কৃপণের মন্ত্র (গোবিন্দরামের কীৰ্ত্তি-পৰ্য্যায়)
প্ৰথমাৰ্দ্ধ
একদিন রাত্রে গোবিন্দরাম একটা প্রকাণ্ড টিনের বাক্স হইতে বাণ্ডিল বাণ্ডিল কাগজ বাহির করিতেছিলেন। একবার মনে করিলাম, জিজ্ঞাসা করি ব্যাপারটা কি; কিন্তু আমি জানি, তাঁহার নিজের মৌজ না হইলে তিনি কোন কথাই বলিবেন না, সুতরাং তাঁহার মৌজের প্রতীক্ষা করিয়া নীরবে তাঁহার কাগজের বাণ্ডিলগুলির দিকে সতৃষ্ণনেত্রে চাহিয়া রহিলাম।
কিয়ৎক্ষণ পরে তিনি মাথা তুলিয়া সাহস্যে বলিলেন, “ডাক্তার, এখানে এত ব্যাপার আছে যে, তোমার পাঁচ-সাতখানা প্রকাণ্ড পুস্তক প্রস্তুত হইতে পারে।”
আমি বলিলাম, “আমার মনে হয়, এই সকল তোমার প্রথম অনুসন্ধানের ফল। কতকগুলি ব্যাপার শুনিতে পাইলে খুসি ভিন্ন অসুখী হইব না।”
“হাঁ, কথাটা ঠিক—আমার জীবনচরিত লেখকের সহিত আমার পরিচয় হইবার পূর্ব্বে এই সকল ব্যাপার ঘটিয়াছে। এই টীনের বাক্সের আর বাণ্ডিলগুলির ধূলিধূসরিত অবস্থা দেখিয়াই তুমি এইরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি, তাহা বুঝিতে পারিয়াছি; বিশেষতঃ এই জিনিষগুলির উপরে কালের যেরূপ প্রলেপ পড়িয়াছে, তাহাতে এ কথা বলা শক্ত নহে। ডাক্তার, ইহার সকল গুলিতে যে আমি সফল হইতে পারিয়াছিলাম, তাহা নহে, তবে ইহার মধ্যেও কতকগুলি বিশেষ কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার আছে—এই রামবাগানের খুন—এই—গঙ্গাধরের মোকদ্দমা, হাঁ—এই ব্যাপারটীতে খুব নূতনত্ব আছে।”
এই বলিয়া গোবিন্দরাম সেই প্রকাণ্ড টীনের বাক্সের ভিতর হইতে একটা ছোট কাঠের বাক্স বাহির করিলেন। বাক্সের ডালা তুলিয়া তিনি একখণ্ড কাগজ, একটা প্রাচীনকালের পিতলের চাবি একটা কাঠে জড়ান এক বাণ্ডিল সূতা আর তিনটা কৃষ্ণবর্ণের ধাতুখণ্ড বাহির করিয়া বলিলেন, ‘ডাক্তার, এ সকল দেখিয়া কি মনে কর?”
“নতুন বটে, খুব চমৎকার সংগ্রহ।”
“হাঁ, ইহার সহিত যে ঘটনা জড়িত আছে, তাহা আরও চমৎকার!”
“তাহা হইলে ইহাদের সহিত একটা ইতিহাস জড়িত আছে?”
“হাঁ, কৃপণের মন্ত্র সম্বন্ধে এখন আমার কাছে এই কয়েকটী জিনিষমাত্রই আছে,”—বলিয়া প্রীতিপ্রফুল্লনেত্রে গোবিন্দরাম সেইগুলি নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখিতে লাগিলেন।
“এ ব্যাপারটা কি জানিলে উপকৃত হইব। তা ছাড়া সেটা কাজেও লাগাইতে পারিব।”
গোবিন্দরাম ব্যগ্রভাবে সম্মুখদিকে উভয় হস্ত প্রসারিত করিয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘রক্ষা কর—আর কাজে লাগাইয়া কাজ নাই, যাহা তুমি কিছু কাজে লাগাইয়াছ, তাহাতেই তুমি আমাকে এমনই বিশ্ববিখ্যাত করিয়া তুলিয়াছ যে, আর কিছু কাজে লাগাইলে আমার কাজকর্ম্ম একেবারে বন্ধ হইবে—এমন কি আহার নিদ্রা পর্য্যন্ত। মানুষ খুন করিবার এ একটা তোমার অভিনব কৌশল বটে। পুলিশের লোকের হুড়াহুড়ি ত আগেকার চেয়ে এখন দশগুণ বাড়িয়াছে, তাহার উপর বাহিরের লোকের ও আমদানী প্রচুর—ঈশ্বর ত আমার জন্য আর চব্বিশ ঘণ্টার বেশী সময় করেন নাই। যাক্—কি উদ্দেশ্যে কিরূপে আমি ডিটেটিভের ব্যবসা গ্রহণ করিলাম, তাহা সমস্তই তুমি জান; সুতরাং সে সব বিষয়ের পুনরুল্লেখে প্রয়োজন নাই। এখন তোমাকে এই ব্যাপারটার বিষয় বলি, যৌবনের প্রারম্ভে শান্তশীল বলিয়া পল্লিগ্রামের একটী যুবকের সহিত আমার বন্ধুত্ব হয়। বর্দ্ধমান জেলার গাংপুর গ্রামে তাঁহার বাস। পূর্ব্বে তাঁহারা খুব বড়লোক ছিলেন, কিন্তু এখন একখানি বৃহৎ অর্দ্ধভগ্ন অট্টালিকা ব্যতীত আর তাঁহাদের বিশেষ কিছু নাই, তবে তাঁহারা একেবারে দরিদ্রও নহেন। এখনও তাঁহাদের সম্বন্ধে এরূপ কিম্বদন্তী আছে যে, তাঁহাদের কোন পূর্ব্বপুরুষ এমনই কৃপণ-চূড়ামণি ছিলেন যে, তিনি প্রাণ ধরিয়া সরকারকে খাজনা দিতেন না; তাহাতেই তাঁহার সমস্ত জমিদারী বিক্রয় হইয়াছে, অনেক জমিদারী তিনি নিজেই বিক্রয় করিয়া ফেলেন, তিনি এক পয়সা খরচ করিতেন না, সুতরাং তাঁহার এই সকল ধন কোথায় গেল, তাহা কেহ বলিতে পারে না।
“অনেকদিন শান্তশীলের সঙ্গে আমার দেখা নেই, সহসা তিনি একদিন আমার বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আমি তাঁহাকে দেখিয়া বিশেষ আহ্লাদিত হইলাম; তাঁহাকে যত্ন করিয়া বসাইয়া বলিলাম, ‘সব ভাল ত?”
‘শান্তশীল আমাকে বলিলেন, ‘হয়তো তুমি আমার পিতৃবিয়োগের কথা শোন নাই। আজ প্রায় দুই বৎসর হইতে চলিল, তিনি মারা গিয়াছেন। সেই পর্য্যন্ত আমাকে গাংপুরে আসিয়া বিষয়-সম্পত্তি সব দেখিতে হইতেছে; শুনিলাম, তুমি নাকি আজকাল একজন মস্তবড় ডিটেক্টিভ হইয়াছ?”
“হাঁ, কতকটা তাহাই বটে।”
“শুনিয়া খুসী হইলাম। তোমার পরামর্শ এখন আমার বিশেষ কাজে লাগিবে। গাংপুরে সম্প্রতি বিশেষ আশ্চর্য্যজনক দুই-একটা ঘটনা ঘটিয়াছে, পুলিস তাহার কিছুই করিতে পারে নাই। প্রকৃতই বিশেষ আশ্চর্য্যজনক ব্যাপার।
“তখন আমার হাতে কোনই কাজ ছিল না। বিশেষতঃ আলস্যের সহিত বন্ধুত্বটা তখন আমার পক্ষে অসহ্য হইয়া উঠিতেছিল, এই জন্য শান্তশীলের কথা শুনিয়া আমার বড় আনন্দ হইল। পুলিশে কিছু করিতে পারে নাই, এ বিষয়ে আমি সফল হইলে খুব একটা বাহাদুরী প্রকাশ করিতে পারিব। আমি হৃদয়ের আনন্দ অবশ্য প্রকাশ করিলাম না। গম্ভীরমুখে বলিলাম, ‘সব বল, তাহা হইলে বুঝিতে পারি।’
‘শান্তশীল আমার নিকটে সরিয়া বসিয়া বলিলেন, ‘প্রথমে গাংপুরে আমার বাড়ীর বিষয় বলি। যদিও পূর্ব্বের ন্যায় আমাদের জমিদারী আর নাই, তবুও পূর্ব্বের ন্যায় আমাদের মান-সম্ভ্রম বজায় রাখিয়া চলিতে হয়; বাড়ীতে অনেক লোকজন দাস-দাসী আছে, ইহাদের মধ্যে একজনের বিষয় বিশেষ করিয়া বলা আবশ্যক।
“ইহার নাম নন্দলাল। বাবা ইহাকে চাকরী দেন, এই লোক বাড়ীর সরকারের কাজ করিয়া থাকে, এ এরূপ বিচক্ষণ বুদ্ধিমান্ কাজের লোক যে এখন এ না থাকিলে আমাদের এক মুহূর্ত্তও চলে না। নন্দলাল প্রায় পনের বৎসর আমাদের বাড়ীতে আছে, দেখিতেও সুপুরুষ, এখন বয়স চল্লিশের উর্দ্ধ নহে।
“যদিও নন্দলালের অনেক গুণ, তবুও একটা অতি গুরুতর দোষ আছে, স্ত্রীলোকের প্রতি নন্দলালের সৰ্ব্বদাই দৃষ্টি, যতদিন তাহার স্ত্রী জীবিতা ছিল, ততদিন বড় কোন গোলযোগ হয় নাই, তাহার স্ত্রীর মৃত্যুর পর হইতে তাহাকে আর আমার দাসীদের লইয়া বড়ই গোলযোগ হইতেছে। প্রথমে রঙ্গিয়া বলিয়া একজন হিন্দুস্থানী দাসীর সহিত তাহার প্রণয় হয়। কিন্তু নন্দলাল তাহার কয়েক দিন পরেই রঙ্গিয়াকে পরিত্যাগ করিয়া শ্যামা বলিয়া আর একটী দাসীর স্কন্ধে চাপিয়াছে, এ দিকে রঙ্গিয়া সেই পর্য্যন্ত পাগলের মত হইয়াছে।
“এই ত গেল প্রথম ঘটনা—তাহার পর নন্দলাল যে কাণ্ড করে, তাহাতে তাহাকে একেবারে দূর করিয়া দিতে আমি বাধ্য হইলাম। পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি যে, লোকটা ভারি কাজের লোক—ভারি বুদ্ধিমান; কিন্তু যে সকল বিষয়ে তাহার কোন সম্বন্ধ নাই, সে সৰ্ব্বদাই সেই সকলে হাত না দিয়া থাকিতে পারিত না। অসাক্ষাতে এটা দেখিবে, সেটা দেখিবে, এটা ওটা দেখিবার জন্যই সে যেন মহা ব্যস্ত। মনে হয়, এ সংসারে এমন কোন জিনিষ নাই, যাহাতে তাহার আদৌ কৌতূহল নাই।
“যাহা হউক, সম্প্রতি একদিন রাত্রে আমার ঘুম না হওয়ায় আমি মনে করিলাম, যে উপন্যাসখানি পড়িতেছিলাম, যতক্ষণ ঘুম না হয়, ততক্ষণ সেখানি পড়ি। সেজন্য একটা আলো লইয়া আমার বসিবার ঘরের দিকে চলিলাম; সেইখানেই আমার সমস্ত পুস্তক থাকিত। দূর হইতে দেখিলাম, আমার ঘরের দ্বারের ফাঁক দিয়া আলো বাহির হইতেছে। আমি উঠিয়া আসিবার সময় নিজে আলো নিবাইয়া দিয়া আসিয়াছিলাম; তবে আবার আলো জ্বালিল কে? আমি বিস্মিত হইয়া পা টিপিয়া টিপিয়া অগ্রসর হইলাম; দ্বারে উঁকি মারিয়া আমি যাহা দেখিলাম, তাহাতে একেবারে মহাবিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া গেলাম—দেখি আমারই চেয়ারে বসিয়া আমারই টেবিলে ম্যাপের মত কি একখানা কাগজ খুলিয়া নন্দলাল বিশেষ মনোযোগের সহিত দেখিতেছে।
“এ ব্যাপারে আমার মুখ হইতে কথা বাহির হইল না, আমি দ্বারের পার্শ্বে নিস্তব্ধভাবে দাঁড়াইয়া তাহার দিকে এক দৃষ্ঠে চাহিয়া রহিলাম। কিয়ৎক্ষণ পরে সে উঠিল, যে দেরাজে আমাদের কুল-কারিকাদি বংশ সম্বন্ধীয় কাগজপত্র থাকিত, তাহা একটা চাবি দিয়া খুলিল। খুলিয়া তাহার ভিতর হইতে একখানা কাগজ বাহির করিয়া আনিয়া টেবিলে রাখিয়া ব্যগ্রভাবে সেই ম্যাপের সহিত মিলাইতে লাগিল।
“তখন আর আমি ক্রোধ সম্বরণ করিতে পারিলাম না; দরজা ঠেলিয়া গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলাম। সে আমাকে দেখিয়া চকিতে একলম্ফে সরিয়া দাঁড়াইল। ভয়ে তাহার মুখ পাংশুবৰ্ণ হইল, তাড়াতাড়ি ম্যাপের মত সেই নক্সাখানা বস্ত্রমধ্যে লুকাইল। আমি হুঙ্কার দিয়া উঠিলাম, ‘নন্দলাল, এইরূপে তুমি বিশ্বাসঘাতকতা কর? কাল সকালেই এ বাড়ী হইতে দূর হও।’
“সে কোন কথা না কহিয়া নতমুখে তথা হইতে ধীরে ধীরে চলিয়া গেল, সে দেরাজ হইতে কি কাগজ বাহির করিয়াছে, আমি তাহাই দেখিতে অগ্রসর হইলাম। যাহা দেখিলাম, তাহাতে বিস্মিত হইলাম; দেখিলাম, বিশেষ আবশ্যক কাগজ কিছুই নয়, ইহাতে আমাদের বংশগত একটা মন্ত্র লেখা আছে মাত্র, ইহা কৃপণের মন্ত্র বলিয়া আমরা জানি। আমাদের পূর্ব্বপুরুষের মধ্যে একজন নাকি বড় কৃপণ ছিলেন, তিনিই নাকি এই মন্ত্রের সৃষ্টি করিয়া যান। যখন আমাদের বংশের কেহ সাবালক হয়েন, তখন তাঁহাকে এই মন্ত্র উচ্চারণ করিতে হয়। কত শত বৎসর হইতে এইরূপ হইয়া আসিতেছে, তাহা কেহ জানে না; আর এই মন্ত্রের যে কোন একটা বিশেষ অর্থ আছে, তাহা বলিয়া বোধ হয় না; বংশগত নিয়ম বলিয়া সকলেই উচ্চারণ করে এইমাত্র।’
“আমি বলিলাম, ‘কাগজের কথা পরে আলোচনা করা যাইবে, এখন কি হইয়াছে তাহাই বল।”
“আমি দেরাজে কাগজখানি রাখিয়া চাবি বন্ধ করিলাম, আমি শয়ন করিতে যাইতেছিলাম, এমন সময়ে আমি বিস্মিত হইয়া দেখিলাম, নন্দলাল ফিরিয়া আসিয়াছে!’
“সে রুদ্ধপ্রায় জড়িতকণ্ঠে বলিল, “বাবু, প্রায় বিশ বৎসর এই সংসারে কাজ করিতেছি, সকলের সম্মুখে অপমান করিয়া আমায় তাড়াইবেন না, ইহা আমি সহ্য করিতে পারিব না, আমি আত্মহত্যা করিব। যদি আপনি কিছুতেই আমায় না রাখেন, তবে দয়া করিয়া আমায় আর এক মাস সময় দিন, তখন কেহ এ-সকল কিছুই জানিতে পারিবে না, সকলে বুঝিবে আমি স্ব-ইচ্ছায় চলিয়া যাইতেছি।’
“ক্রোধে আমার সর্ব্বাঙ্গ কাঁপিতেছিল, আমি বলিলাম, ‘তুমি বিন্দুমাত্র দয়ার উপযুক্ত নও, যা-ই হউক, তুমি আমাদের সংসারে অনেক দিন আছ, আমি সকলের সম্মুখে তোমায় অপমান করিয়া তাড়াইব না। এক সপ্তাহ সময় দিলাম, এই এক সপ্তাহের মধ্যে তোমার ইচ্ছামত যে কোন অজুহাতে আপনা-আপনি তুমি আমার বাড়ী হইতে বিদায় লইবে।’
“কাতরভাবে নন্দলাল বলিল, ‘মোটে এক সপ্তাহ—পনের দিন সময় দিন।
“আমি গর্জিয়া উঠিলাম, ‘আর এক দিনও নয়, ইহাই তোমার উপর বিশেষ দয়া প্রকাশ করা হইল।’
“সে তখন হতাশ হইয়া নতমুখে প্রস্থান করিল, আমিও সেই ঘরের আলোটা নিবাইয়া দিয়া নিজের শয়নগৃহে আসিয়া শয়ন করিলাম।
“এই ঘটনার পর দুই দিন নন্দলাল বিশেষ মনোযোগের সহিত তাহার কাজকর্ম্ম করিল, আমি রাত্রের ঘটনা একেবারে আর উত্থাপন করিলাম না। কি ছল করিয়া সে এ বাড়ী ত্যাগ করিবে, আমি তাহাই ভাবিতে লাগিলাম।
“প্রত্যহ সে দিনের মধ্যে কি কি কাজ করিতে হইবে, আমার নিকট তাহা জানিতে আসিত, কিন্তু তৃতীয় দিনে না আসায় আমি বিস্মিত হইলাম। এই সময়ে রঙ্গিয়া সেইখানে আমাকে দুধ দিতে আসিল। আমি প্রত্যহ প্রাতে গরম দুধ খাইয়া থাকি। আমি পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, সে পীড়িত হইয়াছিল, সম্প্রতি সে কঠিন পীড়া হইতে কিছু সুস্থ হইয়াছে। কিন্তু আজ তাহাকে আরও দুর্ব্বল ও পাংশুবর্ণ দেখিলাম; এ অবস্থায় সে কাজ করিতে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত, সেজন্য আমি তাহাকে বলিলাম, ‘রঙ্গিয়া, দেখিতেছি তোমার এখনও অসুখ রহিয়াছে, যাও শুয়ে থাক গে, ভাল না হইলে তোমার কাজ করিবার আবশ্যক নাই।”
“রঙ্গিয়া এমনই ভাবে আমার দিকে চাহিল যে, আমি তাহার সেই ব্যাকুল দৃষ্টি দেখিয়া মনে করিলাম, কোন কারণে তাহার মস্তিষ্ক বিকৃত হইয়াছে। সে ধীরে ধীরে বলিল, ‘বড়বাবু, আমার তো আর কোন অসুখ নাই।”
“আচ্ছা, আগে ডাক্তার কি বলেন শুনি, এখন তুমি শুইয়া থাক গে—যাও, নন্দলালকে আমার কাছে এখনই একবার পাঠাইয়া দাও।’
“নন্দলাল বাবু চলিয়া গিয়াছেন।’
“চলিয়া গিয়াছে! কোথায়?
“তা জানি না; তিনি তাঁহার ঘরে নাই, সকাল হইতে কেহ তাঁহাকে দেখে নাই!’ সে এই বলিতে বলিতে প্রাচীরে গিয়া পড়িল, হিহি করিয়া হাসিয়া উঠিল, হাসির উপর হাসি—কিছুতেই তাহা থামে না। আমি চোখ রাঙাইয়া ধমক দিলাম, তথাপি সে উন্মত্ততার ন্যায় উচ্চহাস্যে অস্থির হইতে লাগিল। হঠাৎ তাহার উপর হিষ্টিরিয়ার আক্রমণ হইতে দেখিয়া আমি বিস্মিত ও ভীত হইয়া চীৎকার করিয়া লোক ডাকিলাম, সকলে ধরাধরি করিয়া তাহাকে অন্দরে লইয়া গেল।
“তখন আমি নন্দলালের অনুসন্ধান করিলাম। সে যে নিরুদ্দেশ হইয়াছে, তাহাতে আর কোন সন্দেহ নাই। তাহার ঘরে গিয়া দেখিলাম, সে রাত্রে বিছানায় শোয় নাই। গতরাত্রে সে তাহার ঘরে গিয়াছিল—এই পর্য্যন্ত, তাহার পর কেহ আর তাহাকে দেখে নাই। অথচ সে- কিরূপে বাড়ী হইতে বাহির হইয়া গেল, আশ্চর্য্য! প্রাতে উঠিয়া সকলেই দেখিয়াছিল যে, দরজা জানালা সমস্ত বন্ধ রহিয়াছে, অথচ সে নাই। তাহার কাপড়, তাহার বাসন, তাহার টাকা, তাহার জিনিস-পত্র সমস্তই তাহার ঘরে পড়িয়া রহিয়াছে, সে কিছুই লইয়া যায় নাই। তাহার জুতা পর্য্যন্ত রহিয়াছে, কেবল চটি জুতো জোড়াটা নাই, এ অবস্থায় সে কিরূপে কোথায় গেল, আর তাহার হইয়াছেই বা কি?
“বলা বাহুল্য আমরা সমস্ত বাড়ী তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিলাম, যদিও বাড়ীটী পুরাতন ও বড়, তবুও আমরা প্রতি ঘর বিশেষ করিয়া অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু কোথাও তাহাকে খুঁজিয়া পাইলাম না। তাহার সমস্ত টাকা-কড়ি জিনিষ পত্র ফেলিয়া রাখিয়া সে কোথায় হঠাৎ নিরুদ্দেশ হইল? আশ্চর্য্য!
“আমি পুলিশে সংবাদ দিলাম। রাত্রে বৃষ্টি হইয়াছিল। পায়ের দাগ থাকিবার কথা, তাহাও কোন স্থানে দেখিলাম না। আমরা বাড়ীর বাহিরে চারিদিকে তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু কোথাও তাহার কোন সন্ধান পাইলাম না।
“ইহার পর আবার যাহা ঘটিল, তাহাতে এই প্রথম রহস্য একরূপ চাপা পড়িয়া গেল। রঙ্গিয়া তিন দিন প্রায় অজ্ঞান হইয়া রহিল, আমি ডাক্তার ডাকিয়া তাহার চিকিৎসা করাইলাম। নন্দলালের নিরুদ্দেশের তৃতীয় দিন রাত্রে রঙ্গিয়াও নিরুদ্দেশ হইল। প্রাতে এই কথা শুনিয়া আমি তখনই তাহার অনুসন্ধান করিলাম। সে নীচের যে ঘরে শয়ন করিত, সেই ঘরের জানালা খোলা রহিয়াছে, জানালার বাহিরেই তাহার পায়ের দাগ, আমরা সেই পায়ের দাগ ধরিয়া ধরিয়া চলিলাম; দাগ খিড়কীর পুষ্করণীর ঘাটে পর্য্যন্ত আসিয়া আর নাই।
“ইহাতে আমার প্রাণ শিহরিয়া উঠিল, আমি বুঝিলাম উন্মত্তা রঙ্গিয়া পুষ্করিণীতে ডুবিয়া মরিয়াছে। আমি তখনই টানা জাল আনিয়া পুকুরে টানাইলাম, কিন্তু তাহার মৃতদেহের কোন চিহ্নই দেখিতে পাওয়া গেল না। তাহার দেহের পরিবর্তে জালে এক অদ্ভুত দ্রব্য উঠিল— ক্যাম্বিসের ব্যাগ! ব্যাগটা খুলিয়া দেখি, তাহাতে কতকগুলা ভাঙা মর্চ্চেধরা লোহা, আর কতকগুলা নুড়ি, সেই নুড়িগুলি এতই কালো যে, তাহা পাথরের বা কাচের, কিছুই স্থির করিবার উপায় নাই।
“পুনঃ পুনঃ জাল টানিয়াও পুষ্করিণীতে আমরা আর কিছুই পাইলাম না, তাহার পর তাহাদের অনেক অনুসন্ধান করিয়াছি, কিন্তু রঙ্গিয়া বা নন্দলাল, এই দুইজনের কাহারও সন্ধান পাই নাই। আমাদের সেখানকার পুলিশ হতাশ হইয়াছে; তখন তোমার কথা মনে পড়িল, সেইজন্য তোমার কাছে ছুটিয়া আসিয়াছি!”
গোবিন্দরাম আমাকে বলিলেন, “ডাক্তার, তুমি বুঝিতেই পারিতেছ, আমি অতি ব্যগ্রতার সহিত এই ব্যাপারটা শুনিলাম, তাহার পর এই সমস্ত ব্যাপারটা কেবল একটা মাত্র সূত্রে ঝুলিতেছে কি না, তাহাই মনে মন ভাবিতে লাগিলাম। নন্দলাল নিরুদ্দেশ—রঙ্গিয়া নিরুদ্দেশ! রঙ্গিয়া নন্দলালকে ভালবাসিত, পরে নন্দলাল তাহাকে হতাদর করায় নিশ্চয়ই নন্দলালের উপর তাহার মর্মান্তিক রাগ হইয়াছিল। তাহার পর দেখা যাইতেছে, সে একটা ব্যাগ পুষ্করিণীতে ফেলিয়া দিয়া কোথায় নিরুদ্দেশ হইয়াছে; ব্যাগে কতকগুলা নুড়ী। এই সমস্তই বিশেষরূপে আলোচনা করিয়া দেখিতে হইবে; কিন্তু ইহাদের কোনটাই মূল রহস্যের দিকে যাইতেছে না। এই সকল ঘটনাবলীর মূলসূত্র কোথায়? সেই মূলসূত্রটা একবার অবলম্বন করিতে পারিলে, এক মুহূর্তে সকল রহস্যই পরিস্কার হইয়া যায়।
“একটা কথা মনে হওয়ায় আমি শান্তশীলকে বলিলাম, ‘আমি সেই কাগজটুকু দেখিতে চাই। সেখানা এমন কি কাগজ, যাহা দেখিবার জন্য তোমার এই সরকার নিজের এতদিনের চাকরী পর্য্যন্ত নষ্ট করিতে কুণ্ঠিত হয় নাই।’
‘আমার বন্ধু বলিলেন, ‘সে এক রকম একটা হাস্যজনক ব্যাপার! বংশ পরস্পরায় চলিয়া আসিতেছে, ইহাই ইহার একমাত্র গুণ বা যাহাই বল। আমি তাহার একটা কপি তোমায় দেখাইবার জন্য আনিয়ছি, দেখিতে চাও — দেখ।’
“আমি কাগজখানি লইয়া পড়িলাম, এটা একটা প্রশ্নোত্তর বলিয়া বোধ হইল। এই দেখ সেই কাগজখানাও আমি রাখিয়াছি, ডাক্তার এই শোন;—
“কাহার ছিল?”
“সে গিয়াছে।”
“কাহার হবে?”
“যে আসিবে।”
“কি মাস?”
“প্রথম হইতে ষষ্ঠ।”
“কোথায় ছিল সূৰ্য্য?”
“তালগাছের মাথায়।”
“কোথায় ছিল ছায়া?”
“বটগাছের তলায়।”
“কত পা—কত পা?”
“উত্তরেতে দশ দশ—পূৰ্ব্বেতে পাঁচ পাঁচ—দক্ষিণেতে দুই দুই—পশ্চিমেতে এক এক–সেই রকম তো নীচে।”
“ইহার জন্য কি দিব?”
“যা আছে সব দিব।”
“কেন দিব—কেন দিব?”
“ভালর জন্য—ভালর জন্য।”
“আমার বন্ধু বলিলেন, ‘এ কাগজখানায় কোন তারিখের উল্লেখ নাই, তবে লেখা ও বানান দেখিয়া বোধ হয়, অন্ততঃ পাঁচ শত বৎসরের আগের লেখা। শুনিয়াছি, অনেক পুরুষ এই মন্ত্র উচ্চারণ করিয়া আসিতেছেন। ইহাতে গোবিন্দরাম তোমার যে বিশেষ সাহায্য হইবে, এমন বোধ হয় না।’
“আমি বলিলাম, ‘যাহাই হউক, ইহাও যে আর একটা রহস্য তাহাতে সন্দেহ নাই। বোধ হয় তোমার সরকার ও দাসীর নিরুদ্দেশ-রহস্য অপেক্ষাও এটী আরও রহস্যময়। হয় ত একটার রহস্য ভেদ করিতে পারিলে, অপরটীর রহস্যও ভেদ হইবে। তুমি কিছু মনে করিও না, আমি দেখিতেছি, তোমার পূর্ব্ব পুরুষদিগের অপেক্ষা তোমার এই সরকারের প্রবল বুদ্ধি ছিল।’
“আমি ঠিক তোমার কথা বুঝিতে পারিতেছি না, আমি ত এই মন্ত্রের কোন মানে দেখিতে পাইতেছি না।’
“আমি কিন্তু ইহাতে যথেষ্ট গুরুতর ব্যাপার দেখিতেছি, তোমার সরকারও ঠিক তাহাই ভাবিয়াছিল। খুব সম্ভব, তুমি যে রাত্রে তাহাকে এই কাগজ দেখিতে দেখিয়াছিলে, তাহার পূর্ব্বেও সে এই কাগজ দেখিয়াছিল।’
“খুব সম্ভব—ইহা লুকাইবার জন্য আমরা কেহই কখনও আবশ্যক মনে করি নাই।”
“শেষ দিন সে কেবল তাহার নক্সার সঙ্গে ইহা মিলাইতেছিল, এইমাত্র।”
“হাঁ, তাহাই সে দেখিতেছিল বটে, কিন্তু কি উদ্দেশ্যে, আর এই পাগলের অর্থশূন্য মন্ত্রের মানেই বা কি?”
“আমার বোধ হয়, ইহা বুঝিতে আমাদের বিশেষ ক্লেশ পাইতে হইবে না। চল, এখনই আমি তোমার সঙ্গে গাংপুরে যাইতে প্রস্তুত আছি, সেখানে গেলে ইহার ভিতরে আরও প্রবেশ করিতে সক্ষম হইব।”
‘পরদিন আমি গাংপুরে বন্ধুর আলয়ে আসিয়া উপস্থিত হইলাম; দেখিলাম, বন্ধুর বাড়ীটাই বোধ হয় দুই তিন বিঘা জমি লইয়া, তাহার পর বাগান পুষ্করিণী প্রভৃতি আছে। এত বড় বাড়ী ঠিক মেরামত করিয়া রাখা অনেক টাকার কাজ, সুতরাং অধিকাংশ অংশই ভগ্ন ও অর্দ্ধভগ্ন হইয়া পড়িয়া গিয়াছে—কেবল এক অংশ বাসের উপযুক্ত আছে; তাহাতেই বন্ধু শান্তশীল বসতি করেন।
“আমি একবার বাড়ীর চারিদিক্টা ভাল করিয়া দেখিয়া লইলাম। আগে আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিয়াছিল যে, বন্ধুর বাড়ীতে তিনটী স্বতন্ত্র রহস্য, অর্থাৎ (১) সরকারের নিরুদ্দেশ, (২) দাসীর অন্তর্দ্ধান (৩) আর এই কৃপণের মন্ত্র। এখন বুঝিতেছি, তিনটী রহস্য নহে, একটাই রহস্য। যদি আমি এই কৃপণের মন্ত্রের অর্থ স্থির করিতে পারি, তাহা হইলে অতি সহজেই দাসী ও সরকারের নিরুদ্দেশ-রহস্যও ভেদ করিতে পারিব। এই জন্য এই মন্ত্রের অর্থ করিবার জন্যই আমার সমস্ত মনটা একদিকে নিযুক্ত করিলাম।
কেন এই সরকার এই মন্ত্র বুঝিবার জন্য এত ব্যস্ত হইয়াছিল? যাহা আমার বন্ধুর পূর্ব্বপুরুষদিগের মধ্যে কেহই স্থির করিতে পারেন নাই, বা গুরুতর বলিয়া ভাবেন নাই, তাহাই এই সরকার নিশ্চয়ই নিতান্ত গুরুতর বলিয়া মনে করিয়াছিল; আরও নিশ্চয় বুঝিয়াছিল, ইহাতে লাভের প্রত্যাশা আছে! কিন্তু এই লাভটা কি— আর লাভ হস্তগত করিতে গিয়া তাহারই বা কি হইয়াছে?
“ইহাতে নক্সার ব্যাপার থাকায় আমি স্পষ্ট বুঝিলাম যে, এই মন্ত্রে এই বাড়ীর কোন একটা বিশেষ স্থান নির্দ্দেশ করিতেছে। যদি আমরা কোনরূপে সেই স্থান খুঁজিয়া বাহির করিতে পারি, তাহা হইলে তখন বুঝিতে পারিব, কি জন্য বন্ধুর পূর্ব্বপুরুষ এই অদ্ভুত উপায়ে তাহা গোপনে রাখিয়া গিয়াছেন।
“দুইটী বিষয় ধরিয়া আমরা এ অনুসন্ধান আরম্ভ করিতে পারি—তালগাছ আর বটগাছ। তালগাছ সম্বন্ধে কথা নাই—বাড়ীর সম্মুখেই এক অতি প্রাচীন তালগাছ এখনও আকাশে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া আছে। এত পুরাতন তালগাছ আমি আর কখনও দেখি নাই; যদিও দেখিলাম, ইহাতে এক্ষণে আর তাল ফলে না, তথাচ ইহা অতি পুষ্টভাবে জীবিত আছে।
“আমি আমার বন্ধুকে জিজ্ঞাসিলাম, ‘এই মন্ত্র যখন লেখা হয়, তখন এই তালগাছ এখানে ছিল?’
“তিনি হাসিয়া বলিলেন, “যে রকম আকার প্রকার তাহাতে মান্ধাতার স্বহস্ত-প্রোথিত বলিয়াই মনে হয়।’
“কোন পুরান বটগাছ কাছে আছে?”
“হাঁ—ঐ দিকে একটা ছিল। প্রায় দশ বৎসর হইল সেটা ঝড়ে পড়িয়া গিয়াছে।’
“ঠিক কোথায় ছিল জান?”
“হাঁ; তা ঠিক জানি।”
“আর কোন বটগাছ নাই?”
“পুরানো নাই—চারাগাছ আছে।”
“কোথায় পুরানো গাছটা ছিল, একবার দেখিতে চাহি।”
“বন্ধু আমাকে সেই স্থানে লইয়া গেলেন। দেখিলাম, তাহা তালগাছ ও অট্টালিকার প্রায় মাঝামাঝি স্থান। আমি বলিলাম, ‘গাছটা কত উঁচু ছিল, বোধ হয় তাহা এখন আর জানিবার উপায় নাই।’
“কেন, আমি বলিতে পারি—ঠিক চল্লিশ হাত উঁচু ছিল।”
আমি বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কিসে জানিলে?”
“গুরু মহাশয় যখন কালি করাইতেন, তখন এই গাছটা কত উঁচু তাহার কালি করিতে আমায় প্রায়ই বলিতেন, সেজন্য আমার বেশ মনে আছে।”
“আমি মনে মনে বিশেষ সন্তুষ্ট হইলাম,—কাজের অনেক সুবিধা হইয়া আসিতেছে। আমি বলিলাম ‘তোমার সরকার কখন তোমায় এ কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিল?’
“বন্ধু বিস্মিতভাবে আমার মুখের দিকে চাহিলেন; বলিলেন, ‘তুমি এ কথা জিজ্ঞাসা করিলে বলিয়া এখন মনে পড়িল। হাঁ, একদিন কি কথায়—হাঁ—মনে পড়িয়াছে, বৃদ্ধ খেদুবেহারার সঙ্গে তাহার তর্ক হওয়ায় নন্দলাল এই গাছ কত উঁচু ছিল,আমায় জিজ্ঞাসা করিয়াছিল।’
“বলা বাহুল্য, এ কথা শুনিয়া বেশ বুঝিলাম যে, আমি এ ব্যাপারে আসল সূত্র ধরিতে পারিয়াছি, আর সেই সূত্র ধরিয়া ঠিক পথেই যাইতেছি।
“আমি আকাশের দিকে চাহিলাম, দেখিলাম প্রায় এক ঘণ্টার মধ্যে সূর্য ঠিক তালগাছের মাথার উপরে আসিবে। তাহা হইলে মন্ত্রের একটা কথা ঠিক হইবে। তাহার পর বটগাছের ছায়া—নিশ্চয়ই এই সময়ে বটগাছের ছায়া শেষ যেখানে গিয়া পড়িবে, মন্ত্রের তাহাই অর্থ। এখন দেখিতে হইবে, তালগাছের মাথায় সূর্য্য গেলে, বটগাছের ছায়া পশ্চাদ্দিকে কোথায় গিয়া পড়ে।”
আমি বলিলাম, “সবই বুঝিলাম, কিন্তু বটগাছ যে নাই, এখন কিরূপে তাহার ছায়া পাইবে?”
গোবিন্দরাম বলিলেন, “শক্ত স্বীকার করি, তবে একটা সরকার যাহা পারে, আমি তাহা পারিব না, ইহা কখনই হইতে পারে না। বিশেষতঃ ইহাতে কঠিন কিছুই নহে। আমি চারি হাত লম্বা একখানা বাঁশ ও কতকটা দড়ি লইয়া যেখানে বটগাছটা ছিল, ঠিক সেইখানে এই বংশখণ্ড পুতিলাম। যখন তালগাছের উপরে সূর্য্য আসিল, তখন ইহার ছায়া কোন্ দিকে পড়িল, তাহা বিশেষ করিয়া দেখিলাম। তাহার পর এই ছায়া মাপিয়া দেখিলাম, ইহা ঠিক ছয় হাত লম্বা হইয়াছে।
“এখন দেখ, বাঁশটা ৬ ফিট, তাহার ছায়া হইল ৯ ফিট। যদি ৬ ফিট লম্বা বাঁশের ৯ ফিট লম্বা ছায়া হয়, তাহা হইলে ৬০ ফিট লম্বা গাছের ছায়া অবশ্যই ৯০ ফিট। ছায়া যে দিকে পড়িয়াছিল, দড়ি দিয়া মাগিয়া দেখিলাম, ছায়া প্রায় বাড়ীর প্রাচীর পর্য্যন্ত আসিল, আমি সেইখানে একটা খোঁটা পুতিলাম। ডাক্তার, তুমি আমার সে সময়ের আনন্দ বুঝিতে পারিবে না—যখন আমি আমার খোঁটার কাছে মাটি কতকটা নীচু দেখিতে পাইলাম, তখন স্পষ্ট বুঝিলাম, সরকারও ঠিক আমার মত এখানে খোঁটা পুতিয়াছিল; তাহা হইলে আমি ঠিক তাহার সঙ্গে সঙ্গে যাইতেছি।
“এখন এখান হইতে পা পা মাপ। আমি সেই স্থানের উপর দক্ষিণ পূর্ব্ব পশ্চিম স্থির করিয়া লইলাম। দশ পা উত্তরে—আমায় দেওয়ালের ধারে ধারে ইহা চলিল দশ পা আসিয়া আমি আবার এক খোঁটা পুতিলাম। তাহার পর আমি পাঁচ পা পূর্ব্বে এবং দুই পা দক্ষিণে মাপিলাম; ইহাতে আমি দেখিলাম, আমি একটা অতি পুরাতন দ্বারের চৌকাঠে উপস্থিত হইয়াছি। এখন এক পা পশ্চিমে অর্থাৎ দরজার ঠিক পরে গৃহমধ্যে; এখন বুঝিলাম মন্ত্রে এই ঘরের কথাই বলিতেছে। কিন্তু এ কি? এখানে কিছুই নাই! ডাক্তার জীবনে এরূপ হতাশার কষ্ট আর কখনও অনুভব করি নাই; তবে কি আমার সমগ্র পরিশ্রমই পণ্ড হইল? এই স্থানে বড় বড় পাথর দিয়া মেজে প্রস্তুত, কেহ যে কখনও এই পাথর সরাইয়াছে, তাহার কোন চিহ্ন নাই; নিশ্চয়ই সরকার নন্দলাল এখানে কিছু করে নাই, তাহা হইলে তাহার চিহ্ন থাকিত।
“আমি পাথরগুলি প্রত্যেক স্থানে ঠুকিয়া দেখিলাম। না—ভিতরে যে ফাঁক আছে, তাহা বলিয়া বোধ হইল না। আমি আরও হতাশ হইলাম। আমার বন্ধুও এক্ষণে কতকটা ব্যাপার বুঝিয়া ব্যগ্রভাবে আমার অনুসরণ করিতে ছিলেন; তিনি বলিয়া উঠিলেন, “সেই রকম তো নীচে’—তুমি নীচের কথা ভুলিয়াছ।’
‘আমার মনে হইয়াছিল, যে আমাদের এইখানটা খুঁড়িতে হইবে, কিন্তু আমি আমার ভুল বুঝিতে পারিয়াছি; তাহা হইলে ইহার নীচে একটা ঘর আছে।’
“শান্তশীল বলিল, ‘হাঁ, অনেক দিন হইতে আছে, বাড়ী হওয়া পর্য্যন্তই আছে। আমরা কেহ ইহার ভিতর কখনও যাই না; দেখিতে চাওতো এস—এই দরজা দিয়া এস। আমি এখনই একটা লণ্ঠন আনিতেছি।’
“ক্ষণপরে বন্ধু লণ্ঠন লইয়া আসিলে আমরা উভয়ে ভগ্নস্তূপের মধ্যে প্রবেশ করিলাম; তাহার পর একটা ভাঙ্গা ঘরে আসিলাম, এই ভাঙ্গা ঘর হইতে সিঁড়ী দিয়া নামিয়া একটা অন্ধকার পূর্ণ ঘরে আসিলাম।
“এই ঘরে জ্বালানী কাঠ বোঝাই থাকিত; আমরা বুঝিলাম যে, আমরা প্রথম এখানে আসি নাই—আমাদের পূর্ব্বেও এঘরে কেহ আসিয়াছিল। কতকগুলা কাঠ কে এক পার্শ্বে সরাইয়া মধ্যে কতকটা স্থান পরিষ্কার করিয়াছে, এই পরিষ্কার স্থানে আমরা একখানি অতীর প্রকাণ্ড পাথর দেখিলাম; এই পাথরের মধ্যস্থলে একটা মর্চ্চেপড়া কড়া সংলগ্ন রহিয়াছে; তাহাতেই বুঝিলাম, সেই কড়া ধরিয়া সেই প্রকাণ্ড প্রস্তব-ফলকটাকে টানিয়া তুলিতে পারা যায়।
“আমরা দুইজনে শরীরের সমস্ত বলপ্রয়োগ করিয়া সেই কড়াটা ধরিয়া অনেক টানাটানি করিলাম; কিন্তু কিছুতেই তুলিতে পারিলাম না। তখন আমার বন্ধু তাঁহার দুই-তিন জন লোক ডাকিলেন। এই সময়ে গৃহতল হইতে বন্ধু শান্তশীল একটা গলাবন্ধ কুড়াইয়া বলিলেন, ‘এ যে নন্দলালের গলাবন্ধ, এখানে আসিল কিরূপে? সে এখানে কি করিতেছিল?”
“সকলে মিলিয়া ধরাধরি করিয়া অবশেষে পাথরখানি একপার্শ্বে সরান হইল। পাথরের নিম্নে একটা অন্ধকারপূর্ণ গহ্বর দেখা গেল। এবং গহ্বরের ভিতর হইতে একটা দুর্গন্ধ নির্গত হইতে লাগিল; কিন্তু তখন সে দিকে লক্ষ্য করিবার অবসর আমাদের আদৌ ছিল না। বন্ধু তাড়াতাড়ি সেই গহ্বরের মুখে লণ্ঠনটা প্রবেশ করাইয়া দিলেন; আমরা দেখিলাম, তাহার ভিতর একটী ঘর,বোধ হয়, উপর হইতে সেই গৃহতল পাঁচ হাত নিম্নে—একজন ইচ্ছা করিলে ইহার ভিতর লাফাইয়া পড়িতে পারে। আমরা আরও দেখিলাম যে, গৃহতলে একটা লোহার সিঁড়ি পড়িয়া আছে, যে লাফাইয়া নামিবে ফিরিবার সময় এই সিঁড়ি লাগাইয়া উঠিয়া আসিতে তাহাকে আর কোনই কষ্ট পাইতে হইবে না। গৃহমধ্যে তিনটা বড় বড় লোহার সিন্দুক রহিয়াছে, ইহার একটার তালা খোলা, সিন্দুকের আংটায় চাবিটা কলুপে লাগান রহিয়াছে, তাহার পার্শ্বে আরও দুইটা চাবি ঝুলিতেছে।
“কিন্তু এ সকল বিশেষ করিয়া দেখিতে আমাদের সময় হইল না। আমাদের দৃষ্টি অন্য এক বিষয়ে আকৃষ্ট হইল—দেখিলাম, এক ব্যক্তি একটা সিন্দুকের পার্শ্বে জানুভরে বসিয়া আছে, এবং তাহার মাথা বুকের উপরে ঝুলিয়া পড়িয়াছে, হাত দুইটা সিন্দুকের উপর দুই দিকে বিস্তৃত হইয়া রহিয়াছে।
আমরা বুঝিতে পারিলাম, এ একটা মৃতদেহ, এবং দেহটা বিশেষরূপে পচিয়া উঠিয়াছে; সেই দুর্গন্ধই আমরা পূৰ্ব্বে পাইয়াছিলাম। যাহা হউক, আমরা শীঘ্রই কোনরূপে এই দেহ সেই ভয়াবহ গৃহ হইতে বাহিরে আনিলাম। মৃতদেহটা পচিয়া এতই বিকৃত হইয়াছে যে, মৃতের মুখ দেখিয়া চিনিবার উপায় নাই—এ কে; তবে ইহার কাপড়-চোপড় দেখিয়া সকলেই চিনিল, সরকার নন্দলাল ব্যতীত এ ব্যক্তি আর কেহ নহে। সে কয়েকদিন হইল মরিয়াছে, তাহার দেহে কোনরূপ আঘাতের চিহ্ন নাই।
“যখন তাহার দেহ আমরা বাহিরে আনিয়া পুলিশে সংবাদ দিলাম। সদলবলে স্থানীয় দারোগাবাবুর আবির্ভাব হইল, তখনও এ রহস্যের সম্পূর্ণরূপে উদ্ভেদ হইল না। ডাক্তার, আমি যে আমার কার্য্যে বিশেষ সন্তুষ্ট হইলাম, তাহা নহে। এখনও বুঝিতে পারি নাই, কিরূপে এই সরকার এই গৃহে প্রবেশ করিল, আর রঙ্গিয়াই বা এ নাটকের কোন্ অংশ কিরূপ অভিনয় করিয়াছে; তবে কৃপণের মন্ত্রের রহস্য পরিষ্কার হইল। সিন্দুক তিনটী খুলিয়া দেখা গেল, ব্যাগে যেরূপ কৃষ্ণবর্ণের লোষ্ট্ৰাদি পূর্ণ ছিল, এই তিনটি সিন্দুকও সেইরূপ কৃষ্ণবর্ণের লোষ্ট্ররাশিতে পরিপূর্ণ।
“যাহারা ইহা দেখিল, সকলেই হাসিতে লাগিল। দারোগাবাবু হাসিয়া শান্তশীলকে বলিলেন, ‘দেখিতেছি, আপনাদের বংশে একটী মহা পাগল কোন সময়ে জন্মিয়াছিলেন, নতুবা এত নুড়ী পাটকেল কেহ এ ভাবে এখানে রাখে না।’
“সকলেই তাঁহার কথায় অনুমোদন করিয়া হাসিতে লাগিল। আমি আমার বন্ধু শান্তশীলকে বলিলাম, ‘পূর্ব্ব-পুরুষের কথা—পাগলই হউন, আর যাহাই হউন, যখন এগুলো কাহারই কোন কাজে লাগিবে না, তখন যেখানকার জিনিষ যেমন আছে, তেমনই থাক—কি জানি কি তুক্-তাক্ আছে।’
“সকলেই আমার কথায় মত দিলেন। আবার আমরা সিন্দুক বন্ধ করিয়া ঘরের সেই দ্বারে পূর্ব্ববৎ পাথর চাপা দিলাম।
“ডাক্তার, তুমি তো আমার অনুসন্ধানের প্রথা জান। যখন সহজে ভাবিয়া কিছুই ঠিক করিতে না পারি, তখন অনন্যোপায় ভাবে আমি ঠিক অপরের স্থানে আমাকে ফেলিয়া দিই—সে সময়ে সে যাহা করিত, মনে মনে আমি তাহাই করিতে চেষ্টা পাই। এই ব্যাপারে সে রাত্রে এই সরকার কি করিয়াছিল, তাহাই আমি মনে মনে আলোচনা করিতে লাগিলাম।
“এই সরকার যে খুব বুদ্ধিমান্ ছিল, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। এই বাড়ীর কোন স্থানে খুব মূল্যবান্ কিছু লুক্কায়িত আছে, তাহা সে বেশ বুঝিতে পারিয়াছিল। তাহার পর সে মন্ত্ৰ ধরিয়া এই গুপ্তগৃহ আবিষ্কারও করিয়াছিল। কিন্তু দেখিল একজনে কখনও এই পাথর সরানো সম্ভব নহে, সে এ বিষয়ে কাহাকে বিশ্বাস করিতে পারে না অথচ একজন বলবান্ লোক প্রয়োজন। রঙ্গিয়া হিন্দুস্থানী, দেহে বল আছে এবং সে তাহাকে ভালবাসে; এরূপস্থলে নন্দলাল মধ্যে তাহার সহিত বিবাদ হওয়া সত্বেও রঙ্গিয়াকে আবার হাত করিয়া এই কার্য্যোদ্বারের জন্য তাহাকে এই গুপ্ত গৃহের উপরে পাথরের নিকটে লইয়া যায়; কিন্তু তাহা হইলেও এই পাথর দুইজনে সরানো সহজ নহে,—সুতরাং কোন উপায় আবশ্যক, বুদ্ধিমান্ সরকারের উপায় বাহির করিতে অধিকক্ষণ সময় লাগিল না—সে কি উপায়ে পাথর তুলিয়াছিল, তাহার প্রমাণ আমি তৎক্ষণাৎ পাইলাম।
“আমরা যখন চারি পাঁচজনে কষ্টে এই পাথর তুলিয়াছিলাম, তখন নিশ্চয়ই দুই জনে- তাহার মধ্যে আবার একজন স্ত্রীলোক, এরূপস্থলে কখন কোনরূপ কৌশলাবলম্বন ব্যতীত এই পাথর তুলিতে পারে নাই। আমি যাহা ভাবিয়াছিলাম, শীঘ্রই তাহার প্রমাণ পাইলাম। দেখিলাম, দুইখানা কাঠ স্পষ্টতঃ এই পাথরে লাগানো হইয়াছিল। একদিক্ এই পাথরের গুরুভারে কাঠখানা একেবারে চেপ্টা হইয়া গিয়াছে।
“এখন বুঝিলাম, তাহারা কি করিয়াছিল; সরকার ও রঙ্গিয়া উভয়ে পাথরখানা টানিয়া একটু উচু করিয়া পা দিয়া দুইদিক হইতে দুইখানা কাঠ সেই ফাঁকের মধ্যে প্রবেশ করাইয়া দিয়াছিল; এইরূপে একটু একটু করিয়া ধীরে ধীরে পাথরের নীচে কাঠ লাগাইয়া তাহারা একটা মানুষ গলিতে পারে পাথর সেইরূপ উঁচু করিয়া ক্ষুদ্র পথ করিয়া লইয়াছিল।
“সেই গভীর রাত্রে নিৰ্জ্জনে কি নাটক এইখানে অভিনীত হইয়াছিল, আমি মনে মনে তাহাই গড়িতে লাগিলাম। স্পষ্টতই বুঝিলাম, তাহারা পাথর সরাইয়া যে সংকীর্ণ পথ করিয়াছিল, তাহার ভিতর দিয়া কেবল একজনই গৃহমধ্যে নামিয়াছিল। সে আর কে? এই হতভাগ্য সরকার নন্দলাল। রঙ্গিয়া উপরে অপেক্ষা করিতেছিল। নন্দলাল সিন্দুক হইতে নুড়ি ব্যাগে বোঝাই করিয়া ব্যাগ রঙ্গিয়ার হাতে দিয়াছিল, আবার নুড়ি সিন্দুক হইতে সংগ্রহ করিতেছিল, এই সময়ে কি ঘটিল, বলিতে পার ডাক্তার?
“সহসা ভীষণ প্রতিহিংসায় রঙ্গিয়ার হৃদয় পরিপূর্ণ হইয়া গেল! নন্দলাল রঙ্গিয়াকে অবহেলা করিয়াছিল, তাহার ভালবাসা উপেক্ষা করিয়াছিল, তাহার উপরে তাহার মর্মান্তিক আক্রোশ ছিল; সহসা সেই আক্রোশবশে অথবা সেই প্রতিহিংসাবৃত্তি তাহার হৃদয়ে বলবতী হওয়ার নন্দলালের বাসনা ফলবতী হইল না;—রঙ্গিয়া পাথর গহ্বরের মুখে ফেলিয়া দিয়াছিল। অথবা এমনও হইতে পারে, হঠাৎ পাথরখানা কোনরূপে আপনা হইতেই পড়িয়া গিয়া থাকিবে; তাহা ঠিক করিয়া বলা যায় না; তবে এটা স্থির, পাথর পড়িয়া দ্বাররুদ্ধ হইয়া গেলে রঙ্গিয়া ব্যাগ লইয়া উন্মাদিনীর ন্যায় সে স্থান হইতে পলাইয়া গিয়াছিল—হয় ত রঙ্গিয়া তাহার বিশ্বাসঘাতক প্রণয়ীর অর্দ্ধস্ফুট আর্তনাদ শুনিতে পাইয়াছিল, হয় ত নন্দলাল কাতরে পাথরে ঘা মারিতেছে, তাহাও সে শুনিতে পাইয়াছিল।
“এই জন্যই পরদিন রঙ্গিয়ার মুখের ভাব দেখিয়া আমার বন্ধু তাহাকে পীড়িত মনে করিয়াছিলেন; এই জন্যই রঙ্গিয়া উন্মত্তার ন্যায় সহসা বিকট উচ্চহাস্য করিয়া উঠিয়াছিল। এই ভয়াবহ কাৰ্য্যেই সে নিজের মাথা ঠিক রাখিতে পারে নাই। তাহার পর সে একটু ভাল হইবামাত্র সেই ব্যাগটা পুষ্করিণীতে ফেলিয়া দিয়া অন্তর্হিত হইয়াছিল। এখন সকল রহস্যই পরিষ্কার হইয়া গেল।
“সকলে চলিয়া গেলে শান্তশীলকে লইয়া আমি তাহার বাহিরের ঘরে আসিয়া বসিলাম। শান্তশীল বিষণ্ণভাবে বলিলেন, ‘পুরাতন ভৃত্যের এরূপ ভয়াবহ মৃত্যুতে আমি দুঃখিত হইয়াছি। সিন্দুকে কি আছে জানিলে বেচারা এত কষ্ট করিয়া কখনও এ গুপ্তগৃহ আবিষ্কার করিতে চেষ্টা করিত না, আর সেই চেষ্টার ফলে ভয়াবহ মৃত্যুমুখে ও পতিত হইত না।’
“আমি তাঁহার কথায় কোন উত্তর না করিয়া মৃদুহাস্যে তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলাম। বন্ধু কহিলেন, ‘হাসিতেছ কেন? প্রকৃতই ইহার মৃত্যতে আমি দুঃখিত হইয়াছি।’
“আমি বলিলাম, ‘ইহার মৃত্যুতে আমিও দুঃখিত। বন্ধু! সেজন্য আমি হাসিতেছি না।’
“তবে কিসের জন্য হাসিতেছ?”
“তুমি কি মনে কর যে, তোমার পূর্ব্বপুরুষের মধ্যে যিনি এই মন্ত্র তোমাদের ভাবী বংশ-পরম্পরায় প্রচলিত রাখিবার ব্যবস্থা করিয়া গিয়াছিলেন, তিনি উন্মত্ত ছিলেন?”
‘কাজেই—না হইলে কে রাশীকৃত পাটকেল নুড়ী কুড়াইয়া এরূপভাবে সিন্দুক পূর্ণ করিয়া রাখিয়া যায়; তাহার পর এই দশ পুরুষ ধরিয়া সকলকে গাধা বানাইয়া এই অর্থশূন্য মন্ত্র আওড়াইয়াছে!
“এগুলি ঠিক নুড়ী অথবা পাটকেল নয়!”
“তবে কি? স্পষ্ট দেখা যাইতেছে নুড়ী—তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।’
“আমি ব্যাগটী তুলিয়া লইলাম, একটী নুড়ী লইয়া কাপড় দিয়া খুব জোরে ঘষিতে লাগিলাম,তাহার পর তাহা বন্ধুর হাতে দিলাম, তিনি লম্ফ দিয়া উঠিয়া বলিলেন, ‘এ যে হীরা।’
“আমি হাসিয়া বলিলাম, হাঁ—হীরা, আবার এটা দেখ।’
“যাহা তিনি পূর্ব্বে লৌহখণ্ড ভাবিয়াছিলেন; তাহার একটা কাপড়ে ঘষিয়া তাহার হাতে দিলাম। তিনি বলিয়া উঠিলেন, ‘এ যে মোহর—’
“হাঁ—আসরফি—স্বর্ণখণ্ড! এই জন্যই পুলিসের সম্মুখে কিছু বলি নাই—আজ হইতে পৃথিবীর মধ্যে তুমি একজন মহাধনী লোক।”
“এত—এ সব হীরা—সব মোহর!”
“হাঁ—তাহাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। কত কালে যে এ সকল তোমাদের বংশে সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা কে বলিতে পারে? হয় ত ইহা কোন রাজার ধন, শত্রুহস্ত হইতে রক্ষা করিবার জন্য তোমার কোন পূর্ব্ব-পুরুষের নিকটে গচ্ছিত রাখিয়া দিয়াছিলেন—সেই পৰ্য্যন্ত ইহা এইখানেই রহিয়া গিয়াছে।”
“মন্ত্রের মানে কি!’
কোথায় ধন লুক্কায়িত থাকিল, তাহাই সঙ্কেতে বলিয়া দেওয়া হইয়াছে। দশপুরুষের মধ্যে তোমাদের কেহ এই মন্ত্রের অর্থ বুঝিতে পারে নাই—একবার ইহার গূঢ় অর্থের প্রতি দৃষ্টিও আকৃষ্ট হয় নাই; দেখিতেছি, তোমার এই সরকার তোমাদের সকলের অপেক্ষা বুদ্ধিমান্ ছিল—সেই প্রথম বুঝিয়াছিল যে, এই মন্ত্রের এক গূঢ় অর্থ আছে, কেবল সে-ই বুঝিয়াছিল যে, ইহাতে কোন লুক্কায়িত গুপ্তধনের কথাই বলিতেছে! তাহাই সে এই গুপ্তধনের লুক্কায়িত স্থান বাহির করিবার জন্য ব্যগ্র হয়; কৃতকাৰ্য্যও হইয়াছিল; কিন্তু ভগবান্ তাহার প্রতি বিরূপ, তিনি এরূপ অপহরণের প্রশ্রয় দেন না, তাহাই এই পরের ধন চুরি করিতে গিয়া বেচারা প্রাণ দিয়াছে।”
“আমার বন্ধু রুদ্ধকণ্ঠে বলিলেন, ‘তাহা হইলে—তাহা হইলে—আমি—আমি কেমন— কেমন করিয়া জানিব যে, এই সকল ধনরত্ন আমি লইতে পারি?”
“আমি বলিলাম, ‘মন্ত্রই তাহার প্রমাণ! মন্ত্র কি বলিতেছে—।’
“কাহার ছিল?’
“অর্থাৎ—এ ধন কাহার ছিল।
“যে গিয়াছে।’
“অর্থাৎ—যাহার মৃত্যু হইয়াছে।
“কে পাবে?”
‘যে পরে আসিবে। অর্থাৎ—তাহার পরে যে আসিবে — পুত্র, পৌত্র, প্রপৌত্র যে কোন উত্তরাধিকারী—তুমি এ ধন আবিষ্কার করিয়াছ—এ ধন এখন তোমারই।’
“ডাক্তার এই হইল কৃপণের মন্ত্রের রহস্য—এই রহস্যোদ্ভেদের সঙ্গে সঙ্গে আমি একজনকে অতুল ধনের অধিকারী করিতে সক্ষম হইয়াছিলাম।”
***