॥ ১১ ॥
পঁচিশ বছর পরের কথা।
অরুর বড় মেয়ে রুচির আজ বিয়ে। বিরাট আয়োজন। ছাদে প্যাণ্ডেল হয়েছে। পাঁচশ‘র মত মানুষ দাওয়াত করা হয়েছিল – ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে হাজারের ওপর দাওয়াতী মেহমান এসে পড়েছে। সমস্যা হচ্ছে আকাশের অবস্থা ভাল না। সারাদিন ঝকঝকে রোদ গিয়েছে। সন্ধ্যা থেকেই আকাশ মেঘলা। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। অরুর স্বামী আবরার সাহেব চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছেন। খাওয়া কম পড়ে গেলে সমস্যা হবে। হোটেলে লোক পাঠিয়েছেন। খবর দিয়ে রাখা – প্রয়োজনে যাতে খাবার চলে আসে।
কিছু মেহমান খাইয়ে দিলে ভিড় পাতলা হত। খাওয়ানো যাচ্ছে না। কারণ বর এখনো আসেনি। বড় দেরি করছে। সন্ধ্যা সাত‘টার সময় চলে আসার কথা – এখন বাজছে আটটা। আকাশের অবস্থাও আরো খারাপ করেছে। বৈশাখ মাস, ঝড়ুবৃষ্টির কাল। তিরপল দেয়া আছে।
ভারি বর্ষণ হলে তিরপলে কাজ হবে বলে মনে হয় না। এই নিয়েও আবরার সাহেব দুঃশ্চিন্তা করছেন। তাঁর প্রেসারের সমস্যা আছে। সামান্য দুঃশ্চিন্তাতেও তাঁর প্রেসার বেড়ে যায়। বর আসতে এত দেরি হবার কথা নয়। এত দেরি হচ্ছে কেন?
বর এল রাত সাড়ে আটটায়।
অরুর মেজো মেয়ে কান্তা ছুটে এসে তার মা‘কে বলল, বর এসেছে মা। কি কুৎসিত রুচি দেখলে তুমি বমি করে দেবে। কটকটের হলুদ রঙের একটা পাঞ্জাবী পরে এসেছে। গরম খুব, এই জন্যে না-কি সে আচকান পড়ে নি। পাঞ্জাবী দেখে আমার সব বন্ধুরা হাসাহাসি করছে।
অরু হাতের কাজ ফেলে বর দেখতে গেলেন। বরে মুখের দিকে তিনি তাকালেন না। তাকিয়ে রইলেন কটকটে হলুদ রঙের পাঞ্জাবীর দিকে। তাঁর মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগল। কান্তা বলল, কি হয়েছে মা, এ রকম করছ কেন?
তিনি অস্পষ্ট স্বরে বললেন, শরীরটা ভালো লাগছে না মা। আমাকে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দে তো।
বিয়েবাড়ির আনন্দ কোলাহল থেকে তিনি দূরে সরে গেলেন। ঘর অন্ধকার করে শুইয়ে রইলেন চুপচাপ। আবরার সাহেব খবর শুনে স্ত্রীর পাশে এসে বসলেন। হাত রাখলেন মাথায়।
অরু বললেন, হাজারো কাজের সময় তুমি এখানে বসে আছ কেন? আমি ভাল আছি। মাথাটা কেন জানি একটু ঘুরে উঠল।
আবরার সাহেব বললেন, কোন অসুবিধা নেই। আমি না গেলে কাজ আটকে থাকবে না।
‘ঝড়ুবৃষ্টি হচ্ছে। তিরপল না-কি ঝড়ে উড়ে গেছে। তুমি খোঁজ-খবর করবে না?‘
‘খোঁজ-খবর করার লোক আছে। তুমি চুপচাপ শুয়ে থাকো তো।‘
‘এত সব সমস্যা আর তুমি বসে আছ আমার ঘরে। লোকে হাসাহাসি করবে তো।‘
‘করুক হাসাহাসি।‘
রাত একটার মত বাজে। বিয়েবাড়ি মোটামুটি শান্ত হয়েছে। বরযাত্রীরা চলে গেছে। শুধু বর আর তার কিছু বন্ধু-বান্ধব রয়ে গেছে। এই বাড়িতে বাসর হবে। অল্পবয়স্ক মেয়েদের উৎসাহের সীমা নেই। তারা অকারণে চিৎকার ছোটাছুটি করছে।
কান্তার উৎসাহই সবচে‘ বেশি। যেন বাসরের যাবতীয় খুটি-নাটি সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে দেবার পুরো দায়িত্ব তার উপর। তার বার বছরের জীবনে এমন উত্তেজনার মুহূর্ত আসেনি। সে ছুটতে ছুটতে মা‘র ঘরে এসে ঢুকল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, এখন খুব মজা হবে মা। আপা করছে কি দুলাভাইয়ের পাঞ্জাবী আগুন দিয়ে পুড়াচ্ছে। ‘বন ফায়ার‘ হবে। সবার সামনে আগুন দিয়ে পুড়ানো হবে।
অরুর চোখে জল এসে যাচ্ছে। তিনি সেই জল সামলাবার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। আজ তাঁর মেয়ের বিয়ে। এমন আনন্দের দিনে কি আর চোখের জল ফেলতে আছে?
॥ সমাপ্ত ॥