কৃপণের দণ্ড (অর্থাৎ অর্থের নিমিত্ত কৃপণের যে কিরূপ পরিণাম হয় তাহার অদ্ভুত দৃষ্টান্ত!)

কৃপণের দণ্ড (অর্থাৎ অর্থের নিমিত্ত কৃপণের যে কিরূপ পরিণাম হয়, তাহার অদ্ভুত দৃষ্টান্ত!) 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

এই ঘটনাটি পুরাতন, প্রায় দশ বার বৎসরের কথা। 

রাত্রি তিনটা বাজিতে না বাজিতে একটি খুনের সংবাদ আসিয়া উপস্থিত হইল। 

প্রথম সংবাদে, কোন্ ব্যক্তি খুন করিয়াছে, কাহাকে খুন করিয়াছে বা কোন্ স্থানেই বা খুন হইয়াছে, তাহার কিছুমাত্রই জানিতে পারিলাম না। কেবলমাত্র যে থানার এলাকায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়াছিল, তাহাই জানিতে পারিলাম মাত্ৰ। 

সংবাদ পাইবামাত্রই সেই থানায় গমন করিলাম, এবং থানা হইতে একটি লোক সঙ্গে লইয়া, যে বাড়ীতে খুন হইয়াছিল, সেই বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। 

ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইয়াই দেখিলাম, যে বাড়ীতে এই ভয়ানক হতাকাণ্ড ঘটিয়াছিল, সেই বাড়ী আমার নিতান্ত অপরিচিত নহে, বা যে ব্যক্তি হত হইয়াছে, তাহার সহিত আমার বিশেষরূপ পরিচয় না থাকিলেও, তাহার অবস্থা সম্বন্ধে আমি একেবারে অনভিজ্ঞ ছিলাম না। 

কিরূপ অবস্থায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়াছিল, তাহার আনুপূর্ব্বিক অবস্থা বর্ণনা করিবার পূর্ব্বে হত ব্যক্তির অবস্থা পাঠকগণকে বলিয়া দেওয়া আবশ্যক বিবেচনা করিয়া কিঞ্চিৎ বলিতেছি। 

কালাচাঁদবাবু সহরের মধ্যে একজন বিখ্যাত লোক ছিলেন। তিনিই আজ হত হইয়াছেন। তাঁহারই হত্যা মোকদ্দমার অনুসন্ধানের নিমিত্ত আজ আমাকে আসিতে হইয়াছে। 

কালচাঁদবাবু সহরের মধ্যে কিরূপভাবে বিখ্যাত ছিলেন, তাহার কিছু পাঠকবর্গ অবগত আছেন কি? যদি না থাকেন, তাহা হইলে তাহারই একটু পরিচয় এই স্থানে প্রদান করিতেছি। 

কালাচাঁদবাবু তাঁহার জীবনে ভ্রমক্রমেও কখন কোনরূপ সৎকার্য করেন নাই। 

বিশেষরূপ বিপদগ্রস্ত হইয়াও কখন যে কাহাকেও একটি পয়সা তিনি দান করিয়াছেন, তাহা আমরা কখনও শ্রবণ করি নাই। শুনিয়াছি, তিনি অনেক পয়সার অধিকারী; কিন্তু অনশনে বিশেষরূপ কষ্টভোগ করিয়া, মুষ্টি ভিক্ষার নিমিত্ত কখনও কোন ব্যক্তি তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলে, তিনি যে কখনও তাহাকে একট মুষ্টি অন্ন প্রদান করিয়াছেন, এ কথা আমরা কখনও শ্রবণ করি নাই, মোটামুটি দান ত পরের কথা। 

দুর্ভিক্ষে দেশ উৎসন্ন যাউক, জলকষ্টে দেশের ভিতর হাহাকার উপস্থিত হউক, অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় দরিদ্রগণ সমূলে নির্মূল হউক; কিন্তু কালাচাঁদের অর্থে কিছুতেই হস্তক্ষেপ করিবার উপায় নাই। 

মাতা-পিতৃ শ্রাদ্ধ উপলক্ষে কোন দরিদ্র, তাঁহার দরজায় বসিয়া থাকুক, কন্যাভার-গ্রস্ত পিতা গললগ্ন বাসে সমস্ত দিবস তাঁহার সম্মুখে দণ্ডায়মান থাকুক, মাতা-পিতৃহীন দীন ব্রাহ্মণ বালক যজ্ঞোপবীত গ্রহণ উপলক্ষে মাসাবধি তাঁহার আরাধনা করুক, কিছুতেই তাঁহার মন বিচলিত হইত না। কাহারও সম্মুখে কখন তিনি তাঁহার হস্ত প্রসারণ করিতে সমর্থ হইতেন না। যে কোন ব্যক্তি যে কোন উপলক্ষে তাঁহার নিকট আগমন করিত, তাহাকেই নিতান্ত দুঃখিত অন্তঃকরণে রিক্তহস্তে প্রত্যাগমন করিতে হইত। 

গবর্ণমেন্টও সময় সময় তাঁহাকে নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিয়াছেন, রাজ-কর্ম্মচারীগণের মধ্যে কেহ কেহ সময়ে সময়ে তাঁহাকে কত প্রলোভন দেখাইয়াছেন, গবর্ণমেণ্ট প্রদত্ত উপাধিতে তাঁহাকে ভূষিত করিবেন, এ কথাও মধ্যে মধ্যে কেহ কেহ তাঁহাকে ভূষিত করিবেন, এ কথাও মধ্যে মধ্যে কেহ কেহ তাঁহাকে বলিয়া, তাঁহার নিকট হইতে কিছু অর্থ বাহির করিবার বিশেষরূপ চেষ্টাও করিয়াছেন; কিন্তু এ পর্যন্ত কেহই কোনরূপেই কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই। এইরূপ নানা কারণে সহরের মধ্যে কালাচাঁদবাবুর নাম না জানিত, এইরূপ কোন লোকই ছিল না। সুতরাং তাঁহার নাম একরূপ বিখ্যাত হইয়া পড়িয়াছিল। 

কালাচাঁদবাবু যে বাড়ীতে বাস করিতেন, তাহা তাঁহার স্বোপার্জ্জিত বাড়ী নহে। তাঁহার পৈতৃক সম্পত্তি। বাড়ীটি খুব বড়, এমন কি অন্দরের ভিতর পর্যন্ত বাগান ও পুষ্করিণী ছিল। কিন্তু এখন তাহার অবস্থা নিতান্ত শোচনীয়! পুষ্করিণীর জল পচা পানায় ভরিয়া রহিয়াছে, বাগান জঙ্গলে পরিণত হইয়া, শৃগালের আবাস-স্থল হইয়াছে! 

কালাচাঁদের পিতা তাঁহার মৃত্যুর পূর্ব্বে এই বাড়ী শেষ মেরামত করিয়া গিয়াছিলেন। তাহার পর সেই বাড়ীর ভিতর কখনও রাজমজুর প্রবেশ করে নাই। কালাচাঁদের বয়ঃক্রম প্রায় সত্তর বৎসরের কম নহে; বিংশতি বৎসরের সময় তাঁহার পিতৃ-বিয়োগ হয়। সুতরাং পঞ্চাশ বৎসরকাল এই বাড়ীর অধিকারী কালাচাঁদ হইয়াছিলেন, ও এ কাল পর্য্যন্ত তিনি সেই বাড়ীতেই বাস করিয়া আসিতেছেন। কিন্তু পুরাতন বাড়ীতে যে মধ্যে মধ্যে মেরামত করিতে হয়, তাহা কালাচাঁদ শিক্ষা করেন নাই। বাড়ীর অনেক স্থান ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, জানালা দরজা পচিয়া পড়িয়া গিয়াছে, কিন্তু তাহার একটিও মেরামত করা হয় নাই। কিন্তু যে জানালা বা দরজা মেরামত করিবার নিতান্ত আবশ্যক বিবেচনা করিয়াছেন, সেই স্থানে ঝাঁপ বাঁধিয়া দিয়া ব্যয়ের অনেক সাহায্য করিয়াছেন। 

কালাচাঁদের এই অবস্থা শুনিয়া, পাঠকগণ! হয়ত মনে করিতে পারেন, কালাচাঁদের বাস্তবিকই কিছু নাই। যাহার হস্তে সামান্য পয়সা আছে, সেও যে বাড়ীতে বাস করে, তাহার অবস্থা কখনও এরূপ করিয়া রাখিতে পারে না। 

পাঠকগণ যাহাই মনে করুন আমরা কিন্তু তাহা বলিব না। কারণ, অনেক দিবস হইতে দেখিতেছি যে, বড়বাজারে তাঁহার একখানি বেশ বড় দোকান আছে। পার্শ্ববর্তী অপরাপর দোকানদারের নিকট হইতে সর্ব্বদাই শুনিতে পাওয়া যায়, কালাচাঁদ সুন্দররূপে তাঁহার দোকান চালাইয়া আসিতেছেন। কখনও যে তাহার এক পয়সা লোকসান হইয়াছে, তাহা এ পর্য্যন্ত কেহই শুনিতে পায় নাই। অধিকন্তু যেরূপভাবে তিনি ব্যবসাকার্য্য করিয়া থাকেন, তাহাতে অভাবপক্ষে বার মাসে যেমন তেমন করিয়া, তিনি বার হাজার টাকা উপার্জ্জন করেন। এই ব্যবসাকার্য্য তিনি তাঁহার পিতার মৃত্যুর পর হইতেই করিয়া আসিতেছেন। এরূপ অবস্থায় কিরূপে অনুমান করা যাইতে পারে যে, তাঁহার নিতান্ত অর্থাভাব। 

এতদ্ব্যতীত তাঁহার সংসারের খরচও যে নিতান্ত অধিক হয়, এমনও নহে। তাঁহার পরিবারের মধ্যে বাড়ীতে একটি বালিকা ভিন্ন আর কেহই নাই। একমাত্র স্ত্রী লইয়া তিনি একাল পর্য্যন্ত সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিয়া আসিয়াছিলেন; কিন্তু প্রায় দ্বাদশ বৎসর অতীত হইল, তাঁহার সেই স্ত্রীও ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যান। মৃত্যুকালে তাঁহার স্ত্রী কেবলমাত্র একটি কন্যা রাখিয়া গিয়াছিলেন। কন্যাটি তাহার শ্বশুর বাড়ীতেই থাকিত। স্ত্রীর মৃত্যুর কিয়ৎদিবস পর কন্যাটিও বিধবা হন। কিন্তু বৈধব্য-যন্ত্রণা তাহাকেও অনেক দিবস সহ্য করিতে হয় নাই। বিধবা হইবার অল্প দিবস পরেই কেবলমাত্র একটি কন্যা রাখিয়া তিনিও ইহলোক পরিত্যাগ করেন। সেই কন্যাটিকে লালন-পালন করিবার অপর কোন ব্যক্তি না থাকায়, বৃদ্ধ কালাচাঁদ তাহাকে আপনার বাড়ীতে লইয়া আসেন, এবং তাহাকে প্রতিপালন করিয়া, তাঁহার বিবাহ পর্যন্তও দিয়াছেন। সেই কন্যাটির বয়ঃক্রম এখন একাদশ বৎসরের অধিক হইবে না। 

কালাচাঁদের সংসারে পুত্র-কন্যাদির মধ্যে এই দৌহিত্রী ব্যতীত আর তাঁহার কেহই নাই। বাড়ীতে চাকর চাকরাণীও কেহ থাকে না। দোকানে যে সকল লোকজন আছে, তাহাদিগের মধ্যে একটি ব্রাহ্মণ দুইবেলা কালাচাঁদের বাড়ীতে আসিয়া উভয়ের নিমিত্ত কিছু আহারীয় প্রস্তুত করিয়া দিয়া যায়, ও দোকানের অপর আর একজন চাকর সংসারের নিতান্ত আবশ্যকীয় কার্য্যগুলি নির্ব্বাহ করিয়া দিয়া যায়। সুতরাং এই ব্যক্তিও দুইবেলা কালাচাঁদের বাড়ীতে আহার করে। এক কথায় কালাচাঁদ, তাঁহার দৌহিত্রী ও সেই দুইটি দোকানের কর্ম্মচারী ব্যতীত তাঁহার সংসারের সহিত অপর কাহারও আর কোনরূপ সংস্রব নাই। এরূপ অবস্থায় পাঠকগণ সহজেই মনে করিতে পারেন যে, কালাচাঁদের নগদ অর্থ বা বিষয় সম্পত্তি কিছুই নাই। 

বৎসরের মধ্যে প্রায়ই দুই চারিবার কালাচাঁদের গৃহে চোর প্রবেশ করিয়া থাকে; কিন্তু সামান্য দুই একখানি পিত্তল কাঁসার দ্রব্যাদি ব্যতীত চোরেরা কখন কিছুই লইয়া যাইতে পারে নাই। কারণ, বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিয়া কোন চোরে এ পর্য্যন্ত কোনরূপ অর্থাদি কখন প্রাপ্ত হয় নাই। তিনি যে অর্থাদি কোথায় রাখিয়াছেন, তাহা এ পর্যন্ত কেহই অবগত নহে। 

এই ত কালাচাঁদের অবস্থা। এইরূপ অবস্থায় কালাচাঁদ দিন যাপন করিয়া আসিতেছেন। রাত্রিকালে বাড়ীতে চাকর প্রভৃতি কেহই অবিস্থিতি করে না। অন্দরমহলের মধ্যে সমস্ত গৃহই অব্যবহার্য্য অবস্থায় পড়িয়া আছে, কেবলমাত্র দুইটি গৃহ ব্যবহৃত হইয়া থাকে। তাহার একটিতে শয়ন করেন, কালাচাঁদবাবু; অপরটি তাঁহার দৌহিত্রী মাধবীর দ্বারা অধিকৃত। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

কালাচাঁদের বাড়ীতে উপস্থিত হইয়া শুনিতে পাইলাম যে, বৃদ্ধ কালাচাঁদই আজ স্বয়ং হত হইয়াছেন। তাঁহার মৃত দেহ এখন পর্যন্ত তাঁহার শয়ন গৃহে পড়িয়া আছে। 

এই অবস্থা জানিতে পারিয়া, আমিও কালাচাঁদের বাটীর ভিতর প্রবেশ করিলাম, এবং যে গৃহে তিনি শয়ন করিতেন, ক্রমে সেই গৃহে গিয়া উপস্থিত হইলাম। 

আমি সেই স্থানে উপনীত হইবার পূর্ব্বে আরও অনেক পুলিশ-কৰ্ম্মচারী সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন সুতরাং আমিও তাঁহাদিগের সহিত মিলিত হইয়া, এই হত্যার অনুসন্ধানে লিপ্ত হইলাম। 

দেখিলাম,—বৃদ্ধ কালাচাঁদের মৃতদেহ তাঁহার শয়ন গৃহের মেজের উপর পড়িয়া রহিয়াছে। তাঁহার হস্ত দুইখানি পশ্চাদ্দিকে কঠিনরূপে বাঁধা, গলায় কালশিরার দাগ পড়িয়াছে, জিহ্বা বহির্গত হইয়াছে! দেখিলে সহজেই অনুমান হয়, যে, কোন ব্যক্তি কালাচাঁদের হস্তদ্বয় বাঁধিয়া জোর করিয়া তাহার গলা টিপিয়া ধরিয়া তাহাকে হত্যা করিয়াছে। 

কিরূপে এবং কাহা কর্তৃক কালাচাঁদ হত হইয়াছে, তাহা বলিবার লোক একমাত্র মাধবী ব্যতীত সেই বাড়ীর ভিতর আর কেহই নাই। মাধবী বিবাহিতা হইলেও, তাহার স্বামী প্রায়ই সেই স্থানে থাকেন না। তিনি তাঁহার নিজের বাড়ীতেই বাস করিয়া থাকেন। কোন কোন রাত্রি কালাচাঁদের বাড়ীতে যাপন করিলেও ঘটনার রাত্রিতে তিনি সেই স্থানে ছিলেন না। সুতরাং একা মাধবী ব্যতিরেকে আর কাহাকেও কিছু জিজ্ঞাসা করা যাইতে পারে, এরূপ লোক সেই বাড়ীতে আর কেহই নাই। 

যে স্থানে কালাচাদের লাস পড়িয়াছিল, মাধবীকেও সেই স্থানে দেখিতে পাইলাম। দেখিলাম; একজন কর্ম্মচারী তাহাকে জিজ্ঞাসাবাদ করিতেছেন, ও অপরাপর সকলেই মনোযোগের সহিত তাহার কথাগুলি শ্রবণ করিতেছেন। কারণ মাধবীর নিকট যিনি যাহা জানিয়া লইতে পারিবেন, তাহা ব্যতীত অপর আর কাহারও নিকট আর কিছুই জানিয়া লইবার উপায় নাই। সুতরাং মাধবীর কথাগুলি আমিও অতীব মনোযোগের সহিত শুনিতে লাগিলাম। 

মাধবীকে যিনি জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, তিনি এক জন উপযুক্ত ও বহু পুরাতন কৰ্ম্মচারী; সুতরাং অপর কেহই তাঁহার কার্য্যের প্রতিবন্ধকতা না করিয়া, তাঁহার ও মাধবীর সহিত যে সকল কথা হইতে লাগিল, সকলেই একান্ত মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিতে লাগিলেন। 

কর্ম্মচারী। তোমার নাম কি? 

মাধবী। আমার নাম মাধবী 

কৰ্ম্মচারী। যিনি মরিয়া গিয়াছেন, তাঁহার নাম কি? 

মাধবী। ইহার নাম কালাচাঁদ। 

কর্ম্মচারী। ইনি তোমার কে হইতেন? 

মাধবী। দাদা মহাশয় হইতেন। 

কৰ্ম্মচারী। কিরূপ দাদা মহাশয়? 

মাধবী। আমার মায়ের বাপ! 

কর্ম্মচারী। তোমার বিবাহ হইয়াছে? 

মাধবী। হইয়াছে। 

কর্ম্মচারী। কাহার সহিত তোমার বিবাহ হইয়াছে? 

মাধবী—নিরুত্তর। 

কর্ম্মচারী। তোমার স্বামীর নাম কি? 

এবারেও কোন উত্তর নাই। 

কর্ম্মচারী। তোমার স্বামী এই স্থানে থাকেন কি? 

মাধবী। না, তিনি এখানে থাকেন না। 

কর্ম্মচারী। তিনি কোথায় থাকেন? 

মাধবী। তাঁহার নিজের বাড়ীতেই। 

কর্ম্মচারী। এখন তিনি কোথায়? 

মাধবী। এই খানেই আছেন, সংবাদ পাইয়া তিনিও এখানে আসিয়াছেন। 

কর্ম্মচারী। রাত্রিকালে তিনি এখানে ছিলেন না? 

মাধবী। না। 

কর্ম্মচারী। এ বাড়ীতে আর কে থাকে? 

মাধবী। আর কেহ থাকে না। 

কর্ম্মচারী। চাকর চাকরাণী? 

মাধবী। কেহই রাত্রিতে থাকে না। 

কর্ম্মচারী। সাংসারিক কর্ম্মকার্য্য কে করে? 

মাধবী। দোকানের একটি চাকর সকল কৰ্ম্ম করিয়া দিয়া চলিয়া যায়। 

কর্ম্মচারী। রন্ধনাদি কে করে? 

মাধবী। দোকান হইতে একটি ব্রাহ্মণ আসিয়া, দুইবেলা রাধিয়া দিয়া যায়। 

কৰ্ম্মচারী। সেই ব্রাহ্মণটি রাত্রিকালে থাকেন কোথায়? 

মাধবী। দোকানে থাকেন, কি তাহার বাড়ীতে থাকেন, তাহা আমি জানি না। 

কর্ম্মচারী। কালাচাঁদবাবু প্রত্যহ দোকানে যাইতেন কি? 

মাধবী। যাইতেন। তবে যদি কোন দিন অসুখ করিত, সেই দিন যাইতেন না; নতুবা প্রত্যহই যাইতেন।

কর্ম্মচারী। কোন সময়ে তিনি দোকানে যাইতেন? 

মাধবী। দশটা এগারটার মধ্যে প্রায়ই তিনি বাহির হইয়া যাইতেন। 

কর্ম্মচারী। তিনি দোকানে গেলে বাড়ীতে কে থাকিত? 

মাধবী। আমি থাকিতাম। 

কর্ম্মচারী। তুমি একাকী থাকিতে কি? 

মাধবী। প্রায়ই একাকী থাকিতাম, মধ্যে মধ্যে অপরাপর বাড়ীর দুই-একটি মেয়ে কখন কখন আসিত।

কর্ম্মচারী। তুমি নিতান্ত বালিকা, এত বড় বাড়ীতে একা থাকিতে তোমার ভয় করিত না?

মাধবী। না, কখন ভয় করে নাই। শৈশব হইতেই একা থাকিতে বেশ অভ্যাস হইয়া গিয়াছে।

কর্ম্মচারী। কোন্ সময়ে কালাচাঁদবাবু দোকান হইতে ফিরিয়া আসিতেন? 

মাধবী। সন্ধ্যার পরই প্রায় আসিতেন। 

কর্ম্মচারী। দোকান হইতে তিনি একাকী আসিতেন, না অপর আর কেহ তাঁহার সহিত আসিতেন? 

মাধবী। ব্রাহ্মণ ও চাকর তাঁহার সহিত আসিত। পরে রান্না খাওয়া হইলে, তাহারা উভয়েই চলিয়া যাইত।

কর্ম্মচারী। তাহারা কোথায় চলিয়া যাইত? 

মাধবী। তাহা আমি জানি না। 

কর্ম্মচারী। কালাচাঁদবাবুর সহিত অপর কোন ব্যক্তি দেখা সাক্ষাৎ করিতে কখনও আসিত? 

মাধবী। আসিত, জানিতে পারিতাম। কিন্তু কখনও কাহাকেও দেখি নাই। 

কর্ম্মচারী। আসিত, জানিতে পারিতে, কিন্তু কখন দেখ নাই; এ কিরূপ কথা? 

মাধবী। কোন ব্যক্তি আসিয়া তাঁহাকে ডাকিলে তিনি বাহিরে গমন করিতেন ও বাহির বাড়ীতেই তাহাদিগের সহিত কথাবার্তা বলিয়া পুনরায় তিনি বাড়ীর ভিতর আসিতেন। আমি বাহিরে যাইতাম না বলিয়া কাহাকেও দেখিতে পাইতাম না। 

কর্ম্মচারী। দোকানে গমন করিবার সময় তিনি হাঁটিয়া যাইতেন, কি গাড়িতে যাইতেন? 

মাধবী। আমাদিগের নিজের গাড়ি নাই, বাড়ী হইতে হাঁটিয়াহি গমন করিতেন। কিন্তু বাহিরে গিয়া গাড়ি ভাড়া করিতেন কি না জানি না, কখনও দেখি নাই। 

কর্ম্মচারী। দোকান হইতে আসিতেন কিরূপে? 

মাধবী। হাঁটিয়া আসিতেই দেখিতাম। 

কৰ্ম্মচারী। দোকান হইতে সন্ধ্যার সময় যখন বাড়ীতে আসিতেন, তখন টাকাকড়ি প্রভৃতি কিছু লইয়া আসিতেন কি? 

মাধবী। অধিক পরিমাণে টাকাকড়ি কখন আনিতে আমি দেখি নাই, বা আমাদিগের গৃহের কোন স্থানে যে টাকাকড়ি কিছু আছে, তাহাও আমার বোধ হয় না। একটি ছোট মনিব্যাগ কেবল তাঁহার নিকট দেখিতে পাইতাম। বাজার খরচ প্রভৃতি কোনরূপ সামান্য খরচের প্রয়োজন হইলে, সেই মনিব্যাগ হইতেই তিনি বাহির করিয়া দিতেন। সেই মনিব্যাগের ভিতর পাঁচ টাকার অধিক আমি কখনও দেখি নাই। উহাও, বিশ্বাস করিয়া কখনও তিনি কাহারও হস্তে প্রদান করিতেন না। সৰ্ব্বদাই উহা আপনার সঙ্গেই রাখিতেন। 

কর্ম্মচারী। আজ রাত্রিতে কিরূপ অবস্থা ঘটিয়াছিল, তাহার যতদূর তুমি মনে করিয়া বলিতে পার, তাহা আমাদিগকে বল দেখি? 

মাধবী। মনে করিয়া আমি সকল কথা বলিয়া উঠিতে পারিব না। আপনারা এক এক করিয়া জিজ্ঞাসা করুন। আমি যতদূর মনে করিতে পারি, তাহার উত্তর প্রদান করিতেছি। 

মাধবীর কথা শুনিয়া, আমরা অতিশয় সন্তুষ্ট হইলাম। বুঝিলাম, মাধবীর বয়ঃক্রম অল্প হইলেও, তাহার বুদ্ধি নিতান্ত অল্প নহে। আমরা তাহাকে যে সকল বিষয় জিজ্ঞাসা করিয়াছি, তাহার যথাযথ উত্তর ত পাইয়াছি। তদ্ব্যতীত এখনও যাহা যাহা জিজ্ঞাসা করিব, মাধবী তাহারও যথাযথ উত্তর প্রদান করিবে। সরল বালিকা কোন কথা যে গোপন করিবে, বা কোনরূপ মিথ্যা কথা বলিয়া আমাদিগকে প্রতারিত করিবে, তাহা আমরা কোনরূপেই বিশ্বাস করিতে পারিলাম না। সুতরাং আমাদিগের আবশ্যক বিষয় সকল এখন তাহাকে বিশদরূপে জিজ্ঞাসা করাই স্থির করিলাম। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

কৰ্ম্মচারী। কালাচাঁদবাবু কাল দোকানে গমন করিয়াছিলেন? 

মাধবী। না। 

কর্ম্মচারী। কেন গমন করেন নাই, তাহার কিছু বলিতে পার কি? 

মাধবী। কাল তাঁহার শরীর একটু অসুস্থ ছিল, তাই কাল তিনি আফিসে যান নাই, বা আহারাদিও করেন নাই।

কর্ম্মচারী। অন্য রাত্রিতে যে সময় তিনি শয়ন করিতেন, আজ তিনি ঠিক সেই সময়ে শয়ন করিয়াছিলেন, কি অধিক রাত্রি হইয়াছিল? 

মাধবী। অন্যান্য দিবস তিনি রাত্রি দশটা এগারটার কম শয়ন করিতেন না। কিন্তু আজ তিনি রাত্রি নয়টার মধ্যেই শয়ন করিয়াছিলেন। 

কৰ্ম্মচারী। কালাচাদবাবু শয়ন করিবার পর তবে তুমি শয়ন করিয়া থাক? 

মাধবী। তাঁহার শয়ন করিবার অনেক পরে আমি শয়ন করি। তিনি শয়ন করিবার পরে আমাদিগের আহারাদি হয়। তাহার পর চাকর বামুন গমন করে। তাহার পর আমি আপনার গৃহে শয়ন করি 

কর্ম্মচারী। যখন তুমি শয়ন করিবার নিমিত্ত তোমার গৃহে গমন কর, সেই সময় কালাচাঁদবাবু নিদ্রিত হইয়া পড়িয়াছিলেন, কি জাগ্রত ছিলেন? 

মাধবী। তিনি সেই সময় জাগ্রত ছিলেন না, নিদ্রিত হইয়া পড়িয়াছিলেন। 

কর্ম্মচারী। শয়ন করিবার কতক্ষণ পরে তুমি নিদ্রিত হইয়া পড়? 

মাধবী। শয়ন করিবার অতি অল্প সময় পরেই আমি নিদ্রিত হইয়া পড়ি। 

কর্ম্মচারী। তুমি শয়ন করিবার পরেও নিদ্রা যাইবার পূর্ব্বে, এই মোকদ্দমা সম্বন্ধে কোন বিষয় দেখিয়াছ কি, বা কোন কথা শ্রবণ করিয়াছ কি? 

মাধবী। আপনার এ প্রশ্নের ঠিক উদ্দেশ্য, আমি বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। শয়ন করিবার পরই আমি নিদ্রিত হইয়া পড়ি। ইহার পূর্ব্বে আমি কিছুই জানিতে পারি নাই। 

কর্ম্মচারী। তোমার নিদ্রা কখন ভঙ্গ হইয়াছিল? 

মাধবী। যখন আমার নিদ্রা ভঙ্গ হইল, তখন রাত্রি যে কত, তাহা আমি বলিতে পারি না। 

কৰ্ম্মচারী। কিরূপ অবস্থায় তোমার নিদ্রা ভঙ্গ হইল? 

মাধবী। দাদা মহাশয়ের কথায় আমার নিদ্রা ভঙ্গ হয়। 

কর্ম্মচারী। তোমার দাদা মহাশয়ের কিরূপ কথায় তোমার নিদ্রা ভঙ্গ হইল? 

মাধবী। আমি যেন বুঝিতে পারিলাম যে, দাদা মহাশয় আমাকে ডাকিতেছেন। দাদা মহাশয়ের কথা শুনিয়া হঠাৎ আমার নিদ্রা ভঙ্গ হইল। তখন শুনিতে পাইলাম, দাদা মহাশয় বলিতেছেন, “মাধবী তুমি ঘুমাইয়াছ কি?” উত্তরে আমি কহিলাম, “না দাদা মহাশয়! আমি ঘুমাই নাই।” তখন দাদা মহাশয় আমাকে ডাকিলেন, ও কহিলেন, ‘আমার মনটা কেমন করিতেছে, তুমি আমার নিকট আইস।” দাদা মহাশয়ের কথা শুনিয়া, আমি আমার শয্যা পরিত্যাগ করিয়া, তাঁহার গৃহে আসিয়া তাঁহারই বিছানার উপর উপবেশন করিলাম। সেই সময় দাদা মহাশয় আমার গাত্রে হস্তার্পণ করিয়া কহিলেন, “মাধবী! আমি বোধ হয়, আর অধিক দিন বাঁচিব না।” 

উত্তরে আমি কহিলাম, “কেন দাদা মহাশয়! আপনি আজ এরূপ কথা বলিতেছেন, কেন?” 

দাদা বলিলেন, “আজ আমার মনটা কেমন কেমন বোধ হইতেছে। বোধ হইতেছে যেন আমাকে শীঘ্রই হই—জগৎ পরিত্যাগ করিতে হইবে। আর এক কথা মাধবী! আমি স্থির করিয়াছি, বৃদ্ধ বয়সে কারবারের মধ্যে আর কোনরূপে জড়ীভূত থাকিব না। সমস্ত কারবার উঠাইয়া দিয়া, দেনাপত্র একবারে পরিষ্কার করিয়া ফেলিব। আর সহর পরিত্যাগ করিয়া সহরতলীতে গিয়া বাস করিব।” 

আমি বলিলাম, “কারবার উঠাইয়া দিবেন ভালই; কিন্তু দাদা মহাশয়! আমাদিগের পুরাতন বাসস্থান পরিত্যাগ করিবেন কেন?” 

দাদা বলিলেন, “তুমি কি জান না, আজ কয়েক বৎসর হইল, আমি একটি বাগান খরিদ করিয়াছি। সেই বাগানে এত দিবস পর্য্যন্ত একটি ভাড়াটীয়া বাস করিতেন বলিয়া, আমরা সেই বাগানে গমন করি নাই। যে ব্যক্তি উহাতে বাস করিতেন, সম্প্রতি তিনি উহা পরিত্যাগ করিয়াছেন। এখন সেই বাগান খালিই আছে। যে কয়দিবস বাঁচিব, সেই কয়দিবস সেই নিৰ্জ্জন বাগানে বাস করা ভাল নয় কি?” 

আমি কহিলাম, “ভালমন্দ আমি কি বুঝিব? আপনি যাহা ভাল বিবেচনা করিবেন, তাহাই করিবেন। সে বাগানে কেবল আপনি যাইবেন, না আমাকেও গিয়া থাকিতে হইবে?” 

দাদা মহাশয় হাসিয়া বলিলেন, “কেন? তুমি কি “তাহাকে” ছাড়িয়া সেই স্থানে গমন করিতে চাহ না কি?” (মাধবী এই স্থানে “তাহাকে” শব্দ ব্যবহার করিয়া, যে অর্থ করিল, তাহা আমরা সকলেই বেশ বুঝিতে পারিলাম। বুঝিলাম, “তাহাকে” অর্থে শরৎকে। আরও বুঝিলাম, শরৎ মাধবীর স্বামী।) 

দাদা মহাশয়ের এই ব্যঙ্গোক্তি শুনিয়া আমি আর কোন কথা কহিলাম না, চুপ করিয়া, সেই স্থানেই বসিয়া রহিলাম। 

দাদা মহাশয় বুঝিলেন, তাঁহার কথায় আমি লজ্জিত হইয়াছি। তখন তিনি পুনরায় কহিলেন, “আমার বাগান সহর হইতে বহুদুর নহে। যখন ইচ্ছা হইবে, তখনই সেই স্থানে গমন করিতে পারিবে। এবং ইচ্ছা যখন হইবে, তখনই সেই স্থান হইতে চলিয়া আসিতে পারিবে।” 

দাদা মহাশয়ের কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, “যে স্থানে আপনি ভাল বিবেচনা করেন, সেই স্থানেই আমি গমন করিব। অনেক দিবস সহরে বাস করিয়া আপনার শরীর ক্রমেই খারাপ হইয়া আসিতেছে; কিছু দিবস বাগানে বাস করিলে, আপনার শরীর, বোধ হয়, ক্রমেই সুস্থ হইয়া আসিবে।” 

আমার কথা শুনিয়া দাদা মহাশয় সবিশেষ সন্তুষ্ট হইলেন, এবং পরিশেষে কহিলেন, “আমি এত দিবস কারবার করিয়া যে কিছুই সংস্থান করিয়া রাখিতে পারি নাই, তাহ নহে। আমি যাহা কিছু রাখিয়া যাইব, তাহা তোমারই হইবে। যদি বেশ বুঝিয়া চলিতে পার, তাহা হইলে কখনই কোনরূপ কষ্ট পাইবে না। আমার ধনাদি অপহরণ করিবার মানসে, এই বাড়ীতে যে কতবার চোর প্রবেশ করিয়াছে, তাহা আমি বলিতে পারি না। কিন্তু এ পর্য্যন্ত তাহারা কিছুই অপহরণ করিতে পারে নাই, বা কখন যে পারিবে, তাহা আমার বোধ হয় না। কারণ, আমার ধনাদি যে কোথায় আছে, তাহা আমি ব্যতীত অপর আর কেহই অবগত নহে। যে পৰ্য্যন্ত আমি বলিয়া না দিব, সেই পৰ্য্যন্ত কেহই স্থির করিতে পারিবে না যে, আমার অর্থ কোথায় আছে। 

“আমার বিষয় সম্পত্তি যাহা কিছু আছে, উইল করিয়া তাহা আমি তোমাদিগকেই দান করিয়াছি। আমার মৃত্যুর পর, তোমরা সেই বিষয়ের অধিকারী হইতে পারিবে। কিন্তু যত দিবস আমি জীবিত থাকিব, তত দিবস উহার সহিত তোমাদিগের কোনরূপ সংস্রব নাই। মৃত্যুর কথা কিছুই বলা যায় না; সুতরাং হঠাৎ যদি আমার মৃত্যু হয়, তাহা হইলে আমার বিষয় সম্পত্তি বা অর্থাদি যে কোথায় আছে, তাহা তোমরা কিছুই জানিতে পারিবে না। সুতরাং আমার কর্তব্য যে, এই সময়েই সকল কথা তোমাদিগকে বলিয়া দি। 

“আমি যে উইল করিয়াছি, তাহাও আমি আমার গৃহে রাখি নাই। এইখানে তোমাকে বলিয়া রাখি, সেই উইলখানি আমার বিশ্বস্ত বন্ধু বাবু বিপিনবিহারী বসুর নিকট আমি রাখিয়া দিয়াছি। 

“আমার মৃত্যুর পর তোমরা তাঁহার নিকট গমন করিলেই, তিনি তোমাদিগের হস্তে আমার লিখিত উইল প্রদান করিবেন। সেই উইলখানি পাঠ করিয়া দেখিলেই তোমরা জানিতে পারিবে যে, তোমাদিগের নিমিত্ত আমি কিরূপ বিষয় সম্পত্তি রাখিয়া গেলাম। কিন্তু নগদ অর্থাদি আমি যে কেথায় রাখিয়া গেলাম, তাহা উইল পড়িয়াও বুঝিয়া উঠিতে পারিবে না! তুমি উইলের সহিত এক টুকরা কাগজ পাইবে, সেই কাগজখানি পড়িয়া তাহার অর্থ কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিবে না। আমি আরএকখানি কাগজ তোমাকে প্রদান করিতেছি, একান্ত যত্নের সহিত উহা তুমি রাখিয়া দিবে। উহার অর্থ বুঝিতে পারিতেছ না বলিয়া, কদাচ তুমি উহা পরিত্যাগ করিবে না। আমার মৃত্যুর পর উইলের সহিত যে কাগজের টুকরা প্রাপ্ত হইবে, সেই কাগজের সহিত আমার প্রদত্ত এই কাগজ খানি মিলাইয়া পড়িয়া দেখিও। তাহা হইলেই অনায়াসে বুঝিতে পারিবে, আমার পরিত্যক্ত অর্থ তোমাদিগের নিমিত্ত কোথায় রাখিয়া যাইতেছি।” 

এই বলিয়া দাদা মহাশয় তাঁহার ক্যাসবাক্স খুলিয়া এক টুকরা কাগজ বাহির করিলেন, ও উহা আমার হস্তে প্রদান, করিয়া কহিলেন, “ইহা সবিশেষ সাধধানের সহিত রাখিও। যেন কোনরূপে হারাইয়া ফেলিও না। কি জানি, যদি কোন গতিতে হারাইয়াই ফেল, তাহা হইলে চির দিবসের নিমিত্ত তোমাদিগকে বিশেষরূপ কষ্টভোগ করিতে হইবে। এই কাগজের একটি নকল আমার বাক্সের ভিতর রহিল। যদি নিতান্তই উহা হারাইয়া ফেল, তাহা হইলে নকল 

দেখিয়াও তোমাদিগের কার্য্য উদ্ধার হইবার সম্ভাবনা। তুমিও না হয়, ইহার আর একটা নকল করিয়া অপর কোন স্থানে রাখিয়া দিও।” 

দাদা মহাশয়ের কথা শুনিয়া, আমি কহিলাম, “এখন আপনার মৃত্যুর সময় উপস্থিত হয় মাই। ইহার মধ্যেই আপনি এত ব্যস্ত হইলেন কেন? যখন আমরা বুঝিতে পারিব, আপনার অন্তিম সময় উপস্থিত, তখন আমরাই আপনাকে জিজ্ঞাসা করিব, আমাদিগের জন্য আপনি কিছুই রাখিয়া গেলেন কি না। সেই সময় আপনি আপনার মনের কথা আমাদিগকে অনায়াসেই বলিয়া যাইতে পারিবেন।” 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

দাদা মহাশয়ের নিকট আমি বসিয়া আছি, ও তাঁহার সহিত পূর্ব্ব বর্ণিতরূপ কথাবার্তা কহিতেছি, এমন সময় যমদূতের ন্যায় হঠাৎ দুই ব্যক্তি আমাদিগের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাদিগের ভয়ঙ্কর আকৃতি দেখিয়া আমার মনে নিতান্ত ভয়ের সঞ্চার হইল। আমি কাঁপিতে কাঁপিতে একরূপ হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলাম। সেই সময় উহাদিগের মধ্যে একজন আমার দাদা মহাশয়কে সবলে ধরিয়া পালঙ্ক হইতে তাঁহাকে নীচে নামাইল, ও তাঁহাকে প্রহার করিতে করিতে কহিল, “আজ সমস্তই জানিতে পারিয়াছি। বল্ তোর অর্থ কোথায় লুকাইয়া রাখিয়াছিস্? নতুবা এখনই তোমাকে হত্যা করিব।” 

দাদা মহাশয়কে এইরূপ ভাবে প্রহার করিতে দেখিয়া আমি আর স্থির থাকিতে পারিলাম না; উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার করিয়া উঠিলাম। আমার চীৎকার শুনিয়া, উহাদিগের মধ্যে একজন বল-পূর্ব্বক আমার মুখে পদাঘাত করিল। আমি সেই সবল পদাঘাত সহ্য করিতে না পারিয়া, সেই স্থানে পড়িয়া গেলাম, ও অনন্যোপায় হইয়া চুপ করিলাম। সেই সময় আমি একরূপ হতজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিলাম। যখন আমার জ্ঞান জন্মিল, তখন দেখিলাম, দাদা মহাশয় মৃতাবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছেন। গৃহের ভিতর অপর লোকজন আর কেহই নাই। সেই সময় আমি বাড়ী হইতে দ্রুতপদে বাহিরে আসিলাম, রাস্তায় আসিয়া চীৎকার করিলাম। আমার চীৎকারে পাড়ার দুই একজন লোক আসিয়া উপস্থিত হইল, ও আমার নিকট এই ভীষণ সংবাদ শ্রবণ করিয়া, অনেকেই আমাদিগের বাড়ীর ভিতরে আসিয়া প্রবেশ করিল। প্রবেশ করিয়া উহারা সকলেই দাদা মহাশয়ের অবস্থা স্বচক্ষে দর্শন করিল। 

কৰ্ম্মচারী। যে সময় তুমি ও তোমার দাদা মহাশয় একত্র বসিয়াছিলে, সেই সময় দুই ব্যক্তি হঠাৎ আসিয়া তোমাদিগের সম্মুখে উপস্থিত হইল, এ কথা তুমি পূৰ্ব্বে বলিয়াছ। কিন্তু সেই দুই ব্যক্তি কোনদিক হইতে তোমাদিগের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল, তাহা কিছু বলিতে পার কি? 

মাধবী। না, তাহা আমি বলিতে পারিব না। উহাদিগকে হঠাৎ সম্মুখে দেখিলাম, কোন্‌দিক্ হইতে আসিল তাহা আমি লক্ষ্য করি নাই। 

কর্ম্মচারী। উহাদিগের পোষাক পরিচ্ছদ কিরূপ ছিল? 

মাধবী। মালকোঁচা মারিয়া কাপড় পরা ও মাথায় পাগড়ী, গায়ে আর কোন কাপড় ছিল না। 

কর্ম্মচারী। সেই লোক দুইজন দেখিতে কিরূপ? 

মাধবী। আমার যেরূপ ভয় হইয়াছিল, তাহাতে আমি উহাদিগের দিকে ভাল করিয়া চাহিয়া দেখিতে পারি নাই। আমি যতদূর দেখিয়াছি, তাহাতে আমার বেশ মনে হয় যে, উহারা উভয়েই খুব কাল! যমদূতের ন্যায়! 

কর্ম্মচারী। উহাদিগের হস্তে লাঠি, কি অন্য কোনরূপ অস্ত্রাদি কিছু দেখিয়াছ বলিয়া, বোধ হয়? 

মাধবী। অপর কোন দ্রব্য দেখিয়াছি বলিয়া আমার মনে হয় না। 

কৰ্ম্মচারী। সেই দুই ব্যক্তিকে হঠাৎ গৃহের ভিতর দেখিয়া, তুমি কিছু বুঝিতে পারিলে যে, উহারা একবারে বাহির হইতেই সেই সময় গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল, অথবা পূর্ব্ব হইতেই উহারা গৃহের ভিতরের কোন স্থানে লুকাইয়া ছিল, এবং হঠাৎ প্রকাশিত হইল? 

মাধবী। আমার বোধ হয়, পূর্ব্ব হইতে উহারা গৃহের ভিতর লুকাইয়া ছিল। নতুবা উহারা কেন বলিল যে, আজ আমরা তোর সকল কথা জানিতে পারিয়াছি। বল, টাকাকড়ি তুই কোথায় লুকাইয়া রাখিয়াছিস্। 

কর্ম্মচারী। উহারা যে কথা কহিয়াছিল, তাহা বাঙ্গলায় বলিয়াছিল, কি হিন্দুস্থানীতে বলিয়াছিল? 

মাধবী। উহাদিগের কতক বাঙ্গলা কথা, কতক খোট্টাই কথা। 

কর্ম্মচারী। উহাদিগের যেরূপ কথা শুনিয়াছ, তাহাতে তুমি কোনরূপ অনুমান করিতে পার যে, উহারা বাঙ্গালী কি হিন্দুস্থানী লোক? 

মাধবী। তাহা আমি ঠিক বলিতে পারি না। 

কর্ম্মচারী। উহাদিগকে পুনরায় দেখিলে তুমি চিনিতে পারিবে কি? 

মাধবী। চিনিতে পারিব বলিয়া আমার বোধ হয় না। কারণ, সেই সময় আমার এত ভয় হইয়াছিল, এবং তাহাদিগের পদাঘাতে আমার এরূপ হইয়াছিল যে, আমি সাহস করিয়া তাহাদিগের মুখের দিকে ভাল করিয়া তাকাইয়া দেখিতে পারি নাই। 

কর্ম্মচারী। উহাদিগের মুখে দাড়ি আছে কি? 

মাধবী। তাহা আমার স্মরণ হয় না। কিন্তু একজনের মুখে যেন দাড়ি আছে বলিয়া বোধ হয়। 

কর্ম্মচারী। উহারা হিন্দু কি মুসলমান, তাহা কিছু অনুমান করিতে পার কি? 

মাধবী। না মহাশয়! আমি বলিতে পারি না, উহারা হিন্দু কি মুসলমান। 

কর্ম্মচারী। তোমাদিগের গৃহ হইতে অন্য কোন দ্রব্য উহারা অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে বলিয়া বোধ হয় কি? মাধবী। তাহা আমি জানি না। কারণ, উহাদিগকে কিছু লইতে আমি দেখি নাই; বা কখন যে উহারা গমন করিয়াছে, তাহাও আমি জানি না। 

কর্ম্মচারী। তোমার দাদা মহাশয় তোমাকে যে কাগজখানি দিয়াছিলেন, তাহা আমাদিগকে দাও দেখি। দেখি উহাতে কি লেখা আছে। 

 মাধবী। কাগজখানি দাদা মহাশয় আমাকে দিয়াছিলেন সত্য; কিন্তু উহা যে কি হইল, তাহা আমি বলিতে পারি না।

কর্ম্মচারী। কেন, উহা ত তোমার হাতেই ছিল? 

মাধবী। উহা আমি হাতে করিয়া রাখিয়াছিলাম সত্য; কিন্তু সেই গোলযোগের সময় উহা কোথায় পড়িয়া গেল, বা আমার হস্ত হইতে অপর কেহ গ্রহণ করিল, তাহা আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই। যে সময় আমি হতজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিলাম, সেই সময় দস্যুগণ হয়ত আমার হস্ত হইতে উহা অপহরণ করিয়া থাকিবে। 

কর্ম্মচারী। যে বাক্সের ভিতর হইতে তোমার দাদা মহাশয় সেই কাগজখানি বাহির করিয়া, তোমার হস্তে প্রদান করিয়াছিলেন, সেই বাক্সটি একবার আন দেখি। দেখি উহার মধ্যে সেই কাগজের নকলখানি আছে, কি উহাও অপহৃত হইয়াছে। 

কর্ম্মচারীর এই কথা শুনিয়া মাধবী সেই গৃহের ভিতর সেই বাক্সটির বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিল; কিন্তু যে স্থানে উহা রক্ষিত ছিল, সেই স্থানে বা অপর কোন স্থানে উহা দেখিতে না পাইয়া কহিল, “না, মহাশয়! বাক্সটি ত দেখিতে পাইতেছি না। বোধ হয়, উহা অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে।” 

কর্ম্মচারী। সেই বাক্সের ভিতর মূল্যবান্ দ্রব্যাদি কিছু ছিল, বলিতে পার? 

মাধবী। অনেক সময় দাদা মহাশয় তাঁহার বাক্স আমার সম্মুখে খুলিয়াছেন; কিন্তু মূল্যবান দ্রব্য কখনও তাহার ভিতর দেখি নাই। সেই বাক্স প্রায়ই কাগজপত্রে সর্ব্বদাই পূর্ণ দেখিতে পাইতাম। 

কর্ম্মচারী। সেই বাক্স ব্যতীত তোমাদিগের গৃহের আর কোন দ্রব্য অপহৃত বা স্থানান্তরিত হইয়াছে কি না, তাহা একবার ভাল করিয়া দেখ দেখি। 

কর্ম্মচারী মহাশয়ের কথা শুনিয়া মাধবী অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত তাহাদিগের গৃহের দ্রব্যাদি উত্তমরূপে দেখিল ও পরিশেষে কহিল, “বাড়ীর অপর কোন দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে কি না, তাহ আমি ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না।” 

কর্ম্মচারী। তৈজসপত্র প্রভৃতি বা অপর কোন দ্রব্যাদি কিছুই অপহৃত হয় নাই ত? 

মাধবী। পিতল কাঁসার দ্রব্যাদি যাহা আমি এ পর্যন্ত দেখিয়া আসিতেছি, তাহার কোন দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে বলিয়া আমার বোধ হইতেছে না। 

কর্ম্মচারী। যাহারা তোমাদিগের গৃহে প্রবেশ করিয়া, তোমার দাদা মহাশয়কে হত্যা করিয়া প্রস্থান করিয়াছে, তাহারা কয়জন ছিল বলিলে? 

মাধবী। আমি দুইজনকে দেখিয়াছি। 

কর্ম্মচারী। দুইজন ব্যতীত অপর আর কেহ ছিল কি না, তাহা তুমি ঠিক বলিতে পার কি? 

মাধবী। আমি যতদূর দেখিয়াছি, তাহাতে দুইজনকেই দেখিয়াছি, ইহা আমার বেশ মনে আছে। সেই দুই ব্যক্তি ব্যতীত আর কোন ব্যক্তি ছিল কি না, তাহা বলিতে পারি না। 

কর্ম্মচারী। যে ব্যক্তি তোমাকে পদাঘাত করিয়াছিল, তাহাকে তুমি উত্তমরূপে দেখিয়াছ; সুতরাং তাহাকে দেখলে তুমি অনায়াসেই চিনিতে পারিবে? 

মাধবী। আমি তাহাকে উত্তমরূপে দেখিয়াছি সত্য; কিন্তু তাহাকে পুনরায় দেখিলে যে আমি চিনিতে পারিব, তাহা ঠিক বলিতে পারি না। 

কর্ম্মচারী। যে সময় তোমাদিগের গৃহের ভিতর এই সকল গোলযোগ ঘটে, সেই সময় গৃহের ভিতর নিশ্চয়ই আলো ছিল? 

মাধবী। হাঁ মহাশয়! গৃহের ভিতর একটি প্রদীপ জ্বলিতেছিল। 

কর্ম্মচারী। তুমি এখন এই বাড়ীতে একাকী বাস করিতে পারিবে? 

মাধবী। না মহাশয়! আমি এখানে একাকী কখনই বাস করিতে পারিব না। 

কৰ্ম্মচারী। এখন তুমি কোথায় থাকিতে মনস্থ করিতেছ? 

মাধবী। আমি আজই আমার স্বামীর গৃহে গমন করিব, ও সেই স্থানেই বাস করিব। 

মাধবীর নিকট এই সমস্ত ব্যাপার অবগত হইয়া, আমরা সেই বাড়ীর অবস্থাটি একবার উত্তমরূপে দেখিবার নিমিত্ত সেই গৃহ হইতে বহির্গত হইলাম। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

মাধবীর নিকট যতদূর সম্ভব ঘটনাসকল অবগত হইয়া প্রথমে সেই গৃহের ভিতর উত্তমরূপে আর একবার দেখিলাম। দেখিলাম, যে গৃহে কালাচাঁদ শয়ন করিতেন, সেই গৃহের সংলগ্ন আর একটি খালি ঘর আছে। উভয় ঘরের মধ্যে একটি জানালা আছে, কিন্তু উহার গরাদিয়া সকল ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। সেই জানালার ভিতর দিয়া খালি ঘর হইতে কোন লোক মনে করিলে, অনায়াসেই আসিতে পারে। সেই খালি ঘরের ভিতর গমন করিয়া দেখিলাম, সেই গৃহের দরজা বহু পুরাতন হওয়ায় আপনিই ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। সুতরাং সেই গৃহের ভিতর সকলেই ইচ্ছামত প্রবেশ করিতে পারে। 

সেই গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া উপরের অপরাপর গৃহগুলি সমস্তই দেখিলাম। সমস্তগুলির অবস্থা প্রায় একই প্রকারের। এক গৃহের ভিতর প্রবেশ করিতে পারিলে গৃহের মধ্য দিয়া প্রায় সকল গৃহেই যাতায়াত করিতে পারা যায়। 

উপরের অবস্থা এই প্রকার দেখিয়া নিম্নে নামিলাম। নীচের অবস্থাও ততোধিক। কিন্তু বাড়ীর চতুঃপার্শ্ব উচ্চ প্রাচীরের দ্বারা বেষ্টিত, তাহার কোন স্থান ভগ্ন হয় নাই। সেই প্রাচীর উল্লঙ্ঘন করিয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করা নিতান্ত সহজ ব্যাপার নহে। অন্দরের ভিতর প্রবেশ করিবার কেবল একটি ভিন্ন দ্বার নাই; সেই দরজাটিও খুব মজবুত। বাড়ীর ভিতরের অবস্থা যাহাই হউক, ভিতর হইতে কেহ সহজে প্রবেশ করিতে পারে না। 

এইরূপ উচ্চ প্রাচীর উল্লঙ্ঘন করিয়া চোরগণ কোনস্থান দিয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল, তাহা প্রথমে আমরা সহজে বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। কিন্তু বাড়ীর চতুঃপার্শ্বে উত্তমরূপে দর্শন করিতে করিতে দেখিলাম যে, প্রাচীরের বহির্ভাগে যে বাগান আছে, তাহার এক পার্শ্বের একটি আম্র বৃক্ষের ডাল প্রাচীরের একস্থানের উপর দিয়া বাড়ীর ভিতর আসিয়া পড়িয়াছে। ইহা দেখিয়া, আমরা সহজেই বুঝিতে পারিলাম, বাড়ীতে চোর প্রবেশ করিবার ইহাই সুন্দর পথ। 

কালাচাঁদের মৃতদেহ পরীক্ষার নিমিত্ত বাড়ী হইতে কলেজে পাঠান হইলে, আমরা কালাচাদের শয়ন-গৃহটি আরও একবার উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু চোর কর্তৃক পরিত্যক্ত কোন দ্রব্য প্রাপ্ত হইলাম না। 

কালাচাঁদের অপহৃত বাক্সটির অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত বাগান, পুষ্করিণীর চতুঃপার্শ্ব প্রভৃতি সমস্ত স্থানেই উত্তমরূপে দেখিলাম; কিন্তু কোন স্থানেই সেই বাক্সের চিহ্নমাত্র দেখিতে পাইলাম না। 

আমরা যখন বাগানের ভিতর সেই অপহৃত বাক্সের অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছি, সেই সময় অন্তঃপুরের মধ্যস্থিত নীচের একটি গৃহের মধ্য হইতে জনৈক কর্ম্মচারী উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিলেন, “বাক্স এই স্থানে পড়িয়া রহিয়াছে।” 

কর্মচারীর সেই কথা শুনিবামাত্র আমরা সকলেই পুনরায় সেই অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, নিতান্ত অপরিষ্কৃত ও বিষম অন্ধকারময় একটি নীচের গৃহের ভিতর কালাচাঁদের বাক্সটি ভগ্নাবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে; এবং উহার চতুঃপার্শ্বে কাগজপত্র ছড়ান রহিয়াছে। দুই একটি অর্দ্ধদগ্ধ দেশালাইয়ের কাটিও সেই স্থানে পড়িয়া আছে। 

একটি আলোর সাহায্যে সেই গৃহটির অবস্থা উত্তমরূপে দেখিয়া, এবং সেই স্থানের বিচ্ছিন্ন কাগজগুলি উত্তমরূপে সংগ্রহ করিয়া, সেই ভগ্নবিশিষ্ট বাক্সটির সহিত বাহিরে আসিলাম। 

বাহিরে আসিয়া সেই কাগজপত্রগুলি এক একখানি করিয়া, সমস্তই পড়িয়া দেখিতে লাগিলাম; কিন্তু এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে আমাদিগের কোনরূপ সাহায্য হইতে পারে, এরূপ কিছুই প্রাপ্ত হইলাম না। সেই বাক্স কতকগুলি চিঠিপত্র, কতকগুলি দলিল দস্তাবেজ ও দোকানের কতকগুলি হিসাবপত্রের দ্বারা পরিপূর্ণ। সেই বাক্সের ভিতর যে সকল কাগজপত্র পাওয়া গিয়াছিল, তাহার সমস্তগুলিই পড়িয়া দেখিলাম, তাহার মাও বেশ বুঝিতে পারিলাম। কিন্তু একখানি কাগজে যাহা লেখা ছিল, তাহার অর্থ আমি ত কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না, আমার সমভিব্যাহারী অপরাপর যতগুলি কর্ম্মচারী ছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্যেও কেহ উহার অর্থ করিয়া উঠিতে পারিলেন না। সেই কাগজে যাহা লেখাছিল, তাহা এই :—

ন্ত যাহা কিছু
য়াছি চোরের ভয়ে
নাই, সমস্তই
বাড়ীতে আছে,
মার যে পাকা বাড়ী
মধ্যস্থলে একটি
পোঁতা আছে, উহার
ত্তি রাখিয়া গেলাম 
মার উইলের সহিত
বিপিন বিহারী 
ট থাকিল বাগান
মধ্যস্থলের তিন 
করিলে সেই সিন্ধুক
বিশেষরূপ কষ্টে
সের সঞ্চিত অর্থ
করিও না। কালাচাঁদ। 

বৃদ্ধ যে কাগজখানি মাধবীর হস্তে প্রদান করিয়াছিলেন, এবং তাহার একখানি নকল করিয়া তাহার বাক্সের ভিতর রাখিয়াছিলেন, এই কাগজ দেখিয়া বোধ হইল, ইহাই সেই কাগজের নকল হইবে। তদ্ভিন্ন, এই কাগজ দেখিয়া অপর আর কোনরূপ অর্থই করিয়া উঠিতে পারিলাম না। 

মাধবীর মুখে যতদূর শ্রবণ করিলাম ও স্বচক্ষেও যতদূর দেখিতে পাইলাম, তাহাতে আমাদিগের সকলের মনে স্পষ্টই প্রতীয়মান হইল যে, তস্করের দ্বারা এই ভয়ানক কার্য্য সম্পন্ন হইয়াছে। বৃদ্ধ কালাচাঁদের যথেষ্ট অর্থ আছে, একথা সকলেই জানিত। কিন্তু তিনি যে তাঁহার অর্থ কোথায় রাখিয়াছেন, তাহা কেহই জানিত না। চুরি করিবার অভিপ্রায়ে চোরগণ ইতিপূর্ব্বে আরও কয়েকবার তাঁহার বাড়ীতে প্রবেশ করিয়াছিল; কিন্তু মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিয়া একবারও গমন করিতে পারে নাই। গৃহের ভিতর অনেক অনুসন্ধান করিয়া লুক্কায়িত অর্থের কিছুমাত্র সন্ধান করিয়া উঠিতে পারে নাই। আজও তাহারা চুরির অভিপ্রায়ে পুনরায় বৃদ্ধের বাড়ীতে প্রবেশ করিয়াছিল; কিন্তু সেই সময় বৃদ্ধ জাগরিত অবস্থায় থাকিয়া, আপন বিষয় আশয় প্রভৃতির সমস্ত কথা মাধবীকে বলিতেছিলেন। চোরগণ এই সুযোগ পাইয়া উভয়ের কথাগুলি আনুপূর্ব্বিক শ্রবণ করে, এবং তখন তাহারা বিশেষরূপে অবগত হইতে পারে যে, বৃদ্ধের অনেক লুক্কায়িত সম্পত্তি আছে। কিন্তু সেই সকল সম্পত্তি যে কোথায় আছে, তাহা সেই সময় বৃদ্ধ বলিয়া না দিলে, কোনরূপেই অবগত হইবার আর উপায় নাই, এই ভাবিয়া বৃদ্ধের নিকট হইতে সমস্ত জানিয়া লইবার নিমিত্ত উহারা গৃহের ভিতর আসিয়াই একবারে বৃদ্ধকে আক্রমণ করে, এবং প্রহার করিতে থাকে। বৃদ্ধ উহাদিগের অত্যাচার সহ্য করিতে না পারিয়া অর্থাদি কোথায় লুক্কায়িত আছে, তাহা বলিয়া দিয়াছেন কি না বলা যায় না। কিন্তু উহাদিগের হস্ত হইতে পরিত্রাণ পান নাই, সেই স্থানেই মানবলীলা সম্বরণ করেন। দস্যুগণ যখন দেখিল যে, তাহারা এক করিতে আর এক করিয়া বসিল, চুরি করিতে বসিয়া নরহত্যা করিয়া ফেলিল, তখন অনন্যোপায় হইয়া, তাহারা গৃহ হইতে পলায়ন করিল। যাইবার সময় বৃদ্ধের হাতবাক্সটি লইয়া গেল, কিন্তু উহার ভিতর কিছু না পাইয়া নীচের গৃহের ভিতর ফেলিয়া পলায়ন করিল। 

আমরা আরও ভাবিলাম, দস্যুগণের হস্তে বিষম যন্ত্রণা সহ্য করিয়া বৃদ্ধ আপনার জীবন পর্য্যন্ত অর্পণ করিয়াছে, তথাপি লুক্কায়িত ধনের কিছুমাত্র সন্ধান উহাদিগকে প্রদান করে নাই। কারণ, দস্যুগণ যদি লুক্কায়িত ধনের সন্ধান অবগত হইতে পারিত, তাহা হইলে, গমনকালীন বৃদ্ধের হাতবাক্সটি লইয়া যাইবে কেন? 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া বৃদ্ধের দোকানের অবস্থা কিরূপ, তাহা একবার উত্তমরূপে দেখিবার ইচ্ছা করিলাম।

বৃদ্ধের এইরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে, জানিতে পারিয়া দোকানের দুই একজন কর্ম্মচারী সেই স্থানেই আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল; তাহাদিগকে সঙ্গে লইয়া আমরা দোকানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম,—মহাজনের নিকট বৃদ্ধের যে পরিমিত টাকা দেনা আছে, দোকানে তাহা অপেক্ষা অধিক মূল্যের মাল মজুত আছে। দোকানের লোহার সিন্ধুক খুলিলাম। দেখিলাম, সেই দিবস দোকানে যাহা কিছু বিক্রয় হইয়াছিল, কেবলমাত্র সেই টাকাটাই মজুত আছে। সেই সিন্ধুকের ভিতর একখানি ব্যাঙ্কের বহি পাওয়া গেল, সেই বহি দেখিয়া স্পষ্টই অনুমান হইল, ও দোকানের কর্ম্মচারীগণের নিকট হইতে জানিতে পারিলাম যে, দোকানে যে টাকা বিক্রয় হইত, তাহা তিনি কখনও বাড়ীতে লইয়া যাইতেন না, পূর্ব্ব দিবসের বিক্রয়ের সমস্ত টাকা পর দিবস ব্যাঙ্কে পাঠাইয়া দিতেন। কোন মহাজনকে তিনি কখনও নগদ টাকা প্রদান করিতেন না; যে ব্যাঙ্কে তাঁহার টাকা গচ্ছিত থাকিত, সেই ব্যাঙ্কের উপর চেক কাটিয়া দিতেন। 

ব্যাঙ্কের বহি দেখিয়া স্পষ্টই জানা গেল যে, এখন ব্যাঙ্কে তাঁহার প্রায় সাত হাজার টাকা জমা আছে। 

দোকান হইতে যে ব্রাহ্মণ রন্ধন করিবার নিমিত্ত, ও যে ব্যক্তি অপরাপর কার্য্য করিবার নিমিত্ত, কালাচাঁদের বাড়ীতে সেই দিবস সন্ধ্যার সময় গমন করিয়াছিল, তাহাদিগের সম্বন্ধে একটু বিশেষ সতর্কতার সহিত অনুসন্ধান করা হইল; কিন্তু তাহাদিগের বিপক্ষে কোন কথাই পাওয়া গেল না। 

দোকানের অপরাপর কর্মচারীগণের চরিত্রসম্বন্ধে বিশেষরূপ অনুসন্ধান করা হইল। কিন্তু তাহাদিগের উপরে সন্দেহ সূচক কোন বিষয়ের প্রমাণ পাইলাম না। 

পুনরায় আমরা কালাচাঁদের বাড়ীতে আগমন করিলাম। মাধবীকে ডাকিয়া তাহাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমাদিগের দোকানে যে সকল লোক কৰ্ম্ম করে, তাহাদিগের সকলকেই তুমি চেন কি?” 

মাধবী। সকলকেই চিনি। আবশ্যক হইলেই উহারা সকলেই আমাদিগের বাড়ীতে আইসে। 

আমি। রাত্রিকালে যে দুই ব্যক্তি তোমাদিগের গৃহে প্রবেশ করিয়াছিল, তাহাদিগের আকৃতি সহিত তোমাদিগের দোকানের কোন ব্যক্তির কোনরূপ সাদৃশ্য আছে বলিয়া বোধ হয় কি? 

মাধবী। আমি বেশ বলিতে পারি,—উহাদের কোন ব্যক্তিই আমাদিগের দোকানের লোক নহে। দোকানের কোন লোক হইলে, আমি নিশ্চয়ই চিনিতে পারিতামই। উহাদিগকে আমি পূর্ব্বে আর কখনও দেখি নাই। 

মাধবীর এই কথা শুনিয়া, দোকানের লোকজন সম্বন্ধে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন রহিল না। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

কালাচাঁদবাবুর বন্ধু বিপিনবিহারী বসু। এ কথা পাঠকগণ পূৰ্ব্বেই অবগত হইতে পারিয়াছেন। আরও জানিতে পারিয়াছেন যে, কালাচাঁদবাবুর লিখিত উইল সেই বিপিনবাবুর নিকটেই গচ্ছিত আছে। এরূপ অবস্থায় বিপিনবাবুর সহিত একবার দেখা করা নিতান্ত আবশ্যক মনে করিয়া, যে ব্যক্তি বিপিনবাবুর বাড়ী জানিত, তাহাকে সঙ্গে লইয়া বিপিনবাবুর বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। 

বিপিনবাবু বাড়ীতেই ছিলেন, সংবাদ পাইবামাত্রই তিনি বাহির বাড়ীতে আসিয়া আমাদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। 

বিপিনবাবুর সহিত আমাদিগের সাক্ষাৎ হইবার পূর্ব্বে কালচাঁদবাবু যে হত হইয়াছেন, এ কথা তাঁহার কর্ণগোচর হয় নাই। আমাদিগের প্রমুখাৎ কালাচাঁদবাবুর মৃত্যু সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া, তিনি বিশেষরূপে দুঃখিত হইলেন ও নানারূপ শোক প্রকাশ করিতে লাগিলেন। 

এইরূপে কিছু সময় অতিবাহিত হইলে, যে কার্য্যের নিমিত্ত আমরা তাঁহার নিকট গমন করিয়াছিলাম, সেই কার্য্যের প্রসঙ্গ উঠাইলাম। আমরা তাঁহাকে যে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিলাম, তিনি তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করিতে লাগিলেন। কালাচাঁদবাবুর উইলের কথা জিজ্ঞাসা করায় বিপিনবাবু কহিলেন যে, কালাচাঁদবাবু একটি বাক্স তাঁহার কাছে রাখিয়া দিয়াছেন। যে সময় সেই বাক্সটি তাঁহার নিকট রাখিয়া দেন, সেই সময় তাঁহাকে ইহাও বালিয়াছিলেন যে, উহার ভিতর তাঁহার একখানি উইল থাকিল। আরও বলিয়াছিলেন যে, তাঁহার মৃত্যুর পর সেই বাক্সটি যেন তাঁহার দৌহিত্রীর হস্তে অর্পণ করা হয়। 

এইরূপ বলিয়া বিপিনবাবু আপনার অন্দরের ভিতর প্রবেশ করিলেন, এবং কিয়ৎক্ষণ পরে একটি বাক্সের সহিত প্রত্যাবর্তন করিয়া কহিলেন, “মহাশয়! এই সেই বাক্স; কিন্তু ইহার ভিতর যে কি আছে, তাহা আমি জানি না। কারণ, একাল পর্যন্ত এই বাক্স খুলিয়া আমি দেখি নাই, বা এই বাক্সের চাবিটি আমার নিকট নাই।” 

বিপিনবাবুর কথা শুনিয়া সেই বাক্সটি প্রথমে খুলিবার চেষ্টা করিলাম, কিন্তু কোনরূপেই খুলিতে সমর্থ না হইয়া, সৰ্ব্বসমক্ষে সেই বাক্স ভাঙ্গিয়া ফেলিলাম। দেখিলাম, উহার ভিতর একখানি উইল। উইলের সহিত সংলগ্ন এক টুকরা কাগজ, লোহার সিন্ধুকের একটি চাবী, এবং একখানি ব্যাঙ্ক বহি আছে। 

ব্যাঙ্ক বহি দেখিয়া সকলেই অবগত হইলেন যে, ব্যাঙ্কে তাঁহার কেবল পাঁচ সহস্র টাকা আছে মাত্র। 

ইহার পর সর্বসমক্ষে সেই উইলখানি পঠিত হইল। উহার সংক্ষিপ্ত মর্ম্ম এইরূপ : 

“ইহ-জগতে আমার বিষয়-আশয় ও নগদ টাকার উপযুক্তরূপ উত্তরাধিকারী না থাকায়, আমার সমস্ত বিষয়ের উত্তরাধিকারিণী আমার দৌহিত্রী শ্রীমতী মাধবীকে করিয়া গেলাম। আমার মৃত্যুর পর তিনি আমার ভদ্রাসন বাড়ী, বাগান বাড়ী ও অপরাপর যে সকল সামান্য জমি আছে, তাহার অধিকারী হইবেন। ব্যাঙ্কে যে পাঁচ হাজার টাকা জমা আছে, তাহার মধ্যে বিবেচনা মত টাকা ব্যয় করিয়া আমার অন্তেষ্টিক্রিয়া প্রভৃতি সমাপন হইবে। দোকানের হিসাবে যে টাকা জমা থাকিবে, বা দোকানে যে সকল মাল মজুত থাকিবে, তাহ হইতে মহাজনের দেনা পরিশোধান্তে যাহা কিছু অবশিষ্ট থাকিবে, তাহাও মাধবীর হইবে। আর যদি উহাতে দেনা পরিশোধ না হয়, তাহা হইলে অন্তেষ্টিক্রিয়া বাদে যে টাকা থাকিবে, তাহা হইতেই সেই দেনা পরিশোধ হইবে। মাধবীর স্বামী শরৎচন্দ্র যদি আমার সেই দোকান চালাইতে চাহেন, তাহা হইলে সেই দোকানের দেনা-পাওনার সহিত মাধবীর কোনরূপ সংস্রব থাকিবে না; সমস্তই শরতের হইবে। তদ্ব্যতীত আমার সঞ্চিত নগদ টাকা হইতে শরৎ আরও পাঁচ হাজার টাকা প্রাপ্ত হইবেন। 

“আমার সঞ্চিত নগদ টাকা যে লোহার সিন্ধুকের ভিতর আছে, তাহার চাবি এই সঙ্গেই রহিল। 

“মৃত্যুর পূর্ব্বে এক টুকরা কাগজ আমি মাধবীকে দিয়া যাইব, সেই কাগজে যাহা লেখা আছে, তাহার সহিত এই উইলের সংলগ্ন কাগজখানি মিলাইয়া পড়িলেই জানিতে পারিবেন, ধনপূর্ণ লোহার সিন্ধুক আমি কোথায় রাখিয়া গেলাম। আমি আমার সমস্ত অর্থ মাধবীকে প্রদান করিয়া গেলাম সত্য; কিন্তু তাহার সমস্ত জীবনের মধ্যে সেই অর্থ হইতে পঁচিশ হাজার টাকার অধিক কোনরূপেই ব্যয় করিতে পারিবেন না।” 

উইল পাঠ সমাপ্ত হইয়া গেলে, সেই উইলের সংলগ্ন কাগজখানি বিশেষ আগ্রহের সহিত সকলেই পাঠ করিলেন, কিন্তু উহার প্রকৃত অর্থ কেহই বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না। সেই কাগজখানিতে লেখা ছিল :—

আমি একাল পৰ্য্য 
সংগ্রহ করিয়া রাখি 
তাহা বাড়ীতে রাখি 
আমার বাগান
বাগানের ভিতরআ
আছে তাহার হলের ঠিক
লোহার সিন্ধুক
ভিতর সমস্ত সম্প
সিন্ধুকের চাবি আ 
আমার বন্ধু বাবু
বসু মহাশয়ের নিক
বাড়ীর হলের ঠিক
ফুট জমি খনন
দেখিতে পাইবে
না পড়িলে এত দিব 
কখন সহজে খরচ 

এই সকল অবস্থা দেখিয়া আমরা বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, মাধবী আমাদিগকে যে সকল কথা বলিয়াছিল, তাহার কিছুমাত্রও মিথ্যা নহে, সমস্তই প্রকৃত 

এখন আরও আমাদিগের মনে স্পষ্টই প্রতীতি জন্মিল যে, দস্যুগণ কালাচাঁদের গৃহে চুরি করিবার অভিসন্ধিতে প্রবেশ করিয়াছিল। সেই সময় তাহার নিকট গুপ্ত অর্থের কথা অবগত হইতে পারিয়া, কোথায় সেই অর্থ লুক্কায়িত আছে, জানিবার প্রত্যাশায় কালাচাঁদকে লইয়া বিশেষরূপ পীড়াপীড়ি করিয়াছিল। কিন্তু বৃদ্ধ সেই যন্ত্রণা সহ্য করিতে না পারিয়া, গুপ্ত বিষয় ব্যক্ত না করিয়াই হঠাৎ মৃত্যু মুখে পতিত হইয়াছেন। 

এখন আমাদিগের প্রধান কার্য্য কোন্ দুস্যগণের দ্বারা এই ভয়ানক কাৰ্য্য সম্পন্ন হইল, তাহা স্থির করা, সেই দস্যুগণকে ধৃত করিয়া যাহাতে তাহারা উপযুক্ত দণ্ডে দণ্ডিত হয়, তাহার চেষ্টা করা। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমরা সকলেই সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। বলা বাহুল্য, উইল প্রভৃতি যাহা বিপিনবাবুর নিকটে ছিল, তাহার সমস্তই আমরা সঙ্গে করিয়া আনিলাম। 

আমাদিগের বিশেষরূপ প্রয়োজন না থাকিলেও, বৃদ্ধ কি পরিমিত অর্থ রক্ষা করিয়া গিয়াছেন, ও উহা কোন্ স্থানেই বা লুকাইয়া রাখিয়াছেন, তাহা জানিবার নিমিত্ত কর্ম্মচারীমাত্রেরই বিশেষরূপ কৌতূহল জন্মিল। 

আমরা সকলে কালাচাঁদবাবুর বাড়ীতে আসিয়াই তাঁহার বাক্সের ভিতরে প্রাপ্ত সেই কাগজের সহিত উইলের সংলগ্ন কাগজখানি একত্র মিলিত করিয়া পাঠ করিলাম। দুই অর্দ্ধ অংশ একত্র করিয়া পাঠ করিলে দেখা গেল, উহাতে এইরূপ লিখিত আছে :—

আমি একাল পর্য্য—ন্ত যাহা কিছু 
সংগ্রহ করিয়া রাখি—য়াছি, চোরের ভয়ে
তাহা বাড়ীতে রাখি—নাই, সমস্ত
আমার বাগান—বাড়ীতে আছে,
বাগানের ভিতর আ—মার যে পাকা বাড়ী  
আছে তাহার হলের ঠিক—মধ্যস্থলে একটি
লোহার সিন্ধুক—পোঁতা আছে, উহার
ভিতর সমস্ত সম্প—ত্তি রাখিয়া গেলাম;  
সিন্ধুকের চাবি আ—মার উইলের সহিত
আমার বন্ধু বাবু—বিপিন বিহারী
বসু মহাশয়ের নিক—ট থাকিল, বাগান
বাড়ীর হলের ঠিক—মধ্যস্থলের তিন
ফুট জমি খনন—করিলে সেই সিন্ধুক  
দেখিতে পাইবে—বিশেষরূপ কষ্টে 
না পড়িলে এত দিব—সের সঞ্চিত অর্থ 
কখন সহজে খরচ—করিও না। কালাচাঁদ। 

কালাচাঁদের লিখিত উইলের সমস্ত অবস্থা এখন মাধবী ও শরৎ উত্তমরূপে অবগত হইলেন। বাগানের মধ্যস্থিত যে বাড়ী আছে, তাহার হলের মধ্যে কথিত লোহার সিন্ধুক বাস্তবিকই পোঁতা আছে কি না, তাহা জানিবার নিমিত্ত সকলেই বিশেষরূপ কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া পড়িলেন। পরিশেষে উর্দ্ধর্তন কর্মচারীবর্গের অনুমতিক্রমে আমরা সকলে বাগান বাড়ীতে গমন করিলাম, ও হলের ঠিক মধ্যস্থলে তিন ফুট পরিমিত জমি খনন করিলে একটি লোহার সিন্ধুক বাহির হইয়া পড়িল। উইলের সহিত প্রাপ্ত চাবির দ্বারা সেই সিন্ধুক খোলা হইলে দেখা গেল, কতকগুলি সুবর্ণ ও রজত মুদ্রা দ্বারা উহা পরিপূর্ণ। সকলেই অনুমান করিয়া স্থির করিলেন, সেই পূর্ণ সিন্ধুকের মূল্য দুই লক্ষ টাকার কম হইবে না। 

এখন অনেকেই জানিতে পারিল, যে মাধবী কি পরিমিত অর্থের অধিকারিণী হইলেন। সুতরাং তস্করের কর্তৃক এখন তাহার বিশেষরূপ বিপদ্‌গস্ত হইবারই সম্ভাবনা। কর্তৃপক্ষীয়গণ এই ব্যাপার দেখিয়া, সেই সকল অর্থ যে স্থানে ছিল, সেই স্থানে আর থাকিতে না দিয়া, তখনই উহা ব্যাঙ্কে পাঠাইয়া মাধবীর নামে জমা করিয়া দিলেন। 

এই ঘটনার পর প্রায় এক মাসকাল পর্য্যন্ত আমরা অনেক কর্ম্মচারী এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে লিপ্ত রহিলাম। যে সকল চোরের দ্বারা এইরূপ কার্য্য হইতে পারে, যে সকল ব্যায়েস এইরূপ ভাবের বদমায়েসী করিয়া দিনযাপন করিয়া থাকে, তাহাদিগের মধ্যে বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিলাম, এবং পরিশেষে তাহাদিগেরই সাহায্যে অপরাপর চোর বদমায়েসদিগের অনেক ভিতরের সংবাদ সংগ্রহ করিতে লাগিলাম। কিন্তু কোন ব্যক্তির দ্বারা যে এই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়াছে, তাহার কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত হইলাম না। 

এক মাসকাল বিশেষরূপ অনুসন্ধানের পর কর্ম্মচারীগণের মধ্যে সকলেই এক এক করিয়া, এই অনুসন্ধান পরিত্যাগ করিলেন। বলা বাহুল্য, আমিও পরিত্যাগ করিয়া, অপর কার্য্যে মনোনিবেশ করিলাম। 

যে কার্য্যের নিমিত্ত ক্রমাগত এক মাসকাল অনবরত পরিশ্রম করিয়াছি, এবং কোনরূপ সংবাদ পাইবার প্রত্যাশায় মধ্যে মধ্যে নিজের অনেক অর্থও ব্যয় করিয়াছি, নিষ্ফল হইয়া সেই কার্য্য পরিত্যাগ করিতে মনে মনে অতিশয় কষ্ট হইল সত্য; কিন্তু যখন কোনরূপ সূত্র অবলম্বন করিতে পারিলাম না, তখন বাধ্য হইয়া কাজেই সেই অনুসন্ধান আমাকে পরিত্যাগ করিতে হইল। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

কালাচাঁদের মৃত্যু সম্বন্ধীয় সমস্ত গোলযোগ মিটিয়া গেলে, মাধবী ও শরৎ উভয়েই কালাচাদের পুরাতন ভদ্রাসন বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া, পূর্ব্বকথিত বাগানে গিয়া বাস করিতে লাগিলেন। দোকান যেরূপ ভাবে চলিতেছিল, সেইরূপই রহিল। দোকানের কার্য্যাদি শরৎ নিজেই দেখিতে লাগিলেন। 

কালাচাঁদ যেরূপ নিতান্ত দরিদ্র ভাবে বাস করিতেন, শরৎ বা মাধবী কিন্তু সেরূপ ভাবে বাস করিতে পারিলেন না। দাস দাসী, রাধুনিবামন, মালী, দ্বারবান্ প্রভৃতি রাখিতে হইল। নিজের একখানি গাড়ি করিয়া সহিস কোচমানদিগকেও প্রতিপালন করিতে হইল। 

এইরূপে প্রায় ছয় মাসকাল অতিবাহিত হইয়া গেল। মাধবী ও শরৎ কালাচাঁদের শোক ভুলিয়া মনের সুখে কালযাপন করিতে লাগিলেন। 

এইরূপে আরও কিছু দিবস অতিবাহিত হইয়া গেলে, এক দিবস প্রাতঃকালে সংবাদ পাইলাম, জমিরুদ্দিন ধরা পড়িয়াছে। এই সংবাদ পাইয়া জমিরুদ্দিনকে দেখিবার নিমিত্ত নিতান্ত ইচ্ছা হইল। যে থানার এলাকায় জমিরুদ্দিন ধৃত হইয়াছিল, তৎক্ষণাৎ সেই থানায় উপস্থিত হইলাম। 

পাঠকগণ এই স্থানে সহজেই জিজ্ঞাসা করিতে পারেন যে, জমিরুদ্দিনকে দেখিবার নিমিত্ত আমার এত আগ্রহ জন্মিল কিসে? 

এ প্রশ্নের উত্তরে আমাকে এইমাত্র বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, কলিকাতার ভিতর জমিরুদ্দিন একজন বিশেষ প্রসিদ্ধ চোর। রাত্রিকালে সিঁদ কাটিয়া চুরি করিতে তাহার সদৃশ ব্যক্তি অতি অল্পই আছে। চারি পাঁচ বার সে জেলেও বাস করিয়া আসিয়াছে, সর্ব্বশেষে একটি সিঁদ চুরি মোকদ্দমায় তাহার দশ বৎসরের নিমিত্ত কারাবাস হয়। কিন্তু জেলের ভিতর এক বৎসরকাল বাস করিতে না করিতেই কোনরূপ সুযোগ পাইয়া, সে জেল হইতে পলায়ন করে। সেই পর্য্যন্ত জমিরুদ্দিনের আর কোন ঠিকানা ছিল না। পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণ তাহাকে ধৃত করিবার নিমিত্ত যে কত অনুসন্ধান করিয়াছেন, তাহার ইয়ত্তা নাই। আমিও উহার সন্ধান পাইবার নিমিত্ত বিশেষরূপ চেষ্টা করিয়াছিলাম; কিন্তু কোনরূপেই কৃতকার্য্য হইতে পারি নাই। ইহাকে ধরিবার নিমিত্ত গবর্ণমেন্ট দুই শত টাকা পারিতোষিক দিতে প্রস্তুত আছেন, তথাপি একাল পর্য্যন্ত জমিরুদ্দিন ধৃত হয় নাই। 

জমিরুদ্দিনের জেল হইতে পলায়নের পর কয়েকটি বড় বড় সিঁদ চুরি হইয়া গিয়াছে, এবং উহার কোন কোন চুরিতে জমিরুদ্দিনের উপর সন্দেহ হইয়াছে; তথাপি অনুসন্ধান করিয়া তাহাকে পাওয়া যায় নাই। 

আজ সেই জমিরুদ্দিন ধৃত হইয়াছে শুনিয়া তাহাকে না দেখিয়া থাকিতে পারিলাম না। 

থানায় গিয়া জানিতে পারিলাম যে, যে বাগানে আমাদিগের পূর্ব্ব পরিচিত মাধবী, ও শরৎ বাস করিতেছেন, রাত্রিকালে জমিরুদ্দিন সেই বাগানের ভিতরেই ধৃত হইয়াছে। সুতরাং কিরূপে জমিরুদ্দিন ধৃত হইল, তাহা জানিবার নিমিত্ত আমার আরও কৌতূহল জন্মিল; দ্রুতপদে আমি সেই বাগানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। 

ছয় মাস পূর্ব্বে মাধবী একবার আমাদিগের সম্মুখে বাহির হইয়াছে, যখন যে কথা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছি, তখন সে তাহারই উত্তর প্রদান করিয়াছে। সুতরাং আজও আমাদিগকে দেখিয়া সে কিছুমাত্র কুণ্ঠিতা হইল না। আমাকে দেখিবামাত্র মাধবী ও শরৎ আমার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। জমিরুদ্দিন কিরূপে ধৃত হইয়াছে, তাহা উহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম; রাত্রি আন্দাজ একটার সময় কোন কারণে মাধবী খুলিয়া বাহিরের বারান্দায় আইসে। সেই সময় বাড়ীর সন্নিকটে বাগানের মধ্যে একটি মনুষ্যমূর্তি তাহার নয়নগোচর গৃহের দরজা হয়। এই ব্যাপার দেখিয়া মাধবী অতিশয় ভীতা হয়, এবং দ্রুতগতি আপন স্বামীর নিকট গমন করিয়া তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ করে। 

শরৎ মাধবীর নিকট সমস্ত ব্যাপার অবগত হইয়া উভয়েই পুনরায় বারান্দায় আইসে; কিন্তু সেবার কিছুই দেখিতে পায় না। মাধবী ঘুমের ঘোরে কি দেখিতে কি দেখিয়াছে, পরিশেষে ইহাই স্থির করিয়া উভয়ে গিয়া শয়ন করেন। 

শরৎ ও মাধবীর কথায় সেই সময় দ্বারবানের নিদ্রা ভঙ্গ হয়। কিন্তু কিসের নিমিত্ত মাধবী ও শরৎ অসময়ে গাত্রোত্থান করেন, তাহার কিছুমাত্র জানিতে না পারিয়া দ্বারবান আপন চারিপায়ার উপর চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। যে স্থানে দ্বারবান্ বসিয়াছিল, সেই স্থান হইতে বাগানের সমস্ত অবস্থা বেশ দৃষ্টিগোচর হয়; কিন্তু বাগানের ভিতর হইতে কোন ব্যক্তি তাহাকে দেখিতে পায় না। 

এইরূপে কিয়ৎক্ষণ চারিপায়ার উপর বসিয়া থাকিবার পর, একটু সামান্য শব্দে বাড়ীর দিকে তাহার নয়ন আকৃষ্ট হয়। সেই সময় দ্বারবান দেখিতে পায়, গৃহের পশ্চাতে বসিয়া এক ব্যক্তি গৃহের দেওয়ালে সিঁদ কাটিতেছে। 

এই ব্যাপার দেখিয়া দ্বারবান সবিশেষ সতর্কতার সহিত অপরাপর চাকরগণকে উঠায় ও কৌশল করিয়া সকলে মিলিয়া চোরকে ঘিরিয়া ফেলে। সেই সময় চোর কি অবস্থায় পতিত হইয়াছে জানিতে পারিয়া, পলায়নের চেষ্টা করে। কিন্তু দ্বারবানের সবল-লগুড়াঘাতে সে পলাইতে পারে না। সুতরাং অনায়াসেই সকলে তাহাকে ধরিয়া ফেলে। 

মাধবী ও শরৎ পরিশেষে এই ব্যাপার জানিতে পারিয়া, বন্ধনাবস্থাতেই সেই চোরকে থানায় পাঠাইয়া দেন। 

জমিরুদ্দিনকে থানার কোন কোন ব্যক্তি চিনিত; সুতরাং তাহাকে দেখিবামাত্রই সেই চোরকে জমিরুদ্দিন বলিয়া চিনিয়া ফেলে। 

জমিরুদ্দিন যে জেল হইতে পলাতক, জমিরুদ্দিন তাহা কোনরূপেই স্বীকার করিল না। তাহার বাসস্থান কোথায়, তাহাও কোন প্রকারে তাহার নিকট হইতে জানিতে পারা গেল না। 

উহার পরিহিত বস্ত্রের অনুসন্ধানে এক টুকরা কাগজ ব্যতীত আর কিছুই পাওয়া গেল না। সেই কাগজখানি পড়িয়া দেখিয়া জানিতে পারিলাম যে, কালাচাঁদ যে রাত্রিতে হত হন, সেই রাত্রিতে যে কাগজখানি তিনি মাধবীর হস্তে প্রদান করিয়াছিলেন, উহা সেই কাগজখানি। 

এই কাগজখানি জমিরুদ্দিনের নিকট প্রাপ্ত হওয়ায় বেশ বুঝিতে পারা গেল, কালাচাদের হত্যা এই জমিরুদ্দিন কর্তৃকই হইয়াছে। 

কিন্তু এই সামান্য প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া, হত্যাপরাধে জমিরুদ্দিনের বিচার হইল না। জেল হইতে পলায়ন, সিঁদ কাটিয়া চুরি করিবার উদ্যোগ প্রভৃতি অপরাধে তাহার পুনরায় দশ বৎসর জেল হইল। এখনও জমিরুদ্দিন জেলে আছে। 

জমিরুদ্দিনকে ধরিবার নিমিত্ত যে পারিতোষিক প্রদানে গবর্ণমেন্ট স্বীকৃত ছিলেন, তাহা দ্বারবান্ প্রভৃতি চাকরগণকে বণ্টন করিয়া দেওয়া হইল। 

[ফাল্গুন, ১৩০৩] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *