কৃষ্ণধাম কথা – বিমল কর

কৃষ্ণধাম কথা – বিমল কর

বাসটা ঠিক জায়গাতেই নামিয়ে দিল। রাস্তা ঘেঁষে বটগাছ। একটার গায়ে গায়ে আরেকটা। বাসস্টপের নাম ‘জোড়া বটতলা’। বৃষ্টি পড়ছে তখনও। তবে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। আকাশে মেঘ। চেহারা দেখে মনে হয় সারা দিনেও এই বাদলা ঘুচবে না। আশপাশে গাছগাছালি, ঝোপ, জংলা লতাপাতা। একপাশে একটা ভাঙা মন্দির। অন্যপাশে, সামান্য তফাতে, কোনও এক মিশনারিদের অনাথালয়। চারদিকে পাঁচিল তোলা। ফটকটাও দেখা যায়।

বটগাছের তলায় ছাতা হাতে যশোদাজীবন দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরনে ধুতি, মালকোঁচা মেরে পরেছেন যেন। গায়ে একরঙা শার্ট। পায়ে বর্ষা-জুতো, আজকাল বাজারে যা দেখা যায়।

কিকিরা দেখতে পেয়েছিলেন যশোদাকে।

“আমি আধঘণ্টাখানেক দাড়িয়ে আছি,” যশোদা কয়েক পা এগিয়ে এলেন। “বাসটা তা হলে পেয়েছেন। দিনটা বড় খারাপ আজ।”

কিকিরা বললেন, “কেন, সময়েই তো পৌঁছে গেলাম। ক’টা বাজে এখন? দশটার বেশি নাকি?”

“না, না, ওইরকমই হবে।… এদিককার বাস কম। গোটা তিন-চার। খারাপ হয়ে গেলে তাও কমে যায়। তার ওপর দিন বুঝে বাস চালায়। আজ দিনটা একেবারে পুরো বর্ষার মতন। আসুন—।”

কিকিরা তারাপদকে ইশারা করলেন এগিয়ে যেতে। যশোদাকে বললেন, “কত দূর যেতে হবে?”

“বেশি নয়। মিনিটবিশেক হাঁটতে হবে। রাস্তা ভাল নয়, কাঁচা। কাদায় পা ডুবে যায়…”

“ঠিক আছে চলুন। তা যশোদাবাবু, বাসটা থেকে আমরা দু’জন মাত্র নামলাম এখানে। আর তো কেউ নামল না।”

“ওইরকমই। এক-আধজনই নামে এখানে। হাটের দিনে অবশ্য ভিড় হয়। ওই ওপাশে মঙ্গলঘাটা বলে একটা জায়গায় হাট বসে রবিবার। পাইকাররা আসে। অন্যদিন ভোঁ-ভা।”

“অনাথালয়টা কাদের?”

“মিশনারি সাহেব বাবুদের পয়সায় তৈরি। শুনেছি কোন এক নামকরা বিদেশি মেমসাহেব এদিকে একবার বেড়াতে এসে টাকা-পয়সার ব্যবস্থা। করে দিয়ে গিয়েছিলেন। অন্যরাও টাকা দেয়। ওদের নিজেদের একটা পুরনো জিপগাড়ি আছে। কাজেকর্মে বাইরে যায়।”

কিকিরারা হাঁটতে শুরু করেছিলেন। কাঁচা রাস্তা। হাত-কয়েক চওড়া মাত্র। জল কাদায় পা রাখা দায়। মাঝে মাঝে ইটের টুকরো, ভাঙা পাথরের চাঁই ফেলা রয়েছে। দু’পাশে নিচু জমি। কোথাও কোথাও আধখাপচাভাবে চাষ হয়েছে, কোথাও সবজি বাগান, ছোট একটা নার্সারিও চোখে পড়ল।

তারাপদ তেমন খুশি হচ্ছিল না। কিকিরা দিন দিন যেন ছেলেমানুষ হয়ে যাচ্ছেন। কোথাকার কে হীরালাল বলে এক ভদ্রলোক দিন চার-পাঁচ হল তাঁর বাগান থেকে উধাও। ভদ্রলোক নাকি বড়সড় কারবারি, কলকাতা শহরে তিনটে আর হাওড়ায় একটা কাপড়ের দোকান। ছোটখাটো দোকান নয়। মস্ত দোকান। বেশ নামডাক আছে দোকানগুলোর, হাজার হাজার টাকার কারবার করেন। তা করুন কারবার, ভাল কথা। তা ওই ভদ্রলোক— হীরালালবাবু— বছর তিন-চার আগে এদিকে অনেকটা জমি কিনে তাঁর শখের ‘কৃষ্ণধাম’ বলে একটা বাগানবাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন। বাগানবাড়ি বলতে ঠিক যা বোঝায়— তেমন বাড়ি অবশ্য নয়। একটা ছোট বাড়ি, আর আশপাশে বাগান— ফলফুলুরির। লোকজন রেখেছিলেন নিজের পছন্দ মতন। প্রত্যেক হপ্তায় শুক্রবারে হীরালাল তাঁর কৃষ্ণধামে চলে আসতেন। থাকতেন সোমবার পর্যন্ত। ওঁর স্ত্রী বিগত। সংসারে ছেলেমেয়েরা আছে। তাদের বয়েসও কম হল না। বাবার ব্যাবসা ছেলেরাই দেখে। হীরালালবাবু নিজে ব্যাবসাপত্র থেকে ধীরে ধীরে সরে এসেছেন। তবু তিনি থাকা মানে মাথার ওপর ছাতা থাকা। ইদানীং ভদ্রলোক কেমন যেন হয়ে যাচ্ছিলেন। উদাস, নিস্পৃহ। তিনি কোনও ব্যাপারেই মন বা নজর দিতে চাইতেন না। একেই বোধহয় বলে বৃদ্ধ বয়সের সংসার বৈরাগ্য।

গত শুক্রবার হীরালাল যথারীতি তাঁর কৃষ্ণধামে চলে আসেন। সঙ্গে যশোদা। যশোদা হীরালালের নিত্যসঙ্গী। বন্ধু নয়, কর্মচারী। হীরালালের যৌবনকাল থেকে পাশে পাশে আছেন। দুঃখের দিনের সঙ্গীকে সুখের দিনেও ছাড়েননি হীরালাল। সম্পর্কটা প্রায় বন্ধুর মতন হয়ে উঠেছিল। লোকে জানে, যশোদা হলেন হীরালালের ম্যানেজার এবং বিশ্বস্ত বান্ধব।

গত শনিবার বিকেল থেকে হীরালালকে কৃষ্ণধামে পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া যাচ্ছে না— সে অন্য কথা। কিন্তু হীরালালের হাতে লেখা যে তিনটি চিরকুট পাওয়া গিয়েছে সেটাই মারাত্মক।

চিরকুটগুলো পড়লে ধাঁধা লেগে যায়। মনে হয়:

(১) হীরালাল আত্মহত্যা করার কথা ভাবছিলেন,

(২) আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত তিনি নেন সম্প্রতি,

(৩) সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর হীরালাল আত্মহত্যা করতে যাচ্ছেন বলে একটা চিরকুট লিখে রেখে উধাও হয়ে গিয়েছেন।

শনিবার বেলার দিকে হীরালাল যশোদাকে একটা কাজে পাঠিয়েছিলেন। কাজটা মোটেই জরুরি নয়। মাইল চারেক দূরে ‘বৈকুণ্ঠ নার্সারি’-তে গিয়ে খোঁজ করতে হবে তারা সত্যি সত্যি নার্সারি বিক্রি করার কথা ভাবছে কি না! যদি বিক্রি করাই ঠিক করে থাকে— তবে জমি-জায়গা নার্সারি সমেত দরদাম কী পড়তে পারে!

যশোদা যেতে চাননি। কী হবে নার্সারিতে, বা জমিজায়গায়! ঈশ্বরের কৃপায় বড়বাবু— মানে হীরালালের তো কম সম্পদ নেই; তা হলে অযথা আর সম্পত্তি বাড়ানো কেন? তা ছাড়া একটা পড়তি নার্সারি সম্পত্তি হিসেবেও কেনার কোনও মানে হয় না। আপত্তি সত্ত্বেও যেতে হয় যশোদাকে; হাজার হোক বড়বাবুর হুকুম।

মেঠো রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে যশোদা বৈকুণ্ঠ নার্সারিতে গিয়েছিলেন। ফিরতে ফিরতে বিকেল। ফিরে এসে আর বড়বাবুকে দেখেননি।

আশপাশে কোথাও আছেন ভেবে যশোদাও আর হীরালালের খোঁজ করেননি তখন। যশোদারও বয়েস হয়েছে; যাওয়া-আসায় আট মাইল। তাও মেঠো পথে। সাইকেল চালাবার ধকল সামলে যশোদা যখন খানিকটা সামলে নিয়েছেন নিজেকে, তখন বড়বাবুর খোঁজ করলেন। ভাদ্রমাসের বিকেল ততক্ষণে মরে গিয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে। এখানে ইলেকট্রিক নেই। কেরোসিনের বাতিতেই কাজ চালাতে হয়। মাঝে মাঝে বড়বাবুর খেয়ালে কৃষ্ণধামের বারান্দায় একটা ছোট পেট্রমাক্স বাতি জ্বালানো হয়। চতুর্দিক ফাঁকা, যেদিকে তাকাও মাঠ আর গাছপালা আর অন্ধকার। ওর মধ্যে পেট্রম্যাক্স বাতিটা যেন আকাশের তারার মতন দেখায়। অবশ্য জ্যোৎস্নার দিনে বাতি জ্বালানো হয় না বাইরে। তখন অঢেল জ্যোৎস্না আর জোনাকির নৃত্যই যেন কৃষ্ণধামকে ঘিরে থাকে।

সন্ধের মুখেও হীরালালকে দেখতে না পেয়ে যশোদা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। কাজের লোক তিনজন। একজন রান্নাবান্না নিয়ে থাকে, অন্যজন ঘরদোর সাফসুফ রাখে। তৃতীয়জনের কাজ হল জল তোলা আর চৌকিদারি। বাড়তি দু’জন মালি আসে হপ্তায় তিনদিন। তারা বিকেল বিকেল চলে যায়।

কাজের লোকরা বলতে পারল না বড়বাবু কোথায় গিয়েছেন। তাঁকে বিকেলের পরে তারা দেখেছে। তারপর আর দেখেনি।

যশোদা তখন হীরালালের শোয়ার ঘরে খোঁজ করতে আসেন। এসে দেখেন বিছানার ওপর তিনটুকরো কাগজ রাখা। প্রত্যেকটি কাগজের ওপর ভারী কিছু চাপা দেওয়া— যেন না বাতাসে উড়ে যায় কাগজগুলো।

কাগজের লেখাগুলো পড়েই যশোদার মাথা ঘুরে যায়। তিনি বিশ্বাস করতেও পারেননি। তারপর খোঁজ খোঁজ পড়ে যায় আবার। এবং যশোদা নিজে বাড়ির কাজের তিনটে লোককে নিয়ে মাঠেঘাটেও খুঁজে বেড়াতে শুরু করেন বড়বাবুকে। আত্মহত্যা করুন আর না করুন, কোথাও হয়তো পড়ে আছেন মাথা ঘুরে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে, সাপেখোপেও কামড়াতে পারে।

লণ্ঠন আর টর্চ নিয়ে ঘন্টাখানেকের বেশি খোঁজ চলল। রাত্রে আর কত খোঁজ করা যায়। এদিকে কলকাতা যাওয়ার শেষ বাস চলে গিয়েছে সোওয়া সাতটা নাগাদ। কলকাতায় যাওয়ারও উপায় নেই।

রাতটা উদ্বেগে আর দুর্ভাবনায় কাটিয়ে পরের দিন যশোদা ছুটলেন কলকাতায়। বড়বাবুর বাড়ি বাগবাজারে। তেতলা বাড়ি। ছেলেরা সকলেই একসঙ্গে থাকে। বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবার।

বড়বাবুর বড় ছেলে বড়দা— মানে কানাইলাল। মেজো ছেলে শ্যামলাল। তিনি হলেন মেজদা। ছোটর নাম কুমারলাল। বড়দা এখন বেনারসে, পুজোর মরসুমে কাশীর চকপট্টি আর তাঁত-মহল্লায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন ব্যাবসার কাজে। এখন থেকে না ব্যবস্থা করে রাখলে বিয়ের মরসুমে মনের মতন বেনারসি পাবেন না। তা ছাড়া আজকাল সুতি কাপড়েও বেনারসি ধরনের কাজ হয় কাশীতে। মালের অর্ডার দিয়ে দু’-একদিনের মধ্যেই ফিরবেন। তাঁকে হুট করে এ-সময় একটা দুঃসংবাদ দেওয়া যায় না। আর না-জেনে না-দেখে— কেমন করে বড়দাকে খবর দেওয়া যায় যে, বাবা আত্মহত্যা করেছেন, তুমি পত্রপাঠ ফিরে এসো।

মেজো শ্যামলাল স্বভাবে ভিতু আর সাবধানী। তার মোটেই ইচ্ছে নয়, ব্যাপারটা নিয়ে হুট করে থানাপুলিশ করা। বাবা যদি আত্মহত্যা না করে থাকে— আর থানা-পুলিশ করতে ছোটে বাড়ির লোকে— তবে ভবিষ্যতে বিরাট একটা গোলমাল হবে। আত্মহত্যা করতে চলেছি— এই ব্যাপারটা পুলিশকে জানালেও সেটা বিশ্রী অপরাধ বলে গণ্য হবে। আইনের কত না ফ্যাকড়া।

কুমারলাল এখন ছুটেছে বর্ধমান, আসানসোল, কালনা— যেখানে যেখানে জ্ঞাতি, গোষ্ঠী আছে। তাদের— সকলের কাছে গিয়ে বাবার খোঁজ নিতে। মানুষ বুড়ো হলে ভীমরতি ধরে। বাবারও যে ধরেনি কে বলবে।

শ্যামলালের সঙ্গে পরামর্শ করে যশোদা এসে ধরেছিলেন কিকিরাকে। রায়বাবুর সঙ্গে মোটামুটি একটা পরিচয় ছিল যশোদার। অনেককাল আগে একই পাড়ায় থাকতেন দু’জনে।

কিকিরা মন দিয়ে সব শুনেছিলেন ঘটনাটা। কৌতুক এবং কৌতূহল— দুই-ই বোধ করছিলেন। শেষমেশ রাজিও হয়ে গেলেন।

মাথায় ছাতা। গায়ে রেনকোট। মাঠঘাট, জলকাদা ভেঙে, মাঝে মাঝে বুনো ঝোপ সরিয়ে কিকিরারা শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণধামে পৌঁছে গেলেন।

দূর থেকে ভাল করে বোঝা যায় না, আন্দাজ করা চলে। তার ওপর বৃষ্টির বিরাম নেই। কাছে এসে বোঝা গেল, কৃষ্ণধামের কম্পাউন্ড-ওয়াল তেমন উঁচু নয়, হাত তিনেক হবে। তার ওপর অবশ্য ছোট ছোট লোহার খুঁটি জড়িয়ে তারকাঁটা লাগানো। গাছপালাই নজরে পড়ে বেশি, সামনের দিকে। বড় বড় গাছও রয়েছে অনেক: আম, জাম, পেয়ারা। পেছন দিকে কৃষ্ণধাম। বাড়িটা বড় নয়। ছোট দেড়তলার মতন লাগে তফাত থেকে দেখলে। বাড়ির ছাঁদ অনেকটা মন্দিরের মতন। মানে নকশাটা মন্দির ধরনের। আশপাশে ফুলগাছ, সরু সরু পথ, মোরাম আর নুড়ি পাথর বিছানো পথ।

ভালই লাগে দেখতে।

তারাপদ বলল, “কিকিরা সার, আপনি বললেন বর্ষায় একটু ‘ফিশিং’ করতে যাবেন। এই আপনার ফিশিং?”

কিকিরা বললেন, “দ্যাখো তারাবাবু, আমি অনেক কিছু জানি; তার চেয়েও বেশি হল যা জানি না। পৃথিবীর একভাগ স্থল, তিনভাগ জল। আমার ব্রেনেরও সেই অবস্থা, সার বস্তু ওয়ান পার্ট ওনলি! ফিশিংটা আমার শেখা হয়নি বাপু। ছিপ আমি দেখেছি; মাছ ধরতেও দেখেছি তাদের। কিন্তু জীবনে কখনও ছিপ ধরিনি।… তা সে যাই হোক, তোমাকে আমি এই ফিশিংয়ের ব্যাপারটা বলেছি আগেই।”

“তা অবশ্য বলেছেন।”

“তবে?”

“ব্যাপারটা আমার কাছে বাজে বলে মনে হচ্ছে। এই বৃষ্টিবাদলায় কেউ এমন অজ গাঁয়ে আসে! চাঁদু বেঁচে গিয়েছে।”

“বেঁচে গেল, কিন্তু মজাটা জানতে পারল না। চাঁদু কথায় কথায় বাড়ি ছোটে কেন বলতে পারো?”

“ও বোধহয় হাসপাতালের চাকরি ছেড়ে দেবে। বাড়ি গিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস নিয়ে বসবে।”

“পারবে?”

“পারবে। মন বসাতে পারলে। চাঁদু দারুণ ছেলে। তবে কিকিরা, চাঁদু কলকাতা ছেড়ে চলে গেলে আমি মরে যাব। ও আমার বন্ধু, ভাই, গার্জেন…”

কিকিরা হেসে বললেন, “তুমি এক কাজ করো।”

তারাপদ তাকিয়ে থাকল।

কিকিরা মজার গলায় বললেন, “কম্পাউন্ডারিটা শিখে নাও। চাদুর ‘কম্প’ হয়ে পাশে পাশে থাকতে পারবে।”

তারাপদ হেসে ফেলল। বলল, “তা ঠিক।… তবে আমি একটা চিরকুট রেখে এসেছি চাঁদুর কোয়ার্টারে। কাল পরশু ফিরলেই জানতে পারবে।”

॥ ২ ॥

হাত-পা ধুয়ে ভিজে পোশাক পালটে কিকিরারা চা খেতে বসলেন। বেলা প্রায় এগারোটা। বৃষ্টি ধরে রয়েছে, তবে আবার নামবে।

চা খেতে খেতে কিকিরা যশোদাকে বললেন, “কই, সেই কাগজগুলো দিন, দেখি।”

যশোদা আগেই নিয়ে এসেছেন কাগজের চিরকুটগুলো। জামার পকেটেই ছিল। এগিয়ে দিলেন।

কিকিরা হাত বাড়িয়ে নিলেন কাগজগুলো। দেখলেন একবার। একই ধরনের কাগজ। এক্সারসাইজ খাতার সাদা পাতা। লেখার কালি-কলমও এক। হীরালালের হাতের লেখা চলনসই।

যশোদা বললেন, “পর পর গুছানো আছে। ওপরেরটা প্রথম…।”

কিকিরা লেখাটা পড়লেন মনে মনে। “আমার বয়েস আটষট্টি হইয়া গিয়াছে। দেশ ছাড়া হইয়া যখন আসি, উনিশ-কুড়ি বয়েস ছিল। লেখাপড়া ঠিকঠাক শেখা হইয়া উঠে নাই। পাঁচ ঘাটের জল খাইয়া কাটা কাপড়ের ব্যাবসা শুরু করি। তাহার পর কাপড়ের গাঁঠরি পিঠে করিয়া বাড়ি বাড়ি তাঁতের শাড়ি বিক্রি করিতাম। পরিশ্রম অনেক করিয়াছি। অবশেষে শ্যামবাজারে একটি কাপড়ের দোকান দিতে পারি। ঈশ্বরের কৃপায় ইহা সম্ভব হইয়াছিল। সৎভাবে ব্যাবসা করিয়াছি। ভাগ্যও সহায় হইয়াছে। ক্রমে ক্রমে আমাদের ব্যাবসা বাড়িল। তিন-তিনটি দোকান দিলাম। এখন তো অভাব অনটন কিছুই আর নাই। ছেলেরাও দাঁড়াইয়া গিয়াছে। আমার মনে কিন্তু সুখ নাই। অনর্থক আর বাঁচিতে ইচ্ছা করে না। শ্রীকৃষ্ণচরণে শরণ লইতে ইচ্ছা করে।”

লেখাটা বার দুই-তিন পড়ে কাগজটা তারাপদকে পড়তে দিলেন কিকিরা।

দ্বিতীয় চিঠিটা ছোট। তাতে লেখা: “অনেক ভাবিয়া দেখিলাম, এবার সংসার হইতে বিদায় লওয়াই আমার উচিত। বাঁচিয়া থাকিলে না জানি কত অধর্ম অন্যায় দেখিতে হইবে। মহাভারতে পড়িয়াছি, স্বয়ং মহাজ্ঞানী ভীষ্মও নিজের ইচ্ছামৃত্যুর জন্য অনুতাপ করিতেন। ভাবিতেন, উহা যেন অভিশাপ। আমি সামান্য মানুষ। আমার আর কতটুকু ক্ষমতা। আমি মনঃস্থির করিয়া ফেলিয়াছি। আমার যাওয়া আর কে আটকায়।”

চিঠিটা তারাপদকে পড়তে দিলেন কিকিরা। শেষ টুকরোটা হাতে নিয়ে যশোদাকে বললেন, “এইটেই শেষ?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

চিঠিটা খুবই ছোট। কয়েকটি মাত্র কথা। “আমি শেষ যাত্রায় চলিলাম। স্বেচ্ছায়। আমার পরিণতির জন্য কাহাকেও আমি দায়ী করি না। ঈশ্বর উহাদের মঙ্গল করুন।”

বার দুই-তিন শেষ চিঠিটা পড়ে কিকিরা কাগজের টুকরোটা তারাপদকে এগিয়ে দিলেন।

সামান্য চুপচাপ। পকেট থেকে কিকিরা চুরুট বার করলেন। সরু আঙুলের মতন চুরুট। দেশলাইটা স্যাঁতসেঁতে হয়ে গিয়েছে। চুরুট ধরাতে দশ বারোটা কাঠি নষ্ট হল।

“যশোদাবাবু?”

“বলুন?”

“চিঠি তিনটের হাতের লেখা তো একই লোকের মনে হচ্ছে। হীরালালবাবুর। চিঠির শেষে নামও লিখেছেন, হীরালাল দাশ। আপনি কী বলেন?”

“হাতের লেখা বড়বাবুরই।”

“নকল নয় তো?”

“আজ্ঞে না।”

“কালির রং, কলমও একই বলে মনে হচ্ছে।”

“ঠিকই বলেছেন। আমিও কোনও তফাত দেখিনি।”

কিকিরা এবার তারাপদর দিকে তাকালেন। বললেন, “তারা, তুমি একটা জিনিস নজর করে দেখেছ? চিঠিতে কাটাকুটি বোধহয় মাত্র দু’-তিন জায়গায়। হাতের লেখা স্পষ্ট। কোথাও হাত কাঁপেনি, এলোমেলো হয়নি লেখা। দেখেছ?”

তারাপদ দেখল। মাথা হেলিয়ে বলল, “হ্যাঁ— কথাটা ঠিকই।”।

কিকিরা বললেন, “একজন লোক যখন সুইসাইড নোটের মতন চিঠি লেখে— তখন তার মাথা কতটা ঠান্ডা হতে পারে? তার কোথাও একটু আবেগ থাকবে না, দুঃখ থাকবে না? তোমার কী মনে হয়?”

“থাকা বোধহয় উচিত।”

“বেশ, উচিত বাদ দিলাম। হয়তো হীরালালবাবুর মাথা বেজায় ঠান্ডা ছিল। স্ট্রং নার্ভ। তিনি বেশ গুছিয়ে নিজের কথাগুলো লিখেছেন। মনে মনে মকশও করে থাকতে পারেন। কিন্তু আমার যে ধোঁকা লাগছে হে!” বলে কিকিরা যশোদার দিকে তাকালেন। “যশোদাবাবু, আপনাকে খোলাখুলি ক’টা কথা জিজ্ঞেস করি। যা জানেন বলবেন, কথা লুকোবেন না।”

“লুকোব কেন! বলুন।”

“হীরালালবাবুর সঙ্গে আপনি অনেকদিন ধরে আছেন, আমি জানি। তবু ঠিক কত বছর রয়েছেন জানা নেই।”

“আঠাশ-তিরিশ বছর। বড়বাবু যখন শ্যামবাজারে তাঁর প্রথম দোকান করেন তখন থেকেই আমি তার কর্মচারী। বাবু, আমি আর বিনোদ বলে একটা ছেলে দোকান দেখতাম।”

“দ্বিতীয় দোকানটা কবে হয়?”

“পাক্কা দশ বছর পরে। কলেজ স্ট্রিট মার্কেটে।”

“তৃতীয়টা?”

“ভবানীপুরে। সেটা হয়েছিল মেজদার বিয়ের আগে।”

“আর হাওড়ার দোকান?”

“ওটা তেমন পুরনো নয়। বছর পাঁচ-সাত আগে হয়েছে।”

“দোকানগুলোর মালিকানা?”

“আগে সবই বড়বাবুর ছিল। পরে তিনি ভাগ করে দেন। আদি দোকান পায় বড়দা, কলেজ স্ট্রিটের দোকান দেওয়া হয় মেজদাকে। ভবানীপুরের দোকানের মালিকানা ছোড়দার।”

“আর হাওড়ার দোকান?”

“ওটা বড়বাবু অন্যরকম ব্যবস্থা করেন। তাঁর শ্যালক ও শ্যালকের ছেলেদের লিখে দেন। অবশ্য ওই দোকানটায় শালাবাবুদেরও টাকা খাটত।”

“আপনার মনিবই বলুন আর বড়বাবুই বলুন— মানুষ কেমন ছিলেন?”

“বাবু বড় ভাল লোক ছিলেন। সাদামাঠা, সরল। সৎ মানুষ। ব্যাবসাদার হলেও তিনি শুধু লাভের দিকে চোখ রাখতেন না। বরং দশ পয়সার জায়গায় আট পয়সা লাভেই সন্তুষ্ট থাকতেন। ঠাকুর দেবতায় অগাধ ভক্তি ছিল। বউ ঠাকুরন গত হওয়ার পর পুরোপুরি নিরামিষ আহার করতেন। আর গত তিন-চার বছর দোকানের ব্যাপারে মাথা ঘামাতেন না বিশেষ। বাড়ির কাছে বলে শ্যামবাজারের আদি দোকানটায় সন্ধের মুখে এক-আধ ঘণ্টা বসতেন। পুরনো লোকজন এলে কথাবার্তা বলতেন সুখদুঃখের।”

কিকিরা চুরুট টানতে টানতে মাথা নেড়ে যাচ্ছিলেন।

তারাপদ হঠাৎ কিকিরাকে বললেন, “সার, ছেলেদের সঙ্গে মন কষাকষি হয়নি তো? বুড়োমানুষ, কোনও ব্যাপারে মান-অভিমান হতে পারে।”

যশোদাই জবাব দিলেন। বললেন, “না, তেমন কিছু নয়। তবে বড়দা শ্যামবাজারের দোকানটা বাড়িয়ে নিয়েছিল। পাশের একটা ছোট হোসিয়ারি দোকান কিনে নেয়। আর আজকাল যা ফ্যাশান, দোকানটা হাল কায়দায় সাজিয়ে— ঠান্ডা-মেশিন চালু করে দোকানে। বড়বাবুর এটা পছন্দ হয়নি। তিনি সাবেকি মানুষ, নিজের হাতে গড়া দোকান, অত ঝকমকি তিনি মেনে নিতে পারেননি।”

“ও! তা এ নিয়ে ছেলের সঙ্গে মন কষাকষি হয়েছিল?”

“না। বড়বাবু চুপ করেই থাকতেন। মুখে কিছুই বলেননি। মনে লেগেছিল।”

“দোকান সাজানোর পর বিক্রিবাটা কমেছিল, না, বেড়েছিল?”

“বেড়েছিল।”

“তবে আর কী। অন্য দোকানগুলোর বেলায় কী হয়েছিল?”

“না, সেগুলো আগের মতনই ছিল।”

“কেমন চলত?”

“খারাপ নয়। মেজদার কলেজ স্ট্রিটের দোকানে তিন-চার মাস খুব বেচাকেনা হত— এই পুজোর টাইমে। ভবানীপুরের দোকানও ভাল চলত। ছোড়দা তার দোকানে রেডিমেড পোশাক রাখত। বাচ্চাদেরই বেশি।”

“আর হাওড়ার দোকান?”

“আজ্ঞে, ওটা আজকাল ভাল চলত না। তবে দোকানটা তো বড়বাবু শালাবাবুকে দান করেছিলেন। কাজেই ওটা হীরালাল দাশ অ্যান্ড সন্সের মধ্যে পড়ে না।”

বেলা হয়ে আসছিল। আবার বৃষ্টি নামল।

কিকিরা বললেন, “যশোদাবাবু, এখন থাক। এবার স্নান-খাওয়া সেরে নিই। দুপুরে একটু জিরিয়ে, বিকেলে কৃষ্ণধামের ঘরদোর দেখা যাবে। চোখে সব দেখে নেওয়া ভাল। আজ আমরা কিন্তু রাত্তিরেও আছি এখানে। মনে আছে তো?”

যশোদা বললেন, “ও-কথা কেন বলছেন। আপনাদের জন্যে সবরকম ব্যবস্থা করা আছে। যতদিন খুশি থাকতে পারেন।”

চুরুট নিভে গিয়েছিল কিকিরার। সেঁতিয়ে গিয়েছে। তারাপদর কাছে একটা সিগারেট চাইলেন কিকিরা।

সিগারেট ধরাতে ধরাতে হঠাৎ যশোদাকে বললেন, “আপনার বড়বাবু পান-তামাক খেতেন না?”

“আজ্ঞে না। ওঁর কোনও নেশা ছিল না। দু’বেলা দু’পেয়ালা চা খেতেন মাত্র। আর গলা খুসখুস করে কাশি আসত বলে লবঙ্গ মুখে রাখতেন বেশিরভাগ সময়। বড়বাজার থেকে বাবুর জন্যে বাছাই করা ভাল লবঙ্গ আসত। আমিই আনতাম।”

“চলুন ওঠা যাক।” কিকিরা উঠে পড়লেন।

॥ ৩ ॥

বিকেলে কৃষ্ণধামের ঘরগুলো দেখলেন কিকিরারা। নীচের তলায় চার-পাঁচটি ঘর। মাঝারি মাপের। রান্না-খাওয়ার ব্যবস্থা সামান্য তফাতে, এক পাশে। বারান্দা প্রায় চারপাশেই। বারান্দার তলায় লতাপাতা আর ফুলগাছের ঝোপ। হাসনুহানা, টগর, বেল— আরও কত। ঘরগুলো পাকাপোক্তভাবে তৈরি। তবে বাহুল্য নেই, বিলাসিতা নেই। একটা ঘরে দু’আলমারি ধর্মগ্রন্থ। দেওয়ালে দুর্গা, কালী, শ্রীকৃষ্ণ আর শ্রীগৌরাঙ্গর পট। সরল সাধাসিধে ঘরদোর। কিন্তু বেশ লাগে।

শেষে হীরালালের শোয়ার ঘরে এলেন কিকিরারা। অবাকই হলেন ঘরটি দেখে। আসবাব যৎসামান্য। একটি পুরনো পালঙ্ক, ড্রয়ার একটি, কাঠের আলমারি, আলনা। দুটি মাত্র চেয়ার। টেবিল নেই। ঘরে চারটি জানলা। কাঠের পাল্লা, গ্রিলও রয়েছে।

যশোদা পালঙ্কটি দেখিয়ে বললেন, “চিঠির টুকরো তিনটি এই বিছানার ওপরেই ছিল।”

কিকিরা আর তারাপদ নজর করে ঘর দেখছিলেন।

কিকিরা বললেন, “যশোদাবাবু, অনেককাল আগে আপনার সঙ্গে দোকানে বেড়াতে গিয়ে একবার হীরালালবাবুকে দেখেছিলাম। চেহারাটি ঠিক মনে নেই। বেঁটে রোগা মতন ভদ্রলোক না?”

“আজ্ঞে বেঁটে ঠিক নয়, তবে মাথায় খাটো। গায়ের রং ছিল ধবধবে। মাথায় চুল অল্প। ইদানীং সবই পেকে সাদা হয়ে গিয়েছিল।”

“সাজপোশাকও সাধারণ ছিল, না?”

“ধুতি-পাঞ্জাবি। গায়ে ফতুয়া পরতেন। গেঞ্জি কখনও পরেননি। চামড়ার জুতোও পায়ে দিতে পারতেন না।”

“কেন?”

“পায়ে অনেক কড়া ছিল। ওষুধ বিষুধ করেছেন। কাটিয়েছেন। আবার গজিয়ে যেত। ক্যাম্বিসের পা-ঢাকা জুতো পরতেন।”

“একটা হারমোনিয়াম দেখছি যে মশাই?”

যশোদা বললেন, “এখানে থাকলে নিজের মনে একটু গান গাইতেন। রামপ্রসাদ গানই বেশি।”

তারাপদ বলল, “ধার্মিক মানুষ।”

“তা ঠিকই। অমন মানুষ কেন যে…”

কথা থামিয়ে কিকিরা বললেন, “চলুন, এবার ওপরে যাওয়া যাক।”

সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলে দক্ষিণ দিকে দুটি ঘর। উত্তরে ঘর নেই, ফাঁকা ছাদ। বাড়িটাকে তাই দোতলা না বলে দেড়তলা বলাই ভাল। আকাশে মেঘ রয়েছে। তবে ছেঁড়া ছেঁড়া। বৃষ্টি আপাতত বন্ধ। আলো মরে এসেছে। টুকরো মেঘগুলো জমে গেলেই আবার অন্ধকার হয়ে যাবে।

যশোদা বললেন, “আসুন, ঘর দুটো দেখুন।”

কিকিরারা এগিয়ে গেলেন। পাশাপাশি দুটি ঘর। একটি একেবারে ফাঁকা। মাটিতে একপাশে একটি কার্পেট পাতা। দেওয়ালে মস্ত বড় এক শ্রীগৌরাঙ্গর পট।

যশোদা বললেন, “এটিতে বড়বাবু কখনও কখনও কীর্তনগানের আসর বসাতেন। বরানগর থেকে বাণীবাবু আসতেন কীর্তন গাইতে। তাঁর দলবল থাকত। আর আমরা থাকতাম। আশপাশের দু’-পাঁচজন।”

কিকিরা দেখলেন ঘরটা। পরিচ্ছন্ন। হীরালাল নেই, তবু ঘরটি যে ঝাঁট পড়েছে, মোছা হয়েছে— বুঝতে কষ্ট হয় না।

পাশের ঘরটি হীরালালের ঠাকুঘর। একপাশে উঁচু বেদি। বেদির ওপর সাদা মার্বেল পাথরের স্ল্যাব। মাঝখানে রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ। কালো পাথরের। আন্দাজে মনে হয়, হাত দুই উঁচু বিগ্রহ। দেখতে সুন্দর। চিৎপুরের পাথর বাজারে যা বিক্রি হয়— সেরকম মামুলি জিনিস নয়। বিগ্রহের দু’পাশে দুটি লম্বা বাতিদান। পেতলের। ঝকঝক করছে। ঘরের ঘোলাটে আলোতেও সেটা চোখে পড়ে। বেদির তিন পাশে গ্লাস ফাইবার, ধোঁয়া রঙের; সামনের দিকটা খোলা। বেদির তলায় দু’ধাপ সিঁড়ি। সিঁড়ির ধারগুলো আলপনার নকশায় রং করা। দেওয়ালের একটি পাশে দেওয়াল-তাক, কাচের পাল্লা, ভেতরে কয়েকটা রুপোর বাসন, বাটি, চন্দন কাঠ, আরতির পঞ্চপ্রদীপ— এইরকম কত কী। আর গোল গোল কাচের শিশি। শিশির মধ্যে বাতাসা, কিশমিশ, শুকনো খেজুর, মিছরি। একটা শিশিতে লবঙ্গও রয়েছে। শিশিটা কাত হয়ে গিয়েছে একপাশে।

যশোদা বললেন, “এসব ঠাকুরের।”

“বোঝাই যায়।… আচ্ছা যশোদাবাবু, ওই ফাইবার গ্লাসগুলো লাগানো হয়েছিল কেন?”

“ঠাকুরের গায়ে ধুলোময়লা যাতে না পড়ে।”

“ও!” বলে কিকিরা মাথার ওপর তাকালেন, তারপর তারাপদকে বললেন, “দেখেছ?”

তারাপদ আগেই দেখেছে। এই ঘরের ছাদের ধাঁচটা যেন মন্দিরের চূড়োর মতন।

“চলুন বাইরে যাই,” কিকিরা বললেন।

বাইরে, ঠাকুরঘরের পেছনের আর পাশের খানিকটা লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা। গ্রিলের রেলিং। হাতকয়েক চওড়া ফাঁকা বারান্দা। ব্যালকনি মতন। ঠাকুরঘরের পেছন দিকের ব্যালকনি থেকে একটা ঘোরানো লোহার সিঁড়ি নীচে নেমে গিয়েছে। সিঁড়িটা শেষ হয়েছে যেখানে তার চারপাশে কলাঝোপ আর পাতকুয়া। কলাঝোপ যথেষ্ট ঘন। তার ওপর বর্ষায় পাতাগুলো যেন বিস্তর বেড়ে উঠেছে। ঝোপ ছাড়ালেই একটা জাম গাছ। জাম গাছের ওপাশে ঢালু জমি। বাঁশঝোপ। তারপর কৃষ্ণধামের পেছন দিকের পাঁচিল।

কিকিরা মন দিয়ে দেখছিলেন।

তারাপদও নজর করে দেখছিল আশপাশ।

কিকিরা বললেন, “যশোদাবাবু, এই সিঁড়িটা দিয়ে নেমে গেলেই কলাঝোপ?”

“আজ্ঞে।”

“কুয়োর জল কেমন?”

“ভাল।”

“একটাই কুয়ো নাকি?”

“না, আরও একটা আছে। গোয়ালঘরের দিকে।”

তারাপদ কী বলতে যাচ্ছিল তার আগেই কিকিরা পায়ের তলা থেকে কী যেন কুড়িয়ে নেওয়ার জন্যে ঝুঁকে পড়লেন। কাচের টুকরো। পায়ে লাগতে পারত। টুকরোটা তুলে নিতে গিয়ে কিকিরার চোখে পড়ল, কয়েকটা লবঙ্গ ছড়িয়ে আছে। বৃষ্টিতে ভিজে একেবারে অন্যরকম দেখায়।

লবঙ্গগুলো তুলে নিলেন কিকিরা। তারপর চোখের ইশারায় তারাপদকে কিছু বললেন।

তারাপদ বুঝতে পারল।

কিকিরা যশোদাকে নিয়ে অন্যপাশে সরে গেলেন। তারাপদ লোহার সিঁড়ি বরাবর কী যেন খুঁজতে লাগল হেঁট হয়ে।

অন্যপাশে সরে গিয়ে কিকিরা যশোদাকে বললেন, “আপনি হীরালালবাবুর সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক। উনি যে এরকম একটা কাজ করতে পারেন— আপনাকে আভাসমাত্র দেননি।”

“না।”

“আপনিও বুঝতে পারেননি?”

“না। শুধু বুঝতে পেরেছিলাম উনি মনে। মনে কেমন যেন ভেঙে পড়েছেন। কথায়বার্তায় আফসোস। দুঃখ করতেন।”

“কীসের আফসোস?”

যশোদাজীবন ইতস্তত করছিলেন; শেষে বললেন, “সেভাবে সরাসরি আমায় কিছু বলেননি। বোধহয় বলতে চাইতেন, পারতেন না। তবে বুঝতে পারতাম, তিনি যা চান না, ভাবতেও পারেন না— এমন একটা ব্যাপার বাড়ির মধ্যে কোথাও হচ্ছে।”

কিকিরা নজর করে দেখলেন যশোদাকে। মনে হল, হীরালালের এই বিশ্বস্ত বন্ধু এবং কর্মচারীটি সঠিক জবাব দিলেন না। কথা লুকোলেন।

কথা পালটে নিলেন কিকিরা। সহজভাবে বললেন, “বাড়িতে তিন ছেলের মধ্যে সদ্ভাব কেমন?”

“আজ্ঞে, হাতের পাঁচ আঙুল যেমন সমান হয় না, সংসারে ভাইবোনরাও সকলে সমান হয় কি! ফারাক থাকবেই।”

“যেমন?”

“যেমন ধরুন, বুদ্ধি-বিবেচনা, সাহস, জেদ, এইরকম আর কী। কেউ ধূর্ত হয় বেশি, লোভী; কেউ যেমন আছে তেমনই থাকতে চায়। কেউ ভিতু, সাবধানী। কেউ বা হালকা স্বভাবের। নিজেরটি নিয়ে থাকে।”

“কথাটা ঠিকই যশোদাবাবু, পাঁচ আঙুল সমান হয়।… তা ছেলেদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান কে?”

“বড়দা কানাইলাল। অতিশয় বুদ্ধিমান বলতে পারেন। সাহসী।”

“মেজো ছেলে?”

“শ্যামলাল—মানে মেজদার কথা আগেই বলেছি। ভিতু ধরনের। শখশৌখিনতাও নেই। সাদামাঠা।”

“আর ছোট ছেলে?”

“কুমারলাল এখনও ঝোঁকের মাথায় চলে। হালকা স্বভাবের, বয়েসও কম। তবে হাল কায়দায় চলতে চায়। তা সে যাই করুক, ভবানীপুরের দোকানের ব্যাবসাটা মন্দ চালায় না।”

তারাপদ ততক্ষণে ফিরে এসেছে।

কিকিরা আর কথা বাড়ালেন না। “চলুন, নীচে যাই।… ভাল কথা, হীরালালবাবু চলে যাওয়ার পর ওপরতলার ঠাকুরঘর, বাইরের এই জায়গাগুলো ঝাঁট পড়েনি? মোছামুছি করেছে তো?”

“মনে হয় করেনি। সকলেই বড়বাবুকে খোঁজাখুজিতে ব্যস্ত। আমি না হয় জিজ্ঞেস করব ওদের?”

“করবেন?… আপনিও তো ব্যস্ত। চলুন যাই, চা-টা খেতে হবে।”

কিকিরারা নীচে নেমে গেলেন।

॥ ৪ ॥

কিকিরা আর তারাপদ মুখোমুখি বসে কথা বলছিল। ঘরে লণ্ঠন জ্বলছে। সন্ধে পেরিয়ে গিয়েছে, তবে রাত নয়। তবুও, এই ফাঁকা জায়গায় সন্ধে-রাতই যেন অনেক। বাইরে বৃষ্টি নেই, ঝিঁঝি ডাকছে। বাঁশবাগান আর কলাঝোপের দিক থেকে ক্রমাগত ব্যাঙ ডেকে যাচ্ছিল।

কিকিরা বললেন, “তারা, চিঠিগুলো— মানে, হীরালালবাবুর লেখাগুলো আমি বারবার পড়েছি। আমার কী মনে হয় জানো?”

“কী?”

“ভদ্রলোক ব্যাবসাদার হলেও সৎ সরল মানুষ। তিনি শুধু ধর্মকর্ম করতেন না, মনে মনেও অধর্ম করার কথা ভাবতেন না। তাঁর কাছে ধর্ম ভেক ছিল না। অথচ নিজের সংসারের মধ্যেই এমন কোনও অন্যায় অধর্ম হচ্ছিল যা তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না। আবার মুখ ফুটে বলতেও পারছিলেন না।”

“কেন?”

“এরকম হয়। বুড়োমানুষ, সংসারের সাত-পাঁচে থাকতেন না। বলতে গিয়ে যদি বিপত্তি হয়। তা ছাড়া আমার ধারণা, বলার মতন জোর প্রমাণও তাঁর হাতে ছিল না। হয়তো সন্দেহ করেছিলেন। কানাঘুষো শুনেছিলেন…”

“হতে পারে। তবে কীসের সন্দেহ?”

“সেটাই ভাবছি। যশোদাবাবুর পেটে এখনও কথা আছে। বলতে পারছেন না।”

“তা হলে মামলা ছেড়ে দিন, সার। আমার মনে হয়, আত্মহত্যা করার কথাটা বাজে। এখানে কেউ আত্মহত্যা করলে আজ ক’দিনে তার কোনও হদিশ মিলবে না?”

“তোমার কথাটা ঠিকই। আমারও মনে হয় না, হীরালালবাবু সত্যি সত্যি আত্মহত্যা করেছেন।… আরে, একটা মানুষ যখন আত্মহত্যা করতে যায় তখন কি সে ঠাকুরঘরের লবঙ্গর শিশি থেকে এক মুঠো লবঙ্গ তুলে নিয়ে চলে যায়। অসম্ভব! তখন তার মনের সে-অবস্থা থাকে না।”

তারাপদ বলল, “আপনি ওপরে লোহার ঘোরানো সিঁড়ির সামনে লবঙ্গ পেয়েছেন সার, আমি সিঁড়ির নীচের ধাপেও গোটা দুয়েক পেয়েছি।”

“ভদ্রলোক যাওয়ার আগে ঠাকুরঘরে ঢুকেছিলেন। হয়তো ঠাকুর প্রণাম করতে। তারপর কাচের আলমারি থেকে এক মুঠো লবঙ্গ তুলে নিয়ে সিঁড়ির পথ ধরেই কলাঝোপ আর বাঁশঝাড়ের আড়াল দিয়ে পালিয়ে গিয়েছেন কোথাও।”

তারাপদ মাথা নাড়ল। বলল, “বেশ বুদ্ধি করেই পালিয়েছেন। যশোদাবাবুকে কোন এক নার্সারি দেখে আসতে বলে, কাজের লোকদের চোখে ধুলো দিয়ে দিব্যি গা-ঢাকা দিলেন। কিন্তু সার, ওই বুড়োমানুষ কোথায় যেতে পারেন! এখানে কাছাকাছি লুকিয়ে থাকার জায়গা কোথায় পাবেন? সবই তো ফাঁকা।”

কিকিরা মাথা দোলাতে লাগলেন। ভাবছিলেন। পরে বললেন, “শোনো বাপু, আমাকে একটু ভাবতে দাও। হীরালাল আত্মহত্যা করেননি বলেই আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু তিনি কোথায় লুকিয়ে আছেন বুঝতে পারছি না। আরও বুঝতে পারছি না, ভদ্রলোক কেন, কীসের জন্যে এই নাটক করছেন। বাড়ির গন্ডগোল একটা কারণ হতে পারে। সেই গন্ডগোল কেমন? কে বা কারা করেছে? কেনই বা?… তা আপাতত আমরাও আর এখানে থাকছি না। কালই ফিরে যাব কলকাতায়। আবার আসব আসছে হপ্তায়। শুক্র বা শনিবার। চাঁদুও ততদিনে ফিরে আসছে। তখন একবার চেষ্টা করা যাবে।”

তারাপদ বলল, “এই ক’দিন কী করবেন?”

“দাশবাবুর পারিবারিক খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করব। দোকানগুলো দেখব। আর ফন্দিফিকির খুঁজব।”

“দেখুন চেষ্টা করে।”

“তুমি একবার যশোদাবাবুকে ডেকে আনে। কথা বলব।”

তারাপদ বাইরে গেল যশোদাজীবনকে ডাকতে।

ক’ মুহূর্ত পরেই যশোদা এলেন।

কিকিরা বললেন, “যশোদাবাবু, আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।”

“বলুন।”

“আমরা কাল ফিরে যাব। … না, না, আসব আবার, আসছে হপ্তায়— শুক্র বা শনিবার। এর মধ্যে আপনি যেভাবে খবরটা চেপেচুপে আছেন সেইভাবে থাকবেন। থানা-পুলিশ করবেন না। মেজোবাবু ছোটবাবুকে সামলে রাখবেন।

“বড়দা?”

“তাঁকে আলাদা করে খবর না দিলেই ভাল। তবে তিনি যদি নিজেই ফিরে আসেন কাশী থেকে অন্য কথা। …ক’টা দিন সবুর করে থাকুন, হইচই করবেন না। একটা কথা জানবেন, আপনার বড়বাবু সত্যি সত্যি আত্মহত্যা করেননি। আর যদি করেও থাকেন তবে এখানে কোথাও নয়। বুঝলেন!”

মাথা নাড়লেন যশোদাজীবন।

॥ ৫ ॥

পরের শুক্রবারই এলেন কিকিরা। একা।

বর্ষাবাদলা নেই। ভাদ্রমাসের চড়া রোদ থাকছে দিনভর। গাছপালার সেঁতানি ভাব শুকিয়ে এসেছে অনেকটা। রাত্রে হালকা জ্যোৎস্না। শুক্লপক্ষ চলছে।

এসেই বললেন, “আপনাদের বড়দা ফিরেছেন নাকি?”

‘না। দু’-চারদিনের মধ্যে আসছেন।”

“বাড়িতে হইচই হচ্ছে?”

“আজ্ঞে তা তো হবেই। মেজদাকে আমি সামলে রেখেছি। কিন্তু ছোড়দা আর শুনতে চাইছে না। বলছে, বাবার আত্মহত্যা করার কথাটা না হয় চেপে গেলুম। হারিয়ে যাওয়ার কথাটা তো পুলিশকে জানাতে পারি।”

কিকিরা একটু হাসলেন। বললেন, “মিসিং। তা অবশ্য জানাতে পারেন; তবে মিসিংয়ের সঙ্গে অনেক ফ্যাকড়া জড়িয়ে আছে। সুতোর জট খুলতে গেলে ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে আপনাদের ছোড়দার জানা নেই।”

যশোদা মাথা হেলালেন। মানে, তিনি বোঝেন সবই।

সামান্য চুপচাপ থাকার পর কিকিরা হঠাৎ বললেন, “আপনাদের এখানে শুকনো খড় পাওয়া যাবে। খড়ের আঁটি?”

যশোদা অবাক! হকচকিয়ে যাওয়ার মতন অবস্থা। “আজ্ঞে খড়?”

“খড়ের আঁটি। গোরু গোয়ালঘর যখন রয়েছে এখানে— আপনাদের কৃষ্ণধামে তখন খড় পাওয়া সহজ। না কি!”

“পাওয়া যাবে।”

“ধরুন একটু বেশিই লাগবে।”

“দেখি। খড়ের গাড়ি এ-হপ্তায় আসেনি। জোগাড় হয়ে যাবে!”

“আপনাদের এখানে কেরোসিন তেল দিয়েই লণ্ঠন জ্বলে। চার-পাঁচ বোতল বা ধরুন দু’-চার লিটার তেল পাব নিশ্চয়।”

যশোদা কিছুই বুঝলেন না। তাকিয়ে থাকলেন হাঁ করে।

কিকিরা মুচকি হাসলেন। ঠাট্টার গলায় বললেন, “ঘাবড়ে যাবেন না। ভয়ের কিছু নেই। …শুনুন, কাল আমার জনা দুই লোক লাগবে। মালি আসবে না?”

“আসতে পারে।”

“ঠিক আছে।… না এলে আপনাদের এখানে কাজের লোক আছে। দুটো ঠিকে মজুর ধরে দিতে পারবেন না?”

যশোদা কিছু না বুঝলেও মাথা নাড়লেন। পরে বললেন, “তারাপদবাবু এলেন না?”

“কাল আসবে। অফিস সেরে। আমি আগে আগে এলুম কাজ খানিকটা গুছিয়ে রাখতে। একটাই শুধু আমার ভয় মশাই, হঠাৎ করে যদি বৃষ্টি নেমে যায় কাল-পরশু— তবেই বিপদ।”

“আর এখন নামবে বলে মনে হয় না। ক’টা দিন একটু মাঠঘাট শুকুক। তবে ভাদ্রমাস, বলা যায় না কিছুই।”

পরের দিন তারাপদ এল। বিকেল বিকেল। কাঁধে কিটব্যাগ, হাতেও একটা নাইলনের ছোট হাত-ঝোলা।

কিকিরা বাগানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বোধহয় অপেক্ষা করছিলেন তারাপদর। বললেন, “সংবাদ কী?”

“ভাল।”

“চাঁদু?”

“সারের অ্যাডভাইস জানিয়ে এসেছি। হাজির থাকবে সময় মতন। আপনার কাজ কতটা এগুল?”

কিকিরা আঙুল দিয়ে কৃষ্ণধামের কম্পাউন্ড-ওয়ালের দিকটা দেখালেন। বললেন, “দুটো পাশ হয়ে গিয়েছে। বাকি দু’পাশ কাল দুপুরের মধ্যেই হয়ে যাবে। যাও-না, একবার দেখে এসো।”

তারাপদ এগিয়ে গিয়ে দেখে এল। বলল, “সার, গর্তগুলো আগুপিছু কেন?”

কিকিরা মুচকি হাসলেন। “একে বলে জিগজাগ ট্রেঞ্চ। অবশ্য এটা ট্রেঞ্চ নয়। মানে, মাটি কাটা নালা নয় হে, ফুট তিনেক অন্তর একটা করে গর্ত। তা গর্তগুলো ফুট দুই-আড়াই হবে, তলার দিকে, ডিপ আর কী! আর গোললাইয়ের মাপও মোটামুটি ওইরকম। …আগুপিছু— জিগজাগ করার মানে হল, তফাত থেকে দেখলে চোখের ভুল হবে। বোঝ যাবে না, একটা গর্ত থেকে আর-একটা গর্তের মধ্যে হাত কয়েক তফাত। আগুন যখন জ্বলবে, দূর থেকে দেখলে মনে হবে, একটানা দাউদাউ করে জ্বলছে।”

তারাপদ হেসে বলল, “এটা কি আপনার ম্যাজিশিয়ানের টেকনিক?”

“খানিকটা তো বটেই,” বলে আবার হাত তুলে একটা জায়গা দেখালেন, “ওই যে দেখছ জায়গাটা, ওখানে যত রাজ্যের গাছের শুকনো পাতা ঝেঁটিয়ে এনে জমানো হয়েছে। আরও দু’-চার ঝুড়ি কাল জমানো যাবে। খড় রেডি। কেরোসিন তেল মজুত। আর তুমি তো অন্য মালমশলাও এনেছ।” অন্য মালমশলা বলতে খানিকটা গন্ধক।

বাগান থেকে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে তারাপদ বলল, “সবই না হয় হল। আপনি লঙ্কাদহন পর্বটা সারলেন, কিন্তু যার জন্য এত— সেই ভদ্রলোক যদি ধরা না দেন।”

“না দিলে করার কিছু নেই। আমরা যশোদাবাবুকে বলব, আপনারা থানা-পুলিশ করুন, আমাদের দিয়ে হল না।”

তারাপদ যশোদাজীবনকে দেখতে পেল, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। বলল কিকিরাকে।

কিকিরা গলা নামিয়ে বললেন, “তারাপদ, কাল তুমি যশোদাবাবুর ওপর নজর রাখবে। উনি যেন এই বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে যেতে না পারেন। এমনিতেই ভদ্রলোক ভ্যাবাচাকা খেয়ে গিয়েছেন। মগজে কিছুই ঢুকছে না ওঁর। তার ওপর কাল সন্ধের ঝোঁকে যখন বাড়ির চারপাশে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠবে, উনি বোধহয় পাগলামি শুরু করবেন।”

তারাপদ সে-কথার কোনও জবাব দিল না। শুধু বলল, “হীরালালবাবু এখানেই কাছাকাছি কোথাও আছেন বলে আপনার ধারণা। যদি না থাকেন—?”

“না থাকেন? দেখে তারাবাবু, আমি ফিশিং এক্সপার্ট নই, তবে শুনেছি এক-একরকম মাছের জন্যে এক-একরকম চার কাজে লাগে। বঁড়শিরও হেরফের হয়। হীরালালবাবুর এই কৃষ্ণধামই আমার টোপ। এই টোপে হয় তিনি ধরা দেবেন, না হয় আমরা হার মেনে নিয়ে ফিরে যাব।… যাকগে, চাঁদুকে সব ভাল করে বুঝিয়ে দিয়েছ তো?”

“দিয়েছি। এ জায়গাটা আন্দাজ করতে পেরেছে। এদিকে একবার ওদের ক্যাম্প বসেছিল। ডাক্তারদের ক্যাম্প। …ও ঠিক সময়ে হাজির হয়ে নিজের পজিশন নেবে।” তারাপদ হাসল।

“ভাল কথা। দেখা যাক কী হয়?”

বারান্দায় উঠে এলেন কিকিরা। যশোদাজীবন দাঁড়িয়ে আছেন। দেখলেন তারাপদকে। কিকিরা হেসে বললেন, “যশোদাবাবু, আমার চেলা এসে গিয়েছে। বলেছিলুম না, সময় মতন চলে আসবে।”

যশোদা বললেন, “দেখেছি ওঁকে। আসুন, চা তৈরি, ডাকতেই এসেছিলাম আপনাকে।”

“চলুন।”

॥ ৬ ॥

দূর থেকে দেখলে মনে হবে, সত্যি সত্যিই কৃষ্ণধামে আগুন লেগে গিয়েছে। কম্পাউন্ড-ওয়ালের কাছাকাছি মাটি খুঁড়ে করা গর্তগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া শুকনো খড়, গাছের পাতা জ্বলে উঠেছে দাউ দাউ করে। ভাদ্রমাসের বাতাসে দমকা নেই, তবু যেটুকু হাওয়া দিচ্ছিল ফাঁকা মাঠে তাতেই শিখা উঠেছে আগুনের, ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে আশপাশ। বোঝা যাচ্ছে না, একটা গর্তের সঙ্গে অন্য গর্তের হাত কয়েক ফাঁক আছে। এই মাঠে, দু’-পাঁচটা ঝোপঝাড় গাছপালার মধ্যে সামান্য আগুনেই কম হলকা ছড়ায় না। আর এই সন্ধেবেলার মুখেই ঝাপসা জ্যোৎস্নার মধ্যে কৃষ্ণধামের আগুন কার না নজরে পড়বে! কাছাকাছি গাঁ-গ্রাম নেই, তবু সামান্য তফাতে দু’-চার ঘরের বসতি তো আছেই, আছে এক-আধটা ছোট নার্সারি-বাগান। লোকজন সাকুল্যে হয়তো দশ-পনেরোজন। প্রথমটায় হয়তো এরা হকচকিয়ে গিয়েছিল। তারপর মাঠ ভেঙে ছুটে আসতে লাগল।

যশোদাজীবন হতবাক! কী যে হচ্ছে তিনি বুঝতেই পারছিলেন না। ভয়ে আতঙ্কে দিশেহারা অবস্থা তাঁর। কৃষ্ণধামের কাজের লোক তো তিনটি— তারাও বোকার মতন এই অগ্নিকাণ্ড দেখছিল।

ঠিক যে কতক্ষণ সময় কাটল, বোঝা গেল না। হঠাৎ চন্দনের গলা পাওয়া গেল, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে, “তারা, ধরে ফেলেছি, শিগগির আয়, ধরা পড়ে গিয়েছেন।”

তারাপদ ফটকের দিকে দৌড়ে গেল। খোলাই ছিল ফটক। চন্দনকে দেখতে পেল তারাপদ, বুড়োমতন এক ভদ্রলোককে জাপটে ধরে রেখেছে চন্দন।

হীরালাল।

বারান্দায় একটা চেয়ারে বসানো হল হীরালালকে। ভদ্রলোকের যেন হুঁশ নেই। কী দেখছেন, কাদের দেখছেন— বোঝাই যায় না। কাঁপছেন তখনও। কপালে ঘাম। চন্দন একবার নাড়ি দেখল ভদ্রলোকের। বলল, “আগে জল দিন ওঁকে, একটা পাখা এনে বাতাস করুন কেউ।”

যশোদা প্রায় কেঁদে ফেললেন, “বড়বাবু!”

জল এল, পাখাও এল।

হীরালাল জল খেলেন, চোখেমুখে দিলেন। একজন পাখার বাতাস করতে লাগল।

আগুন ধরেছে দেখে যারা ছুটে এসেছিল তারা দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর যশোদার কথায় চলে গেল একে-একে। কৃষ্ণধামের গায়ে কোথাও আগুনের চিহ্ন নেই, বাগান ছাড়িয়ে পাঁচিলের গায়ে-গায়ে যা আগুন জ্বলছে তখন, তাও নিভে এসেছে বারোআনা।

হীরালাল কাশছিলেন। যশোদা বড়বাবুর জন্যে লবঙ্গ আনতে বললেন।

প্রায় মিনিট পনেরো পরে হীরালাল খানিকটা সুস্থ হলেন। যশোদাকে বললেন, “এসব কী? এঁরা কারা?”

কিকিরাই কথা বললেন, “আমরা আপনার খোঁজেই এসেছিলাম। আমি কিঙ্করকিশোর রায়, লোকে বলে কিকিরা। এরা দু’জন আমার চেলা, তারাপদ আর চন্দন। … আমরা নিজের গরজে আসিনি মশাই, যশোদাবাবু আমার চেনা লোক, উনিই আমায় ধরে এনেছিলেন।”

“আপনারা পুলিশ…?”

“না। আপনি যা করেছিলেন— তাতে থানা-পুলিশ করা যেত। করা হয়নি। আপনি বুড়োমানুষ, আপনার মতন মানুষের কাণ্ডজ্ঞান থাকার কথা। তবু এমন ভীমরতি ধৱল কেন? আপনি কি জানেন না, আত্মহত্যা করার শাসানিও পুলিশ ভাল নজরে দেখে না। কেন আপনি এসব থিয়েটার করতে গিয়েছিলেন! কেন?”

হীরালাল কথা বলতে পারছিলেন না। অসহায়ের মতন মুখ করে যশোদার দিকে তাকালেন। তাঁর চোখ জলে ভরে আসতে লাগল। বিপন্ন, হতবুদ্ধি মানুষ।

কিকিরা বললেন, “কী হয়েছিল আপনার?… আমি আপনার লেখা কাগজের টুকরোগুলো পড়েই বুঝেছিলাম— আত্মহত্যা করার মানুষ আপনি না। এখানেই কোথাও লুকিয়ে আছেন।”

হীরালাল আধ-বোজা গলায় বললেন, “আপনারা আমায় ধরে আনলেন!”

“আমরা নিমিত্ত; আপনাকে ধরে এনেছে— আপনার কৃষ্ণধাম। আপনার এত সাধের, এমন ভক্তি-ভালবাসার বাড়ি, বিগ্রহ পুড়ে যাবে— সে কি আপনি জীবন থাকতে সইতে পারেন। দেখুন মশাই— মানুষ যা ভালবাসে অন্তর দিয়ে, ভক্তি করে, বিশ্বাস করে— তার ক্ষতি সইতে পারে না। আপনি ধার্মিক মানুষ, বিশ্বাসী মানুষ, ন্যায়-অন্যায় বোধ রয়েছে। সৎ সহজ ভদ্রলোক আপনি। এই কৃষ্ণধাম আপনাকে টেনে এনেছে। কিন্তু কোন আঘাতে অভিমানে আপনি চিঠিগুলো লিখেছিলেন বলুন তো?”

হীরালাল প্রথমটায় কথা বলতে পারছিলেন না। ঠোঁট কাঁপছিল।

“বলুন! সত্যি কথাই বলুন।”

“আমার বড় ছেলে—” হীরালাল বললেন। “আমার বড় ছেলে কানাই যা করতে যাচ্ছিল তার চেয়ে বড় অন্যায় অধর্ম কী হতে পারে!”

“কী করতে যাচ্ছিল?”

“আমাদের শ্যামবাজারের আদি দোকানে আগুন লাগাবার ফন্দি করেছিল। দোকানের গায়ে একটা ছোট দরজির দোকানও আছে। ভাল চলে না আজকাল। আমাদের দোকান অনেক আগেই ইনসিওর করিয়ে নিয়েছিল ছেলে। পরে আরও মোটা টাকায় ইনসিওর করায়। দোকান বেড়েছে, মালপত্র বেড়েছে, কাজেই অসুবিধে হয়নি।”

কিকিরা তারাপদদের দিকে তাকালেন।

হীরালাল বললেন, “হঠাৎ একদিন আমার কানে গেল, কানাই দোকান থেকে তলায় তলায় দামি শাড়ি কাপড়চোপড় সরাচ্ছে। এর পর ভাড়াটে লোক দিয়ে আগুন ধরাবে। তারপর ইনসিওরেন্স থেকে টাকা নেবে। বখরার ব্যবস্থাও করে রেখেছিল বোধ হয়। দোকান পুড়িয়ে সে নতুন করে সাজিয়ে পশার বসাবে। এয়ারকন্ডিশন করবে। দরজির দোকানটাকে কিছু টাকা দিয়ে তুলে দেবে। …বলুন, এ অধর্ম নয়, পাপ নয়, জুয়াচুরি নয়। আমি আমার কাঁধে, মাথায় শাড়ির বোঝা বয়ে জীবন শুরু করেছিলাম। অনেক রক্ত জল করে আমার ওই দোকান। প্রায় চল্লিশ বছরের…! সেই দোকানে আজ ও আগুন লাগাবে!” হীরালাল কপাল চাপড়ে ছেলেমানুষের মতন কেঁদে ফেললেন।

তারাপদ বলল, “আপনি ছেলেকে বলতে। পারেননি কিছু?”

“না বাবা, পারিনি। যদি অস্বীকার করত! তা ছাড়া কী জানো? সন্তানস্নেহ মানুষকে শুধু অন্ধ করে না, তার বিবেককেও যোবা করে রাখে। ধৃতরাষ্ট্রের কথাই মনে করো।”

কিকিরা বললেন, “আপনার বড় ছেলে দেখছি অতি ধূর্ত, সে নিজে গিয়ে কাশীতে বসে থাকল কাজের ছুতোয়, আর এখানে দোকান পোড়াবার

জন্যে লোক লাগিয়ে গেল! যেন তাকে কেউ সন্দেহ না করে।”

“ঠিকই বলেছেন আপনি।… আমি ভেবেছিলাম চিঠিগুলো ছেলেদের হাতে পড়লে হয়তো…”

“আপনার মেজো ছেলে, ছোট ছেলে— এসব। কিছু জানে না?”

“না।”

“আপনি কোত্থেকে জানলেন?”

হীরালাল মুখে বললেন না কিছুই। শুধু ঘাড় তুলে একবার যশোদার দিকে তাকালেন।

“তা কোথায় লুকিয়ে ছিলেন এতদিন?”

“মিশনারিদের বাড়িতে। ওখানকার সরকারবাবু আমার জানাশোনা। বন্ধুর মতন। ওঁর আশ্রয়েই ছিলাম।”

কিকিরা তারাপদদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।

২৩ ডিসেম্বর ১৯৯৭

অলংকরণ: দেবাশিস দেব

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *