৩০
ক্রেটকে তার ম্যানেজার ফিলিপসমেত দিল্লির একটি বিশাল হোটেল থেকে অ্যারেস্ট করতে খুব বেশি সময় লাগেনি। বড়ো বাবাজি এবং অ্যাকিন দুজনেই জানত ক্রেট কোথায় রয়েছে। তাদের কাছ থেকে সেই খবর জেনে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল দিল্লি পুলিশে। ওখানকার পুলিশ চূড়ান্ত তৎপরতার সঙ্গে সেই হোটেলে গিয়ে ক্রেটকে তার ম্যানেজারসমেত সাতসকালেই অ্যারেস্ট করে এবং বিকেলের মধ্যে তাকে বিশেষ পাহারার মধ্যে গৌহাটিতে পাঠানো হয়। তবে আশ্রমের খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল দেশজুড়ে। মিডিয়া, রাজনৈতিক থেকে গোটা দেশের সাধারণ জনমহল তোলপাড়। ভারতবর্ষে এমন নৃশংস ব্যবসাও যে হতে পারে তা সত্যিই অভাবনীয়। ক্রেট যেহেতু একজন আন্তর্জাতিক পরিচিত ব্যক্তি ফলে গোটা দুনিয়ায় তার এই অপরাধ নিয়ে আলোচনা এবং শাস্তির দাবি নিয়ে ঝড় বইতে শুরু করল। ক্রেটকে আপাতত কড়া নিরাপত্তায় বিশেষ গোপন কাস্টডিতে রাখা হয়েছে। তবে অ্যাকিন এবং বাবাজিকে আলাদা আলাদাভাবে জেরা করে উঠে আসছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। দফায় দফায় চলছে জেরা। অ্যাকিন হলো ক্রেটের ডানহাত। এই কালো ব্যবসার ম্যানেজার বলা যায়। এশিয়ার যেসব দেশগুলোতে ক্রেট এই জঘন্য ব্যবসা খুলেছে সেগুলোর ফ্র্যানচাইজিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অ্যাকিন। অ্যাকিন থার্ল্ড ওয়ার্ল্ডের দেশগুলোয় ঘুরে ঘুরে খোঁজ করত উপযুক্ত এজেন্টের। এবং তারপর সেই এজেন্টকে দায়িত্ব দেওয়া হতো এই কারখানা বানানোর। প্রোডাক্টের ডিজাইন কেমন হবে, নতুন প্রেডাক্টের স্যাম্পল থেকে সবকিছু দেওয়া-নেওয়া অ্যাকিনের মধ্যস্থতায় হতো। ক্রেট কোনো এজেন্টের সঙ্গেই সরাসরি যোগাযোগ করত না। এবং ক্রেট যখন যে-দেশে যেত তার কয়েকদিন আগে অ্যাকিন সেই দেশে চলে গিয়ে সব ব্যবস্থা করে ফেলত। কিন্তু কখনই তারা একই হোটেলে থাকত না। এবং প্রকাশ্যে দেখাও করত না। গোপনে যোগাযোগ চলত। ভারতে কাজের চাপ যথেষ্ট বাড়ছিল এখানের মেটেরিয়ালের সাপ্লাই ভালো এবং হিউম্যান লেদার প্রোডাক্ট কেনার কাস্টমার বাড়ছিল দিনে দিনে। কিন্তু এই প্রোডাক্ট অত্যন্ত দামি এবং শৌখিন বলে এর শুরু এবং শেষ দুটোই ক্রেট নিজে দেখতেন। তাই অ্যাকিন এবং ক্রেটকে ঘনঘন ইন্ডিয়ায় আসতে হচ্ছিল, এমন ঘনঘন আসার উপযুক্ত কারণ না থাকলে দুই দেশেরই সন্দেহ হতে পারে, তাই এই দেশে তিনি তৈরি করেছিলেন বেশ কিছু বৃদ্ধাশ্রম, অনাথাশ্রম। তাদের দেখার জন্য তিনি আসতেই পারেন। কিন্তু এতগুলো দেশে ছুটোছুটি অ্যাকিনের পক্ষে একা করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই ক্রেট চেয়েছিলেন ইন্ডিয়াতে এমন একজন বিশ্বস্ত ও যোগ্য এজেন্ট থাকুক যে একা ইন্ডিয়ার কাজ সামলাতে পারবে। বছরকয়েক আগে অ্যাকিনের মাধ্যমে রামচরণের সঙ্গে ক্রেটের যোগাযোগ হয়। অ্যাকিন এবং ক্রেট দুজনেই বুঝেছিলেন রামচরণ সেই যোগ্য লোক যাকে দিয়ে কাজ হবে। ভারতবর্ষে ধর্ম হলো মস্ত বড়ো ব্যবসা, সঙ্গে যদি অর্থবল থাকে তাহলে এ দেশে যে-কোনো মানুষেরই ঈশ্বর হয়ে উঠতে বেশি সময় লাগে না। রামচরণের শাস্ত্রজ্ঞান এবং শয়তানি বুদ্ধি তো ছিল এছাড়া ছিল গুরুদেব হয়ে ওঠার যোগ্যতা। ফলে ক্রেটের টাকায় খুব দ্রুত একজন ধর্মগুরু হয়ে উঠতে তার খুব বেশি সময় লাগেনি। বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলে টাকাপয়সা ইত্যাদি খাইয়ে সবদিক থেকেই সে একজন গডফাদার হয়ে উঠেছিল। এবং তারপরেই নারেঙ্গির এই পবিতরার জঙ্গলে নিরাপদ একটি আশ্রম বানানোর পরিকল্পনা এবং আশ্রমের নিচে সেই ভয়ংকর ফ্যাক্টরি।
সবই ঠিকঠাক চলছিল শুধু গন্ডগোল হয়ে গেল এবার। অ্যাকিন এলো, তারপর এলো ক্রেট। দুজনে আলাদা আলাদা হোটেলে উঠল। বেশ কয়েকটি নতুন ডিজাইনের প্রোডাক্টের অর্ডার ছিল। সবকটা প্রোডাক্টই দুবাইয়ে যাওয়ার ছিল। ফিনিশ হয়ে ডেলিভারি হওয়ার আগে ক্রেট নিজে জিনিসগুলো দেখবেন বলে এসেছিলেন। বাবাজির চ্যালা দুলারাম তার এজেন্ট শান্তিলালকে ফোন করে মাল নেওয়ার কথা বলল, শান্তিলাল নাম ভুলে যাওয়ার ভয়ে প্যাকিংপেপারে অ্যাকিনের আর হোটেলের নাম লিখে বিশাল ভুলটা করল। আর সেই ভুলটুকুই গড়াতে গড়াতে শেষে এত বড়ো চক্রান্ত ফাঁস।
আগামীপরশু দিয়া আর অরণ্য ফিরে যাবে কলকাতায় এবার যে উদ্দেশ্য নিয়ে গৌহাটি এসেছিল দুজনে সেই বড়োদিন কভারেজ আর হলো না। উলটে যা হলো তাতে দেশজুড়ে তো বটেই পুরো ফ্যাশন দুনিয়ায় হুলুস্থুল পড়ে গেছে। আগামীকাল গৌহাটি গভর্নমেন্ট থেকে দিয়া আর অরণ্যকে একটি সংবর্ধনাও দেওয়া হবে। আজ দেশের প্রায় সবকটা খবরের কাগজেই এই দুর্ধর্ষ ঘটনার ফলাও খবর। এবং অবশ্যই অরণ্য, দিয়া এবং সিদ্ধার্থর ছবি।
তবে দিয়া ঠিক করেছে এই অভিযানের পুঙ্খানুপুঙ্খ স্টোরি ও নিজের পেপারেই করবে। অন্য কোথাও এত ডিটেলে কিছু বলেনি। হোটেলে একবেলা রেস্ট নেওয়ার পর দিয়া ফোন করল সিদ্ধার্থকে।
সিদ্ধার্থও তার সাফল্যে বেজায় খুশি। পদোন্নতি তার পাকা।
বলুন ম্যাডাম। ফোন তুলে সহাস্যে সাড়া দিলেন সিদ্ধার্থ।
একটা অনুরোধ ছিল যে। রাখা সম্ভব?
আরে বলুন না?
ঘণ্টাখানেক ক্রেটের সঙ্গে কথা বলতে চাই। স্রেফ আমি আর অরণ্য। ব্যবস্থা করা যেতে পারে?
উঁ… আচ্ছা কিছু পারমিশনের ব্যাপার রয়েছে। আমি চেষ্টা করছি। কলব্যাক করছি আপনাকে।
ফোন রাখার পর অরণ্য জিজ্ঞাসা করল কী ব্যাপার, আবার ক্রেট কেন?
দিয়া হেসে বলল, শেষ একটা চেষ্টা। অফিসের টাকায় এসেছি, একেবারে কিছুই না করে ফিরে যাব?
তুই মাইরি গুরুদেব। তবে মনে হয় না পারবি
দেখা যাক। না পারলে আমার ক্যারিয়ারের ব্যর্থতা বলে ধরে নেব আর কি।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সিদ্ধার্থর ফোন এলো। হ্যাঁ ব্যবস্থা করা গেছে। একঘণ্টা তো?
হ্যাঁ।
বেশ আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি। ওখানে নিয়ে যাবে। শুধু একটা অনুরোধ রয়েছে। মানে এখন তো ক্রেট সরকারি হেফাজতে, তাই প্লিজ কিছু রেকর্ডিং করবেন না।
আচ্ছা ঠিক আছে।
আধঘণ্টার মধ্যেই গাড়ি চলে এলো। ওদের নিয়ে যাওয়া হলো পুলিশের একটি বিশেষ নিরাপত্তাবেষ্টিত স্থানে যেখানে ভয়ংকর আসামিদের কোর্টে তোলার আগে হেফাজতে রাখা হয়।
অরণ্য আর দিয়াকে নিজেদের সবকিছু জমা রেখে তারপর ঢুকতে অনুমতি দেওয়া হলো যে ঘরে ক্রেটকে রাখা রয়েছে।
৩১
ছোটো একটি ঘর। ঘরে সিঙ্গেল খাট এবং টেবিল-চেয়ার। ক্রেট খাটে শুয়েছিল। পুলিশ দরজা খুলে ওদের দুজনকে ভেতরে প্রবেশ করতে দিয়ে আবার দরজা বন্ধ করে দিলো। ক্রেট দিয়া আর অরণ্যকে দেখে উঠে বসল। ওরা ভেবেছিল এখনই বুঝি ভয়ংকর গালিগালাজ করে ওদের ঘর থেকে বার করে দেবে কিংবা ঝাঁপিয়ে পড়বে মারার জন্য। আজ অরণ্যও মনে মনে প্রস্তুত হয়ে রয়েছে, সেদিন সুযোগ হয়নি আজ ক্রেট গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করলেই এমন মার দেবে যেন সেই ব্যথা অনেকদিন থেকে যায়। কিন্তু ক্রেট সেসব কিছুই করল না, একগাল হেসে খুব স্বাভাবিক গলায় বলল হ্যাল্লো ইয়ং লেডি। আমি ভাবছিলাম তোমার সঙ্গে বুঝি আর দেখাই হলো না। প্লিজ বসো।
ধন্যবাদ। এবার আর আমার চামড়া ছাড়িয়ে লেডিস ব্যাগ বানানো হলো না, সরি ক্রেট। তোমায় সাহায্য করতে পারলাম না।
শুনে আবার হেসে উঠল ক্রেট। যদিও আজকের হাসির মধ্যে একটা হতাশা মিশে রয়েছে সেটা ও আড়াল করতে পারল না।
হলো না। কিন্তু তোমার চামড়ার কোয়ালিটি খুবই ভালো। যদি বানানো যেত প্রচুর ভালো মানের একটা ব্যাগ আমি আমার ক্রেতাকে দিতে পারতাম। আসলে তোমাদের মানে ইন্ডিয়ানদের চামড়ার গুণমান খুবই ভালো। যাক বসো, সরি আমি এখানে তোমাদের চা অফার করতে পারছি না।
দিয়া আর অরণ্য বসল চেয়ারে। ক্রেট বিছানাতেই বসে।
তোমাদের তো এখন নিশ্চয়ই পৃথিবীজুড়ে নাম ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও তোমাদের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর আমি তোমাদের ব্যাপারে একটু জেনে নিয়েছিলাম, তোমরা এর আগে কী কী করেছ সেটাও জানা হয়ে গিয়েছিল। তবে তোমরা যে আমাকেও খাঁচায় পুরবে সেটা সত্যিই ভাবতে পারিনি।
হ্যাঁ পুরো ঘটনাটাই কাকতালীয় মিস্টার ক্রেট। আমাদের এখানে এসে এই রহস্যে জড়িয়ে পড়া এবং শেষে আপনাকে এভাবে পাওয়া সত্যিই অভাবনীয়। আপনি যে ঈশ্বরের ছদ্মবেশে একজন পাকা নরপিশাচ সেটা জানতে পেরে আমাদের একটুও আনন্দ হয়নি। এই জঘন্য কুৎসিত ব্যবসায় কেন নামলেন ক্রেট? ঈশ্বর তো আপনাকে কম কিছু দেননি। অর্থ, প্রতিপত্তি সবই পেয়েছেন কিন্তু তারপরেও…
শুনে মুচকি হাসলেন ক্রেট। বললেন তুমি দেখছি আজও আমার ইন্টারভিউ নেওয়ার আশাতেই এসেছ। হাল ছাড়োনি। গুড। এজন্যই তোমাকে আমার পছন্দ। নিজের কাজ যদি মন দিয়ে করতে পারো তাহলেই বাস।
ধন্যবাদ। আমি তো আপনাকে বলেই ছিলাম, আমি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যাব আপনার ইন্টারভিউ নেওয়ার। অবশষে দেবেন কি না সেটা আপনার সিদ্ধান্ত।
ঠিক। আমি জীবনে কখনো আলোর সামনে দাঁড়াইনি, কাউকে কখনো ইন্টারভিউ দিইনি।
সেসব তো আগেই শুনেছি ক্রেট। কিন্তু সেদিনের অবস্থা আর আজকের অবস্থা তো এক নয়। সেদিন আপনার মনে ধরা পড়ার ভয় ছিল, তাই হয়তো নিজেকে আড়ালে রাখতে চাইতেন, আজ আর আপনার সেই ভয় নেই।
কিন্তু আমার মতো একজন পাপী মানুষের ইন্টারভিউ নিয়ে তুমি কী করবে?
সত্যি বলতে কী, আগে আপনার ইন্টারভিউ নেওয়ার ইচ্ছে ছিল শুধু আপনার গুণের জন্য। আপনি একজন ওয়ার্ল্ড ফেমাস ফ্যাশন ডিজাইনার, অথচ অধরা, তাই আপনাকে ধরার একটা আপ্রাণ জেদ ছিল। বৃদ্ধাবাসে আপনি যখন সেই অসহায় মানুষগুলোর পাশে বসে খাওয়াদাওয়া করছিলেন তখন আপনাকে দেবতা মনে হয়ছিল, তখন কল্পনার অতীত ছিল আপনি আসলে এত ভয়ংকর, এত নৃশংস।
একজন এত গুণীমানুষও কেন এত ভয়ংকর? কী তার অতীত, কেমন তার জীবন সেটা জানার আগ্রহ এখন আমাদের বেশি হচ্ছে। বলল অরণ্য।
পৃথিবীর প্রতিটি জিনিয়াসই কোনো না কোনো ব্যাপারে ভয়ংকর, নির্মম। নৃশংসতা আসলে প্রতিভারই অঙ্গ। বলল ক্রেট। দেখো জীবন আমার কাছে একটা খেলা ছাড়া আর কিছু নয়। আমার কাছে দয়ামায়া ভালোবাসা এসব শব্দগুলোর কোনো অর্থ নেই। আমি ওসব বুঝিও না। কিন্তু আমি কাজ বুঝি, যারা কাজ করতে, নিজের স্বপ্নকে ছুঁতে ভালোবাসে তাদের আমি পছন্দ করি, আর সেই কারণেই আমি তোমাকে পছন্দ করি। কাল তোমরা আমার ট্র্যাপে ধরা পড়ে গিয়েছিলে, কিন্তু তোমাদের গেম স্ট্র্যাটেজি আমার থেকে স্ট্রং ছিল, আমি তোমাদের অত গুরুত্ব দিইনি, ফলে আমি গেমে হেরেছি। কাল তোমরা হারলে এতক্ষণে জবাই হয়ে তোমাদের চামড়া ছাড়িয়ে প্রসেসিং শুরু হয়ে যেত। বলে হাসলেন ক্রেট। এমন ভয়ংকর একটা কথা বলে এত সহজে হাসা কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে অসম্ভব।
আর এবার আপনার ফাঁসি হবে। কথাটা বলার সময় নিজের রাগ গোপন রাখতে পারল না অরণ্য।
অবশ্যই, আমি জীবনে যত মানুষ জবাই করিয়েছি তার হিসেব আমিও জানি না, আমাকে একবার ফাঁসি দিলেও যথেষ্ট শাস্তি হবে না। কিন্তু আমার প্রাণ একটাই। বারবার ফাঁসি দেওয়ার উপায় নেই। তবে আমার একটা শেষ ইচ্ছে রয়েছে। আমাকে মারার পর আমার শরীরের চামড়া ছাড়িয়ে যেন একজোড়া জুতো বানানো হয়।
জুতোই বা কেন?
কারণ, আমি জীবনে প্রথম মানুষের চামড়া দিয়ে যেটা বানিয়েছিলাম সেটা ছিল একজোড়া জুতো। এবং সেই মানুষ কে ছিলেন জানো?
কে?
আমার বাবা।
কথাটা শুনে শিউরে উঠল দুজনেই। কী বলছেন আপনি!
ঠিকই বলছি। বলে আবার হাসল ক্রেট। আমার বাবা ছিলেন মুচি। খুব গরিবের সংসার। দিন আনি দিন খাই। যে গ্রামে থাকতাম তার থেকে বেশ কিছুটা দূরে ছিল ঘন জঙ্গল। বাবা যখন চামড়া কিনতে পারত না, তখন জঙ্গলে যেত পশু শিকার করতে। কিছু-না-কিছু একটা মেরে নিয়ে আসত, তারপর সেটার ছাল ছাড়িয়ে দেশি পদ্ধতিতে ট্যান করে জিনিস বানাত। ছোটোবেলা থেকেই আমি কাটাকাটি রক্তারক্তি সহ্য করতে পারতাম না। রক্ত দেখলেই ভয় হতো। পালাতাম। অসুস্থ হয়ে পড়তাম। বাবা আমাকে জোর করে ওইসব পশু জবাই, ছাল ছাড়ানো দেখাত, শুধু দেখানো নয় আমাকে শিখতেও হয়েছিল সব। চামড়া ছাড়ানো থেকে ট্যানিং, কাটিং, স্টিচিং সবকিছু। আর আমার বাবার প্রতি ভয় এবং রাগ দুটোই তৈরি হতো। কিন্তু আমি কিছু বলতে পারতাম না। আমরা আর আমার এই দারিদ্র্যও ভালো লাগত না। বাবা জুতো বানিয়ে মাঝে মাঝে শহরে যেত বিক্রি করতে। আমি যখন কৈশোরে পৌঁছলাম আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যেত। আমি সেদিন শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম আর দেখতাম আমার বয়সেরই ছেলেরা কত খুশিতে, কত আনন্দে রয়েছে। ভালো পোশাক, ভালো খাবার অথচ আমার কিছুই নেই। যে স্কুলে পড়তাম সেখানে মাঝে মাঝেই যেতাম না। কারণ বাড়িতে পড়ার সময় পেতাম না, অনেক কাজ করতে হতো। কিন্তু আমার পড়তে ইচ্ছে করত। অথচ উপায় ছিল না। আমার এই অবস্থার জন্য মনে হতো আমার বাবা-মাই দায়ী। আমার রাগ বাড়ছিল। আমি যে বড়ো হচ্ছিলাম বাবা সেটা খেয়াল করত না। একদিন আমার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হচ্ছিল, বাবা আমার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো, আমার আর সেদিন মাথার ঠিক থাকল না, ঘর থেকে বাবার পশু জবাইয়ের ছোরাটা নিয়ে এসে সটান বাবার পেটেই ভরে দিলাম। বাবা মেঝেতে পড়ে গেল। আমি নিজেও বুঝতে পারলাম না এটা আমি কী করে করলাম। মা ওই দৃশ্য দেখে চিৎকার করতে যাচ্ছিল, এখনই লোকজন ছুটে আসবে এবং আমাকে মেরে ফেলবে এই ভয়ে আমি মায়ের পেটেও ছোরাটা গেঁথে দিলাম। আমার পায়ের সামনে ওরা দুজনেই পড়ে রইল। উত্তেজনায় হাঁপাতে হাঁপাতে আমিও ওদের পাশে বসে পড়লাম। বারবার দুটো রাস্তা মনে পড়ছিল। এক, আমিও আত্মহত্যা করি অথবা এখনই এখান থেকে পালাই। বডিদুটোকে ঘরে রেখে একবেলা আমি ভাবলাম। তারপর মনে হলো আমি পালাবও না, মরবও না। আমি বরং ওদের দুজনের হাত থেকে মুক্তি পেলাম। তাহলে বডিদুটোকে নিয়ে কী করব? হঠাৎ মাথায় এলো বাবা যেভাবে নিরীহ পশুগুলোকে মেরে ছাল ছাড়িয়ে ব্যাগ, জুতো, জ্যাকেট ইত্যাদি বানাত আমিও তাই করব। যেভাবে একটা জংলি ভেড়া কিংবা বুনো খরগোশকে মেরে তার ছাল ছাড়াত বাবা আমিও সেই পদ্ধতিতে আমার নিজের হাতে বাবার শরীরের চামড়া ছাড়ানো শুরু করলাম। এবং অবাক হচ্ছিলাম যে আমার এতটুকুও কষ্ট হচ্ছে না। বরং ভালো লাগছে। আমার মনের ভেতর জমে ওঠা অনেক রাগ ওই রক্তের সঙ্গেই ধুয়ে যাচ্ছে। প্রায় সারাদিন চেষ্টা করে আমি আমার বাবার শরীরের চামড়া কাটলাম। তারপর মায়ের। এবং দুটো শরীরকেই খণ্ড খণ্ড করে কেটে দুটো কয়েকটা ছোটো ব্যাগে ভরলাম। এবং পরের কয়েকদিন ধরে রোজ দুটো করে ব্যাগ জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে ফেলে আসতে থাকলাম। কয়েকদিনের মধ্যেই আমার জীবন থেকে মা এবং বাবা পুরোপুরি উধাও হয়ে গেল। গ্রামের মানুষ জানল বাবা আর মা বাড়িতে অশান্তি করে দুজনেই যে যার মতো ভেগে গেছে। আমাদের গ্রামের মানুষ এতই গরিব ছিল যে সকলেই নিজেদের পেট চালানোর জন্য ব্যস্ত থাকত। তাছাড়া ঘরে ঘরে অশান্তি লেগেই থাকত, তাই কেউ কারও সংসারে কী হচ্ছে তাই নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাত না। পুলিশও কখনো আসত না আমাদের গ্রামে। ফলে আমার ঘরে পড়ে রইল দুটো চামড়া। আমি কী করব দুদিন ভাবলাম। তারপর মনে হলো বাবার চামড়া দিয়ে একজোড়া জুতো বানিয়ে আমি সেটা পরব। তাহলে আমার সঠিক প্রতিশোধ নেওয়া হবে। আমার মায়ের প্রতি অত রাগ ছিল না, মায়ের ইচ্ছে ছিল তার শখের বাইবেলটি যেন চামড়ায় বাঁধিয়ে দেওয়া হয়। আমি ঠিক করলাম সেটাই করব। প্রায় এক মাস লেগে গেল আমার ওই দুটো জিনিস বানাতে। বাবার চামড়া দিয়ে বানানো জুতো পরে কয়েকদিন ঘুরলাম। মায়ের চামড়া বাঁধানো বাইবেল তুলে রাখলাম যত্ন করে। ঘরে জমানো যে কটা টাকা আর খাবার মজুত ছিল তাই দিয়ে কিছুদিন চলল তারপর ঠিক করলাম আমাকে পেটের ধান্দায় নামতে হবে। চলে গেলাম শহরে। তারপর এখানে-ওখানে টুকটাক কাজ। মাথায় ছিল বুদ্ধি, আর নতুন নতুন ডিজাইন বানানোর ক্ষমতা এবং আগ্রহ। বাস। একে একে জীবনে সুযোগ এলো আর প্রতিটা সুযোগ কাজে লাগাতে লাগাতে একটা সময় ক্রিস্টোফার হয়ে উঠল ফ্যাশন দুনিয়ার ক্রেট। বলে থামলেন ক্রেট।
কিন্তু আপনি কি বরাবর মানুষ মেরেই তার চামড়া দিয়ে জিনিস বানিয়ে গেছেন?
নাঃ। একেবারেই নয়। বরং বলা ভালো বাবা আর মাকে খুন করে তাদের চামড়া দিয়ে ওই জিনিসদুটো বানানোর পর আমি কোনোরকম চামড়ার জিনিসই বানাতাম না। আসলে আমি বরাবর পশুপ্রেমী। ওই অবলা প্রাণীগুলোকে খুন করে তাদের চামড়া দিয়ে জুতো, জ্যাকেট, ব্যাগ বানাতে আমার কোনোদিনই ইচ্ছে করত না। কিন্তু আমি মানুষকে ঘৃণা করতাম। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে আমি ঘৃণা করতাম, এখনো করি।
মানে মিসঅ্যানথ্রোপ?
হুঁ বলতে পারো। মানবজাতির প্রতি আমার কোনো মায়াদয়া নেই। কোনো ভালোবাসা নেই। কোনো প্ৰেম নেই।
তাহলে যে এত অনাথাশ্রম, বৃদ্ধাবাস?
হাহাহা শেষে তুমি এমন একটা বোকার মতো প্রশ্ন করে বসলে? অরণ্যকে উত্তর দিলো ক্রেট। ওগুলো সবই আসলে আমার গোডাউনও বলতে পারো বা পোল্ট্রি। যদি রাস্তা থেকে মেটেরিয়াল তুলতে কখনো সমস্যা হতো তখন আমরা আমাদের ওইসব গোডাউন থেকে মাল নিতাম।
উফ্! আপনি মানুষ নয় ক্রেট। আপনি একটা সাক্ষাৎ শয়তান।
একদম ঠিক বলেছ তুমি। আমি মানুষ হতেও চাইনি কখনো। আজও আমার কোনো অনুতাপ নেই। আসলে জীবনের প্রতি আমার কোনো ভালোবাসাই নেই।
বেশ তারপর কী করলেন? জিজ্ঞাসা করল দিয়া।
তারপর…তারপর ওই চলতে থাকল আর কি। ফ্যাশন দুনিয়ায় আমি হয়ে উঠলাম সম্রাট। আমার তৈরি গার্মেন্টস, ফ্যাশন একসেসরিজ হয়ে উঠল আধুনিক ফ্যাশনের স্টেটমেন্ট। গোটা দুনিয়ার ধনকুবের থেকে সেলিব্রিটিরা আমার ডিজাইনের জিনিস ব্যবহার করা শুরু করল। কিন্তু বারবার আমার কাছে অনুরোধ আসতে থাকল আমি কেন লেদারের জিনিসপত্র করছি না। সত্যি বলতে করার ইচ্ছেও ছিল না।
আপনি অবিবাহিত, তাই না?
হ্যাঁ। বিয়ে করার প্রশ্নই নেই। তবে শরীরের চাহিদা তো ছিলই। ইচ্ছে হলে নারীশরীর ভোগ করতাম। অবশ্যই শুধু শরীরটুকুই আমার চাহিদা ছিল। একবার একটি মেয়ে আমার প্রেমে পড়ল। মেয়েটির নাম ছিল স্টেলা। ফ্যাশন মডেল। চমৎকার তামাটে রঙের চামড়া ছিল তার। মসৃণ। একেবারে তোমাদের ইন্ডিয়ানদের মতো টাইপ ফোর স্কিন। আমার ভালো লাগত ওর চামড়া, কিন্তু সে আমাকে ভালোবাসতে শুরু করল। একসঙ্গে থাকার জন্য ঘ্যানঘ্যান শুরু করল। তার সঙ্গে আমি মাঝে মাঝে থাকতাম কয়েকঘণ্টা কিন্তু বিয়ে, প্রেম একসঙ্গে থাকার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি। একবার ক্রিসমাসের রাতে স্টেলা সেদিন আমার কাছে ছিল। আমাকে জোর করতে লাগল বিয়ে করার জন্য। আমি ওকে চলে যেতে বলছিলাম, কিন্তু ও ছিল নাছোড়। বলছিল আমাকে না পেলে ও মরে যাবে। ও আমাকে ভালোবাসে ইত্যাদি। হয়তো সত্যিই ভালোবাসত। কিন্তু আমাকে সব সময়ের জন্য পাওয়া অসম্ভব। তাই ওর ইচ্ছেই পূর্ণ করলাম আমি। মেরে ফেললাম। তারপর… তারপর আবার বহুদিন পর বসলাম নিজের ছুরি কাঁচি নিয়ে। ওর লোভনীয় চামড়াটা মাটির নিচে পচে নষ্ট হবে সেটা আমার কাছে খুবই যন্ত্রণাদায়ক হতো, তাই ওর চামড়াটা ছাড়িয়ে নিয়ে বডিটাকে পাঠিয়ে দিলাম মাটির নিচে। আবার বহুকাল পরে নিজের হাতে তৈরি করলাম ডিজাইন। স্টেলা নানারকমের হ্যান্ডব্যাগ ব্যবহার করতে ভালোবাসত, তাই ওর স্মৃতিতেই বানালাম একটি লেডিস ব্যাগ। না একটা নয় দুটো। একটা নিজের কাছে রাখলাম। আরেকটা পাঠালাম আমার ডিস্ট্রিবিউটরের কাছে। তারা ব্যাগের কোয়ালিটি এবং মেটেরিয়াল দেখে অবাক। ছুটে এলো আমার কাছে। তার কাছে আমার গোপন করার কিছু ছিল না। বললাম একটি মৃত মানুষের চামড়া দিয়ে বানিয়েছি। সে আমাকে বলল, এই জিনিস যদি আমি নিয়মিত তাদের সাপ্লাই দিতে পারি তাহলে ইউনিকনেসের দিক থেকে ক্রেট হয়ে উঠবে তামাম ফ্যাশন দুনিয়ার এক নম্বর। আর আমার এটাই ইচ্ছে ছিল। আমি হব ফ্যাশন সাম্রাজ্যের প্রধান সম্রাট। প্রতিমুহূর্তে নতুন নতুন কিছু করার আগ্রহ আমার ভেতরে ছটফট করত। আমি রাজি হয়ে গেলাম। শুরু হয়ে গেল কাজ। কয়েকজন বিশ্বস্ত কর্মচারী নিলাম শুধু এই কাজের জন্য। তারাই বিভিন্ন জায়গা থেকে আমার জন্য এনে দিতে থাকল মেটেরিয়াল। আমি এই আইটেমের জন্য স্পেশাল সব ডিজাইন করতে থাকলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম এই জিনিস বিক্রি হবে না। কিন্তু এই দুনিয়ায় সবকিছু কেনারই খরিদদার রয়েছে। বিক্রিও হতে শুরু করল। তবে গোপনে। চাহিদা আরও বাড়তে থাকল। আমি বুঝলাম আমাকে এবার নিজেই ফিল্ডে নামতে হবে। তাই করলাম। আমার ডিস্ট্রিবিউটরও ততদিনে এই জিনিসের স্বাদ পেয়ে গেছে। সে আলাদা ব্যবসা শুরু করল আমি আলাদা। ও একটা ওয়েবসাইটও করেছিল যার মাধ্যমে কাস্টমার ধরত কিন্তু আমি সেটা করিনি। ডাইরেক্ট এজেন্টের মাধ্যমে কেনাবেচা করতাম।
কারা কিনত এসব?
যাদের হাতে বিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার রয়েছে এবং প্রকৃত শৌখিন। তা সে হলিউডের মস্ত কোনো স্টার বা আরবের কোনো ধনকুবের। অথবা আমেরিকার কোনো বিজনেস টাইকুন। কিন্তু আমার দেশে এই কাজ করতে বেশ কিছু সমস্যা তৈরি হলো। একে তো জ্যান্ত মানুষ বারবার উধাও করা বেশ কঠিন এবং কবরখানা থেকে সদ্য কবর দেওয়া মৃত শব গায়েব করাও বেশ কঠিন, কারণ আমাদের দেশে আইনশৃঙ্খলা কঠোর, জনসংখ্যা কম। আর তার থেকেও বড়ো কথা হলো কোয়ালিটি। বলে আবার মুচকি হাসলেন ক্রেট। দেখলেন ছেলেমেয়েদুটো হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এই প্রথমবার অনর্গল নিজের জীবনকে কারও কাছে বলছেন তিনি। আরাম লাগছে। মনে হচ্ছে দীর্ঘযুগ ধরে জমে থাকা এক বরফের পাহাড় আছড়ে ভেঙে পড়ছে জলে। হালকা হচ্ছে অন্তর। বোতল থেকে দুটোক জল খেলেন, তারপর আবার বললেন, মানুষের চামড়া আমি যে-কোনো স্কিনস্পেশালিস্টের থেকে ভালো বুঝি। মানুষের সাধারণত চার রকমের চামড়া হয়, এদের মধ্যে বেস্ট হলো টাইপ ফোর মানে যেটা সব থেকে বেশি দেখতে পাওয়া যায় সেন্ট্রাল এবং মধ্য-এশিয়ার দেশগুলোতে। অর্থাৎ ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ইত্যাদি দেশে। এই টাইপ ফোর হলো বেস্ট কোয়ালিটির চামড়া।
কেন? জিজ্ঞাসা করল দিয়া।
এসব দেশগুলোর মানুষের শরীরে সূর্যের আলো পড়ে বেশি। এবং এদের চামড়া এই আমাদের মতো ইউরোপিয়ানদের চামড়ার মতো বার্ন হয়ে না। ট্যান হয়। ফলে চামড়ার রং বাদামি বা কালচে হলেও গুণগত দিক থেকে তোমাদের চামড়ার কোয়ালিটি আমাদের থেকে অনেক বেশি ভালো।
যাব্বাবা! এ কী কথা শুনলাম! চিরকাল তো কালো চামড়া বলে আমাদের হেয়ো করে এসেছেন আপনার মতো সাহেবরা। মানুষ বলেই মনে করেননি, আগেও না এখনো অনেকাংশে না।
হ্যাঁ, রঙের দিক থেকে আমরা উন্নত হলেও গুণের দিক থেকে তোমরাই সেরা। বললেন ক্রেট। আর একেবারে পাকা রং। চট করে নষ্ট হয় না। আমার চোখ পড়ল তখন এই দেশগুলোয়। প্রথমত, তোমাদের চামড়ার কোয়ালিটি; আর দ্বিতীয়ত, তোমাদের মতো দেশগুলোর আর্থসামাজিক অবস্থা। এখানের মেটেরিয়াল পাওয়া সোজা। এত জনসংখ্যা, এত দারিদ্র্য, এত হিসেবের বাইরে মানুষ রয়েছে যে রোজ দু-দশটা মানুষ ফুটপাত থেকে বস্তি থেকে উধাও হয়ে গেলেও কেউ তাদের খোঁজ নেবে না। আর এই ভাবনাটা মাথায় আসার পর আমি আর সময় নষ্ট করিনি। জাস্ট শুরু করে দিলাম আমার প্রোজেক্ট। যে-দেশের যেটা সব থেকে বড়ো সেন্টিমেন্ট সেটাকেই ঢাল বানিয়ে কাজ শুরু হলো। আমাকে সব থেকে বেশি প্রফিট দিত তোমাদের দেশ, ইন্ডিয়া। আমার ডিস্ট্রিবিউটরও প্যারালালি এই কাজে নেমে পড়েছিল। কিন্তু ও কাজ করত ইউরোপিয়ানদের চামড়া দিয়ে। তার কোয়ালিটি খুব ভালো হতো না। তাছাড়া ওই যে বললাম ওইসব দেশে জ্যান্ত মানুষ চুরি করা বেশ কঠিন। গতবছর ও পুলিশের কাছে ধরা পড়ে গেল, ওর সাইটও সিজ করে দিলো পুলিশ। কিন্তু আমার কে আর ব্র্যান্ডকে কেউ আটকাতে পারেনি।
কে আর?
ইয়েস এটা আমার এই প্রোডাক্টের কোড। কে আর ফর ক্রেট।
ওঃ তাইতো। আমরা কে আর মানে ভেবেছিলাম কৃত্তিবাস।
হাহাহা ভুল ভেবেছিলে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিতলে তোমরাই। যাহোক, ইয়ং লেডি, শেষ পর্যন্ত খেলায় যখন তুমিই জিতলে আমার এই সাক্ষাৎকার তোমার জেতার পুরস্কারস্বরূপ তোমাকে দিলাম। তুমি হলে প্রথম এবং শেষ সাংবাদিক যে ক্রেটের সাক্ষাৎকার নিতে পারলে। বলে আবার হাহা করে হেসে উঠল ক্রেট।
দিয়া আর অরণ্য অবাক হয়ে যাচ্ছিল এই মানুষটার মধ্যে কোনো অনুতাপ নেই, কোনো মৃত্যুভয় নেই।
এবার তোমরা আসতে পারো। আমি একটু ঘুমোব। বহুদিন আমি ঠিক করে ঘুমোই না। শেষ একবার চেষ্টা করি। বাই দা ওয়ে তোমাদের যেটা অনুরোধ করেছিলাম, আমার চামড়া দিয়ে যদি…
ভারতবর্ষকে আপনি চেনেননি ক্রেট। এই দেশে সব থেকে নির্দয় নির্মম মানুষটির বিচারও আদালত সম্মানের সঙ্গে করে। আমি জানি না কোন দেশে আপনার বিচার হবে, যদি এই দেশে আপনার বিচার হয় এবং ফাঁসিও হয় তাহলেও আপনার মৃতদেহের প্রতি এতটুকু অসম্মান করা হবে না। আমাদের দেশ ভারতবর্ষ। এ দেশের শত্রুর লাশও সসম্মানে ফেরত পাঠানো হয়। গুডবাই।
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো দিয়া আর অরণ্য। দম যেন আটকেছিল দুজনের। একটা মানুষরূপী জন্তুর কথা শুনতে শুনতে ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠছিল।
পুলিশের সঙ্গে কথা বলে ওরা দুজনে রাস্তায় নামল। আজ ঝলমলে রোদ। চারদিকে দোকানপাটগুলো নানা রঙে সেজে উঠেছে। সাধারণ মানুষ খুশির মেজাজে। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা মাথায় লাল রঙের সান্তাটুপি পরে ঘুরছে।
আজ পঁচিশে ডিসেম্বর জানিস? বলল অরণ্য।
জানি।
আজ থেকে দুই হাজার বছর আগে একজন মানুষ পৃথিবীর মানুষের কল্যাণ চেয়ে নিজে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন। আজও গোটা পৃথিবী
তাকে ভালোবাসে।
হুঁ। আর কিছু বলল না দিয়া। গাড়িতে উঠে বসল। অরণ্য বসল ওর পাশে। দিয়ার হাতের ওপর নিজের হাত রাখল। নরম স্নিগ্ধ স্পর্শ। গাড়ি ছুটে চলল গন্তব্যের দিকে।
***