কৃপাময়ী
অস্কার ওয়াইল্ড লিখেছিলেন—ম্যারেজ ইজ এ পারমারেন্ট ডিসএগ্রিমেন্ট। মানে স্থায়ী একটা মতের অমিল। স্বামী আর স্ত্রীর মতের মিল হলে, বিবাহিত জীবনের সমস্ত স্বাদই চলে গেল। সেই দাম্পত্য জীবন আলুনি তরকারির মতো। চিনি আর দুধ ছাড়া চায়ের মতো। লেজ-কাটা বেড়ালের মতো। গোঁফ-কামানো বাঘের মতো। শব্দহীন ঝরনার মতো। নি:শব্দ হাটের মতো। ফ্যাঁস আর ফোঁস এই হল দাম্পত্য জীবন। আমি ফ্যাঁস করব, তিনি ফোঁস করবেন। লাগাতার খিচিমিচির নাম বিয়ে। কি বড়, কি ছোট জীবনের যে কোনও ব্যাপারে দুজনের দু-রকম মত। একবার এক নৌকা-ভ্রমণে আমি দেখেছিলাম—মাঝ নদীতে পালতোলা নৌকো চলছে তরতর করে, আর দুজন লোক সেই নৌকোয় কি একটা ব্যাপার নিয়ে মারামারি করছে। আরে মশাই চলন্ত নৌকো যে উল্টে যাবে! কে কার কথা শোনে। জীবন আগে, না ফায়সালা আগে। দাম্পত্য জীবন অনেকটা মহাকালের স্রোত আর তাতে বেয়ে দুই চরিত্রে চলছে আজীবন হাতাহাতি। কোনও বিশ্বসংস্থার যেমন ক্ষমতা নেই বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার, অশান্তি কোনও না কোনও ভাবে ফুঁড়ে বেরোবেই, এখানে ওখানে, সেইরকম সারাদিনে একবার না একবার লাগবেই স্বামী-স্ত্রীতে!
দাঁত ফুটো থাকলে খাবার খেলে যা হয়। একটা কণা গিয়ে ঢুকবেই সেই গর্তে। তারপর জিভ। সারাদিন জিভের কাজই হবে গর্ত থেকে সেই কণাটিকে ঠেলে বের করার। সে মন্দ নয়। এক ধরনের ব্যস্ততা। যাকে বলে এনগেজমেন্ট। একটা রোখ, একটা গোঁ। বের করতেই হবে অস্বস্তি। এই যে ঢুকবেই, তা বলে কি খাওয়া বন্ধ হবে। অবশ্যই না।
স্বামীর মনের ছিদ্রে স্ত্রীর ব্যক্তিত্ব, স্ত্রীর মনের ছিদ্রে স্বামীর ব্যক্তিত্ব। দুজনেরই জিভ মহাব্যস্ত। ঠেলাঠেলি। জিভ মানেই বাক্যবাণ। আমি বলি, তুমিও বলো। দুজনের বলাবলি, পাড়া-প্রতিবেশীর শ্রবণ। সংসার মানেই অবিচ্ছিন্ন ঠোকাঠুকি। কোস্তাকুস্তি। মন নিয়ে যখন কারবার, তখন তো এমন হবেই। মন থাকলেই মত থাকবে, আর দুটো মত কখনও এক হবে না, যদি সামনে কোনও মতলব না থাকে। অকারণে কেন মতের মিল হবে। কোথায় কবে হয়েছে।
ফ্রয়েড সাহেব, অতবড় একজন মনস্তাত্বিক, তাঁকে প্রশ্ন করা হল, আপনার সঙ্গে আপনার স্ত্রীর নিশ্চয় কোনও মনোমালিন্য হয়নি। আপনি এতবড় একজন মনস্তাত্বিক। ফ্রয়েড বললেন, হ্যাঁ, হয়েছিল জীবনে মাত্র একবার। একবারই হয়েছিল। ঘটনাটা খুবই সামান্য। সস্ত্রীক এক বন্ধুর বাড়িতে যাবেন। বাড়ির দরজার সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রয়েড সাহেব বললেন, আমি ডান দিকে বসব। ডান আর বাঁ নিয়ে অল্পকিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি। শেষে কি হল? খুব সহজ সমাধান। দুজনে মুখোমুখি বসলাম। গাড়ি চলতে শুরু করল। পাশাপাশি বসতে না পারলেও মুখোমুখি তো বসা যায়!
মতে-মতে না মিললেও, যে-কোনও একটাকে মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। সংসার-রথের সারথি কৃষ্ণ হলেন—স্ত্রী। মন্ত্রটা গীতারই বাণী যথা নিযুক্তিহস্মি তথা করোমি। যা বলবে, বাবা, তাই করব। কিছু ব্যাপারে নিজের মত একেবারেই খাটাতে যাবো না। লোকে স্ত্রৈণ বলবে, তা বলুক। ত্রুশ্চেভ তখন রাশিয়ার সর্বময়। সাংবাদিক জিগ্যেস করলেন, আচ্ছা, আপনি কারওকে ভয় করেন? ত্রুশ্চেভ বললেন, হ্যাঁ করি।
কাকে করেন?
সবাই যাকে করে।
অর্থাৎ স্ত্রীকে। স্ত্রীকে ভয় করার কারণটা কি? কারণ একটাই—সংসারের শান্তি। রুমি বলছেন, অখুশি অশান্ত স্ত্রীর সঙ্গে বাড়িতে থাকার চেয়ে বাড়ির কার্নিসে বসবাস করাই ভালো। আত্মবিকাশের জন্যে গৃহশান্তির ভীষণ প্রয়োজন। আমরা বলি, অন্তর্কলহ খুব খারাপ ব্যাপার। এই করে দেশ ভাঙে, ভাঙে যৌথ পরিবার। যৌথ পরিবার তো ভায়ে-ভায়ে, ভায়ের বউয়ে-বউয়ে, কোন্দল করে শেষ হয়ে গেছে। এখন একক পরিবারের যুগ। তাও তো অশান্তির শেষ নেই। পরস্পর মানিয়ে চলাকে আমরা মনে করি বশ্যতা স্বীকার করা। সে আবার কি? আমি আমার মতো চলব, তুমি তোমার মতো চলবে, তাহলে তো সবই অচল হয়ে যাবে। একই নৌকোয় দুই দাঁড়ি যদি বিপরীত দিকে সমান শক্তিতে দাঁড় বাইতে থাকে নৌকো তো একই জায়গায় ঘুরপাক খাবে। স্ত্রীর মতে এই কারণেই চলা ভালো, মেয়েরা সংসারের ব্যাপারটা বোঝে ভালো। ছেলেরা বাইরের জীব, মেয়েরা সংসারের। অবশ্য প্রবাদে বলা আছে, স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ংকারী। স্ত্রীর বুদ্ধি নিয়ে বাইরের জগতে চলতে গেলে বিপদ হতে পারে, কিন্তু সংসারের নানা খুঁটিনাটি ব্যাপারে স্ত্রীকে ল্যাং মারার চেষ্টা না করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কথায় বলে—বাঘের সঙ্গে বিবাদ করে জঙ্গলে বসবাস করা যায় না। সব ব্যাপারেই একটা কায়দা থাকে। সংসারে ঢোকার আগে সেই কায়দাটা সকলেরই শেখা উচিত। রিং মাস্টার বাঘের খেলা দেখাচ্ছে অথচ বাঘ তার পোষ মানে না। ফল কি হবে। পটল তোলা। নারী চরিত্র বুঝতে হবে। বিবাহ সারা জীবনের চুক্তি। স্ত্রী মা হবেন। ভবিষ্যৎ পুরুষ গড়ে উঠবে তাঁরই তত্বাবধানে। সংসারে তাঁর দাপট মানতেই হবে। মেয়েরা হলেন কোমল জাতি, সংবেদনশীল, স্পর্শকাতর। তাঁদের মিষ্ট কথায় তুষ্ট করতে পারলেই—আপদ শান্তি—বিপদ শান্তি। নিজের মত চাপাতে গেলেই বিপদ। নিজের মতে কায়দা করে বেড়াতে হবে। এমন করতে হবে যে, আমার মতটাই তাঁর মতের মতো মনে হবে। কূটনীতিবিদরা যা করেন আর কি! নিজেকে একটু নরম করে, একটু বিনীতভাবে সামনে ফেলতে পারলেই কাজ হবে। নারী যে কৃপাময়ী।