কৃত্রিম-মুদ্রা
কয়েক বৎসর অতীত হইল, এক সময় কলিকাতায় বহুল পরিমাণ কৃত্রিম-মুদ্রার প্রচলন আরম্ভ হয়। সেই সময়ে দিন দিন এত পরিমাণ ওই সকল মুদ্রার আমদানি হইতে থাকে যে, সকলেই চমকিত হইয়া পড়েন। নানা স্থান হইতে প্রেরিত কৃত্রিম-মুদ্রা রাখিবার নিমিত্ত ব্যাঙ্কে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ সংস্থাপিত করিতে হয়; হিসাব রাখিবার নিমিত্ত আরও দুই এক জন স্বতন্ত্র কর্মচারীও নিয়োগ করিতে হয়।
কৃত্রিম-মুদ্রার বহুল প্রচলনে গভর্ণমেন্টকে ভাবনাতীত ক্ষতি সহ্য করিতে হয়। কারণ, অকৃত্রিম মুদ্রার প্রচলন দিন দিন হ্রাস হইতে আরম্ভ হয়। পুলিস ইহার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হন। যাঁহার নিকট কৃত্রিম-মুদ্রা পাওয়া যায়, কৃত্রিম-মুদ্রা নির্মাণ ও প্রচলন-অপরাধে সন্দেহ করিয়া, পুলিস তাঁহাকেই ধৃত করেন; তাঁহার দোকান ঘর-বাড়ি ও অন্তঃপুর পর্যন্তও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুসন্ধান হইতে থাকে। এইরূপে ক্রমে ক্রমে অনেকেই বিশেষ রূপে অপমানিত হইতে লাগিলেন, অনেকেই বন্দীরূপে বিচারালয়ে প্রেরিত হইতে লাগিলেন। তথাপি কিছুই হইল না, কৃত্রিম-মুদ্রার প্রচলন বন্ধ হইল না।
এই ব্যাপার লইয়া চারিদিকে হুলস্থুল পড়িয়া গেল। কৃত্রিম-মুদ্রা-প্রস্তুতকারীগণকে ধৃত করিবার নিমিত্ত অনেক পাকা পাকা নামজাদা কর্মচারীগণ নিযুক্ত হইলেন। সাজ-বেসাজে ডিটেকটিভ-কর্মচারীগণও নানাদিকে নানা প্রকার গুপ্ত-অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। আমার উপরও এক হুকুম জারি হইল। আমিও ওই কার্যে নিযুক্ত হইলাম।
এক দিন দুই দিন করিয়া ক্রমে এক সপ্তাহ গত হইয়া গেল। এক সপ্তাহ দুই সপ্তাহ করিয়া একটি মাসও চলিয়া গেল; কিন্তু কেহই কিছুই করিতে পারিলেন না; প্রকৃত অপরাধীগণের কোন সন্তানই কেহ বাহির করিতে সমর্থ হইলেন না। এইরূপে ক্রমে দুই মাস অতীত হইয়া যায়, এমন সময় আমি ইহার একটু সন্ধান পাইলাম। আমার একজন গোয়েন্দা এক দিবস আমাকে সংবাদ দিল যে, কয়েক জন কৃত্রিম-মুদ্রা-নির্মাণকারী প্রায় ১৫ দিবস হইতে চোরবাগানের ভিতর একখানি খোলার ঘরে অবস্থান করিতেছে।
এই সংবাদে আমি বিশেষ আনন্দিত হইয়া অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলাম। একটু গুপ্ত অনুসন্ধানেই জানিতে পারিলাম, বাখরগঞ্জনিবাসী শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায় নামীয় এক ব্যক্তিই এই দলের প্রধান নেতা। যে সকল বিষয় আমি অবগত হইলাম, তাহার কোন কথা আমার ঊর্ধ্বতন কর্মচারীগণকে না বলিয়া আমি নিজেই গুপ্ত অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম।
যে ঘরে উহারা বাস করিতেছিল, তাহা একখানি সামান্য খোলার ঘর মাত্র। ওই ঘরের পশ্চাতে আর একখানি ভগ্ন খোলার ঘর ছিল। উহাতে লোকজন কেহই থাকিত না। এই ভগ্ন ঘরখানি আমার বিশেষ উপকারে আসিল। রাত্রি ১০টার পর ওই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া আমি চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতাম। ওইরূপ নির্জন, ভগ্ন, অপরিষ্কার ও দুর্গন্ধবিশিষ্ট স্থানে একাকী চুপ করিয়া বসিয়া থাকা যে কিরূপ কষ্টকর, তাহা যিনি ভুগিয়াছেন তিনিই জানেন। জোরে নিশ্বাস ফেলিবার যো নাই, কাশির উপক্রম হইলে কাশিবার উপায় নাই, শত-সহস্র মশার কামড়ে অস্থির হইলেও তাহার প্রতিবিধানের কোন চেষ্টা করিবার উপায় নাই! এইরূপ অবস্থায় কোন কোন দিন সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত হইয়া যাইত। সমস্ত দিবস শুইয়া ঘুমাইতাম; আর সমস্ত রাত্রি সেই ভগ্ন ঘরে বসিয়া কাটাইতাম। এইরূপে সাত রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গেল। অষ্টম রাত্রে, দেখিলাম, রাত্রি ২টার পর, উহারা কৃত্রিম-মুদ্রা প্রস্তুত করিতে আরম্ভ করিল। সেই ঘরের বেড়ার সামান্য ফাঁক দিয়া দেখিতে পাইলাম, কেহ অগ্নি প্রজ্বলিত করিতেছে, কেহ বা একটি যন্ত্রের সাহায্যে কৃত্রিম-মুদ্রা প্রস্তুত করিতেছে। এই অবস্থা দেখিয়া আমি সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম। দ্রুতপদে আমাদিগের আফিসে আসিয়া আমার ঊর্ধ্বতন কর্মচারীগণকে সকল কথা কহিলাম। লোকজন লইয়া সেই বাড়ির ভিতর প্রবেশ—পূর্বক উহাদিগকে ধৃত করিবার নিমিত্ত, তিনি আমাকে উপদেশ দিলেন, নিজে কিন্তু আলস্য পরিত্যাগ করিয়া আমার সহিত আসিলেন না। আমি চারি জন মাত্র লোক সঙ্গে করিয়া পুনরায় দ্রুতপদে সেইস্থানে আসিলাম। তখন পর্যন্ত সেই ঘরের ভিতর অগ্নি প্রজ্বলিত ছিল ও লোকজনের মৃদু-মৃদু কথা শ্রবণগোচর হইতেছিল। আমরা আস্তে আস্তে সেই বাড়ির দরজায় গমন করিলাম, কাহাকেও কিছু না বলিয়া আমাদিগের সমভিব্যাহারী একজনকে প্রাচীরের উপর উঠাইয়া দিলাম। সে প্রাচীরের উপর দিয়া বাড়ির ভিতর লাফ দিয়া পড়িল, ও যত শীঘ্র পারিল, সদর দরজা খুলিয়া দিল। আমরা দ্রুতপদে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিলাম। কিন্তু বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিয়া কি দেখিলাম। দেখিলাম, বাড়ির ভিতর ঘোর অন্ধকারে আচ্ছন্ন, কোন স্থানে অগ্নি বা প্রজ্বলিত দীপাগ্নির চিহ্ন-মাত্র নাই। বাড়ির ভিতরে যে কয়েকজন লোক ছিল, সকলেই যেন গাঢ় নিদ্রায় অচেতন।
বাড়ির এইরূপ অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল, আমি ভ্ৰমে পতিত হইয়াছি, এক বাড়িতে প্রবেশ করিতে ভুল করিয়া অন্য বাড়িতে প্রবেশ করিয়াছি। কিন্তু, বিশেষরূপ দেখিয়া বুঝিলাম যে, আমার ভ্রম হয় নাই, প্রকৃত বাড়িতেই প্রবেশ করিয়াছি। সুতরাং বাড়ির এইরূপ অবস্থা দেখিয়াও আমরা অনুসন্ধান একেবারে পরিত্যাগ করিলাম না। সকলে মিলিয়া সেই বাড়ি উত্তমরূপে তল্লাস করিলাম; কিন্তু আবশ্যকীয় দ্রব্য কিছুই না পাইয়া ক্ষুণ্নমনে সে দিবস সকলকেই ফিরিয়া আসিতে হইল।
পূর্বকথিত ঘটনার ২/৩ দিন পরেই শ্যামাচরণ সে বাড়ি পরিত্যাগ করিল। আমি যদিও একবার অপ্রস্তুত হইয়াছি, তথাপি আশা একেবারে পরিত্যাগ করিতে পারিলাম না। অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম যে, শ্যামাচরণ তখন বেনেটোলায় আর একখানি খোলার বাড়িতে উঠিয়া গিয়াছে। এবার মনে মনে স্থির করিলাম যে, ঠিক সংবাদ ভিন্ন শ্যামাচরণকে আর স্পর্শও করিব না। সুযোগও ঘটিল সেইরূপ। যে বাড়িতে শ্যামাচরণ বাস করিত, সেই বাড়ির সংলগ্ন আর একখানি বাড়ির এক ব্যক্তির সহিত আমি বন্ধুত্ব স্থাপন করিলাম। তাঁহার ঘর ও শ্যামাচরণের ঘর এক বলিলেই হয়—কেবল একটিমাত্র মৃত্তিকা-নির্মিত দেওয়াল ব্যবধান মাত্র। আমি সর্বদা আমার এই নূতন বন্ধুর বাড়িতে যাইতাম; তিনিও আমাকে ডিটেকটিভ-কর্মচারী বলিয়া জানিতেন। তবে যে কারণে আমি তাঁহার বাড়িতে সর্বদা যাতায়াত করিতাম, তাহা কিন্তু তাঁহার নিকট একদিনের নিমিত্তও বলি নাই। রাত্রে যখন আমার বন্ধুর ঘরে বসিয়া থাকিতাম, সেই সময় প্রায়ই শ্যামাচরণের ঘর হইতে কল চালাইবার শব্দ, টাকার বাদ্য এবং প্রজ্বলিত অগ্নির শব্দও শুনিতে পাইতাম। এই সংবাদ আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্মচারীর নিকট বলিলাম। তিনিও এক দিবস নিজে আসিয়া এই শব্দ স্বকর্ণে শ্রবণ করিলেন; এবং বলিলেন যে, ‘এখন নিশ্চয়ই মুদ্রা নির্মাণ হইতেছে।’ কাজেই তখন আর কাল-বিলম্ব না করিয়া আরও লোকজন সংগ্রহ করিলাম, ও দরজা ভাঙ্গিয়া সেই বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিলাম; কিন্তু কিছুই প্রাপ্ত হইলাম না। সমস্ত ঘর পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে তল্লাস করিলাম; ঘরের মেজে, উঠান প্রভৃতি খনন করিয়া ফেলিলাম; কিন্তু কিছুই প্রাপ্ত হইলাম না। এই ঘটনাকে তখন যেন ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়া বলিয়া বোধ হইতে লাগিল।
আমি তখন শ্যামাচরণকে কহিলাম, ‘দেখ, শ্যামাচরণ, তুমি এইরূপে কৃত্রিম মুদ্রা প্রস্তুত করিয়া আর কত দিন আমাদিগের হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইবে? এখনও তুমি এই নিকৃষ্ট কার্য পরিত্যাগ-পূর্বক দেশে গমন করিয়া আপন জীবন রক্ষা কর; আমরাও এই প্রকার কষ্ট হইতে পরিত্রাণ পাই।
শ্যামাচরণ। আপনারা নিরপরাধ ব্যক্তিকে অপরাধী সাব্যস্ত করিয়া, দুই দুইবার, আমার ঘর অনুসন্ধান-পূর্বক, আমাকে বিশেষরূপে অপমানিত করিলেন। আপনারা পুলিশ-কর্মচারী; ভদ্রলোকের অপমান করিতে আপনাদিগের সৃষ্টি। ইহাতে যে নিরপরাধ আমাকে অপমানিত করিবেন, তাহার আর বিচিত্র কি! আপনারা কৃত্রিম-মুদ্রা-প্রস্তুতকারীকে ধরিতে এখানে আসিয়াছেন; কিন্তু সে ক্ষমতা আপনাদিগের নাই। কৃত্রিম-মুদ্রা প্রস্তুতকারীকে ধরিবার ক্ষমতা যদি আপনাদিগের থাকিত, তাহা হইলে চোরের মত আমার বাড়িতে প্রবেশ করিয়া নিরপরাধ লোকের অবমাননা করিতেন না।
শ্যামাচরণের এই কথা শুনিয়া আমার একটু রাগও হইল, লজ্জাও হইল; মনে মনে একটু অপমানও বোধ করিলাম। এবং শ্যামাচরণকে কহিলাম, ‘দেখ শ্যামাচরণ, তুমি যে এই কার্যের গুরু, তাহার আর কিছুমাত্র ভুল নাই। কিন্তু যখন দুই দুইবার তোমাকে ধরিতে চেষ্টা করিয়াও কৃতকার্য হইতে পারি নাই, তখন তোমাকে কোন কথা বলা বৃথা। যদি কখনও তোমাকে ধরিতে পারি, তখনই দেখিব যে কৃত্রিম-মুদ্রা-প্রস্তুতকারীগণকে ধরিবার ক্ষমতা আমাদের আছে কি না!’ এই বলিয়া ক্ষুণ্নমনে আমরা সেই স্থান পরিত্যাগ করিলাম।
সে দিবস সেই স্থান পরিত্যাগ করিলাম সত্য, কিন্তু হৃদয় হইতে আশা একেবারে পরিত্যাগ করিতে সমর্থ হইলাম না। শ্যামাচরণের উপর আমার যেরূপ তীব্র দৃষ্টি ছিল তাহারও কিছুমাত্র হ্রাস হইল না। দেখিলাম এক সপ্তাহের মধ্যে শ্যামাচরণ সে বাড়ি পরিত্যাগ করিয়া শ্যামবাজারের একটি সঙ্কীর্ণ গলির ভিতর ইষ্টক নির্মিত একটি দ্বিতল বাড়ি ভাড়া করিল। এই বাড়িটি পূর্ব-দেশীয় একটি বৃদ্ধা স্ত্রীলোকের। বৃদ্ধাও ওই বাড়িতে থাকিতেন; তিনিও সেই বাড়ি পরিত্যাগ না করিয়া শ্যামাচরণের সহিত একত্রে বাস করিতে লাগিলেন।
আরও ছয় মাস অতীত হইয়া গেল। এই ছয় মাসের মধ্যে শ্যামাচরণকে মুদ্রা নির্মাণ-উপযোগী যন্ত্রাদির সহিত ধরিবার নিমিত্ত কত যত্ন ও চেষ্টা করিলাম; কিন্তু কোনরূপই কৃতকার্য হইতে পারিলাম না। শ্যামাচরণের বাড়ির পার্শ্বেই একটি ভদ্রলোকের বাড়ি। তখন সেই ভদ্রলোকের সহিত মিশিলাম; তিনিও আমায় যথেষ্টরূপ সাহায্য করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। এই ভদ্রলোকটির বাড়ির প্রাঙ্গণে একটি বৃহৎ আম্রবৃক্ষ ছিল; সেই আম্রবৃক্ষের উপর আরোহণ করিলে শ্যামাচরণের গৃহের কোন কোন অংশ দৃষ্টিগোচর হইত। কোন কোন দিন রাত্রে সেই আম্রবৃক্ষে উঠিয়া বসিয়া থাকিতাম; বসিয়া বসিয়া ভিতরস্থিত অবস্থা যতদূর দেখিতে পাইতাম দেখিতাম। ওই বাড়িতে কেবল শ্যামাচরণ ও বৃদ্ধা থাকিতেন, ইহাই আমার বিশ্বাস ছিল। কিন্তু এখন জানিতে পারিলাম, উহা আরও কয়েকজনের আবাসস্থল; দু-একজন স্ত্রীলোকও ওতে আছে। ওই বাড়ির কেবলমাত্র একটি দরজা; ওই দরজা ছাড়া বাড়ির ভিতর হইতে বাহির হইবার আর কোন উপায় ছিল না। দরজা কিন্তু সর্বদাই ভিতর হইতে বন্ধ থাকিত। বাড়ির ভিতর হইতে বহির্গত হইবার সঙ্গে সঙ্গেই অমনি অমনি দরজা বন্ধ হইত। ওই বাড়ির কোন ব্যক্তি বাহির হইতে আসিয়া যখন ভিতরে প্রবেশ করিত, তখন সেই দরজা-সংলগ্ন একটি ‘কড়া’ ধরিয়া শব্দ করিলেই অমনি ভিতর হইতে দ্বার খুলিয়া যাইত। কিন্তু কোন বাহিরের লোক আসিয়া সেই ‘কড়া’ নাড়িলে, হঠাৎ কেহ দরজা খুলিয়া দিত না; সে ব্যক্তি কে, কি কার্যে আসিয়াছে প্রভৃতি সমস্ত বিষয় ভিতর হইতে প্রথমে কেহ জানিয়া লইয়া, আবশ্যক হইলে, পরিশেষে দরজা খুলিত। আমি ইহা দেখিয়া বুঝিলাম যে, ‘কড়া’ নাড়ার ভিতরেও রহস্য আছে। আবশ্যক হইলে বাড়ির দরজা ভাঙিয়া প্রবেশ করার ক্ষমতা যদিও আমার আছে, কিন্তু সেই উপায়ে দু-দু বার ঠকিয়াছি, ওইরূপে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিতে যে সময়ের আবশ্যক হয়, তাহার ভিতরই উহারা মুদ্রা-নির্মাণ উপযোগী সমস্ত দ্রব্যই কোথায় যে রাখিয়া দেয়, তাহার আর কিছুমাত্র অনুসন্ধান পাওয়া যায় না। সুতরাং দরজা ভাঙিয়া বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিবার চেষ্টা এবার পরিত্যাগ করিলাম। কৌশল করিয়া সকলের অগোচরে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিবার উপায় অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। দরজার ‘কড়া’ নাড়ার রহস্য যদি কিছু অনুমান করিয়া লইতে পারি, তাহারই চেষ্টা দেখিতে লাগিলাম। প্রায় একমাস কাল ‘কড়া’ নাড়া বিশেষ মনোযোগের সহিত দেখিতে লাগিলাম। ক্রমে অনুমান দ্বারা উহা একপ্রকার স্থিরও হইয়া গেল। তখন বুঝিতে পারিলাম যে, ২৪ ঘণ্টায় ভিন্ন ভিন্ন ২৪ রকম কড়া-নাড়াইয়া উহাদিগের সঙ্কেত। কড়া নাড়ার রহস্যের ভিতর প্রবেশ করিয়া একটু আনন্দ হইল। তখন কোন সময় উহারা মুদ্রা নির্মাণ করে, তাহার প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম। একদিন রাত্রি দুটার সময় সেই ভদ্রলোকটির সহিত আমি তাঁহার রান্না-বাড়ির ছাদের উপর উঠিলাম। এই ছাদের উপর স্ত্রীলোক ভিন্ন আর কেহই উঠিত না; সেই বাড়ির স্ত্রীলোকগণের বায়ু-সেবনের নিমিত্তই এই ছাদ নির্মিত হয়। এই ছাদের চতুর্দিক উচ্চ প্রাচীর দ্বারা এরূপভাবে আবৃত ছিল যে, কোন স্থান হইতে কেহই ছাদস্থিত কাহাকেও দেখিতে পাইত না। কিন্তু প্রাচীরের স্থানে স্থানে যে এক একটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র ছিল, সেই ছিদ্র দিয়া বাহিরের দিকে অল্প অল্প দৃষ্টি চলিত।
সেই ছাদের উপর বেড়াইতে উঠিয়া একটি ছিদ্র দিয়া আমরা দেখিলাম যে, শ্যামাচরণের উপরের ঘরের একটি জানালা অল্প খোলা রহিয়াছে; এবং সেই ঘরের প্রজ্বলিত দীপের আলোকে ঘরের ভিতরের অল্প অল্প অবস্থা দৃষ্টিগোচর হইতেছে। তখন আমরা বিশেষ মনোযোগের সহিত দেখিতে লাগিলাম; এবং পরিশেষে দেখিতে পাইলাম যে, সেই ঘরের ভিতর তিন চারি ব্যক্তি একত্র মিলিত হইয়া ছোট একটি কলের সাহায্যে বাস্তবিকই কৃত্রিম-মুদ্রা প্রস্তুত করিতেছে।
ইহার পূর্বে যখন দুবার শ্যামাচরণকে ধরিবার চেষ্টা করি, সেই সময় আমার ঊর্ধ্বতন কর্মচারীকে সঙ্গে করিয়া একবার লইয়া যাই, পরিশেষে বিশেষ লজ্জিত হই। সুতরাং এবার আর আমার ঊর্ধ্বতন কর্মচারীকে কোনরূপ সংবাদ না দিয়া ওই বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিব স্থির করিলাম। সেই ছাদ হইতে অবতরণ করিয়া প্রথমে থানা অভিমুখে ছুটিলাম; এবং থানা হইতে ৪/৫ জন কনস্টেবল লইয়া পুনরায় সেই স্থানে আসিলাম। কনস্টেবল কয়েকজনকে তখন সেই ভদ্রলোকটির বাড়ির ভিতর লুকাইয়া রাখিয়া সেই রান্নাঘরের ছাদের উপর পুনরায় উঠিয়া দেখিলাম যে, তখনো মুদ্রা প্রস্তুত হইতেছে!
এই অবস্থা দৃষ্টে আর তিলার্ধ বিলম্ব না করিয়া সকলে মিলিয়া আস্তে আস্তে সেই বাড়ির দরজায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। সকলে সেই স্থানে চুপ করিয়া দাঁড়াইল, আমি তখন সময় অনুযায়ী কড়ার শব্দ করিতে লাগিলাম। শব্দ—মাত্র ভিতর হইতে দরজা খুলিয়া গেল। আমরা সকলে দরজা ঠেলিয়া বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, সেই বৃদ্ধা স্ত্রীলোকটি একটি প্রদীপ হস্তে আমাদিগকে দরজা খুলিয়া দিয়াছে। সে আমাদিগকে দেখিয়াই একেবারে স্তম্ভিত হইয়া গেল, ও আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘তোমরা কারা? এত রাত্রে কাহার অনুসন্ধানে আসিয়াছ?’ আমি বৃদ্ধার কথা শুনিয়া কহিলাম, ‘আমরা যাহার অনুসন্ধানেই আসিয়া থাকি না কেন, তুমি যদি আর কোন কথা কহিবে, তাহা হইলে এখনই তোমার মস্তক চূর্ণীকৃত করিব।’ এই বলিয়া তাহাকে একজন কনস্টেবলের জিম্মা করিয়া দিলাম। অপর আর একজনকে দরজার ভার অর্পণ করিয়া, দ্রুতপদে উপরে উঠিতে লাগিলাম। আমাদিগকে উপরে উঠিতে দেখিয়া বৃদ্ধা ম্রিয়মাণ হইয়া পড়িল, ও হস্তস্থিত প্রদীপ ভূতলে নিক্ষেপ করিয়া পুনরায় কহিল, ‘আমি কথা কহিতে চাই না। তবে উপরে একটি লোক মৃত্যুশয্যায় শায়িত; তোমরা একটু আস্তে আস্তে উপরে উঠ।’
আমি বৃদ্ধার কথায় কর্ণপাত না করিয়া উপরে উঠিলাম। একে অন্ধকার, তাহাতে অপরিচিত বাড়ি—কাজেই উপরে উঠিতে একটু সময়ও লাগিল। উপরে উঠিয়া দেখিলাম, কেবল তিনটিমাত্র ঘর আছে; আর তার তিনটি ঘরেরই দরজা বন্ধ। কিন্তু দরজার ফাঁক দিয়া ভিতর হইতে অল্প অল্প আলোক দেখা যাইতেছিল। আমি তিনটি ঘরের দরজাতেই লোক রাখিয়া, একটি দরজায় অল্প ধাক্কা দিলাম। আপনিই খুলিয়া গেল। আমি ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। তখন দেখিলাম, সেই ঘরের ভিতর একটি প্রদীপ জ্বলিতেছে। তাহার নিকট একটি খাটের উপর এক ব্যক্তি পুস্তক হস্তে শয়ন করিয়া কি পড়িতেছে। আমি ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবামাত্রই সে উঠিয়া বসিল ও আমাকে কহিল, ‘আপনি কে? এত রাত্রে আপনি এখানে কাহার অনুসন্ধানে আসিয়াছেন?’
এই অবস্থা দেখিয়া আমি তো অবাক্! তখন কি বলিব ভাবিয়া স্থির করিতে না পারিয়া, আমি কহিলাম, ‘আমি শ্যামাচরণবাবুর অনুসন্ধানে আসিয়াছি।’
আমার কথা শুনিয়া সেই ব্যক্তি কহিল, শ্যামাচরণবাবু এ ঘরে থাকেন না। ওই পাশের ঘরে দেখুন।
আমি আর কিছু না বলিয়া আস্তে আস্তে সেই ঘর হইতে বহির্গত হইলাম। পার্শ্বের ঘরের দরজাও একটু সামান্য ধাক্কা দিতেই উহা খুলিয়া গেল। দেখিলাম, সে ঘরের ভিতরেও একটি প্রদীপ জ্বলিতেছে; আর চারি ব্যক্তি সেই স্থানে বসিয়া তাস খেলা করিতেছে। আমি ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবামাত্রই শ্যামাচরণ আমাকে চিনিল, ও আস্তে আস্তে কহিল, ‘কি! এবারও আবার কৃত্রিম-মুদ্রা ধরিতে আসিয়াছ নাকি?’
শ্যামাচরণের কথা শুনিয়া আমি তো অবাক। যাই হোক বলিলাম, ‘শ্যামাচরণ, এবার আর তোমার কথা শুনিব না। আমি নিজ চক্ষে এখনই তোমাকে মুদ্রা নির্মাণ করিতে দেখিয়াছি। আর আমি একাকীও নহি যে আমার ভুল হইতে পারে। যাহা হউক, এখন যদি বিশেষরূপে অপমানিত না হইতে চাহ তবে যন্ত্রাদি সমস্ত কোথায় রাখিয়াছ, বল!”
আমার কথা শুনিয়া শ্যামাচরণ একটু হাসিল ও কহিল, ‘এখন রহস্য করিবার সময় নহে। পার্শ্বের ঘরে একটি লোক মৃত্যুশয্যায় শায়িত। তাহাকেই তীরস্থ করিবার অভিপ্রায়ে আমরা এত রাত্রি পর্যন্ত এইস্থানে বসিয়া আছি, ও তাস খেলিয়া কেবল রাত্রি অতিবাহিত করিতেছি। আপনি অত জোর করিয়া কথা কহিবেন না। কারণ ওই ঘরের ভিতর যে ডাক্তার বসিয়া আছেন, তিনি এই স্থানে শব্দাদি করিতে নিষেধ করিয়াছেন; আমাদিগকে পর্যন্তও ওই ঘর হইতে বহির্গত করিয়া দিয়াছেন। আমাকে যদি আপনার বিশেষ কোন প্রয়োজন থাকে, বলুন; নতুবা সময়মত কল্য একবার আসিবেন—আপনার যে কোন প্রয়োজন থাকে, সাধ্যমত করিয়া দিব।’
শ্যামাচরণের অবস্থা দেখিয়া ও তাহার কথা শুনিয়া আমি তো স্তম্ভিত! আমার মুখ দিয়া আর বাক্য নির্গত হইল না। তখন মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম, ‘আমার কি মতিভ্রম হইয়াছে, না বহুদিবস এই বষয়ে চিন্তা করিতে করিতে চিন্তিত বিষয়কে সত্য বলিয়া অবধারণ করিয়া লইয়াছি!’ যাহাই হউক, আমাকে ইতস্তত করিতে দেখিয়া শ্যামাচরণ পুনরায় আমাকে কহিল, ‘আমি আপনাকে যাহা বলিলাম, বোধ হয়, আপনার তাহা বিশ্বাস হইতেছে না। আপনি যাইয়া স্বচক্ষে রোগীর অবস্থা দর্শন করুন। তাহা হইলে সমস্ত বুঝিতে পারিবেন।’ এই বলিয়া শ্যামাচরণ আমাকে লইয়া সেই তৃতীয় গৃহের দরজায় উপস্থিত হইল। দরজায় হাত দিতে না দিতেই দরজা খুলিয়া গেল। সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া যাহা দেখিলাম তাহাতে আমার মস্তক ঘুরিয়া গেল, আমার বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পাইল। দেখিলাম সেই ঘরের মধ্যস্থলে একটি মাদুরের উপর একটি সামান্য বিছানা বিস্তৃত রহিয়াছে, আর তাহার উপর এক ব্যক্তি সংজ্ঞাশূন্য অবস্থায় পতিত। তাহার মস্তকের নিকট একজন বিংশতি বর্ষ বয়স্কা স্ত্রীলোক অর্ধ-অবগুণ্ঠনাবৃতা হইয়া একটি তৃতীয় বর্ষ বয়স্ক বালককে ক্রোড়ে করিয়া বসিয়া রহিয়াছে। স্ত্রীলোকটির দুইটি চক্ষু সেই রোগীর মুখের উপর যেন বৈদ্যুতিক ক্রিয়ার যোগে মিলিত হইয়া গিয়াছে; আর সেই পলকহীন নীল চক্ষু দিয়া খরবেগে জলধারা নির্গত হইয়া নাসিকা গণ্ড ও বক্ষস্থল বহিয়া পরিধেয় বসন ভিজিয়া যাইতেছে। ঘরের এক পার্শ্বে একখানি চৌকির উপর পেন্টুলান-চাপকান আঁটিয়া, চেন ঝুলাইয়া, এক ব্যক্তি বাম-হস্ত কপালে দিয়া ও দক্ষিণ হস্তে একটি ‘থারমোমিটার’ ধরিয়া বসিয়া রহিয়াছেন। সেই স্ত্রীলোকটির বাম হস্তের নিকট কয়েকটি শিশি রহিয়াছে; তাহার কোনটিতে অর্ধেক, কোনটিতে বা সিকি পরিমাণ লাল সাদা প্রভৃতি রঙের নানাবিধ ঔষধ রহিয়াছে।
আমাকে দেখিবামাত্রই সেই পেন্টুলান-চাপকানধারী মানুষটি আস্তে আস্তে আমার নিকট উঠিয়া আসিলেন ও আমাকে কহিলেন, “মহাশয়, এখানে কোন প্রকার কথা কহিবেন না, বা কোনরূপ গোলযোগ করিবেন না। যদি আমার নিকট আপনার কোন প্রয়োজন থাকে তবে আমার বাসায় গিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন। বোধ হয়, আপনি আমাকে উত্তমরূপে চেনেন না; আপনি শ্যামবাজারের ডাক্তার ক্ষেত্রনাথকে জানেন কি?’
ডাক্তার মহাশয়ের কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, ‘হ্যাঁ মহাশয়, আমি ক্ষেত্রবাবুর নাম বিশেষরূপে অবগত আছি। কিন্তু তাঁহার সহিত আমার চাক্ষুষ আলাপ নাই।
আমার এই কথা শুনিয়া তিনি কহিলেন, ‘আমি সেই ক্ষেত্র ডাক্তার—এই আমার ঠিকানা।’ এই বলিয়া তিনি পকেট হইতে একখানি কার্ড বাহির করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন।
সেই সময় সেই স্ত্রীলোকটি ডাক্তারকে সম্বোধন করিয়া কহিল, ‘মহাশয়, এখন একবার দেখুন দেখি, কেমন কেমন বোধ হইতেছে।’
এই কথা শুনিয়া ডাক্তার মহাশয় পুনর্বার সেই রোগীর নিকট গমন করিলেন। হস্ত, পদ, মস্তক ও বক্ষস্থল প্রভৃতি উত্তমরূপে দেখিয়াই কহিলেন, ‘আর কি দেখিব, হইয়া গিয়াছে।’ এই বলিয়া পকেট হইতে রুমাল বাহির করিয়া চক্ষে প্রদান-পূর্বক ঘর হইতে বাহির হইলেন।
তখন সেই ঘরের যে কিরূপ অবস্থা হইল, তাহা যিনি দেখিয়াছেন, তিনিই জানেন। এখন তাহা বর্ণনা করা একেবারে অসম্ভব। সেই রমণী আপন ক্রোড়স্থিত শিশুটিকে দূরে নিক্ষেপ করিয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিল; এবং বারে বারে ভূমিতে পড়িয়া আপন শরীরকে ব্যথিত করিয়া তুলিতে লাগিল; তাহার মস্তকের বেণী খুলিয়া গেল, শরীরের বসন খসিয়া গেল; কপালে করাঘাত করিতে করিতে তাহার কপাল দিয়া রক্ত পড়িতে লাগিল। আর তখন তাহার সেই হৃদয়ভেদী উচ্চ চিৎকারে বাড়ির সকলেই আসিয়া সেই ঘরে উপস্থিত হইল; শিশুটি উঠিয়া কাঁদিতে লাগিল। সেই ভয়ানক অবস্থা দেখিয়া, হৃদয়ভেদী ক্রন্দনধ্বনি শুনিয়া আমার চক্ষু দিয়াও জল আসিল। আমি আমার লোক কয়েকজন লইয়া নিচেয় নামিলাম।
নিচেয় গিয়া ভাবিলাম, ‘এখন এ বাড়ির কি ভয়ানক অবস্থা! এখন যে ইহার ভিতর কৃত্রিম মুদ্রা প্রস্তুত হইতেছে, তাহাই বা কি প্রকারে বলিব! কিন্তু যখন নিজ চক্ষে দর্শন করিয়াছি, তখন কি করিয়াই বা উহাকে মিথ্যা বলিয়া অবধারণ করিয়া লই! যাহা হউক, যখন এই বাড়ির ভিতর কোনরূপে প্রবেশ করিয়াছি, তখন একবার ভাল করিয়া না দেখিয়াও যাওয়া কোন প্রকারে যুক্তিসঙ্গত নহে। যখন ইহারা মৃতদেহ লইয়া গমন করিবে, সেই সময় একবার ঘরগুলি দেখিয়া লইব। কৃত্রিম মুদ্রা পাই আর না পাই, যন্ত্রটিও পাইলে পাইতে পারি!’ এই ভাবিয়া আমি সেইস্থানে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম।
ডাক্তার বাড়ি হইতে বহির্গত হইয়া গেলেন। অন্যান্য সকলে সেই মৃত ব্যক্তির নিকট গিয়া গোলযোগ করিতে লাগিল। কেহ বা সেই স্ত্রীলোকটিকে সান্ত্বনা করিবার চেষ্টায় কত প্রকার বুঝাইতে লাগিল; আর কেহ বা বালকটিকে লইয়া ব্যস্ত হইল; কেহ বা মৃতদেহটিকে ঘর হইতে বাহিরে আনিবার প্রস্তাব করিল; আর কেহ বা তাহাতে নিবারণ করিয়া কহিল, “যখন ঘরের ভিতর বিছানার উপর ইহার মৃত্যু হইয়াছে তখন বাহিরে লইয়া আর লাভ কি!—নাহোক টানাটানি করা মাত্র। যখন খাট আসিবে, তখনই একেবারে খাটের উপর উঠাইয়া লইয়া যাওয়া যাইবে। দুই একজন গমন করিয়া একখানি খাট খরিদ করিয়া আন; মৃতদেহ এখান হইতে লইয়া যাওয়াই উচিত। ঘরের ভিতর মৃতদেহ অনেকক্ষণ পর্যন্ত ফেলিয়া রাখা আমাদের ধর্মবিরুদ্ধ। এই কথা শুনিয়া দুইজন খাট আনিবার অভিপ্রায়ে বাড়ি হইতে বহির্গত হইয়া গেল ও কিয়ৎক্ষণ পরে একখানি দড়ির খাট লইয়া প্রত্যাবর্তন করিল।
খাটখানি উপরে লইয়া যে ঘরে মৃতদেহ ছিল, সেই ঘরের ভিতর লইয়া গেল। কিয়ৎক্ষণ পরে সেই খাট-সমেত মৃতদেহ নামাইয়া আনিয়া অতি অল্পক্ষণের নিমিত্ত আমার সম্মুখেই রাখিল! দেখিলাম, মৃতদেহটি একখানি মোটা চাদর দিয়া ঢাকা রহিয়াছে; কিন্তু মস্তক খোলা রহিয়াছে। ওই মৃত ব্যক্তির চক্ষু ও মুখ দেখিয়া আমিও বুঝিলাম যে, সে নিশ্চয়ই মরিয়া গিয়াছে। অতঃপর আমার সম্মুখে সেই চাদরের এক প্রান্ত দিয়া উহার মুখ ঢাকিয়া দিয়া, কয়েকজন সেই খাট-সমেত সেই মৃতদেহ উঠাইয়া আপন স্কন্ধের উপর রাখিল ও মুখে ‘বল হরি হরিবোল’ বলিয়া বাড়ি হইতে বহির্গত হইয়া গেল। অবশিষ্ট এক ব্যক্তি সেই স্ত্রীলোকটিকে ও বালককে লইয়া তাহাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিল। স্ত্রীলোকটি সেই সময়ে আরও উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিয়া সেই স্থানের সকলের হৃদয়েই বিষম শোকের উদ্রেক করিয়া দিল।
সেই বাড়ির ভিতর কেবল সেই বৃদ্ধা স্ত্রীলোকটি ভিন্ন তখন আর কেহই রহিল না। আমি কিয়ৎক্ষণ সেই স্থানেই অপেক্ষা করিলাম। রাত্রি প্রভাত হইয়া গেল। সূর্যদেব আপন স্থান অধিকার করিলেন। তখন আমি সেই বাড়ির সমস্ত স্থান অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। নিচের প্রত্যেকঘরগুলি দেখিলাম, উপরের দুইটি ঘরও দেখিলাম। কিন্তু কিছুই পাইলাম না। পরিশেষে সেই মৃত ব্যক্তি যে ঘরে ছিল, ঘরে গমন করিলাম; এবং ঘরের সকল স্থানই অনুসন্ধান করিলাম। কিন্তু কিছুই পাইলাম না। পরিশেষে যে মাদুরের উপর সেই মৃতদেহ ছিল, সেই মাদুরটি উঠাইলাম। উঠাইয়াই আমার মন যেন কেমন হইল। সেই স্থানের অবস্থা দেখিয়া ভাবিলাম, চতুর শ্যামাচরণ এবারও আমাদের সহিত চতুরতা করিয়া, আমাদিগের চক্ষে ধূলিমুষ্টি প্রক্ষেপ করিয়াছে। অনুসন্ধানে সেইস্থানে অগ্নি চিহ্ন প্রভৃতি দেখিলাম। আর দেখিলাম সেইস্থানে একখানি কাষ্ঠফলক রহিয়াছে। তখন সেই কাষ্ঠখণ্ড উঠাইলাম। দেখিলাম তাহার নিচে একটি গহ্বর—দুই ফিট প্রশস্ত, তিন ফিট লম্বা ও এক ফুট গভীর। উহার ভিতর ভস্মাদি রহিয়াছে; স্থানে স্থানে গলিত ধাতুর চিহ্নও বিদ্যমান আছে। এই অবস্থা দেখিয়াই আমি তো অবাক! তখন আর কাহাকেও কিছু না বলিয়া সেই বাড়ির বাহিরে আসিলাম। একখানি গাড়ি লইয়া আমি প্রথমে কাশী মিত্রের ঘাট পরে নিমতলার ঘাটে গমন করিলাম। সেইস্থানে মৃতদেহের কোন সন্ধান পাইলাম না; বরং ইহাই জানিতে পারিলাম যে, সেইস্থানে সেই সময়ে সেই প্রকারের কোন মৃতদেহ আইসে নাই। সেইস্থান হইতে ডাক্তার ক্ষেত্রনাথবাবুর বাড়িতে গমন করিলাম; ডাক্তারবাবুর অনুসন্ধান করিলাম; একটি বাবু বাহির হইয়া আসিলে আমি তাঁহাকে সেই ডাক্তার প্রদত্ত কার্ডখানি দেখাইয়া কহিলাম, ‘আমি ডাক্তারবাবুর সহিত সাক্ষাৎ প্রার্থনা করি।’ বাবুটি আমার কথার প্রত্যুত্তরে কহিলেন, ‘এ কার্ডখানি আমারই।’ আমারই নাম ক্ষেত্রনাথ ডাক্তার। ইহাতে আমি আরও আশ্চর্যান্বিত হইলাম। তাঁহাকে কহিলাম, ‘মহাশয়, আমার সহিত তো আপনার কাল রাত্রিতে দেখা হয় নাই। যিনি ক্ষেত্রবাবু পরিচয়ে আমাকে এই কার্ড দিয়াছেন, তিনি তো আপনি নহেন! এই বলিয়া ডাক্তারবাবুকে সকল কথা বলিলাম। তিনিও শুনিয়া অবাক হইলেন। তাহার কার্ড কিরূপে কোন জুয়াচোরের হস্তে পড়িল, তাহাই ভাবিয়া চিন্তিয়া দেখিতে লাগিলেন। আমিও নিতান্ত লজ্জিত মনে সেইস্থান হইতে চলিয়া আসিলাম। কিন্তু মনে মনে শ্যামাচরণের কৌশলকে ধন্যবাদ দিলাম; তাহার উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা করিতে লাগিলাম। শ্যামাচরণ সেই মৃতদেহের সহিত বাড়ি হইতে বহির্গত হইবার পর আর সেই বাড়িতে প্রত্যাগমন করিল না। তাহার পর দুই মাস পর্যন্ত নানারূপে উহাদিগের অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু কোনস্থানেই তাহার সন্ধান পাইলাম না।
এই ঘটনার প্রায় চারি মাস পরে পুনরায় শ্যামাচরণের অনুসন্ধান পাইলাম। এবার দেখিলাম, শ্যামাচরণ শহর পরিত্যাগ করিয়া শহরতলীতে অবস্থান করিতেছে। শ্যামাচরণ আমাকে উত্তমরূপে চিনিয়াছে বলিয়া, এবার আর আমি তাহার বাড়ির নিকট গমন না করিয়া, আমার বিশ্বাসী অন্য আর একজনের নিকট সাহায্য গ্রহণ করিলাম। যে বাড়িতে শ্যামাচরণ অবস্থান করিতেছিল, সেই বাড়ির সম্মুখেই রাস্তার উপর একটি ঘর ভাড়া লইলাম ও সেই ঘরে একটি মনিহারী দোকান খুলিয়া দিলাম। আমার বিশ্বাসী সেই ব্যক্তি সেই দোকানে বসিয়া সামান্য বেচা-কেনা আরম্ভ করিলেন। আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য দোকানের উন্নতিসাধন নহে, কেবল শ্যামাচরণের সহিত মেশামিশি করা। ক্রমে কার্যত ঘটিল তাহাই। সেই দোকানের নিকট দিয়া শ্যামাচরণের গমনাগমন কালে ক্রমে আমার সেই লোকের সহিত তাহার আলাপ হইল। সেই দোকানে আসিয়া, কখনো দোকানে বসিয়া শ্যামাচরণের ক্রমে ধূমপান আদিও চলিতে লাগিল।
একদিন শ্যামাচরণ সেই দোকান হইতে ০ আনা মূল্যের একটি সামগ্রী ক্রয় করিয়া তাহার পরিবর্তে একটি সিকি প্রদান করিল। আমার লোকটি তখন দেখিলেন যে, সেটি প্রকৃত সিকি নহে কৃত্রিম। কিন্তু শ্যামাচরণকে কিছুই না বলিয়া অবশিষ্ট 40 আনা তাহাকে ফিরাইয়া দিলেন। দুই দিবস পরে পুনরায় শ্যামাচরণ আর একটি দ্রব্য লইয়া তাহার পরিবর্তে একটি কৃত্রিম টাকা প্রদান করিল। অদ্য আমার উপদেশমত শ্যামাচরণকে একটি আভাস দেওয়া হইল। সেই লোকটি শ্যামাচরণকে কহিলেন, ‘সেদিন সিকিতে আমার চারি পয়সার লোকসান হইয়াছে। সুতরাং আমি এই টাকার পরিবর্তে ৮০ আনার অধিক দিতে পারিব না; আর, এই মূল্যে আপনি আমাকে যত টাকা দিবেন, ততই লইতে প্রস্তুত আছি।’ এই কথা শুনিয়া শ্যামাচরণ প্রথমে যেন একেবারে আশ্চর্যান্বিত হইল। কিন্তু পরিশেষে ho আনা মূল্যেই সেই টাকা প্রদান করিল। ইহার পরে আমার লোকের সহিত শ্যামাচরণের মনের মিল হইতে লাগিল; ক্রমান্বয়ে ছয় মাস কাল পর্যন্ত তাঁহাকে উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া পরিশেষে শ্যামাচরণ তাঁহাকে বিশ্বাস করিল। একটি—দুটি হইতে আরম্ভ করিয়া ক্রমে ৫০ টাকা পর্যন্তও প্রদান করিতে লাগিল; তিনিও উহার পরিবর্তে নিয়মিত মূল্য প্রদান করিতে লাগিলেন। এইরূপে কৃত্রিম-মুদ্রাসকল যাহা শ্যামাচরণ তাহাকে ho আনায় বিক্রয় করিতে লাগিলেন, তাহার সমস্তই আমার নিকটে জমিতে লাগিল।
যখন দেখিলাম যে, আমার সেই লোকের উপর শ্যামাচরণের কোনরূপ অবিশ্বাস নাই তখন কৃত্রিম-মুদ্রা চালান—অপরাধে তাহাকে মুদ্রা-সহিত ধরাই সাব্যস্ত করিলাম। একদিন আমার ঊর্ধ্বতন কর্মচারীর সহিত সেই দোকানের ভিতর এক স্থানে লুকাইয়া থাকিলাম। সেইদিন শ্যামাচরণের ৫০টি মুদ্রা আনার কথা ছিল। দেখিতে দেখিতে শ্যামাচরণ মুদ্রার সহিত উপস্থিত হইল; এবং সেই লোকটিকে যেমন মুদ্রা দিবে, অমনিই মুদ্রার সহিত আমরা শ্যামাচরণকে ধৃত করিলাম। শ্যামাচরণ বন্দী হইল। আমাদিগের লোকজন সংগ্রহ ছিল; সুতরাং তখন মুহূর্ত-মধ্যেই যে বাড়িতে শ্যামাচরণ থাকিত, সেই বাড়ি ঘিরিয়া ফেলিলাম। বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিয়া একটি স্ত্রীলোক ভিন্ন আর কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না। এই স্ত্রীলোকটিকে আমি চিনিতে পারিলাম। পূর্বে ইহার স্বামীর মৃত্যু হইয়াছিল; এবং ইনিই এই পুত্রটিকে লইয়া স্বামী-বিরহে রোদনপূর্বক আমার কঠিন হৃদয়কেও দ্রবীভূত করিয়াছিলেন।
এবার শ্যামাচরণ অগ্রেই ধরা পড়িয়াছে। সুতরাং বাড়ির ভিতরস্থিত দ্রব্যাদি লুকাইবার কোনরূপ বন্দোবস্ত করিতে সমর্থ হয় নাই। কাজেই অনুসন্ধানে সমস্ত দ্রব্যই বাহির হইয়া পড়িল। ঘর তল্লাস করিতে করিতে ৫ হাত ঊর্ধ্বে দেওয়ালের ভিতর একটি ছিদ্র পাওয়া গেল; সেই স্থান খনন করাতে প্রায় পাঁচ শত কৃত্রিম মুদ্রা বাহির হইয়া পড়িল। বাড়ির প্রাঙ্গণে একটি কূপ ছিল, তাহার ভিতর হইতে একটি কাষ্ঠের বাক্স বহির্গত হইল। সেই বাক্সের ভিতর লৌহ ও পিতল-নির্মিত মুদ্রা-নির্মাণোপযোগী সমস্ত যন্ত্রই পাওয়া গেল। তখন অনুসন্ধানে ডাক্তার প্রভৃতি সকলের নামও বাহির হইয়া পড়িল। সেই সমস্ত দ্রব্যাদি পাইয়া ও দলের সমস্ত লোকের নামধামাদি অবগত হইয়া, আমরা অতীব সন্তুষ্ট হইলাম। আমাদিগের এতদিনের পরিশ্রম সার্থক হইল। পরিশেষে আলিপুরের সেসনে শ্যামাচরণের বিচার হয়। সেই স্থান হইতে কঠিন পরিশ্রমের সহিত তাহার পাঁচ বৎসর কারাবাসের আদেশ হইল। কিন্তু অন্যান্য সকলে সে যাত্রা পরিত্রাণ পাইল।
শ্যামাচরণ কারারুদ্ধ হইল সত্য কিন্তু কি উপায়ে তিন তিন বার শ্যামাচরণ আমাদিগকে বঞ্চিত করিয়াছিল, তাহা জানিবার নিমিত্ত আমার কৌতূহল কোনরূপেই নিবারিত হইল না। আমি একদিন জেলের ভিতর গমন করিয়া শ্যামাচরণকে আমার মনোভিলাষ অবগত করিলাম। তাহাতে সে কেবল এইমাত্ৰ কহিল যে—
‘প্রথম দিবস যখন আপনারা আমার বাড়িতে প্রবেশ করেন সেই সময় আমরা কৃত্রিম-মুদ্রা নির্মাণ করিতেছিলাম। যখন আপনারা দরজা ভাঙিতেছিলেন, ‘সেই সাবকাশের মধ্যে তাড়াতাড়ি সমস্ত দ্রব্যাদি সংগ্রহ পূর্বক একখানি কাপড়ে উত্তমরূপে বাঁধিয়া আমাদের প্রাঙ্গণে যে একখানি বাঁশ পোঁতা ছিল, সেই বাঁশের সাহায্যে, আমার বাড়ির পার্শ্বস্থিত বাড়ির ভিতর উহা রাখিয়া দিই। অন্য লোকের বাড়ি—আপনারা অনুসন্ধান করেন নাই। কাজেই কিছুই প্রাপ্ত হন নাই।
‘দ্বিতীয় দিবস যখন আপনারা প্রবেশ করেন, তখন দ্রব্যাদি লুকাইবার সাবকাশ পাই নাই। কিন্তু আমাদিগের ভিতরস্থিত একটি লোক পূর্ব হইতেই কনস্টেবলের পোশাকে সজ্জিত ছিল। আপনারা কনস্টেবল-সহিত যখন প্রবেশ করেন, তখন সেও আপনাদিগের সহিত মিলিত হয়। সে যে আপনাদিগের আনীত কনস্টেবল নহে, রাত্রে তাহা আপনারা অনুধাবন করিতে পারেন নাই। যখন একজন কনস্টেবলকে আপনারা বাহিরের দরজায় পাহারার নিমিত্ত পাঠাইয়া দেন, সেই সময় আমাদের সেই সজ্জিত কনস্টেবল পাহারা দিবার ভান করিয়া সমস্ত দ্রব্যাদি লইয়া বাড়ির বাহিরে গমন করে এবং যন্ত্রাদি সমস্তই ক্রমে লুকাইয়া ফেলে। কিন্তু আপনারা ইহার বিন্দুবিসর্গও বুঝিতে সমর্থ হন নাই।
‘এইরূপে তৃতীয় দিবস যেরূপে আপনাকে ফাঁকি দিয়াছিলাম, তাহা তো আপনি স্বচক্ষেই দেখিয়াছেন। খাটে করিয়া যখন মৃতদেহ লইয়া গিয়াছিলেন, সেই সময় উহার উপর করিয়াই সমস্ত দ্রব্যাদি বাহির করিয়া লইয়া প্ৰস্থান করি। সেটি মৃতদেহ ছিল না; দলস্থিত এক ব্যক্তিই মৃতদেহের মতন পড়িয়া ছিল। আর, তাহার স্ত্রী বলিয়া যে আপনাকে পরিচয় দিয়াছিল সে, ডাক্তার প্রভৃতি অপরাপর সমস্ত লোক যাহাদিগকে আপনারা দেখিয়াছিলেন তাহারা সমস্তই আমাদিগের দলভুক্ত।’
শ্যামাচরণের এই সকল কথা শুনিয়া ভাবিলাম, আমি এতদিন কর্ম করিয়া যে জ্ঞান উপার্জন করিতে সমর্থ হই নাই, এক শ্যামাচরণের নিকট তাহার অধিক জ্ঞান উপার্জন করিলাম; এবং তাহার বুদ্ধির প্রশংসা করিতে করিতে জেল হইতে বহির্গত হইলাম। সেই সময় হইতেই শ্যামাচরণের দল ছিন্নভিন্ন হইয়া পড়িল, তাহার অধিকাংশই কলিকাতা পরিত্যাগ-পূর্বক, আপন আপন দেশে গমন করিল। কৃত্রিম-মুদ্রার প্রচলন ক্রমে কম হইয়া আসিল।
[ চৈত্র, ১২৯৯]