কৃষ্ণপক্ষ – পর্ব ০৫

॥ ৫ ॥
মহসিন বলল, শালা হারামী।
এই-জাতীয় গালি সে কিছুক্ষণ পর পর দিচ্ছে। যাকে দেয়া হচ্ছে সে অবশ্যি শুনছে না। সে দশটনি ট্রাক নিয়ে ছুটে যাচ্ছে। যার পেছনে বাম্পারে লেখা – মায়ের দোয়া।
এই ট্রাক ড্রাইভার মহসিনকে সাইড দিচ্ছে না। অন্যদের দিচ্ছে কিন্তু মহসিনের পিকআপকে দিচ্ছে না।
ট্রাক ভর্তি করোগেটেড টিনের শীট। টিনের শীটের উপর দুজন কুলী মাথায় গামছা বেঁধে বসে আছে। দু‘জনের হাতেই বিড়ি। তারা খুব মজা পাচ্ছে। সাইড চেয়ে যে কোন গাড়ি হর্ণ দেয়া মাত্র ট্রাক তাকে সাইড দিয়ে দিচ্ছে। শুধু যখন মহসিন হর্ণ দিচ্ছে তখন ট্রাক চলে যাচ্ছে মাঝ রাস্তায়। ট্রাকে বসে থাকা কুলী দু‘জন দাঁত বের করে হাসছে। তারা খুব মজা পাচ্ছে।
মুহিব বলল, পাল্লা দিয়ে লাভ নেই ড্রাইভার সাহেব। ও সাইড দিবে না।
মহসিন ক্রুদ্ধ গলায় বলল, সবেরে দিতেছে, আমারে দিব না কেন?
‘কে জানে কেন? কোন একটা তামাশা করছে। আমাদের আগে যাবার দরকার নেই, আমরা পেছনে পেছনেই যাই।‘
‘ট্রাকের পেছনে থাকলে রাস্তা দেখা যায় না। চালাতে অসুবিধা।‘
‘তাহলে আসুন এক কাজ করি। চায়ের দোকান দেখে গাড়ি থামান। আমরা চা খাই। ট্রাক এর মধ্যে চলে যাক।‘
‘এই হারামজাদাকে ওভারটেক না করতে পারলে আমি বাপের ঘরের না।‘
‘কোনই দরকার নেই ভাই। আপনি গাড়িটা থামান, আমরা চা খাই। চায়ের তৃষ্ণা হচ্ছে।‘
মহসিন নিতান্ত অনিচ্ছায় গাড়ি থামাল। মুহিব প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি সময় নিয়ে চা খেল। লীনাও মুহিবের সঙ্গে নেমেছে। সেও চা খাবে। তাকে পিরিচে করে চা দেয়া হয়েছে। সে চা খাচ্ছে। লম্বা ঘুম দেওয়ায় তার নিজস্ব ব্যাটারী চার্জ হয়ে গেছে। সে ক্লাস টু‘র বাংলা
বইয়ের সব ছড়া একের পর এক শুনিয়ে যাচ্ছে। ছড়া বলছে হাত পা নেড়ে। ছড়া বলার ফাঁকে ফাঁকে পিরিচে চা ঢেলে তার মুখে ধরে খাইয়ে দিতে হচ্ছে। মুহিবকে লীনা এখন ডাকছে – ছোট মামা। ছোট মামা কেন ডাকছে সেই জানে।
‘ছোট মামা?‘
‘কি?‘
‘রং তুলি কবিতা শুনবে?‘
‘বল।‘
‘রং তুলিতে ছোপ ছাপ
মাঠের পাশে ঝোপ ঝাপ।
ঝোপের পাশে সোনার গাঁও
একটুখানি বসে যাও।‘
মহসিন গম্ভীর মুখে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার মেজাজ ভয়ংকর খারাপ। কেন জানি তার ধারণা হয়েছে যে তাদের পেছনে না দেখে ট্রাকটাও থেমেছে। অপেক্ষা করছে কখন আবার আসে। যেই সে পিক-আপ নিয়ে দেখা দেবে ওমনি ট্রাক ড্রাইভার আগের ফাজলামী শুরু করবে। হারামজাদা।
লীনা চা শেষ করে বলল, নাচ দেখবে ছোট মামা?
‘এখানে নাচবে?‘
‘হুঁ। আমি সব জায়গায় নাচতে পারি।‘
‘এখন তো আমরা রওনা হব। আমরা বরং চিটাগাং পৌঁছে নাচ দেখব।‘
‘তাহলে কবিতা বলি?‘
‘বল।‘
‘খোকন খোকন ময়না
পরিয়ে দেব গয়না
খোকন যাবে মামার বাড়ি
আর যে দেরি সয় না …‘
মহসিন যা ভেবেছিল তাই।
তারা রওনা হয়েছে পনেরো মিনিট পর। এই পনেরো মিনিটে ট্রাকের অনেক দূর চলে যাওয়ার কথা। তা যায়নি। মহসিন পিক-আপ নিয়ে কিছুদূর এগোতেই দেখল ট্রাক। কুলী দু‘জন পিক-আপের দেখা পাওয়া মাত্র আনন্দে হেসে ফেলল। মহসিন বলল, হারামজাদা,
কুত্তা।
মুহিব বলল, ড্রাইভার সাহেব আপনি ওদের লক্ষ্য করবেন না, নিজের মত চালান।
মহসিনের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। চোখ লালচে। সে বিড় বিড় করে কি যেন বলল।
ট্রাকে বসে থাকা কুলী দু‘জন দাঁত বের করে হাসছে। একজন আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছে। মহসিন দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘শুয়োরের বাচ্চা।‘ আর ঠিক তখনি ট্রাক সাইড দিল। ট্রাক ড্রাইভার জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ইশারা করল চলে যেতে। মহসিন তাই করল। নিমিষে ট্রাকের পাশাপাশি চলে এল। ভুল যা করার তা এর মধ্যেই হয়ে গেছে। মহসিনের সামনে কোকাকোলা কোম্পানীর মাইক্রোবাস। পেছনে যাবার উপায় নেই। পেছনে ঢাকা-চিটাগাং লাইনের বিরাট একটা হিনো বাস। বাস ড্রাইভার μমাগত হর্ণ দিচ্ছে। কান ঝাঝা করছে। ট্রাক ড্রাইভার কি ইচ্ছে করে তাকে এই বিপদে ফেলেছে? না রসিকতা? মহসিনের ত্রিশ বছরের গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা কোন কাজে লাগছে না। মাথা কাজ করছে না। চোখের দৃষ্টিও ধোঁয়াটে হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে হঠাৎ ঘন হয়ে কুয়াশা পড়েছে, স্টিয়ারিং হুইল হয়ে গেছে পাথরের মত শক্ত। মহসিন চোখ বন্ধ করে ফেলল।
লীনা শক্ত করে মুহিবের গলা জড়িয়ে ধরে আছে। কিন্তু তাকিয়ে আছে চোখ বড় বড় করে।
মাইক্রোবাস মুখোমুখি ধাক্কা দিয়ে মুহিবদের পিক-আপকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *