেশ করল। অন্ধকারে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আগন্তুক পকেট থেকে পেন্সিল টর্চ বার করল। তারপর পকেট থেকে ছোট একটা লোহার রড বার করে আলমারির দুর্বল তালাটার ওপর ক্রমাগত আঘাত করতে লাগল। তার ওই ক্রমাগত আঘাত পুরোনো তালার সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না, কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেঙে পড়ল।

তালা ভেঙে পড়তেই আগন্তুক হঠাৎ সতর্কতার সমস্ত মুখোশ খুলে ফেলে দ্রুতগতিতে কাজ হাসিল করার চেষ্টা করল। আলমারির এক একটা জিনিস মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলতে লাগল। পেন্সিল টর্চটা দিয়ে খুঁজে দেখতে লাগল সমস্ত আলমারিটা।

সামনে দেখতে পেলাম, কঙ্কণ ও ভৌমিক উদ্যত পিস্তল হাতে গুটি গুটি আলমারির দিকে এগোচ্ছে। অন্ধকারে কঙ্কণ চৌধুরীর গম্ভীর স্বর শোনা গেল, অমন করে কি খুঁজছেন প্রবালবাবু?

প্রবাল কিছু জবাব দেবার আগেই কঙ্কণ হঠাৎ আমাকে উদ্দেশ করে বলল, লাইটটা জ্বালা, সুইচ তোর কাছেই আছে।

লাইট জ্বালতেই সমস্ত ঘরখানা আলোর বন্যায় ভেসে গেল।

প্রবালের মুখখানা আতঙ্কে নীল হয়ে গেছে। এমন অভাবনীয় কাণ্ড ঘটবে, ও বিন্দুমাত্র জানত না। এখন ফাঁদে পড়ে কাটা মাছের মতো ছটফট করছে। ওর করার কিছু নেই। কারণ আমরা চারদিক থেকে ওকে ঘিরে ধরেছি, পালাবার পথ বন্ধ। প্রবাল আলমারির পাল্লায় একটা হাত রেখে অসহায় দৃষ্টিতে আমাদের দেখতে থাকে।

ধরাই পড়ে গেলেন শেষ পর্যন্ত প্রবালবাবু? কঙ্কণ চৌধুরী হাসতে হাসতে বলল।

প্রবাল কিছু বলল না, হাসল শুধু—শুকনো হাসি।

কিছু বলবেন না? কঙ্কণ আবার বলল, ধরা পড়ে খুব আফসোস হচ্ছে, তাই না?

আমি আমার কর্তব্য করেছি কঙ্কণবাবু। প্রবাল শান্ত কণ্ঠে বলল।

মানুষ মারাকে আপনি কর্তব্য বলে মনে করেন! ভৌমিক উপহাসের ভঙ্গিতে বলল।

ক্যাপ্টেন মানুষ ছিল না ইন্সপেক্টর, একটা জানোয়ার ছিল। বহু পাপ ও করেছে, কিন্তু আইন ওকে কোনো শাস্তি দিতে পারেনি, অথচ শাস্তি ওর পাওনা ছিল।

কি এমন পাপ ক্যাপ্টেন করেছিল, যার জন্য আপনার মতো সাধুপুরুষকেও হত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছিল? ভৌমিকের কণ্ঠে এখনও বিদ্রুপের সুর।

প্রবাল কিন্তু এই ঠাট্টা গায়ে না মেখে শান্ত কণ্ঠে বলল, সে এক ইতিহাস।

ভৌমিক নির্লজ্জ ভাবে হেসে বলল, বেশ, শোনান দেখি আপনার মহাভারত।

আগে ওঁকে বলতে দাও ভৌমিক। কঙ্কণ বিরক্তির সুরে বলল : সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় না।

খুনিদের অত সম্মান করার কি আছে, কঙ্কণ?

তোমার নৈতিক চরিত্রটা মনে হয় একেবারেই হারিয়ে ফেলেছ ভৌমিক। কঙ্কণ ধমকের সুরে বলল, প্রবালবাবু হত্যাকারী হলেও প্রত্যেক মানুষের মতো তাঁর একটা সম্মান আছে। তা ছাড়া তুমি জান না, উনি কেন খুন করেছেন এবং এতে ওঁর দোষ কতখানি। অথচ তার আগেই নৃশংস খুনি ঠাউরে ফেলেছ। এই না হলে বুদ্ধি বলে?

কঙ্কণ চৌধুরীর কথা শুনে ভৌমিক মনে মনে বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বলল না, গম্ভীর মুখে বসে রইল।

কঙ্কণ ওদিকে খেয়াল না করে প্রবালকে বসতে একটা চেয়ার দিল : বলুন এবার প্রবালবাবু, আপনার সেই ইতিহাস!

জানেন কঙ্কণবাবু,—প্রবাল ধরা গলায় বলল, ক্যাপ্টেনকে কোনোদিন হাতের কাছে পাব, কল্পনাই করিনি। আমার বাবা ছিলেন বিপ্লবী। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তিনি আজীবন লড়াই করেছিলেন। কোনোদিন সুস্থির হয়ে সংসার করতে পারেননি। মা বাবার জন্য রাত জেগে বসে থাকতেন। বাবা আসতেন না। আসত পুলিশ। মাকে ধরে নিয়ে গিয়ে নানা রকম জেরা করত। উত্তর না পেলে মার ওপর অত্যাচার করত। সবচেয়ে শয়তান ছিল মাইক ডেনেস। তার অত্যাচারের পরিমাণটা ছিল সবচেয়ে বেশি। শেষে একদিন ওর গুলিতেই বাবা মারা গেলেন সুদূর দার্জিলিংয়ে। আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি।

প্রবাল তার অতীত ইতিহাস বলে চলল : আমার মা অন্যান্য ভারতীয় নারীর মতো দুর্বল ছিলেন না। বাবাকে তিনি হাসিমুখে বিপ্লবের মাঝে উৎসর্গ করেছিলেন। বাবার মৃত্যুসংবাদ যেদিন এসে পৌঁছল, সেদিন কিন্তু একটুও চোখের জল ফেলেননি। শুধু আমাকে দিয়ে একটা প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন। এ হত্যার যেন বদলা নিই। সেটা ছিল ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর মাস। বহু খুঁজেও সেদিন ক্যাপ্টেনকে পাইনি। এর কয়েক মাস পরেই দেশ স্বাধীন হল। সমস্ত ইংরেজ দেশ ছেড়ে চলে গেল। মা কিন্তু তখনও আমায় প্রতিজ্ঞার কথা মনে করিয়ে দিতেন—’বদলা নিও।’

কিন্তু কোথায় বদলা নেব? আমার বিশ্বাস ছিল, ক্যাপ্টেন কোনোদিনই এদেশে ফিরে আসবে না। মাকে আশ্বাস দিলেও, প্রতিশোধ নেওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। ইতিমধ্যে গ্র্যাজুয়েট হয়ে দার্জিলিং থেকে পাহাড়ে চড়ার ট্রেনিং নিলাম। পাহাড়ের প্রতি আকর্ষণ আমার ছোটবেলা থেকেই ছিল। তারপর বড় হয়ে যখন বিভিন্ন রোমাঞ্চকর পর্বতাভিযানের কাহিনি পড়লাম, তখন উৎসাহ আরো বাড়ল। তাই সাততাড়াতাড়ি ট্রেনিংটা নিয়ে নিলাম। ট্রেনিং নেওয়ার মাস ছয়েকের মধ্যে এভারেস্ট অভিযানের আমন্ত্রণ এল। সেই সঙ্গে ইংরেজ অভিযাত্রীদের ফটোসহ পরিচয়পত্র এল। ফটো দেখে মা ক্যাপ্টেনকে চিনতে পারলেন। উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, এই সেই লোক প্রবাল, ইনিই তোমার বাবাকে মেরেছিলেন।

রাতে শুয়েই স্থির করেছিলাম, যেমন করে হোক ক্যাপ্টেনকে মারতে হবে। বাবার হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার এমন সুযোগ দ্বিতীয়বার আসবে না।

প্রবাল এই অভিশপ্ত রাতটার কথা ব্যাখ্যা করল। বলল, প্রচণ্ড তুষার ঝড়ে সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল। সেই সুযোগে আমি সরাসরি ডেনেসের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ডেনেস প্রথমে তুষার মানব ভেবে চিৎকার করে উঠল। আমি আমার পরিচয় দিলাম। বাবার পরিচয় দিলাম। ডেনেসের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। আতঙ্কে ও চিৎকার করে উঠল। তখন পাহাড়ের খাদে ঝুলছে ও। দড়ি কেটে দিলাম। বাধা দিয়েছিল ডেনেস, কিন্তু বাঁচতে পারেনি।

একটানা অনেকক্ষণ বলার পর প্রবাল একটু থামল। তারপর গলাটা কেশে নিয়ে বলল, জানেন কঙ্কণবাবু, আমি বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নই। নিজের কর্তব্য করেছি। ছেলে হয়ে বাবার হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছি। মা শুনে খুব খুশি হয়েছেন, দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করেছেন। আমার কোনো ক্ষোভ নেই, অনুশোচনাও নেই। যা শাস্তি দেবেন, মাথা পেতে নেব।

প্রবালকে যখন গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হল, তখনও তার মুখে দেখেছিলাম প্রশান্তির চিহ্ন। কোনো উদ্বেগ, বা আফসোসের চিহ্ন দেখিনি।

পরদিন কঙ্কণ চৌধুরীর কোয়ার্টারে বসে এই হত্যা—রহস্য সম্বন্ধে আলোচনা হচ্ছিল। চা খেতে খেতে কথা বলছিলাম।

তুমি প্রবালবাবুকে সন্দেহ করেছিলে কীভাবে?

কঙ্কণ চৌধুরীকে এ প্রশ্ন করতেই ও হেসে বলল, অনেক আগেই সন্দেহ করেছিলাম, কিন্তু কোনো প্রমাণ ছিল না হাতে।

কেন, দড়িতে দু’গ্রুপের রক্ত। ওতেই তো—

নো বন্ধু। কঙ্কণ একগাল হেসে বলল, দড়িতে যে রক্ত ছিল, তা একজনেরই, অর্থাৎ ক্যাপ্টেনের।

বিস্মিত কণ্ঠে বললাম, তবে যে ওদের বললে—

স্রেফ ধাপ্পা। নইলে খুনিকে হাতেনাতে ধরা যেত না।

তা হলে আমাকেও ধাপ্পা দিয়েছিলে?

রাগ কোরো না বন্ধু, মাঝে মাঝে এমন মিথ্যে কথাও বলতে হয়।

মনে মনে রেগে গেলেও সহজ হওয়ার ভঙ্গিতে বললাম, তোমার কাজ তুমি করেছ, এতে বলার কি আছে? কিন্তু সন্দেহটা করলে কীভাবে?

ওর বাবার জীবনী আর ডেনেসের সঙ্গে সংঘর্ষ, সব কিছু পরিষ্কার করে দিল। সবশেষে প্রত্যেকের জবানবন্দি পড়ে কনফার্মড হলাম।

কি করে?

প্রথমত যাকে তুমি বা আমি সন্দেহ করেছিলাম, সেই তিনজন এলভিন, পিটার ও রেনেল এর আগেও ইউরোপের পাহাড়ে চড়েছে, সেক্ষেত্রে তাদের সঙ্গী ছিল ক্যাপ্টেন। ক্যাপ্টেনকে যদি তারা মারতে চাইত, তবে অনেক আগেই ইউরোপের যে কোনো পাহাড়ে মারতে পারত। তার জন্য এতদূর আসার প্রয়োজন হত না।

দ্বিতীয়ত, তুষার মানব দেখা প্রসঙ্গে। সবার মতে তুষার মানব একটা ছোটখাটো চলমান বরফের স্তূপ। একমাত্র প্রবাল এর ব্যতিক্রম। তার মতে তুষার মানব একটা দৈত্যবিশেষ। অর্থাৎ সবাই তুষার মানব ভ্রমে প্রবালকে দেখেছিল। প্রবাল বেঁটেখাটো চেহারার মানুষ—তার দেহে বরফের আস্তরণ ছিল। সবাই তাকে ক্ষণিকের জন্য দেখেছিল, তাও আবার জ্যোৎস্নালোকে। সুতরাং ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে প্রবাল একজন সত্যিকারের তুষার মানবের কথা বলেছিল, যা ও কোনোদিনই দেখেনি। আর ওতেই ও বিপদ ডেকে আনল।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আজও আকাশে মেঘ করেছে। শীতকালে এ সময়টা বৃষ্টি হয় না। অথচ এবার যেন সবই সৃষ্টিছাড়া। কঙ্কণের কাছে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম। কেন জানি না, বারবার প্রবালের কথাই মনে হচ্ছিল। ওর মা কি সত্যিই খুশি হয়েছে? বিশ বছরের পুরোনো ইতিহাসের পাতা খুলে মা ছেলেকে দিয়ে মহৎ কাজ করতে চেয়েছিলেন। সত্যি কি তা মহৎ ছিল? হয়তো মহৎ! আইন যতই কড়া হোক না কেন, তাতে ফাঁকও থাকে প্রচুর। শুধু ডেনেস কেন, আজও এমন ভারতীয় পাওয়া যাবে, যারা একদিন ব্রিটিশদের পদলেহী ছিল, আজ সে মুখোশ খুলে ফেলে ভালোমানুষ সেজে বসে আছে। কেউ বড় অফিসার হয়েছে, কেউ রাজনৈতিক নেতা। এরা সময় বিশেষে খোলস পাল্টায়। তাই আইন এদের কিছু করতে পারে না।

ডেনেস বহু বিপ্লবীর জীবনীশক্তি নিঃশেষিত করেছেন। বহু সংসার ছারখার হয়েছে। মা সন্তানকে হারিয়েছেন, স্ত্রী স্বামীকে। কারাপ্রাচীরের অন্তরালে কেউ জীবন হারিয়েছেন, কেউ পঙ্গু হয়েছেন, কেউ বা দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। অথচ ডেনেসের বিচার হয়নি—তিনি প্রমোশন পেয়েছিলেন। পেয়েছিলেন আরও অনেক সরকারি খেতাব। পাপের শাস্তি তাঁকে কেউ দেয়নি।

অথচ বিশ বছর পরে যখন একজন তাকে সেই চরম দণ্ড দিল, তখন আইন ওকে ছাড়ল না। ওর অপরাধ, আইন ও নিজের হাতে নিয়েছিল। মানছি, আইন নিজের হাতে নেওয়াটা মারাত্মক। কিন্তু আইন যেখানে পরাভূত, পুলিশ যন্ত্র যেখানে নিষ্ক্রিয়, সেখানেও আইন হাতে নেওয়াটা অপরাধ? এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে? জেলের চার দেওয়ালের মাঝে বসে প্রবালও হয়তো এই কথাই ভাবছে।

জানি না, সে এর উত্তর কোনোদিন পাবে কিনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *