কৃষ্ণপক্ষ – পর্ব ০৯

॥ ৯ ॥
মুহিবের সব বন্ধুরাই এখনো আছে। চারজন ছিল, তার সঙ্গে আরো দুজন যুক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে একজনের নাম তোফাজ্জল। সে হাসপাতালের ডাক্তারদের বড় বিরক্ত করছে। দশ মিনিট পর পর হাত কচলাতে কচলাতে জিজ্ঞেস করছে, স্যার অবস্থা কি রকম দেখছেন? ইমপ্রুভমেন্ট বোঝা যায়? ব্লাড লাগবে কি-না একটু কাইণ্ডলি বলবেন? আমার আর মুহিবের সেম ব্লাড গ্রুপ – বি পজেটিভ।
শুরুতে ডাক্তাররা তার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন। এখন দিচ্ছেন না। তাকে দেখামাত্র বিরক্ত হচ্ছেন। তোফাজ্জল এইসব বিরক্তি গায়ে মাখছে না। সে যে শুধু ডাক্তারদের বিরক্ত করছে তাই না, নার্সদেরও বিরক্ত করছে। বিশেষ করে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের নার্সদের। দরজায় টোকা দিয়ে বলছে – সিস্টার, একটু বাইরে আসবেন? জাস্ট ফর এ সেকেণ্ড। রুগীর অবস্থাটা একটু বলবেন? খুব টেনশান ফিল করছি। অবস্থা স্টেবল কি-না বলুন। ব্লাড লাগলে জানিয়ে দিলেই হবে। আমারো বি পজেটিভ। আপা কি মনে করেন, অবস্থাটা এখন ভালর দিকে না?
মুহিবের অবস্থা ভালর দিকে নয়। জ্ঞান এখনো আসেনি। সে আছে কোমার ভেতর। হার্টবিট নেমে গেছে। মাঝে মাঝে দু‘একটা বিট মিস করা শুরু করেছে। পায়ের পাতা হয়েছে হালকা নীল যার মানে ফুসফুস রক্ত তেমনভাবে পরিষ্কার করতে পারছে না। রক্তে অক্সিজেন
ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। বাইরে থেকে অক্সিজেন দিয়েও সেই ঘাটতি পুরণ হচ্ছে না। রিফ্লেক্স এ্যাকশান সর্ব নিু পর্যায়ে। চোখের মণিতে কড়া আলো ফেলার পরও মণি তেমনভাবে সংকুচিত হচ্ছে না।
রাত দশটায় রেসিডেন্ট ফিজিশিয়ান তোফাজ্জলকে তার ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন। শুকনো গলায় বললেন, রুগীর অবস্থা ভাল না।
তোফাজ্জল ক্ষীণ স্বরে বলল, একটু আগে একজন সিস্টার বললেন অবস্থা স্টেবল।
‘এখনো স্টেবল। স্টেবল মানেই ভাল তা তো না। অবস্থা খারাপ হওয়া শুরু করেছে।‘
‘ও।‘
‘আমাদের তেমন কিছু করণীয় নেই।‘
‘স্যার, পিজিতে কি ট্রান্সফার করব?‘
‘তাতে কোন উনিশ-বিশ হবে বলে মনে হয় না। পিজিতে যেসব ফেসিলিটি আছে আমাদেরও আছে। আমরা চেষ্টার ত্রুটি করছি না। একমাত্র অপেক্ষা করা ছাড়া এখন আর কিছু করার নেই। অপেক্ষা করুন এবং প্রার্থনা করুন।‘
‘ব্লাড কি লাগবে স্যার?‘
‘একটু পর পর ব্লাডের কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন? লাগলে আপনাদের জানাতাম। রুগী আপনার কে হয়?‘
‘ভেরী ক্লোজ ফ্রেণ্ড স্যার।‘
বলতে বলতে তোফাজ্জল কেঁদে ফেলল। মুহিব তার বিয়ের সময় তাকে খবর দেয় নি। এই দুঃখেও সে একবার কেঁদেছে। এখন কাঁদছে সম্পূর্ণ ভিনড়ব রকম দুঃখে। বছর তিনেক আগে তোফাজ্জলের আলসার অপারেশন হল। দু‘ ব্যাগ রক্ত লেগেছিল। সেই দু‘ ব্যাগ রক্ত মুহিব দিয়েছে। রক্তের ঋণ শোধ হয় নি।
ডাক্তার সাহের অস্বাভাবিক কোমল গলায় বললেন, ভাই কাঁদবেন না। আপনি রুগীর আত্মীয় স্বজন সবাইকে খবর দিন। খুব খারাপ কিছুর জন্যে সবাইকে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে বলুন। আরেকটা কথা – আপনি ইনটেনসিভ ইউনিটের নার্সদের আর বিরক্ত করবেন না। প্লীজ। ওরা আপনার বিরুদ্ধে কমপে−ইন করেছে।
‘স্যার, আমি আর বিরক্ত করব না।‘
তোফাজ্জল ডাক্তারের ঘর থেকে বের হয়ে এল চোখ মুছতে মুছতে। তার বন্ধুরা তাকে কিছুই জিজ্ঞেস করল না। সেও কিছু বলল না। শুধু যখন জেবা এসে বারান্দায় দাঁড়াল তখন সে বলল, আপা, ডাক্তার সাহেব বললেন মুহিবের অবস্থা ভাল না। আত্মীয়-স্বজনদের খবর দিতে বললেন।
জেবা ক্লান্ত গলায় বলল, খবর দেয়ার আর কেউ নেই। ঐ মেয়েটা কি এসেছিল, অরু?
‘জ্বি-না।‘
‘ওর বাসার ঠিকানা কি তোমরা কেউ জান? আমি মেয়েটিকে নিয়ে আসব।‘

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *