কৃষ্ণপক্ষ – পর্ব ০১

কৃষ্ণপক্ষ । হুমায়ূন আহমেদ

উৎসর্গ
অধ্যাপক মোঃ আবদুল বায়েছ ভূঞা
প্রিয়জনেষু

আমার ব্যালকনির জানালা বন্ধ করে রেখেছি
কারণ, কানড়বার শব্দ আমার পছন্দ নয়।
তবু ধূসর দেয়ালের আড়াল থেকে
কানড়বা ছাড়া আর কোন কিছুরই শব্দ শোনা যায় না।
( লোরকা )

॥ ১ ॥
‘নোটটা বদলাইয়া দেন আফা, ছিড়া নোট।‘
অরুর গা বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। কুড়ি টাকার একটা নোটই তার কাছে আছে। ছেড়া নোট বদলাবে কোত্থেকে? অরু গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করতে করত বলল, কই দেখি নোটটা? রিকশাওয়ালার মুখে অহংকার মেশানো বিজয়ীর হাসি। ছেড়া নোটটা আবিষ্কার করে সে খুব খুশী। যেন সে ক্রিষ্টফার কলম্বাস। আমেরিকা আবিষ্কার করে ফেলেছে।
অরু বলল, কই আমি তো ছেড়া দেখছি না।
রিকশাওয়ালা তচ্ছিল্যের ভঙ্গি করে বলল, নজর দিয়া দেহেন।
অরু ‘নজর‘ দিয়ে দেখল। হ্যাঁ ছেড়া। ছিড়ে দুখণ্ড করা। স্কচ টেপ দিয়ে এত সাবধানে জোড়া লাগানো যে রিকশাওয়ালা ছাড়া অন্য কারো বোঝার উপায় নেই।
‘কি আফা বিশ্বাস হইল?‘
অরু ক্ষীণ গলায় বলল, শোন, আমার কাছে আর কোন টাকা নেই। এই একটাই নোট।
তুমি এক কাজ কর পুরোটাই নিয়ে যাও।
‘ছিড়া নোট নিয়া ফায়দা কি?‘
‘ফায়দা আছে। গুলিস্তানে ছেড়া নোট বদলে নেয়। দু‘টাকা বাটা রাখবে। কুড়ি টাকার বদলে তুমি পাবে আঠারো টাকা। দশ টাকা লাভ।‘
‘আমার লাভের দরকার নাই।‘
‘এখন আমি টাকা পাব কোথায়? বলেছি না আমার কাছে একটাই নোট!‘
‘টাকা পয়সা না নিয়া রিকশাতে উঠেন ক্যান?‘
‘ভুল করে উঠি। তুমি ভুল কর না? মাঝে মাঝে বৃষ্টির দিনে প্লাস্টিকের পর্দা ছাড়া চলে আস না?‘
যুক্তি রিকশাওয়ালাকে কাবু করল না। সে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল। অরু বলল, আচ্ছা ঠিক আছে তুমি মিনিট দশেক অপেক্ষা কর। তোমাকে ভাল নোট দেব। রিকশার সিটে বসে আরাম করে চা খাও।
ফ্লাক্সে করে এক ছেলে ঘুরে ঘুরে চা বিক্রি করছে। অরু তাকে ডেকে বলল, তুমি এই রিকশাওয়ালাকে এক কাপ চা দাও। রিকশাওয়ালা খানিকটা হকচকিয়ে গেল। এই জাতীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি সে এর আগে হয় নি।
অরু ঘড়ি দেখল – চারটা সাত।
কাটায় কাটায় চারটার সময় তার আসার কথা, সে তাই এসেছে। মুহিবের খোঁজ নেই। সে মনে হয় আজও দেরি করবে। আজকের দিনটিতেও সে কি সময় মত আসবে না?
কুড়ি একুশ বছরের একটি মেয়ের জন্যে একা একা অপেক্ষা করা যে কি যন্ত্রনা তা ক‘জন জানে? সেজেগুজে একা দাড়িয়ে থাকা মেয়ের দিকে সবাই খানিকটা কৌতুহল, খানিকটা করুণা এবং খানিকটা তাচ্ছিল্য নিয়ে তাকায়। বুড়োরা এমন ভঙ্গি করে যেন দেশ রসাতলে যাচ্ছে। সংসদ ভবনের এই রাস্তা এখন বলতে গেলে বুড়োদের দখলে। সকাল বিকাল এদের দেখা যায় হাঁটাহাঁটি করছে। স্বাস্থ্য রক্ষা। যে করেই হোক আরো কিছুদিন বাঁচতে হবে। সমাজের অনাচার দেখে নাক সিঁটকাতে হবে। কিছুতেই মরা চলবে না।
রিকশাওয়ালা চা খেতে খেতে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে অরুকে দেখছে। এও এক যন্ত্রনা। একজন কেউ তাকিয়ে থাকলে কিছুতেই স্বাভাবিক হওয়া যায় না। অরু আবার ঘড়ি দেখল – মাত্র পাঁচ মিনিট পার হয়েছে। সময় কি পুরোপুরি থেমে আছে? না ঘড়ি বন্ধ?
মুহিবকে এতক্ষণে দেখা গেল। লম্বা লম্বা পা ফেলে ছুটতে ছুটতে আসছে। কোন দিকে তাকাচ্ছে না। অরু ডাকল, এ্যাই। মুহিব থমকে দাঁড়াল। যেদিক থেকে শব্দ এসেছে সেদিকে না তাকিয়ে অন্য দিকে তাকাচ্ছে। কি যে অদ্ভূত কাণ্ডকারখানা! রাগে অরুর গা জ্বলে যাচ্ছে।
আজকের দিনে সে এমন বিশ্রী পোশাক পরে এল কি করে? কে বলেছে তাকে পাঞ্জাবী পরতে? কটকটে হলুদ রঙের সিল্কের পাঞ্জাবীতে তাকে যে কি বিশ্রী দেখাচ্ছে তা বোধহয় সে নিজেও জানে না। আয়না দিয়ে নিশ্চয়ই নিজেকে দেখেনি। অরু গলা উচিয়ে ডাকল, এ্যাই এ্যাই।
মুহিব তাকাল। এবং হেসে ফেলল। সেই হাসি এত সুন্দর যে অরু তার দেরি করে আসার অপরাধ অর্ধেক ক্ষমা করে দিল। কটকটে হলুদ পাজ্ঞাবী পরার অপরাধ অবশ্যি এখনো ক্ষমা করা যাচ্ছে না।
‘তাড়াতাড়ি আসতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। ভেবে রেখেছিলাম আজ অন্তত এক ঘণ্টা আগে উপস্থিত হব। গাড়ি যোগাড় করতে গিয়ে …‘
‘কে তোমাকে গাড়ি যোগাড় করতে বলেছে?‘
‘কেউ বলেনি। ভাবলাম … ‘
‘কোথায় তোমার গাড়ি?‘
‘তেল নেবার জন্যে পেট্রল পাম্পে থেমেছিল – তারপরে আর স্টার্ট নিচ্ছে না।‘
‘ঐখান থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে এসেছ?‘
‘হুঁ। খুব দূর না। আসাদ গেট পেট্রল পাম্প।‘
‘ভাংতি টাকা আছে তোমার কাছে?‘
‘আছে।‘
‘দেখি আমাকে দশটা টাকা দাও। আর ঐ চাওয়ালা ছেলেটাকে এক কাপ চায়ের দাম দাও।‘
অরু টাকা নিয়ে রিকশাওয়ালার দিকে এগিয়ে গেল। হাসিমুখে বলল, এই নাও দশ টাকা। আট টাকা রিকশা ভাড়া। দু‘টাকা ওয়েটিং চার্জ।
তার ইচ্ছা ছিল কিছু কঠিন কথা রিকশাওয়ালাকে বলে। বলা হল না। আজ একটা শুভ দিন। আজ তাদের বিয়ে। এই দিনে কঠিন কথা বলা সম্ভব না। তার একুশ বছর জীবনের অনেক কথাই সে পরবর্তী সময়ে মনে করতে পারবে না। কিন্তু আজকের দিনের সব কথা মনে
থাকবে। কি দরকার আজ ঝগড়া করার? বরং রিকশাওয়ালার নাম জিজ্ঞেস করা যাক। এই রিকশায় করেই না হয় কাজি অফিসে যাওয়া যাবে। যে রিকশায় করে তারা বিয়ে করতে গেল সেই রিকশায়ালার নাম জানা রইল। এটা মন্দ কি?
‘তোমার নাম কি?‘
‘আমারে জিগান?‘
‘হ্যাঁ।‘
‘আমার নাম সুরুজ মিয়া।‘
‘সুরুজ মিয়া, আমরা খিলগাঁও কাজি অফিসে যাব। আজ আমাদের বিয়ে। তুমি কি নিয়ে যাবে আমাদের?‘
রিকশাওয়ালা হ্যাঁ না কিছুই বলছে না। মনে হচ্ছে সে গভীর সমস্যায় পড়ে গেছে। এতক্ষণ যাকে তুমি তুমি করে বলছিল এখন অরু তাকে কি মনে করে যেন আপনি বলল, আপনি চিন্তা করে একটা ডিসিশানে আসুন। বেশি সময় নেবেন না। আমরা দেরি করতে পারব না।
অরু মুহিবের দিকে এগিয়ে গেল। মুহিব সিগারেটের দোকান থেকে সিগারেট কিনছে। সে কখনো একটার বেশি কিনে না। আজ এক প্যাকেট কিনে ফেলল। সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, অরু, তুমি কি তোমাদের বাড়ির কাউকে বিয়ের ব্যাপরে কিছু বলেছ?
অরু বলল, না। তবে রাত দশটা নাগাদ সবাই জেনে যাবে। একটা চিঠি লিখে খামের মুখ বন্ধ করে বড় আপার টেবিলে রেখে এসেছি। আপা বিয়েবাড়িতে গেছে। দশটা নাগাদ ফিরবে।
তারপর হৈ চৈ বেধে যাবে। বাবার স্ট্রোক না হলেই হয়।
‘কি লিখেছ চিঠিতে?‘
‘তিন লাইনের চিঠি – আজ বিয়ে করছি তাই লেখা -‘
‘কিভাবে লেখা – ল্যাংগুয়েজটা কি?‘
‘তিস লাইনে তো খুব কাব্যিক ল্যাংগুয়েজ হয় না। তবু যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।‘
‘কাকে বিয়ে করছ এইসব কিছু লেখনি তো?‘
‘না। শুধু লিখলাম – একটি বেকার এবং আপাতদৃষ্টিতে অপদার্থ যুবককে বিয়ে করছি। আমার মনে হচ্ছে না আমি কোন অপরাধ করছি। তার পরেও ক্ষমা প্রার্থনা করছি – আপা, তুমি বাবা-মা‘কে শান্ত করবে এবং বুঝিয়ে বলবে।‘
মুহিব শুকনো গলায় বলল, তোমার বাবা-মা‘র রিএ্যকশান কি হবে?
‘কি করে বলব কি হবে! তাদের কোন মেয়েতো এর আগে কাউকে কিছু না জানিয়ে বিয়ে করে নি। এই প্রথম এবং এই শেষ। চল রওনা হওয়া যাক।‘
তারা রিকশায় উঠল। মুহিব বলল, হুড তুলে দেব?
‘না।‘
‘খারাপ লাগছে অরু?‘
‘খারাপও লাগছে না আবার ভালও লাগছে না। মনে হচ্ছে একটা ঘোরের মধ্যে আছি। জ্বর জ্বর লাগছে। দেখ তো জ্বর কি-না?‘
‘না জ্বর নেই।‘
অরু হাসতে হাসতে বলল, জ্বর নেই বলে হাত সরিয়ে নিলে কেন? লজ্জা লাগছে?
‘হু, আজ কেন জানি অন্যদিনের চেয়ে অনেক বেশি লজ্জা লাগছে। আজ মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবাই তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।‘
‘তাকিয়ে আছে তো বটেই। তাকিয়ে আছে তোমার হলুদ পাঞ্জাবীর জন্যে। তুমি দয়া করে আজ রাতেই এই পাঞ্জাবী পুড়িয়ে ফেলবে।‘
‘আচ্ছা।‘
অরু হালকা গলায় বলল, বিয়ের পর আমরা যাব কোথায়?
‘বাসর কোথায় হবে এই কথা জিজ্ঞেস করছ?‘
অরু অস্পষ্ট স্বরে বলল, হুঁ।
‘বজলুর বাসায়।‘
‘বজলু কে?‘
‘আমার স্কুল জীবনের বন্ধু, অতি ভাল ছেলে। গত বৎসর বিয়ে করেছে। তার বৌটা তার চেয়েও ভাল। ওরা একটা ঘর আমাদের জন্যে ছেড়ে দিয়েছে। ফুলটুল দিয়ে সাজিয়ে হুলস্থুল করেছে।‘
‘অপরিচিত কারো বাসায় উঠতে আমার ইচ্ছে করছে না।‘
‘ওদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেই তোমার মনে হবে এরা অপরিচিত না। খুবই পরিচিত। তা ছাড়া আমার আর কোন জায়গাও নেই যেখানে তোমাকে নিয়ে যেতে পারি।‘
‘তুমি তোমার আপাকে সব খুলে বলবে বলেছিলে – বলেছ?‘
‘না।‘
‘বলনি কেন?‘
‘কাল বলব। আপাকে একটা সারপ্রাইজ দেব।‘
‘উনি রাগ করবেন না?‘
‘পাগল, আপার রাগ করার ক্ষমতাই নেই।‘
‘আবার একটা সিগারেট ধরিয়েছ, একটু আগেই না একটা খেলে।‘
‘টেনশন বোধ করছি।‘
অরু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এই যে তোমার পাশে বসেছি – শেষবারের মত বন্ধুর পাশে বসেছি। এরপর বসব – স্বামীর পাশে।
‘স্বামী কি বন্ধু না?‘
‘গল্প উপন্যাসে বন্ধু। বাস-বে না। বাস-বের স্বামীরা যতটা না বন্ধু তার চেয়েও বেশী অভিভাবক।‘
মুহিব গম্ভীর গলায় বলল, তুমি ভুল করছ অরু। আমি তোমার বন্ধুই থাকব।
অরু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, থাকলে তো ভালই।
‘তোমার মনে কোন সন্দেহ আছে?‘
‘আছে। হুডটা তুলে দাও। আসলেই সবাই আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি তাকাচ্ছে আমাদের রিকশাওয়ালা। যেভাবে সে পেছন ফিরে ফিরে রিকশা চালাচ্ছে মনে হয় এ্যাকসিডেন্ট করবে।‘
মুহিব হুড তুলে দিল। অরু বলল, আজ কত তারিখ বল তো?
‘এগারোই ডিসেম্বর।‘
‘বাংলা কত?‘
‘জানি না বাংলা কত।‘
অরু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আজ আমাদের বিয়ে আর আজকের বাংলা তারিখটা তোমার জানার ইচ্ছা হল না? আজ ২৬শে অগ্রায়ণ।
‘ও আচ্ছা ২৬শে অগ্রায়ণ।‘
‘আর আমাদের রিকশাওয়ালার নাম হচ্ছে সুরুজ মিয়া। তার নামটাও মনে রাখা দরকার। তার রিকশায় করে বিয়ে করতে যাচ্ছি।‘
মুহিব কিছু বলল না। অরু বলল, ভাল করে দেখ তো জ্বর কি-না। এত খারাপ লাগছে কেন? মাথা ঘুরছে। ভুলে জরদা দিয়ে পান খেলে যেমন লাগে তেমন লাগছে।
‘কিছুক্ষণের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ধর আর আধ ঘণ্টা।‘

অরু ঘড়িতে দেখল তাদের বিয়ের পুরো অনুষ্ঠান শেষ হতে মাত্র ১৬ মিনিট লাগল। কাজী সাহেবের কাছে অনুষ্ঠানটা হয়ত খুব ‘বোরিং‘ লাগছে। তিনি কয়েকবার হাই তুললেন এবং যন্ত্রের মত বললেন, এইখানে সই করেন। তারিখ দেন। অরু গোটা গোটা করে লিখল, অরুণা চৌধুরী। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ। কি আশ্চর্য! কটকটে হলুদ পাঞ্জাবী গায়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা এখন তার স্বামী। এই জীবনের সবচে‘ কাছে মানুষ। কোন ভুল হয়নি তো? প্রচণ্ড বড় কোন ভুল! যে ভুল এই জীবনে আর শোধরানো যাবে না। অরুর পানির পিপাসা পেয়ে গেল।
কাজী সাহেবকে সে কি বলবে পানির কথা? না-কি মুহিবকে বলবে? মুহিবের সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা লাগছে। মুহিবের দিকে তাকাতেও লজ্জা লাগছে।
বজলু এগিয়ে এসে বলল, ভাবী, চলুন যাওয়া যাক।
ভাবী ডাকটা কি অদ্ভূত শোনাচ্ছে! গা শির শির করে। অরু নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরুল।
মুহিবের অন্য বন্ধুরা এখনো কেউ তাকে কিছু বলেনি। একজন শুধু তাকে বলেছে – কনগ্র্যাচুলেশনস ভাবী, বলে হাতে একটা গোলাপ ফুল দিয়েছে। ফুলটার দিকে তাকাতেও কেন জানি লজ্জা লাগছে। মুহিবকেও অন্য রকম লাগছে। ও আচ্ছা এখন বোঝা গেল – বাবু চুল
কেটেছেন। নতুন হেয়ার স্টাইল।
গোলাপ ফুল দেয়া মানুষটা বলল, কোথাও বসে এক কাপ চা কিংবা কোল্ড ড্রিংস খাওয়া যাক। কাছেই একটা ভালো কনফেকশনারী দোকান আছে। যাবে?
বজলু বলল, না না – স্ট্রেইট আমার বাসায় চল। কেক কেনা আছে। কেক কাটা হবে।
রেনুকে চা রেডি রাখতে বলেছি। গাড়িতে উঠ সবাই। গাড়িতে উঠ। মুহিব তুই ভাবীকে নিয়ে ড্রাইভারের পাশে বস। আমরা সবাই পেছনে আছি।
অরুর প্রচণ্ড পানির পিপাসা পাচ্ছে। মনে হচ্ছে এক গ্লাস পানি খেতে না পারলে সে মরে যাবে। বজলু নামের মানুষটার বাসায় তার যেতে একেবারেই ইচ্ছা করছে না। এমন কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে যেখানে একটা মানুষও নেই। খুব নির্জন কোন জায়গা, যেখানে শুধু সে এবং মুহিব থাকবে। আর কেউ থাকবে না। কেউ না।

বজলুর স্ত্রী রওশন আরাকেও অরুর পছন্দ হল না। মেয়েটা এক সেকেণ্ডের জন্যে না থেমে কথা বলে যাচ্ছে। ক্রমাগত কথা। ছোটাছুটিও করছে অকারণে। এই সামান্য সময়ে একটা গ্লাস ভেঙেছে, টেবিল ক্লথের উপর পায়েস ফেলে দিয়েছে। সামান্য চা দেয়া নিয়ে সে যে
কথাগুলি বলল তা হচ্ছে –
‘ও মা। এখনো চা দিলাম না। ঠাণ্ডা হয়ে গেছে বোধহয়। ঠাণ্ডা হলে ঠাণ্ডা চা খেতে হবে। আমি আবার গরম করতে পারব না। সারাক্ষণ চুলার পাশে বসে থাকলে গল্প করব কখন? চায়ে কিন্তু চিনি দেই নাই। যার যার দরকার নিয়ে নেবেন। সরি সরি, চিনি বোধ হয় দেয়া হয়েছে। আগে চেখে দেখবেন। এখানে ডায়াবেটিসওয়ালা কেউ আছে? থাকলে আওয়াজ দিন। আর শুনুন, চায়ের কাপে সিগারেট ফেললে ঐ চা জোর করে খাইয়ে দেব। মাই গড, চামুচ দেয়া হয়নি।‘
মুহিব অরুকে বলল, একটু বারান্দায় এসো তো।
অরু বারান্দায় এসে ক্লান্ত গলায় বলল, সবাই এত কথা বলছে – আমার একেবারে মাথা
ধরে গেছে।
‘এরা বেশিক্ষণ থাকবে না, চলে যাবে। তুমি কি কিছুক্ষণ রেস্ট নেবে? রেস্ট নিতে চাইলে পাশের ঘরে চলে যাও – তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে শরীর খারাপ করেছে।‘
‘প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। আর পানির পিপাসা হচ্ছে। তিন গ্লাস পানি খেয়েছি তবু পিপাসা মিটছে না।‘
‘মাথা ধরা কি খুব বেশি?‘
‘হুঁ।‘
‘দাঁড়াও, প্যারাসিটামল এনে দিচ্ছি। শোন অরু, আমাকে ঘণ্টা খানিকের জন্যে একটু বাইরে যেতে হবে।‘
অরু হকচকিয়ে গেল। গম্ভীর গলায় বলল, কেন?
‘আমার দুলাভাই বলে রেখেছেন যেন ঠিক সাড়ে সাতটায় অফিসে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। তাঁর কথা তো তোমাকে বলেছি – দেখা না করলে – স্ট্রেইট বলবে, বের হয়ে যাও।‘
অরু দুঃখিত গলায় বলল, আজকের দিনটা তুমি আলাদা রাখতে পারলে না? বলতে পারলে না যে তোমার কাজ আছে?
মুহিব অস্পষ্ট স্বরে বলল, না অরু বলতে পারি নি। দুলাভাইকে এটা বলা সম্ভব না। তাছাড়া আমার ক্ষীণ সন্দেহ কি জান? চাকরির কোন ব্যাপার। উনি হয়ত কিছু ব্যবস্থা করেছেন। ইচ্ছা করলে তো তিনি পারেন। তুমি ঘণ্টা খানিক থাক, আমি চলে আসব।
‘এই বাড়িতে আমার এক সেকেণ্ডও থাকতে ইচ্ছা করছে না। তোমার বন্ধু পত্নীকে আমার অসহ্য বোধ হচ্ছে।‘
‘ও কিন্তু খুব ভাল মেয়ে অরু। কথা বেশি বলে। কিন্তু মেয়ে চমৎকার। আমার একটা জেনারেল অবজারভেশন কি জান? যারা কথা বেশি বলে তারা মানুষ ভাল হয়। যাও, তুমি ভেতরে গিয়ে বস। এক ঘণ্টার বেশি আমি এক সেকেণ্ডও দেরি করব না। অনেস্ট।‘
‘এক ঘণ্টার বেশি আমাকে যদি এই বাড়িতে থাকতে হয় – আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যাব – ঐ মহিলাটিকে আমার অসহ্য বোধ হচ্ছে।‘
কথা শেষ হবার আগেই বারান্দায় রওশন আরাকে দেখা গেল। সে চেঁচিয়ে বলল, কাজকারবার এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেল? সারা রাত তো ভাই পড়েই আছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাল বাসাবাসি না করলে হয় না?
অরুর অসহ্য বোধ হলেও সে হাসার ভঙ্গি করল। এই মহিলা কিছুক্ষণ আগে তাকে
ভয়ঙ্কর গা-জ্বালা ধরানোর মত কিছু কথা বলেছেন। অরুর ইচ্ছা করছিল গলা চেপে ধরতে।
রওশন আরা ভাল মানুষের মত তাকে ডেকে পাশের ঘরে নিয়ে গেছে। গায়ে হাত রেখে কথা বলা শুরু করেছে –
‘এই দেখ ভাই তোমাদের বাসর ঘর। পছন্দ হয় কি না দেখ।‘
অরুর পছন্দ হল। ঘরটা আসলেই সুন্দর করে সাজানো। বালিশের ওয়ার এবং বিছানার চাদর হালকা গোলাপী। গোলাপী চাদরে বেলী ফুল এবং গোলাপ দিয়ে নানা রকমের নকশা করা। খাটের পাশে সাইড টেবিলে ফুলদানি ভরতি গোলাপ। ঘরের অন্য প্রানে- একটা টেবিলে পানির জগ এবং গ্লাশ। একটা ফ্লাক্স এবং চায়ের কাপও দেখা যাচ্ছে। ঘরের চার কোণায় চারটা ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে।
‘অরু ভাই শোন, প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছি। বাসররাতে ঘর কখনো অন্ধকার করতে নেই। এই জন্যেই প্রদীপ। প্রদীপ নেভাবে না। ভয়ের কিচ্ছু নেই, তোমরা কি করছ বা করছ না আমরা দেখতে আসব না। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে – ফ্লাক্সে চা আছে, টিফিন বক্সে কেক বিসকিট এবং লাড্ডু আছে। গল্প করতে করতে রাত তিনটা সাড়ে তিনটার দিকে ক্ষিধে পেয়ে যাবে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আমাদের কি হয়েছে শোন – এমন ক্ষিধে পেয়ে গেল। হিহি-হি। পেটের ক্ষিধে কি আর চুমু খেলে মিটে? কি ভাই ঠিক না? তোমাদের জন্যে এই কারণেই সব খাবার-দাবার দিয়ে দিয়েছি। সবচে‘ ইম্পর্টেন্ট জিনিস রেখেছি তোষকের নিচে। ইম্পর্টেন্ট জিনিসটা কি বল তো?
‘জানি না।‘
‘বিয়ের রাতেই তুমি নিশ্চয়ই প্রেগনেন্ট হতে চাও না? যাতে না হতে হয় সেই ব্যবস্থা। এটাও ভাই আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ফসল। এখন তুমি আমাকে অসভ্য ভাবছ। পরে আমাকে থ্যাংস দেবে। বুঝলে?‘
অরু কোন কথা বলেনি। কথা বলতে ইচ্ছে করেনি। মুহিব যে এক ঘণ্টা থাকবে না সেই এক ঘণ্টা তার কি করে কাটবে ভেবেই অস্থির লাগছে। তাছাড়া মাথা ধরাটা বাড়ছে। নির্ঘাৎ জ্বর এসে গেছে। বমি বমি ভাবও হচ্ছে।

মুহিব তার দুলাভাই ইস্ট এশিয়াটিক লিমিটেড-এর জেনারেল ম্যানেজার শফিকুর রহমান সাহেবের ঘরের দরজা ফাঁক করে মাথা ঢুকাল।
শফিকুর রহমান বললেন, অপেক্ষা কর। আমি তোমাকে ডাকব। বলেই তিনি হাত ঘড়ির দিকে তাকালেন। সাতটা পাঁচ বাজে। মুহিবকে সাতটায় আসতে বলেছিলেন। সে পাঁচ মিনিট দেরি করে এসেছে।
শফিকুর রহমান সাহেবের এই অফিস ঘরটি বেশ জমকালো। ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট। বিশাল আকৃতির সেক্রেটেরিয়েট টেবিলে তিনটা টেলিফোন। একটা টেলিফোনের রঙ লাল। মনে হয় কোন মিনিস্টারের ঘর। এয়ার কুলার আছে। এই শীতেও এয়ার কুলার চালু করা। বিজ বিজ শব্দ হচ্ছে। মাথার উপর খুব আসে- ফ্যান ঘুরছে। শফিকুর রহমান মাঝে মাঝেই রাত ন‘টা-দশটা পর্যন্ত অফিস ঘরে থাকেন।
তিনি মানুষটা ছোটখাট তবে তাঁকে দেখলেই মনে হয় ঈশ্বর এ-জাতীয় মানুষদের একজিকিউটিভ বস বানানোর জন্যে বিশেষ করে তৈরি করেছেন। তাঁদের গলার স্বর এয়ার কুলারের হাওয়ার মতই শীতল। মেজাজও শীতল, তবে সেই শীতল মেজাজের সামনে এসে দাঁড়ালে বুকের রক্তও শীতল হয়ে যায়।
ঠিক সাতটা কুড়ি মিনিটের সময় শফিকুর রহমান বেল টিপলেন। মুহিব দরজা খুলে ঢুকল। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, তোমাকে ডাকিনি, তুমি বস। যথাসময়ে ডাকব। বেয়ারাকে ডেকেছি চা দেবার জন্যে।
‘একটা কাজ ছিল দুলাভাই।‘
‘আমিও তোমাকে কাজেই ডেকেছি। অকাজে ডাকিনি। অপেক্ষা কর।‘
মুহিব ঘর থেকে বেরিয়ে ওয়েটিং রুমে বসল।
শফিকুর রহমান তাঁকে কফি দেয়ার নির্দেশ দিয়ে টেলিফোন নিয়ে বসলেন। বিদেশের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগের জন্যে এই সময়টাই উত্তম। কিছু জরুরী ট্রানজেকশন টেলিফোনের মাধ্যমেই হবে। এল সি সংক্রান্ত কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে।
রাত আটটায় মুহিব আবার উঁকি দিল। ক্ষীণ গলায় ডাকল, দুলাভাই।
শফিকুর রহমান ফাইল দেখছিলেন। ফাইল থেকে চোখ তুললেন না। মুহিব বলল, আমার খুব জরুরী একটা কাজ ছিল।
শফিকুর রহমান শীতল গলায় বললেন, তোমার সঙ্গে জরুরী কথা আছে বলেই তোমাকে আসতে বলেছি। গসিপ করার জন্যে ডাকি নি। তারপরেও তুমি যদি মনে কর তোমার কাজ অসম্ভব জরুরী তাহলে চলে যেতে পার। তোমাকে বেঁধে রাখা হয়নি।
তিনি টেলিফোন তুলে ডায়াল করা শুরু করলেন। মুহিব ফিরে গেল আগের জায়গায়। তার মুখে থু থু জমতে শুরু করেছে, অসম্ভব রাগ লাগছে। ইচ্ছে করছে পুরো অফিসটা পেট্রল দিয়ে পুড়িয়ে দিতে। তার সামনেই এসট্রে তবু সে ইচ্ছে করে কার্পেটে সিগারেটের ছাই ফেলছে।
অফিস এ্যাটেণ্ডেন্ট রফিক মিয়ার অবস্থাও তার মত। সাহেব অফিসে আছেন বলে সেও যেতে পারছে না। শুকনো মুখে হাঁটাহাঁটি করছে। কিছু করার নেই বলেই বোধহয় মুহিবকে এসে জিজ্ঞেস করল, এই বৎসর শীত কেমন বুঝতেছেন স্যার? মুহিব কোন কথা বলল না যদিও তার বলতে ইচ্ছে করছে – কাছে আস রফিক মিয়া, তোমার গালে একটা চড় দেই। চড় খেলে বুঝবে শীত কত প্রকার ও কি কি?
মুহিবের ডাক পড়ল রাত দশটায়। শফিকুর রহমান হাই তুলতে তুলতে বললেন, সরি, অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম। তোমাকে কি কফি দেয়া হয়েছে?
‘জ্বি।‘
‘দাঁড়িয়ে আছ কেন, বোস।‘
মুহিব বসল। মনে মনে বলল, আপনাকে আমি কোন কালেই পছন্দ করি নি। ভবিষ্যতে কখনো করব, সেই সম্ভাবনাও অত্যন্ত ক্ষীণ। আপনি অতি কুৎসিত একটি প্রাণী। মাকড়শা দেখলে মানুষের যেমন গা ঘিন ঘিন করে – আপনাকে দেখলেও আমার অবিকল সেই রকম গা ঘিন ঘিন করে। এখন আপনাকে দেখাচ্ছে একটা মাকড়শার মত। মেয়ে মাকড়শা। যে পেটে ডিম নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
‘মুহিব।‘
‘জ্বি।‘
‘তোমাকে চিটাগাৎ যেতে হবে।‘
মুহিবের গা দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। বুক ধক ধক করতে লাগল। মনে হচ্ছে মাকড়শাটা এখন বলবে – আজ রাতেই যেতে হবে। তুর্ণা নিশীথায়।
মুহিব চাপা গলায় বলল, কখন যেতে হবে?
‘দি আর্লিয়ার, দি বেটার। ভোড়ের ট্রেনে যেতে পার। কিংবা দুপুরের দিকে যেতে পার। দুপুরে অফিসের একটা গাড়ি চিটাগাং যাবে। যেটা তুমি প্রেফার কর। তোমার জন্যে চাকরির ব্যাবস্থা করা হয়েছে। কি চাকরি বেতন কত সব চিটাগাং গেলেই জানবে। টেলিফোনে কথা বলে রেখেছি। আজ দুপুরেই কনফার্ম করা হয়েছে। ছয় সাত হাজার টাকা বেতন হবার কথা। তারচে‘ বেশিও হতে পারে। সবচে‘ যেটা ভাল সেটা হচ্ছে – কোয়ার্টার আছে। যতদূর শুনেছি ভালো কোয়ার্টার। বিদেশে ট্রেনিং-এর সুযোগ পাবে। সব সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে অল্প সময়ে ভালো উনড়বতি করবে।‘
মুহিবের হৃৎপিণ্ড এমন লাফাচ্ছে যে মনে হচ্ছে গলা দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসবে। গলার ফুটো ছোট বলে বেরুতে পারছে না। এটা স্বপড়ব দৃশ্য নয়তো? চেয়ারে বসে সে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে স্বপড়ব দৃশ্য খুব বাস-ব হয়। দুলাভাই তার দিকে তাকিয়ে আছেন। স্বপড়ব দৃশ্য হলেও এই মানুষটাকে ধন্যবাদ সূচক কিছু বলা উচিত। মুহিব ফ্যাস ফ্যাসে গলায় বলল, ‘থ্যাংকস দুলাভাই।‘
‘আমাকে থ্যাংকস দেবার দরকার নেই। তুমি আমাকে পছন্দ কর না তা আমি জানি। আমিও যে তোমাকে পছন্দ করি তাও না। যাই হোক, কাজকর্ম ঠিকমত করবে। রেসপনসিবিলিটি নামক ব্যাপারটি আ্তস্থ করার চেষ্টা করবে। ঠিক আছে এখন তাহলে যাও।‘
মানুষটাকে এখন আর মাকড়শার মত লাগছে না – বরং সুন্দর লাগছে। সুন্দর। ঘর থেকে বেরুনোর সময় দরজায় ধাক্কা খেয়ে কপালের একটা অংশ ফুলে গেল। ব্যথা লাগছে। এটা তাহলে স্বপড়ব নয়। স্বপ্নে শারিরীক ব্যথা বোধ থাকে না।

মুহিব আশঙ্কা করছিল রাত এগারটায় সে যখন উপস্থিত হবে অরু অসম্ভব রাগ করবে। কেঁদে-কেঁটে একাকার করবে। সে-রকম কিছু হল না। অরু হাসিমুখে বলল, আমি ভাবলাম তুমি পালিয়ে গেছ, প্রচণ্ড ক্ষিধে লেগেছে। এসো খেতে বসি। আদর্শ বাঙালী স্ত্রীদের মত না
খেয়ে বসে আছি।
মুহিব বলল, ওরা কোথায়?
অরু হাসতে হাসতে বলল, তুমি চলে যাবার কিছুক্ষণ পরই তোমার অন্য বন্ধুরা চলে গেল। তারপর মজার একটা ব্যাপার হল – তোমার প্রিয় বন্ধু বজলু এবং রওশন আরা ভারী অকারণে তুমুল ঝগড়া শুরু করলেন। সে এক দেখার মত দৃশ্য। আমি হতভম্ব। এত অল্প সময়ে ঝগড়া ক্লাইমেক্সে চলে যেতে পারে তা আমার জানা ছিল না। রওশন আরা ভাবী কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমি কি নাইলনের দঁড়ি দিয়ে তোমাকে বেঁধে রেখেছি? গো এওয়ে। তুমি চলে গেলে আমি প্রাণে বেঁচে যাই। তুমি আমার লাইফ হেল করে দিয়েছ। তারপরই ভাবী উল্কার বেগে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। আমি তোমার বন্ধুকে বললাম, আপনি দেখছেন কি উনাকে আটকান।
বজলু সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, আমি আটকাব কেন? আমার কিসের দায়? আপদ বিদেয় হয়েছে ভাল হয়েছে। তার আধ ঘণ্টা পরই বজলু সাহেবের মাথা ঠাণ্ডা হল। উনি নরম গলায় বললেন, আমার মিসটেক হয়েছে। খুবই খারাপ লাগছে। কি করা যায় বলুন তো? ও গেছে তার ভাইয়ের বাড়ি, নিয়ে আসি কি বলেন? আমি কিছু বলার আগেই উনিও উল্কাল মত বেরিয়ে গেলেন। সেই থেকে আমি একা বসে আছি।
‘সে কি! আর কেউ নেই?‘
‘একটা কাজের মেয়ে আছে। সে বলল, সপ্তাহে এই ঘটনা দু‘ থেকে তিনবার হয়। সাধারণত হয় সন্ধ্যার দিকে। বেগম-সাহেব তার ভাইয়ের বাসায় চলে যান। সাহেব যান তাঁর পিছু পিছু। রাত বারোটা-একটার দিকে ভাই গাড়ি করে দু‘জনকে পৌঁছে দিয়ে যান।‘
‘তার মানে কি এই যে এ-বাড়িতে আমরা এখন মাত্র দু‘জন?‘
‘কাজের মেয়েটি আছে।‘
‘সে ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই। কোন কাজকর্ম না থাকলে এরা অতি দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে পারে।‘
‘অরু হাসতে হাসতে বলল, ও ঘুমুচ্ছে। দাঁড়াও ওকে ডেকে দিচ্ছি, খাবার গরম করুক।‘
‘ডাকতে হবে না। খাবার যা গরম করার তুমি কর। আমি পাশে দাঁড়িয়ে ডিরেকশন দেব। তোমার মাথা ধরা সেরেছে?‘
‘হু। ঘর ফাঁকা হওয়া মাত্র মাথা ধরা চলে গেল।‘
অরু রানড়বাঘরে ঢুকল। অরুর পেছনে পেছনে গেল মুহিব। অরু থালা-বাসন, হাড়ি-কুড়ি এমনভাবে নাড়ছে যেন এই রানড়বাঘর তার দীর্ঘদিনের চেনা। তার নিজেরই যেন বাড়িঘর। মুহিব বলল, একটা থালায় খাবার গরম করে দাও – রানড়বাঘরে দাঁড়িয়েই খেয়ে ফেলি।
অরু বলল – একসেলেন্ট আইডিয়া।
‘মেনু কি?‘
‘পোলাও টোলাও করে হুলস্থুল করেছেন।‘
মুহিব বলল – নিজেরা বোধ হয় না খেয়ে আছে। অরু পে−টে খাবার বাড়তে বাড়তে বলল, বিয়ের রাতে আমি তোমার সঙ্গে ঝগড়া করব না। শুধু জানতে চাচ্ছি কি মনে করে তুমি এত দেরি করলে?
‘ইচ্ছে করে করিনি।‘
‘ইচ্ছে করে যে করনি তা অনুমান করতে পারছি। তোমার দুলাভাই তোমাকে আটকে ফেলেছিলেন, এই তো ব্যাপার? তুমি তার হাত থেকে বের হয়ে আসতে পারলে না। একটি রাতের জন্যে কি এই সাহস দেখানো যেত না?‘
মুহিব বলল, তুমি কিন্তু ঝগড়ার সুরে কথা বলা শুরু করেছে। আজ ঝগড়া করলে সারা জীবন ঝগড়া হবে। এসো আজ রাতটা হেসে হেসে পার করে দি। আমি এগারটা হাসির গল্প রেডি করে রেখেছি। শুনবে আর হাসতে হাসতে ভেঙ্গে পড়বে। এগারটা গল্পের মধ্যে পাঁচটা ভদ্র আর দু‘টা হচ্ছে মিড নাই স্পেশাল। রাত বারোটার পর বলা যায়।
অরু বলল, খবরদার কোন অশ্লীল গল্প চলবে না। অশ্লীল গল্প বললে আমি কিন্তু খুব রাগ করব।
‘পৃথিবীর সবচে‘ মজার গল্পগুলি হচ্ছে অশ্লীল গল্প।‘
‘আমি পৃথিবীর সবচে‘ মজার গল্পগুলি শুনতে চাচ্ছি না। তুমি বরং কম মজার গল্পগুলি বল। এখুনি শুরু কর। তার আগে জানতে চাচ্ছি কপাল ফাটালে কি করে?
মুহিব বলল, দুঃখে মানুষের কপাল ফাটে আমারটা ফেটেছে আনন্দে। পরে তোমাকে গুছিয়ে বলব এখন শোন স্টোরি নাম্বার ওয়ান। স্যার ক্লাসে পড়াচ্ছেন। শেরশাহ প্রথম ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করেন। এক ছাত্র তাই শুনে অবাক হয়ে বলল, সে কি স্যার! শেরশাহের আগে কি ঘোড়া ডাকতে পারত না?
অরু হাসতে হাসতে বিষম খেল। হাসির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে কাজের মেয়েটি উঠে এসেছে। সে দুজনকে রানড়বাঘরে দেখে বেশ অবাক হল। অরু বলল, এ্যাই শোন, তোমার তো খাওয়া হয়ে গেছে। তোমার ঘুম পেলে ঘুমিয়ে পড়। থালা-বাসন কিচ্ছু ধুতে হবে না। আমি দরজা-টরজা খুব ভাল মত বন্ধ করে ঘুমুতে যাব।
মুহিব বলল, সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না – দ্বিতীয় গল্পটি শোন। রোগশয্যায় শায়িতা স্ত্রী কাঁদো কাঁদো গলায় স্বামীকে বলছে, আমি জানি আমি মারা গেলেই তুমি বাঁচ, তাই না?
স্বামী স্ত্রীর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, এমন নির্মম সত্য কথা এভাবে বলতে নেই লক্ষ্মী সোনা। একটু ঘুমানোর চেষ্টা কর।
অরু এই গল্পে হাসল না। বিরক্ত স্বরে বলল, মেয়েদের ছোট করা হয় যেসব গল্পে সেসব শুনতে আমার ভাল লাগে না।
‘এই গল্পে কোথায় মেয়েদের ছোট করা হল?‘
‘ছোট করা হয়েছে, তুমি বুঝবে না।‘
‘কোথায় ছোট করা হয়েছে বুঝিয়ে বল। আমি একটা সহজ রসিকতা করলাম। এখানে মেয়েদের কোথায় ছোট করা হল -?‘
অরু বলল, আলাপ আলোচনা আবার কিন্তু ঝগড়ার দিকে টার্ন নিচ্ছে।
‘আমি মজার কিছু গল্প বলার চেষ্টা করছি। তুমি যদি সেগুলি ঝগড়ায় নিয়ে যাও আমি কি করব?‘
‘গল্প বলা বন্ধ করে চল ঘুমুতে যাই। অসম্ভব ঘুম পাচ্ছে।‘
মুহিব বলল, আজ তো ঘুমুনোর কথা না। পৃথিবীতে এমন কোন স্বামী-স্ত্রী পাবে না যারা বাসর রাত ঘুমিয়ে কাটিয়েছে।
অরু বলল, আমরা তাহলে হব ব্যাতিক্রম। আমরা বিছানায় যাওয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়ব। এক ঘুমে রাত কাবার করে দেব।
‘আমি তোমাকে এক সেকেণ্ডের জন্যেও ঘুমুতে দেব না। দরকার হলে গায়ে সিগারেটের ছ্যাঁকা দেব।‘
‘দ্যাট রিমাণ্ডইস মি। শোবার ঘরে তুমি কিন্তু সিগারেট ধরাতে পারবে না। ফুলের গন্ধে ঘর ম ম করছে। তুমি সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘর দুর্গন্ধ করে ফেলবে তা হতে দেব না। দয়া করে সিগারেট যা খাওয়ার এই রানড়বাঘরে খেয়ে যাও। আর গা থেকে পাঞ্জাবীটা খুলে দাও। আমি এখন এটা পুড়াব।‘
‘সত্যি পুড়াবে?‘
‘হ্যাঁ সত্যি। খোল। এক্ষুণি খোল।‘
‘কি পাগলামী করছ।‘
‘কোন পাগলামী করছি না। যা বলছি সুস্থ মাথায় বলছি। আমি তোমার পাঞ্জাবী পুড়াবই। এটা হবে আমাদের জীবনের একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে – বাসর রাতে কি করেছে? আমি বলব, স্বামীর পাঞ্জাবী পুড়িয়ে ছাই বানিয়েছি।‘
যে পাঞ্জাবী পরে বিয়ে করেছি সেই পাঞ্জাবী আমি পুড়াতে দেব না। যতড়ব করে তুলে রাখব। আমার ছেলে এই পাঞ্জাবী পরে বিয়ে করতে যাবে।
পাঞ্জাবী পুড়ানো হল না। তারা এক সঙ্গে শোবার ঘরে ঢুকল। অরু বলল, তুমি শুয়ে পড়, আমি শাড়ি পাল্টে আসছি। সিল্কের শাড়ি পড়ে আমি ঘুমুতে পারব না। রওশন আরা ভাবীর কাছ থেকে আমি একটা সুতি শাড়ি রেখে দিয়েছি।
মুহিব বলল, শাড়ি পাল্টে আসতে চাচ্ছ আস, কিন্তু খবর্দার ঘুমের নাম মুখে আনবে না।
সারা রাত জেগে থাকতে হবে।
‘আচ্ছা যাও সারা রাত জেগে থাকব।‘
‘হাই তুলতে পারবে না, এবং বলতে পারবে না যে ঘুম পাচ্ছে।‘
‘আচ্ছা বাবা যাও বলব না।‘
শাড়ি পাল্টে এসে অরু দেখে মুহিব ঘুমুচ্ছে। গাঢ় ঘুম। অরু তাকে জাগাল না। মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অসংখ্যবার বলল, আমি তোমাকে কতটুকু ভালবাসি তা তুমি কোন দিনও জানবে না। তোমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। পৃথিবীতে আজ এই মুহূর্তে আমার চেয়ে সুখি মেয়ে কেউ নেই। তার চোখে পানি এসে গেল।
ঘরের চার কোণায় ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে। ফুলের গন্ধে বাতাস সুরভিত। শেষ রাতে আকাশে চাঁদও উঠল। প্রদীপের আলোর সঙ্গে চাঁদের আলো মাখামাখি হয়ে নতুন এক ধরনের আলো তৈরি হল। অরুর খুব ইচ্ছা করছে ঘুম ভাঙ্গিয়ে মুহিবকে এই অদ্ভূত আলো দেখায়। কিন্তু বেচারা ক্লান্ত হয়ে ঘুমুচ্ছে। আহা! বেচারা ঘুমাক। অরুর জেগে থাকার কথা, সে জেগে থাকবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *