কৃষ্ণসাধিকা মীরাবাঈ : অলৌকিক জীবন-কথা
এক
তাঁর জন্মবৃত্তান্তকে কেন্দ্র করে প্রচলিত আছে এক স্মরণযোগ্য কাহিনি। এই কাহিনিটি পড়লে আমরা বুঝতে পারি জন্মমুহূর্ত থেকে মীরা কেন বিষ্ণুগতপ্রাণা হয়ে উঠেছিলেন।
তখন বৈকুণ্ঠে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সুখশয্যায় শায়িত আছেন। পতিসেবায় মগ্না লক্ষ্মী। তাঁরা তো এভাবে এক সুন্দর সার্থক আদর্শ দাম্পত্য জীবনযাপন করতেন। একে অন্যকে ছেড়ে ক্ষণমাত্র থাকতে পারতেন না।
ঠিক এই সময় এক অনিন্দ্য রূপসী কন্যা এসে শ্রীকৃষ্ণকে প্রাণাম জানালো। তার মুখের দিকে তাকিয়ে শ্রীকৃষ্ণ বুঝতে পারলেন যে, সে কোনও কিছু বলতে চাইছে। কী তার মনোগত বাসনা?
কৃষ্ণ জানতে চাইলেন—আমি তোমার অভিলাষ বুঝতে পেরেছি। তুমি আবার মর্ত্যে যেতে চাও, তাই তো? তোমার কি মনে পড়ে কন্যা, দ্বাপরে তুমি ছিলে আমার এক গোপিনী? তুমি আমাকে মধুরসে সেবা করতে। তোমার চোখে আমি ছিলাম তোমার জীবন—দেবতা। অথচ সেভাবে তুমি আমাকে স্পর্শ করোনি। তোমার কি মনে আছে কন্যা, আমি কিন্তু তোমার মনের কোনও অভিলাষ অপূর্ণ রাখিনি?
এবার একটু উদাস হয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণ বললেন—আমি তোমার মতো আমার সকল গোপিনীকে সুখী করার চেষ্টা করেছি। আমি আমার আচরণের দ্বারা এমন কিছু ভাব প্রকাশ করিনি, যাতে তারা বিন্দুমাত্র দুঃখিত হতে পারে। তারপর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন—তুমি আবার মর্ত্যধামে গিয়ে তোমার লীলা প্রদর্শন করতে চাইছো, তাই তো?
মেয়েটি অবাক হয়ে কৃষ্ণের মুখের দিকে তাকাল। এর আগে সে কৃষ্ণের অলৌকিক ক্ষমতার নানা চিহ্ন দেখেছে। আজ আরও একবার শ্রীকৃষ্ণ প্রমাণ করলেন যে, তিনি সর্বজ্ঞ। তিনি সর্বত্র বিরাজমান। তিনি যে—কোনও মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে তার মনের বাসনা অনুভব করতে পারেন।
মেয়েটির দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণ বললেন—তথাস্তু, তোমার আশাই পূর্ণ হোক। তুমি আবার মর্ত্যধামে গিয়ে তোমার লীলা প্রদর্শন করো।
এবার মেয়েটিকে আশীর্বাদ করে কৃষ্ণ জানালেন—তুমি মর্ত্যে কিন্তু একা আবির্ভূতা হবে। আমি আর শরীর ধারণ করে সেখানে যাব না। তবে একটা কথা মনে রেখো, আমি কিন্তু সর্বক্ষণ তোমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করব। এমনকি পথ চলতে চলতে যদি তুমি হঠাৎ পেছন ফিরে তাকাও, তাহলে হয়তো আমাকে দেখতে পাবে। তবে সাবধান, আমার উপস্থিতির কথা জনসমক্ষে প্রকাশ কোর না। তুমি আমার প্রতি তোমার মন প্রাণ সমর্পণ করবে। তাহলেই আমি তোমাকে এসে দেখা দেবো। আর যদি কখনও সামান্যতম বিপদে পড়ো, তাহলে নির্দ্বিধায় আমার নাম ধরে ডাকবে। জানো তো আমি ভক্তের ভগবান। আমার ভক্ত বিপদে পড়লে আমি সেখানে ছুটে যাই। বিপদের হাত থেকে ভক্তকে রক্ষা করি। এই হল আমার একমাত্র স্বভাব।
কৃষ্ণ বললেন—তোমার কোনও ভয় নেই। তুমি একা ওখানে থাকতে পারবে। কিন্তু তোমার ওপর কিছু কিছু বিপদ এসে পড়তে পারে। এভাবেই আমি আসলে তোমাকে পরীক্ষা করব। একজন মানুষ বিপদে না পড়লে বুঝতে পারা যায় না সে মানসিক দিক থেকে কতখানি শক্তিশালী। তাই তোমার সামনে সাজানো বিপদ আসবে। তুমি সেই বিপদ অতিক্রম করতে পারবে। আমি তোমাকে আরও বেশি শক্তিশালী করে গড়ে তুলব। আমার শক্তিতে তুমি বিরুদ্ধবাদীদের ধ্বংস করে দেবে। অথচ তোমার কোনও ক্ষতি হবে না।
এবার মেয়েটি জানতে চাইল—প্রভু, অনুগ্রহ করে বলুন, আমি কোথায় জন্মগ্রহণ করব। কী আমার নাম হবে?
এই কথা শুনে কৃষ্ণ বলেছিলেন—তুমি মেবার রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করবে। তোমার নাম হবে মীরা। কলিতে সারা ভারতবর্ষে একদিন তোমার নামে জয়ধ্বনি দেওয়া হবে। ভক্তশিরোমণি মীরাবাঈ হিসাবে তুমি সকলের অন্তরে বিশেষ স্থান দখল করবে। বেশিদিন তুমি পৃথিবীতে থাকতে পারবে না। একদিন পৃথিবীর লীলা শেষ করে তোমায় আবার এখানে ফিরে আসতে হবে। কিন্তু তোমার প্রতি একইরকম থাকবে পার্থিব মানুষের ভক্তি। মানুষ কোনও দিন তোমাকে ভুলতে পারবে না।
কথা বলা শেষ হয়ে গেল। কিন্তু তখনও অনেক কিছু জানা বাকি ছিল বেচারি ওই গোপিনীর। সে তো ভাবতেই পারছে না যে, এবারে একেবারে একা পৃথিবীতে গিয়ে লীলা দেখাতে হবে। কিন্তু কী আর করা যায়, কৃষ্ণ যা আদেশ করবেন, নত মস্তকে সেই আদেশ পালন করতে হবে তাকে।
তবু ভয়ে ভয়ে সে শুধায়—হে প্রভু, অনুগ্রহ করে বলে দিন, আমি এমন কী ক্ষমতার অধিকারিণী হব, যাতে আমার নাম কেউ কখনও ভুলতে পারবে না?
কৃষ্ণ বরাবরই তাঁর গোপিনীদের বিশেষ স্নেহ করেন। কারণ তিনি জানেন এইসব গোপিনীরা হল নারীশক্তির এক—একটি অঙ্গ। এদের মাধ্যমেই নারী মহিমা প্রকাশিত হয়। তিনি যে সদাসর্বদা গোপিনীদের সঙ্গে অলৌকিক রঙ্গরসিকতায় মেতে ওঠেন, এর কারণ কি? এর অন্তরালে একটি আলাদা প্রতীতি বা বোধ লুকিয়ে আছে। আমরা সাধারণ দৃষ্টিতে হয়তো তা অনুভব করতে পারি না। শ্রীরাধিকা হলেন কৃষ্ণের ভাবিকা শক্তি আর এই গোপিনীরা সকলে মিলে তাকে নানারকম শক্তিতে বিভূষিত করেছে।
তিনি বললেন—শোনো, আগামী জন্মে তুমি কবিত্ব শক্তির অধিকারিণী হবে। তোমার মনের মধ্যে দার্শনিক অভিজ্ঞান থাকবে। তুমি কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে এমন সব গান লিখবে এবং সেই গানগুলিতে এত সুন্দর সুর সংযোজিত করবে যে, মানুষ সেই ভজন কখনও ভুলতে পারবে না।
এই কটি কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সেই গোপিনীর সমস্ত শরীরে বুঝি বিদ্যুৎ শিহরিত হল। কতদিন ধরে সে তো একথাই ভেবেছে। তার মনোগত বাসনার কথা সুন্দর সুন্দর শব্দ সম্ভারে সে সাজিয়ে তুলবে। গ্রামের দেহাতি মানুষ ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে এ গান গাইবে। যখন রাতের অন্ধকার নেমে আসবে চারপাশে, জ্বলে উঠবে প্রদীপ শিখা, তখন কর্মক্লান্ত মানুষজন গাছতলায় বসে কৃষ্ণভজনা করবে। আর এইভাবেই তার নামটি সকলের মনের ভেতর গেঁথে যাবে চিরকালের জন্য। সে ভাবল, আমি কত সৌভাগ্যবতী। না হলে এত গোপিনী থাকতে শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণ কিনা আমাকেই এই কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন? চোখ বন্ধ করল সে। সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণের করুণাঘন মূর্তিখানি তার চোখের তারায় ফুটে উঠল। দু’হাত জোড় করে কৃষ্ণের উদ্দেশে প্রণাম নিবেদন করল সে।
দুই
ভারতের উত্তর—পশ্চিম প্রান্তে রাজস্থান। শৌর্যে—বীর্যে, অতুলনীয় পরাক্রমে এক বিস্তৃত ভূখণ্ড। এই রাজস্থানের সকল যোদ্ধা বিদেশী শত্রুর বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াই করেছেন। হাসতে হাসতে শহিদ হয়েছেন। এই রাজস্থানের কত রমণী সতীত্ব রক্ষার জন্য জহরব্রত পালন করেছেন। আর এই রাজস্থানের বুকেই কত লোকসঙ্গীত রচিত হয়েছে। রাজস্থানকে তাই প্রকৃতির খেয়ালি খেলাঘরের এক দুরন্ত কন্যা বলা হয়। রাজস্থানের ভূ—প্রকৃতির মধ্যে একধরনের বন্ধুর স্বভাব লুকিয়ে আছে। যতদূর চোখ পড়ে ধু—ধু প্রান্তর। মাইলের পর মাইল শুধু বালিয়াড়ি। সেখানে কখনও হঠাৎ মধ্য দিনে ঝড় ওঠে, আঁধিমায় ঢেকে যায় সূর্যের মুখ। সাঁঝের আকাশে চাঁদ থেকে ঝরে পড়ে অকৃপণ জোছনধারা। তাকে দেখলে মনে হয়, প্রকৃতি তাকে এত সুন্দরভাবে সাজিয়েছে কিন্তু সে এত নিরাভরণা কেন?
রাজস্থানের মানুষ সৎ শোভন জীবনযাপন করতে ভালোবাসে। তারা পরিশ্রমী, তারা উদ্যমী। তারা ভগবানের ওপর নির্ভর করে। রাজপুত মেয়েরা শৌর্য—বীর্যের অধিকারিণী। আবার গৃহকর্মে নিপুণা। স্বামীর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থেকে সকল কাজে স্বামীকে সাহায্য করে। আদর্শ মানুষ বলতে যা বোঝায়, রাজস্থানে গেলে তা দেখতে পাওয়া যায়।
এই রাজস্থানের বুকে রুক্ষ মরুভূমির ভেতর ছোট্ট একটি গ্রাম। গ্রামটির নাম কুড়কী। তার কাছাকাছি শহর বলতে মেড়তা। সেখান থেকে আঠারো মাইল পায়ে হাঁটলে তবে আমরা রিয়া গ্রামে পৌঁছোতে পারব। রিয়া গ্রামের চারপাশে শুধুই বালুর আস্তরণ, দুই—একটি উট চলেছে মাঝেমধ্যে। সেই পথে আরও আট মাইল গেলে তবে তুমি পৌঁছোতে পারবে ওই কুড়কী গ্রামে। এখন এই গ্রামটি ভারতের সর্বত্র খ্যাতি লাভ করেছে। কারণ এখানেই একদা জন্মেছিলেন ওই কৃষ্ণসাধিকা মীরাবাঈ।
জন্মেছিলেন কমলাবাঈয়ের ঘরে। ঘর আলো করে এসেছিলেন তিনি। জানি না তাঁর জন্মমুহূর্তে কোথাও মঙ্গলশঙ্খ বেজে উঠেছিল কিনা। আকাশ থেকে দেবদেবীরা কি নেমে এসে পুষ্পবৃষ্টি করেছিলেন? জানি না, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ তাঁর জন্মুহূর্তে সেখানে উপস্থিত থেকে এই নবজাতিকাকে আশিস দান করেছিলেন কিনা; অথচ এই মেয়েটির রূপলাবণ্যের ছটা দেখে গ্রামের সকলে একেবারে অবাক হয়ে গিয়েছিল। বেচারি কমলা, সে ভাবতেই পারেনি, তার কোল আলো করে এমন এক দেবকন্যা শেষ পর্যন্ত জন্মগ্রহণ করবে।
তার বাবা রত্ন সিংহ ছোটোখাটো ভূস্বামী। তা সত্ত্বেও তিনি পায়ের ওপর পা রেখে বিলাসী জীবন কাটাতে ভালোবাসেন না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রাণপাত করে পরিশ্রম করেন। তার বিনিময়ে যেটুকু ফসল ওঠে, তাতেই সংসার চলে যায়। মনের ভেতর উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, সহজ সরলভাবে দিন কাটলেই তো হল।
এমন একটি পরিবারের কন্যা সন্তান হওয়াতে মীরা বোধহয় ছোটো থেকেই নির্লোভ মনের অধিকারী হতে পেরেছিলেন। জাগতিক সুখ—স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি বিন্দুমাত্র নজর ছিল না তাঁর। বরং তিনি ভালোবাসতেন প্রকৃতির খেয়ালি খেলাঘরে এক অরণ্য বালিকা হয়ে ঘুরে বেড়াতে। যখন ভোরবেলা নিশান্তিকার শেষ তারাটি মুখ লুকোত অন্ধকারে, পুব আকাশ ধীরে ধীরে আলোকিত হতো, তখন মীরা পায়ে পায়ে উঠে যেতেন তাঁদের বাড়ির ছাদে। পুব আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। হঠাৎ তাঁর মনে হতো, আকাশের চারপাশে বুঝি শ্রীকৃষ্ণের মুখ দেখা যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করতেন মীরা। এক অদ্ভুত ভাবাবেশ এসে তাঁর সমস্ত সত্তাকে জড়িয়ে ধরত।
বেচারি কমলাবাঈ, মেয়ে মীরা গেল কোথায়? আহা, কোথাও পড়ে—টড়ে যায়নি তো? মীরার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে তিনি ছুটে আসতেন। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতেন তাঁর শিশু কন্যাটির মুখের দিকে। এ কী? আমি কি চোখে ভুল দেখলাম? আমার কেবলই মনে হচ্ছে মীরার চারপাশে এক জ্যোতির্বলয় সৃষ্টি হয়েছে। তাহলে? মীরা কি স্বর্গলোকের দেবী? ভুল করে ভালোবাসার নীল গ্রহ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছে?
তখনই একটা ভয়ার্ত অনুভূতি এসে কমলাবাঈয়ের সমস্ত শরীরকে আঁকড়ে ধরত। তাঁর কোষে—কোষান্তরে প্রবাহিত হতো এক অব্যক্ত যন্ত্রণা। তিনি ভাবতেন, এই মীরাবাঈকে তিনি কি চিরদিন তাঁর কোলে ধরে রাখতে পারবেন? নাকি একদিন এই মীরাবাঈ সংসারজীবনের সকল মায়া ত্যাগ করে সন্ন্যাসিনী হয়ে যাবে? সেদিন আর শত চেষ্টা করেও কমলাবাঈ তার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না।
ছোটো ছোটো পদের মাধ্যমে মীরাবাঈ তাঁর জীবনের সমস্ত ঘটনার কথা আমাদের শুনিয়েছেন। নিজের জন্ম সম্পর্কে বলতে গিয়ে মীরাবাঈ লিখেছেন—
”মেড়তিয়া ঘর জনম লিয়ো হ্যায়
মীরা নাম কহায়ো।”
ভারি সুন্দর এইসব পদের শব্দসঞ্চয়ন। মনে হয় দূরে কোথাও বোধহয় মাদল বাজছে, আর একটু বাদেই শুরু হবে বসন্তোৎসব। তাই তো, মীরার রচিত পদগুলি আজও আমাদের হৃদসরোবরে শতদল হয়ে ফুটে আছে। আজও চোখ বন্ধ করলে তাঁর লেখা ভজন গানের সুর আমরা শুনতে পাই— মনে হয় কোনও এক রাখাল বুঝি দুখ—জাগানিয়া সুরে শোনাচ্ছে ঘুম—ভাঙানিয়া গান।
পাড়াপড়শিরাও মীরার এহেন আচরণে একেবারে অবাক হয়ে যেতেন। তাঁরা ভাবতেও পারতেন না এক শিশু হওয়া সত্ত্বেও মীরার মধ্যে এত গাম্ভীর্য এল কী করে? কেউ কেউ আড়ালে আবডালে বলতেন, মীরা এক অবতার। সত্যিই কি তাই? নাকি কোনও কোনও শিশু এমন গম্ভীর স্বভাবের হয়ে থাকে। এই মেয়েটি হয়তো ঠিক তেমনই।
দিন কাটতে থাকে। প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে একটির পর একটি নাটক অভিনীত হতে থাকে। মীরার বয়স বাড়তে থাকে এক পা এক পা করে। ইতিমধ্যে মীরা গ্রামের সকলের চোখের মণি হয়ে উঠেছেন। মা—বাবার আদরের ধন। তাঁকে এক মুহূর্ত না দেখলে মায়ের অন্তর কেঁপে ওঠে। সব কাজ শেষ করে বাবা যখন ঘরে ফিরে আসেন, তখন মীরার নাম ধরে ডাকতে থাকেন।
আগেই বলেছি, এই কাহিনির কেন্দ্র হল উত্তর—পশ্চিম ভারতের রাজস্থান। এই রাজ্যের অন্তর্গত মারবার প্রদেশ। সেখানে আছে যোধপুর। এই সুন্দর নগরটি স্থাপন করেছিলেন রাঠোর বংশীয় রাজা যোধাজির চতুর্থ পুত্র দুদাজি। তিনি মেড়তাতে এক পৃথক রাজ্য স্থাপন করেন। রাঠোর বংশের মেড়তিয়া শাখা এই দুদাজি থেকেই শুরু হয়েছিল। দুদাজি ছিলেন এক ধর্মপ্রাণ মানুষ। কর্তব্যকর্মে অবিচল। তাঁর চতুর্থ পুত্র রত্ন সিংকে ভরণপোষণের জন্য কুড়কী, বাজোলি প্রভৃতি বারোটি গ্রাম জায়গীর প্রদান করেছিলেন। রত্ন সিং—এর কোনও পুত্র ছিল না। তাঁর একটি মাত্র কন্যা সন্তান পৃথিবীতে এসেছিলেন। তিনি হলেন মীরাবাঈ।
মীরার জন্মকাল নিয়ে অনেক মতপার্থক্য আছে। বিভিন্ন ইতিহাসবিদ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করেছেন। তবে মনে হয়, সম্বৎ ১৫৫৫, অর্থাৎ ১৪৯৯ খ্রিস্টাব্দে কুড়কী গ্রামে মীরার জন্ম হয়।
তবে একথা জানা আছে যে, মীরাকে দেখে তাঁর মা কমলাদেবী খুবই খুশি হয়েছিলেন। তিনি ভাবতে পারেননি যে, তাঁর ঘর আলো করে এমন এক নবজাতিকা আসবে। এই মেয়েটির গাত্রবর্ণ চাঁপা ফুলের মতো। নিষ্পাপ দুটি চোখের তারায় পৃথিবীর সব রহস্য রোমাঞ্চ বুঝি খেলা করছে। সদ্যজাত মীরাকে দেখে গ্রামের সকলে আনন্দে একেবারে আত্মহারা হয়ে যান। তাঁরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, একদিন এই মেয়েটি এই বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে। তখন কি কেউ ভেবেছিল যে, মীরা বড়ো হয়ে হবেন এক কৃষ্ণসাধিকা? আমরা জানি না, কখন কোথায় কী ঘটনা ঘটে যায়।
একেবারে ছোটোবেলায় মীরা কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে যেতেন। তখন সবেমাত্র আধো আধো বোল ফুটেছে তাঁর গলায়। তখন তাঁর দৃষ্টিসীমার মধ্যে বিশাল পৃথিবী ধীরে ধীরে ধরা দিচ্ছে। সহেলিদের সঙ্গে খেলার সময় তিনি মাটি দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি তৈরি করতেন। কৃষ্ণ ছাড়া অন্য কোনও কিছুর প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র আকর্ষণ ছিল না। শুধু তাই নয়, সেই বয়সেই তিনি ছিলেন মধুর স্বভাবা, মৃদুভাষিণী এবং সকলের প্রতি সমান সহানুভূতিসম্পন্না। বালিকা মীরার এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখে সমাজপতিরা একেবারে অবাক হয়ে যেতেন। তাঁরা ভাবতেই পারতেন না যে, এত কম বয়সে এই মেয়েটির মধ্যে এতখানি গাম্ভীর্য এল কোথা থেকে?
একদিন রাতে মীরা এক স্বপ্ন দেখলেন। সেই স্বপ্নবৃত্তান্তের কথা মায়ের কাছে খুলে বলেছিলেন তিনি। তিনি বলেছিলেন—
”মাই মহাঁনে সুপানে মঁ পরণ গয়া জগদীশ
অংগ অংগ হলদী মৈঁকরী জী, সুধেভীজ্যো গাত।
মাই মহাঁনে সুপনে মে, পরণ গয়া দীননাথ।।
ছপ্পন কোট জহাঁ জান পধারে, দুলহা—শ্রীভগবান
সুপনে মে তোরণ বাঁধিয়ো জী, সুপনে মে আই জান।
মীরা কে গিরিধর মিল্যা জী পূরব জনম কো ভাগ।।
সুপনে মেঁ মহাঁনে পরণ গয়া জী, হো গড়া অচল সুহাগ।
—মা, আমি স্বপ্নে দেখেছি জগদীশের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আমি সারা গায়ে মেখেছি হলুদ রং। রাজমহলে আমার বর শ্রীভগবান এসেছিলেন। তোরণ বাঁধা হয়েছিল, আমার বর সেখানে পদার্পণ করেন। আমার জন্ম—জন্মান্তরের ভাগ্য, গিরিধারীকে আমি আমার স্বামী হিসাবে পেয়েছি। তিনি স্বপ্নে দেখা দিয়ে আমাকে বিয়ে করে গেছেন। এ আমার অপরিসীম সৌভাগ্য।
এই পদখানি পড়ে মনে প্রশ্ন জাগে, সত্যি সত্যি কি বালিকা মীরা এমন পদ রচনা করেছেন? নাকি পরবর্তীকালে, প্রাপ্তবয়স্ক হবার পর তাঁর কলম থেকে এই জাদুশব্দগুলি নির্ঝরিত হয়েছিল? মীরার জীবনীকাররা বারংবার অন্বেষণ করেও এই প্রশ্নের কোনও সঠিক জবাব দিতে পারেননি। তাঁদের মধ্যে যাঁরা ঈশ্বর বিশ্বাসী, তাঁরা বলে থাকেন, একেবারে ছোটো থেকেই মীরা ছিলেন অলৌকিক কবিশক্তির অধিকারিণী। সেই বয়সেই তিনি এমন সুন্দর সুন্দর পদ লিখে সকলকে একেবারে অবাক করে দিতেন।
মীরার ছোটোবেলার জীবনে একাধিক স্মরণীয় ঘটনা ঘটে গেছে। যদি আমরা নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এই ঘটনাগুলি বিচার করতে যাই, তাহলে হয়তো অবাক হতে হবে আমাদের। আসলে বিশ্বাস বস্তুটি হল রহস্যময়। ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর’—এমন একটা প্রবাদবাক্য আমরা মাঝেমধ্যেই বলে থাকি। পাঠক—পাঠিকারা, বিষ্ণুপ্রিয়া মীরাবাঈয়ের জীবনকাহিনি বর্ণনা করতে হলে সেই বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করতে হবে আমাদের। যুক্তিতর্ক এসে আবেগ আর অভিমানকে যেন নস্যাৎ করে না দেয়—সেদিকে নজর রাখা দরকার।
একদিন বাজি—বাদ্য বাজিয়ে বহু লোক চলেছে। সঙ্গে চলেছে বর। চারপাশে উৎসবমুখর পরিবেশ। বালিকা মীরা ওই বাজনা শুনে ছুটে এলেন। মা ছিলেন কাছে দাঁড়িয়ে। মীরা বালিকাসুলভ কৌতূহলে প্রশ্ন করলেন—মা, ও কে যাচ্ছে?
মা বললেন—মীরা, বর চলেছে বিয়ে করতে।
বালিকা মীরা তখন হেসে বলেছিলেন—মা, আমার বর কে? কে আসবে আমাকে বিয়ে করতে?
কথায় কথায় মা বলেছিলেন, এই গিরিধারী গোপালই হল তোমার বর।
এই ক’টি শব্দ মীরার অন্তরে প্রবেশ করে। তখন থেকেই তিনি গিরিধারী গোপালকে পতি হিসাবে ভাবতে শিখেছিলেন। তাঁর স্বপ্নে—বিষাদে—মায়ায়—তখন শুধু গিরিধারীর অবস্থান।
তখনই কি শ্রীকৃষ্ণকে উদ্দেশ করে তিনি লিখেছিলেন এমন একটি পদ?
”মেরে তো গিরিধর গোপাল দুসরো ন কোই—
জাকে সির মোর মুকুট মেরী পতি সোই।”
—গিরিধারী গোপাল ছাড়া আমার আর কেউ নেই। যাঁর মাথায় ময়ূর মুকুট, তিনিই আমার পতি।
তখন থেকে সত্যি সত্যি মীরা গিরিধারীকে নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত থাকতেন। যে বয়সে মেয়েরা পুতুল নিয়ে খেলা খেলে, গোল্লাছুটের আসরে চলে যায়, মাঝদুপুরে সঙ্গী—সাথীদের সঙ্গে নিয়ে লুকোচুরির খেলায় মেতে ওঠে, সেই বয়সে মীরা জগৎসংসার থেকে দূরে গিরিধারীকে নিয়ে সাজিয়ে ছিলেন তাঁর সুখের সংসার। এ সংসারে ঈশ্বর এসে মাঝেমধ্যে দেখা দিতেন। এমনকি মীরা সেই ভগবানের সাথে মেতে উঠতেন অন্তরঙ্গ আলাপনে। আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন অন্বেষণ করতেন। শিশুকাল চলে গেল জীবন নাটক থেকে। এবার মীরা এসে উপস্থিত হলেন বালিকা বয়সে। এই সময় তাঁর জীবনে একটা মনে রাখার মতো ঘটনা ঘটে যায়। যে ঘটনার ছাপ পড়েছিল তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনে।
একদিন এক সন্ন্যাসী এসেছিলেন মীরাদের পরিবারে। তিনি বৈষ্ণব সাধু। সারাজীবন ধরে কৃষ্ণতত্ত্বের সাধনায় মগ্ন ছিলেন।
তাঁর কাছে ছিল গিরিধারীর একটি মূর্তি। সেই মূর্তির দিকে তাকালেই মন প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। বিশেষ করে সেই মূর্তির মুখমণ্ডলে এমন এক লাবণ্যমাখা ছিল, যা মনকে প্রফুল্ল করে দেয়।
হঠাৎ মীরার নজরে পড়ল এই মোহন মূর্তিটি। মীরা আবদার করলেন—সাধুজি, তুমি তোমার গিরিধারীকে আমাকে দেবে? আমি ওকে যত্নে রাখব। দু’বেলা পুজো করব। দোহাই সাধুজি, তোমার পায়ে পড়ি। তুমি কিন্তু আমাকে বিমুখ করো না।
ছোট্ট বালিকার এহেন আবদার শুনে সাধুমহারাজ খুবই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী, অনেক লোভ তাঁকে সংবরণ করতে হয়। তবু মাঝে মধ্যে তাঁকে সংসারে এসে প্রবেশ করতে হয়। কোনও কোনও ভক্ত—শিষ্যের আতিথ্য গ্রহণ করেন কয়েকদিনের জন্য। এই সুবাদে বহু লোকের সঙ্গে তাঁর আলাপ পরিচয় হয়। কিন্তু তিনি এই বালিকার মুখমণ্ডলে ফুটে ওঠা স্বর্গীয় আভা দেখে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।
তবে এই আবদার তিনি মানবেন কেমন করে? তিনি যে সদাসর্বদা ওই গিরিধারী মূর্তিকে সঙ্গে রাখেন। ওই গিরিধারী তাঁর প্রাণের প্রতিমা। তাঁকে ছেড়ে এক মুহূর্ত থাকার কথা চিন্তা করতে পারেন না ওই সাধুমহারাজ। তিনি পরম বৈষ্ণব ভক্ত। বৈষ্ণব শাস্ত্রের বিভিন্ন রীতিনীতি সম্পর্কে যথেষ্ট পড়াশুনা করেছেন।
অথচ মীরা তখন একনাগাড়ে তাঁর মনের কথা বলেই চলেছেন। কিছুতেই তিনি ওই গিরিধারীকে ছাড়বেন না। শেষ অবধি সাধু ভাবলেন, এই মেয়েটি কি খেলাচ্ছলে এমন কথা বলছে, নাকি এর মনে সত্যি সত্যি বৈষ্ণব ভাবনার উদয় হয়েছে?
গিরিধারী বোধহয় মীরার প্রাণের ধন। সবসময় তিনি গিরিধারীর কথাই চিন্তা করেন। তাঁর আর গিরিধারীর জীবন বুঝি একই সুতোতে বাঁধা।
সাধুর কাছে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন মীরা। বারবার করে বলতে লাগলেন সাধুমহারাজ, তোমার পায়ে পড়ি, তোমার গিরিধারীকে আমাকে দাও। আমি ওকে আমার কাছে রেখে দেবো। তুমি কিছু ভেবো না, তুমি যেমন যত্ন করে গিরিধারীর পুজো করো আমিও ঠিক সেইভাবে গিরিধারীর পুজো করব।
সাধু মহারাজ এবার একটু হেসে বললেন—বোকা মেয়ে, তুমি কতটুকু বলো তো, তোমাকে কে দেখে তার ঠিক নেই, আর তুমি কিনা বৈষ্ণব মতে গিরিধারীর পুজো করবে? তা কেমন করে হয়?
এবার মীরা কেঁদে ফেললেন। মীরা বুঝতে পেরেছেন শুধু কথা বলে সাধু মহারাজের কঠিন হৃদয় গলানো যাবে না। কান্নাই হল তাঁর শেষ অস্ত্র। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন—তুমি একবার দিয়েই দেখো না, আমি সেবা করতে পারি কিনা।
সাধু মহারাজ বুঝতে পারলেন তিনি মহাবিপদে পড়েছেন। একদিকে ছোট্ট মেয়ের বায়না, অন্যদিকে শাস্ত্রমতে পূজার্চনা। তিনি এখন কোন পথের পথিক হবেন? অবশেষে অভিজ্ঞ সাধুমহারাজ বুঝতে পারলেন যে, এই মেয়েটির সাথে কথা বলা অনর্থক। তিনি চুপ করে থাকলেন।
দিন কাটতে থাকে। মীরা কিন্তু কিছুতেই সাধু মহারাজকে ছাড়তে চাইছেন না। সাধুকে তিনি এক মুহূর্ত স্থির হয়ে বসতে দেন না। দেখা হলেই তাঁর মুখে শুধু একটিই বায়না—পায়ে পড়ি তোমার। তোমার গিরিধারীকে আমাকে দাও। গিরিধারী ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না।
শেষ পর্যন্ত সাধু মহারাজ রত্ন সিং—এর কাছে নালিশ জানাতে বাধ্য হলেন। রত্ন সিং সব শুনে খুব রেগে গেলেন। তিনি জানেন তাঁর মেয়ে একটু আত্মভোলা ধরনের। বাকি পাঁচজনের থেকে একেবারে আলাদা। কি আর করা যাবে, পৃথিবীর সবাই তো একই রকম স্বভাব নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। কিন্তু এবারের ব্যাপারটা অন্যরকম। সাধু মহারাজ সম্মানীয় অতিথি। আর তাঁর সাথে কিনা এমন আচরণ? রত্ন সিং সঙ্গে সঙ্গে মীরাবাঈকে ডেকে পাঠালেন। বললেন—তুই সাধুর ঠাকুর নিয়ে কী করবি? তোর যদি ইচ্ছা হয়, আমি না হয় হাট থেকে মাটির গিরিধারী এনে দেবো। খেলা করবি তো!
রত্ন সিং ভেবেছিলেন এ বোধহয় ছোট্ট মেয়ের বায়না। এই একটু পরে ভুলে যাবে। কিন্তু যখন তিনি দেখলেন যে, মীরা কিছুতেই তাঁর কথা শুনলো না, তখন তিনি একটু চিন্তায় পড়লেন। সাধুর কাছে বারবার মীরা ঘুরঘুর করছেন। কাতরভাবে তাঁর প্রাণের কথা জানাচ্ছেন। হাত দুটি জোড় করে বলছেন—সাধু মহারাজ, তোমার কাছে আমি আর কিছু চাইছি না। কিন্তু দোহাই তোমার তুমি যাবার সময় এই গিরিধারীকে আমাকে দিয়ে যেও। এর সেবা আমি কেমন করছি, তুমি কি জানতে চাও? তাহলে পরের বার এসে দেখে যেও, দেখো, আমি কিন্তু ঠিকমতো সেবাযত্ন করব।
সাধু অবশেষে মীরাবাঈকে অবজ্ঞা করতে শুরু করলেন। মীরা একলা ঘরে তাঁর মনের কথা বলেই চলেছেন। সাধু কোনও উত্তর দেন না।
তখনই এক অঘটন ঘটে গেল। এমন এক ঘটনা, বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না। ভারতবর্ষের বুকে সাধক—সাধিকার জীবনে এমন ঘটনা কতবার ঘটেছে!
সেদিন মধ্যরাত। হঠাৎ সাধু মহারাজের ঘুম ভেঙে গেল। এ কি? কেন এমন হল? মনে হল একটা অদ্ভুত শিহরণ বুঝি তাঁর শরীরের কোষে—কোষান্তরে প্রবাহিত হচ্ছে। তিনি উঠে বসলেন। আকাশের দিকে তাকালেন। নিস্তব্ধ নিশুতি রাত। এইমাত্র তিনি একটা স্বপ্ন দেখেছেন। সেই স্বপ্নের মধ্যে কে যেন তাঁকে বলছেন, তুমি যদি তোমার ভালো চাও, তাহলে তোমার ওই গিরিধারীকে এখনই অবোধ বালিকার হাতে অর্পণ করো। ভেবোনা এটা তার খেলা। সে সত্যি সত্যি গিরিধারীকে ভালেবাসে। গিরিধারী হল তার প্রাণের প্রতিমা।
এই স্বপ্ন দেখেই ঘুম ভেঙে গেছে সাধু মহারাজের। তিনি ভাবলেন, কী করবেন এখন? গিরিধারীকে ছাড়তে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু এ তো একেবারে দৈব আদেশ।
পাশের ঘরে মীরা জাগছেন বিনিদ্র রাত। সারা রাত ধরে তিনি শুধু একটি কথাই বলে চলেছেন—হে গিরিধারী, তোমার মূর্তিকে আমি পুজো করার অধিকার পাব না? আমার বয়স কম বলে ওরা কেউ আমার কথা বিশ্বাস করছে না। কিন্তু তুমি তো জানো, তোমার সঙ্গে আমার জন্ম—জন্মান্তরের সম্পর্ক। তোমাকে হাতে পেয়েও আমি কাছে রাখতে পারব না? তাহলে আমার কী হবে? তুমি চলে গেলে আমি কী নিয়ে থাকব? যেদিকে দু’চোখ যায়, চলে যাব। আত্মহত্যা করব। এই কথা বলে রাখলাম।
তখন তাঁর দু’চোখ দিয়ে নির্গত হচ্ছে লবণাক্ত অশ্রুধারা। অবশেষে সাধু মহারাজ বুঝতে পারলেন, এ হল দেবতার অমোঘ আদেশ। সেই আদেশকে শিরোধার্য করতেই হবে। কেউ কখনও দেবতার আদেশ পালন না করে থাকতে পারে না। তাহলে মহাবিপর্যয় ঘটে যাবে।
তখন সাধুর সমস্ত শরীরে এক অন্যরকম অনুভূতি দেখা দিয়েছে। মনে হচ্ছে তাঁর কোষে—কোষান্তরে কে যেন বাজিয়ে দিয়েছে রণদামামা। চারপাশ থেকে ছুটে আসছে বাক্যবাণ। বিষ—তীর হয়ে আঘাত করছে তাঁকে। তিনি ছটফট করতে থাকলেন। তারপর ভক্তির অশ্রুনির্গত হয় তাঁর চোখ থেকে। মধ্যরাতে সাধু মহারাজ চলে আসেন তাঁর বিগ্রহটির কাছে।
এ কী? বিগ্রহের চোখে জল? নাকি ভ্রম? তিনি ভালোভাবে গিরিধারীর দিকে তাকালেন। তাঁকে বুকের মাঝে চেপে ধরলেন। কতদিন ধরে এই মূর্তিটির সাথে তাঁর এমনই সম্পর্ক। একে এক মুহূর্ত ছেড়ে থাকার কথা তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। তারপর বললেন—গোপাল আমাকে তুমি ছেড়ে চলে যাবে? তুমি কি নিষ্ঠুর? কতদিন ধরে নিয়মরীতি মেনে আমি তোমার পুজো করে এসেছি। একবারের জন্যও অন্যথা হয়নি। আমি অসুস্থ হয়েছি, চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি, তবুও তোমার পুজোয় কোনও ত্রুটি রাখিনি। বলো, বলো হে গোপাল, আমি কি অজান্তে কোনও পাপ করেছি? কর্তব্যে অবহেলা করেছি? কোনও মানুষের মনে আঘাত দিয়েছি? আমার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনে কি তীব্র অনীহা দেখিয়েছি? তা না হলে তুমি কেন আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছো?
একটু বাদে সাধু মহারাজ নরম স্বরে বললেন—আমি বুঝতে পেরেছি, আমার তো বয়স হয়েছে, হাত—পা কাঁপে, হয়তো আগের মতো আর ঠিক করে তোমার পুজো করতে পারি না, তাই তোমার মনে অভিমান হয়েছে, গোপাল? তুমি এভাবে তোমার বুড়ো ছেলেকে কষ্ট দেবে? আমি বুঝতে পারছি, আমার পুজো তোমার আর ভালো লাগে না।
তাকিয়ে থাকলেন তিনি গিরিধারীর মুখের দিকে। তাঁর কেবলই মনে হল এই মূর্তিটি বুঝি এখনই তাঁকে কিছু বলবে। কিন্তু কই? তাঁর ঠোঁট নিথর কেন? সে তো কোনও শব্দ উচ্চারণ করছে না?
তখন রাতের বয়স ক্রমশ গড়িয়ে চলেছে সকালের দিকে। পাখিদের জেগে ওঠার সময় হল বুঝি। সাধু মহারাজের দু’চোখে ঘুম নেমেছে। অবশেষে তিনি তাঁর প্রিয় গোপাল মূর্তিটি বুকের মাঝে রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন।
সকাল হল, এক অপার্থিব সকাল। এই সকালে ঘটে গেল এমন এক ঘটনা, যা মীরাবাঈয়ের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। মীরাবাঈ সারা রাত জেগে জেগে কাটিয়েছেন। লাল হয়ে গেছে চোখ দুটি। ভোরের দিকের বাতাস এসে মায়ের পরশে আদর করেছে তাঁকে। তখন ঘুমিয়ে পড়েছেন তিনি। আহা, কতই বা বয়স হবে, এই বয়সে একটি মেয়ে এমন ঈশ্বর—অভিলাষী হল কী করে?
সে এক অলৌকিক দৃশ্য। সাধুমহারাজ তাঁর প্রাণের গোপাল মূর্তি নিয়ে এক—পা এক—পা করে এগিয়ে চলেছেন অলিন্দ পথে। অবশেষে তিনি মীরার শোবার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। বাতায়ন পথে তাকালেন নিদ্রিতা বালিকার মুখের দিকে। আহা, পৃথিবীর সমস্ত নিষ্পাপতা বুঝি সেখানে বাসা বেঁধেছে। মনকে ধিক্কার দিলেন তিনি। তিনি সাধু। বৈষয়িক বিষয়ের প্রতি তাঁর সামান্যতম আকর্ষণ থাকার কথা নয়। অথচ তিনি কিনা জোর করে গিরিধারীকে আটকে রেখেছিলেন? গিরিধারী তাঁকে অভিশাপ দিয়েছেন। তাঁর এমনটি করা উচিত হয়নি।
মীরার কাছে এসে অনুচ্চ কণ্ঠস্বরে ডাকলেন, মীরা, মা মীরা,তুমি একবার ওঠো। দেখো, আমি কাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি।
মীরাবাঈ তখন বোধহয় স্বপ্নের মধ্যে তাঁর গিরিধারীকেই দেখছিলেন। ধরফড় করে উঠে বসলেন তিনি। অবাক বিস্ময় ফুটে উঠল তাঁর মুগ্ধ দুটি চোখের তারায়। তিনি ভাবতেই পারেননি, এভাবে তাঁর স্বপ্ন সফল হবে। সাধু মহারাজের কোলে গিরিধারী!
তিনি বললেন—সাধুজি, তুমি সত্যি সত্যি আমার কথা শুনেছো। এ জীবনে আমি আর কোনও কিছু চাইব না।
সাধু মহারাজ ধীরে ধীরে তাঁর প্রিয় মূর্তিটি মীরার হাতে সমর্পণ করলেন। তারপর বললেন—এ আমার বড়ো প্রিয় মূর্তি, মীরা। আমি জানি তুমি একে আদরে যত্নে রাখবে। তবু কি জানো, বয়স তো হয়েছে, মন যে মানতে চায় না।
মীরার মুখে তখন ফুটে উঠেছে স্বর্গীয় হাসি। নিজেকে তিনি পৃথিবীর সম্রাজ্ঞী বলে ভাবছেন। হায়, কত বড়ো বংশের কন্যাসন্তান তিনি। রাশি রাশি অর্থ আছে তাঁদের কোষাগারে। ধন—দৌলতের কোনও অভাব নেই। অলঙ্কার আছে অনেক। তবু মীরা কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে মোটেই ভাবনা চিন্তা করতে ভালোবাসেন না। তাঁর মন—প্রাণ সব কিছু শুধুমাত্র গিরিধারীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। সেই গিরিধারীকে তিনি হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়েছেন। তাঁর আনন্দ আকাশ ছুঁয়েছে বুঝি।
মীরা দু’হাতে গোপালকে ধরে রাখেন। অনেকক্ষণ তাঁর মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকেন। বুঝতে পারেন সাধু মহারাজ, যে মূর্তি ছিল পাষাণ প্রতিমা, এখন সেখানে জীবনের স্পন্দন দেখা দিয়েছে। ওই তো, তিনি স্পষ্ট লক্ষ্য করলেন, গোপালের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেছে দুষ্টু হাসি। এভাবেই তো গোপাল তাঁর সমস্ত বালক—জীবন ধরে দুষ্টুমি করে এসেছে।
মীরা আনন্দ পেলেন। সাধু মহারাজকে মনে মনে অনেক ধন্যবাদ জানালেন তিনি।
এই ঘটনার কিছুদিন বাদে মর্মাহত সাধু মহারাজ প্রাসাদ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।
তিন
শুরু হল মীরার নতুন খেলা। এতদিন চোখের সামনে কোনও অবয়ব ছিল না। বিমূর্ত শক্তিকে আমরা কি কল্পনা করতে পারি? তাইতো, হিন্দুশাস্ত্রে প্রতিমা পুজোর আয়োজন। এখন গিরিধারীকে কাছে পেয়েছেন মীরা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলছে তাঁর সাথে অবুঝ খেলা। কখনও তিনি গিরিধারীকে মাঝে বসিয়ে রেখে তাঁকে প্রদক্ষিণ করেন। কখনও গিরিধারীকে মাথায় রেখে নাচেন। কখনও বা বুকে জড়িয়ে ধরে ছুটে বেড়ান। গিরিধারীর মুখের দিকে তাকিয়ে কত না কথা বলেন। এইসব শব্দমালার মধ্যে তাঁর বালিকা মনের না বলা অনুভূতিগুলি প্রস্ফুটিত গোলাপ হয়ে ওঠে। তাঁর কত ব্যথা, আশা—নিরাশা, বেদনা—উল্লাস, সব বুঝি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
চানঘরে গিয়ে আগে গিরিধারীকে চান করান। তারপর নিজে অবগাহন করেন।
খাওয়ার সময় হলে আগে গিরিধারীকে খাওয়ান তারপর নিজে খান। এইভাবেই গিরিধারীর সাথে তাঁর আত্মীয়তা ক্রমশ বেড়ে চলে। আশেপাশে যারা থাকে, তারা অবাক হয়ে তাঁর ওই পূজার্চনার পদ্ধতির দিকে তাকিয়ে থাকে। মীরাবাঈ কিন্তু তথাকথিত মন্ত্রমালা শেখেননি। তাঁর পুজোর মধ্যে আনুষ্ঠানিকতা নেই। তিনি মনে করেন গিরিধারী বুঝি তাঁর আত্মার আত্মীয়, প্রাণের বন্ধু। তাঁর পরিবারের একজন। তিনি নিজে যা খান, তারই একটা অংশ গিরিধারীর মুখে তুলে দেন। তাঁর বিশ্বাস, গিরিধারী নিশ্চয়ই তাঁর দেওয়া এই খাবার খাচ্ছেন।
মায়ের ডাকে সাড়া দেন না, বাবার সামনে সহসা আসেন না। আপন মনে খেলা করেন। মাঝরাত্তিরে দেয়ালা করেন ঈশ্বরের সাথে। এই পৃথিবীতে গোপাল ছাড়া তাঁর বুঝি আর কেউ নেই। গোপাল তাঁর শয়নে অবস্থান করেন, তাঁর স্বপন এবং নিশিজাগরণে শুধু গোপালের উপস্থিতি।
যখন বিকেলের অস্তরাগ পৃথিবীকে নববধূর আলিঙ্গনে রাঙিয়ে দিয়ে যায়, যখন পাখির দল নীড়ে ফেরে, তখন সহেলিরা আসে তাঁকে খেলার অঙ্গনে নিয়ে যাবার জন্য। আগে মাঝে মধ্যে তাদের ডাকে সাড়া দিতেন মীরাবাঈ। কিন্তু এখন তিনি একেবারে অন্যরকম হয়ে গেছেন বুঝি। তাঁকে দেখে মনে হয়, তিনি বুঝি এই পৃথিবীর বাসিন্দা নন। রাজস্থানের কুড়কী গ্রামে তাঁর শরীরটা আছে বটে, কিন্তু মন চলে গেছে সুদূরে কোথায়? সেই বৈকুণ্ঠধামে কি? যেখানে স্বয়ং বিষ্ণুর অবস্থান?
সঙ্গীনীরা অবাক হয়ে মীরার ধ্যানমগ্না মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এ কি? চোখ দুটি বন্ধ, অথচ ঠোঁট নড়ছে কেন? মীরা কি শেষ পর্যন্ত পাগলিনী উন্মাদিনী হয়ে যাবেন?
কখনও মীরা সোজাসুজি তাঁর মনের বাসনার কথা জানিয়ে দেন। বলেন, না, এসব খেলা খেলতে আমার আর ভালো লাগে না। তোরা বরং যা, সময় বয়ে যাচ্ছে, এক্ষুনি সন্ধ্যার আঁধার ঝুপ করে নেমে আসবে।
ইদানিং আর ঘর থেকে বেরোতে চান না মীরা। একটি ঘরের মধ্যে নিজেকে স্বেচ্ছাবন্দিনী রেখেছেন। সেখানে আছে তাঁর গিরিধারী। তাঁর প্রিয়তম সাথী।
এই সময় মীরার জীবনে এক অঘটন ঘটে গেল। হঠাৎ তাঁর মায়ের মৃত্যু হল। কিন্তু এই ঘটনাও তাঁকে শোকাচ্ছন্না করতে পারেনি। আসলে তিনি তখন একেবারে অন্য জগতের বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিলেন। এই পৃথিবীর শোক অথবা সুখ, বেদনা অথবা উল্লাস, কোনও কিছুই তাঁর মনে দাগ কাটতে পারে না।
তখন মীরার বাইরের জীবনে এক স্মরণযোগ্য পরিবর্তন ঘটে যায়। মায়ের মৃত্যুর পর এগিয়ে এলেন পিতামহ দুদাজি। তিনি এই নাতনিকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন। লোকমুখে শুনেছিলেন এর অদ্ভুত স্বভাবের কথা। এই জন্যই বোধহয় মীরা তাঁর হৃদয়ের অনেকখানি দখল করেছিলেন। দুদাজি প্রিয় নাতনিকে নিজের কাছে নিয়ে গেলেন। মীরা এলেন কুড়কী থেকে মেড়তায়। পিতামহের কাছে পরম যত্নে পালিত হতে থাকলেন। দুদাজি ছিলেন পরম বৈষ্ণব। রোজ সকালে উঠে শাস্ত্রানুসারে শ্রীকৃষ্ণের অর্চনা করতেন। সাংসারিক জীবনযাপনে তাঁর খুব একটা আগ্রহ ছিল না। যদিও তাঁর ওপর অনেক দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল, কিন্তু তাঁকে দেখে মনে হতো তিনি বোধহয় এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে খুব একটা ভালোবাসেন না। সাধারণত জমিদাররা যে প্রকৃতির হয়ে থাকেন, দুদাজি ছিলেন একেবারে অন্যরকম। তাঁর আচার—আচরণের মধ্যে এক নিস্পৃহ ভাব ফুটে উঠত, তা দেখে সঙ্গী—সাথীরা পর্যন্ত অবাক হয়ে যেতেন।
মানুষের জীবনের সমস্ত ঘটনা বোধহয় আগে থেকে স্থির হয়ে থাকে। মনে হয় জীবনটা হল এমন একটা নাটক, যার সংলাপ আগেই লেখা হয়ে গেছে। না হলে মীরাবাঈয়ের জীবনে একটির পর একটি ঘটনা এমনভাবে ঘটবে কেন? আর কেনই বা ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হবে তাঁর অধ্যাত্ম চেতনার বাতায়ন? সেই জানালা পথে প্রবেশ করবে বৈষ্ণবরসের বাতাস?
পিতামহের কাছে এসে প্রাণের আরাম খুঁজে পেলেন বালিকা মীরা। এখানে সবসময় কৃষ্ণের নামগান কীর্তন করা হয়। সকাল—সন্ধ্যা কীর্তনের আসর বসে। মীরা নিয়ম করে এইসব আসরে যোগ দেন। এক—একটি পদের অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন করার চেষ্টা করেন। তিনি বুঝতে পারেন, কৃষ্ণকে নিয়ে মানুষের চিন্তাভাবনার কোনও শেষ নেই। আর কৃষ্ণ হচ্ছেন স্থল—জল—অন্তরীক্ষের অধিকর্তা। দাদু তাঁকে খুবই ভালোবাসতেন। কথায় কথায় মহাভারতের অনেক গল্প শোনাতেন তাঁর প্রিয় নাতনিকে। এসব গল্প শুনে মীরাবাঈ কেমন যেন হয়ে যেতেন। বিশেষ করে দাদু যখন বলতেন যে, কৃষ্ণ হলেন মহাভারতের প্রধান চরিত্র, ধর্মসংস্থাপনার কারণে তিনি জগতে এসেছিলেন, তখন মীরার মন আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। সত্যিই তো, তাঁর গিরিধারী কি যে সে দেবতা নাকি? ইচ্ছে হলে তিনি যে কোনও মানুষকে অনন্ত জীবন দান করতে পারেন। আবার কারোর ওপর রাগ হলে তাকে অভিশাপও দিতে পারেন। কই, আমার খেলার পুতুল ওই গিরিধারী তো আমায় কখনও বকেন না? আসলে তাঁর সঙ্গে তো আমার জন্ম—জন্মান্তরের ভাব— ভালোবাসার সম্পর্ক।
দেখতে দেখতে দিন কাটে, মীরার বালিকা বয়স শেষ হবার দিকে এগিয়ে চলেছে। মীরাকে এখন কিশোরী কন্যা হতে হবে। প্রবেশ করতে হবে জীবনের সব থেকে রোমাঞ্চিত মুহূর্তে। কিন্তু হায়, তখনও তাঁর হৃদ—আকাশে এমন কোনও নক্ষত্রের উদয় হয়নি, যাকে আমরা রহস্যে রোমাঞ্চে ঢাকা বলতে পারি। বরং গিরিধারীর প্রতি আকর্ষণ আরও বেড়ে যায়। এখন আর অন্য কারও সান্নিধ্য সহ্য করতে পারেন না তিনি। কিন্তু ভালো লাগে গদাধর পণ্ডিতকে। তিনি হলেন কুলপুরোহিত। তাঁর চেহারার মধ্যে এমন একটা পবিত্রতা আছে, যা দেখে ভালো লাগে মীরার। মনে হয়, তিনি যেন সূর্যস্নাত ব্রাহ্মণ। রোজ নিয়ম করে এই প্রাসাদে আসেন। বেশ কিছুটা সময় কাটান মীরাবাঈয়ের সঙ্গে।
গদাধর পণ্ডিত এক আশ্চর্য ব্যক্তি। বিভিন্ন শাস্ত্রে তাঁর অগাধ ব্যুৎপত্তি। মীরাকে দেখে তিনি বুঝতে পারেন যে, এই মেয়েটির মধ্যে এক ঐশী শক্তি লুকিয়ে আছে। তাঁকে আমরা চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দিনী রাখতে পারব না। তিনি হলেন দূর আকাশের পাখি। কখন শিকল কেটে আকাশে উড়ে যাবেন কে জানে।
গদাধর পুরাণের নানা গল্পকথা জানেন। পুরাণ হল ভারতের সব থেকে বৈচিত্র্যময় অধ্যাত্ম সাহিত্য। বিভিন্ন লেখক এবং পণ্ডিতদের বিনিদ্র পরিশ্রমে আঠারো খণ্ডের এই বিশাল কাহিনিমালা রচিত হয়েছে। এক—একটি পুরাণ গল্পে দার্শনিক অভিজ্ঞান লুকিয়ে আছে। যেহেতু এই গল্পগুলি সাধারণ মানুষের জন্য লেখা, তাই এখানে ভাষার মধ্যে কোনও জটিলতা আনা হয়নি। সহজ সরল বাক্যের সাহায্যে লেখকরা এক—একটি গল্পকে পাঠক—পাঠিকার সামনে তুলে ধরেছেন। মন দিয়ে পুরাণ পাঠ করলে আমরা জীবনের অনেক অমীমাংসিত রহস্য সমাধান করতে পারব।
শুধু তাই নয়, এইসব গল্পের মধ্যে যে দার্শনিক সত্য লুকিয়ে আছে, সেগুলি অনুধাবন করলে জীবনপথ পরিষ্কার হয়ে যাবে। মন—আকাশে হাজার সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়বে।
মীরা এই মুহূর্তটির জন্য উদগ্রীব চিত্তে অপেক্ষায় থাকেন। কখন পণ্ডিতমশায় এসে পুঁথিখানি খুলে ধরবেন, অথবা মুখে মুখে গল্প বলবেন। কত গল্প, রাজা—রানি, ভগবান এবং মানুষের, মনুষ্যেতর প্রাণীর। এক—একটি পুরাণকথা বুঝি নতুন ভাবে মীরার মনকে প্রাণিত করে দেয়। মীরা তাঁর আরাধ্য দেবতার আরও কাছাকাছি পৌঁছে যান।
যেমন, একদিন গদাধর পণ্ডিত শোনালেন গরুড়ের কাহিনি। নাগ হল গরুড়ের প্রিয় খাদ্য। তাই নাগরা গরুড়ের নাম শুনলে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে।
অনন্তনাগের ছেলে মণিনাগ। সে ছিল বেশ শক্তিশালী।
গরুড়ের ভয়ে মহাদেবের তপস্যা শুরু করে দিল।
আমরা সবাই জানি মহাদেব অল্পে সন্তুষ্ট হন। তিনি বললেন—মহানাগ, বলো তুমি কী চাও?
মণিনাগ বলল—প্রভু, আমাকে সেই বর দিন, যাতে গরুড় আর আমাকে ভয় দেখাতে না পারে। আমরা নাগজাতি সকলে গরুড়ের ভয়ে দিন কাটাই। এমন করে বাঁচতে ভালো লাগে না।
মহাদেব বললেন—তথাস্তু, আমি তোমাকে সেই বর দিলাম।
মণিনাগ সঙ্গে সঙ্গে মহাদেবকে প্রণাম করল। মণিনাগ বুঝতে পারল তার অনেক দিনের সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে। এবার সে এল গরুড়ের কাছে। তার সামনে এসে ঘুরে বেড়াতে লাগল।
গরুড় তার এহেন আচরণ দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গেল। সে বুঝতে পারেনি যে, এখন আর মণিনাগকে ভয় দেখানো যাবে না, কারণ তার মাথার ওপর স্বয়ং মহাদেবের আশীর্বাদ আছে। সে মণিনাগকে একটা ঘরের ভেতর আটকে রাখল।
গল্প এগিয়ে চলেছে, মীরাবাঈয়ের চোখ দুটি বড়ো বড়ো হয়ে গেছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে তাঁর। তিনি বললেন—পণ্ডিত, কী হবে মণিনাগের? গরুড় কি তাকে মেরে ফেলবে? নাকি মহাদেব তাকে বাঁচিয়ে দেবে?
কথা বলতে বলতে গদাধর স্নেহপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন মীরার দিকে। আহা, মা মরা মেয়েটি, চোখেমুখে শৈশবী সারল্য লেগে আছে। এই পৃথিবীতে কিছু মেয়ের বয়স কোনওদিন বাড়ে না। জীবনের শেষ লগ্নে পৌঁছোনো সত্ত্বেও তারা বুঝি শৈশবী উপত্যকার বাসিন্দাই হয়ে থাকে। গদাধর পণ্ডিতের মনে হয়, মীরাবাঈ হলেন সেই দলের।
পণ্ডিত বললেন—শোনো না গল্পটা। এখন এত কথা বললে গল্প এগোবে কি করে?
মীরাবাঈ চুপ করে যান। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন পণ্ডিতের মুখের দিকে।
পণ্ডিত আপন মনে বলতে থাকেন—মণিনাগকে ফিরতে না দেখে নন্দী নামে মহাদেবের এক অনুচর মহাদেবের কাছে পৌঁছে গেল। সে বলল—প্রভু, মণিনাগ যে গেল, আর তো ফিরে এল না? তার কি কোনও বিপদ হয়েছে? হয় গরুড় তাকে বেঁধে রেখেছে কিংবা খেয়ে ফেলেছে।
এই কথা শুনে মহাদেব খুবই দুঃখিত হলেন। তিনি আপন ভোলা দেবতা, সমস্ত ভক্তকে বড়ো ভালোবাসেন। ভক্তের বিপদ দেখলে সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ছুটে যান। তিনি এবার ধ্যানে বসলেন। ধ্যান মারফত সব কিছু বুঝতে পারলেন। এখন কী উপায়? এখন বিষ্ণুকে সন্তুষ্ট করতে হবে। কারণ গরুড় হল বিষ্ণুর বাহন। বিষ্ণুকে সন্তুষ্ট না করলে মণিনাগকে ফিরে পাওয়া যাবে না।
মহাদেবের নির্দেশে নন্দী গেল বিষ্ণুর কাছে। একমনে সে বিষ্ণুর স্তব করল। তারপর মহাদেবের কথা জানাল।
নারায়ণ নন্দীর স্তবে খুবই খুশি হয়েছিলেন। তিনি তাঁর বাহন গরুড়কে বললেন, শোনো, তুমি মণিনাগকে এখুনি ছেড়ে দাও। তুমি কি জানো না মণিনাগের ওপর মহাদেবের আশীর্বাদ আছে।
গরুড় কিন্তু তার প্রভুর নির্দেশ মানতে চাইছে না। সে জানে, একবার ছাড়া পেলে মণিনাগ সাংঘাতিক কাণ্ড করবে। সে বলল, নাগ আমার আহার্য দ্রব্য। কত কষ্ট করে তাকে আমি বেঁধে রেখেছি। আর আপনি কিনা বলছেন তাকে ছেড়ে দিতে হবে। আপনি আমার প্রভু, আপনার উচিত আমার হাতে উত্তম আহার্য তুলে দেওয়া। আপনি তা দিচ্ছেন না। আমি ভালো আহার সংগ্রহ করেছি, আর আপনি সেখানে এসে বাধ সাধছেন। আমার পিঠে চড়ে আমার শক্তিতেই তো আপনি শত্রুদের পরাস্ত করেন। সে কথাটা কি আপনি একেবারে ভুলে গেছেন?
গরুড়ের এহেন কথা শুনে নারায়ণ মনে মনে ব্যথিত হলেন। বুকের ব্যথা মুখের কথায় প্রকাশ করলেন না। তিনি বললেন—শোনো, তুমি আমার বাহন, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তোমার শক্তিতেও আমি শত্রুদের জয় করে থাকি। তোমার এসব কথার কোনও প্রতিবাদ আমি করছি না। গরুড়, তুমি তো মহাশক্তিশালী, আমার এই কড়ে আঙুলটা আমি কি একবার তোমার মাথার ওপর রাখতে পারি?
এই পর্যন্ত বলে গদাধর পণ্ডিত একটু চুপ করলেন। আর মীরা বড়ো বড়ো চোখে প্রশ্ন করলেন—বলুন পণ্ডিতমশায়, তারপর কী হল?
পণ্ডিত হেসে ফেললেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে এখন মীরাবাঈয়ের মনে নানা প্রশ্ন এসেছে।
পণ্ডিত বললেন—নারায়ণ তাঁর কড়ে আঙুলটা গরুড়ের মাথার ওপর রাখলেন। ওই আঙুলের ভারে গরুড় যেন নুইয়ে পড়ল। দেখতে দেখতে তার মাথা কাঁধের মধ্যে ঢুকে গেল।
এই কথা শুনে মীরা বুঝি ভয় পেলেন। লাফিয়ে উঠলেন তিনি। কম্পিত কণ্ঠে কোনওরকমে বললেন—বলুন পণ্ডিত, তারপর কী হল।
পণ্ডিত বললেন—আর কী হবে? মাথাটা ক্রমশ কাঁধের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। মাথার ভারে কাঁধ চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে।
বেচারি গরুড় তখন বুঝতে পারল, তার পক্ষে এমন আচরণ করা উচিত হয়নি। সে কিনা স্থল—জল—অন্তরীক্ষের দেবতার সাথে এমন ব্যবহার করেছে? সে একমনে বিষ্ণুর বন্দনা করতে লাগল। বলতে লাগল—হে প্রভু, হে নারায়ণ, আমি আপনার শরণাগত ভৃত্য। না বুঝে আপনাকে অনেক ছোটো বড়ো কথা বলে ফেলেছি। আমার অপরাধ আপনি ক্ষমা করুন। এখন আমি বুঝতে পারছি আপনি সকলের সেরা। আপনি তো জানেন, ভৃত্য অপরাধ করলেও প্রভু তাকে ক্ষমা করে দেন।
গরুড়ের এহেন দুর্দশা দেখে লক্ষ্মী আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি নারায়ণকে অনুরোধ জানালেন। বললেন—নারায়ণ, তুমি তো মানুষের রক্ষাকর্তা। আর তোমার বাহন কিনা এখন হাহাকার করছে? তোমার কানে কি তার আর্তনাদ পৌঁছোচ্ছে না?
তখন নারায়ণ নন্দীকে বললেন—তুমি গরুড়ের সঙ্গে মণিনাগকে নিয়ে যাও শিবের কাছে। যদি শিব দয়া করে তাহলেই গরুড় তার আগেকার শরীর ফিরে পাবে।
নারায়ণকে প্রণাম জানিয়ে গরুড়কে সঙ্গে নিয়ে নন্দী ফিরে এল শিবের কাছে। সঙ্গে গেল মণিনাগ। শিবের কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বলল।
শিব সব কিছু শুনে গরুড়কে আদেশ দিলেন—হে গরুড়, তুমি এখনই গিয়ে গৌতমী গঙ্গায় স্নান করে এসো। তাহলেই তুমি তোমার আগের শরীর ফিরে পাবে।
শিবের আদেশমতো গরুড় গেল গৌতমী গঙ্গায় স্নান করতে।
স্নান করার পর সে একেবারে অবাক হয়ে গেল। আর তখনই শিবের করুণার পরিচয় পেল। আগের মতো বলসম্পন্ন হয়ে উঠল তার দেহ।
এই হল পুরাণের একটি গল্প।
এতক্ষণ ধরে একনাগাড়ে গল্প বলছিলেন গদাধর পণ্ডিত। এবার থামলেন। মীরার মনে অনেক ঔৎসুক্য জেগেছে। তিনি বললেন—পণ্ডিতমশায়, থামলেন কেন? আর একটা গল্প বলুন।
একটু হেসে পণ্ডিত বললেন—পাগলি মেয়ে, এক জায়গায় বসে তোমায় গল্প শোনালেই হবে? আমার কত যজমান। কত জায়গায় যেতে হয় পুজো করতে। কথা দিচ্ছি, কাল তোমাকে পুরাণের আর একটা ভারি সুন্দর গল্প শোনাব। আজ সারাদিন তুমি তোমার গিরিধারীকে নিয়ে খেলা করো। আমি এখন আসছি কেমন?
মীরাবাঈ বসে থাকেন পরের দিনের জন্য। কী গল্প শোনাবেন তাঁকে গদাধর পণ্ডিত? সেই গল্পের মধ্যে কতটা শিহরণ থাকবে? কতটা উত্তেজনা? কোন দেবতার কথা বলবেন পণ্ডিত? এসব ভাবতে ভাবতে সারারাত তাঁর চোখের তারায় ঘুম নামে না।
পরদিন সকালে যথাসময়ে গদাধর পণ্ডিত এসে হাজির হন। মীরার অনুরোধে তিনি শুরু করেন আর একটি গল্প বলা।
গদাধর পণ্ডিত বললেন—আজ তোমাকে ব্রহ্মপুরাণের গৌতম আর মণিকুন্তলের কথা বলব।
গৌতম ছিলেন কৌশিক নামে এক ব্রাহ্মণের সন্তান। কৌশিক বাস করতেন গৌতমী গঙ্গার দক্ষিণ পাড়ে। বন রাজার রাজ্যে।
গৌতম ছিলেন বিভিন্ন শাস্ত্রে সুপণ্ডিত। কিন্তু তাঁর স্বভাব মোটেই ভালো ছিল না। তাঁর এক ধনী বন্ধু ছিলেন। তাঁর নাম মণিকুন্তল। দু’জনের মধ্যে ভারি ভাব—ভালোবাসা।
একদিন গৌতম মণিকুন্তলকে বললেন—চলো, আমরা বিদেশে গিয়ে ব্যবসা করি, তাহলে অনেক টাকা আয় করতে পারব।
মণিকুন্তল বললেন—আমার আর বেশি টাকার দরকার কি? আমার বাবা অনেক টাকা রেখে গেছেন। তাতেই আমার চলে যাবে।
কিন্তু গৌতমের মন তখন লোভে পরিপূর্ণ হয়েছে। তিনি নানাভাবে মণিকুন্তলকে বোঝাতে লাগলেন। তিনি বললেন—টাকা কি এক জায়গায় জমিয়ে রাখতে হয়? জমানো টাকা খরচ করলে একদিন তা শেষ হয়ে যাবে। আজ যে টাকাটা আছে, সেটা ব্যবসায় ঢালো। তাহলে আরও বেশি টাকা পাবে। বাকি জীবনটা পায়ের ওপর পা রেখে সুখে—শান্তিতে কাটাতে পারবে।
মীরাবাঈ অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন গদাধর পণ্ডিতের মুখের দিকে। গল্পের প্রতিটি শব্দ বুঝি ভালো লাগছে তাঁর। এভাবেই গল্পের মাধ্যমে তার জীবনে নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হতে থাকে।
মণিকুন্তল ছিলেন খুবই সরল। শেষ পর্যন্ত তিনি গৌতমের কথায় রাজি হয়ে গেলেন। একদিন মণিকুন্তল গৌতমের হাতে তাঁর সমস্ত ধন সম্পদ তুলে দিলেন। আর বললেন—বন্ধু, তাহলে আর দেরি করা কেন? চলো, আজই আমরা বিদেশ যাত্রা করি। মা—বাবার কাছ থেকে অনুমতি না নিয়ে দুই বন্ধু চললেন বিদেশে। পথে যেতে যেতে তাঁরা নানা বিষয়ে শলা—পরামর্শ করতে থাকেন। বিদেশে গিয়ে কি নিয়ে ব্যবসা করা যেতে পারে, সে ব্যাপারে গৌতম অনেক কথা বললেন।
কিন্তু কুচক্রী গৌতমের মনে তখন শুধু একটি কুবুদ্ধি খেলা করছে—কীভাবে মণিকুন্তলের কাছ থেকে টাকা আদায় করা যায়। বেচারি মণিকুন্তল, তিনি কিন্তু বন্ধুকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেছেন।
একদিন গৌতম মণিকুন্তলকে বললেন, বন্ধু, অনেক ভেবে দেখলাম, এই পৃথিবীতে ধার্মিক আর সৎ লোকেরাই দুঃখ—কষ্ট ভোগ করে। অসৎ লোকেরা আনন্দে দিন কাটায়। তাই আমার মনে হয়েছে, ধর্মপথে থেকে কোনও লাভ নেই। ধার্মিক মণিকুন্তল কিন্তু বন্ধুর এই কথা মানতে পারলেন না। সারা জীবন ধরে তিনি সৎপথে থাকার চেষ্টা করেছেন। কোনও জিনিসের প্রতি অহেতুক লোভ করেননি। তিনি বন্ধুর কথা শুনবেন কেন?
তাই তিনি বললেন—ছিঃ বন্ধু, একথা কি বলতে আছে? ধর্ম ছেড়ে কখনও আমি অধর্মে যেতে পারব না। যেখানে ধর্ম, সেখানেই সুখ। পাপের পথ বড়ো পিচ্ছিল। মানুষ হঠাৎ লোভে পড়ে পাপ কাজ করে। শেষ পর্যন্ত তাকে নরকে পচে মরতে হয়। এই কথা শুনে গৌতম হো হো করে হেসে ফেললেন। বেশ বোঝা গেল, এসব কথা তিনি বিশ্বাস করেন না। তখন দুই বন্ধুর মধ্যে জোর তর্ক লেগে গেল। কিছুতেই তর্কের মীমাংসা হল না।
শেষ পর্যন্ত তাঁরা ঠিক করলেন, পথচলতি লোকের কাছে এই প্রশ্নটা করবেন। ধর্ম বড়ো, না অধর্ম বড়ো—তা জানতে হবে।
রাস্তায় চলতে চলতে গৌতম একজনকে দেখে বললেন—আচ্ছা ভাই, আমাদের মধ্যে একটা বিষয় নিয়ে দারুণ তর্কাতর্কি হচ্ছে।
লোকটি বলল—কী বিষয়, পরিষ্কার করে বলো তো?
গৌতম বললেন—ধর্ম আর অধর্মের মধ্যে কার শক্তি বেশি, তা কি তুমি বলতে পারবে?
লোকটি বলল—চারপাশে যা দেখছি, অধর্মই শেষ পর্যন্ত জিতে যাচ্ছে। অসৎ লোকেরাই সুখে—শান্তিতে থাকে। যারা সৎপথে চলে তারা অশেষ দুঃখ ভোগ করে। এটা হল আমার অভিজ্ঞতা।
এরকম কথা অনেকেই বলেছিল। দেখা গেল, বেশির ভাগ মানুষ গৌতমের মতকেই সমর্থন করছে। গৌতম আগেই একটি শর্ত দিয়েছিলেন মণিকুন্তলের কাছে। তিনি বলেছিলেন—দেখো ভাই, যদি বেশির ভাগ লোক অধর্মের কথা বলে, আর অধর্মকেই মহান বলে মনে করে, তা হলে আমি তোমার সব টাকা নিয়ে নেব। আর যদি তোমার মতে বেশির ভাগ লোক যোগ দেয়, তাহলে আমার সব টাকার ভাগ পাবে তুমি।
শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, মণিকুন্তলের কথা কেউ মানছে না। পৃথিবীতে এমন একজন মানুষকেও পাওয়া গেল না যে, জোর গলায় ধর্মের পক্ষে সওয়াল করবে।
বাধ্য হয়ে মণিকুন্তল তাঁর সমস্ত অর্থ গৌতমের হাতে তুলে দিলেন।
এত দুঃখ—কষ্টের মধ্যেও মণিকুন্তল কিন্তু ধর্মের কথা ভুলতে পারলেন না।
তখনও তিনি বারবার ধর্মের জয়গান গাইতে লাগলেন। তাই দেখে একদিন কৌতুক করে গৌতম বললেন—আচ্ছা বন্ধু, তোমার মাথায় কি বুদ্ধিসুদ্ধি বলে কিছু নেই? দেখো, ধর্মপথে থেকে তুমি আজ নিঃস্ব—রিক্ত হয়েছো। তবুও ধর্ম—ধর্ম করছো। কিন্তু মণিকুন্তল তখনও নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল, বন্ধুর কথা কানেও নিলেন না। তিনি আগের মতো ধর্মের প্রশংসা করতে লাগলেন।
কুটিল গৌতম এবার আর একটি চাল চাললেন। তিনি বললেন—বেশ, চলো, এবার দুটো হাত পণ রাখি। যার হার হবে, তার দুটো হাত কাটা যাবে। কি বন্ধু, আমার কথায় রাজি তো?
অন্য কেউ হলে এই মারাত্মক শর্তে কখনও রাজি হতো না। শেষ পর্যন্ত মণিকুন্তল প্রমাণ করেই ছাড়বেন যে, এই পৃথিবীতে শেষ পর্যন্ত ধর্মের জয় হয়। তাই ভয়ঙ্কর সম্ভাবনার কথায় ভুলে গিয়ে তিনি বললেন—ঠিক আছে, তাই হবে বন্ধু।
তারপর আবার পথচলতি মানুষের কাছে গৌতমের প্রশ্নটা রাখা হল। বেশির ভাগ মানুষই গৌতমের মতকে সমর্থন করল। শেষ অব্দি এই লড়াইতেও গৌতম জিতে গেলেন।
শর্ত মতো তিনি মণিকুন্তলের হাত দুটি কেটে নিলেন। তারপর বললেন—কি বলবে বলো? এখনও ধর্মের জয়গান গাইবে? শেষ পর্যন্ত আমার মতো অধর্মকেই বড়ো করবে কি?
মণিকুন্তল হাসতে হাতে বললেন—প্রাণ গেলেও আমি ধর্মকে ছোটো করতে পারব না। ধর্মের জয়গান আমি সব সময় গাইব।
দুই বন্ধু বেড়াতে বেড়াতে গঙ্গার ধারে একটি মন্দিরে এলেন।
মণিকুন্তলের মুখে তখনও পর্যন্ত ধর্মের কথা শুনে গৌতম বিদ্রূপের সুরে বললেন—ধর্ম—ধর্ম করে তোমার দুটো হাত কাটা গেছে। এখন আছে শুধু প্রাণটুকু। যদি এখনও আমার মতে সায় না দাও, তাহলে এই তলোয়ার দিয়ে তোমার মাথাটা কেটে ফেলব।
মণিকুন্তল হেসে বললেন—বন্ধু, তোমার হাতে তরবারি আছে, তুমি যা খুশি তাই করতে পারো। তবু কখনও আমি অধর্মের সওয়াল করব না। যে পাপিষ্ঠ ধর্মের নিন্দা করে তাকে স্পর্শ করলেও পাপ হয়।
গৌতম বন্ধুর এই কথা শুনে খুব রেগে গেলেন। তিনি গর্জন করে বললেন— তবে, এবারে এসো, আবার লোকের মতামত নেওয়া হবে। যে হারবে, তাকে প্রাণ দিতে হবে।
মণিকুন্তল এই শর্তে রাজি হলেন। আবার পথচলতি মানুষের কাছে সেই প্রশ্নটা করা হল। এবারও আগের মতো ঘটনা ঘটল। বেশির ভাগ মানুষ জোর গলায় বলল, এখনকার পৃথিবীতে ধর্মের কোনও স্থান নেই। অধার্মিক লোকেরাই জীবনযুদ্ধে জিতে যাচ্ছে।
এবার গৌতম বুঝতে পারলেন তাঁর স্বার্থসিদ্ধি হতে চলেছে। তিনি মণিকুন্তলকে মাটিতে শুইয়ে দিলেন। তলোয়ারের খোঁচা মেরে তাঁর চোখ দুটো উপড়ে নিলেন। তারপর বললেন—বন্ধু, তুমি ধর্মের প্রশংসা করে দুটি হাত খুইয়েছো। চোখ দুটি হারিয়েছো। আর একথা বলো না। আমি এখানে তোমাকে এ অবস্থায় রেখে চলে যাচ্ছি। দেখি, কোন ধর্ম তোমাকে বাঁচায়।
মন্দিরের সামনে এসে অসহায় মণিকুন্তল ঈশ্বরের নাম করতে লাগলেন। বারবার বললেন, হে ভগবান, ধর্মের জন্য আমার এমন দুর্দশা হল কেন?
দিন কাটে, সন্ধ্যা আসে, রাতের অবসান হয়। দেখতে দেখতে এল শুক্লপক্ষের একাদশীর সন্ধ্যা।
সেদিন ধার্মিক রাক্ষসরাজ বিভীষণ এসেছেন হরিমন্দিরে পুজো দিতে। তাঁর সঙ্গে পুত্র বৈভীষণীও আছেন।
পুজোর পর বৈভীষণী মণিকুন্তলকে দেখতে পেলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করে পুরো ঘটনা জানতে পারলেন। তারপর পিতার কাছে এসে সব কথা বললেন।
পিতা বিভীষণ বললেন—বাবা, অতীতে যখন লক্ষ্মণ শক্তিশেলে আহত হয়ে সংজ্ঞা হারিয়েছিলেন তখন হনুমান তাঁকে সুস্থ করার জন্য গন্ধমাদন নামে একটি পাহাড়কে তুলে এনেছিল। সেই পাহাড়ে ছিল বিশল্যকরণী আর মৃতসঞ্জীবনী নামে দুটি মহৌষধ। এই ওষুধের গুণে লক্ষ্মণের মূর্চ্ছা ভেঙে যায়। লক্ষ্মণ আবার জীবিত হয়ে ওঠেন। হনুমান যখন ওই পর্বত নিয়ে ফিরে যাচ্ছিল তখন মন্দিরের কাছে ওই ওষুধের ডাল ভেঙে পড়েছিল। ওই দেখো, সেই ডাল থেকে কত বড়ো গাছ হয়েছে। ওই গাছের ডাল ভেঙে আনো, আর সেটা বণিকের শরীরে ছুঁইয়ে দাও। তাহলে ও আবার সুস্থ হয়ে উঠবে।
পুত্র পিতার কথা মতো সব কাজ করলেন। মণিকুন্তল আগের মতো সুস্থ জীবনে ফিরে এলেন।
তারপর এই গাছের একটি ডাল ভেঙে নিয়ে মণিকুন্তল পথে বেরিয়ে পড়লেন। ঘুরতে ঘুরতে তিনি এসে দাঁড়ালেন মহাপুর রাজ্যে। ওই রাজ্যের রাজার কোনও পুত্র সন্তান ছিল না। ছিল একটি মাত্র মেয়ে, সে সুন্দরী, কিন্তু চোখে দেখতে পায় না। তাই রাজার মনে কোনও সুখ নেই।
রাজা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যে তাঁর মেয়ের অন্ধত্ব ঘুচিয়ে দিতে পারবে, তার সাথেই মেয়ের বিয়ে দেবেন। যদি সে রাক্ষস হয়ে থাকে, তাহলেও তিনি কিছু মনে করবেন না। দেব—দানব—ব্রাহ্মণ—যে এই কাজ করতে পারবে তাকে তিনি জামাই হিসাবে বরণ করে নেবেন।
লোকমুখে এই কথা শুনে মণিকুন্তল রাজার কাছে পৌঁছে গেলেন। তিনি বললেন, আমি রাজকন্যার চোখ ভালো করে দেবো। এই কথা শুনে রাজা একেবারে অবাক হয়ে গেলেন। কত বদ্যি এসেছেন, কিন্তু কেউই রাজকন্যার চোখে দৃষ্টি ফেরাতে পারেনি। ভিনদেশী এই বণিক বলে কি? তবু তিনি মণিকুন্তলকে পাঠিয়ে দিলেন নিজের মেয়ের কাছে। সেখানে গিয়ে মণিকুন্তল গাছের ডাল রাজকন্যার গায়ে স্পর্শ করালেন।
সঙ্গে সঙ্গে একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেল। রাজকন্যা দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেন। তখন রাজার মনের আনন্দ বুঝি আকাশ ছুঁয়েছে।
প্রতিশ্রুতি মতো রাজা নিজের ওই কন্যার সঙ্গে মণিকুন্তলের বিয়ে দিলেন। সমস্ত রাজত্ব দান করলেন জামাইকে।
মণিকুন্তল আরামে সুখের মধ্যে দিয়ে দিন যাপন করতে লাগলেন। এত ভোগবিলাসের মধ্যে জীবন কাটানো সত্ত্বেও মণিকুন্তল কিন্তু তাঁর প্রিয় বন্ধু গৌতমকে ভুলতে পারেননি।
গৌতম কোথায় আছেন এবং কেমন আছেন, তা জানার জন্য মণিকুন্তলের প্রাণ ছটফট করতে লাগল।
একদিন গৌতম মণিকুন্তলের প্রাসাদে এসে হাজির হলেন। গৌতমের সে রূপ—যৌবন কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। শরীরে বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে। কথা বলতে গেলে কষ্ট হয়। মণিকুন্তলকে ঠকিয়ে যেসব টাকা আত্মসাৎ করেছিলেন সব জুয়ার আসরে উড়িয়ে দিয়েছেন। এখন রিক্ত—নিঃস্ব ভিখারি হয়ে এসেছেন মণিকুন্তলের কাছে যদি কিছু ভিক্ষা পাওয়া যায় সেই আশায়।
মণিকুন্তল গৌতম ব্রাহ্মণকে আদর—যত্ন করে বসালেন। তারপর গৌতম মণিকুন্তলের জীবনবৃত্তান্ত শুনে অনুশোচনা করতে লাগলেন। তখন তাঁর মনের পরিবর্তন হল। তিনি ছিলেন প্রবঞ্চক এবং শঠ। মানুষকে ঠকিয়ে অর্থ উপার্জন করতেন। গঙ্গায় স্নান করে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করলেন। আত্মীয়স্বজনও মণিকুন্তলের সঙ্গে ঈশ্বর আরাধনা করে দিন কাটাতে লাগলেন। এতক্ষণ ধরে গদাধর পণ্ডিত একমনে ব্রহ্মপুরাণের এই বিখ্যাত গল্পটি মীরাকে শোনাচ্ছিলেন। এবার গল্প বলার পালা শেষ হয়ে গেল। মীরা পণ্ডিতের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
বেশ বুঝতে পারা যাচ্ছে, তখন তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন আরও পুরাণ কথা শুনতে চাইছে। কিন্তু গদাধর পণ্ডিত তো একদিনে একটির বেশি গল্প বলেন না। তাই আগামীকাল আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি সেখান থেকে চলে গেলেন।
সে রাতে মীরার চোখের তারায় ঘুম আসেনি। শয্যায় শুয়ে ছটফট করতে করতে তিনি পুরাণের গল্পগুলির কথাই ভাবছিলেন। সত্যিই তো, শত প্রলোভনের মধ্যেও আমরা যেন মন ঠিক রাখতে পারি। তাহলে শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর আমাদের আশীর্বাদ করবেন। গল্পের সাথে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের যোগসূত্রতা আছে। গল্পের মধ্যে যা বলা হয়, তা শুধু বানানো কাহিনি নয়, মানুষের নিত্যদিনের জীবন থেকে এই গল্পগুলি সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া গল্পের মধ্যে যে অধ্যাত্ম চিন্তার উন্মেষ চোখে পড়ে, তার গুরুত্বও কম নয়।
এইভাবে দিন কাটে কিশোরী মীরার। একদিকে গদাধর পণ্ডিতের মুখে শাস্ত্রীয় গল্প শোনা, আর অন্যদিকে গিরিধারী গোপালের সেবা ও পরিচর্যা।
এইভাবে মীরা অনেক পুরাণ—কাহিনি শুনে নিলেন। শুনতে শুনতে অবাক বিস্ময়ে চোখ দুটি বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে থাকেন গদাধর পণ্ডিতের দিকে। আবার গল্পটি পছন্দ না হলে, সে কথাটিও সরাসরি জানিয়ে দেন মীরা। আসলে তাঁর মধ্যে কোনও কৃত্রিমতা নেই। তিনি যে কথা বলেন তা অন্তর থেকে ঘোষণা করেন।
মীরা এখন ত্রয়োদশী। তেরোটি বসন্ত অতিক্রান্ত হয়েছে তাঁর জীবনে। এই বয়সে তিনি হলেন অনন্যা রূপসী কন্যা। যে তাঁর দিকে একবার দৃকপাত করে, তার মন—সমুদ্রে তরঙ্গ ওঠে। এই মেয়েটিকে আরও কাছে পাবার জন্য সে বুঝি উন্মাদ হয়ে যায়। তাঁকে আর দোষ দিয়ে কী লাভ? কবি—সাহিত্যিকরা ত্রয়োদশী কন্যা মীরার রূপ—লাবণ্য বর্ণনা করতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন।
কবির ভাষায় বলা হয়েছে—
”অলকা সুষমা হেরি মুগ্ধ মন।
সুদীর্ঘ সুন্দর কুন্তলরাজি
চুম্বিত ভূতল অতুল শোভায়,
যেন র্স্বগাধিক সুরূপেসাজি
প্রফুল্ল রকত কমল জিনিয়া
কেমন কমল বসন তাঁর,
অমলা গঞ্জিয়া কেমন সুরূপ,
তাহা বর্ণিবার শকতি কার?
খগরাজ পেয়ে লাজদুখ চিত।
নিরিখি নাসিকা নির্মাণ তাঁর
এণগণ লাজে পলাইলা বনে
নিরখি নয়ন শোভার সার।
কিবা শোভা ধরে মুকতা নির্ঝরে,
যত সুষ্ঠু তাঁর দন্তের পাঁতি।
স্মরুক শোভার দম্ভ কর হারে,
আদরে যে মুক্তা গলেতে গাঁথি।
ওষ্ঠদ্বয় অতি সুডৌল সংযত,
রঞ্জিত ললিত লোহিত রাগে।
তাই বিম্ব ক্ষোভে অন্তরেতে কাল
বাহিরে কুলিয়া আরক্ত রাগে।”
এত রূপসী হলে কী হবে, সাংসারিক বিষয়ের প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ নেই মীরাবাঈয়ের। সবসময় তিনি তাঁর আরাধ্য মূর্তি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে ভালোবাসেন।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাঁর উন্মদাবস্থা বুঝি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে অন্তত অন্য কারোর সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতেন। এখন সদাসর্বদা ওই মূর্তির সামনে বসে থাকেন। গিরিধারীকে গান শোনান। তাঁর সঙ্গে মেতে ওঠেন অন্তরঙ্গ আলাপনে। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হতে পারে যে, তাঁর আচরণের মধ্যে বুঝি উন্মাদ অবস্থার ছায়া এসেছে, কিন্তু যাঁরা তাঁকে ছোটো থেকে চেনেন এবং জানেন, তাঁরা বুঝতে পারেন, মীরাবাঈ তখন আরও বেশি করে সাধনার দিকে এগিয়ে চলেছেন। এই মেয়েটিকে আমরা কি সাতপাকের বাঁধনে বেঁধে সংসারের মধ্যে প্রবেশ করাতে পারি?
আবার অনেকে ভাবে, মীরা বোধহয় একেবারে উন্মাদিনী হয়ে গেছেন। তখন থেকে মীরা নিয়মিতভাবে আধ্যাত্মিক সঙ্গীত রচনা করেন। এক—একটা সঙ্গীতের মাধ্যমে তাঁর মনের এক—একটি ভাবনার কথা অকপটে শোনাতেন আমাদের।
যেমন একটি গানের মাধ্যমে মীরা বলেছেন—
”মনরে পরসি হরিকে চরণ!
সুভগ সীতল কঁবল—কোমল, ত্রিবিধ জ্বালা হরণ
জিন চরণ প্রহ্লাদ পরসে, ইন্দ্র—পদবী ধরণ।।
জিন চরণ ধ্রুব অটল কীনে, রাখি অপনী সরণ
জিন চরণ ব্রহ্মাণ্ড ভেট্যো, নখ সিথা সিরী ধরণ।।
জিন চরণ প্রভু পরসি লীনো তরী গৌতম—ঘরণ
জিন চরণ কালীনাগ নাথ্যো, গোপলীলাকরণ।।
জিন চরণ গোবরধন গর্ব মঘবা হরণ
দাসি ‘মীরা’ লাল গিরিধর, অগম তারণ—তরণ।।”
—মন হরির চরণ দেখো। আমার প্রভু কত সুন্দর। তাঁর শীতল কমল কোমল চরণস্পর্শে বিবিধ জ্বালা চিরকালের জন্য দূর হয়ে যায়। তাঁর চরণ প্রহ্লাদ পরশে ইন্দ্র করে ধারণ, তাঁর চরণ প্রসাদে ভক্ত ধ্রুব তৈরি করেছিল ধ্রুবলোক। ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী তাঁর চরণ। আব্রহ্ম তাঁর শোভায় শোভমান। তাঁর চরণের স্পর্শে গৌতম পুনর্জীবন লাভ করে। তাঁর চরণস্পর্শে কালীয়নাগ বশীভূত হয়। প্রভু এভাবে গোপলীলা সংবরণ করেন। আমার প্রভু গিরিগোবর্ধন পূরণ করে ইন্দ্রের গর্ব নাশ করেন। সেই গিরিধারী নাগরের দাসী মীরা। প্রভু আমার পতিত পাবন।
আমি সেই পরমপুরুষের দাসী। এ আমার কত বড়ো ভাগ্য।
ঠাকুরঘরে বসে বসে রাত জেগে একটির পর একটি গান লিখতেন মীরা। সেই গানে নিজেই সুর সংযোজন করে তারপর আবার আপন মনে গাইতে থাকেন একা একা।
সমবয়সী সহেলিরা তাঁর এহেন আচরণ দেখে ঠাট্টা করে। কেউ কেউ উপযাচক হয়ে শুধায়—আচ্ছা মীরা, বিয়ে করবি না? তোর এত রূপ—যৌবন, আমরা যদি এই রূপের স্পর্শ পাই তা হলে বোধহয় আমাদের ভাগ্য পালটে যাবে।
এসব কথা শুনে মীরা কিন্তু বিন্দুমাত্র রাগ করেন না। তাঁর স্বভাবে রাগ শব্দটাই অচেনা; তিনি হেসে বলেন—আমার স্বামী তো গিরিধারী গোপাল, তাঁকে ছেড়ে আমি আর কাকে বিয়ে করব, তোরাই বল। আমার তো মনে হয়, এই মহাবিশ্বে কৃষ্ণ হল একমাত্র অখণ্ড পুরুষসত্তা। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা সেই সত্তার অনুসন্ধান করি না। যে একবার এই সত্তার বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করেছে, সেই মানুষ জীবনের প্রতিটি প্রহর ঈশ্বর সান্নিধ্যে কাটাবার জন্য চেষ্টা করে।
মীরার মুখ থেকে এসব কথা শুনে সহেলিরা অবাক হয়ে যায়। তারা জানে, ছোটো থেকেই মীরা অন্য জগতের বাসিন্দা। তাহলে মীরা হঠাৎ কেন এই পৃথিবীতে জন্মালেন?
মীরার বৈরাগী মনের খবর পরিবারের বয়স্ক মানুষরা সব জানেন। তাঁরা বিধান দিলেন, অবিলম্বে মীরাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসাতে হবে। নাহলে তার মানসিক উদ্বিগ্নতা কাটবে না। এ হল উঠতি বয়সের খেয়াল। বিয়ে হলে এসব ভাবপ্রবণতা কোথায় হারিয়ে যাবে।
মীরা কিন্তু তাঁর গিরিধারীর প্রতি অনুরাগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। সকাল—সন্ধ্যা নিয়ম করে গিরিধারীর মন্দিরে বসে থাকেন। প্রিয় দেবতাকে উদ্দেশ করে একটির পর একটি সঙ্গীত নিবেদন করেন। তাঁর সুরেলা কণ্ঠমাধুর্যের সুললিত স্বর—বহুদূর পৌঁছে যায়। মনে হয়, স্বয়ং দেবতা বুঝি তাঁর গান শুনে প্রীত হয়েছেন।
রোজ একাধিক পদ রচনা করেন মীরা। প্রতিটি পদের মধ্যে এমন এক অমোঘ আকর্ষণ আছে, যা অস্বীকার করার উপায় নেই। শুধু কি তাই? মীরার রচিত এক একটি পদের আধ্যাত্মিকতা আমাদের একেবারে অবাক করে দেয়। এত অল্পবয়সে এই মেয়েটি দর্শনের দুরূহ বিষয়গুলি আত্মস্থ করলেন কী করে? মীরার পদ বিশ্লেষণ করে পণ্ডিতরা একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে যান। তারা ভাবতেই পারছেন না যে, কীভাবে মীরা ভক্তিরসের প্রাবল্যে এত জ্ঞানবতী হয়ে উঠেছেন। এর অন্তরালে কি অন্য কোনও কারণ লুকিয়ে আছে? একে কি আমরা জন্ম—জন্মান্তরের শুভ কর্মের ফল বলতে পারি?
যখন ষোড়শী মীরার দিন কাটছে এই ছায়াচ্ছন্ন ভাবতন্ময়তার মধ্যে, তখন প্রিয় দেবতা গিরিধারীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আরও জটিল হয়েছে। তিনি ক্রমশই সাধন জগতের এক—একটি সোপান অতিক্রম করার মতো শক্তি ও সাহস অর্জন করছেন। রাতের অন্ধকারে সমস্ত পৃথিবী যখন ঘুমিয়ে পড়ে, মীরা অলিন্দ পথে এসে দাঁড়ান। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। মৌন মহাকাশ বুঝি তাঁকে অন্য এক আকর্ষণে ডাক দেয়। চাঁদের জোছনধারায় পরিপ্লাবিত হচ্ছে পৃথিবী। মীরা গালে হাত দিয়ে ভাবেন কত নশ্বর এই জগৎ। আজ সব কিছুকেই সত্য বলে মনে হচ্ছে। কাল কোনও কিছুই থাকবে না। শুধু থাকবেন কৃষ্ণ, বংশীধারী ওই মহাদেবতাকে উদ্দেশ করে মীরা কত না চোখের জলে লেখেন গান আর কবিতা। নিজে সুর দেন। সন্ধ্যাকালে আরতি শেষ হবার পর সেই সঙ্গীত পরিবেশন করেন তাঁর প্রিয় দেবতাকে। তাঁর এহেন আচরণে পিতামহ দুদাজি বেশ ক্ষুণ্ণ হয়েছেন। মনে—প্রাণে তিনি বৈষ্ণবধর্মের প্রতিটি অনুশাসনকে মেনে চলার জন্য সদাসর্বদা সচেষ্ট থাকেন। কিন্তু এক রাজনন্দিনী এইভাবে পার্থিব সকল অনুভূতিকে দূরে সরিয়ে রেখে শুধুমাত্র ঈশ্বর সাধনায় মগ্ন থাকবে, এই ব্যাপারটি তাঁর মোটেই ভালো লাগে না। মীরা এখন যৌবনপ্রাপ্তা হয়েছেন। আজ বাদে কাল তাঁকে শ্বশুরগৃহে পদার্পণ করতে হবে। সেখানে তাঁর ওপর অনেক কাজের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হবে। সেখানে গিয়েও তিনি যদি এমন আচরণ করেন তাহলে কি হবে? এই বংশের মান—মর্যাদা আছে। তখন যদি কেউ মীরার নামে বদনাম ছড়ায়, তাহলে দুদাজি সমাজে মুখ দেখাতে পারবেন না। মাঝে মাঝে প্রিয় নাতনিকে কাছে ডেকে নিয়ে তার সাথে তিনি কথা বলেন। তিনি অত্যন্ত অনুভবী মানুষ। তিনি বুঝতে পারেন, জন্ম থেকেই মীরার মধ্যে এমন এক বৈরাগ্যভাবের সঞ্চারণ ঘটে গেছে। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে মীরা এই জগতের কোনও কিছুর প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ প্রদর্শন করে না। তাকে দেখে মনে হয় সরল নির্লিপ্তির ওড়না বুঝি তার সর্বাঙ্গে জড়ানো আছে।
বেচারি দুদাজি, তিনি তো আর মীরার পূর্বজন্মের ইতিহাস জানেন না। তিনি যদি জানতেন যে, গত জন্মে মীরা ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় এক গোপিনী, তাহলে হয়তো মীরার এহেন আচরণের একটা অর্থ খুঁজে পেতেন। স্নেহপূর্ণ কণ্ঠস্বরে তিনি মীরার সঙ্গে কথা বলেন। বলেন, ওরে পাগলি মেয়ে, আমিও তো ভগবান আরাধনা করি। রোজ সকাল—বিকাল নিয়ম করে মন্দিরে যাই। তা বলে আমি কি কর্তব্য কর্ম থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি?
তুই যে কৃষ্ণভগবানের কথা বলিস, একবার তাঁর দিকে চেয়ে দেখ তো, পরিস্থিতির চাপে তিনি কত অপ্রীতিকর পরিবেশের সামনে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর এক একটি সিদ্ধান্তের ওপর ভারতবর্ষের ইতিহাস রচিত হয়েছে। তাঁকে তো আমরা যথার্থই এক কর্মবীর বলতে পারি। তুই যদি সত্যি সত্যি গিরিধারীকে তোর ইষ্টদেবতা বলে মনে করিস, তাহলে তাঁর জীবনচর্চার আদর্শে কেন অনুপ্রাণিত হবি না?
শান্ত মনে সব কিছু বিচার বিবেচনা করে মীরা বুঝতে পারেন, দাদু ঠিক কথাই বলেছেন। কিন্তু পার্থিব কোনও বিষয়ে মন দিলেই তাঁর অন্তর কেমন যেন অশান্ত হয়ে ওঠে। তাঁর কেবলই মনে হয়, ওই কৃষ্ণ বুঝি পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর দিকে তাকাচ্ছেন লাজুক দৃষ্টিতে। বলছেন মীরা, তুমি কি গত জন্মের অঙ্গীকারের কথা ভুলে গেছো? তুমি হলে আমার পরম শক্তির এক প্রকাশ মাত্র। আমি তো এইভাবেই আমার পুরুষশক্তিকে ভিন্ন ভিন্ন গোপিনীর মাধ্যমে প্রকাশ করেছি। আর এভাবে তুমি আমাকে অপমান করছো? তুমি কি জানো না, তুমি আর পাঁচটা মেয়ের মতো এক সাধারণ নারী নও? তুমি গতজন্মের আরাধ্য কাজ শেষ করবে বলে আবার মানুষ রূপে জন্মগ্রহণ করেছো।
মীরার ভাগ্যাকাশে হঠাৎ নেমে আসে কালো মেঘের ঘনঘটা। যে পিতামহ তাঁকে খুব স্নেহ করতেন, তিনি প্রয়াত হলেন ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে। এবার সিংহাসনে এলেন তাঁর বড়ো ছেলে বীরমদেবজি। এই ভদ্রলোক ছিলেন অত্যন্ত কঠিন স্বভাবের। অযথা ভাগবত প্রেমে মগ্ন হয়ে পথ চলতে ভালোবাসতেন না। প্রশাসনিক দৃঢ়তা ছিল তাঁর চরিত্রের সবখানে। তিনি এসেই একটি কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। যার ফলে মীরার ভবিষ্যৎ জীবন নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। তিনি বললেন—এক বছরের মধ্যে মীরাকে পাত্রস্থ করতে হবে। এই বংশের মেয়েরা এতদিন পর্যন্ত অবিবাহিত অবস্থায় থাকে না। কথাটা হয়তো সত্যি, বিশেষ করে রাজপুতনার মতো একটি দেশে, যেখানে বংশ পরম্পরাগত ঐতিহ্যকে সকলে নতমস্তকে মেনে নিতে বাধ্য হয়। যেখানে কোনও নারীর হৃদ—অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া ছোটো খাটো বিস্ফোরণের সম্মান কেউ দেয় না। এই খবর যখন মীরার কানে পৌঁছে গিয়েছিল, তখন মীরা বুঝি তাঁর দুটি কানকে বিশ্বাস করতে পারেননি। গিরিধারীর পায়ের কাছে আছড়ে পড়েছিলেন তিনি। চিৎকার করে বলেছিলেন—হে প্রেমের ঠাকুর, তুমি আমাকে এ কোন কঠিন পরীক্ষার মধ্যে নিয়ে চলেছো, বলো? শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সাংঘাতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে থেকে আমি কীভাবে তোমাকে পুজো করব? প্রতি মুহূর্তে সংঘাত দেখা দেবে। মন বিক্ষিপ্ত হবে। এই অবস্থায় আমি কি তোমার চরণবন্দনা করতে পারব? তাছাড়া, গানই তো আমার জীবন। আমি তো গানের মাধ্যমে তোমার সান্নিধ্য পেয়ে থাকি। ওখানে গেলে আমি কি সেই সুযোগ পাব? বিবাহিতা গৃহবধূ গান রচনা করছে, সুর সংযোজনা করছে, তা গাইছে ইষ্টদেবতার সামনে—এমন অন্যায় আচরণ তাঁরা মানবেন কেমন করে?
আমরা জানি না, মীরার প্রাণের দেবতা কেন তাঁর কণ্ঠ নির্গত আর্তনাদের এইসব শব্দগুলিকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেছিলেন। তিনি কি মীরার সামনে একটির পর একটি অগ্নি পরীক্ষা এনেছিলেন? মীরা কতখানি দক্ষ এবং কর্তব্যনিষ্ঠ, তা প্রমাণ করবেন বলে? অবশেষে যা হবার তাই হয়ে গেল। চিতোরের সিসোদিয়া রাজবংশের মহারাণা সংগ্রাম সিংহের বড়ো ছেলে কুমার ভোজরাজের সঙ্গে শুভদিনে মীরার বিয়ে সুসম্পন্ন হল। জানি না, সেদিন সকাল থেকে আকাশের মুখ ভার ছিল কিনা। ভারতবর্ষের এই অঞ্চলে বৃষ্টি বুঝি চিরচঞ্চলা নারী। হঠাৎ কখন তার সঙ্গে দেখা হবে কে জানে, কিন্তু আমার মনে হয়, সেদিন বুঝি সকাল থেকেই আকাশের মুখ ছিল ভার। মেঘবালিকারা অশ্রুকণায় ভিজিয়ে দিয়েছিল মাটির পৃথিবীকে। এখানে সেখানে হঠাৎ মাঝদুপুরে আঁধি দেখা দিয়েছিল। প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ে সব কিছু মুখ ঢেকেছিল গহন অন্ধকারে।
তারপর, বিকেলের কনে দেখা আলোয় ভোজরাজ এলেন বিয়ের আসরে। মীরার কেবলই মনে হচ্ছিল বহুদিন আগে স্বপ্নে দেখা সেই অলৌকিক বিবাহ আসরের কথা। স্বয়ং গিরিধারী এসেছেন বধূরূপ প্রদান করতে। এই ছবিটা বারবার তাঁর চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে। তাই কখনও তিনি ভোজরাজকে স্বামীর সম্মান দিতে পারেননি। নেহাত কর্তব্য করতে হয়, তাই নীরবে সব করে গেছেন। স্বামী এবং স্ত্রীর মধ্যে জন্ম—জন্মান্তরের যে প্রেম ও প্রীতির বাঁধন থাকে, এক্ষেত্রে তা ছিল না। এজন্য মীরাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আর ভোজরাজ? ইতিহাসের পাতায় তিনি বুঝি এক ট্র্যাজিক চরিত্র। তিনি এমন এক নারীকে বিয়ে করলেন, যাঁর মধ্যে পার্থিব অনুভূতি বলতে কিছু নেই। আমরা জানি না কেমন ভাবে অতিবাহিত হয়েছিল মধুর মিলনের প্রথম রাত্রি। যে রাত্রির জন্য সমস্ত নারী ও পুরুষ এক বুক আশা এবং এক আকাশ তৃষ্ণা নিয়ে অপেক্ষা করে।
সেই রাতে কোথাও কি বেজেছিল সুখের সানাই? কোথাও কি রচিত হয়েছিল মিলনশয্যা? নাকি আকাশ থেকে শুধুই ঝরে পড়েছিল নক্ষত্রের অশ্রুকণা? মীরার দু’চোখের তারায় ঘুম ছিল না। অনিদ্রিত প্রহর কাটাতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। আর ভোজরাজ? সদ্য যুবক এই মানুষটি তাঁর পাশে শয্যাসঙ্গিনীকে দেখে কেন ভীতিবিহ্বল হয়ে গিয়েছিলেন? তিনি কি প্রথম রাতেই আবিষ্কার করেছিলেন যে, মীরার মধ্যে জাগতিক ব্যাপারে কোনও চেতন নেই। কোনও পুরুষের শরীর কখনও তাঁকে কামনা—বাসনার জগতে নিয়ে যেতে পারবে না। তাঁর পায়ের পাতা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত এমন এক পবিত্রতার বাতাবরণ আছে, যাকে অতিক্রম করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা অনায়াসেই বলতে পারি যে, সেই রাত থেকে মীরা আর ভোজরাজের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান রচিত হয়। তারপর যে ক’টা দিন মীরা স্বামীর সঙ্গে ঘর করেছেন, কখনও এই ব্যবধান সামান্যতম দূরীভূত হয়নি। হবে কেমন করে? যে তরুণী সদাসর্বদা ঈশ্বরের সাথে কথোপকথনে মেতে ওঠেন, তাঁকে উদ্দেশ করে একটির পর একটি ভক্তিসঙ্গীত রচনা করেন, তাঁর কাছে স্বামী তো খেলার পুতুল ছাড়া আর কেউ নয়। বেচারি ভোজরাজ, সবকিছু থাকা সত্ত্বেও তাঁকে এমন বিরহ যন্ত্রণা ভোগ করে দিন কাটাতে হয়েছে। এজন্য সমবেদনা নিশ্চয়ই তাঁর প্রাপ্য।
কিন্তু এই ঘটনায় ভোজরাজের ভূমিকাকে কি অস্বীকার করা যায়? জনান্তিকে শোনা যায় তিনি নাকি কিশোর বয়স থেকে মীরার কণ্ঠনিঃসৃত মধুর ভজন সঙ্গীত শুনতে ভালোবাসতেন। পরে এই ভালোবাসাই প্রবল অনুরাগে পরিণত হয়। একবার তিনি ছদ্মবেশে মীরার গান শুনছিলেন। ওই গান তাঁকে একেবারে আত্মহারা করে দেয়। সঙ্গীত যে মানুষের মনে এমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে, ভোজরাজ তা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি মীরাকে আরও বেশি কাছে পেতে চাইলেন। ভোজরাজের তরফ থেকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল।
শ্বশুরবাড়িতে আসার পর মীরাকে একটির পর একটি পরীক্ষা দিতে হয়েছে। ওই পরিবারের নিয়ম মতো নববিবাহিত দম্পতিকে নিয়ে যাওয়া হয় শ্রীদুর্গামন্দিরে। দুর্গা হলেন তাঁদের বংশ পরম্পরাগত পূজিতা মহাদেবী। মীরা কিন্তু দেবী দুর্গার কাছে মাথা নত করতে রাজি হননি। রাজ পরিবারের ইষ্টদেবী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর কাছে মীরা ভক্তিবিনম্র প্রণাম নিবেদন করেননি। এই ঘটনায় শাশুড়ি মা খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন।
মীরা সবার সামনে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছিলেন—আমি গিরিধারী নাগর ছাড়া কাউকে প্রণাম করি না।
পরবর্তীকালে মীরাকে একটি ঘরের ভেতর আটকে রাখা হয়। তাঁর ওপর চলতে থাকে নানাধরনের উৎপীড়ন। তাঁর এই একগুঁয়ে জেদি মনোভাব শ্বশুরবাড়ির কেউই খোলা মনে মানতে পারেনি। তবে ভোজরাজ তাঁর প্রতি বিশেষ সহানুভূতি প্রদর্শন করতেন। তিনিই হলেন একমাত্র ব্যক্তি, যিনি তাঁর মনোগত বেদনার কথা বুঝতে পেরেছিলেন।
স্ত্রী হিসাবে মীরা কিন্তু তাঁর ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনে অপারগ হননি। সময়মতো স্বামীসেবা করতেন। স্বামীর দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়ের প্রতি ছিল তাঁর তীক্ষ্ন নজর। তবে যে অর্থে স্বামী—স্ত্রী দাম্পত্য জীবনযাপন করে, সেই অর্থে মীরা কখনও সেই জীবনে প্রবেশ করেননি। তিনি জানতেন স্বামী তাঁর কাছে পরমপূজ্য দেবতার মতো। তাই স্বামীকে উপযুক্ত যত্ন করা তাঁর কর্তব্য।
কিন্তু মিলনের ইচ্ছা নিয়ে যখন ভোজরাজ ছুটে আসতেন, তখন মীরা নিজেকে দূর থেকে আরও দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতেন। মহিয়সী মীরা অনেকবার স্বামীকে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন। বলেছেন, প্রিয়, এসব দু—দিনের সুখ। এ নিয়ে কী হবে? আমার এসব ভালো লাগে না। ভগবান দয়াময়, তিনি আপনার মঙ্গল করবেন। আশা করি আপনি আর এভাবে আমাকে প্রলোভিত করার চেষ্টা করবেন না।
ভোজরাজ অবাক হয়ে শুনেছেন মীরার মুখনিঃসৃত এই সব কথা। লজ্জায় ম্রিয়মান হয়ে গেছে তাঁর সমস্ত মুখমণ্ডল। একটু আগে হৃদয়ে যে বাসনার আগুন শিখা জ্বলে উঠেছিল, এখন তা নির্বাপিত হয়েছে।
এরপর থেকে ভোজরাজ আর কোনওদিন মধ্যরাতে মীরার কাছে এই প্রস্তাব রাখেননি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মীরাকে শ্রদ্ধা করতে হবে। মীরা হলেন এক অনন্যা দেবী। তাঁর সাথে দৈহিক মিলনের আশা না করাই ভালো।
পরবর্তীকালে ভোজরাজ মীরার জন্য একটি সুন্দর মন্দির নির্মাণ করে দেন। এই মন্দিরের নামকরণ করা হয় মুরলীধরের মন্দির। মীরা বাপের বাড়ি থেকে গদাধর পণ্ডিতকে নিয়ে এসেছিলেন। গদাধর পণ্ডিত এক মহাশাস্ত্রবিদ। বেদ, পুরাণ, উপনিষদের অসংখ্য গল্প তাঁর কণ্ঠস্থ। তিনি—ই ছোটোবেলায় মীরাকে নানা গল্প বলতেন। গদাধর সেই মন্দিরে প্রধান পুরোহিতের পদ গ্রহণ করলেন। তখন থেকে এই মন্দির অঙ্গনে দিন কেটেছে মীরার।
মীরা একটির পর একটি গান লিখেছেন, এখন গিরিধারীজির পাশাপাশি যমুনাজি, শিবজি আর তুলসীজির প্রতিও শ্রদ্ধা দেখা যাচ্ছে। এই তো ক’দিন আগে শিববন্দনাতে মীরা লিখলেন—
”শিব মন্ত্র পর সোহৈ লাল ধ্বজা
কৌন শিখর পর গৌরী বিরাজৈ,
কৌন শিখর পর বমভোলা
উত্তর শিখর পর গৌরী বিরাজে
দক্ষিণ শিখর পর বমভোলা।
‘মীরা’কে প্রভু গিরিধর নাগর,
হরিকে চরণ পর চিত মোরা।”
—শিবমঠের ওপর লালধ্বজা শোভা পাচ্ছে। কোনও শিখরে গৌরী বিরাজিতা, আবার কোনও শিখরে ব্যোমভোলাকে দেখা যাচ্ছে। উত্তর শিখরে আছেন গৌরী আর দক্ষিণ শিখরে আছেন ব্যোমভোলা অর্থাৎ শিব। আমার চিত্তে প্রভু গিরিধারী নাগর হরির চরণে রয়েছে।
আর একদিন গিরিধারীকে নিয়ে একটি সুন্দর গান লিখেছিলেন মীরা। এই গানের মাধ্যমে তিনি প্রেমের ঠাকুরকে তাঁর হৃদয়ের সবকিছু উৎসারিত করে দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন—
”সুনী হো মৈ হরি আয়ন কী অয়াজ।
মহল চড়চড় জোঁউ মেরী সজনী
কব আয়ৈ মহারাজ।
দাদুর মোর পপাইয়া বোলৈ
কোহল মথুরে সাজ।।
উঁমগ্যো ইন্দ্র চহুঁ দিস
বরসৈ দামিন ছোড়ী লাজ।
ধরতী রূপ নবানবা
ধরিয়া ইন্দ্র মিলনকৈ কাজ।।
মীরা কে প্রভু গিরিধর নাগর
বেগ মিলো মহারাজ।।
—আমি শুনতে পাচ্ছি ওই হরি আসছে। তার আসার শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওগো সজনী, তোমরা এখনই যাও, রাজমহলে গিয়ে দেখো কোথায় হরি এসেছে। দাদুর, ময়ূর, পাপিয়া ডাকছে। এখন উৎসবমুখর পরিবেশ। হরি আসছে—এই খবর বাতাস বয়ে এনেছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। হরি আমার আসছে। তাই সমস্ত বসুন্ধরা নতুন সাজে সেজেছে। ইন্দ্র মিলনের কাজে রত। গিরিধারী নাগর আসছে। হে নাগর, তুমি তাড়াতাড়ি এসে তোমার প্রিয়ার সঙ্গে মিলিত হও। তুমি এলে আমি শান্তি পাব।
এসব পদ শুনে ভোজরাজ আরও একবার অবাক হয়ে গেলেন। তখন নিজেকে বড়ো বেশি সাধারণ পুরুষ বলে মনে হল তাঁর। তিনি আর ভাগ্যকে দোষারোপ করলেন না। বরং বুঝতে পারলেন যে, ঈশ্বরের অভিপ্রায়ে তিনি মীরার মতো এক কৃষ্ণসাধিকার স্বামী হবার গৌরব অর্জন করেছেন। এ গৌরব কি সকলে পায়?
মীরা তখন মুরলীধরের মন্দিরে এসে দেবতাকে নৃত্য প্রদর্শন করছেন। তিনি ভাবছেন কখন মুরলীধরের মুরলীধ্বনি তাঁর কর্ণে প্রবেশ করবে? শুরু হয় প্রতীক্ষার প্রহর গোনা।
ভোজরাজ চেয়েছিলেন, একদিন পর্দার আড়াল থেকে মীরার নৃত্যরত অপরূপ তনুবাহারের দিকে তাকিয়ে থাকবেন। যে কিশোরী কন্যার কণ্ঠনিঃসৃত সুরলহরী একদা তাঁর শ্রবণেন্দ্রিয়কে পরিতৃপ্ত করেছিল, তাঁর দেহসৌষ্ঠবের লীলায়িত ভঙ্গিমা দেখে জীবন সার্থক করবেন। কোনও এক মধ্যযামিনীতে তাঁর এই মনোগত বাসনার কথা মীরার কাছে উত্থাপিত করেছিলেন ভোজরাজ। কিন্তু মীরা সঙ্গে সঙ্গে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন—শুনুন স্বামী, আমি নৃত্য প্রদর্শন করি আমার প্রিয়তম গিরিধারীর জন্য। পৃথিবীর কোনও পুরুষ যেন কখনও এই নাচ না দেখে। তাহলে আমার সমস্ত শরীর অশুদ্ধ হয়ে যাবে। আমার নাচের মধ্যে এমন একটা সাত্ত্বিক ভাব আসে, যার আসল অর্থ আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন না। এই নাচ দেখলে মনের কোথাও কামনা—বাসনার জন্ম হয় না। রজোগুণের বৃদ্ধি হয় না। এই নাচ দেখলে মন শান্ত হয়ে ওঠে। এ নাচ আপনার পছন্দ হবে না। আপনি রজোগুণ সম্পন্ন মানুষ, আপনি কি আমার অন্তরের ভাব বুঝতে পারবেন?
মীরাবাঈয়ের এহেন আচরণে মাঝে মধ্যে ভোজরাজ অতৃপ্ত থেকে যান। মনে হয় এ জীবনে সকল চাওয়া পাওয়ার বুঝি অন্ত হয়ে গেছে। মন ভেঙে যায় তাঁর, কিন্তু তবুও তো তাঁকে সংসারজীবন যাপন করতেই হবে। তিনি এক বিশাল ভূখণ্ডের অধিপতি। রোজ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কত প্রশাসনিক দায়িত্ব সামাল দিতে হয়। তার পাশাপাশি যদি মীরা এমন আচরণ করে তাহলে কী হবে?
মীরা তখন একেবারে উন্মাদিনী অবস্থায় পৌঁছে গেছেন। একদিন সকালবেলা হঠাৎ লিখে ফেললেন একটি অসাধারণ পদ। যে পদের মাধ্যমে তাঁর মনের কথা আমরা জানতে পারলাম। তিনি লিখলেন—
”ফাগুনকে নি বার রে
হোরী ফেল মনা রে।
বিন, করতাল, পখায়জ বাজৈ
আহদ কী ঝণকার রে।।
বিনী সুর রাগ ছতী সুঁ
গায়ৈ রোম রোম রঁগ সার রে।
সীল সঁতোম কী কেসর ধোলী
প্রেম পীত পিচকার রে।
উড়ত গুলাল লাল ভয়ো অংবর
বরসত রঙ্গ অপার রে।।
ঘট কে সব খোল দিয়ে হৈ
লোকলাজ সব ডাররে।
হোরী খেলি পীর ঘর আয়ে
সোই প্যারী পিয় প্যার রে।
মীরাঁ কে প্রভু গিরিধর নাগর,
চরণ কঁয়ল বলিহার রে।।”
—ফাগুন দু’দিনের জন্য পৃথিবীতে আসে। তখন মন কী আনন্দে হোলি খেলে। বীণা, করতাল আর পাখোয়াজ বেজে ওঠে। ওই শোনা যাচ্ছে অনাহত ধ্বনি। ছয় রাগ আর ছত্রিশরাগিনী ছাড়া যে আর কিছু নেই। প্রেম পিচকিরি দিয়ে শীল সন্তোষের আবির মাখি। অম্বর লাল হবে ওড়া আবিরে। প্রকৃতি বুঝি আজ এক অনন্যা রূপসী কন্যার সাজে সেজেছে। এসো, আমি হৃদয়ের দুয়ার খুলে দিই। লোকলাজ সব ত্যাগ করি। আমার প্রিয় হোলি খেলে ঘরে ফিরে আসি। মীরার প্রভু গিরিধারী নাগরের চরণ কমলই একমাত্র আরাধ্য বিষয় এই পৃথিবীর।
সেদিন সন্ধ্যাসমাগমে মীরা আর একটি গান লিখেছিলেন। এই গানের মাধ্যমে তিনি তাঁর প্রিয়তম হরির কাছে পাঠিয়েছিলেন তাঁর মনের আকুল বার্তা। মীরা লিখেছিলেন—
”সাধন করনা চাহিয়ে মনয়া ভজন করনা চাহিয়ে।
নিত নহানে সে হরি মিলেতো জলজন্তু হোই।
ফলমূল খাকে হরি মিলেতো বাঁদুড় বাঁদরাই।।
তুলসী পূজনসে হরি মিলে তো মৈঁ পূঁজু তুলসী ঝাড়।
পাথর পূজনসে হরি মিলে তো মৈঁ পূঁজু পাহাড়।।
তিরণ তখন সে হরি মিলেতো বহুত মৃগী তজো।
স্ত্রী ছোড়নসে হরি মিলে তো বহুত রহে খোজাদ।।
দুধ পীনেসে হরি মিলেতো বহুত বৎসওয়ালা।
মীরা কহে বিনা প্রেমসে নহি মিলে নন্দলাল।।”
—মন তোমাকে সাধন—ভজন করতে হবে। সাধন—ভজন না করলে তুমি তোমার হরির সান্নিধ্য পাবে কী করে? নিত্যসাধনে যদি হরিকে মেলে তাহলে তুমি জলজন্তু হয়ে যাও। যদি ফলমূল খেলে হরিকে পাওয়া যায়, তাহলে তুমি হও বানর। তুলসী তুললে হরিকে যদি পাওয়া যায়, তাহলে তুমি তুলসীর ঝাড়কে পুজো করবে। পাথরের মধ্যে যদি হরিকে পাওয়া যায়, তাহলে পাথরকে পুজো করবে। যদি তৃণদলে হরিকে পাওয়া যায়, তাহলে তুমি হবে হরিণ আর ছাগল। স্ত্রীসঙ্গ ছাড়লে হরিকে পাওয়া গেলে খোজা হতে হবে। দুধ খেলে হরিকে পেতে হলে বাছুর হতে হবে। মীরা বলে, বিনা ভালোবাসায় নন্দলালকে পাওয়া যায় না।
এই গানটির মধ্যে এমন এক অন্তর্নিহিত ভাবনা লুকিয়ে আছে, যা আমাদের মনকে অদ্ভুত আবেগে আপ্লুত করে। এই গান শুনে অনেকের চোখ থেকে লবণাক্ত অশ্রুকণা ঝরে পড়ে। অনেকে আবার নীরবতার মধ্যে থেকে যায়। অনেকে ভাবে এমন হরিনামে বিভোর হতে হবে।
কখনও কখনও মীরা নূপুরের নিক্কণ শোনান তাঁর দেবতা হরিকে। কখনও হাতে করতাল নিয়ে চোখ বন্ধ করে নাচতে থাকেন। কখনও আবার নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকেন অনন্তকাল। বুঝি এক ধ্যানমগ্না নারী।
এইভাবে তখন মিলন—বিরহের কত পালা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সেই পালায় ভোজরাজ এক নীরব দর্শক মাত্র। ইদানিং তিনি মীরার অনুরোধে মন্দিরের বারপ্রাঙ্গণে এসে বসেন। অপলক চোখে তাকিয়ে থাকেন মীরার দিকে। মীরার এই উপাসিকা মূর্তি দেখে ভোজরাজের মনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে যায়। ভোজরাজ বুঝতে পারেন, এই পৃথিবীতে মানুষ মাত্র ক’দিনের জন্য আসে। তারপর আবার সে কোথায় মিলিয়ে যায়। শুধু থেকে যায় এই হরিভক্তি, এই আধ্যাত্মিক চেতনা, আর দার্শনিক অভিজ্ঞান। সত্যিই তো, নারী—পুরুষের মিলনের মধ্যে ক্ষণকালের আনন্দ আছে, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু সময়ের আক্রমণে এই আনন্দটা হারিয়ে যায়। তখন থেকে যায় কেবল শুদ্ধ হরিভক্তি। যার কোনও ক্ষয় হয় না। অক্ষয় অমর হয়েই হরিভক্তি উপলব্ধি করতে হবে। তবেই তো আমরা সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠতে পারব।
মীরা মাঝে মধ্যেই তাঁর নন্দলালার সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় মেতে উঠতেন। একদিন তিনি এভাবেই সংলাপের মাধ্যমে মনের কথা শোনাচ্ছেন তাঁর প্রিয় দেবতাকে।
বাড়ির লোকজনের কানে সেই কথা পৌঁছে গেল। মীরার এই অবাক করা কাণ্ড দেখে তারা বুঝি আহত হল। সকলে চলে এল ভোজরাজের কাছে। বলল, তোমার স্ত্রী একেবারে পাগল হয়ে গেছে। মন্দিরে বসে কার সঙ্গে বকবক করছে। আশেপাশে কোনও মানুষ নেই। তুমি যাও, এখনই চিকিৎসককে ডেকে আনো। না হলে এই রোগ সারবে না।
ভোজরাজ উদভ্রান্ত মনে মন্দির চত্বরে চলে এলেন। সঙ্গে ছিল প্রিয় বন্ধু—বান্ধব।
সেখানে গিয়ে যে দৃশ্য তাঁরা দেখেছিলেন, তাতে মনে দুশ্চিন্তা হয় বৈকি। ভোজরাজ দেখলেন, মীরা দু’হাতে নন্দলালার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। নানা ভাবে জানাচ্ছেন নিজের অন্তরের কথা।
কখনও নন্দলালাকে পুত্র স্নেহে আদর করছেন। বলছেন, খাও, খাও, এ মিষ্টি তোমাকে খেতেই হবে। আমি তোমার মা। আমার কথা না শুনলে আমি মনে কষ্ট পাব।
আবার নন্দলালাকে তিনি কখনও প্রেমিক হিসাবে ঘোষণা করছেন। নন্দলালাকে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কাঁদছেন মীরা। তাঁর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুকণা। কখনও তাঁর কণ্ঠে জাগছে অভিমানের সুর। কখনও তিনি আবার একটু দুষ্টুমি করে বলছেন, নন্দলালা, তুমি কি আমার সাথে চিরদিন এমন লুকোচুরি খেলা খেলবে? তুমি কেন আমার কাছে ধরা দিচ্ছো না? তুমি কি আমার মনের কষ্ট বুঝতে পারো না?
ভোজরাজ মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন তাঁর বিবাহিতা স্ত্রীর দিকে। যতই শুনছেন ততই বিস্মিত হচ্ছেন তিনি। সঙ্গের লোকজনদের বললেন—তোমরা এখন এখান থেকে যাও। আমি একটু বাদে আসছি।
সকলে চলে গেলেন। ভোজরাজ একা একা দাঁড়িয়ে থাকেন। মীরার ভাব দেখেন।
হঠাৎ মীরা তাঁর স্বামীকে দেখতে পেলেন। যখন তিনি নন্দলালের সামনে তাঁর নাচ দেখাচ্ছিলেন, তখনই চোখ পড়ে গেল বাইরের প্রাঙ্গণে বসে থাকা ভোজরাজের দিকে।
এতক্ষণ লজ্জা ছিল না তাঁর। স্বামীকে দেখা মাত্র লজ্জায় মুখের ওপর ওড়না টেনে দিলেন।
রাজা বললেন—থাক, এখন আর কাপড় দিয়ে লজ্জা ঢাকতে হবে না। এতক্ষণ এত লোক দাঁড়িয়ে তোমার রঙ্গ—তামাশা দেখছিল, তুমি রাজবধূ, তবু তোমার লজ্জাশরম নেই। এখন এত লজ্জা কেন?
মীরা জোড় হাত করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। বলেন, স্বামী বিশ্বাস করুন, আমি আমার ভাবে এতই বিভোর হয়েছিলাম, কোথায় কে এসে দাঁড়িয়েছে, তা আমি বুঝতে পারিনি। যদি আমার আচরণে আপনি সামান্যতম ক্ষুণ্ণ হয়ে থাকেন, তাহলে আমাকে ক্ষমা করুন। আমি কথা দিচ্ছি, ভবিষ্যতে কখনও এমন আচরণ করব না। এবারটির মতো আমাকে মাফ করে দিন।
ভোজরাজ বুঝতে পারেন, মীরার মনটা কত সুন্দর। তিনি বললেন—শোনো, তোমাকে আমি ভালোবাসি বলেই বলছি, এখন থেকে এমন কাজ আর করো না। তোমায় কি এসব মানায়? এসব হল রাস্তার ফকিরের কাজ।
মীরা বললেন—একথা কী বলছেন প্রভু? নন্দলালার জন্য যদি কেউ ফকির হয়, তাহলে তার দিকে সকলে ঈর্ষার চোখে চাইবে। নন্দলালা ছাড়া এ বিশ্বাসংসারে আর কেউ কি আছে? মনে রাখবেন এই যে আপনি কথা বলছেন, নানা ভাবনা ভাবছেন, রাজ্যশাসন করছেন এসবের অন্তরালে আছেন ওই পরমপুরুষ। তাঁর দয়া ছাড়া আমরা একমুহূর্তও অতিবাহিত করতে পারি না।
তারপর মীরা বললেন—আমি সামান্য মানুষ, আপনার মতো পড়াশোনা শিখিনি, তবুও বলছি নন্দলালা আছেন বলেই এই বিশ্বজগৎ সংসার আছে। এই যে প্রাসাদ, এত অর্থ, অহঙ্কার, প্রতিপত্তি—এসব তো অনিত্য। মানুষ চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু শেষ হয়ে যায়। আর আসল বস্তু হল ভগবানের প্রতি প্রেম, যা শাশ্বত এবং সনাতন। আশাকরি, আপনি আমার কথার মানে বুঝতে পারছেন।
নিজের স্ত্রীর কণ্ঠনিঃসৃত এইসব শব্দগুলি শুনে ভোজরাজ কেমন যেন হয়ে যান। এতদিন পর্যন্ত সাংসারিক সুখের প্রতি তাঁর মনে ছিল আসক্তি। এই প্রথম তাঁর মনে হল, সত্যিই তো, এই জগতের সবকিছু একেবারে অনিত্য। চৈত্র শেষের ঝরা পাতার মতো সবকিছু একদিন কোথায় উড়ে যাবে। থাকবে শুধু বিশীর্ণ স্মৃতির অনুবর্তন। তার চেয়ে আমরা যদি ঈশ্বর আরাধনায় মগ্ন থাকি, তাহলে কেমন হয়? হয়তো এক জীবনের সাধনায় তাঁর সান্নিধ্য লাভ করা সম্ভব হবে না, কিন্তু আমার কাজটা তো একটু এগিয়ে থাকবে।
আমরা জানি না, সেই মুহূর্তে ভোজরাজের মনে কোনও বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল কিনা। তা সত্ত্বেও তিনি স্ত্রীকে বলেছিলেন—শোনো, তোমার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। তাও বলব, তুমি তো রাজবধূ, তুমি কেন এখন থেকে এমন নিস্পৃহ সুরে কথা বলবে? তোমার হাতে অনেক কাজ আছে, ঈশ্বর তোমার ওপর বেশ কয়েকটি কর্তব্যের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছেন। রাজবধূ হিসাবে তোমার উচিত সেই কাজগুলো ভালোভাবে সম্পন্ন করা। তারপর না হয় তুমি তোমার নন্দলালার সেবা করো।
মীরা বুঝতে পারলেন, বিষয়ী মানুষ ভোজরাজের মনের পরিবর্তন ঘটানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না। তবু তিনি বললেন আত্মগত সম্ভাষণের সুরে—আমি যা করছি তা আমার হাতে নেই। আশা করি এ ব্যাপারটা আপনি বুঝতে পারছেন। আমার নন্দলালা আমাকে যখনই যে কাজ করতে বলেন, আমি সঙ্গে সঙ্গে সে কাজ করে দিই। কী করব বলুন, এতে যদি আমার কোনও দোষ—ত্রুটি থেকে যায়, আমি নিরূপায়।
এতক্ষণ শান্তভাবে সব শুনছিলেন ভোজরাজ। মীরার এই কথা শুনে একটু উত্তেজিত হলেন তিনি। তিনি বললেন, আমি আর তোমার মুখ থেকে এসব কথা শুনতে চাই না। তুমি রানি, রানির মতো আচরণ করবে। ভবিষ্যতে এমন কোনও কাজ করো না, যার জন্য মানুষ আমাকে দোষারোপ করে। মনে রেখো, আমি কিন্তু ভালোবেসে তোমাকে বিয়ে করেছি। আমি আশা করব, তুমি সারা জীবন ধরে ভালোবাসার মর্যাদা রক্ষা করবে।
এবার ভোজরাজ মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে গেলেন। মীরা তাকিয়ে থাকলেন তাঁর অপসৃয়মান শরীরটির দিকে। তারপর প্রিয় নন্দলালার মূর্তির সামনে এসে বসলেন। এখন নীরবতার মধ্যে অনেকটা সময় তাঁকে কাটাতে হবে। হয়তো মেতে উঠতে হবে আত্মসমালোচনায়। সত্যিই তো, এক রাজবধূ হয়ে তিনি কি অসামাজিক কাজ করছেন? আর এহেন কাজে এই রাজবংশের গৌরব ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে? মেবার রাজস্থানের মধ্যে এক অত্যন্ত পবিত্র এবং সম্মানীয় রাজ্য। যুগে যুগান্তরে এই রাজ্য নিষ্ঠা ও আদর্শের প্রতীক স্বরূপ বিরাজ করেছে। মীরার এই ধরনের আচরণ কি রাজ্যের মহিমাকে একেবারে নষ্ট করে দিচ্ছে? মীরা তাকিয়ে থাকেন মূর্তির দিকে। আর তাঁর মন থেকে উৎসারিত হয় একটি অমোঘ প্রশ্ন—হে ঈশ্বর, তুমি বলে দাও, আমি এখন থেকে কোন পথের পথিক হব। আমি কি আর কখনও তোমার সাধনা করব না? আমি কি এক রাজরানির মতো দিন কাটাব সুখে, ঐশ্বর্যে আর অহঙ্কারে?
তখন মীরার কেবলই মনে হয়, নন্দলালার ঠোঁটের কোণে লেগে আছে দুর্জ্ঞেয় হাসি। তিনি বোধহয় মীরাকে আরও পরীক্ষার সামনে এনে ফেলবেন। ধীরে ধীরে আরও শুদ্ধ ও পবিত্র হবেন মীরাবাঈ। তখনই তো ঈশ্বর সাক্ষাতের দুয়ার হবে উন্মুক্ত। মীরা কাঁদতে থাকেন—হে ঈশ্বর, সেই শুভদিন শুভক্ষণ কবে আসবে?
মীরা আকুল মনে প্রার্থনা জানালেন তাঁর ইষ্টদেবতার কাছে। হাজার হোক, তিনি তো ভোজরাজকে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ করেছেন। ভোজরাজের কোনও ক্ষতি তিনি সহ্য করবেন কেমন করে? মীরা বেশ বুঝতে পারেন তাঁর এহেন আচরণে স্বামী মনোক্ষুণ্ণ হন। কিন্তু কী করবেন বেচারি? তাঁর সকাল থেকে সন্ধ্যা গড়িয়ে মধ্যরাত অবধি শুধু নন্দলালার উপাসনায় কেটে যায়। তিনি তো নিরূপায়। তিনি মন—প্রাণ সবকিছু ওই দেবতাকে সমর্পণ করে বসে আছেন। ভোজরাজের জন্য ভীষণ কষ্ট হয় মীরার। মাঝেমধ্যে তাঁর অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত হয় একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস। সত্যিই তো, অন্য রাজপুরুষরা তাদের স্ত্রীদের নিয়ে আনন্দে দাম্পত্য জীবনযাপন করছে, এক বা একাধিক সন্তানের জনক—জননী হবার সৌভাগ্য হয়েছে তাদের। তাদের পাশাপাশি ভোজরাজকে দেখলে মনে হয় তিনি বুঝি সত্যি সত্যি বিরহ কাতর এক পুরুষ। স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও স্ত্রীর সান্নিধ্য বা সাহচর্য সেভাবে অনুভব করতে পারছেন না। মাঝেমধ্যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মীরা নিজেকে অনেক প্রশ্ন করেন আর ভাবেন, এই যে আমি আমার স্বামীর প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করছি, এতে কি নন্দলালা আমার ওপর রুষ্ট হচ্ছেন? এ কি আমার এক অলৌকিক খেলা? সংসার জীবনে প্রবেশ করা সত্ত্বেও আমি তো নিজেকে সাংসারিক কর্তব্যে নিয়োজিত করছি না?
পরক্ষণে তাঁর মনে অন্যতর ভাবনা এসে উপস্থিত হয়। তাঁর মনে হয়, জগৎসংসার সব কিছু তো নিরর্থক, নিস্পৃহতা এসে গ্রাস করে তাঁর সমস্ত সত্তাকে। সেদিনও তাই হয়েছিল। নন্দলালার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মীরার মনে হল তাঁর কোষে—কোষান্তরে কোথাও যেন প্রবাহিত হচ্ছে এক আশ্চর্য অনুরণন।
একটু বাদে মীরা শুনতে পেলেন, কে যেন তাঁর নাম ধরে ডাকছেন। তিনি মন্দিরের বাইরে এলেন। তিনি দেখলেন, তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক জ্যোতির্ময় পুরুষ। তিনি কে? মীরার নামই বা জানলেন কী করে?
সাধু—সন্তদের দেখলে মীরা কেমন যেন হয়ে যান। মীরার কেবলই মনে হয় এঁরাই হলেন সংসারের পরম পুরুষ। সংসারের মধ্যে বাস করা সত্ত্বেও সাংসারিক কলঙ্ক এঁদের স্পর্শ করতে পারে না। এঁরা হলেন মানুষ আর ঈশ্বরের মধ্যে এক যোগসূত্র।
মীরা বললেন—আপনি সাধু মহারাজ, মন্দিরের ভেতরে চলুন। আপনি আমার নাম জানলেন কেমন করে?
এই প্রশ্ন শুনে সাধু মহারাজের ঠোঁটের কোণে রহস্যের হাসি ফুটে উঠল। তিনি বললেন—তোমার নাম তো এখন মানুষের মুখে মুখে ফিরছে, মীরা। তুমি জানো না, গানের মাধ্যমে তুমি কী বিপ্লব এনেছো। সঙ্গীতের মাধ্যমে যে ঈশ্বরের চরণ স্পর্শ করা যায়, এর আগে আমরা তা জানতাম না।
সাধু মহারাজ এসে মীরাকে শোনান নানা তত্ত্বকথা। ভারি সুন্দর কথা বলতে পারেন তিনি। কথায় কথায় জানা গেল তিনি স্থানীয় এক মন্দিরের কথকঠাকুর। মীরার গান এবং তাঁর অধ্যাত্মসাধনার কথা শুনে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন।
প্রহর গড়িয়ে যায়, রাজপ্রাসাদ থেকে ডাক আসে। পরিচারিকারা নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মীরা তখন বুঝি এক অন্য জগতের বাসিন্দা হয়ে গেছেন। ভুলে গেছেন ক্ষুধা—তৃষ্ণার কথা। ভুলে গেছেন তাঁর ওপর ন্যস্ত দায়িত্বের কথা।
অবশেষে শেষ বিকেলে মীরা হুঁশ ফিরে পান। তিনি বললেন—আজ অনেক কথা শোনা হল, সাধু মহারাজ। আপনি অনুগ্রহ করে এই প্রসাদ গ্রহণ করুন। কথা দিন, মাঝে মধ্যে আমার কাছে এসে এভাবেই তত্ত্বকথা শুনিয়ে যাবেন।
সাধুমহারাজ তথাস্তু বলে বিদায় নেন।
ইতিমধ্যে এই খবর পৌঁছে গেছে ভোজরাজের কানে। মীরা প্রাসাদে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে ভোজরাজ এগিয়ে আসেন তাঁর কাছে। তিনি বললেন—মীরা, এ কী করছো তুমি? তুমি কি জানো না, আমাদের বংশের মেয়েরা অসূর্যস্পর্শা। স্বামী ছাড়া অন্য কোনও পুরুষের মুখ পর্যন্ত দর্শন করে না। আর তুমি কি না এক সাধুর সামনে বসে তাঁর সঙ্গে কথা বলছো? এত সাহস তোমার হল কেমন করে?
মীরা ভাবতে পারেননি, তাঁর আচরণের এই পরিণাম হবে। তিনি ধীরে ধীরে ভোজরাজের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন—আমি কি অপরাধ করেছি?
ভোজরাজ এতক্ষণ তাঁর ধৈর্য্যের বাঁধ বেঁধে রেখেছিলেন। হাজার হোক, তিনি তো রাজপুত। তাঁর ধমনীতে বইছে শৌর্য আর বীর্যের উষ্ণ রক্ত। তিনি চিৎকার করে বললেন—এখনও বুঝতে পারছো না আমার কথার আড়ালে কোন অর্থ লুকিয়ে আছে? তুমি ওই সাধুকে মন্দির অঙ্গনে প্রবেশ করতে দিলে কেন? মনে রেখো, তোমার সুবিধার্থে এই মন্দির আমি তৈরি করে দিয়েছি। এর জন্য আমাকে নানা কথা শুনতে হয়েছে। আর তুমি যদি এইভাবে মন্দির অঙ্গন অপবিত্র করো, তাহলে আজ থেকে এই মন্দিরের দুয়ার তোমার মুখের ওপর বন্ধ করে দেওয়া হবে।
মীরা ভাবতে পারেননি যে তাঁকে এইভাবে অপমানিত হতে হবে। তাঁর মাথার ভেতর ঝড় বয়ে যায়। চোখের সামনে নেমে আসে নিঃসীম অন্ধকার। হে নন্দলালা, তোমার সাথে আমি কথা বলার সময় পাব না? এ তুমি কী করছো?
অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করেন তিনি। তারপর ধীরে ধীরে বলেন—ঠিক আছে, আমি কথা দিচ্ছি, আর কেউ আজ থেকে ওই মন্দিরে প্রবেশ করবে না।
মীরা তাঁর শয়নকক্ষে চলে আসেন। অঝোরে কাঁদতে থাকেন তিনি। ওই কান্না বুঝি তাঁর সমস্ত রাগ—দুঃখ—অভিমানকে মুছে দিচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর শান্ত হন তিনি। সংযতচিত্তের অধিকারিণী হয়ে ওঠেন। পরক্ষণে তাঁর মনে হয়, তিনি কি জেহাদ ঘোষণা করবেন তাঁর স্বামীর ওই আদেশের বিরুদ্ধে? না, আপাতত শান্তি বজায় রাখতে হবে। পরে না হয় অন্য কিছু ভাববেন। তখন না হয় সংসারের সব কিছু ছেড়ে দেবেন। কিন্তু সত্যি সত্যি সেদিন কি আসবে তাঁর কাছে?
চার
দেখতে দেখতে মীরার দাম্পত্য জীবনের বয়স হল চার বছর। যখন তিনি দুদাজির কাছ থেকে এই পরিবারে প্রবেশ করেছিলেন, তখন ছিলেন একেবারে অনভিজ্ঞ। গত চার বছরে অনেক ঘাত—প্রতিঘাত তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। আঘাতে আঘাতে মূক হয়ে গেছেন তিনি। চোখের জল শুকিয়ে গেছে বোধহয়। তবু এখনও পর্যন্ত মীরা কিন্তু তাঁর কর্তব্যকর্ম থেকে দূরে সরে থাকেননি। যথাসম্ভব স্বামীর সেবা করার চেষ্টা করেন। মাঝে মধ্যে স্বামীর মুখচ্ছবির দিকে তাকান। আর তখনই অন্তর হাহাকার করে ওঠে তাঁর। তিনি ভাবেন, আমি কেন বিবাহ— পিঁড়িতে বসার অনুমতি দিলাম। কেন আমি আমার আত্মীয়দের এই কাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠলাম না? তা হলে তো আমায় আজ এমন অন্তর্জ্বালায় জ্বলতে হতো না। আমি এক প্রাণে এক মনে নন্দলালার উপাসনা করতে পারতাম।
হঠাৎ আকাশে ঘনিয়ে এলো কালো মেঘপুঞ্জ। অসুস্থ হলেন মেবার নৃপতি ভোজরাজ।
তখন মধ্যরাত। বাইরে ঘোর বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। আকাশে বজ্রসংকেত। মীরা অনেকক্ষণ ধরে বসেছিলেন অসুস্থ স্বামীর শয্যাপ্রান্তে। বেশ বুঝতে পারছিলেন একটা ব্যথা বুঝি ধীরে ধীরে ভোজরাজের সমস্ত শরীর গ্রাস করছে। তাঁর মুখমণ্ডল কেমন যেন হয়ে গেছে। চোখ দুটি খোলা, অথচ চোখের তারায় স্পন্দন কই। মীরা বুঝতে পারলেন, অনতিবিলম্বে সর্বনাশ ঘটতে চলেছে। চিৎকার করে তিনি ডাকলেন তাঁর নিকট আত্মীয়দের। সকলে ছুটে এলেন ওই নির্দিষ্ট ঘরে।
তারপর, সত্যি সত্যি ভোজরাজ চোখ বন্ধ করলেন। মীরার মনে হল, অনেক অতৃপ্তি আর দুশ্চিন্তা নিয়ে তাঁর স্বামী পরলোক গমন করেছেন।
বেচারি মীরা, দাম্পত্য জীবনের সুখ শান্তি কী, তা জানার চেষ্টাই করলেন না। তাঁকে ধারণ করতে হল বৈধব্য বসন।
আবার তিনি ভাবলেন, এতদিন পর্যন্ত সংসারের সাথে একটা ক্ষীণ বন্ধন ছিল। যাই হোক, ভোজরাজ তাঁর স্বামী। ভোজরাজ তো কোনও অন্যায় করেননি। আর এখন থেকে তিনি হলেন একেবারে বন্ধনমুক্ত। নীল আকাশে অনায়াসে উড়িয়ে দেবেন তাঁর ছোট্ট দুটি ডানা। উড়তে উড়তে হয়তো একদিন সত্যি সত্যি পৌঁছে যাবেন ওই বৈকুণ্ঠধামে, যেখানে তাঁর প্রাণের ঠাকুর শ্রীকৃষ্ণ অবস্থান করেন।
সংসারধর্ম থেকে অনেক দূরে চলে গেছেন মীরা। যখন শেষতম বন্ধনটিও ছিঁড়ে গেল, তখন আর কী দরকার ওই দিকে নজর রেখে? এখন তাঁকে দেখে মনে হয়, তিনি বুঝি সত্যি সত্যি এক মহাসাধিকা। ভোজরাজের অবর্তমানে সিংহাসনে বসেছেন তাঁর ভাই রত্নসিংহ। অবশ্য তিনিও বেশিদিন রাজত্ব করতে পারেননি, এমনকি তাঁকে তখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে রাজা উপাধিতে ভূষিত করা হয়নি তার আগেই দেহ রাখলেন তিনি।
প্রজামণ্ডলে গুঞ্জন উঠল, মীরাবাঈয়ের জন্যই কি একটির পর একটি অঘটন ঘটে চলেছে? অনেকের কাছে মীরাবাঈ এক জীবন্ত জাদুকরী। অনেকে ভাবে, তিনি বুঝি জাদু জানেন। জাদুর মাধ্যমে সকলকে বোকা বানিয়ে দেন। না হলে এক রমণী কীভাবে দিনের পর দিন নন্দলালার সঙ্গে সময় কাটান? তাঁর আচরণের ওপর অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করে।
এবার এলেন বিক্রমজিৎ, তিনি ভোজরাজের বৈমাত্রেয় ভাই। তিনি এসে মেবারের সিংহাসন দখল করলেন। বিক্রমজিৎ একেবারে অন্য স্বভাবের মানুষ। কৈশোরে পদার্পণ করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চরিত্রে কলঙ্কের দাগ লাগতে শুরু করেছিল। পরকীয়া প্রেমে পাগল। যে কোনও নারী দেখলে তার ওপর লোলুপ দৃষ্টি মেলে ধরেন। প্রজাপীড়ক বলেও যথেষ্ট দুর্নাম আছে বিক্রমজিতের। তিনি যে শেষ পর্যন্ত মেবারের রাণা হবেন, সেটা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। রাজ্যের অনেক গণ্যমান্য মানুষ তাঁকে এই পদে মানতে পারেননি। তাঁরা সরাসরি বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন।
বিক্রমজিতের হাতে সাত হাজার শক্তিশালী পালোয়ান আছে। তাদের নিয়ে বিক্রমজিতের সময় কাটে। বিক্রমজিৎ নিজেকে স্বর্গের সম্রাট বলে মনে করেন। তাই রাজপুত সর্দারদের প্রতিপত্তি সহ্য করতে পারেন না।
এই অবস্থায় ঘটে গেল চরম অঘটন। ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শা চিতোর আক্রমণ করলেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি এই অঞ্চলের দিকে তাঁর লোভী দৃষ্টি মেলে দিয়েছিলেন। যতদিন পর্যন্ত ভোজরাজ ছিলেন চিতোরের রাণা, ততদিন তিনি এই ভূখণ্ড অধিকারের জন্য বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেননি। কারণ তিনি জানতেন ভোজরাজ একটি বিশাল সৈন্যবাহিনির সর্বাধিনায়ক। তাঁর স্বদেশপ্রেম প্রশ্নাতীত। প্রজারা সকলে তাঁকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করে। এই অবস্থায় ওই ভূখণ্ড আক্রমণ করলে পরাজয়ের তেঁতো স্বাদ তাঁকে গ্রহণ করতে হবে। যখন বিক্রমজিৎ সিংহাসনে আসীন হলেন, তখন সুলতান বাহাদুর শা বুঝতে পারলেন, এটাই হল মেবার অধিকার করার প্রকৃষ্ট সময়। কারণ বিক্রমজিৎ তাঁর সেনাবাহিনির ওপর সামান্যতম কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারবেন না। নারীসক্ত আর সুরাসক্ত এই মানুষটিকে সকলেই মনে মনে ঘৃণা করে।
খবর পৌঁছোল রাজমাতা কর্ণবতী দেবীর কাছে। তিনি জানতেন, বিক্রমজিতের পক্ষে এই রাজ্য রক্ষা করা সম্ভব হবে না। চোখের সামনে মেবারের পতন দেখতে হবে? অবশেষে তিনি বাধ্য হয়ে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের সাহায্য চাইলেন। হুমায়ুন কিন্তু তাঁর অনুরোধে কর্ণপাত করেননি। এর অন্তরালে ছিল বাহাদুর শা—র প্ররোচনা। একটি গোপন চিঠি লিখে তিনি হুমায়ুনকে বলেছিলেন—সম্রাট, কাফের হিন্দুদের কখনও সাহায্য করবেন না। ওদের সাহায্য করলে খোদার কাছে আপনি কী জবাব দেবেন? ওরা আমাদের চিরশত্রু। আমি মেবার আক্রমণ করছি। আপনার কোনও সাহায্য আমি প্রার্থনা করছি না। তবে আমি চাইব, আপনি যেন মেবার অধিপতির দিকে সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে দেন।
এই কথা শুনে হুমায়ুন নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে দিলেন। তিনি ভাবলেন, আমার সাম্রাজ্যে কত সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমি কেন অপরকে সাহায্য করার জন্য হাত বাড়াব? শত্রু বাড়িয়ে কী লাভ?
বাহাদুর শা—র সৈন্যদল চিতোর আক্রমণ করল। অবাধে তারা এই শহরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। বহু মানুষকে হত্যা করে অসংখ্য ধনরত্ন নিয়ে স্বদেশে ফিরে এল। চিতোর বাসিন্দারা বুঝতে পারলেন এখন থেকে তাঁদের অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে দিন কাটাতে হবে। রাণা ভোজরাজের আমলে সমগ্র চিতোর জুড়ে নিরাপত্তার যে দুর্ভেদ্য প্রাচীর রচিত হয়েছিল, এখন তা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। বাহাদুর শা একবার বিজয়ের স্বাদ পেয়েছেন, তিনি রক্তলোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন চিতোরের ওপর। তিনি বুঝতে পারছেন, যখন তখন এই দেশটিকে আক্রমণ করা যায়। এমনকি চিতোর সুন্দরীদের সাথে খেলা যায় ভালোবাসাবাসির অবুঝ খেলা। রাজপুত রমণীদের রূপ—সৌন্দর্যের ডালি বাহাদুর শা—র রাতের ঘুম কেড়ে নেয়।
এক বছর বাদে বাহাদুর শা আবার চিতোর আক্রমণ করার কথা ঘোষণা করলেন। রাজমাতা কর্ণদেবী বুঝতে পারলেন যে, এখন তাঁকে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি মেবার রাজ্যের ভার তুলে দিলেন শক্তিশালী সর্দারদের হাতে। সর্দারদের দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত। হাসতে হাসতে তারা জীবন বলি দেবে, তবু এক ইঞ্চি জমি বিদেশি শত্রুর হাতে ছেড়ে দেবে না।
রাজপুতরা স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠলেন। বিক্রমজিৎ এবং উদয় সিংহকে পাঠানো হল বুন্দিতে।
শুরু হল জোর লড়াই। এবার রাজপুতদের তরফ থেকে কিছুটা প্রতিরোধ দেখা গেল। কিন্তু বাহাদুর শা—র সৈন্যরা ছিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। তারা চিতোরগড়ের ওপর ধারাবাহিক গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এই গড়টিকে নিয়ে মেবারবাসীদের গর্বের অন্ত ছিল না। তারা বলাবলি করত, কোনও শত্রু কখনও এই দুর্গ ধ্বংস করতে পারবে না। কিন্তু সেবার চিতোরগড়ের পঁয়তাল্লিশ ভাগ দেওয়াল চোখের সামনে ধসে পড়ল।
অবশেষে কর্ণবতী এক ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলেন। তিনি বুঝতে পারলেন এখন তাঁকে সতীত্ব রক্ষা করতে হলে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। পালন করতে হবে জহরব্রত। তাই শেষবারের মতো ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন। নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে মেবার রাজ্যকে বিদেশি শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করবেন। এটাই ছিল তাঁর অন্তরের বাসনা। এইভাবে যুগে যুগে রাজপুত রমণীরা আত্মবলিদান করে স্বদেশের সম্মান রাখার চেষ্টা করেছেন। এ হল এক অদ্ভুত প্রথা।
সেদিন সকালে দেখা গেল এক বিহ্বল দৃশ্য। সকলের আগে এগিয়ে চলেছেন সালঙ্কারা কর্ণবতী, মধ্য যৌবনে দাঁড়িয়েও যথেষ্ট রূপবতী। তাঁকে অনুসরণ করছে আরও অনেক রাজপুত রমণী। জ্বলে উঠেছে দাউদাউ আগুনশিখা। এই অগ্নিশিখাকে প্রদক্ষিণ করতে করতে রাজপুত রমণীরা হাসিমুখে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সেখানে। বাতাস ভারী হচ্ছে মৃতদেহের কটূ গন্ধে।
বারবার বাহাদুর শার আক্রমণে মেবারে তখন দেখা দিয়েছে দারুণ অশান্তি। প্রজারা এই অকর্মণ্য শাসকের অধীনে বন্দী জীবন কাটাতে আর রাজি নয়। দেখা দিল প্রজা বিদ্রোহ। তখনও পর্যন্ত বিক্রমজিত নীরব হয়ে বসে আছেন। তাঁকে দেখে মনে হতো, তিনি বুঝি এক নপুংসক। রাজ্যশাসনের দিকে বিন্দুমাত্র নজর নেই। শুধু তাই নয়, তখনও তিনি নারী আর মদে ডুবে আছেন। দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া পড়ল এই রাজ্যের ওপর। হাজার হাজার মানুষ মারা গেল অনাহারে। অথচ রাণার তরফ থেকে এর কোনও প্রতিকার করা হল না।
তখন বিক্রমজিৎ ব্যস্ত আছেন সাধ্বী রমণী মীরাবাঈকে ভোগ করার কুটিল ষড়যন্ত্রে। যে করেই হোক ওই সুন্দরী রমণীকে অঙ্কশায়িনী করতেই হবে, তার জন্য যদি ব্যক্তিগত ক্ষতি হয়, তিনি পরোয়া করবেন না।
ইতিমধ্যে মীরাবাঈ সাধনতত্ত্বের আর এক স্তরে পৌঁছে গেছেন। এতদিন পর্যন্ত তিনি একা একা নন্দলালার কাছে প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। আর এখন বৈধব্য শোককে দমন করে এক সাধুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। এই সাধু হলেন রৈদাস। তিনি স্বরূপ—সাধন প্রণালী সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানার্জন করেছিলেন। এই সাধন প্রণালী অনুসারে ঈশ্বরকে পেতে হলে যথেষ্ট কষ্ট স্বীকার করতে হয়। যেহেতু মীরাবাঈয়ের কাছে ঈশ্বর—আরাধনার একমাত্র সম্বল ছিল সঙ্গীত, তাই সাধু রৈদাস তাঁকে সঙ্গীতের মাধ্যমেই ঈশ্বর—আরাধনার অনুমতি দিয়েছিলেন। এই সাধুর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে দীক্ষা গ্রহণ করে তিনি ‘দিন দুনা, রাত চৌগুণা’ সাধন—ভজনে সময় কাটাতে লাগলেন। পরবর্তীকালে এই মীরাবাঈ তাঁর একাধিক পদে গুরু রৈদাসের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন। তিনি লিখেছেন—
”রৈদাস সন্ত মিলে সতগুরু।
গুরু মিলিয়া রৈদাস জী দীন্হী জ্ঞান কী গুটকী।
মীরানে গোবিংদ মিলা জী গুরু মিলিয়া রৈদাস।”
গুরুর উপদেশ লাভ করে মীরা তখন আধ্যাত্মিক চেতনায় আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন। সংসার—জীবনের প্রতি কোনওকালেই তাঁর বিন্দুমাত্র আকর্ষণ ছিল না, এখন তাঁর অন্তরে ভক্তিভাবের আগুন শিখা দাউদাউ জ্বলে উঠেছে। আধ্যাত্মিক উন্নতির পাশাপাশি তাঁর নাম, যশ এবং প্রতিষ্ঠা চারদিকে পরিব্যাপ্ত হল। তাঁকে সম্মানিত করা হল ‘হিন্দুবাণী সুরজ’ উপাধিতে। এই সময় দূর—দূরান্ত থেকে অনেক সাধু—সন্ন্যাসী তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য ওই মন্দির প্রাঙ্গণে উপস্থিত হতে লাগলেন। তাঁরা এসে মীরার সাথে অন্তরঙ্গ আলাপনে মগ্ন থাকতেন। মীরার মুখনিঃসৃত এক—একটি বাক্যের মধ্যে যে তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞান লুকিয়ে আছে, তা পর্যবেক্ষণ করে তাঁরা অবাক হয়ে যেতেন। মীরাও পরমানন্দে এইসব সাধু—সন্ন্যাসীদের সেবা করতেন। তাঁর কেবলই মনে হতো, এইভাবেই বুঝি তিনি ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের পথে এক পা এক পা করে এগিয়ে চলেছেন।
মীরাকে দেখে তখন মনে হতো—তিনি বুঝি চিরবিরহিনী। সবসময় তাঁর পায়ে থাকত ঘুঙুর, হাতে তানপুরা এবং করতাল। তিনি ঈশ্বরপ্রেমে আপ্লুত হয়ে নৃত্য এবং গীত প্রদর্শন করতেন।
রাণা বিক্রমজিৎ তাঁর এই আচরণে যথেষ্ট বিরক্তি বোধ করেছিলেন। তিনি বারবার মীরাকে অনুরোধ করেছিলেন যে, মীরা যেন এখন থেকে আর কোনও সাধুসঙ্গ না করেন। মীরা দেবরের কথায় কর্ণপাত করলেন না। অনেক বছর ধরে তিনি এই পথের পথিক, তাছাড়া বিক্রমজিতের স্বভাব—চরিত্র সম্পর্কে সব খবর তাঁর জানা ছিল। তিনি কেন এমন এক দুর্বিনীত দুশ্চরিত্র লোকের কথায় কান দেবেন?
দেখা দিল দু’জনের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সংঘাত। শুধু তাই নয়, রাণা চম্পা ও চামেলি নামে দুই সুচতুর স্ত্রীলোককে মীরার তদারকির কাজে নিযুক্ত করলেন। এই দুই রমণীর ওপর একটি বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তারা সবসময় মীরার আচরণের ওপর নজর রাখত। মীরা সারাদিন কী করছেন, কার সাথে কথা বলছেন, সব খবর গোপনে রাণার কাছে পাঠানোর চেষ্টা করা হতো। চম্পা ও চামেলি নানাভাবে মীরার মন পরিবর্তনের চেষ্টা করে। রাজবধূ হয়ে তিনি কেন এইভাবে পথের ভিখারিদের সাথে মেলামেশা করেন, এর জন্য মীরার কাছ থেকে কৈফিয়ত তলব করে। মীরা বুঝতে পেরেছিলেন, এভাবেই নন্দলালা তাঁকে একটির পর একটি অগ্নিপরীক্ষার সামনে নিয়ে আসবেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধৈর্য্যশীলা রমণী। জীবনে কখনও কারও প্রতি সামান্যতম রাগ প্রদর্শন করেননি। আসলে তাঁর কাছে এসব বিষয় ছিল অত্যন্ত তুচ্ছ। তিনি জানতেন, জীবনধারণ করতে হলে এইসব সমস্যার সামনে তাঁকে দাঁড়াতেই হবে। তা বলে ভেঙে পড়লে চলবে না। কীভাবে সমস্যা সমাধান করা যায়, সেই পন্থা অন্বেষণ করতে হবে। তিনি বলতেন—আমি জানি, তোমাদের কোনও দোষ নেই, তোমরা তো রাণার গুপ্তচর। কিন্তু আমার ওপর কী নজর রাখবে? তোমরা কি জানো আমার মন উড্ডীয়মান পাখির মতো কোন দূর—দূরান্তে চলে গেছে? আমার শরীরটা শুধু এখানে পড়ে আছে। আমি আমার নন্দলালার সঙ্গে সব সময় কাটাই, আমি গিরিধারীলালকেই ভালোবাসি। এতে যদি কোনও অন্যায় হয়ে থাকে, তাহলে আমি দোষী।
একদিন কথায় কথায় চম্পা ও চামেলির কাছে নিজের মনোগত বাসনার কথা খুলে বলেছিলেন মীরাবাঈ। তিনি বলেছিলেন, শোনো, এ হল আমার অন্তরের কথা, আমি কারও বারণ কোনওদিন শুনিনি, আজও শুনব না। আমি সাধুসঙ্গে বাস করে অনন্ত আনন্দ লাভ করব, তোমাদের রাণার সাধ্য কি, আমাকে তিনি সেই আনন্দসাগর থেকে দূরে সরিয়ে দেবেন? আমার ধনসম্পত্তি এবং শরীর—সব কিছু যদি বিনষ্ট হয়, আমি বিন্দুমাত্র দুঃখ পাব না, যদি কৃষ্ণনাম করার অপরাধে তোমাদের রাণা আমায় হত্যা করেন, আমি হাসিমুখে তাঁর এই শাস্তি মাথায় পেতে নেব। আমার মন এখন প্রভু গিরিধারীর সঙ্গে রত, তাই আমি যে কোনও নিন্দা হাসতে হাসতে সহ্য করব।
কথা বলতে বলতে মীরাবাঈয়ের মধ্যে কেমন একটা আধ্যাত্মিক চেতনার উদয় হল। চম্পা ও চামেলি এতদিন মীরাবাঈয়ের আধ্যাত্মিক সাধনা সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছিল। তারা ভেবেছিল, এ বুঝি গুজব, কিন্তু এখন চোখের সামনে রাজবধূর এই পরিবর্তন দেখে তারা ভয় পেয়ে গেল। তখন মীরাবাঈ বুঝি সত্যি সত্যি বৈকুণ্ঠলোকের বাসিন্দা হয়ে গেছেন। বেজে উঠল তাঁর তানপুরা। শোনা গেল নূপুরের নিক্কণ। তখন তিনি একমনে গাইছেন—
”বরজি মৈঁ কাহ কী নাহিঁ রহূঁ।। টেক।।
সুনো রী সখী তুম চেতন হোই কে, মন কী বাত কহুঁ।। ১।।
সাধ সংগতি করি হরি সুখ লেউঁ, জগ সূঁ মৈঁ দূরি রহূঁ।। ২।।
তন ধন মেরো সবহী জাবো, ভল মেরো সীস লহূঁ।। ৩।।
মন মেরো লাগো সুমিরণ সেতী, সব কো মৈঁ বোল সহূঁ।। ৪।।
মীরা কহে প্রভু গিরধর নাগর, সতাগুরু সরণ রহূঁ।। ৫।।
—আমি আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত সঙ্গীতের মাধ্যমে অতিবাহিত করব, আমি গানের মাধ্যমে আমার প্রভু গিরিধারী নাগরের সান্নিধ্য পাব। যদি আমার এই আচরণে তোমাদের প্রভু সমাজপতি ক্রদ্ধ হন, তাহলে আমি নিরুপায়। তোমরা আমার মনের কথা তাঁকে জ্ঞাপন করো। তোমরা বলো, তিনি কোনওভাবেই আমাকে প্রভাবিত করতে পারবেন না। আমি মীরা, আমি বলছি, আমি আমার প্রভুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে বাস করব। তাঁর মতো সাধারণ মানুষের সাধ্য কি, আমাকে এই পথ থেকে দূরে ঠেলে সরিয়ে দেয়।
অবশেষে চম্পা ও চামেলি মীরার এই সাধন—প্রণালীর অলৌকিকত্ব বুঝতে পেরেছিল। তাদের নিযুক্ত করা হয়েছিল মীরার সন্দেহজনক আচরণের ওপর নজর রাখতে। কিন্তু মীরার শুদ্ধ আধ্যাত্মিক গুণের প্রভাবে তাদের মধ্যে পরিবর্তন ঘটে গেল। তখন থেকে তারা হল মীরার আধ্যাত্মিক জীবনের সাহায্যকারিণী। এমনকি এরপর থেকে মন্দির প্রাঙ্গণে এক আশ্চর্য দৃশ্যের অবতারণ ঘটে গেল। যখন মীরা ভাবোন্মাদে উন্মাদিনী হয়ে গিরিধারীর ভজন গাইছেন, তখন তারাও তাঁর সঙ্গে সঙ্গত করত। সে এক আশ্চর্য দৃশ্য। তিনজন রমণী ভাবাবেগে উন্মাদিনী হয়ে গেছেন। তাঁদের চোখ দিয়ে নির্গত হচ্ছে ভক্তিপূর্ণ জলধারা। নন্দলালা বুঝি সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছেন।
অনতিবিলম্বে এই ঘটনার কথা রাণার কানে পৌঁছে গেল। তিনি ভাবতেই পারেননি যে, বারবার তাঁকে মীরার হাতে পরাজয় বরণ করতে হবে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে আর এক দাসীকে পাঠালেন মীরাকে সংযত করার জন্য। সেই দাসী গিয়ে মীরার কাছে মহারাণার শেষ আদেশ শুনিয়ে দিয়েছিল। সে মুক্ত কণ্ঠস্বরে বলেছিল—আপনি রাজবধূ, সম্মানের অধিকারিণী, কিন্তু আপনি এমন আচরণ করছেন যে, আপনার সাথে কথা বলতেও আমি ঘৃণা বোধ করছি। শুনুন, আমাদের মহারাণা শেষবারের মতো আপনাকে সতর্ক করে দিচ্ছেন, আপনি যদি এইভাবে আপনার বেয়াদপি চালিয়ে যান, তাহলে কঠিন শাস্তির সামনে দাঁড়াতে হবে।
মীরা শান্ত মনে দাসীর এই উপদেশ শ্রবণ করলেন। মনকে সংযত রাখলেন, তিনি জানেন যে, তাঁর সব ইচ্ছার কথা জানিয়ে তাঁকে একটা গান বাঁধতে হবে। এই গানটিকে তিনি প্রতিবাদ পত্র হিসাবে রাণার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মধ্যে এক আশ্চর্য ভাবতন্ময়তার সঞ্চারণ ঘটে গেল। তখন সবেমাত্র শেষ বিকেলের অলক্তক রাগে সুসজ্জিতা হয়ে উঠেছে বসুন্ধরা। আকাশের বিরাট প্রেক্ষাপটের ওপর একটি দুটি তারার ঘুম ভাঙছে। মীরা ভাবাচ্ছন্ন অবস্থায় লিখলেন—
”রাণাজী হুঁ অব ন রহূঁগী তোরী হটকী।
সাধ সংগ মোহি প্যারা লাগৈ, লাজ গঈ ঘুঁঘট কী।।
পীহর মেড়তো ছোড়া অপনা সুরত নিরত দৌউ চটকী।
সতগুর মুকর দিখায়া ঘটকা, নাচুঁগী দে দে চুটকী।।
হার সিঁগার সভী ল্যো অপনা, চূড়ী কর কী পটকী।
মেরা সুহাগ অব মোকূঁ দরসা, ঔর ন জানে ঘটকী।।
মহল কীলা রাণা মোহিঁ ন চহিয়ে, সারী রেসম পট কী।
হুঈ দিবানী মীরা ডৌলে, কেস লটা সব ছিটকী।।”
—হে রাণা, আপনার সাধ্য কি, আপনি আমায় নিয়ন্ত্রণ করেন, আমি পরিষ্কারভাবে আমার মনোগত বাসনার কথা আপনাকে জ্ঞাপন করছি, আমি কোনওদিন আপনার অধীনে ছিলাম না, আর থাকবও না। সাধুসঙ্গ আমার ভালো লাগে, ভেবে দেখবেন, আমি আমার ঈশ্বরকে লাভ করার জন্য লজ্জাবরণ ঘোমটা হাসতে হাসতে ত্যাগ করেছি। আমি আমার জন্মভূমি মেড়তা ছেড়েছি, নিজের মা—বাবার সঙ্গে আমার দেখা হয় না। তাঁদের স্নেহ—মায়া—মমতা—সব কিছু কোথায় হারিয়ে গেছে। আমার ভেতর এক সদগুরু আছেন, তিনি আমাকে সর্বদা আশীর্বাদ করছেন। আমার মনের আয়নায় তাঁর মুখচ্ছবি দেখতে পাই, আমি মনের আনন্দে তাঁর সান্নিধ্যে থাকব এবং নাচ—গানের মাধ্যমে ঈশ্বরের আরাধনা করব। আপনি আমার অলঙ্কার—পোশাক—পরিচ্ছদ, সবকিছু নিয়ে নিন। আমার ভেতর একজন স্রষ্টা বিরাজ করছেন। তাঁর সান্নিধ্যেই আমার পরম তৃপ্তি। আর আমি আমার শরীর সম্পর্কে কোনও কিছু ভাববো না। রাণা, আমি রাজপ্রাসাদ চাই না, পট্টবস্ত্র চাই না। আপনাদের মীরা এখন সাধুদের সঙ্গে নিয়ে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াবে। আপনার সাধ্য কি, আপনি তার চলার পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারেন।
রাণা ভাবতে পারেননি, মীরার মতো এক বিধবা তাঁর বিরুদ্ধে এভাবে রুখে দাঁড়াবেন। এখনই মীরার এই তেজ ভাঙতে হবে। না হলে প্রজামহলে তিনি এক অকর্মণ্য নপুংসক রাজা হিসাবে চিহ্নিত হবেন। মীরাবাঈয়ের অধ্যাত্ম সাধনার সামনে কীভাবে প্রতিবন্ধকতা খাড়া করা যায়, রাণা তখন সেই চিন্তায় বিভোর। অথচ তাঁর ভূখণ্ডে সামান্যতম শান্তি নেই। সেদিকে রাণার নজর পড়ে না। সীমান্ত সম্পূর্ণ অরক্ষিত, যে কোনও মুহূর্তে বিদেশি শত্রু সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। সেনাপতিদের মধ্যে চাপা গুঞ্জন দেখা দিয়েছে। প্রজাদের মধ্যে কেউ কেউ আঞ্চলিক শাসনকর্তা হয়ে উঠেছেন। রাণা কিন্তু এইসব প্রশাসনিক কাজ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। মীরার ক্ষতিসাধন করাই তাঁর জীবনের ধ্যান—জ্ঞান—সাধনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মীরার নামে মানুষ নানা কথা বলছে, এতে তাঁর আত্মসম্মানে ঘা লেগেছে। হাজার হোক, মীরা তো এই পরিবারের বধূ। মীরাকে কেউ কলঙ্কিতা বললে রাণা তা সহ্য করবেন কি করে? অথচ সরাসরি তিনি তাদের বিরুদ্ধাচরণ করতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত রাণা একটি অত্যন্ত ঘৃণ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। তিনি স্থির করলেন, মীরা যখন তাঁর আনুগত্য স্বীকার করছেন না, তখন মীরাকে এই পৃথিবী থেকে চিরতরে দূরে সরিয়ে দিতে হবে।
শুরু হল তাঁর গোপন ষড়যন্ত্র। কীভাবে মীরাকে হত্যা করা যায় তার পরিকল্পনা রচিত হল ধীরে ধীরে। এটি হবে এমন এক কাজ যেখানে রাণার নাম কেউ উচ্চারণ করতে পারবে না। রাণা নিষ্কলঙ্ক থেকে যাবেন, অথচ সকলের অজান্তে সরে পড়বে একটি প্রস্ফুটিত রক্তগোলাপ!
খবর পৌঁছোল রাণার বোন উদাবাঈয়ের কানে। উদাবাঈ মীরার প্রতি সহানুভূতিসম্পন্না ছিলেন। হয়তো এক অনুভূতিশীলা মহিলা বলে তিনি মীরার মনোগত অবস্থানের কথা বুঝতে পারতেন। অনেক দিন ধরেই তিনি মীরাকে চেনেন। তিনি জানেন, মীরা কখনও পরপুরুষের সাথে সামান্যতম অশালীন আচরণ করেন না। তবে হ্যাঁ, মীরা সাংসারিক কাজকর্মের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ বোধ করেন না, একথা সত্যি। তাঁর সমস্ত দিন কাটে মন্দির প্রাঙ্গণে। রাজপুত ঘরের রাজবধূ হওয়া সত্ত্বেও তিনি মুখে ঘোমটা টানেন না। এইসব বিষয়গুলি উদাবাঈয়েরও ভালো লাগে না। শেষ পর্যন্ত উদাবাঈ ঠিক করলেন, তাঁকে এখন আসরে প্রবেশ করতে হবে। নাহলে সর্বনাশ ঘটে যাবে। ভাইয়ের স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি জানেন, তাঁর ভাই এই বংশের কলঙ্ক। যদি সত্যি সত্যি মীরাকে হত্যা করা হয়, তার অভিশাপে এই বংশ একেবারে শেষ হয়ে যাবে।
সেদিন নিভৃতে দু’জনের মধ্যে অনেক আলাপ আলোচনা হল। শেষ অব্দি রাণা তাঁর সঙ্কল্প থেকে কিছুদিনের জন্য সরে আসার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। এই অবসরে উদাবাঈ মীরার মনে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করবেন। শুরু হল সেই কাজ।
উদাবাঈয়ের সঙ্গে মীরাবাঈয়ের সম্পর্ক সখ্যের। মাঝে মধ্যেই উদাবাঈ এসে মীরার শরীর—স্বাস্থ্য সম্পর্কে খবর সংগ্রহ করতেন। সেদিন একেবারে সকালবেলা উদাবাঈ হাজির হলেন মীরার কক্ষে। কী আশ্চর্য, এখনও অনেকের ঘুম ভাঙেনি, আর মীরা কিন্তু অপলক চোখে তাঁর নন্দলালাকে প্রত্যক্ষ করছেন। এ দৃশ্য দেখে উদাবাঈয়ের মন কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল। এমন এক মহীয়সী রমণীর পাশে বড্ড সাধারণা বলে মনে হয়েছিল তাঁর। সঙ্গে সঙ্গে ভাইয়ের কুটিল কঠিন মুখখানা মনে পড়ে গেল উদাবাঈয়ের। হাতে বেশি সময় নেই। এই সময়ের মধ্যে উদাবাঈ যদি মীরার মন পরিবর্তন করতে না পারেন, তাহলে সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটে যাবে।
উদাবাঈ বললেন—মীরা, আজ এত সকালে তোমার কাছে কেন এসেছি জানো?
মীরার অকলঙ্ক মুখে প্রথম সূর্যের আলো। চোখের তারায় অতলান্ত গভীরতা। তিনি তাঁর শান্ত কণ্ঠস্বর ভাসিয়ে দিলেন সকালের বাতাসে। বললেন—কেন, বলুন তো? অবশ্য আপনি এখানে আসবেন, তার জন্য এত কথা বলার কি আছে?
উদাবাঈ বললেন—তোমার আচরণে সারা শহরের মানুষ তোমার নিন্দা করছে। শুধু তাই নয়, অনেকে এই রাজকুলের ওপর কলঙ্ক আরোপ করছে। আমি আগেও বলেছি, আবার বলছি, তুমি রাজকুলবধূ, আমাদের নয়নের মণি, তুমি সাধু—সন্ন্যাসীদের সঙ্গ পরিত্যাগ করো। ইচ্ছে হলে তুমি মন্দিরে বসে তোমার নন্দলালার ধ্যান করতে পারো। এতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু এমন আচরণ কেন করছো?
একটু থেমে উদাবাঈ আবার বললেন—তুমি তো আমার ভাইয়ের নিষ্ঠুর স্বভাব সম্পর্কে জানো। সে কিন্তু তোমার ওপর খুবই রেগে আছে। বলা যায় না, হঠাৎ কি করে বসে।
এই কথাগুলি শোনার সঙ্গে সঙ্গে মীরাবাঈয়ের মুখমণ্ডলে এক আশ্চর্য নির্লিপ্তির ছায়া পড়ল। মনে হল তিনি যেন অনেক দূর থেকে ভাসিয়ে দিয়েছেন তাঁর কণ্ঠস্বর। বাতাস—সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে সেই কণ্ঠস্বর পৌঁছে গেল উদাবাঈয়ের কানে।
মীরা বললেন—দেখুন, আপনি আমার বয়োজ্যেষ্ঠা। আপনাকে আমি বরাবর শ্রদ্ধা ও সম্মান করে এসেছি। একটা কথা নিশ্চিত জেনে রাখুন, আমি সাধু—সঙ্গ করতে ভালোবাসি। আমার চোখে সাধুরা হলেন ঈশ্বরের প্রতিভু। তাঁরা আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। তাঁদের মুখনিঃসৃত এক—একটি অমৃতবাণী শ্রবণ করে আমার মন—আকাশ হাজার সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। আমি দিবারাত্র সাধুদের চরণের শরণ নিয়ে থাকব। আপনি যদি একথা রাণাকে বলতে চান, আমি বাধা দেবো না। আমার প্রভু এখন গিরিধারী। আমি সাধুদের হাতে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করেছি।
এই কথা বলে মীরা একটি ছোট্ট পদ শুনিয়েছিলেন উদাবাঈকে। তিনি বলেছিলেন—
”সাধু মাত-পিতা কুল মেরে, সজন সনেহী জ্ঞানী।
সন্ত চরণ কী সরন রৈণ দিন, সত্ত কহত হূঁ বাণী।।
রাণা কো সমঝরো জারো, মৈঁতো বাত ন মানী।
মীরাকে প্রভু গিরধর নাগর, সন্তােঁ হাথ বিকানী।।”
উদাবাঈ ভাবতে পারেননি যে, তাঁকে এমন কথা শুনতে হবে। তবে তিনি আশা ছাড়লেন না। সময় ও সুযোগ পেলেই মীরার সঙ্গে সাক্ষাত করতেন। মীরার কার্যকলাপের ওপর থাকল তাঁর নজর। তিনি পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারলেন, মীরার মনের ভেতর কোনও কলঙ্ক নেই। সত্যিই তিনি সাধুসঙ্গ করতে ভালোবাসেন। শুধু তাই নয়, গোপনে চিকের আড়ালে লুকিয়ে থেকে মীরা আর সাধুদের কথোপকথন শুনেছিলেন। মীরার মুখনিঃসৃত এক—একটি বাক্যের মধ্যে যে দার্শনিক অভিজ্ঞান লুকিয়ে আছে, তা অনুধাবন করে তিনি একেবারে বিস্মিত হয়ে যান। সেই অর্থে মীরার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে কিছু নেই। কিন্তু তিনি এত জ্ঞানী হয়ে উঠলেন কী করে!
দিন কাটতে থাকে। উদাবাঈয়ের মন—আকাশে ঝড় ওঠে। একদিন হঠাৎ দিবাবসানে অস্তরাগের সূর্যের দিকে তাকিয়ে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ভাবলেন, হায়, আমার যৌবন—সূর্য তো ধীরে ধীরে অস্তাচলের দিকে এগিয়ে চলেছে, আজ বাদে কাল আমি আর এই পৃথিবীতে থাকব না, কিন্তু এখানে এসে আমি কি করলাম? তখন মীরাকে বড়ো বেশি ভাগ্যবতী বলে মনে হয়েছিল তাঁর। মনে হয়েছিল মীরার পথই আসল পথ। এই বিষয়—আশয়—সম্পত্তি—অহঙ্কার মাহূর্তিক। আজ বাদে কাল এর কোনও কিছুর অস্তিত্ব থাকবে না। কিন্তু আকাশে—বাতাসে থেকে যাবেন ওই নন্দলালা। তখন থেকে উদাবাঈ মীরার এক অনুরাগিনীতে পরিণত হন। এমনকি দেখা গেল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। মন্দির প্রাঙ্গণে বসে মীরা আপন মনে গান গাইছেন। তাঁর কণ্ঠনিঃসৃত এক—একটি শব্দ বুঝি স্বর্ণালঙ্কার হয়ে তাঁর নন্দলালাকে বিভূষিত করছে। তাঁর পাশে চোখ দুটি বন্ধ করে বসে আছেন উদাবাঈ। মাঝেমধ্যে গানের সঙ্গে গলা দিচ্ছেন। সে এক অপূর্ব দৃশ্য।
সংবাদ পৌঁছোল রাণার কানে। রাণা নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারেননি। যে উদাবাঈকে তিনি পাঠিয়েছিলেন মীরার মন পরিবর্তনের জন্য, সেই উদাবাঈ কিনা শেষ পর্যন্ত এক বিশ্বাসঘাতিনী হয়ে গেলেন? অবশেষে স্বচক্ষে এই দৃশ্য দেখে রাণার অন্তরে আগুন জ্বলে উঠল। তিনি একটি কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। অনেক হয়েছে, আর নয়, এখনই মীরাকে হত্যা করতে হবে। অবশ্য তাঁকে যাতে কেউ দোষী সাব্যস্ত করতে না পারে সেভাবেই কাজটা সমাধা করতে হবে।
অবশেষে তিনি এক অভিনব পন্থা নির্ধারণ করলেন। তিনি জানেন, ঈশ্বরের প্রতি মীরার অগাধ অনুরাগ। তাই চরণামৃতের মধ্যে ভয়ঙ্কর বিষ মিশিয়ে দেওয়া হল। ডেকে পাঠানো হল মন্দিরের প্রধান পুরোহিত দয়ারাম পাণ্ডাকে। দয়ারাম যখন রানার কাছ থেকে এই সংবাদ শুনেছিলেন, তাঁর সমস্ত শরীরে দেখা দিয়েছিল এক বিচিত্র শিহরণ। তিনি মনে প্রাণে ঈশ্বর—অনুগত। আর তাঁকে কিনা রাজাদেশ মানতে গিয়ে এমন একটি ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে যুক্ত হতে হবে!
তিনি করজোড়ে বলেছিলেন—মহারাণা, আমি এই মুহূর্তে আপনার রাজ—পুরোহিতের পদ পরিত্যাগ করছি। আমি এখন থেকে আর মেবার রাজ্যে থাকব না। অনুগ্রহ করে আমাকে এমন পাপ কাজের সঙ্গে যুক্ত করবেন না। তাহলে ঈশ্বর আপনাকে ক্ষমা করবেন না।
দয়ারাম পাণ্ডার এই কথা শুনে রাণা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। তিনি চিৎকার করে বললেন—শুনুন পুরোহিত মশাই, দীর্ঘদিন ধরে আপনাকে আমি যথেষ্ট সেবা যত্ন করেছি। আপনার পরিবারের বসবাসের জন্য একটি সুরম্য অট্টালিকা নির্মাণ করে দিয়েছি। অনেক দিন আপনি আমার নুন খেয়েছেন, এখন আমার গুণ তো গাইতেই হবে। মনে রাখবেন, আপনাকে আমি নির্বাচন করেছি এই জন্য যে, আপনার ওপর মীরার অগাধ আস্থা। আপনি যা কিছু দেবেন মীরা চোখ বন্ধ করে তা গ্রহণ করবে। বাইরে যাবার পথ বন্ধ।
অবাক হয়ে দয়ারাম তাকালেন, সত্যি তো, বীর পালোয়ানরা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শেষ অব্দি দয়ারাম তাঁর বিবেককে হত্যা করে ওই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে বাধ্য হলেন। তাঁর হাতে সুবর্ণপাত্রে বিষ মেশানো চরণামৃত তুলে দেওয়া হল।
রাণার এই ষড়যন্ত্রের কথা উদাবাঈয়ের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। উদাবাঈ যথাসময়ে মীরাকে গিয়ে সাবধান করে দিয়ে আসেন। কী আশ্চর্য, এ কথা শোনা সত্ত্বেও মীরার চোখে—মুখে এক নিস্পৃহতার ছাপ। এই মেয়েটি কে? তিনি কি সত্যিই মহাকাশের কন্যা? তিনি কি ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্যা? মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও যাঁর মধ্যে শঙ্কা শিহরণের জন্ম হয় না। তাঁকে আমরা ভয় দেখাব কেমন করে?
মীরা বললেন—আপনি কিছু ভাববেন না। আমি ভগবানের নাম করে যদি বিষ পান করি, তা আমার কাছে অমৃত হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, চরণামৃত বলে কোনও কিছু আমার কাছে আনা হলে আমি তা বর্জন করব কেমন করে? তাহলে তো আমার নন্দলালা কষ্ট পাবেন।
উদাবাঈ বুঝতে পারলেন এই উন্মাদিনীকে বোঝানো তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তখন তিনি একমন হয়ে ঈশ্বরের আরাধনায় মগ্না হলেন। তিনি বললেন—হে ভগবান, এ মেয়েটিকে তুমি রক্ষা করো। এই মেয়েটির শুধু বয়স হয়েছে। কিন্তু বিচারবুদ্ধি এখনও পরিপক্ব হয়নি। না হলে কেউ সব জেনেশুনে বিষ পান করতে রাজি হয়!
অবশেষে এল সেই মহামুহূর্তটি। দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছিলেন উদাবাঈ। যথাসময়ে দয়ারাম পণ্ডিত এসে মীরাকে সম্বোধন করে তাঁর হাতে সুবর্ণ পাত্র তুলে দিলেন। বললেন—মা, তোমার মঙ্গলার্থে এই চরণামৃত তোমার হাতে তুলে দিলাম। তুমি নন্দলালার নাম স্মরণ করে এটি গ্রহণ করো। দেখবে তোমার জীবনের জ্বালা—যন্ত্রণা একেবারে জুড়িয়ে যাবে।
কথা বলা শেষ করেই দয়ারাম অতি দ্রুত সেখান থেকে চলে গেলেন। তিনি নিজেকে কীভাবে প্রবোধ দেবেন? তাঁর দ্বারা জঘন্য হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতে চলেছে, হায় ঈশ্বর, শেষ পর্যন্ত তুমি আমার একি করলে? এই পুরস্কার পাব বলেই সারা জীবন ধরে এক মনে তোমার চরণ বন্দনা করে গেছি?
সে এক আশ্চর্য দৃশ্য, মীরা তাঁর দু’হাতে তুলে নিয়েছেন বিষপাত্র। তারপর শুরু করলেন তাঁর সঙ্গীত। নৃত্যরতা অবস্থায় প্রদক্ষিণ করলেন তাঁর নন্দলালাকে। ভাবে বিভোর হলেন। বললেন—
”পিয়া ম্হাঁরে নৈণা আগে রহজ্যো জী।।
নৈণা আগে রহজ্যো, ম্হাঁনে ভুল মত জ্যাজ্যো জী।।
ভৌসাগর মেঁ বহী জাত হূঁ, বেগ ম্হাঁরী সুধ লীজ্যো জী।।
রাণাজী ভেজা বীষ কা প্যালা, সো অমৃত কর দীজ্যো জী।
মীরা কে প্রভু গিরিধর নাগর, মিল বিছুরণ মত কীজ্যো জী।।”
—হে প্রিয়, এই মুহূর্তে তুমি আমার সামনে এসে দাঁড়াও। আমি যে জীবন আর মৃত্যুর মাঝে অবস্থিত একটি সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে আছি। তুমি এসো, আমি ভবসাগরে ভেসে যাচ্ছি, তুমি কেন আমাকে দেখছো না? রাণা আমাকে বিষপাত্র পাঠিয়েছেন, এর জন্য তাঁকে আমি দোষারোপ করছি না। তিনি তো তাঁর পথের কাঁটাকে চিরতরে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন। কিন্তু কই, তুমি এসে আমার এ বিষকে অমৃত করে দাও। হে মীরাপতি গিরিধারী নাগর, তুমি এখন আমার সাথে এমনভাবে মিলিত হও, যাতে বিচ্ছেদ এসে কোনওদিন আমাদের পৃথক করতে না পারে।
উদাবাঈয়ের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে বুঝি। তিনি ভাবলেন, শেষবারের মতো মীরাবাঈকে বারণ করবেন। মীরা যেন এই বিষ চরণামৃত গ্রহণ না করেন, অথচ তাঁর অবস্থা হয়েছে চিত্রার্পিতের মতো। ভজন শেষ হল।
মীরা ভক্তিসহকারে সেই বিষপাত্র তাঁর মস্তকে ধারণ করলেন। তাঁর সমস্ত মুখমণ্ডলে ফুটে উঠল এক আরক্তিম আভা। তিনি নিঃশঙ্কচিত্তে সমস্ত বিষ পান করলেন। কী আশ্চর্য! এমন ঘটনা যে ঘটতে পারে উদাবাঈ তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। মীরার শরীরের কোথাও বিষক্রিয়ার সামান্যতম ছাপ ছিল না। আগের মতোই থাকলেন তিনি। মনে হল তিনি বোধহয় ঈশ্বরপ্রেমে আরও বেশি মাতোয়ারা হয়ে উঠেছেন। হায়, এই কি প্রভুর লীলা? উদাবাঈ চোখ বন্ধ করলেন। মনে হল কোথায় যেন ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠেছে। আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে।
একটু বাদে মীরা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় আরও কয়েকটি পদ রচনা করেছিলেন। এই পদগুলি পাঠ করলে আমরা বুঝতে পারি তখন তাঁর মনোজগতে কি ধরনের বিস্ফোরণ ঘটে গিয়েছিল। তিনি বললেন—
”বিষ রা প্যালা রাণোজী ভেজ্যা, দীজো মেড়তনী কে হাথ।
কর চরণামৃত পী গঈ, ম্হাঁরা সকল ধনী কা সাথ।।
বিষ কো প্যালো কী গঈ, ভজন করে উস ঠৌর।
থাঁরী মারী না মরূঁ, মহাঁরী রাখনহারো ঔর।।”
—রাণা আমাকে বিষপাত্র পাঠিয়েছেন। আমার হাতে যখন সেই বিষপাত্র তুলে দেওয়া হল, তখন আমার মন—আকাশে আশঙ্কা—মেঘের ওড়াওড়ি দেখা দেয়নি। আমি সুনিশ্চিত, স্বয়ং লালা আমাকে সমস্ত বিপদের হাত থেকে রক্ষা করবেন। আমি যে আমার জীবনের প্রথম চেতন, প্রহর থেকে তাঁরই চরণে সবকিছু সমর্পণ করে বসে আছি। আমি ভাবলাম এ হল ঈশ্বরের চরণ অমৃত। আমি আমার প্রভুর সামনে তা পান করলাম। তারপর ভজন গান গাইতে লাগলাম। রাণা, মনে রাখবেন, আপনি কখনও আমাকে হত্যা করতে পারবেন না। কারণ আমার রক্ষাকর্তা হলেন আপনার থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী।
সেখানে মীরা আর একটি পদ রচনা করে বলেছিলেন—
”জহর কা প্যালা রাণা ভেজ্যা, অমৃত দীন্হ বনায়।
ন্হায় ধোয় জব পীরণ লাগী, হো অমর অঁচায়।।”
—রাণা আমাকে পাত্রে করে বিষ পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু ভগবান এক লহমায় তা অমৃতে পরিণত করে দিলেন। আমি যখন স্নান করে পান করলাম, মনে হল আমি বুঝি অমরত্ব লাভ করেছি।
এরপর থেকে মীরার ভগবত—সাধনা আরও তীব্র ও গভীর হয়ে ওঠে। তখন থেকে তিনি মুখে মুখে এমন পদ রচনা করতে থাকেন, যার দার্শনিক অভিজ্ঞান এবং আধ্যাত্মিক সৌকুমার্য আমাদের প্রতি মুহূর্তে অবাক করে দেয়। এই পদগুলির ভেতর যে রূপক এবং অনুপ্রাসের প্রয়োগ আছে, যা শুনে মনে হয়, মীরা বুঝি এক অত্যন্ত সাহিত্যমনস্ক কবি। নাহলে একটি শব্দের এত বিভিন্নমুখী ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করলেন কী করে?
তখন উদাবাঈয়ের মনোজগতে সত্যি সত্যি পরিবর্তন ঘটে গেছে। নিজেকে আর রাজনন্দিনী ভাবতে মোটেই ভালো লাগছে না তাঁর। তিনি তখন মনে—প্রাণে হয়েছেন মীরার অনুগামিনী। মীরা যখন মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেন, তাঁকে অনুসরণ করেন উদাবাঈ। মীরার মতো তিনিও দ্বিপ্রহরে কণামাত্র ভোজন করেন না। সন্ধ্যা—সমাগমে মীরা যখন শয়নকক্ষে যান, উদাবাঈ তখনই তাঁর নিজের ঘরে প্রবেশ করেন। এইভাবে দিন কাটতে থাকে। উদাবাঈয়ের সাহচর্য এবং সান্নিধ্য মীরাকে আরও বেশি উদ্দীপ্তা করে তুলেছে। উদাবাঈয়ের সামনে বসে মুখে মুখে তিনি এক—একটি অলৌকিক পদ রচনা করেন। সেই পদগুলি শুনতে শুনতে উদাবাঈ কেমন যেন হয়ে যান। নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে বলেন—হায়, আমি কেন মীরার মতো কবিত্ব শক্তির অধিকারিণী হলাম না! তা হলে তো আমিও এইভাবে নন্দলালাকে অর্চন করতে পারতাম।
মীরার অফুরান ঐশ্বর্যের পাশে নিজের দীনতা দেখে উদাবাঈ বড়োই দুঃখ পান। একদিন উদাবাঈয়ের এই মনোকষ্টের কথা মীরা বুঝতে পেরেছিলেন। মীরা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন—আপনি এমন করছেন কেন? আপনি তো আমার কাছে এক শ্রদ্ধেয়া ব্যক্তি। আমার গান শুনে আপনার মনের পরিবর্তন হবে, আপনি ঈশ্বরের সান্নিধ্য অনুভব করতে পারবেন একদিন। ভেবে দেখুন তো, এটাই কি কম বড়ো পাওয়া? পৃথিবীতে এমন ভাগ্যশালিনী নারী আর ক’জন আছেন? আসুন, মন খারাপ করবেন না। এই মুহূর্তে আমার সমস্ত শরীরে এক আশ্চর্য শিহরণ দেখা দিয়েছে। আমার দুটি ঠোঁটে দেখা দিয়েছে কম্পন। একটি পদ লেখার জন্য আমি ছটফট করছি। আপনি স্থির হয়ে বসুন, আমার এই পদটি শুনুন, তারপর না হয় এর বিচার করবেন।
এই ক’টি কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে মীরা কেমন যেন ভাবোন্মাদ অবস্থায় পৌঁছে গেলেন। অর্ধ—চেতন স্তরে পৌঁছে তখন তাঁর মুখ থেকে শোনা যাচ্ছে কয়েকটি অলৌকিক শব্দ। মনে হল তিনি এইভাবে বোধহয় শব্দসম্ভারে তাঁর প্রিয় নন্দলালাকে সাজিয়ে দেবেন।
মীরা বললেন—
”জব সে মোঁহি নন্দ নন্দন দৃষ্টি পড়্যো মাঈ।
তব সে পরলোক লোক কছু না সোহাঈ।।
মোরন কী চন্দ্রকলা সীস মুকুট সোহৈ।
কেসর কো তিলক ভাল তীন লোক মোহৈ।।
কুণ্ডলকী অলক ঝলক কপোলন পর ছাঈ।
মনো মীন সররর তজি মকর মিলন আঈ।।
কুটিল ভূকুটি তিলক ভাল চিতরণ মেঁ ঢৌনা।
খঞ্জন অরু মধুপ মীন ভুলে মৃগ ছৌনা।।
সুন্দর অতি-নাসিকা সুগ্রীব তীন রেখা।
নটবর প্রভু ভেষ ধরে রূপ অতি বিসেষা।।
অধর বিম্ব অরুণ নৈন মধুর মন্দ হাঁসী।
দসন দমক দাঁড়িম দ্যুতি চমকে পেলা সী।।
ছুদ্র ঘণ্ট কিংকিনী অনূপ ধুনি সোহাঈ।
গিরিধর অঙ্গ অঙ্গ মীরা বলি জাঈ।।”
—যখনই তোমার ওপর আমার দৃষ্টি পড়ে, তখনই আমি বুঝতে পারি জীবন—মৃত্যু বলে এ সংসারে কিছু নেই। তোমার শীর্ষে চন্দ্রকলার মতো মুকুট শোভিত। তোমার তনুবাহার পদ্মৈশ্বর্য অলঙ্কারে সজ্জিত। তুমি কী অনুপম মূর্তিতে আমার সামনে আবির্ভূত হয়েছো। তোমার সাথে মিলনের জন্য আমার সর্বাঙ্গ উদগ্রীব হয়ে উঠেছে।
হে আমার ঈশ্বর, তুমি কেন এইভাবে তোমার ভ্রূ—ভঙ্গিতে বিস্ময় চিহ্ন এঁকেছো? তোমার অঙ্গের সাথে যুক্ত হয়ে আছে হরিণের গতি। তোমার নাসিকা অত্যন্ত তীব্র, তোমার মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তি অসাধারণ। হে নটবর, তুমি রূপে—রূপান্তরে আমার সামনে আবির্ভূত হও। তোমাকে দেখে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ উপমাগুলি আমার মনে পড়ে যায়। তোমাকে দেখে প্রকৃতির রাজ্যে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা আমার স্মরণে আসে। তোমাকে আমি অত্যন্ত ভালোবাসি। হে আমার গিরিধারী, তুমি তোমার মীরার কাছে কবে আসবে?
দেখতে দেখতে দিন এগিয়ে চলে। একদিন উদাবাঈ তাঁর মনোগত একটি বাসনার কথা জানালেন প্রিয়তমা মীরাবাঈকে। তিনি বললেন—মীরা, আমি তোমার অধ্যাত্ম সাধনা সবকিছু অবগত হয়েছি। আমি বুঝতে পেরেছি, তুমি সাধনার কোন স্তরে পৌঁছে গিয়েছো। তুমি যখন তোমার নন্দলালার সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপনে মেতে ওঠো, আমি ঝরোকার আড়াল থেকে তোমার দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকি। তোমার মুখমণ্ডলে তখন বিরাজ করে প্রভাত সূর্যের লালিমা। তোমার দুটি চোখে দেখি সাগরের অতলান্ত গভীরতা। মীরা, তুমি কেবল একটিবার তোমার নন্দলালার সাথে আমার পরিচয় করাও। তাহলে আমার জন্ম—জন্মান্তরের সাধনা সার্থক হবে। আমি অন্তত একবার স্থল—জল—অন্তরীক্ষের দেবতা শ্রীকৃষ্ণকে চোখের সামনে দেখব।
মীরাবাঈ উদাবাঈয়ের উদগ্র মনোবাসনার কথা জানতে পারলেন। নিজের ওপর অগাধ আস্থা ছিল তাঁর। তিনি যেভাবে প্রতিদিন তাঁর প্রিয়তম নন্দলালার সংস্পর্শে আসেন, ঠিক সেইভাবে উদাবাঈয়ের সাথে গিরিধারীর সম্পর্ক ঘটে যাবে। কিন্তু এর জন্য দীর্ঘ সাধনা প্রয়োজন। দরকার এক আকাশ ত্যাগ এবং এক সমুদ্র তিতিক্ষা। মীরাবাঈ অরণ্যের নিঃসীম অন্ধকারে বসে শরীরকে কষ্ট দিয়ে সাধনা করতে রাজি নন। এজন্য তাঁকে তুষারাবৃত মগ্ন মৈনাকের তলায় গিয়ে বসতে হবে না। তিনি সংসারের মধ্যে থেকেও হবেন চিরবিরহিনী। গানে গানে ঈশ্বরের আরাধনা করবেন। তিনি জানেন একদিন এই গানের টানে ঈশ্বর সাড়া দেবেন।
চম্পা, চামেলি আর উদাবাঈকে নিয়ে শুরু হল তাঁর সেই সঙ্গীত—সাধন। সেজন্য তিনি আগে থেকেও নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন। গিরিধারীলাল যেসব আহার্য খেতে ভালোবাসেন, সেগুলি সংগৃহীত হল। শুরু হল তাঁর কণ্ঠনিঃসৃত এক—একটি ভজন। মনে হল বাতাস সমুদ্রে বুঝি তীব্র আলোড়ন উঠেছে। মীরাবাঈ সুনিশ্চিত, এই কণ্ঠ যখন গিরিধারীর কর্ণে প্রবেশ করবে, তখন তিনি আর বৈকুণ্ঠে সুখশয্যায় শায়িত থাকতে পারবেন না। তখন তাঁকে ছুটে আসতেই হবে এই চিতোরে, এই মন্দির প্রাঙ্গণে শোনা যাবে তাঁর পদধ্বনি। এর আগে তিনি তো কতবার মীরাবাঈয়ের সামনে নিজের অপরূপ তনুবাহারকে উন্মুক্ত করেছেন। কত মধ্যনিশীথে বাতাস হয়ে প্রবেশ করেছেন মীরাবাঈয়ের শয়নকক্ষে। কত মধ্যদিনের নিদাঘ তপ্ত শুষ্কতার মধ্যে হয়েছেন স্রোতস্বিণী। আর আজ? হে প্রভু, তুমি আমার কথা শোনো, আমার মুখ রাখো, আমি যে বড়ো আশা করে উদাবাঈকে কথা দিয়েছি। তুমি এসো, নাহলে আমি ওদের কাছে মিথ্যাবাদী বলে প্রমাণিত হব।
হায়, এক অসহায়া রমণীর আর্তনাদ কি শেষ পর্যন্ত শ্রীকৃষ্ণের কানে পৌঁছেছিল? নাকি তখন তিনি প্রিয়তমা পত্নী লক্ষ্মী এবং প্রিয় সহচরী গোপিনীদের সাথে মত্ত ছিলেন বিনোদন খেলায়?
মীরাকণ্ঠ নিঃসৃত সঙ্গীত তখন বুঝি আকুল আর্তনাদে পরিণত হচ্ছে। তিনি যখন বললেন—হে দাসপম্হাঁরে, অর্থাৎ! হে প্রিয়তম স্বামী, অনুগ্রহ করে তুমি একবার আমার ঘরে এসো। তুমি ছাড়া সমস্ত জগৎ আমার কেমন খারাপ লাগছে। আমার এই তনু, মন ও ধন—সবই আমি তোমাকে উৎসর্গ করে দেবো। শুধুমাত্র তোমার ভজন করব। শয়নে—স্বপনে নিশি—জাগরণে তোমার মধুর মুখচ্ছবি আমার মনের পদর্যায় ভেসে উঠবে। হে স্বামী, তুমি গুণবান, গুণসাগর। আমার তো অনেক দোষ, আমি জানি আমি গুণবতী নই। আমার মধ্যে এমন কিছুই নেই, যা তোমাকে চমৎকৃত করতে পারে। তুমি তো সর্বগুণের আধার। হে ঈশ্বর, মীরা বলছে, তুমি আমার সঙ্গে কবে মিলিত হবে। তোমাকে না দেখে আমার একটি মুহূর্তও কাটছে না বুঝি।
সঙ্গীত শেষ হল। মন্দির প্রাঙ্গণে তখন বিরাজ করছে পিনপতন নীরবতা। মীরা উৎকীর্ণ হয়ে বসে আছেন। কই কখন, কখন শোনা যাবে তাঁর নূপুর নিক্কণ? কখন চোখের সামনে এসে দাঁড়াবে ওই শ্যাম তনুখানি।
মীরা আবার গাইলেন—
”প্যারে দরসন দীজ্যো আয়, তুম বিন রহ্যো ন জায়।। টেক।।
জল বিন কঁরল চংদ বিনরজনী,
ওই সে তুম দেঁখ্যা বিন সজনী।।
ব্যাকুল ব্যাকুল ফিরূঁ রৈণ দিন, বিরহ কলেজ্যো খায়।
দিবস ন ভূখ নীদঁ নহিঁ রৈণা, মুখ সূঁ কথত ন আরৈ বৈণা।
কহা কহঁ কুছ কহত ন আরৈ, মিল কর তপত বুঝায়।।
ক্যূঁ তরসারো অংতরজামী, আয় মিলো কিরপা কর স্বামী।
মীরাদাসী জনম জনম কী, পরী তুমহারে পায়।।”
—হে প্রিয়, দয়া করে একবার তুমি দর্শন দাও। তোমার অভাবে আমি আর বেঁচে থাকতে পারছি না। তোমার দর্শন অভাবে আমার অবস্থা হয়েছে জলবিহীন শতদলের মতো। আমি এখন চন্দ্রবিহীন সজনীর মতো নিষ্প্রভ হয়ে উঠেছি। তুমি না হলে আমার জীবনধারণ করা বৃথা। বিরহ আমার হৃদয়ের এখানে—সেখানে অসংখ্য ক্ষতের চিহ্ন এঁকেছে। দিনে আমার খিদে নেই, রাতে আমার ঘুম নেই, আমার মুখ দিয়ে কোনও শব্দ নিঃসৃত হচ্ছে না। কি বলব, কোনও কথাই আমি আর মনে করতে পারছি না। তুমি এসো, আমার সঙ্গে মিলিত হও। আমাকে বিরহ—আগুন থেকে রক্ষা করো। হে অন্তর্যামী, আমাকে কেন তুমি কৃপা করছো না? হে স্বামী, আমি মীরা, আমি জন্মে জন্মে তোমার অনুগামিনী, তোমার পায়ে পড়ি। দয়া করে একবার দেখা দাও।
শেষ পর্যন্ত মীরার এই আকুলতা পৌঁছে গেল চরম সীমায়। অবশেষে বুঝি ঘুম ভাঙল মহাত্মা বিষ্ণুর। তিনি বরাবরই যে কোনও সর্বনাশের হাত থেকে তাঁর ভক্তকে উদ্ধার করেছেন। শোনা গেল সেই মধুর পদধ্বনি। বাতাস বুঝি মুখরিত হল বংশীধ্বনিতে। চোখের সামনে শ্রীবিষ্ণুকে দেখে সকলে একেবারে অবাক হয়ে গেলেন। শুধু তাই নয়, মনে হল এই পুরুষ মূর্তি বুঝি কোনও কিছু আহার্য গ্রহণ করতে আগ্রহী। তাঁকে উদ্দেশ করে নিবেদিত সবকিছু তিনি ভোজন করলেন।
মন্দিরের চারপাশে ছিল রাণার নিযুক্ত প্রহরীরা। তারা হঠাৎ জাগ্রত হয়ে উঠল। এ কি? মন্দির—প্রাঙ্গণ থেকে পুরুষকণ্ঠ ভেসে আসছে কেন? সংবাদ পৌঁছে গেল রাণার কানে। রাণা দীর্ঘদিন ধরে এমনই আশঙ্কা করেছিলেন। তাঁর স্থির বিশ্বাস, এসব বিরহ হল মীরার বাইরের আবরণ। আসলে মীরা দুশ্চরিত্রা। মন্দির প্রাঙ্গণে নিভৃত নিরালায় প্রিয়তমের সাথে মিলিত হন। পাছে লোকে তাঁর এই অশালীনতাকে ধরে ফেলে, তাই এমন কৃষ্ণবিরহিনীর বেশ ধরেছেন।
সঙ্গে সঙ্গে উন্মুক্ত তরবারি হাতে ছুটে এলেন রাণা। সমস্ত শরীর দিয়ে তখন বুঝি আগুন বেরোচ্ছে। প্রবেশ করলেন মন্দির অঙ্গনে। অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি মেলে দিলেন চারপাশে। কিন্তু পুরুষ কোথায়? তার মানে মীরা কি এক শয়তানি? রাণাজি এখানে আসছেন, গোপন সূত্রে সে খবর হয়তো মীরার কানে পৌঁছে গেছে। অতি দ্রুত তিনি তাঁর প্রেমিককে সরিয়ে দিয়েছেন।
রাগে কাঁপতে থাকেন রাণা। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে গেছেন তিনি। মীরার কাছে এসে তীব্র কণ্ঠস্বরে কৈফিয়ত তলব করেন। বলেন—বাঃ মীরা, এতদিনে আমি তোমার আসল অভিসন্ধি বুঝতে পেরেছি। অবশ্য তোমার মতো দুশ্চরিত্রা নারী যে এমন আচরণ করবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। তুমি কি এক পতি নিয়ে সুখে—শান্তিতে সংসার করার জন্য এই পৃথিবীতে এসেছো? যেভাবে মানুষ তার পরিধেয় পাল্টায়, সেভাবে তুমি তোমার প্রেমিককে পরিবর্তন করো। বলো তোমার প্রিয়তমকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছো?
রাণার ওই রণমূর্তি দেখেও মীরার মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তির কোনও পরিবর্তন হল না। তিনি বললেন—আমার পরম বন্ধু গিরিধারীলাল তো আপনার সামনেই দণ্ডায়মান আছেন। আপনি সর্বত্র তাঁকে প্রত্যক্ষ করতে পারবেন। তিনিই আমার একমাত্র অভিভাবক। আপনার যা প্রশ্ন আছে, অনুগ্রহ করে তাঁর কাছে করুন।
রাণাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে মীরা তখন আবার ভজন গানে মাতোয়ারা হয়ে উঠলেন। বেজে উঠল তাঁর কণ্ঠ। শোনা গেল নূপুরের নিক্কণ। ভাব আবেশে মীরার চোখ দুটি বন্ধ হয়ে এল। মীরা তখন বলছেন—
”রাণাজী মৈঁ সাঁঝরে রঙ্গ রাঁচী।
সজ সিঙ্গার পগবাঁধ ঘূঁঘরূ, লোক লাজ তজ নাঁচী।।
গঈ কুমতি লহি সাধ কী সংগতি, ভক্ত রূপ ভই সাঁচী।
গায় গায় হরিকে গুণ নিসদিন, কাল ব্যাল সো বাঁচী।
উন বিন সব জগ খারো লাগত, ঔর বাত সব কাঁচী।
মীরা শ্রীগিরধর লাল সোঁ ভক্তি রসীলী জ্যঁচী।।”
—হে রাণা, আমি এখন শ্যামের প্রেমে মত্ত হয়েছি। আমি এখন বেশভূষা করে পায়ে ঘুঙুর পরে লোকলজ্জা পরিত্যাগ করে নৃত্যরতা। সাধুসঙ্গে থাকতে থাকতে আমার সমস্ত কুমতি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। আমি এখন প্রকৃত ভক্ত হয়েছি। আমি এখন অনুভব করছি ঈশ্বর সাধনার মধ্যে কোনও অলৌকিক মাহাত্ম্য লুকিয়ে আছে। হরিগুণ গাইতে গাইতে আমি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়েছি। রাণা, আপনি শত চেষ্টা করলেও আমাকে বিপথগামিনী করতে পারবেন না। শ্যাম ভিন্ন অন্য কোনও দেবতার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র আকর্ষণ নেই। জাগতিক কোনও বিষয় এখন আর আমার ভালো লাগে না। কোনও কথাবার্তা শুনতে খারাপ লাগে। মীরা একমাত্র গিরিধারীলালের কাছে প্রেম ভক্তি যাচ্ঞা করে।
রাণা তখন রাগে উন্মাদপ্রায় হয়ে উঠেছেন। চারপাশে সযত্ন দৃষ্টিক্ষেপ করলেন। কিন্তু সেখানে তো তাঁর পরিচিত স্ত্রীলোকরাই বসে আছেন। সেই পুরুষ কোথায়? হঠাৎ রাণার নজর পড়ল একপাশে রাখা একটি পালঙ্কের ওপর। সেখানে গিয়ে তিনি সবিস্ময়ে দেখলেন বিরাট আকৃতির এক পুরুষ সেখানে শুয়ে আছেন। এই পুরুষকে দেখে রাণা অত্যন্ত ভীত—সন্ত্রস্ত হলেন। মুহূর্তের মধ্যে তাঁর সংজ্ঞা হারিয়ে গেল। তিনি অচেতন হয়ে পড়লেন। বেশ কিছুটা সময় কেটে যাবার পর রাণার বুঝি ঘুম ভাঙল। তিনি মীরাকে বললেন—তুমি আমাদের কুলদেবতা একলিঙ্গের পুজো করো। তোমার ঈষ্টদেবতার মূর্তি দেখলে সমস্ত শরীরে ভয়ের কম্পন অনুভূত হয়। দোহাই তোমাকে, আর কখনও আমাকে যেন এমন অভিজ্ঞতার সামনে আসতে না হয়।
এই ক’টি কথা কোনওরকমে বলে রাণা সভয়ে সেই স্থান পরিত্যাগ করেছিলেন।
পাঁচ
তা সত্ত্বেও রাণার মনে সন্দেহের বীজ। যে করেই হোক মীরার মাহাত্ম্য ক্ষুণ্ণ করতে হবে। তার জন্য যদি তাঁকে আরও নীচ কাজ করতে হয়, তিনি পিছপা হবেন না। শেষ অব্দি ভাবতে ভাবতে স্থির করলেন কয়েকটি বিষধর সাপ পাঠাতে হবে ফুলের মঞ্জরীর মধ্যে। রাণা জানেন ঈশ্বর সংক্রান্ত যে কোনও বিষয়ে মীরার সীমাহীন আগ্রহ। তাই এই পন্থাটি নির্বাচন করা হল। একদিন ঝাঁপির ভেতর রাখা হল ফুল ও ফুলের মালা। তার মধ্যে থাকল কয়েকটি বিষধর সাপ। মীরা ইতিমধ্যেই এই ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরেছেন। এবার রাণা এত গোপনে এই ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়েছিলেন যে, তাঁর বোন উদাবাঈয়ের কানেও এই খবর প্রবেশ করেনি। অথচ আগের রাতে কৃষ্ণ মীরাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে সব কথা বলে গেছেন।
যথাসময়ে মীরার কাছে ওই ফুলের ঝাঁপি এসে পৌঁছোল। মীরা সেই ঝাঁপি সশ্রদ্ধচিত্তে গ্রহণ করলেন। সেটি মস্তকে ধারণ করলেন। আপন মনে কথা বলতে শুরু করলেন। তিনি বললেন—
”ডব্বামেঁ সালি গরাম বোলত কাহে নহিয়াঁ।
হম বোলত তুম বোলত নাহীঁ,
কাহে কো মৌন ধরে রহিয়াঁ।।
য়হ ভরসাগর আগম বড়ী হৈ,
কাঢ়ি লেঁহু গাহিকে বহিয়াঁ।
মীরা কে প্রভু গিরধর নাগর,
তুম হী মোর সহৈয়া।।”
—হে শালগ্রাম, আমি জানি ঝাঁপির মধ্যে তোমার অবস্থান। তোমার সঙ্গে আমি কত কথা বলছি। অথচ তুমি আমার একটি কথারও উত্তর দিচ্ছো না কেন? তুমি কি কোনও কারণে আমার ওপর রাগ করেছো? বলো কীভাবে তোমার রাগ কমাবো? এই ভবসাগর অগম্য। হে গিরিধারী, তুমি যদি আমার হাত না ধরো, তা হলে কীভাবে আমি তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ এই সাগর পার হব?
এ কথা বলতে বলতে মীরা সকলের সামনে ঝাঁপিটি খুললেন। দেখলেন সেখানে শালগ্রাম আছে, আর আছে সুগন্ধী ফুলের মালা।
যথাসময়ে দূত মারফত এই খবর পৌঁছোল রাণার কানে। রাণা আরও একবার পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। আহত বাঘের মতো গর্জন করতে লাগলেন তিনি।
সেদিনের মতো রাজদরবার বন্ধ করে দিলেন। শয়নকক্ষে প্রবেশ করে ভাবতে লাগলেন, কীভাবে আমি ওই রমণীকে জব্দ করব? কিছুতেই একে হত্যা করতে পারছি না কেন? তখনই সেই বিরাট পুরুষের কথা মনে পড়ে গেল রাণার। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন তিনি। আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। বেশ বুঝতে পারলেন তখন তাঁর মুখমণ্ডলে ভয়ার্ত ছবি আঁকা হয়েছে। কি আর করা যায়? অস্থিরভাবে পদচারণা করতে লাগলেন। একটির পর একটি পন্থা উদ্ভাবন করতেই হবে। রাণা সুনিশ্চিত একদিন না একদিন মীরার জীবনপাখি দূর আকাশে উড়ে যাবে। সেদিন মহাসমারোহে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের অয়োজন করবেন রাণা। ভাববেন, আজ থেকে তাঁর চলার পথ সম্পূর্ণ নিষ্কণ্টক হয়েছে।
মীরাবাঈ এক মনে ঈশ্বর সাধনা করেই চলেছেন। আগে মাঝে মধ্যে সঙ্গীত রচনা করতেন। এখন বোধহয় দেবী সরস্বতী তাঁর হৃদসাগরে উপবেশন করেছেন। না হলে এত অল্প সময়ে এমন দার্শনিক অভিজ্ঞানসম্পন্ন পদ লিখছেন কী করে? সেদিন মীরা লিখলেন—
”রাণা ম্হাঁরো কাঁঈ করিহে, মীরা ছোড় দঈ কুল লাজ।
বিষ প্যালা রাণাজী ভেজ্যো, মীরা মারণ কাজ।।
হঁসকে মীরা পী গঈ হৈ, প্রভু প্রসাদ পর রাগ।
ডব্বা এক রাণাজী ভেজ্যো, উসমেঁ কারা নাগ।।
ডব্বা খোল মীরা জব দেখ্যো, হৈ গয়ে সালিগরাম,
জৈ জৈ ধুনি সব সন্ত সভা ভই, কৃপা করী ঘনশ্যাম।।
সজি সিংগার পগ বাঁধি ঘূঁঘরূ, দৌ কর দেতী তাল।
ঠাকুর আগে নৃত্য করত হী, গারত শ্রীগোপাল।।
সাধু হমারে হম সাধুন কে, সাধু হমারে জীর।
সাধুন মীরা মিলি জো রহী হৈ, জিমি মাখন মেঁ ঘীর।।”
—রাণা, আমার কী করবেন? আমি কুলমর্যাদা এবং লজ্জা ত্যাগ করেছি। রাণা তো আমাকে মারবার জন্য বিষ পাঠিয়েছিলেন, আমি প্রভুর প্রসাদ মনে করে তা হাসতে হাসতে পান করেছি। এক মুহূর্তে মারাত্মক বিষ অমৃতধারায় পরিণত হয়েছিল। রাণা ঝাঁপির ভেতর কালসর্প পাঠিয়েছিলেন। ঝাঁপি খুলে আমি দেখলাম। কি দেখলাম? ঘনশ্যামের কৃপায় সেই সাপ শালগ্রামে পরিণত হয়েছে। এই দৃশ্য দেখে সাধুরা জয়ধ্বনি করেছিলেন। আমি সাজগোজ করে পায়ে ঘুঙুর বেঁধে দু’হাতে তালি দিয়ে ঠাকুরের নামগান করছি। আমি শ্রীগোপালের মাহাত্ম্য কথা সকলকে শোনাচ্ছি। আমার সাধুসঙ্গ ভালো লাগে। সাধুরাই আমার প্রাণ। আমি সাধুসঙ্গে মাখনের সঙ্গে ঘিয়ের মতো মিশে থাকব।
আর একটি দুরভিসন্ধি করা হল। মীরার শয়নের জন্য একটি লোহার কাঁটাযুক্ত খাট পাঠাতে হবে। এই খাটের মধ্যে যে কাঁটা আছে তা যেন মীরা বুঝতে না পারেন। তাই এর ওপর দেওয়া হবে পুষ্পসম্ভার। অনেকের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে সত্যি সত্যি রাণা এমন একটি ভয়ঙ্কর খাট তৈরি করলেন। যথাসময়ে লৌহকণ্টকযুক্ত খাট মীরার কাছে পৌঁছে গেল। যদি মীরা একবার ওই পুষ্পশয্যায় শয়ন করেন। তাহলে তীক্ষ্ন লৌহশলাকা তাঁর সুকোমল তনুবাহারকে বিদ্ধ করবে। ক্ষতস্থান থেকে অবিরল ধারায় রক্ত নির্গত হবে। এই যন্ত্রণা মীরার মতো সরল নারী কখনও সহ্য করতে পারবেন না। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হবে। কখন আসবে সেই শুভক্ষণ? রাণার নিযুক্ত কর্মচারিরা মন্দির প্রাঙ্গণে পৌঁছে গেছে। যথাসময়ে খাটটি সেখানে আনা হল। মীরা কোনও কিছু চিন্তা না করে সেই খাটে উপবেশন করলেন। আহা, কই, তাঁর তো ব্যথা লাগল না। কারণ কি? মীরা হাসতে হাসতে গাইলেন—
”সূল সেজ রাণা নে ভেজী, দীজ্যো মীরা সুলায়।
সাঁঝ ভঈ মীরা সোরণ লাগী মানো ফুল বিছায়।।”
—আমার শোবার জন্য রাণা শূলশয্যা পাঠিয়েছিলেন, সন্ধ্যা সমাগমে আমি যখন সেটির ওপর উপবেশন করলাম, মনে হল আমার মঙ্গলের জন্য লোহার পালঙ্কে ঈশ্বর ফুলের শয্যা রচনা করেছেন।
রাণা এবার ক্রোধে উন্মাদ প্রায় হয়ে গেছেন। সত্যিই তো, সত্যযুগে ভগবান বিষ্ণু যেভাবে তাঁর ভক্ত প্রহ্লাদকে একটির পর একটি বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন, কলিযুগেও ঠিক সেইভাবে তিনি তাঁর ভক্ত মীরাকে সম্ভাব্য বিপদের হাত থেকে রক্ষা করছেন। এতেই প্রমাণিত হয় ভক্তের ডাকে সাড়া দেবার জন্য তিনি সর্বদা তৎপর হয়ে থাকেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা ঈশ্বরের এই অনুরাগের ব্যাপকতা এবং গভীরতা সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারি না। তাই সব কিছু ত্যাগ করে তাঁকে ডাকতে পারি না।
মীরা তখন সম্পূর্ণভাবে অন্য জগতের বাসিন্দা হয়ে গেছেন। জাগতিক দুঃখ—কষ্টের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র দৃকপাত নেই। তিনি তখন ঈশ্বরের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সাধনা করছেন। তাঁর কেবলই মনে হচ্ছে কবে জগতের এই সকল খেলা শেষ হবে। তিনি নিঃশঙ্ক চিত্তে নিরুদ্বেগ মনে ঈশ্বর আরাধনায় ব্রতী হবেন।
মীরার কীর্তির কথা তখন এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। রোজ সকালে তাঁর আশ্রম প্রাঙ্গণে অসংখ্য মানুষের সমাগম দেখা দেয়। সকলেই মীরার পাদস্পর্শ করার জন্য উৎকণ্ঠিত চিত্তে অপেক্ষমান থাকেন। মীরা সকলের সঙ্গে কথা বলেন, সকলের হাতে ঈশ্বরের প্রসাদ তুলে দেন।
একদিন এক ভণ্ড সাধু মীরার কাছে এসে পৌঁছোলেন। মীরার মধ্যে কতখানি ত্যাগ এবং বৈরাগ্য আছে, তা পরীক্ষা করতে হবে। তিনি বললেন, তুমি যেমন গিরিধারীর দাসী, আমিও ঠিক তাঁরই দাস। গিরিধারীলাল তোমার দুঃখ দূর করার জন্য আমাকে স্বপ্ন দিয়েছেন। স্বপ্নে পাওয়া আদেশানুসারে আমি তোমার কাছে এসেছি। তুমি গিরিধারীর আদেশ মনে করে দ্বিধাহীন চিত্তে আমাকে গ্রহণ করো।
সাধুর মুখনিঃসৃত এইসব কথা শুনে নিঃশঙ্ক চিত্তে মীরা বললেন— গিরিধারীলালের আজ্ঞা আমার শিরোধার্য। কিন্তু আপনি এতদূর থেকে পদব্রজে এসেছেন। আপনাকে দেখে আমার মনে হচ্ছে আপনি খুব ক্লান্ত এবং অভুক্ত। হয়তো দীর্ঘক্ষণ কোনও আহার করেননি। আপনি তৃষ্ণার্ত। আপনি একটু এখানে বসুন। বিশ্রাম ও ভোজন সমাপন করুন। তারপর না হয় আপনার আজ্ঞা আমি শুনব।
এই কথা বলে তিনি সাধুকে নিয়ে গেলেন আরামকক্ষে। সেখানে তাঁর সামনে নানা আহার্য সাজিয়ে দিলেন। তাঁকে তৃপ্তিসহকারে ভোজন করালেন। তাঁর জন্য রচিত হল উত্তম শয্যা। সেই শয্যায় সাধুকে উপবেশন করার জন্য অনুরোধ করলেন।
সাধু ভাবতে পারেননি যে, মীরার মতো এক মহাসাধিকা তাঁর জন্য এত সমাদরের ব্যবস্থা করবেন। এবার সাধু বললেন—মীরা, তুমি আমার সঙ্গে একটি নির্জন স্থানে চলো। তোমাকে আমি এমন কিছু কথা বলব, যা শুনে তোমার সমস্ত শরীর শিহরিত হবে। তুমি এতদিন ধরে যে সাধনায় ব্রতী হয়েছো, দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেই সাধনায় একশো শতাংশ সিদ্ধিলাভ করতে পারোনি। এর কারণ কি জানো? এর কারণ হল তুমি এখনও সঠিক গুরুর সন্ধান পাওনি।
মীরা বললেন—আমি নির্জন স্থান কোথায় খুঁজে পাবো, বলুন সাধু মহারাজ? আপনি একবার চোখ বন্ধ করে দেখুন তো, স্থল—জল—অন্তরীক্ষে এমন স্থান কি আছে, যেখানে আমাদের পরম প্রিয় গিরিধারীলাল উপস্থিত নেই। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র—সর্বত্র তিনি বিরাজ করছেন। তাঁকে দেখতে না পান এবং তিনি পাপ—পুণ্যের সাক্ষী না হন, এমন কোনও স্থান নেই। বলুন সাধু মহারাজ, আপনার সেই স্থানটি কোথায় হবে?
মীরার কণ্ঠনিঃসৃত এই কথাগুলি শুনে সাধু মহারাজের মনোজগতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন, মীরার মতো কোমল স্বভাবা সাধারণ মেয়ের সাথে প্রতারণা করা উচিত হয়নি। তখন তিনি কপটতা পরিত্যাগ করলেন। মীরার চরণপ্রান্তে নিজেকে লুটিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, হে মীরা, আমাকে আপনি ক্ষমা করুন। আমি আপনাকে বিপথগামিনী করার চেষ্টা করেছিলাম। অবশ্য নিজের অভিপ্রায়ে একথা বলিনি। এই দেশের রাজা আমাকে এমন কু—আচরণ করতে বাধ্য করেছেন।
মীরা ওই সাধু মহারাজকে ক্ষমা করে দেন। তিনিও যাতে সাধন—সঙ্গীতে মেতে উঠতে পারেন, সে ব্যবস্থা করলেন।
এই সময় মীরা বেঁধেছিলেন একটি সুন্দর পদ। সেই পদটির মাধ্যমে ঈশ্বরের প্রতি তাঁর অন্তরের ব্যাকুলতা প্রকাশ করেছিলেন। মীরা লিখেছিলেন—
”স্বামী সব সংসার কে হো, সাঁচে শ্রীভগবান্।।
স্থাবর জঙ্গম পারক পানী, ধরতী বীচ সমান।
সব মেঁ মহিমা তেরী দেখী, কুদরত কে কুরবান।।
সুদামা কে দারিদ খোয়ে, বারে কী পহিচান।
দো মুট্ঠী তংদুল কী চাবী, দীনহো দ্রব্য মহান।।
ভারত মেঁ অর্জুন কে আগে, আপ ভয়ে রথরান।
উননে আপনে কুল কো দোখা, ছুট গায়ে তীর কমান।।
না কোই মারে না কোই মরতা, তেরা য়হ অজ্ঞান।
চেতন জীব তো অজর অমর হৈ, য়হ গীতা কো জ্ঞান।।
মুঝ পর তো প্রভু কিরপা কীজে, বংদী আপনী জান।
মীরা গিরিধর সরণ তিহারী লৈগ চরণ মে ধ্যান।।”
—হে ভগবান, তুমি হলে স্থল—জল—অন্তরীক্ষের একমাত্র অধীশ্বর। এ বিশ্বসংসারের স্বামীত্বে তোমাকে আরোপ করা হয়েছে, স্থাবর জঙ্গম অগ্নি জলরাশি পৃথিবী—সর্বত্র তোমার মহিমা একইভাবে বিরাজ করে, বাল্যবন্ধু সুদামার দু’মুঠো চাল নিয়ে তার দারিদ্র নাশ করেছো। তাকে দিয়েছ মহাসম্পদ। ভারতযুদ্ধে তুমি হয়েছিলে অর্জুনের রথের সারথি। অর্জুন যখন সামনে আহত—নিহত আত্মীয় পরিজনদের দেখে যুদ্ধ করার ইচ্ছা ত্যাগ করেছিলেন, তখন তুমি উদ্দীপ্ত বাক্য সহকারে তাঁর মন ফিরিয়েছো। তুমি বুঝিয়েছিলে তাঁকে—এ জগতে কেউ কাউকে মারে না, কেউ মারা যায় না। তুমি অজ্ঞান, তাই তোমার বোধ হচ্ছে তুমি এদের হত্যা করে পাপগ্রস্ত হবে। জীব চৈতন্যস্বরূপ। জীবের বিনাশ নেই। এই সত্যিকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করো।
গীতার এই জ্ঞান তো তুমিই দিয়েছো, হে কৃষ্ণ। প্রভু, আমাকে তুমি দাসীস্বরূপ জ্ঞান করবে। আমার ওপর কৃপা করো। হে গিরিধারী, মীরা জন্ম—জন্মান্তরে তোমার চরণ বন্দনা করবে।
কিছুদিন বাদে মীরা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁকে অতি দ্রুত সুস্থ করে তোলার জন্য উদাবাঈ চিকিৎসকের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু একমাত্র গিরিধারীলালের চরণামৃত ছাড়া মীরা অন্য কিছু সেবন করবেন না। এই জাতীয় চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র আস্থা ছিল না। কথায় কথায় তিনি বলতেন—— স্বয়ং ঈশ্বর যার সহায়, কোন ব্যাধি কি তাকে আক্রমণ করতে পারে? অথচ মীরা এবার সত্যি সত্যি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অনেকে তাঁর এহেন আচরণে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। ভক্তরা মীরাকে এইভাবে অনাসক্তির জগতে বসে থাকতে দেখে খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন। অবশেষে একদিন সকলের একান্ত অনুরোধে মীরা গেয়ে উঠলেন তাঁর এই ভক্তিসঙ্গীতটি। তিনি বলেছিলেন—
”আমি মাথায় কলসী নিয়ে যমুনায় জল আনতে গিয়েছিলাম। বিশাল নেত্র শ্যাম দূর থেকে আমাকে দেখতে পেয়েছিলেন। আমায় দেখার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ঠোঁটে অলৌকিক হাসি ফুটে উঠেছিল। শ্যামসুন্দরের এই মনোহর মূর্তির কথা আমি কখনও ভুলতে পারব না। তোমরা মন্ত্র লেখাতে পারো, তোমরা যন্ত্র আনতে পারো, ওষুধ ঘষতে পারো, কিন্তু কোনও কিছুতেই আমার মনের এই অস্থিরতা দূরীভূত হবে না। আমার এই ব্যাধি তাতে সারবে না। এখন যদি তোমরা শ্যামবৈদ্যকে ডেকে আনতে পারো, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আমার অসুখ সেরে যাবে। আমি হাসতে হাসতে উঠে বসব। তাঁর আঁখির বক্রদৃষ্টি তীরের মতো আমাকে বিদ্ধ করেছে। আমি হলাম গিরিধার নাগরের অনুরাগিনী। তাঁর অভাবে আমি কেমন করে ঘরে বাস করি?”
উপস্থিত সকলে বুঝতে পেরেছিলেন যে, এহেন কৃষ্ণপ্রেমিকার সঙ্গে তর্কাতর্কি করে কোনও লাভ নেই। সেখানে আর একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেল। ক’দিন আগে পর্যন্ত চিকিৎসকরা মীরার স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন এমনভাবে চলতে থাকলে মীরা কিন্তু বেশিদিন আর বাঁচবেন না।
অথচ এই গানটা গাইবার সঙ্গে সঙ্গে মীরার অসুখ ক্রমশ কমতে লাগল। মীরা কয়েকদিনের মধ্যে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করলেন। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা দেখে সকলে আরও একবার অবাক হলেন। তাঁরা বুঝতে পারলেন, মীরাকে এখনই জীবন্ত কিংবদন্তুি বলা উচিত।
তা সত্ত্বেও রাণার দুর্ব্যবহারের মাত্রা কমছে না। তখনও তিনি মীরার সাধনপথে একটির পর একটি বাধা সৃষ্টি করার চেষ্টা করে চলেছেন। একের পর এক পরাজয় তাঁকে হিংস্র পশুর মতো করে তুলেছে।
অবশেষে মীরা তাঁর ভবিষ্যৎ—জীবন সম্পর্কে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলেন। কাঁহাতক আর এই ধারাবাহিক অত্যাচার সহ্য করা যায়। এর ফলে তাঁর সাধনার গভীরতা অনেকখানি কমে যাচ্ছে। এখন আর তিনি এক মন এক প্রাণ হয়ে ঈশ্বরের আরাধনা করতে পারেন না। সবসময় মন এক অজানা আশঙ্কায় কম্পিত থাকে। বলা তো যায় না, রাণা এখনও এই দেশের রাজা। এই দেশের অনেক প্রজা এখনও তাঁর ওপর আস্থাশীল। এই রাণা যদি সবসময় ষড়যন্ত্রের জাল বোনেন, তাহলে মীরা কেমন করে ঈশ্বরের আরাধনা করবেন। অতএব ভবিষ্যৎ—জীবনের সুখ—শান্তি অন্বেষণ করতে হলে তাঁকে এখনই চিতোর ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে হবে।
কিন্তু এই শহরটিকে তিনি প্রাণের থেকে বেশি ভালোবাসেন। এখানকার উন্মুক্ত নীল আকাশ এবং মৃদু—মন্দ বাতাস তাঁকে প্রতি মুহূর্তে অজানা আকর্ষণে ডাক দেয়। চিতোরের সবথেকে বড়ো সম্পদ তার জনসমষ্টি। অভিবাসীরা সৎ শোভন সুন্দর চরিত্রের অধিকারী। তারা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কায়িক পরিশ্রম করে দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের সংস্থান করে। তাদের মনে লোভের কোনও স্থান নেই। তারা একে অন্যের ক্ষতি করতে চায় না। সকলে মিলেমিশে পথ চলতে ভালোবাসে। এমন একটি শহর ছেড়ে স্বেচ্ছায় চলে যেতে মন চাইছিল না মীরার। কিন্তু তিনি নিরুপায়। চিতোর পরিত্যাগ করতেই হবে তাঁকে।
অবশেষে একদিন তিনি চিতোর ত্যাগ করার পরিকল্পনাকে রূপায়িত করলেন। তাঁর জ্যেঠামশাই বিরমদেবজি তাঁর দুর্গতির বিষয়ে সবকিছু জানতে পেরেছিলেন। তিনি মীরাকে আদর—যত্ন করে মেড়তায় ফিরিয়ে আনলেন। অনেকদিন বাদে এই শহরে প্রবেশ করলেন মীরাবাঈ। এই শহরের সঙ্গে তাঁর শৈশব এবং প্রথম কৈশোরের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। মেড়তাতে এসে সেখানকার পরিবর্তিত পরিবেশ দেখে মীরা খুব আহত হয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন জগৎ অত্যন্ত দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। এখন আর পুরোনো মূল্যবোধগুলিকে আঁকড়ে পথ চলা সম্ভব নয়।
মেড়তাতে এসেও মীরাকে বন্দী জীবন কাটাতে হয়েছিল। হয়তো এখানে রাণার মতো কোনও কুচক্রী খলনায়ক ছিলেন না, কিন্তু যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সকলে সমবেতভাবে মীরার অধ্যাত্মজীবনের নানা অশান্তি সৃষ্টি করতে থাকেন। মীরাকে কিছুতেই তাঁরা সর্বজনসমক্ষে বসতে দেবেন না। এমনকি মীরা যে সাধুসঙ্গ করতে ভালোবাসেন, সে ব্যাপারেও তাঁদের আপত্তি ছিল।
মীরা বুঝতে পারলেন, চিতোর আর মেড়তার মধ্যে কোনও তফাৎ নেই। তাঁর মনে তখন একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে, তা হল— সারা পৃথিবী বোধহয় পুরুষদের এভাবেই দেবতার আসনে অসীন করে এবং মেয়েদের কোনও কথাই শুনতে চায় না।
সংসারের প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা জাগল মীরাবাঈয়ের মনের মধ্যে। তিনি ভাবলেন, অনেকদিন তো আমি এইভাবে সংসারের মধ্যে থেকে গেলাম। এবারে সংসার ত্যাগ করে সত্যিকারের সাধিকা হলে কেমন হয়?
মীরা চিতোর ছেড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার ভাগ্যাকাশে কালো মেঘ ঘনিয়ে আসে। তাই মীরাকে বলা হতো চিতোরের সাক্ষাৎ দেবী। তিনি ছিলেন এই শহরের ভাগ্য বিধাত্রী। এবার এল বৈদেশিক আক্রমণ। গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শা বারবার চিতোরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ফলে চিতোর দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এই সময় এগিয়ে এলেন পৃথ্বীরাজের জারজ পুত্র বনবীর। তিনি দীর্ঘকাল মেবারের রাজসিংহাসনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এখন বুঝতে পারলেন বিক্রমজিতকে আক্রমণ করতে হবে। বিক্রমজিৎ এখন হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন। বনবীর চিতোর আক্রমণ করলেন। বিক্রমজিৎ এই যুদ্ধে পরাস্ত ও নিহত হলেন। সারা জীবন ধরে তিনি কলঙ্কিত দিন কাটিয়ে গেছেন। নারীসংসর্গে ছিল তাঁর তীব্র অনুরাগ। মীরাবাঈয়ের মতো এক কৃষ্ণবিরহিনীর সাথে নির্মম ও নিষ্ঠুর আচরণ করেছেন। ভগবান বোধহয় এভাবেই প্রতিশোধ নিলেন।
এদিকে মেড়তার অবস্থাও মোটেই ভালো নয়। সেখানেও তখন দেখা দিয়েছে নানারকমের অশান্তি। বীরমদেবজির কাছ থেকে মেড়তা কেড়ে নেওয়া হল। এগিয়ে এলেন যোধপুরের মালদেবজি। শুধু তাই নয়, মেড়তায় দেখা দিল দারুণ খাদ্যাভাব।
মীরা বুঝতে পারলেন, তাঁকে ঈশ্বর একটির পর একটি পরীক্ষার সামনে এনে দাঁড় করিয়েছেন। পিতৃকুল এবং শ্বশুরকুলের এই অবস্থা দেখে তিনি আরও ঈশ্বরাভিমুখী হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর মনে অনেকদিন একটি গুপ্ত বাসনা ছিল, তা হল জীবনে অন্তত একবার শ্যামের লীলাক্ষেত্র শ্রীবৃন্দাবনধাম দর্শন করবেন। বৃন্দাবনের সর্বত্র শ্যামলালার স্মৃতি এখনও আছে। সেখানে গেলে তিনি তাঁর ইষ্টদেবতাকে আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন। মনের এই আশা নিয়ে অবশেষে একদিন বেরোলেন মীরাবাঈ। কৃষ্ণবিরহিনী মীরাবাঈকে দেখে সকলের চোখে অশ্রু এসে যেত। এই সাধিকা তখন জগৎসংসারের সব কিছু ভুলে এক মনে ঈশ্বর আরাধনা করে চলেছেন। তাঁর মুখ থেকে নির্গত হচ্ছে ঈশ্বর ভজন। তিনি বলছেন—
”মেরে তো গিরধর গোপাল দুসরা ন কোঈ।।
জাকে সির মৌর মুকুট, মেড়ো পতি সোঈ।
তাত মাত ভ্রাত বংধু, অপনা নহিঁ কোঈ।।
ছাঁড় দঈ কুল কী কান, ক্যা করিহৈ কৌঈ।
সংতন টিগ বৈঠি বৈঠি; লোকলাজ খোঈ।।
চনরী কে কিয়ে টুকটুক, ওঢ় লীন্হ লোঈ।
মোতী মূগেঁ উতার, বনমালা পোঈ।।
অঁসুবন জল সীঁচ সীঁচ, প্রেম বেলি বোঈ।
অব তো বেলি ফৈল গঈ, আনংদ ফল হোঈ।।
দুধ কী মথনিয়া বড়ে, প্রেম সে বিলোঈ।
মাখন জব কাড়ি লিয়ো, ছাছ পিয়ে কোঈ।
আঈ মৈঁ ভক্তি কাজ, জগত দেখ মোহী।
দাসী মীরা গিরধর প্রভু তার অবমোহী।।”
—একমাত্র গিরিধারীই হলেন আমার আত্মার আত্মীয়। আমি সর্বত্র তাঁকেই দেখতে পাই। এই পৃথিবীতে নিজের বলে আমার আর কেউ নেই। যাঁর মস্তকে আছে ময়ূরের মুকুট, তিনি আমার পরম পতি। মা—বাবা, ভাই বন্ধু কেউ আর আমার আপন নয়। আমি ঈশ্বর আরাধনা করতে গিয়ে রাজকীয় মর্যাদা পরিহার করেছি, এখন কেউ আমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। সাধু সন্দর্শনে গিয়ে অনেক অপমান সহ্য করেছি। হাতের চুড়ি টুকরো টুকরো করে ভেঙে কম্বলে আমার সুন্দর তনুবাহারকে ঢেকে রেখেছি। আমি মোতি ফেলে দিয়ে বনমালা কণ্ঠে ধারণ করেছি। অশ্রুজল সেচন করে আমি প্রেম বেলি রোপণ করেছি। এখন সে জটা কত বড়ো হয়েছে। সেখানেই আনন্দ—ফল ফলেছে। আমি প্রেমের সঙ্গে দুধ—মন্থন করে মাখন তুলে নিয়েছি। এখন যার ইচ্ছে হবে, সে—ই এই তরল পান করতে পারে। আমি ভক্তি কাজের জন্য এলাম, কিন্তু জগৎ—সংসারের এই অবস্থা দেখে আমার মন বিষাদক্লিষ্ট হয়ে গেল। হে প্রভু, গিরিধারী, আমি চিরকাল তোমার সেবা করে এসেছি। তুমি এখন আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করো।
মীরা একটির পর একটি তীর্থ দর্শন করলেন। ভারতবর্ষ যে কত দেবতার পুণ্যভূমি তা মীরাবাঈ অনুভব করলেন। চরম উন্মাদিনীর মতো পথে—প্রান্তরে ঘুরে বেড়ালেন। ভগবানের এক—একটি লীলাস্থল দর্শন করে তিনি এক—এক ধরনের ভাবতন্ময়তার রাজ্যে প্রবেশ করতেন। মনে হতো তিনি বোধহয় জন্ম— জন্মান্তরের কথা মনে করতে পারতেন। কখনও তিনি হতেন কৃষ্ণের প্রেমিকা, কখনও তাঁর সখী। এইভাবে বিভিন্ন রূপে কৃষ্ণকে বর্ণনা করতে লাগলেন। উদ্ধবকুণ্ড দর্শন করার সাথে সাথে তাঁর ভাবজগতে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। মন কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। মনে হচ্ছে এখন কৃষ্ণের পদতলে সবকিছু সমর্পণ করবেন। আত্মঘাতিনী হবেন শেষ পর্যন্ত।
এমনই এক সন্ধ্যাবেলায় কৃষ্ণ আবেশে আবিষ্ট হয়ে মীরা লিখলেন—
”আলী সাঁররো কী দৃষ্টি, মানো প্রেম কী কটারী হৈ।। টেক।।
লাগত বেহাল ভঈ, তন কী সুধি বুদ্ধি গঈ
তন মন ব্যাপো প্রেম মনো মনো মতরারী হৈ।।
সখিয়াঁ মিলি দুই চারি, বাররী সী ভঈ ন্যারী
হৌঁ তৌ রাকো নীকে জানোঁ কুংজ কো বিহারী হৈ।।
চংদ কো চকোর চাহৈ, দীপক পতঙ্গ দাহৈ
জল বিন মীন জৈসে তৈসে প্রীত প্যারী হৈ।।
বিন তী করোঁ হে স্যাম, লাগো মৈঁ তুম্হারে পাম
মীরা প্রভু ঐসে জানো দাসী তুম্হাঁরী হৈ।।”
—সখি, শ্যামের দৃষ্টিতে কী এক আশ্চর্য ছুরিকা লেগে আছে। সেই দৃষ্টি দিয়ে যখন তিনি আমাকে পর্যবেক্ষণ করেন, আমার মনে হয়, আমার সর্বাঙ্গে বুঝি ছুরিকাঘাত করছেন। আমার ওপর তাঁর সেই দৃষ্টি পড়লে আমার সমস্ত ভাবনা চিন্তা কোথায় হারিয়ে যায়। বুদ্ধি—সুদ্ধি সব লোপ পায়। আমার দেহ—মন কি এক অপার্থিব প্রেমের প্লাবনে প্লাবিত হয়। মনে হয় আমি বুঝি নেশাগ্রস্তা হয়েছি। দু—চারজন সখী আমাকে উন্মাদিনী মনে করে আমার সঙ্গ ত্যাগ করে চলে গেল। আমি তো ওই কুঞ্জবিহারীকে ভালোভাবেই জানি। তিনি সকলের পরিত্রাতা। তাঁকে আমি ত্যাগ করব কেমন করে? আমি জানি, চন্দ্র সর্বদা চকোরকে চায়, পতঙ্গ প্রজ্বলিত আগুন শিখার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, কিন্তু সে ওই আগুন শিখাকে ভালোবাসে। মীন জলকে ভালোবাসে, সারাজীবন জলের সঙ্গে তার সখ্যের সম্পর্ক। জল বিনা মাছ এক মুহূর্ত বাঁচতে পারে না। তোমার বিহনে শ্যাম আমি সময় কাটাব কেমন করে? হে মীরার প্রভু শ্যাম, আমি বারবার তোমার কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি, তুমি আমাকে তোমার পরম দাসী বলে গণ্য করো। তুমি যেন সর্বদা তোমার কৃপাদৃষ্টি আমার ওপর বর্ষণ করো। নাহলে আমার জীবনের একটি মুহূর্তও আর কাটবে না।
এইভাবে মীরা তখন সাধনার অন্য এক সোপানে উপস্থিত হয়েছেন। কখনও তাঁকে দেখা যাচ্ছে ক্রন্দনরতা অবস্থায়, কখনও তিনি বুঝি প্রেম—উন্মাদিনী, কখনও বিরহিনী। অনেকে বলেন, এই সময় মীরার মধ্যে রাধিকাভাবের অবতারণা হয়েছিল। ইহজীবন ধরে তিনি মধুরভাবে শ্যামের আরাধনা করেছেন। কিন্তু এই সময় তাঁর মধ্যে প্রেমসত্তা প্রবলতর হয়ে ওঠে। সত্যিকারের প্রেমিকা না হলে কেউ কি এইভাবে এমন পদ রচনা করতে পারেন, যা যুগে—যুগান্তরে মানুষকে নতুন আদর্শে উদ্বুদ্ধ করবে। মীরার ভজন গান গেয়ে কত শত সাধিকা কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা হয়েছে।
মীরা লিখেছিলেন—
”রস ভরিয়াঁ মহারাজ মোকো, আয় সুনাঈ বাঁসুরী।
সুনত বাঁসুরী ভঈ বাররী, নিকসন লাগী সাঁসুরী।।
রকত রতী ভর না রহ্যো, রহ্যো ন মাসা মাংসুরী।
তন তোরা ভর না রহ্যো, রহি নিগোড়ী সাঁসুরী।।
মৈঁ জমুনা জল ভরন জাতহী, সাসু ননদকী ত্রাসুরী।
মীরাকে প্রভু গিরধর মিলগে, পূরী মন কী আসুরী।।”
—মহারাজ এসে আমার কর্ণে তাঁর মধুর বাঁশীর ধ্বনি শোনালেন। সেই বাঁশী আমাকে প্রেমানন্দে আনন্দিত করার চেষ্টা করল। সেই বাঁশীর স্বর আমার সমস্ত সত্তার মধ্যে বিরাজ করতে লাগল। মধ্যরাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি সেই বাঁশীর উৎস—সন্ধানে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। আমার শ্বাস বের হয়ে যেতে লাগল। শরীরে এক বিন্দু রক্ত থাকল না। এক টুকরো মাংস থাকল না। আমার দেহ তখন সম্পূর্ণ ভারশূন্য অবস্থায় পৌঁছে গেছে। আমি শুধু নিঃশ্বাস নিতে পারছি। শাশুড়ি—ননদের ভয়ে আমি জল আনতে চলেছি যমুনায়, আমার মনে আশা আছে, মীরার প্রভু গিরিধারী সেখানে আমার জন্য অপেক্ষারত। মধ্যনিশীথে যখন সমস্ত পৃথিবী সুষুপ্তিমগ্ন, তখন আমাদের মধ্যে এক অলৌকিক অভিসার রচিত হবে।
এই পদটি শুনলে কি মনে হয় না যে, মীরা তখন একেবারে রাধাভাবে আচ্ছন্না হয়ে গিয়েছিলেন। রাধার সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন। তখন তাঁর মধ্যে মীরাভাবের কোনও কিছুই ছিল না। এইভাবেই তো যুগে—যুগান্তরে মানুষ ইষ্টদেবতার সন্ধানে নিজের আমিত্ব সত্তাকে বিলুপ্ত করে দেয়। পরবর্তী পর্যায়ে আমরা যখন মীরার সাধনা সম্পর্কে আলোচনা করব, তখন তাঁর মনের বিশেষ বিশেষ গতি—প্রকৃতির ওপর বিশেষ আলোকপাত করা হবে।
পথ চলতে চলতে মীরা উন্মাদিনী হয়ে গেলেন। শোকাচ্ছন্ন অবস্থায় রচনা করলেন একটির পর একটি ভজন সঙ্গীত। আজও ভারতের পথে—প্রান্তরে তাঁর লেখা এই অমর—সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। তাঁর গানকে সম্বল করে হাজার হাজার কৃষ্ণ—বিরহিনী ঈশ্বর সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করেন।
মীরা যে ভাবতন্ময়তার কোন জগতে পৌঁছে গিয়েছিলেন সেই পরিচয় আছে তাঁর লেখা এই গানটির মধ্যে।
এই গানটি তিনি লিখেছিলেন যমুনাতীরে সেই বিখ্যাত বংশীবট দর্শন করে, যেখানে শ্রীকৃষ্ণের জীবনের অনেক কাহিনি রচিত হয়েছে।
মীরা লিখলেন—
”বাজন দে গিরধরলাল মুরলিয়া বাজন দে।। টেক।।
সপ্ত সুরন সো মুরলী বাজী, কহঁ কালিন্দী তীর।
সোর সুনত সুধিনা রহী মেরী; কিত গাগর কিত চীর।।
বৈঠি কদম কে চৌতরা, সব গ্বালন লিয়ো বুলাঈ।
খেলত রোকত গ্বালিনী, মুরলী সবদ সুনাঈ।।
পাসা ডালে প্রেম কে মেরো, মন ধন লৈ গয়ে লূটি।
মীরা কে প্রভু সাঁররে তুম অব কহঁ জৈহাঁ ছুটি।।”
—হে গিরিধারীলাল, তোমার বাঁশী যেন বাজতে থাকে। বাঁশীর শব্দ যেন পৃথিবীর সর্বত্র বিরাজ করে। কালিন্দী তীরে কোথায় তোমার মুরলী বাজছে? তার সপ্তসুর আমার সমস্ত সত্তাকে পরিপ্লাবিত করছে। সেই সুর আমার হৃদয়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। আমার সব বুদ্ধি—সুদ্ধি লোপ পেয়ে গেছে। আমার কোনও কিছুই আর মনে থাকছে না। আমি কলস কাঁখে যমুনায় জল আনতে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেই কলস কোথায় হারিয়ে গেল? আমার পরিধানে এখন কোনও বস্ত্র আছে কি? হে কৃষ্ণ, তুমি কদম্ব তরুতলে বেদীর ওপর বসে সখীদের ডেকে এনেছো, তোমার মুরলীর শব্দ শুনে তারা উন্মাদিনী প্রায় হয়ে গেছে।
এবার মীরাবাঈ পৌঁছে গেলেন গোকুলে। কৃষ্ণের স্মৃতিবিজড়িত এই স্থানে আসার পর তাঁর মনোজগতে নানা আবেগের স্ফুরণ ঘটে যায়। কখনও তিনি নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে শ্রীকৃষ্ণের তনুবাহার প্রত্যক্ষ করেন। আবার কখনও সবুজ ঘাসের ওপর কৃষ্ণের ছায়া পড়েছে বলে মনে হয় তাঁর। এখানে একাধিক পদ রচনা করেছিলেন মীরা। লিখেছিলেন—
”সখি মোহি লাজ বৈরিন ভঈ।
চলত লাল গোপাল পিয়া কে সঙ্গ ক্যোঁ না গঈ।।
চলন চাহত গোকুলহি তে রথ সজায়ো নঈ।
রুকমিনি সঙ্গ জাইবে কো হাথ মীজত রঈ।।
কঠিন ছাতি স্যাম বিছুরত বিরহ ক্যোঁ না গঈ।
তুরত লিখী সন্দেস পিয়কো কাহি পঠউঁ দঈ।।
কূবরী সঙ্গ প্রীতি কীনী মোহি মালা দঈ।
দাসি মীরা লাল গিরধর প্রাণ দক্ষিণা দঈ।।”
—হে সখী, শেষ পর্যন্ত লজ্জাই হল আমার শত্রু। আমার প্রিয়লাল গোপাল যখন চলে গিয়েছিলেন, তখন আমি কেন তাঁকে অনুসরণ করলাম না? তিনি গোকুল থেকে চলে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এক নতুন রথ সাজিয়ে আনা হল। রুক্মিণী সঙ্গে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। কঠিন হৃদয়ের শ্যাম আমাদের কাউকে সঙ্গে নিলেন না কেন? বিরহ কেন সঙ্গে গেল না? তাড়াতাড়ি কেউ যাও, শ্যামের কাছে খবর দিয়ে এসো। হায় আমার গলার মালা কুব্জাকে দিয়ে তার সঙ্গে প্রেম করছো? হে গিরিধারীলাল, তোমার দাসী মীরা এই অভিমানে প্রাণ বিসর্জন দেবে।
এই পদটি পড়লে আমরা বুঝতে পারি যে, তখন শ্যামের প্রতি মীরার অনুরাগ কোন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তখন মীরাবাঈয়ের স্মৃতিসত্তা, ভবিষ্যৎ, সবকিছু শ্যামের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। তাই তো তিনি এমন সুন্দর পদ লিখতে পেরেছেন।
এখানে বসে তিনি তাঁর সবথেকে জনপ্রিয় পদখানি রচনা করেন। গানের মাধ্যমে নিজের সমস্ত অনুভূতিকে শ্যামের শ্রীচরণে অর্পণ করেছেন। মানুষ এবং ঈশ্বরের মধ্যে এভাবে এক মহামিলন ঘটে গেছে বুঝি। মীরাবাঈ লিখেছেন—
”মহাঁনে চাকর রাখোজী, গিরধারী ললা চাকর রাখোজী।।
চাকর রহসূঁ বাগ লাগাসূঁ নিত উঠ দরসন পাসূঁ।
বৃন্দাবন কী কুংজ গলিন মেঁ, গোবিংদ লীলা গাসূঁ।।
চাকরী মেঁ দরসন পাউঁ সুমিরণ পাউঁ খরচী।
ভাব ভগতি জাগীরী পাউঁ, তীনো বাতাঁ সরসী।”
—হে গিরিধারীলাল, তুমি আমাকে চাকর রাখো। আমি চাকর হয়ে তোমার বাগান তৈরি করে দেবো। তোমার মালীর কাজ করব। তাহলে প্রতিদিন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমি তোমার সাক্ষাৎ পাব। বৃন্দাবনের প্রতিটি কুঞ্জে গিয়ে আমি তোমার নাম সংকীর্তন করব। চাকর থাকার ফলে তুমি সর্বদা আমার চোখের সামনে থাকবে। আর পারিশ্রমিক রূপে আমি পাব তোমার স্মৃতি। মাইনের পরিবর্তে আমি পাব ভাব আর ভক্তি। এই তিন বার্তাই ভালো। তোমার ময়ূর মুকুট, পীতাম্বর, গলায় বৈজয়ন্তী মালা শোভা পাচ্ছে। হে মোহন মুরলীধারী, তুমি বৃন্দাবনে ধেনু চরিয়ে থাকো। সারি সারি করে বাগান তৈরি করো। সারির মধ্যে অল্প জমি তুমি আলাদা করে রেখে দাও। সুন্দর কুমকুমি শাড়ি পরে শ্যামলিয়াকে দেখব। যোগসাধনার জন্য যোগী আসেন, তপস্যার জন্য তপস্বী আসেন। ওহে বৃন্দাবনবাসী, হরিভজনের জন্য সাধু আসেন, কিন্তু মীরার প্রভু অত্যন্ত গম্ভীর। হে মন ধৈর্য্য ধরো। মন শুদ্ধ এবং নির্মল হলে অবশ্যই প্রভু দেখা দেবেন।
এভাবেই তখন এক ভাবতন্ময়তার মধ্যে মীরাবাঈয়ের দিন কাটছে। একদিন হঠাৎ তিনি ময়ূর—মুকুটধারী শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে পেলেন। তাঁকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে মীরার শরীরের কোষে—কোষান্তরে অদ্ভুত শিহরণ দেখা দিল। ভাবোন্মদনায় বিভোর হয়ে মীরাবাঈ রচনা করলেন আর একটি স্মরণীয় পদ। যে পদটি আজও আমরা পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে উচ্চারণ করি। তিনি লিখলেন—
”আজ থেঁ দেখ্যো গিরধারী
সুন্দর বদন মদন কী শোভা, চিতরন অনিয়ারী।।
বজারে বংসী কুঞ্জন মেঁ।
গারত তালতরঙ্গ রঙ্গধুনি, নাচত গ্বালন মেঁ।।
মাধুরী মুরতি হৈ প্যারী।
বসো রহে নিস দিন হিরদৈ মেঁ, টরে নহীঁ টারী।।
তা পর তন ধন মন বারী।
রহ মুরতি মোহিনী—নিহারত, লোকলাজহারী।।
তুলসী বন কুঞ্জন সঞ্চারী।
গিরধরলাল নরল নটনাগর, মীরা বলিহারী।।
—আহা, আজ আমি আমার গিরিধারীলালকে দেখতে পেলাম। সুন্দর বদনের কী অপরূপ মদনমোহন শোভা। কুঞ্জে কুঞ্জে বাঁশী বাজিয়ে গোপীদের মধ্যে তালে তালে নাচছেন। প্রিয়ের মধুর মূর্তি আমার হৃদয় অধিকার করে আছে। সরিয়ে দিলেও তা সরতে চায় না। তাঁর ওই মূর্তির ওপর আমার তনু, ধন, মন, সমস্তই সঁপে দিয়েছি। ওই মোহন মূর্তি দেখে আমি লোকলজ্জা হারিয়েছি। তুলসীবন— কুঞ্জবিহারী নবনটবর গিরিলাল, তুমি সত্যিই ধন্য।
বৃন্দাবনে আসার পর অনেক সাধুর সাথে তাঁর প্রত্যক্ষ সংযোগ ঘটে গিয়েছিল। যাঁরা বৈষ্ণবতত্বে বিশ্বাসী, তাঁরা ভারতের নানাপ্রান্ত থেকে বৃন্দাবনে এসে বসবাস করতেন। এখানে আসার পর তাঁরা সাধনমার্গের এক—একটি সোপান উত্তীর্ণ হবার চেষ্টা করেছিলেন। বৃন্দাবনে তাঁর সঙ্গে শ্রীজীব গোস্বামীর দেখা হয়েছিল। শ্রীজীব গোস্বামীর সঙ্গে মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের সম্পর্ক আছে। আমরা শ্রীরূপ এবং শ্রীসনাতন গোস্বামীর নাম শুনেছি। তাঁরা হলেন চৈতন্যদেবের দুই প্রিয়তম পার্ষদ। তাঁদের ছোটো ভাইয়ের নাম বল্লভ। বল্লভের পুত্র শ্রীজীব।
শ্রীজীব পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন বাংলাদেশের রামকেলি গ্রামে। ছোটোবেলা থেকেই শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ছিল তাঁর অপরিমাপ্য আকর্ষণ। সদাসর্বদা কৃষ্ণনামে তিনি আকাশ—বাতাস মুখরিত করতেন। কোনওদিন সংসারী হবার ইচ্ছা ছিল না শ্রীজীবের। তাঁর পিতামাতা যখন পুত্রের মনোগত বাসনার কথা জানতে পারেন, তখন কিন্তু তাঁরা তাঁর সাধনপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেননি।
স্থানীয় পাঠশালায় শিক্ষালাভ করে শ্রীজীব এলেন শ্রীধাম নবদ্বীপে। সেখানে গিয়ে বেদ ইত্যাদি শাস্ত্র অধ্যয়ন করলেন গভীর অনুসন্ধিৎসার সঙ্গে। নিত্যানন্দের আদেশে কাশীধামে এসে চার বছর শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। পঁচিশ বছর বয়সে তিনি শ্রীবৃন্দাবনে পদার্পণ করেছিলেন।
বৃন্দাবনের প্রাকৃতিক পরিমণ্ডল তাঁকে এমনভাবে আকর্ষণ করল যে, জীবনের বাকি দিনগুলি তিনি এখানেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন। শ্রীজীব ছিলেন আজন্ম ব্রহ্মচারী। বৃন্দাবনে এসে তিনি শ্রীরূপ গোস্বামীর সঙ্গে বাস করতে থাকেন। ‘ভক্তিরসামৃত— সিন্ধু’ গ্রন্থ লেখার পর তিনি শ্রীরাধা দামোদর প্রভুর সেবায় নিজেকে নিয়োগ করেন।
মীরা লোকমুখে তাঁর পাণ্ডিত্য এবং চারিত্রিক শুদ্ধতার কথা শুনেছিলেন। মীরা যে কোনও সাধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠতেন। এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হল না। শ্রীজীব গোস্বামীর কাছে তিনি তাঁর দূতকে পাঠালেন। দূত এসে গোস্বামীর সঙ্গে দেখা করে মীরাবাঈয়ের মনোগত ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন।
দূত বলেছিলেন, মীরাদেবী অন্তত একবার আপনার সঙ্গে সাক্ষাত করতে ইচ্ছুক।
তাই শুনে গোস্বামী আত্মাভিমানের বশে বলে উঠেছিলেন—বৈষ্ণব মহাত্মারা কোনও নারীর মুখদর্শন করতে চান না। শাস্ত্রে লেখা আছে, নারীর মুখদর্শন করলে মহাপাপ হয়।
মীরার কাছে এসে দূত গোস্বামীর বক্তব্য জানিয়েছিলেন। মীরা সব শুনলেন। তারপর বলে পাঠালেন—শ্রীবৃন্দাবন ধামে একমাত্র কৃষ্ণ ছাড়া আর কোনও পুরুষ নেই। এখন আমি এ কোন পুরুষের কথা শুনছি?
ভক্ত মীরার এই প্রেমপূর্ণ কথা শুনে পরম বৈষ্ণব শ্রীজীব গোস্বামী অত্যন্ত লজ্জিত হয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে, এভাবে মীরার আমন্ত্রণকে উপেক্ষা করা উচিত হয়নি। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন স্বয়ং মীরা তাঁর বসতবাটীর সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি মীরাকে বাড়ির ভেতর ডেকে নিয়ে গেলেন। তাঁর সঙ্গে ধর্ম সম্বন্ধে নানা আলোচনা করলেন।
এভাবেই মীরাবাঈ তাঁর উচ্চ স্তরে আধ্যাত্মিক শক্তি এবং দার্শনিক অভিজ্ঞানের মাধ্যমে অনেক মানুষের জীবনকে আলোকশিখায় উজ্জ্বল করেছেন। সাধু—সন্তদের সঙ্গে একটির পর একটি তর্ক সভায় যোগ দিয়েছেন। তাঁর পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভাষণ শুনে উপস্থিত সকলে একেবারে অবাক হয়ে যেতেন।
আর বেশিদিন বৃন্দাবনে থাকা বোধহয় সম্ভব হবে না মীরার পক্ষে। তিনি দ্বারকায় যাবেন। যে দ্বারকাতে কৃষ্ণ তাঁর জীবনের শেষ লীলা সম্পন্ন করেছিলেন। দ্বারকা তখন তাঁকে এক দুরন্ত আকর্ষণে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তিনি বারবার বলছেন—”রায় শ্রীরণছোড়জো দ্বারিকা কো বাস”, অর্থাৎ শ্রীরঞ্ছোড়জি যেন আমাকে দ্বারকা বাসের সুযোগ দেন। আমরা সকলেই জানি শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকায় ‘রণছোড়’ নামে অভিহিত হন। শ্রীবৃন্দাবন আর দ্বারকা—এই দুটি জায়গাতে শ্রীকৃষ্ণের লীলা প্রদর্শিত হয়েছিল। তাই এই দুটি স্থান ছিল মীরার কাছে অত্যন্ত প্রিয়। বৃন্দাবনধামের সাথে মীরা ইতিমধ্যেই পরিচিতি অর্জন করেছেন। এবার দ্বারকায় যেতে হবে। গুরুর নাম স্মরণ করে মীরা এগিয়ে চললেন। পথে তাঁকে নানা ধরনের কষ্ট পেতে হয়েছিল। বৃন্দাবন থেকে দ্বারকা—দূরত্বটা খুব একটা কম নয়। অন্য কোনও রমণী হলে হয়তো পথশ্রমে ক্লান্ত হতেন। কিন্তু মীরার মধ্যে তখন এমন এক ঐশীভাব দেখা দিয়েছিল যে, মীরা পায়ে হেঁটে দীর্ঘপথ অতিক্রম করলেন। পথে যেতে যেতে তিনি একটির পর একটি গান রচনা করেছেন। সেই গানে সুর সংযোজনা করেছেন। পথ চলতি মানুষ তাঁর কণ্ঠনিঃসৃত গান শুনে আবেগের আতিশয্যে আপ্লুত হয়ে গেছে। আর এইভাবেই মীরা পথের ক্লান্তি অনুভব করেননি। ওই অপূর্ব সুরমূর্ছনা তখন তাঁর সমস্ত সত্তাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে, বাইরের পৃথিবীতে কোন ঘটনা ঘটছে, সেসব সম্পর্কে জানতে মীরা মোটেই আগ্রহী ছিলেন না।
মীরার জীবনীকাররা বলে থাকেন এই দীর্ঘ পদযাত্রায় গুরু রৈদাস সবসময় তাঁকে সাহায্য করেছেন। অনেকে আবার এটিকে এক রূপকল্প নামেই চিহ্নিত করেছেন। কেউ কেউ এমন অনুমান করেছেন যে, মীরা নাকি নিজের সত্তাকে দ্বিখণ্ডিত করতে পারতেন। অর্থাৎ তিনি একই সঙ্গে দু’জায়গায় বিচরণ করতেন। এই প্রসঙ্গে মহীয়সী মীরা তাঁর একটি পদে বলেছেন—
”গুরু মহারে রৈদাস সরনন সোই।
গুরু মিলিয়া রৈদাস জী, দীনহো
জ্ঞানকী গুটকী।
রৈদাস সন্ত মিলে সৎগুরু, দীনহ,
সুরত সহদানী।।”
—আমার গুরু রৈদাস, তিনি আমার আশ্রয়, রৈদাসকে গুরুরূপে আমি পেয়েছি। তিনি জ্ঞানের আধার দিয়েছেন। সন্ত রৈদাসকে গুরুরূপে পেয়েছি। তিনি ধ্যানের সংকেত দিয়েছেন।
এই রৈদাসের জীবনে নানা অলৌকিক ঘটনা ঘটে গিয়েছিল।
তিনি কাশীধামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জাতিতে ছিলেন চামার, অর্থাৎ নিম্নবর্গের মানুষ। জুতো সেলাই করে কোনওরকমে নিজের জীবিকা নির্বাহ করতেন। সাধুদের বিনামূল্যে জুতো তৈরি করে দিতেন।
রৈদাস গত জন্মে রামানন্দের শিষ্য ছিলেন। নিজের অপরাধের জন্য গুরুর ইচ্ছায় পরবর্তী জীবনে চামার হয়ে জন্মেছিলেন।
রৈদাস ছিলেন জাতিস্মর। গত জীবনের কথা তাঁর মনে ছিল। সদগুরু বিচ্ছেদের জন্য শিশু মাতৃস্তন্য ত্যাগ করেছিলেন। পরে গুরু রামানন্দের কৃপায় তিনি মাতৃস্তন্য পান করতে থাকেন। এক সময় দেশে ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। ঈশ্বর রৈদাসকে পরীক্ষা করার জন্য বৈষ্ণবের বেশে তাঁর কাছে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁর হাতে ছিল একটুকরো পরশমণি। তিনি বললেন—রৈদাস, তুমি এটি গ্রহণ করো।
রৈদাস বলেছিলেন—এ তোমার কেমন পরীক্ষা, প্রভু? তুমি আমাকে পরশমণি দিয়ে ভোলাতে চাইছো? আমি কি এক শিশু? আমি তোমাকে চাই, তুমি হলে আমার সেই পরশমণি।
এরপর কয়েকমাস কেটে গেল। বিষ্ণু আবার এলেন কয়েকটি স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে। সেগুলি রৈদাসের হাতে তুলে দিয়ে বললেন—আমি আদেশ করছি রৈদাস, তুমি এখনই এই স্বর্ণমুদ্রাগুলি গ্রহণ করো।
তখন রৈদাসের দিন কাটছে নিদারুণ দারিদ্র্যতার মধ্যে। তা সত্ত্বেও তিনি সেই স্বর্ণমুদ্রাগুলি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। এভাবে আর কখনও আমাকে লোভ দেখাবেন না।
ভগবান তখন স্বপ্নে আদেশ দিয়ে বলেছিলেন, রৈদাস, তুমি এই স্বর্ণমুদ্রা দেশ সেবার কাজে লাগাও।
এবার আর আপত্তি করলেন না রৈদাস। দৈবাদেশে তিনি সেই স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে একটি মন্দির তৈরি করেন। সেখানে একটি শালগ্রাম শিলা রেখেছিলেন।
রোজ সকাল—সন্ধ্যায় পরম ভক্তিশ্রদ্ধা সহকারে রৈদাস শালগ্রাম শিলা পুজো করতেন। নীচু জাতের মানুষ হয়ে রৈদাস দেবপুজো করছে—ব্রাহ্মণরা তাঁর ওপর অত্যন্ত রেগে গেল।
তারা দেশের রাজার কাছে রৈদাসের বিরুদ্ধে নালিশ জানাল। রাজাদেশে রৈদাস রাজদরবারে পৌঁছে গেলেন। রাজা তাঁকে অপমান করে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবার কথা বললেন। তিনি স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন—রৈদাস, তুমি এখন থেকে আমার রাজ্যে থাকবে না। শালগ্রাম শিলা ত্যাগ করে অন্য স্থানে চলে যাও।
রৈদাস বিনীতভাবে বললেন—মহারাজ, আপনার এ আদেশ আমি মাথা পেতে গ্রহণ করব। আপনি একজন ব্রাহ্মণকে নিয়ে আসুন, আমি তাঁর হাতে আপনার সামনে এই শালগ্রাম শিলা অর্পণ করব।
রাজা তাঁর প্রধান ব্রাহ্মণকে রাজসভায় নিয়ে এলেন। আরও ব্রাহ্মণরা সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। এই যুদ্ধে তাঁরা জয়ী হয়েছেন। নীচজাতির অস্পৃশ্য ওই চামার আর শালগ্রাম শিলা স্পর্শ করতে পারবে না, মনে মনে তাই তাঁরা খুব খুশি।
কিন্তু সেখানে এক অভাবিত দৃশ্য ঘটে গেল। ব্রাহ্মণরা শত চেষ্টা করেও ওই শালগ্রাম শিলাটিকে এক চুল সরাতে সমর্থ হলেন না।
চোখের সামনে এমন ঘটনা ঘটতে দেখে রৈদাস বুঝতে পারলেন যে, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে দয়া করেছেন। তিনি এতক্ষণ অপমানের জ্বালায় জর্জরিত হচ্ছিলেন। এখন মনের আনন্দে গান ধরলেন। তিনি বললেন—হে প্রভু, তুমি আমার আশ্রয়, তুমি পরম আনন্দের মূল। তোমার মতো কেউ দ্বিতীয় নেই। অগণিত ভক্তের প্রতি তুমি দৃষ্টিপাত করো। আমি নানা বন ভ্রমণ করেছি। মৃত্যুভয় থেকে উত্তীর্ণ হইনি। রিপু এবং মায়ার বন্ধনে এখনও আবদ্ধ আমার আত্মা। তোমার প্রতি আমি যেন সর্বদা দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে পারি। তবেই আমি ভয় থেকে মুক্ত হব। মানুষ যাকে ধর্ম বলে, তার বিরুদ্ধে যেন বিমুখ না হয়। হে ভগবান, তোমার সেবক রৈদাসের প্রীতি উপহার গ্রহণ করো। তোমার পতিতপাবন নামের মহিমা সার্থক করো।
সজল নয়নে তখন রৈদাস কেবল গান গেয়েই চলেছেন। তাঁকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে এক অলৌকিক পরিমণ্ডল তিনি প্রার্থনা শেষ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে শালগ্রাম শিলা তাঁর কোলের ওপর এসে পড়ল।
চোখের সামনে এমন অভাবিত দৃশ্য দেখে রাজা একেবারে অবাক হয়ে গেলেন। তিনি ব্রাহ্মণদের তিরস্কার করে রাজপ্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে দিলেন।
কথিত আছে, একবার চিতোরের এক রানি যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। সেই যজ্ঞে রৈদাসকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
রৈদাস সেখানে প্রবেশ করলেন। যজ্ঞস্থলে উপস্থিত ব্রাহ্মণরা এই ঘটনাতে অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, এ যজ্ঞের অন্ন অশুদ্ধ, আমরা তা গ্রহণ করব না।
রানি তখন ব্রাহ্মণদের সেবার ব্যবস্থা করলেন। তাই নিয়ে ব্রাহ্মণরা স্বহস্তে রান্না করবেন। তারপর তা গ্রহণ করবেন। সেখানেও এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল। দেখা গেল দু’জন ব্রাহ্মণ পাচকের মধ্যে একজন হলেন ভক্ত রৈদাস। রৈদাস এইভাবে যোগবলে নিজেকে নানা জায়গায় উপস্থিত করতে পারতেন। রৈদাস বলেছেন—
”কৃষ্ণ করিম রাম রহিম হরি জব
লাগি এক ন পেখা
বেদ কিতাব পুরাণানি তব লাগি
ভ্রম হি দেখা।”
—যতক্ষণ তুমি কৃষ্ণ করিম, রাম রহিমকে ভেদ দৃষ্টিতে যা দেখো, ততক্ষণ বেদে, পুরাণে, কোরাণে ভ্রমই তোমার নজরে পড়বে।
এইভাবে রৈদাস সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলেছেন। তাই হয়তো তাঁকে কেন্দ্র করে এই প্রবাদ তৈরি হয়েছে।
আবার অনেকে বলে থাকেন যে, স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর প্রিয় সেবিকা মীরাকে নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন।
পথে যেতে যেতে মীরা একটি সুন্দর পদ রচনা করেছিলেন। এই পদের মাধ্যমে দ্বারকার প্রতি তাঁর তীব্র আকর্ষণের কথা ঘোষণা করেন। তিনি চেয়েছিলেন এই দ্বারকাতেই যেন তাঁর জীবনের অন্তিম লগ্ন সমাগত হয়। তিনি বলেছিলেন—
”দ্বারিকা কো বাস সেহা মোহি, দ্বারিকা কো বাস।
সঙ্খ চক্রহুঁ গদা পদ্মহূঁ, তে মিটে জম ত্রাস।
সকল তীরথ গোমতী মেঁ, করত সদা নিরাস।
সঙ্খ ঝালরি ঝাঁঝ বাজে, সদা সুখ কী রাস।।
তজ্যো দৈসৌ বেস পতিগৃহ, তজ্যো সম্পান্তি রাজি।
দাসী মীরা সরণ আঈ, তুম হৈঁ অব সব লাজি।।”
—হে ভগবান, দ্বারকাতেই যেন আমার বাস হয়। দ্বারকাতেই যেন আমি বসবাস করতে পারি। তোমার শঙ্খ—চক্র—গদা—পদ্ম দেখে আমার মনের ভয় চলে গেছে। এখানকার গোমতী নদীতেই সকল তীর্থ বাস করেন। সর্বদাই এখানে শঙ্খধ্বনি শোনা যায়। ঘণ্টা, ঝাঁঝর এবং কাঁসর বাজে। এটি হল নিজ আনন্দের খনি। দেশ, বেশ, পতি, গৃহ, রাজ্য, সম্পদ—সবকিছু ত্যাগ করে আমি শেষ পর্যন্ত তোমার শরণ নিয়েছি। এখন তুমিই হলে আমার যথাসর্বস্ব।
অবশেষে মীরাবাঈ এসে পৌঁছোলেন দ্বারকাতে। দ্বারকাতে কৃষ্ণ রঞ্ছোড় নামে পরিচিত এর কারণ কি? এপ্রসঙ্গে একটি গল্প আছে।
শ্রীকৃষ্ণ কংসকে বধ করে মথুরা অধিকার করেছিলেন। তখন কংসের স্ত্রী নিজের ভাই জরাসন্ধের কাছে গমন করেন। তাঁকে সব ঘটনা খুলে বললেন। শ্রীকৃষ্ণের এই ব্যবহারে জরাসন্ধ অত্যন্ত কুপিত হন। তিনি সৈন্যদের নিয়ে মথুরা আক্রমণ করেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ আর রণক্ষেত্রে যেতে রাজি হননি। তিনি দ্বারকায় ফিরে আসেন।
তাঁর এহেন আচরণের কারণ কি? অনেকে বলে থাকেন, শ্রীকৃষ্ণ হলেন এক আদর্শ মানব চরিত্র। মানুষকে শুধু চলিষ্ণু মন্ত্র বলে এগিয়ে গেলে চলবে না, কোথায় থামতে হবে তা জানতে হবে। শ্রীকৃষ্ণ সেইভাবে সেখানেই থেমে গিয়েছিলেন। তিনি ‘রণ ছোড়’ অর্থাৎ রণস্থল পরিত্যাগ করে চলে এলেন দ্বারকাতে। দ্বারকাতে তাঁর এই রণছোড়জি মূর্তিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেটি আছে আমেদাবাদের কাছে খেড়া জেলার অন্তর্গত ডাকোরে।
গুজরাট অঞ্চলে তাঁর কিছু ভজন সঙ্গীত প্রচলিত আছে। তা থেকে আমরা ভগবানের দ্বারকা পরিত্যাগ করে ডাকোরে আগমনের একটি বিবরণ পেয়ে থাকি। ঈশ্বর তাঁর এক পরম ভক্তকে অনুগৃহীত করার জন্য তাঁকে স্বপ্নে আদেশ করেছিলেন—তুমি আমাকে ডাকোরে নিয়ে গিয়ে আমার সেবা করো। দ্বারকার পূজারিরা তোমাকে আমার বিগ্রহ প্রদান করতে অস্বীকার করলে, তুমি তাদেরকে আমার সমান ওজনের স্বর্ণ দিতে স্বীকার করবে। আমি ওজনে অর্ধ—রতির কম হব। তুমি সেই পরিমাণ সোনা নিয়ে দ্বারকায় গমন করবে।
এই স্বপ্নাদেশানুসারে সেই ভক্ত অর্ধ—রতি সুবর্ণ নিয়ে দ্বারকাতে উপস্থিত হলেন। সেখানে উপস্থিত পুরোহিতবৃন্দের কাছে তিনি করজোড়ে তাঁর প্রার্থনা জানালেন। যে করেই হোক রঞ্ছোড়জির মূর্তি তাঁকে পেতেই হবে। ব্রাহ্মণরা এই বিগ্রহ প্রদান করতে অস্বীকার করলেন। তখন ওই ভক্ত বিগ্রহের ওজনের সমান সোনা দিতে অঙ্গীকার করেন। তাঁর এই প্রস্তাব শুনে ব্রাহ্মণরা অত্যন্ত লোভী হয়ে উঠলেন। তাঁরা ভাবলেন যে, বিগ্রহের ওজনের সমান সোনা পেলে তাঁদের সারা জীবন আর কাজ না করলেও চলবে। তখন তাঁরা রঞ্ছোড়জির মূর্তিটি তুলাদণ্ডের একদিকে স্থাপন করেন, অন্য দিকে সোনা দেবার জন্য ভক্তকে আহ্বান করেন। ভক্ত তাঁর পূর্বসঞ্চিত অর্ধ—রতি সোনা তুলাধারে রাখলেন। ভক্তবৎসল ভগবানের আশ্চর্য লীলাপ্রভাবে বিগ্রহটি অর্ধরতির থেকেও কম ওজন হল। পূজারিরা এই ঘটনায় অত্যন্ত অবাক হয়ে গেলেন। তাঁরা বুঝতে পারলেন যে, এর অন্তরালে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের লীলা বিদ্যমান। তাঁরা ভয় পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বিগ্রহটি ভক্তের হাতে তুলে দিলেন। ভক্ত সেটি নিয়ে গিয়ে ডাকোরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
আমরা আগেই বলেছি মীরাবাঈ চিতোর ছেড়ে যাবার পর সেখানে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। ১৫৪১ খ্রিস্টাব্দে বিক্রমজিতের ছোটো ভাই উদয়সিংহ বনবীরকে পরাস্ত করেন। তিনি পৈতৃক সিংহাসন অধিকার করে মহারাণা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন। ১৫৪৪ খ্রিস্টাব্দে মীরার বড়ো জ্যাঠা বীরমদেবজিও পুনরায় নিজের রাজ্য মেড়তা অধিকার করেন। কিন্তু মেড়তা বিজয়ের দু’মাস পর তাঁর মৃত্যু হয়। ফলে তাঁর বড়ো ছেলে জয়মল্লজি মেড়তার রাজসিংহাসনে বসেন।
মেড়তা এবং চিতোরের বাসিন্দারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, যে করেই হোক গৃহলক্ষ্মী মীরাকে আবার এখানে ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু মীরা দ্বারকা ছেড়ে চিতোর বা মেড়তায় ফিরে যেতে রাজি হননি। পার্থিব জীবনের প্রতি তখন তাঁর বিন্দুমাত্র আকর্ষণ ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন জীবনের শেষ দিনগুলি ঈশ্বর আরাধনায় মগ্ন থাকতে। তাই বারবার তাঁদের এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। এতেই প্রমাণিত হয়, মীরাবাঈ ছিলেন কত দৃঢ়চেতা রমণী।
দ্বারকায় বসে তিনি একাধিক পদ রচনা করেন। তখন তাঁকে আমরা দিবানিশি রঞ্ছোড়জির মন্দিরে বসে থাকতে দেখেছি। রঞ্ছোড়জির অপরূপ মূর্তির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতেন মীরাবাঈ। ভাবসমাধির জগতে পৌঁছে যেতেন। পরিদৃশ্যমান পৃথিবী সম্পর্কে কোনও চেতনা থাকত না। এই অবস্থায় একবার লিখলেন—
”তুম পলক উখাড়ো দীনানাথ, হুঁ হাজির নাজির কব কী ঘড়ী।। টেক।।
সাউ মে দুসমন হোই লাগে, সব নে লগূঁ কড়ী।
তুমি বিন সাউ কোউ নহীঁ হৈ, ডিগী নাব মেরী সমঁদ অড়ী।।
দিন নহীঁ চৈন রাত নহিঁ নিদরা, সূখুঁ খড়ী খড়ী।।
বান বিরহ কে লগে হিয়ে মেঁ, ভূলূঁ ন এক ঘড়ী।।
পৎথর কী তো অহিল্যা তারা, বন কে বীচ পড়ী।
কহা বোঝ মীরা মেঁ কহিয়ে, সৌ উপর এক ধড়ী।।
গুরু রৈদাস মিলে মোহি পূরে, ধুর সোঁ কমল ভিড়ী।।
সতগুরু সৈনে দঈ জব আ কে, জোত মেঁ জোত রলী।।”
—ওগো দীননাথ, তুমি চোখ খোলো। আমি তোমার দাসী, তুমি কেন আমার প্রতি দৃকপাত করছো না? আমি যে কখন থেকে তোমাকে দেখার আশায় দাঁড়িয়ে আছি। যারা আমার রক্ষক ছিল, তারা আজ আমার শত্রু হয়েছে। তারা সকলে আমার বিরুদ্ধাচরণ করছে। সকলের কাছে আজ আমি কটূ হয়েছি। হে ঈশ্বর, এ বিশ্বজগতে তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে? আমার মন তো মাঝদরিয়ায় টলমল করছে। দিনে শান্তি নেই, রাতে ঘুম নেই। তোমার চিন্তায় আমি একেবারে শুকিয়ে যাচ্ছি। তোমার বিরহে আমার হৃদয় বিদ্ধ হচ্ছে। এই ব্যথা এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারছি না আমি। প্রভু, তুমি তো জানো, অহল্যা শেষ পর্যন্ত পাথর হয়ে গিয়েছিল। বনের ভেতর একা একা পড়েছিল সে। নিঃসঙ্গতার মুহূর্ত কাটাত সে। অবশেষে তুমি তাকে উদ্ধার করেছো। আমার পাপের ভার কি তার থেকেও ভারি? যারা একশো মন তুলতে পারে, তাদের কাছে ওপর থেকে পাঁচসের আর বেশি কি? গুরু মিললেন রৈদাস, তিনি পূর্ণসিদ্ধ। সেই সত্য গুরুর উপদেশে ব্রহ্মরন্ধ্রে আমার প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হল। আমার পতি সেই মহাজ্যোতির সঙ্গে মিলিত হল।
এক শ্রাবণ—সন্ধ্যায় মীরা লিখেছিলেন—
”সাধন দে রহ্যো জোরা রে, ঘর আও জো শ্যাম মোরারে।।
উমড়—ঘুমড় চহুঁ দিস সে আয়া, গরজত হৈ ঘন ঘোরারে।।
দাদুর মোর পপীহা বোলে, কেয়ল কর রহী সোরারে।।
মীরা কে প্রভু গিরিধর নাগর, জ্যো বারূঁ সোহী থোরারে।।”
—শ্রাবণের অবিরাম বর্ষণ নেমেছে। ওগো এসো শ্যাম ঘরে এসো। গুরুগুরু গর্জনে মেঘ অন্ধকার করে আকাশকে ঢেকে দিয়েছে। দাদুরি ডাকছে। ঘন ঘন কেকারব শোনা যাচ্ছে। এমন সময় একটা কোকিল ডেকে উঠল। ওগো মীরার প্রভু গিরিধারী নাগর, তোমার জন্য আজ আমি যা কিছু উৎসর্গ করেছি তা কমই মনে হচ্ছে।
মেবারের রাণা উদয়সিংহ বুঝতে পারলেন, মীরার কাছে আরও একবার লোক পাঠানো দরকার। মীরার মতো এক ধর্মপ্রাণা মহিলার প্রতি যে অকথ্য অত্যাচার করা হয়েছে, তার জন্য তিনি আন্তরিক ক্ষমাপ্রার্থী। উদয় সিংহের মন ছিল অত্যন্ত কোমল। গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকেন তিনি। তারপর রাজপুরোহিতকে পাঠালেন দ্বারকায়। রাজপুরোহিতের ওপরে একটি গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। তিনি পণ্ডিত ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি যেন মীরাকে চিতোরে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন।
রাজপুরোহিত শেষ পর্যন্ত মীরার সঙ্গে দেখা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি বললেন—আপনি হলেন রাজবধূ, মেবার রাজ্যে ফিরে চলুন। আপনার অভাবে রাজ্যে একটির পর একটি অঘটন ঘটে চলেছে। প্রজাদের অবস্থা অবর্ণনীয়। তাদের দুর্দশা চোখে দেখা যায় না। তারা সকলে আপনার জয়গান গাইছে। আপনি কি এখনও তাদের ফেলে এই মন্দির—প্রাঙ্গণে বসে থাকবেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভক্তদের খুবই ভালোবাসেন। চিতোরের সকলে আপনার পরম ভক্ত। তাদের কান্না কি আপনি শুনতে পাচ্ছেন না? হে মীরা দেবী, আপনি আর এক মুহূর্ত দেরি করবেন না। জানি না সেখানকার অবস্থা এখন কেমন। আপনি গেলে সব বিপর্যয়ের মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
রাজপুরোহিতের মুখ থেকে ছুটে আসা এই শব্দগুলি মীরাবাঈকে আঘাত করল। মীরাবাঈ তখন চরম সঙ্কটের মধ্যে পড়েছেন। তাঁর মন—প্রাণ নানা ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। একবার ভাবছেন মেবারে ফিরে যাবেন। সেখানে গেলে যদি অসংখ্য মানুষের প্রাণরক্ষা পায়, তাহলে তিনি তাই করবেন। পরক্ষণে অন্যতর ভাবনা এসে তাঁর সমস্ত সত্তাকে আচ্ছন্ন করল। তিনি তো এক মহাসাধিকা, শ্রীকৃষ্ণের চরণ—বন্দনায় জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উৎসর্গ করেছেন। তিনি কেন আবার সংসার—সমস্যায় যোগ দেবেন?
শেষ পর্যন্ত উপায়ান্তর না দেখে তিনি রঞ্ছোড়জির মন্দিরে এলেন। ঈশ্বরের প্রতিকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করলেন।
”হরি তুম হর জনকী ভীর।
দ্রোপদীকে লাজ রাখ—তুমি বড়ায়ো চীর।
ভক্ত কারণ রূপ নহরহরি ধরয়ো আপ শরীর।।
হিরণ্যকশ্যপ মারি লীনহো ধরয়ো নাহিন ধীর।।
বুড়তো গজরাজ রাখো ফিরো বাহরনীর।
দাস মীরা লাল গিরিধর দুঃখ জহাঁ তহঁ পীর।।”
—প্রভু, তুমি তো সকলের দুঃখ দূর করো। গায়ে চাদর দিয়ে তুমি দ্রৌপদীর লজ্জা দূর করেছিলে। ভক্ত প্রহ্লাদকে বাঁচাবার জন্য নরসিংহরূপ ধারণ করেছিলে। হিরণ্যকশিপুকে বধ করতে গিয়ে ধৈর্য্য ধরতে না পেরে পূর্বরূপে লীন হয়েছিলে।
হে গিরিধারীলাল, মীরা তোমার দাসী, যেখানে দুঃখ, সেখানে ত্রাণ করো।
এই অবস্থায় তুমি আমাকে বলে দাও, আমি কী করব? আমি যে জীবনের শেষ চেতন—প্রহর পর্যন্ত তোমার সেবিকা হয়ে তোমার কাছাকাছি থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু চিতোরের অবস্থা এখন মোটেই ভালো নয়। আমি না গেলে সেখানে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।
আর একটি গানের মাধ্যমে তিনি তাঁর উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন এইভাবে—
”সজন সুধ জ্যুঁ জানো ত্যুঁ লীজৈ হো।
তুম বিন মোরে আউর ন কোই ক্রিপা রায়রী কীজৈ হো।।
দিন নহি ভুখ রৈণ নহি নিদয়া য়ূঁ তন পল পল।
মীরাকে প্রভু গিরিধর নাগর মিল বিছড়ন মতকীজে হো।।’
—হে সজ্জন সুন্দর, তোমার যেমন ইচ্ছে করতে পারো। তুমি ছাড়া আমাকে আর কে কৃপা করবে? আমার দিনে আহার, রাতে ঘুম নেই। পলে পলে দেহ ক্রমশ ক্ষীণ হচ্ছে। হে গিরিধারী নাগর, তোমাকে যেন পাই, আমায় যেন কখনও ভুলে যেও না।
এই গানটির মধ্যে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদনের সুর শোনা গেল। বোঝা গেল মীরা এখন তাঁর সবকিছু ঈশ্বরকে সমর্পণ করেছেন।
মীরা মন্দির প্রাঙ্গণের দরজা বন্ধ করে দিলেন। বাইরে অপেক্ষমান উন্মুখ জনতা। রাজপুরোহিত বসে আছেন একপাশে। তিনিও মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকছেন। তিনি বলছেন—হে ভগবান, তুমি মীরাবাঈয়ের মন পরিবর্তিত করো। মীরাবাঈ যেন আমার আমন্ত্রণে সাড়া দেন। নাহলে চিতোরের সমূহ বিপদ।
চারপাশ নিস্তব্ধ। আর গান শোনা যাচ্ছে না। শুধু উর্মিমালার চঞ্চলতা প্রকাশিত হচ্ছে শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে। মনে হল বুঝি মহাকাল স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে কৃষ্ণসাধিকা মীরাবাঈয়ের মুখের দিকে।
পল—অনুপল ক্রমশ কেটে যাচ্ছে। রাজপুরোহিত ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। শেষ পর্যন্ত মন্দিরের প্রধান পরিচালক সেখানে এসে উপস্থিত হন। তিনি অনুচরদের আদেশ দিলেন অবিলম্বে দরজা ভেঙে ফেলতে হবে।
গভীর উৎকণ্ঠার মধ্যে দরজা ভাঙা হল। কোথায় মীরা? তাঁর চিহ্নমাত্র কোথাও নেই। এক আশ্চর্য জ্যোতিতে ওই ঘর আলোকে উদ্ভাসিত হয়েছে। বাতাস বহন করছে সুগন্ধ।
মীরা, তুমি কোথায়?
পাষাণে পাষাণে ধ্বনি—প্রতিধ্বনি উঠল বুঝি। দেখা গেল রঞ্ছোড়জির মুখের ওপর মীরার ওড়নার কিছু অংশ লেগে রয়েছে।
তখন সকলে বুঝতে পারলেন যে, মীরা আর বেঁচে নেই। তিনি রঞ্ছোড়জির সঙ্গে লীন হয়ে গেছেন। তার মানে? এইভাবে তিনি নিজের জীবন বিসর্জন দিলেন।
রাজপুতানা অঞ্চলে একথা সকলেই মেনে থাকেন। তাই রঞ্ছোড়জির পুজোর সময় এখনও মীরার পুজো করা হয়।
মীরা ছিলেন পূর্বজন্মে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সখী। তাই বোধহয় শ্রীকৃষ্ণের সাথে তাঁর ছিল আজন্ম সখ্যের সম্পর্ক। বারবার মীরা তাঁর একাধিক পদে এই ঘটনাটির কথা স্মরণ করেছেন। তিনি বলেছেন—”মীরা কহে প্রভু কব রে মিলোগে/পূর্ব জনমকে সাথী।”—প্রভু, তুমি তো আমার পূর্বজন্মের সাথী ছিলে। তোমার সঙ্গে আমার কবে আবার দেখা হবে?
মীরা লিখেছেন—”মীরা কে প্রভু গিরিধর নাগর/পূরব জনম কা হৈ কৌল।”—হে গিরিধারী নাগর, তুমি যে পূর্বজন্মে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে, তার কী হল?
মীরা লিখেছিলেন—
”বহুত দিনো পৈ পীতম পায়ো
বিছুরন কো মোহি ডর রে।
মীরা কহে অতি নেহ জুড়ায়ো
মৈঁ লিয়ো পুরবলী বররে।”
—বহুদিন পরে আমি আমার প্রিয়তমকে পেয়েছি। পাছে আমাকে আবার ছেড়ে যান, এই আমার ভয়। মীরা বলছেন, তুমি এখন আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে প্রেম করো। আমি তো পূর্বজন্মে তোমার কাছ থেকে এই বর পেয়েছিলাম।
জানিনা, শেষ পর্যন্ত মীরাবাঈ তাঁর কাঙ্ক্ষিত শান্তির সন্ধান পেয়েছিলেন কিনা। সারাজীবন ধরে তাঁকে নানাধরনের অনভিপ্রেত ঘটনার সামনে এসে দাঁড়াতে হয়েছে। প্রতি মুহূর্তে হতে হয়েছে অপমানিতা এবং লাঞ্ছিতা। শেষ পর্যন্ত স্বয়ং কৃষ্ণ বোধহয় তাঁর অভিলাষ পূর্ণ করেছিলেন।
আজও মীরাবাঈ একটির পর একটি পদ রচনা করে চলেছেন। জানি না, আজ কোথায় বসে মীরাবাঈ তাঁর ভজন—সঙ্গীত পরিবেশন করছেন। সেখানে শ্রোতা হিসাবে কি উপস্থিত আছেন তাঁর জন্ম—জন্মান্তরের প্রেমিক ওই শ্রীকৃষ্ণ?
নাকি এ সবই হল কবির কল্পনা? মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মীরাবাঈ চিরকালের মতো হারিয়ে গেছেন অবলুপ্তির অন্ধকারে। কিন্তু আজও ভারতবর্ষের এখানে সেখানে মন্দিরের প্রাঙ্গণে, গৃহাঙ্গণে, সন্ধ্যাসমাগমে ধ্বনিত হয় তাঁর ভজন—সঙ্গীত। অসংখ্য মানুষের চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। তাইতো মনে হয়, দুঃখিনী পাষাণ প্রতিমা মীরাবাঈ এভাবে অমরত্ব লাভ করেছেন। তাঁর মতো এক মহীয়সী নারীর কখনও মৃত্যু হয় না। তিনি চিরদিন বিরাজ করেন আমাদের মন—আকাশে এক উজ্জ্বল তারা হয়ে।