দ্বিতীয় খণ্ড
প্রথম পরিচ্ছেদ : প্রথম বৎসর
হরিদ্রাগ্রামের বাড়ীতে সংবাদ আসিল, গোবিন্দলাল, মাতা প্রভৃতি সঙ্গে নির্বিঘ্নে সুস্থ শরীরে কাশীধামে পৌঁছিয়াছেন। ভ্রমরের কাছে কোন পত্র আসিল না। অভিমানে ভ্রমরও পত্র লিখিল না। পত্রাদি আমলাবর্গের কাছে আসিতে লাগিল।
এক মাস গেল, দুই মাস গেল। পত্রাদি আসিতে লাগিল। শেষ একদিন সংবাদ আসিল যে, গোবিন্দলাল কাশী হইতে বাটী যাত্রা করিয়াছেন।
ভ্রমর শুনিয়া বুঝিল যে, গোবিন্দলাল কেবল মাকে ভুলাইয়া, অন্যত্র গমন করিয়াছেন। বাড়ী আসিবেন এমন ভরসা হইল না।
এই সময়ে ভ্রমর গোপনে সর্বদা রোহিণীর সংবাদ লইতে লাগিল। রোহিণী রাঁধে বাড়ে, খায়, গা ধোয়, জল আনে। আর কিছুই সংবাদ নাই। ক্রমে এক দিন সংবাদ আসিল, রোহিণী পীড়িতা। ঘরের ভিতর মুড়ি দিয়া পড়িয়া থাকে, বাহির হয় না। ব্রহ্মানন্দ আপনি রাঁধিয়া খায়।
তার পর এক দিন সংবাদ আসিল যে, রোহিণী কিছু সারিয়াছে, কিন্তু পীড়ার মূল যায় নাই। শূলরোগ–চিকিৎসা নাই–রোহিণী আরোগ্য জন্য তারকেশ্বরে হত্যা দিতে যাইবে। শেষ সংবাদ–রোহিণী হত্যা দিতে তারকেশ্বরে গিয়াছে। একাই গিয়াছে–কে সঙ্গে যাইবে?
এ দিকে তিন চারি মাস গেল–গোবিন্দলাল ফিরিয়া আসিল না। পাঁচ ছয় মাস হইল, গোবিন্দলাল ফিরিল না। ভ্রমরের রোদনের শেষ নাই। কেবল মনে করিত, এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন–সংবাদ পাইলেই বাঁচি। এ সংবাদ পাই না কেন?
শেষ ননন্দাকে বলিয়া শাশুড়ীকে পত্র লিখাইল–আপনি মাতা, অবশ্য পুত্রের সংবাদ পান। শাশুড়ী লিখিলেন, তিনি গোবিন্দলালের সংবাদ পাইয়া থাকেন। গোবিন্দলাল প্রয়াগ, মথুরা, জয়পুর প্রভৃতি স্থান ভ্রমণ করিয়া আপাততঃ দিল্লী অবস্থিতি করিতেছেন। শীঘ্র সেখান হইতে স্থানান্তরে গমন করিবেন। কোথাও স্থায়ী হইতেছেন না।
এদিকে রোহিণীও আর ফিরিল না। ভ্রমর ভাবিতে লাগিলেন, ভগবান জানেন, রোহিণী কোথায় গেল। আমার মনের সন্দেহ আমি পাপমুখে ব্যক্ত করিব না। ভ্রমর আর সহ্য করিতে পারিলেন না; কাঁদিতে কাঁদিতে ননন্দাকে বলিয়া শিবিকারোহণে পিত্রালয়ে গমন করিলেন।
সেখানে গিয়া গোবিন্দলালের কোন সংবাদ পাওয়া দুরূহ দেখিয়া আবার ফিরিয়া আসিলেন, আসিয়া হরিদ্রাগ্রামেও স্বামীর কোন সংবাদ না পাইয়া, আবার শাশুড়ীকে পত্র লিখাইলেন। শাশুড়ী এবার লিখিলেন, “গোবিন্দলাল আর কোন সংবাদ দেয় না; এখন সে কোথায় আছে জানি না। কোনও সংবাদ পাই না |” এইরূপে প্রথম বৎসর কাটিয়া গেল। প্রথম বৎসরের শেষে ভ্রমর রুগ্নশয্যায় শয়ন করিলেন। অপরাজিতা ফুল শুকাইয়া উঠিল।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
ভ্রমর রুগ্নশয্যাশায়িনী শুনিয়া ভ্রমরের পিতা ভ্রমরকে দেখিতে আসিলেন। ভ্রমরের পিতার পরিচয় সবিশেষ দিই নাই–এখন দিব। তাঁহার পিতা মাধবীনাথ সরকারের বয়স একচত্বারিংশৎ বৎসর। তিনি দেখিতে বড় সুপুরুষ। তাঁহার চরিত্র সম্বন্ধে লোকমধ্যে বড় মতভেদ ছিল। অনেকে তাঁহার বিশেষ প্রশংসা করিত–অনেকে বলিত, তাঁহার মত দুষ্ট লোক আর নাই। তিনি যে চতুর, তাহা সকলেই স্বীকার করিত–এবং যে তাঁহার প্রশংসা করিত, সেও তাঁহাকে ভয় করিত।
মাধবীনাথ কন্যার দশা দেখিয়া, অনেক রোদন করিলেন। দেখিলেন–সেই শ্যামা সুন্দরী, যাহার সর্ববয়ব সুললিত গঠন ছিল– এক্ষণে বিশুষ্কবদন, শীর্ণশরীর, প্রকটকণ্ঠাস্থি, নিমগ্ননয়নেন্দীবর। ভ্রমরও অনেক কাঁদিল। শেষ উভয়ে রোদন সংবরণ করিলে পর ভ্রমর বলিল, “বাবা, আমার বোধ হয় দিন নাই। আমায় কিছু ধর্ম কর্ম করাও। আমি ছেলে মানুষ হলে কি হয়, আমার ত দিন ফুরাল। দিন ফুরাল ত আর বিলম্ব করিব কেন? আমার অনেক টাকা আছে, আমি ব্রত নিয়ম করিব। কে এ সকল করাইবে? বাবা, তুমি আমার ব্যবস্থা কর, |”
মাধবীনাথ কোন উত্তর করিলেন না–যন্ত্রণা সহ্য হইলে তিনি বহির্বটীতে আসিলেন। বহির্বটীতে অনেকক্ষণ বসিয়া রোদন করিলেন। কেবল রোদন নহে–সেই মর্মভেদী দুঃখ মাধবীনাথের হৃদয়ে ঘোরতর ক্রোধে পরিণত হইল। মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন যে, “যে আমার কন্যার উপর এ অত্যাচার করিয়াছে–তাহার উপর তেমনই অত্যাচার করে, এমন কি জগতে কেহ নাই?” ভাবিতে ভাবিতে মাধবীনাথের হৃদয় কাতরতার পরিবর্তে প্রদীপ্ত ক্রোধে পরিব্যাপ্ত হইল। মাধবীনাথ তখন রক্তোৎফুল্ললোচনে প্রতিজ্ঞা করিলেন, “যে আমার ভ্রমরের এমন সর্বনাশ করিয়াছে–আমি তাহার এমনই সর্বনাশ করিব |”
তখন মাধবীনাথ কতক সুস্থির হইয়া অন্তঃপুরে পুনঃপ্রবেশ করিলেন। কন্যার কাছে গিয়া বলিলেন, “মা, তুমি ব্রত নিয়ম করিবার কথা বলিতেছিলে, আমি সেই কথাই ভাবিতেছিলাম। এখন তোমার শরীর বড় রুগ্ন; ব্রত নিয়ম করিতে গেলে অনেক উপবাস করিতে হয়; এখন তুমি উপবাস সহ্য করিতে পারিবে না। একটু শরীর সারুক___”
ভ্র। এ শরীর কি আর সারিবে?
মা। সারিবে মা–কি হইয়াছে? তোমার একটু এখানে চিকিৎসা হইতেছে না–কেমন করিয়াই বা হইবে? শ্বশুর নাই, শাশুড়ী নাই, কেহ কাছে নাই–কে চিকিৎসা করাইবে? তুমি এখন আমার সঙ্গে চল। আমি তোমাকে বাড়ী রাখিয়া চিকিৎসা করাইব। আমি এখন দুই দিন এখানে থাকিব–তাহার পরে তোমাকে সঙ্গে লইয়া রাজগ্রামে যাইব।
রাজগ্রামে ভ্রমরের পিত্রালয়।
কন্যার নিকট হইতে বিদায় লইয়া মাধবীনাথ কন্যার কার্য কারকবর্গের নিকট গেলেন। দেওয়ানজীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন, বাবুর কোন পত্রাদি আসিয়া থাকে?” দেওয়ানজী উত্তর করিল, “কিছু না |”
মা। তিনি এখন কোথায় আছেন?
দে। তাঁহার কোন সংবাদই আমরা কেহ বলিতে পারি না। তিনি কোন সংবাদই পাঠান না।
মা। কাহার কাছে এ সংবাদ পাইতে পারিব?
দে। তাহা জানিলে ত আমরা সংবাদ লইতাম। কাশীতে মা ঠাকুরাণীর কাছে সংবাদ জানিতে লোক পাঠাইয়াছিলাম–কিন্তু সেখানেও কোন সংবাদ আইসে না। বাবুর এক্ষণে অজ্ঞাতবাস।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
মাধবীনাথ কন্যার দুর্দশা দেখিয়া স্থির প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন যে, ইহার প্রতীকার করিবেন। গোবিন্দলাল ও রোহিণী এই অনিষ্টের মূল। অতএব প্রথমেই সন্ধান কর্তব্য, সেই পামর পামরী কোথায় আছে। নচেৎ দুষ্টের দণ্ড হইবে না–ভ্রমরও মরিবে।
তাহারা একেবারে লুকাইয়াছে। যে সকল সূত্রে তাহাদের ধরিবার সম্ভাবনা, সকলই অবচ্ছিন্ন করিয়াছে; পদচিহ্নমাত্র মুছিয়া ফেলিয়াছে। কিন্তু মাধবীনাথ বলিলেন যে, যদি আমি তাহাদের সন্ধান করিতে না পারি, তবে বৃথায় আমার পৌরুষের শ্লাঘা করি।
এইরূপ স্থির সংকল্প করিয়া মাধবীনাথ একাকী রায়দিগের বাড়ী হইতে বহির্গত হইলেন। হরিদ্রাগ্রমের একটি পোষ্ট আপিস ছিল; মাধবীনাথ বেত্রহস্তে, হেলিতে দুলিতে, পান চিবাইতে চিবাইতে, ধীরে ধীরে, নিরীহ ভালমানুষের মত, সেইখানে গিয়া দর্শন দিলেন।
ডাকঘরে, অন্ধকার চালাঘরের মধ্যে মাসিক পনর টাকা বেতনভাগী একটি ডিপুটি পোষ্ট মাষ্টার বিরাজ করিতেছিলেন। একটি আম্রকাষ্ঠের ভগ্ন টেবিলের উপরে কতকগুলি চিঠি, চিঠির ফাইল, চিঠির খাম, একখানি খুরিতে কতকটা জিউলির আটা, একটি নিক্তি, ডাকঘরের মোহর ইত্যাদি লইয়া, পোষ্ট মাষ্টার ওরফে পোষ্টবাবু গম্ভীরভাবে, পিয়ন মহাশয়ের নিকট আপন প্রভুত্ব বিস্তার করিতেছেন। ডিপুটি পোষ্টমাষ্টার বাবু পান পনর টাকা, পিয়ন পায় সাত টাকা। সুতরাং পিয়ন মনে করে, সাত আনা আর পনর আনায় যে তফাৎ, বাবুর সঙ্গে আমার সঙ্গে তাহার অধিক তফাৎ নহে। কিন্তু বাবু মনে মনে জানেন যে, আমি একটা ডিপুটি–ও বেটা পিয়াদা–আমি উহার হর্তা কর্তা বিধাতা পুরুষ–উহাতে আমাতে জমীন আশমান ফারাক। সেই কথা সপ্রমাণ করিবার জন্য, পোষ্ট মাষ্টার বাবু সর্বদা সে গরীবকে তর্জন গর্জন করিয়া থাকেন–সেও সাত আনার ওজনে ভর্ৎসনা করিতেছিলেন, এমত সময়ে প্রশান্তমূতি সহাস্যবদন মাধবীনাথ বাবু সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ভদ্রলোক দেখিয়া, পোষ্টমাষ্টার বাবু, আপাততঃ পিয়াদার সঙ্গে কচকচি বন্ধ করিয়া, হাঁ করিয়া, চাহিয়া রহিলেন। ভদ্রলোককে সমাদর করিতে হয়, এমন কতকটা তাঁহার মনে উদয় হইল–কিন্তু সমাদর কি প্রকারে করিতে হয়, তাহা তাঁহার শিক্ষার মধ্যে নহে–সুতরাং তাহা ঘটিয়া উঠিল না।
মাধবীনাথ দেখিলেন, একটা বানর। সহাস্যবদনে বলিলেন, “ব্রাহ্মণ?”
পোষ্টমাষ্টার বলিলেন, “হাঁ–তু–তুমি–আপনি?”
মাধবীনাথ ঈষৎ হাস্য সংবরণ করিয়া অবনতশিরে যুক্তকরে ললাট স্পর্শ করিয়া বলিলেন, “প্রাতঃপ্রণাম!”
তখন পোষ্ট মাষ্টার বাবু বলিলেন, “বসুন |”
মাধবীনাথ কিছু বিপদে পড়িলেন;-পোষ্টবাবু ত বলিলেন, “বসুন”, কিন্তু তিনি বসেন কোথা–বাবু খোদ এক অতি প্রাচীন ত্রিপাদমাত্রবশিষ্ট চৌকিতে বসিয়া আছেন–তাহা ভিন্ন আর আসন কোথাও নাই। তখন সেই পোষ্টমাষ্টার বাবুর সাত আনা, হরিদাস পিয়াদা–একটা ভাঙ্গা টুলের উপর হইতে রাশিখানি ছেঁড়া বহি নামাইয়া রাখিয়া মাধবীনাথকে বসিতে দিল। মাধবীনাথ বসিয়া তাহার প্রতি দৃষ্টি করিয়া বলিলেন, “কি হে বাপু, কেমন আছ? তোমাকে দেখিয়াছি না?”
পিয়াদা। আজ্ঞা, আমি চিঠি বিলি করিয়া থাকি।
মাধবী। তাই চিনিতেছি। এক ছিলিম তামুক সাজ দেখি–
মাধবীনাথ গ্রামান্তরের লোক, তিনি কখনই হরিদাস বৈরাগী পিয়াদাকে দেখেন নাই এবং বৈরাগী বাবাজিও কখনও তাহাকে দেখেন নাই। বাবাজি মনে করিলেন–বাবুটা রকমসই বটে চাহিলে কোন না চারি গণ্ডা বখশিশ দিবে। এই ভাবিয়া হুঁকোর তল্লাসে ধাবিত হইলেন।
মাধবীনাথ আদৌ তামাকু খান না–কেবল হরিদাস বাবাজিকে বিদায় করিবার জন্য তামাকুর ফরমায়েশ করিলেন।
পিয়াদা মহাশয় স্থানান্তরে গমন করিলে, মাধবীনাথ পোষ্টমাষ্টার বাবুকে বলিলেন, “আপনার কাছে একটা জিজ্ঞাসা করার জন্য আসা হইয়াছে |”
পোষ্টমাষ্টার বাবু মনে মনে একটু হাসিলেন। তিনি বঙ্গদেশীয়–নিবাস বিক্রমপুরে। অন্য দিকে যেমন নির্বোধ হউন না কেন–আপনার কাজ বুঝিতে সূচ্যগ্রবুদ্ধি। বুঝিলেন যে, বাবুটি কোন বিষয়ের সন্ধানে আসিয়াছেন। বলিলেন, “কি কথা মহাশয়?”
মা। ব্রহ্মানন্দকে আপনি চিনেন?
পো। চিনি না–চিনি–ভাল চিনি না।
মাধবীনাথ বুঝিলেন, অবতার নিজমূর্তি ধারণ করিবার উপক্রম করিতেছে। বলিলেন, “আপনার ডাকঘরে ব্রহ্মানন্দ ঘোষের নামে কোন পত্রাদি আসিয়া থাকে?”
পো। আপনার সঙ্গে ব্রহ্মানন্দ ঘোষের আলাপ নাই?
মা। থাক বা না থাক, কথাটা জিজ্ঞাসা করিতে আপনার কাছে আসিয়াছি।
পোষ্টমাষ্টার বাবু তখন আপনার উচ্চ পদ এবং ডিপুটি অভিধান স্মরণপূর্বক অতিশয় গম্ভীর হইয়া বসিলেন, এবং অল্প রুষ্টভাবে বলিলেন, “ডাকঘরের খবর আমাদের বলিতে বারণ আছে|” ইহা বলিয়া পোষ্ট মাষ্টার নীরবে চিঠি ওজন করিতে লাগিলেন।
মাধবীনাথ মনে মনে হাসিতে লাগিলেন; প্রকাশ্যে বলিলেন, “ওহে বাপু, তুমি অমনি কথা কবে না, তা জানি। সে জন্য কিছু সঙ্গেও আনিয়াছি–কিছু দিয়া যাইব–এখন যা যা জিজ্ঞাসা করি, ঠিক ঠিক বল দেখি___”
তখন, পোষ্ট বাবু হর্ষোৎফুল্ল বদনে বলিলেন, “কি কন?”
মা। কই এই, ব্রহ্মানন্দের নামে কোন চিঠিপত্র ডাকঘরে আসিয়া থাকে?
পো। আসে।
মা। কত দিন অন্তর?
পো। যে কথাটি বলিয়া দিলাম, তাহার এখনও টাকা পাই নাই। আগে তার টাকা বাহির করুন; তবে নূতন কথা জিজ্ঞাসা করিবেন।
মাধবীনাথের ইচ্ছা ছিল, পোষ্টমাষ্টারকে কিছু দিয়া যান। কিন্তু তাহার চরিত্রে বড় বিরক্ত হইয়া উঠিলেন–বলিলেন, “বাপু, তুমি ত বিদেশী মানুষ দেখছি–আমায় চেন কি?”
পোষ্ট মাষ্টার মাথা নাড়িয়া বলিলেন, “না। তা আপনি যেই হউন না কেন–আমরা কি পোষ্ট আপিসের খবর যাকে তাকে বলি? কে তুমি?”
মা। আমার নাম মাধবীনাথ সরকার–বাড়ী রাজগ্রাম। আমার পাল্লায় কত লাঠিয়াল আছে খবর রাখ?
পোষ্ট বাবুর ভয় হইল–মাধবী বাবুর নাম ও দোর্দণ্ড প্রতাপ শুনিয়াছিলেন। পোষ্টবাবু একটু চুপ করিলেন।
মাধবীনাথ বলিতে লাগিলেন, “আমি যাহা তোমায় জিজ্ঞাসা করি–সত্য সত্য জবাব দাও। কিছু তঞ্চক করিও না। করিলে তোমায় কিছু দিব না–এক পয়সাও নহে। কিন্তু যদি না বল, মিছা বল, তবে তোমার ঘরে আগুন দিব, তোমার ডাকঘর লুঠ করিব; আদালতে প্রমাণ করাইব যে, তুমি নিজে লোক দিয়া সরকারী টাকা অপহরণ করিয়াছ–কেমন, এখন বলিবে?”
পোষ্টবাবু থরথরি কাঁপিতে লাগিলেন–বলিলেন, “আপনি রাগ করেন কেন? আমি ত আপনাকে চিনিতাম না, বাজে লোক মনে করিয়াই ওরূপ বলিয়াছিলাম–আপনি যখন আসিয়াছেন, তখন যাহা জিজ্ঞাসা করিবেন, তাহা বলিব |”
মা। কত দিন অন্তর ব্রহ্মানন্দের চিঠি আসে?
পো। প্রায় মাসে মাসে–ঠিক ঠাওর নাই।
মা। তবে রেজিষ্টরি হইয়াই চিঠি আসে?
পো। হাঁ–প্রায় অনেক চিঠিই রেজিষ্টরি করা।
মা। কোন্ আপিস হইতে রেজিষ্টরি হইয়া আইসে?
পো। মনে নাই।
মা। তোমার আপিসে একখানা করিয়া রসিদ থাকে না?
পোষ্টমাষ্টার রসিদ খুঁজিয়া বাহির করিলেন। একখানা পড়িয়া বলিলেন, “প্রসাদপুর |”
“প্রসাদপুর কোন্ জেলা? তোমাদের লিষ্টি দেখ|” পোষ্টমাষ্টার কাঁপিতে কাঁপিতে ছাপান লিষ্টি দেখিয়া বলিল, “যশোর |”
মা। দেখ, তবে আর কোথা হইতে রেজিষ্টরি চিঠি উহার নামে আসিয়াছে। সব রসিদ দেখ।
পোষ্ট বাবু দেখিলেন, ইদানীন্তন যত পত্র আসিয়াছে, সকলই প্রসাদপুর হইতে। মাধবীনাথ পোষ্ট মাষ্টার বাবুর কম্পমান হস্তে একখানি দশ টাকার নোট দিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন। তখনও হরিদাস বাবাজির হুঁকা জুটিয়া উঠে নাই। মাধবীনাথ হরিদাসের জন্যও একটি টাকা রাখিয়া গেলেন। বলা বাহুল্য যে, পোষ্টবাবু তাহা আত্মসাৎ করিলেন।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
মাধবীনাথ হাসিতে হাসিতে ফিরিয়া আসিলেন। মাধবীনাথ, গোবিন্দলাল ও রোহিনীর অধ:পতনকাহিনী সকলই লোকপরম্পরায় শুনিয়াছিলেন। তিনি মনে মনে স্থিরসিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন যে, রোহিণী গোবিন্দলাল এক স্থানেই গোপনে বাস করিতেছে। ব্রহ্মানন্দের অবস্থাও তিনি সবিশেষ অবগত ছিলেন–জানিতেন যে,রোহিনী ভিন্ন তাঁহার আর কেহই নাই। অতএব যখন পোষ্ট আপিসে জানিলেন যে ব্রহ্মানন্দের নামে মাসে মাসে রেজিষ্টরি হইয়া চিঠি আসিতেছে–তখন বুঝিলেন যে, হয় রোহিণী, নয় গোবিন্দলাল তাঁহাকে মাসে মাসে খরচ পাঠায়। প্রসাদপুর হইতে চিঠি আসে, অতএব উভয়েই প্রসাদপুরে কিম্বা তাহার নিকটবর্তী কোন স্থানে অবশ্য বাস করিতেছে, কিন্তু নিশ্চয়কে নিশ্চয়তর করিবার জন্য তিনি কন্যালয়ে প্রত্যাগমন করিয়াই ফাঁড়িতে একটি লোক পাঠাইলেন। সাব্ ইন্স্পে ক্টরকে লিখিয়া পাঠাইলেন, একটি কনস্টেড়বল পাঠাইবেন, বোধ হয় কতকগুলি চোরা মাল ধরাইয়া দিতে পারিব।
সাব ইনস্পেক্টর মাধবীনাথকে বিলক্ষণ জানিতেন–ভয়ও করিতেন–পত্রপ্রাপ্তি মাত্র নিদ্রাসিংহ কনস্টেনবলকে পাঠাইয়া দিলেন।
মাধবীনাথ নিদ্রাসিংহের হস্তে দুইটি টাকা দিয়া বলিলেন, “বাপু হে–হিন্দি মিন্দি কইও না–যা বলি, তাই কর। ঐ গাছতলায় গিয়া, লুকাইয়া থাক। কিন্তু এমন ভাবে গাছতলায় দাঁড়াইবে, যেন এখান হইতে তোমাকে দেখা যায়। আর কিছু করিতে হইবে না |” নিদ্রাসিংহ স্বীকৃত হইয়া বিদায় লইল। মাধবীনাথ তখন ব্রহ্মানন্দকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। ব্রহ্মানন্দ আসিয়া নিকটে বসিল। তখন আর কেহ সেখানে ছিল না।
পরস্পরে স্বাগত জিজ্ঞাসার পর মাধবীনাথ বলিলেন, “মহাশয় আমার স্বর্গীয় বৈবাহিক মহাশয়ের বড় আত্মীয় ছিলেন। এখন তাঁহারা ত কেহ নাই–আমার জামাতাও বিদেশস্থ। আপনার কোন বিপদ আপদ পড়িলেই আমাদিগকেই দেখিতে হয়–তাই আপনাকে ডাকাইয়াছি|”
ব্রহ্মানন্দের মুখ শুকাইল। বলিল, “বিপদ কি মহাশয়?” মাধবীনাথ গম্ভীরভাবে বলিলেন, “আপনি কিছু বিপদগ্র্স্ত বটে |”
ব্র। “কি বিপদ্ মহাশয়?”
মা। বিপদ্ সমূহ। পুলিসে কি প্রকারে নিশ্চয় জানিয়াছে যে, আপনার কাছে একখানা চোরা নোট আছে।
ব্রহ্মানন্দ আকাশ হইতে পড়িল। “সে কি! আমার কাছে চোরা নোট!”
মা। তোমার জানা, চোরা না হইতে পারে। অন্যে তোমাকে চোরা নোট দিয়াছে, তুমি না জানিয়া তুলিয়া রাখিয়াছ!
ব্র। সে কি মহাশয়! আমাকে নোট কে দিবে?
মাধবীনাথ তখন আওয়াজ ছোট করিয়া বলিলেন, “আমি সকলই জানিয়াছি–পুলিসেও জানিয়াছে। বাস্তবিক পুলিসের কাছেই এ কথা শুনিয়াছি। চোরা নোট প্রসাদপুর হইতে আসিয়াছে। ঐ দেখ একজন পুলিসের কনস্টেেবল আসিয়া তোমার জন্য দাঁড়াইয়া আছে–আমি তাহাকে কিছু দিয়া আপাততঃ স্থগিত রাখিয়াছি |”
মাধবীনাথ তখন বৃক্ষতলবিহারী রুলধারী গুম্ফশ্মশ্রু-শোভিত জলধরসন্নিভ কনস্টেঃবলের কান্তমূতি দর্শন করাইলেন।
ব্রহ্মানন্দ থর থর কাঁপিতে লাগিল। মাধবীনাথের পায়ে জড়াইয়া কাঁদিয়া বলিল, “আপনি রক্ষা করুন |”
মা। ভয় নাই। এবার প্রসাদপুর হইতে কোন্ কোন্ নম্বরের নোট পাইয়াছ, বল দেখি। পুলিসের লোক আমার কাছে নোটের নম্বর রাখিয়া গিয়াছে। যদি সে নম্বরের নোট না হয়, তবে ভয় কি? নম্বর বদলাইতে কতক্ষণ? এবারকার প্রসাদপুরের পত্রখানি লইয়া আইস দেখি–নোটের নম্বর দেখি।
ব্রহ্মানন্দ যায় কি প্রকারে? ভয় করে–কনস্টেেবল যে গাছতলায়।
মাধবীনাথ বলিলেন, “কোন ভয় নাই, আমি সঙ্গে লোক দিতেছি |” মাধবীনাথের আদেশমত একজন দ্বারবান ব্রহ্মানন্দের সঙ্গে গেল। ব্রহ্মানন্দ রোহিণীর পত্র লইয়া আসিলেন। সেই পত্রে, মাধবীনাথ যাহা যাহা খুঁজিতেছিলেন, সকলই পাইলেন।
পত্র পাঠ করিয়া ব্রহ্মানন্দকে ফিরাইয়া দিয়া বলিলেন, “এ নম্বরের নোট নহে। কোন ভয় নাই–তুমি ঘরে যাও। আমি কনস্টে বলকে বিদায় করিয়া দিতেছি|”
ব্রহ্মানন্দ মৃতদেহে প্রাণ পাইল। উর্ধ্বশ্বাসে তথা হইতে পলায়ন করিল।
মাধবীনাথ কন্যাকে চিকিৎসার্থ স্বগৃহে লইয়া গেলেন। তাহার চিকিৎসার্থ উপযুক্ত চিকিৎসক নিযুক্ত করিয়া দিয়া, স্বয়ং কলিকাতায় চলিলেন। ভ্রমর অনেক আপত্তি করিল, মাধবীনাথ শুনিলেন না। শীঘ্রই আসিতেছি, এই বলিয়া কন্যাকে প্রবোধ দিয়া গেলেন।
কলিকাতায় নিশাকর দাস নামে মাধবীনাথের একজন বড় আত্মীয় ছিলেন। নিশাকর মাধবীনাথের অপেক্ষা আট দশ বৎসরের বয়ঃকনিষ্ঠ। নিশাকর কিছু করেন না–পৈতৃক বিষয় আছে–কেবল একটু একটু গীতবাদ্যের অনুশীলন করেন। নিষ্কর্মা বলিয়া সর্বদা পর্য্যটনে গমন করিয়া থাকেন। মাধবীনাথ তাঁহার কাছে আসিয়া সাক্ষাৎ করিলেন। অন্যান্য কথার পর নিশাকরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন হে, বেড়াইতে যাইবে?”
নিশা। কোথায়?
মা। যশোর।
নি। সেখানে কেন?
মা। নীলকুঠি কিনব।
নি। চল।
তখন বিহিত উদ্যোগ করিয়া দুই বন্ধু এক দিনের মধ্যে যশোরাভিমুখে যাত্রা করিলেন। সেখান হইতে প্রসাদপুর যাইবেন।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
দেখো, ধীরে ধীরে শীর্ণশরীরা চিত্রানদী বহিতেছে–তীরে অশ্বত্থ কদম্ব আম্র খর্জুর প্রভৃতি অসংখ্য বৃক্ষশোভিত উপবনে কোকিল দোয়েল পাপিয়া ডাকিতেছে। নিকটে গ্রাম নাই; প্রসাদপুর নামে একটি ক্ষুদ্র বাজার প্রায় এক ক্রোশ পথ দূর। এখানে মনুষ্যসমাগম নাই দেখিয়া, নিঃশঙ্কে পাপাচরণ করিবার স্থান বুঝিয়া, পূর্বকালে এক নীলকর সাহেব এইখানে এক নীলকুঠি প্রস্তুত করিয়াছিল এক্ষণে নীলকর এবং তাহার ঐশ্বর্য ধ্বংসপুরে প্রয়াণ করিয়াছে–তাহার আমীন তাগাদগীর নায়েব গোমস্তা সকলে উপযুক্ত স্থানে স্বকর্মাজিত ফলভোগ করিতেছেন। একজন বাঙ্গালি সেই জনশূন্য প্রান্তরস্থিত রম্য অট্টালিকা ক্রয় করিয়া, তাহা সুসজ্জিত করিয়াছিলেন। পুষ্পে, প্রস্তরপুত্তলে, আসনে, দর্পণে, চিত্রে, গৃহ বিচিত্র হইয়া উঠিয়াছিল। তাহার অভ্যন্তরে দ্বিতলস্থ বৃহৎ কক্ষমধ্যে আমরা প্রবেশ করি। কক্ষমধ্যে কতকগুলি রমণীয় চিত্র–কিন্তু কতকগুলি সুরুচিবিগর্হিত–অবর্ণনীয়। নির্মল সুকোমল আসনোপরি উপবেশন করিয়া একজন শ্মশ্রুধারী মুসলমান একটা তম্বুরার কাণ মুচড়াইতেছে–কাছে বসিয়া এক যুবতী ঠিং ঠিং করিয়া একটি তবলায় ঘা দিতেছে–সঙ্গে সঙ্গে হাতের স্বর্ণালঙ্কার ঝিন্ ঝিন্ করিয়া বাজিতেছে–পার্শ্বস্থ প্রাচীরবিলম্বী দুইখানি বৃহৎ দর্পণে উভয়ের ছায়াও ঐরূপ করিতেছিল। পাশের ঘরে বসিয়া, একজন যুবা পুরুষ নবেল পড়িতেছেন এবং মধ্যস্থ মুক্ত দ্বারপথে যুবতীর কার্য দেখিতেছেন।
তম্বুরার কাণ মুচড়াইতে মুচড়াইতে দাড়িধারী তাহার তারে অঙ্গুলি দিতেছিল। যখন তারের মেও মেও আর তবলার খ্যান্ খ্যান্ ওস্তাদজীর বিবেচনায় এক হইয়া মিলিল–তখন তিনি সেই গুম্ফ শ্মশ্রুর অন্ধকারমধ্য হইতে কতকগুলি তুষারধবল দন্ত বিনির্গত করিয়া, বৃষভদুর্লভ কণ্ঠরব বাহির করিতে আরম্ভ করিলেন। রব নির্গত করিতে করিতে সে তুষারধবল দন্তগুলি বহুবিধ খিচুনিতে পরিণত হইতে লাগিল; এবং ভ্রমরকৃষ্ণ শ্মশ্রুরাশি তাহার অনুবর্তন করিয়া নানা প্রকার রঙ্গ করিতে লাগিল। তখন যুবতী খিচুনিসন্তাড়িত হইয়া সেই বৃষভদুলর্ভ রবের সঙ্গে আপনার কোমল কণ্ঠ মিশাইয়া গীত আরম্ভ করিল,–তাহাতে সরু মোটা আওয়াজে সোণালি রূপালি রকম একপ্রকার গীত হইতে লাগিল।
এইখানে যবনিকা পতন করিতে ইচ্ছা হয়। যাহা অপবিত্র, অদর্শনীয়, তাহা আমরা দেখাইব না–যাহা নিতান্ত না বলিলে নয়, তাহাই বলিব। কিন্তু তথাপি সেই অশোক বকুল কুটজ কুরুবক কুঞ্জমধ্যে ভ্রমরগুঞ্জন, কোকিলকূজন, সেই ক্ষুদ্রনদীতরঙ্গচালিত রাজহংসের কলনাদ, সেই যূথী জাতি মল্লিকা মধুমালতী প্রভৃতি কুসুমের সৌরভ, সেই গৃহমধ্যে নীলকাচপ্রবিষ্ট রৌদ্রের অপূর্ব মাধুরী, সেই রজতস্ফটিকাদিনির্মিত পুষ্পাধারে সুবিন্যস্ত কুসুমগুচ্ছের শোভা, সেই গৃহশোভাকারী দ্রব্যজাতের বিচিত্র উজ্জ্বল বর্ণ আর সেই গায়কের বিশুদ্ধস্বরসপ্তকের ভূয়সী সৃষ্টি, এই সকলের ক্ষণিক উল্লেখ করিলাম। কেন না, যে যুবক নিবিষ্টমনে যুবতীর চঞ্চল কটাক্ষ দৃষ্টি করিতেছে, তাহার হৃদয়ে ঐ কটাক্ষের মাধুর্য্যেই এই সকলের সম্পূর্ণ স্ফূর্তি হইতেছে।
এই যুবা গোবিন্দলাল–ঐ যুবতী রোহিণী। এই গৃহ গোবিন্দলাল ক্রয় করিয়াছেন। এইখানেই ইহারা স্থায়ী।
অকস্মাৎ রোহিণীর তবলাহ বেসুরা বলিল। ওস্তাদজীর তম্বুরার তার ছিঁড়িল, তাঁর গলায় বিষম লাগিল–গীত বন্ধ হইল; গোবিন্দলালের হাতের নবেল পড়িয়া গেল। সেই সময় সেই প্রমোদগৃহের দ্বারে একজন অপরিচিত যুবা পুরুষ প্রবেশ করিল। আমরা তাহাকে চিনি–সে নিশাকর দাস।