২৫
এই আশ্রমে রাত দশটার পরই পুরো চত্বর অন্ধকার করে দেওয়া হয়। সব লাইট নিভে যায়। এমনকি গেস্ট হাউজে যারা থাকেন তাদেরও সাড়ে দশটার মধ্যে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ার নিয়ম। নিয়মটা অদ্ভুত এবং সাইনবোর্ডে নিয়মাবলিতে অতিথি, শিষ্য ভক্তদের উদ্দেশ্যে স্পষ্ট লেখা রয়েছে, রাত দশটার পর আশ্রম চত্বরে অযথা ঘোরাফেরা না করতে।
আজও ঠিক দশটার সময় পুরো আশ্রম ঘন অন্ধকারে ডুবে গেল। রাতে এখানে খাওয়ানো হয় খিচুড়ি আর সবজি। আগামীকাল সকালে দীক্ষাদানের অনুষ্ঠান। মূল মন্দির, যেখানে আগামীকাল বাবাজি দীক্ষা দেবেন তা নানাভাবে সাজানো হয়েছে। দীক্ষা নেওয়ার জন্য প্রায় শখানেক মানুষ এসেছেন দেশের নানাপ্রান্ত থেকে। আজ বিকেল থেকে রাত প্রায় আটটা পর্যন্ত মন্দিরে ঠাকুরের নামগান হয়েছে। সন্ধেবেলায় ওখানে দিয়া আর অরণ্যও গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসেছিল। পরিস্থিতি কেমন, রামচরণবাবাজির আচরণ, তার কথাবার্তা, তার লোকবল ইত্যাদি বিষয়ে আন্দাজ করার ছিল। বাবাজি বসেছিলেন মন্দিরের বিশাল নাটমন্দিরে বসেছিল নামগানের আসর। একদিকে বিগ্রহ আর অন্যদিকে বিশালাকার একটি সিংহাসনে বসেছিলেন বাবাজি। যারা গাইছিল তাদের গানের তালে তালে তিনি মৃদু মাথা নাড়ছিলেন। মাঝে মাঝে গেয়েও উঠছিলেন। মাঝে মাঝে ধর্মের কথা বলছিলেন। যেমন সুন্দর কথা বলার ভঙ্গি, তেমনই স্নিগ্ধ অথচ জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর। কে বলবে এই মানুষ আসলে এত ভয়ংকর। বাবাজির একেবারে সামনে যে কয়েকজন মাটিতে বসেছিল তাদের মধ্যে ওই দুলারামও ছিল। মানে সামনে যারা বসেছিল তারা বাবাজির খাস চ্যালা।
রাতে খাওয়াদাওয়ার পর নিজেদের ঘরে চলে এলো দিয়া আর অরণ্য। আজ দুজনেই সাংঘাতিক উত্তেজিত। আজ রাতে আসল অ্যাকশন। বাঘের ডেরায় ঢুকে বাঘ শিকার। হাতে কোনো অস্ত্রও নেই। জানা নেই কপালে কী রয়েছে। রাতে সিদ্ধার্থর সঙ্গে অনেকক্ষণ ফোনে কথা বলল অরণ্য। কতদূর ওরা এগিয়েছে, আজ রাতে কী করতে চলেছে সবকিছু ডিটেলে জানাল। সিদ্ধার্থ সব শুনে বেশ কিছু কৌশল শিখিয়ে দিলেন ওদের। সেগুলো মন দিয়ে শুনে নিল দুজনেই। সেমতো প্রস্তুতি নিল। রাত বারোটা নাগাদ অরণ্য দিয়াকে বলল, আচ্ছা শোন আমি ভাবছি তুই ঘরে থাক, আমি একা যাই।
কেন আমি ঘরে বসে কী করব?
কী করবি মানে…তুই আমার আর সিদ্ধার্থর মধ্যে যোগাযোগটা নিয়ন্ত্ৰণ করবি। এটা কিন্তু খুবই ইম্পর্ট্যান্ট কাজ।
হুঁ সত্যিই খুব ইম্পর্ট্যান্ট। আমি একটা কথা বলি অরণ্য?
হ্যাঁ বল।
এই খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজটা আমি একা পারব না রে। এটা বরং তুই কর। আমি চুনিলালের সঙ্গে যাচ্ছি।
কী বলছিস রে! তুই একা যাবি? আঁতকে উঠল অরণ্য।
কেন তুই একা যেতে পারিস আর আমি পারি না?
দিয়া পুরো চুপ করিয়ে দিলো অরণ্যকে।
ঠিক আছে মেরি আম্মা। ভুল হয়ে গেছে আমার।
এটা লাস্ট চান্স। এর আগেরবারও তুই ভুটানে আমাকে নিবি না বলেছিলি।
সরি ভাই, ইয়ে বউ। বলে হাসল অরণ্য। দিয়াও হেসে উঠল। যদিও দুজনেরই বুক অজানা ভবিষ্যতের জন্য টেনশনে গুড়গুড় করছে।
কী মনে হয় দিয়া পারব?
দেখা যাক। না পারলে আমাদের দুজনকে ডুগডুগি বানিয়ে বাজাবে।
হাহাহা!
অরণ্য আজ যখন চুনিলালের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিল তখন দিয়া গিয়েছিল কৃত্তিবাস মন্দিরে কোনো গোপন দরজা রয়েছে কি না তা দেখার জন্য। খুঁজে পায়নি। তাহলে মন্দিরের ভেতরে মানুষের ফিসফিসানি কীভাবে এলো তা সত্যিই রহস্য।
২৬
রাত ঠিক পৌনে দুটোয় অরণ্য আর দিয়া যথাযথ প্রস্তুত হয়ে বেরোনোর আগে দিয়াকে জড়িয়ে ধরল অরণ্য। বলল, দেখ দিয়া, একটা কথা বলি, যদি আমি ফেঁসে যাই তুই কিন্তু নিজেকে সেভ করার জন্য যা যা করার তাই করবি। কারণ এই জঘন্য কাজকে যেভাবে হোক আমাদের বন্ধ করতেই হবে।
ঠিক আছে। তোর ক্ষেত্রেও ঠিকই শর্ত প্রযোজ্য কিন্তু।
যে আজ্ঞে মাননীয়া।
দরজাটা বন্ধ করে বেরোল দুজনে। চারদিকে ভালো করে দেখল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। ধীরে ধীরে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো নিচে। আকাশে ঘষা আলো। তাতে খুব সামান্যই চারদিক বোঝা যাচ্ছে। পাশাপাশি গা ঘেঁষে পথ আন্দাজ করে এগোতে থাকল কৃত্তিবাস মন্দিরের দিকে। ওখানে চুনিলাল অপেক্ষা করবে বলেছে। বড়ো বাবাজি এলে চাচাজি সেই দুই- তিনদিন বাবাজির সেবা এবং নানা আলোচনার জন্য তার কাছেই থাকেন। তার কাছে মানে একই ঘরে নয়, তবে কাছাকাছি ঘরে। আর এটাই সুযোগ চুনিলালের পক্ষে রাতে আসতে পারার। চুনিলাল ও তেমনই বলেছিল। তবু শেষ পর্যন্ত আসতে পারবে কি না তা অনিশ্চিত।
.
চুনিলাল বারবার বলে দিয়েছিল মন্দিরে আসার সময় যেন ভুলেও কোনো আলো না জ্বালতে। কারণ অন্ধকারেও পাহারায় ঘোরে আশ্রমিকের ছদ্মবেশী প্রহরীরা। তাদের নজরে একবার পড়ে গেলেই বিপদ।
সেই কথা শুনেই দিয়া আর অরণ্য কিছুটা আন্দাজেই এগোতে থাকল। যতটা সময় লাগা উচিত তার থেকে অনেকটা বেশি সময় লাগল ঠিকই কিন্তু শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে পারল কৃত্তিবাস মন্দিরে। অন্ধকারে মন্দিরটা কেমন ভূতুড়ে বাড়ির মতো জেগে রয়েছে। মন্দিরের আশপাশ আগে একটু দূর থেকেই যতটা সম্ভব ওয়াচ করে নিল ওরা। যদিও অন্ধকারে কিছুই দেখা গেল না। চুনিলাল ওদের ফাঁসানোর জন্য কোনো ডবল গেম যদি খেলে থাকে তাহলে কিছু করার নেই, কিন্তু ওকে আপাতত বিশ্বাস করা ছাড়া আর কোনো ওয়ে নেই।
অরণ্য দিয়াকে ফিসফিস করে বলল, শোন, তুই এখানে অপেক্ষা কর। আমি গিয়ে দেখে আসছি। যদি দেখি কেস অন্য তাহলে তোকে কী স্টেপ নিতে হবে তা তুই জানিস।
ও কে। টেক কেয়ার।
দিয়া মন্দির থেকে অল্প দূরে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকল মন্দিরের দিকে। অরণ্য এগিয়ে গেল। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে মন্দির দালানে উঠল। মন্দিরের দরজা পর্যন্ত যেতে হলো না তার আগেই অন্ধকার ফুঁড়ে এগিয়ে এলো একজন। অরণ্য হাতের মুঠিকে শক্ত করল।
আপনি একা এসেছেন?
কণ্ঠস্বরে নিশ্চিন্ত হলো অরণ্য। চুনিলালকে বলল, না, একা নই। দিয়া আসছে।
তাড়াতাড়ি আসতে বলুন। এখানে যদিও রাত দশটার পর থেকে ভোর চারটে পর্যন্ত কাজ বন্ধ থাকে, কিন্তু সিসিটিভি রয়েছে নানা জায়গায়। তবে যারা ওয়াচ করে, রাতে আর তাকিয়ে বসে থাকে না, ঘুমোয়। এই সুযোগটাই নিতে হবে আমাদের। কিন্তু মাল যখনতখন চলে আসতে পারে। র মাল এখান দিয়েই ঢোকে।
র মাল মানে?
মানে একটু পরে নিজেই বুঝতে পারবেন। চলুন। ফিসফিস করে বলল চুনিলাল।
এক মিনিট দাঁড়াও, এখনই ডাকছি। বলে অরণ্য এবার দ্রুতপায়ে মন্দির থেকে নেমে দিয়ার কাছে গিয়ে ওকে নিয়ে এলো।
চুনিলাল বলল, আমাদের মন্দিরের পেছনদিকে যেতে হবে।
ওদিকে কি কোনো দরজা রয়েছে? আমি আজ সকালে খুঁজেছিলাম দেখতে পাইনি।
হ্যাঁ আছে। তবে আপনারা পাবেন না। ওইভাবেই তৈরি।
মন্দিরের পেছনের দিকে গেল তিনজন। এই মন্দির একেবারে শেষে। এরপর আর জঙ্গল ছাড়া কিছু নেই। জঙ্গলশেষে আশ্রমের উঁচু বাউন্ডারি এবং তার ওপারে আবার ঘন জঙ্গল। চুনিলাল মন্দিরের পেছনের দেওয়ালের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় অন্ধকারে হাতড়াতে শুরু করল। কৃত্তিবাসী রামায়ণের নানা অংশ খোদাই করা দেওয়ালে হাতড়াতে হাতড়াতে একটা জায়গায় হাত থামিয়ে বলল এই পেয়েছি। একটা কিছু ধরে জোরে চাপ দিলো, তারপরেই ওই পাথরের দেওয়ালের বেশ কিছুটা অংশ দিব্যি একপাল্লা দরজার মতো খুলে গেল। স্লাইডিং দরজা। মোটামুটি শব্দ হলো খুলতে।
এ কি পাথরের দরজা নাকি?
না এই অংশটা কাঠের, তবে বাইরের অংশ পাথরের ফিনিশিং বলে কারও বোঝার সাধ্য নেই।
এখানে তো এমনিও কেউ আসে না তাহলে পেছনে খামোখা দরজা করার দরকার কী?
চুনি বলল এভাবেই বানানো দাদা। পেছনের দরজা না খুললে ভেতরে যেখান দিয়ে ঢুকব সেটাও খোলা যাবে না। এমনই সিস্টেম করা রয়েছে। আসুন ভেতরে চলে আসুন।
তোমরা ভেতরে ঢোকো, আমার খুব টয়লেট পেয়েছে, এখনই সেরে আসছি। বলেই আর অপেক্ষা করল না মন্দির থেকে একটু দূরেই জঙ্গলের দিকে গিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বার করে সিদ্ধার্থ যেমন শিখিয়েছিলেন তেমন কিছু ব্যবস্থা করে সেটা নিজের রুমালে মুড়ে একটা গাছের নিচে ঝোপের আড়ালে এমনভাবে গুঁজে দিলো যেটা কারও পক্ষে খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন, রাতের অন্ধকারে তো নয়ই। তারপর আবার ফিরে এলো।
মন্দিরের ভেতরে ঢুকল তিনজনে। মন্দিরের ভেতরে একটা ডিমলাইট জ্বলছে। চারদিক ঝাপসা আলো।
দিয়া বলল, মানে আমরা ক্যামেরায় দরজা খোলার যে শব্দ পেয়েছিলাম সেটা এই দরজারই।
হুঁ।
আচ্ছা চুনিলাল তুমি যে মালের কথা বলছ সেটা এই মন্দিরেই ঢোকে কেন?
এটা আশ্রমের শেষপ্রান্তে। এদিকে কেউ আসে না। অবশ্য আসার নিয়মও নেই। একটু পরেই জঙ্গল। তারপর পাঁচিল আর পাঁচিলের বাইরে পবিতরার জঙ্গল। পেছনের দিকে একটা গেট রয়েছে। র মেটেরিয়াল এই জঙ্গলের পথ দিয়েই মন্দিরে ঢোকে। আর আসল কারখানা তো এর মধ্যেই।
তাই! কোথায়?
নিচে। এবার আমরা নিচে যাব। বলে কবি কৃত্তিবাসের মূর্তিটি যে গোলাকার বেদির ওপর বসানো সেই বেদি ধরে ঠেলল চুনি। কৌটোর ঢাকনার প্যাচ যেভাবে খোলা বেদিটাকে সেই স্টাইলেই ঠেলত থাকল। তারপরেই মূর্তিসমেত বেদি একপাশে সরে গিয়ে নিচে খাড়া সিঁড়ি নেমে গেছে দেখা গেল।
দিয়া বলল, ওঃ মাই গড! এ তো পুরো বলিউডের সিনেমা।
এখনো কিছুই দেখেননি দিদি। মন শক্ত করুন। এবার আমরা নরকে ঢুকতে চলেছি। রুমাল সঙ্গে থাকলে নাকে বেঁধে নিন, যদিও নিচে সারাক্ষণ এসি চলে তবু খুব দুর্গন্ধ।
দিয়া রিস্ক নিল না। সঙ্গে সঙ্গে গলার স্কার্ফটা নাকে বেঁধে নিল।
ধীরেসুস্থে আসুন এবার আমার পেছনে।
প্রথমে চুনিলাল তারপর দিয়া আর অরণ্য একে একে নিচে নামল। চুনিলাল বলল এই কৃত্তিবাস মন্দিরই হলো ভয়ংকর কারখানার মেইন গেট। বাইরে থেকে বডি এনে এই পথ দিয়েই নিচে নিয়ে যাওয়া হয়। আসুন। ভেতরে সত্যিই ভ্যাপসা একটা গন্ধ। যদিও মাটির নিচের এই বিশাল হলঘরটায় চারদিকে কনকনে ঠান্ডা তবু চামড়া পচা গন্ধটা নাকে এসে ঝাপটা দিচ্ছে। বিকট গন্ধ। গা গুলিয়ে উঠছে।
এটা কত বড়ো জায়গা চুনিলাল?
অরণ্যর প্রশ্নে চুনি বলল, অনেকটা বড়ো জায়গা দাদা। এখানে অনেকগুলো সেকশন রয়েছে। কসাইখানা থেকে একেবারে ফিনিশিং সবকিছু এই আন্ডারগ্রাউন্ডে হয়। আসুন একে একে সব দেখাচ্ছি।
আচ্ছা চুনিলাল তুমি শিয়োর এখন সিসিটিভিতে আমাদের কেউ খেয়াল করবে না?
না-করার চান্সই বেশি। আসলে এখানে যতক্ষণ কাজ চলে ততক্ষণই সিসিটিভিতে ওয়াচ করা হয়। রাত বারোটার পর মনিটরিং আর তেমন হয় না। তবে কপাল খারাপ থাকলে…যাক, দেখা যাক। আসুন প্রথমে এদিকে। দিয়া আর অরণ্য অবাক হয়ে চারদিকে দেখছিল, মাটির নিচে পুরো একটা কারখানা। চামড়ার জিনিসপত্র বানানোর কারখানা। যে-সে চামড়া নয়, মানুষের চামড়া!
এই যে ঘরটা দেখছেন। এই ঘরটা হলো কসাইখানা। সব থেকে ভয়ংকর ঘর। দরজাবন্ধ একটা ঘরের দিকে আঙুল তুলে দেখাল চুনিলাল। এর ভেতরে দেখার দরকার নেই, সহ্য করতে পারবেন না। রাস্তা থেকে যেসব ফুটপাতবাসী, ভবঘুরে, পাগলদের অজ্ঞান করে ভ্যানে তুলে এখানে নিয়ে আসা হয় তাদের প্রথমে খুন করা হয় এই কসাইখানায়। ধড়-মুণ্ডু আলাদা করে নিয়ে এখানে দুজন কসাই মিলে তার চামড়া ছাড়ায়।
চামড়া ছাড়ায়…মানে কীভাবে? মানুষের চামড়া…দিয়ার মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এলো কথাটা।
যেভাবে মানুষ অন্য প্রাণীদের চামড়া ছাড়ায় ঠিকই একই পদ্ধতি। এখানে যে দুজন এই শরীর কেটে ছাড়ানোর কাজটা করে খুব ধীরেসুস্থে করে, তাড়াহুড়ো করলে চামড়া ছিঁড়ে যেতে পারে। তবে এই দৃশ্য খুব শক্ত মনের মানুষের পক্ষেও সহ্য করা কঠিন। আমার নরপিশাচ চাচা এই নৃশংসতা দেখতে খুব ভালোবাসেন। আমাকে প্রথম দিনই জোর করে এই ভয়ানক দৃশ্য দেখিয়েছিলেন। আমি প্রথমেই অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। আমাকে তারপর জোর করে জ্ঞান ফিরিয়ে আবার দেখানো হয়েছিল। পরপর তিনদিন। ওটা নাকি আমার ট্রেনিং পিরিয়ড ছিল। আসলে চাচা চেয়েছিল আমাকে তার শাগরেদ তৈরি করতে। তার প্রধান কারণ আমার পরিচয়, আমার পরিবার, সাকিন সবকিছু চাচার জানা। ফলে আমি পালিয়ে বা বিশ্বাসঘাতকতা করে পার পাব না চাচা জানে। দুই, আমার শরীর পোক্ত নয়, ফলে এখান থেকে পালানোর শক্তি আর সাহস আমার কোনোটাই নেই। তবু একবার চেষ্টা করেছিলাম। গেটের মুখে ধরা পড়ে গিয়েছি, এখানে বিশেষ কয়েকজন আশ্রমিক ছাড়া আর কারও বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই।
ধরা পড়ার পর কী হলো?
আমাকে মেরে ফেলার কথা হয়েছিল। কিন্তু চাচার জন্য সেবার প্রাণে রক্ষা পাই। চাচা বলে আমি আবার যদি এমন করি তাহলে আমার বাবা-মা, ভাই-বোনেদের সকলকে খুন করে তাদের চামড়া দিয়ে ব্যাগ-জুতো তৈরি করা হবে। বিশ্বাস করুন ওরা সত্যিই তা পারে, আমি আমার মা-বাবা, ভাইবোনদের খুব ভালোবাসি। তাই নিজের জীবন শেষ হয়ে গেছে ধরে নিয়ে আর কোনো চেষ্টা করিনি। তবু মনে মনে ভাবতাম কখনো পুলিশ খোঁজ তো পাবে, অন্যায় করে আজীবন কেউ পার পায় বলুন?
চুনিলাল উত্তেজনায় বেশি কথা বলছে। যাক গে বলুক। অরণ্য বলল, কিন্তু বাইরের লোকেরা তো দেখছি কোনোরকম সিকিউরিটি চেকিং ছাড়াই আসা-যাওয়া করছে। যেমন আমরা এসেছি। আমাদের লাগেজ ব্যাগেজ বা পরিচয়পত্র কিছুই দেখেনি এখানে।
হ্যাঁ যারা দীক্ষা নিতে আসেন বা এমনি আশ্রমে ঘুরতে আসেন তাদের ওই কড়াকড়ির আওতায় রাখা হয়নি। কারণ আশ্রমে যারা আসেন তারা সবই খুব সাধারণ মানুষ, আর এই আশ্রম নিয়ে মানুষের কৌতূহল কম, জঙ্গলে হওয়ার কারণে বেশি ভক্তও আসে না। খুব প্রচার নেই, এরা বেশি প্রচার করেও না। করলে সমস্যা। আর সব থেকে বড়ো কথা বেশি কড়াকড়ি করলে কারও সন্দেহ হতে পারে, সেজন্যই…তবে অদৃশ্য নজরদারি অবশ্যই চলে।
হুঁ…।
কসাইখানা দেখার ইচ্ছে দিয়া আর অরণ্য কারোরই ছিল না। গা শিরশির করছিল ভয়ে। ওই বন্ধ দরজার পেছনে স্তূপ করে রাখা নানা বয়সের মানুষের ছাল ছাড়ানো মৃতদেহ, পড়ে রয়েছে কল্পনা করে গা বমি করছিল দিয়ার। মানুষের মন যে কী বিকৃত হতে পারে তা অকল্পনীয়!
কসাইখানার পাশ দিয়ে ওদের অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছিল চুনিলাল। ফ্ল্যাটের বেসমেন্ট যেমন হয় পাতালঘরটা খানিক ওইরকমই। ছাদ নিচু, ছোটো ডুম জ্বলছে। চুনিলাল বলল চামড়া ছাড়িয়েই কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তা ট্যানারিতে পাঠানো যায় না, এই যে এই ঘরটা দেখছেন এটা কেমিক্যাল রুম। চামড়া ছাড়ানোর পরই সেটা ট্যানারিতে পাঠানো যায় না। মেঝেতে পলিথিন পেতে তাতে ব্রাইন ঢেলে ওই চামড়াগুলো কম করে হলেও সাতদিন ভিজিয়ে রাখতে হয়। তারপর ট্যানারিতে যায়।
ট্যানারিটাও কি এখানেই? জিজ্ঞাসা করল দিয়া।
হ্যাঁ সবকিছু এখানেই। এই যে এখানে ট্যানারি শুরু। ট্যানারিতে তিন রকমের কাজ হয়। প্রথমে হচ্ছে বিমহাউজ অপারেশন। এই যে আসুন।
চুনিলালের সঙ্গে গেল দুজন। কয়েকটা বড়ো ড্রাম রাখা রয়েছে এক জায়গায়। এখানে বিমহাউজ অপারেশন হয়। চামড়া ছাড়ানোর পর এক সপ্তাহ কেমিক্যালে ভিজিয়ে রাখার পর তারপর সেগুলোকে এই ড্রামে ডুবিয়ে ভালো করে ধোয়া হয়। চামড়ার মধ্যে জমে থাকা ময়লা, নুন এসব পরিষ্কার করা হয়। উঁকি দিয়ে দেখুন চামড়া ভেজানো রয়েছে।
দিয়া দেখল না। অরণ্য উঁকি দিলো। সত্যিই ড্রামের মধ্যে লিকুইডে কিছু ফ্যাকাশে সাদা ছাল ডুবিয়ে রাখা। ওগুলো মানুষের! ভাবামাত্র গা গুলিয়ে উঠল। ড্রামের ভেতরে উঁকি দিলো।
আপনারা ছবি নেবেন না? জিজ্ঞাসা করল চুনিলাল।
অরণ্য সামান্য হেসে বলল, দরকার নেই। আমরা দেখে নিচ্ছি সেটাই যথেষ্ট।
আচ্ছা। এই যে এখানে ধোয়ার পর চামড়ার লোম ছাড়ানোর জন্য লাইমিং করা হয়। এই যে এখানে চামড়ায় লাইম মেশানো হয় লোম তুলে ফেলার জন্য। এখানেও প্রায় সপ্তাহখানেক সময় লাগে। এরপর চামড়া যায় ট্রিমিং ও ফ্লেশিং-এর জন্য। এই যে দেখুন এখানে এই কাজটা হয়।
ট্রিমিং ফ্লেশিং মানে? জিজ্ঞাসা করল অরণ্য।
মানে চামড়ার যে অংশগুলো বেশি মাংসল যেগুলো অকাজের সেগুলোকে ছেঁটে ফেলাকে বলে।
ও আচ্ছা।
হুঁ, এখানে বিমহাউজ অপারেশন শেষ। আর এদিকে আসুন।
ওর পাশ দিয়ে একটু এগিয়েই আবার থামল চুনিলাল। এখানটা হলো ট্যানিয়ার্ড অপারেশন। এখানে চার রকমের কাজ হয়। প্রথমে ডিলাইমি অ্যান্ড বেটিং। মানে আগে যে চামড়ায় লাইমিং করা হয়েছিল সেটা এখানে অ্যাসিড আর সল্ট দিয়ে ডিলাইমিং করা হয়। তারপরে পিকলিং মানে সালফিউরিক অ্যাসিড আর নুন মিলিয়ে পিএইচ-কে তিন কি চারে নামিয়ে আনা হয়। এবং এরপরে ট্যানিং। মানুষের চামড়াও অন্য প্রাণীর চামড়ার মতোই ক্রোম ট্যানিং করা হয়। কিছু কেমিক্যাল মিশিয়ে ট্যানিং-এর কাজ চলে। কম করে একদিন লেগে যায় একখণ্ড চামড়াকে ট্যানিং করতে। আর সবশেষে…এই যে এখানে আসুন। আরেকদিকে নিয়ে গেল চুনিলাল, আর এখানে ফিনিশিং অপারেশন হয়। স্যামিং মানে চামড়ার হিউমিডিটি শুকোনো হয়, ডায়িং, ফ্যাটলিকারিং ইত্যাদি কাজগুলো করা হয়।
ডায়িং মানে রং করা তো বুঝলাম, আর ফ্যাটলিকারিং?
ওটা চামড়াকে নরম করার জন্য একরকমের তেল ব্যবহার করা হয়। আর একেবারে শেষে ড্রায়িং করে তারপর পাঠানো হয় টেলারিং-এর জন্য।
এই এতকিছু!
হ্যাঁ এতকিছু।
টেলারিং মানে এই চামড়াগুলো দিয়ে যা সব বানানো হয়?
হ্যাঁ দাদা। তবে সেটা এখানে নয়। ওটা মাধব কন্দলীর মন্দিরের নিচে তৈরি হয়।
উফ্ সেটা আবার আরেক রামায়ণরচয়িতার ঘরে! বাপ রে বাপ! কী ভয়ংকর!
এদিকটা কভার হয়ে যাওয়ার পর চুনিলালকে বলল এবার চলো ওই কসাইখানাটাও দেখব, ওটা সব থেকে বড়ো এভিডেন্স।
দেখবেন?
হ্যাঁ।
চুনিলাল একটু থমকাল। তারপর বলল বেশ। আসুন।
অরণ্য দিয়াকে বলল তুই ঢুকিস না। বাইরে থাক। দিয়া রাজি হয়ে গেল। ওর কোনো ইচ্ছাই নেই ওই বীভৎসতা দেখার।
অরণ্য চুনিলালের সঙ্গে গেল সেই ঘরের সামনে। চুনি বলল, ঘরের ভেতরে এসি পুরো কনকনে ঠান্ডা। তবু নাকে চাপা দিয়ে নিন এবার।
অরণ্য এতক্ষণ নাকে চাপা দেয়নি। যদিও চামড়ার বোঁটকা গন্ধে ওর অস্থির লাগছিল কিন্তু এবার চুনির কথা শুনল। চুনি দরজাটা খুলল। দিয়া বাইরে দাঁড়িয়ে থাকল। ভেতরে ঢুকেই সঙ্গে সঙ্গে আবার দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো অরণ্য। হঠাৎ এত নারকীয় দৃশ্য ও সহ্য করতে পারল না। মিনিট দুয়েক বাইরে ধাতস্থ হয়ে তারপর আবার ঢুকল। ঘরের ভেতরে মাঝখানে একটা চওড়া টেবিল। সেখানে চিত করে শোয়ানো রয়েছে একটা মুণ্ডুহীন মানবশরীর। বুক থেকে লম্বা করে অনেকটা লম্বা করে চিরে দেওয়া। ভেতরে সাদা মাংস দেখা যাচ্ছে। বডিটার হাতদুটো কবজি থেকে আর পাদুটো গোড়ালি থেকে কেটে ফেলা হয়েছে। কী যে ভয়ংকর লাগছে। বমি বমি পাচ্ছে অরণ্যর। ঝুঁকে দেখল। চুনিলাল বেশ অবাক হচ্ছিল অরণ্য সবকিছু বেশি কাছে গিয়ে ঝুঁকে কেন দেখছে।
অরণ্য চুনিলালকে জিজ্ঞাসা করল এখানেই তাহলে ডিসেকশন হয়?
হ্যাঁ। এখানেই।
এই বডিটা কবেকার।
কালই এসেছে।
এমন কি রোজই আসে?
না না মাসে একটা কি দুটো। সেটা নিয়েই সারা মাস কাজ হয়। শুনেছি লক্ষ লক্ষ টাকায় বিক্রি এক একটা আইটেম।
বলো কী!
হ্যাঁ দাদা। সব বিদেশে পাচার হয়। পাচার মানে এমনিই, কাস্টমসের চোখের ওপর দিয়েই যায়। দেখে তো বোঝার উপায় নেই, কীসের চামড়া। একমাত্র চামড়ার ব্যাপারে খুব অভিজ্ঞ লোক অথবা কেমিক্যাল টেস্টেই ধরা পড়বে। আচ্ছা আপনি বলুন তো কোনো দরকার রয়েছে এসবের? জানেন রাস্তাঘাট থেকে নিরীহ মানুষগুলোকে রাতে তুলে নিয়ে এসে এখানে জবাই করা হয়। কী নিষ্ঠুর! ওই যে ওই বড়ো বাক্সটা দেখছেন ওটা আসলে বরফের বাক্স। ওর ভেতরে আরও দুটো বড়ি ছাল ছাড়ানো অবস্থায় পড়ে রয়েছে। কাল হয়তো ওদুটোর গতি হবে।
কী গতি হবে?
এই এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হবে পেছনের মাঠে। ওখানে অ্যাসিড দিয়ে পুরো গলিয়ে ফেলে তারপর মাটিতে পুঁতে দেওয়া হবে। তবে শুনেছি এরপর হাড়গোড়, শরীরের আরও সব পার্টসের নাকি বিজনেস করার কথা ভাবা হচ্ছে।
এখান থেকে বেরোই চলো চুনিলাল। আর থাকতে পারছি না।
হ্যাঁ দাদা চলুন। এই নরকে একমাত্র নরপিশাচ ছাড়া আর কেউ থাকতে পারে না। আমি যে গত কয়েকমাস ধরে কী নরকযন্ত্রণা ভোগ করছি এবার ভাবুন!
হুঁ, বুঝতে পারছি।
ঘরের বাইরে বেরিয়ে যেন রেহাই পেল অরণ্য। এতক্ষণ দম আটকে রেখেছিল। সিদ্ধার্থর কাছে প্রথম যেদিন সেই ছিনতাই হওয়া ব্যাগটার ব্যাপারে জানতে পেরেছিল সেদিন থেকেই কৌতূহল ছিল তীব্র। মনে মনে কিছু ভয়ংকর দৃশ্য কল্পনাও করেছিল, তবে সেটা বাস্তবে যে এতটা ভয়ংকর হবে তা কল্পনা করতে পারেনি। দিয়া তাকাল অরণ্যর দিকে। ওর চোখমুখ দেখেই আন্দাজ করল ঘরের ভেতরে ভয়ংকর কিছু দেখে এসেছে।
আচ্ছা চুনিলাল, এই রামচরণবাবাজিই কি এই সবকিছুর পান্ডা?
তাই হবে। পাক্কা শয়তান একটা। দুশ্চরিত্র। প্রতিদিন ওর মেয়ে চাই। এখানে এলেও মেয়ে লাগে প্রতিরাতে। ওপরে ধর্মের ভেক ধরে মানুষ খুন করে, মেয়েদের নষ্ট করে। খুনও করে।
দিয়া বলল, চুনিলাল ধরো আমরা যদি এখান থেকে পালাতে পারি, যদি এই পুরো চক্রটাকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারি তাহলে তুমি কি সাক্ষী দেবে পুলিশের হয়ে?
হ্যাঁ দিদি এখান থেকে বেরোতে পারলে আমি এদের শাস্তির জন্য যা খুশি করতে পারি।
বেশ তাহলে আমাদের কি এখন একবার ওই মাধব কন্দলীর মন্দিরে নিয়ে যেতে পারবে?
ওখানে ঢোকার সুযোগ আমার নেই দাদা। ওই মন্দিরে ঢোকার সিস্টেম অন্য। আমার জানা নেই। আমার ডিউটি এখানে থাকে বলে আমি জানি।
হুঁ বুঝলাম। ঠিক আছে।
তাহলে দাদা এবার কী হবে?
পুলিশ সব দেখছে আমরা যা যা দেখছি। সুতরাং তারা আশা করছি খুব দ্রুত ব্যবস্থা নেবে!
পুলিশ দেখছে এখন?
হ্যাঁ, সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে হাসল অরণ্য। সিদ্ধার্থ একেবারে আধুনিক প্রযুক্তিতে সাজিয়ে পাঠিয়েছে অরণ্যকে সেটা ও আর বলল না। চলো এখান থেকে বেরোনো যাক।
হ্যাঁ আর দেরি করা ঠিক হবে না। এখানকার মনিটরে রাতে কেউ চোখ রাখে না ঠিকই, কিন্তু রাখলে আমরা ধরা পড়ে যাব। এখান থেকে পালানোর আর কোনো পথ নেই।
সে এখন না দেখলেও পরে রেকর্ডিং যদি কেউ দেখে তাহলেই আমাদের দেখতে পেয়ে যাবে। সুতরাং এখন অত ভেবে লাভ নেই।
আচ্ছা চুনিলাল এই রামচরণবাবাজির সম্পর্কে তুমি কিছু জানো? জিজ্ঞাসা করল দিয়া।
না দিদি কিছুই জানি না। তবে শয়তান লোক এটুকু জানি। অনেক নেতা মন্ত্রীর সঙ্গেও যোগাযোগ রয়েছে। আমার চাচার সঙ্গে এই বাবাজির যোগাযোগ হয়েছিল বেনারসে। সেখানে চাচা এই বাবাজির অনেক সেবা করে খুব কাছের হয়ে ওঠে এবং চাচাকে উনি নিজের খাস চ্যালা করে নেন। এমন বেশ কয়েকজন খাস চ্যালা রয়েছে বাবাজির।
হুঁ। রতনে রতন ঠিকই চিনে নেয়। কিন্তু এরা সবকিছু ছেড়ে কেন মানুষের চামড়ার প্রোডাক্ট তৈরি করে, কীভাবে বিক্রি করে, তুমি কিছুই জানো না, তাই না?
না দাদা। প্রোডাক্ট তৈরি হয় মাধব কন্দলীর মন্দিরে। তারপর ডেলিভারি বয়ের সঙ্গে যোগাযোগের কাজটা আমার চাচা করে।
হুঁ এবং এই ফোনাফুনির কাজটা উনি মন্দিরে বসেই করেন?
সব সময় তা নয়। তবে কখনো তাও করেন।
ও কে। চলো এবার বেরোই। আমাদের যা পাওয়ার পাওয়া হয়ে গেছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
তিনজনে এগিয়ে যেতে গেল ওপরে ওঠার সিঁড়ির দিকে। সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে হলো না। তার আগেই নিচে হুড়মুড় করে নেমে এলো প্রায় সাত-আটজন লোক। কয়েকমুহূর্তের মধ্যে ওদের তিনজনকে চেপে ধরে মুখে কাপড় ঢাকা দিয়ে নিয়ে চলল কোথাও একটা।
২৭
আজ সকালে সিদ্ধার্থ নিজের বাড়িতে ডেকেছিলেন ওর বন্ধু রাকেশকে। ব্যাগটা যে মানুষের চামড়া দিয়ে তৈরি সেটা ফরেন্সিক ল্যাবে টেস্ট করে রাকেশই প্রথম জানিয়েছিল সিদ্ধার্থকে। সিদ্ধার্থ রাকেশকে অনুরোধ করেছিলেন এই বিষয় নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা না করতে। রাকেশ কথা রেখেছে। এখনো পর্যন্ত আর কেউ জানে না খোদ আসামের বুকে এমন ভয়ংকর একটা কাণ্ড হয়ে চলেছে। একদিকে একের পর এক ফুটপাতবাসী ভিখিরি, ভবঘুরেরা মাঝে মাঝেই উধাও হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে মানুষের চামড়া দিয়ে বানানো ব্যাগের সন্ধান। এই দুটো ঘটনার মধ্যে কি কোনো যোগ রয়েছে? এমন কথা ভেবেও শেষে ধন্দে পড়েছেন সিদ্ধার্থ। মানুষের চামড়া দিয়ে কেন? এখনো পশুর চামড়া দিয়ে বানানো জিনিস ব্যান্ড হয়ে যায়নি, এমনকি মানুষের চামড়ার প্রোডাক্টে এমন কোনো বিশেষত্বও নেই তাহলে এসব বানানোর উদ্দেশ্য কী? কারা কেনে, কেন কেনে? আরও অনেক প্রশ্ন সিদ্ধার্থকে অস্থির করে তুলেছিল। তিনি সঠিক উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অগত্যা শেষে রাকেশকেই ফোন করেছিলেন। রাকেশ নিজের কাজটুকু ছাড়াও অনেক বিষয়ে জ্ঞান, বহু বিষয়ে ওর আগ্রহ। কাল রাতে ওর সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময়ে এই প্রশ্নগুলো করেছিলেন তিনি। রাকেশ বলেছিলেন এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, এমন ঘটনা আগেও ইতিহাসে ঘটেছে। শুনে অবাক হয়েছিলেন সিদ্ধার্থ। রাকেশের কাছ থেকে আরও ডিটেলে বিষয়টা জানার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। আজ সকালে রাকেশ এসেছিলেন সিদ্ধার্থর বাড়িতে। কিছুক্ষণ এমনি কথার পরেই সিদ্ধার্থ মূল প্রসঙ্গে এসেছিলেন, তখন রাকেশ প্রথমেই বললেন, ব্যাগটা যে মানুষের চামড়া দিয়ে বানানো তা জানার পর আমিও প্রথমটায় শিউরে উঠেছিলাম। আমি প্রথমে ব্যাগটা হাতে পেয়ে কী চামড়া দিয়ে তৈরি তা খুঁজতে চাইনি, বরং এমন চমৎকার তুলতুলে চামড়ার একটা নতুন কিন্তু ফাঁকা ব্যাগ ফেরত নিতে তার মালিক অস্বীকার করছে কেন সেটা জানার নিছক কৌতূহলেই আমি ওটা নানারকম টেস্ট করতে শুরু করি এবং টেস্ট রিপোর্ট শেষে এই বেরোয়। আমি খুব চমকেছিলাম তারপরে মনে হয়েছিল পৃথিবীতে এত পশুপ্রাণীর চামড়া থাকতে মানুষের চামড়া কেন? এ কেমন খেয়াল? এটা কি পৃথিবীতে প্রথম মানুষের চামড়া দিয়ে তৈরি? যদি তাই হয় তাহলে কেন? যদি না হয় তাহলে এর ইতিহাস কী? তুমি তো জানো নতুন কিছু দেখলেই তা জানার আগ্রহ চূড়ান্ত বেড়ে যায়। বিদেশে আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু রয়েছেন যারা অদ্ভুত অদ্ভুত বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেন। তাদের মধ্যে প্যারিসে থাকে জন, অপরাধতত্ত্ব নিয়ে ওর প্রচুর পড়াশোনা। ওর কাছে এই বিষয়টা নিয়ে আমি জানতে চেয়ে মেইল করি। এবং তার উত্তরে কয়েকদিনের মধ্যেই আমার কাছে লম্বা একটা মেইল পাঠায়, আর সেটা পড়ে আমি স্রেফ অবাক হয়ে যাই। বলে একটু থেমে রাকেশ আবার সিদ্ধার্থকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি হোম অ্যালোন সিনেমাটা দেখেছ?
হ্যাঁ অবশ্যই।
সেখানে শিশু অভিনেতা ম্যাকাউলে কালকিনের অভিনয় মনে রয়েছে নিশ্চয়ই?
মনে নেই আবার! অসামান্য অভিনয় করেছিল বাচ্চাটা।
হুঁ যদিও সে এখন আর বাচ্চা নেই। এই কালকিন আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে প্যারিসে একটি রেডিয়ো সাক্ষাৎকারে ভয়ংকর একটি কথা বলেছিল, ও বলেছিল “হ্যাভ ইউ সিন লেদার প্রোডাক্টস মেড ফ্রম হিউম্যান স্কিন? ইট ইজ ভেরি আনইউজুয়াল, ডিসটিংটিভ লুক। আই লার্ভ অ্যাট এ ভেরি ইয়ং এজ টু আইডেন্টিফাই ইট।’ ম্যাকাউলে এটুকু বলেই শুধু থেমে যায়নি। আরও বলেছিল, যে হলিউডে বিভিন্ন বিভাগে কাজ করে এমন একটা বড়ো অংশ রয়েছে যারা শিশুনির্যাতনকারী, পিডোফেলিক। এমনকি ম্যাকাউলের যখন মাত্র এগারো বছর বয়স তখন ওই হলিউডেরই এক হোমরাচোমরা ওকে খুব অহংকারের সঙ্গে নিজের পায়ের জুতোজোড়া দেখিয়ে বলেছিলেন ওটা নাকি একটি শিশুকে বলি দিয়ে তার চামড়া দিয়ে বানানো হয়েছে। এবং ওই জুতো পরে কাজ করলে তার সব কাজ সফল হয়। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট, ওখানে শিশু আর্টিস্টদের যৌননিপীড়ন করা শুধু নয়, অন্ধ কুসংস্কারের দোহাই দিয়ে শিশুদের হত্যা করে তাদের শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে জিনিসপত্র বানিয়ে এসব মানসিকভাবে বিকৃতমানুষগুলো ব্যবহার করে থাকে। তারমানে এই নয় যে সব শিশুর ক্ষেত্রেই এমন হয়ে থাকে, বা সকলেই বিকৃত। কিন্তু এমন ঘটনাও ওখানে ঘটে থাকে। এই খবরটা দাবানলের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, এবং ফলে নানাভাবে ওই চ্যানেল ও যেসব সাইটস ওই খবরটাকে প্রচার করেছিল তাদের ওপর বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল থেকে চাপ আসতে শুরু করে আর শেষ পর্যন্ত সব মিডিয়াকেই ওই নিউজটা পুরোপুরি মুছে ফেলতে হয়। জন আমাকে অনেকগুলো পেপারকাটিং, বইয়ের পৃষ্ঠার ইমেজ এবং ওয়েবলিঙ্ক দেয়। আমি সেগুলো পড়তে শুরু করি। পড়তে গিয়ে আমিও চমকে উঠি। বলে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রাকেশ বললেন, মানুষের চামড়া দিয়ে জিনিসপত্র বানানোর চল আজকের নয়, বহু প্রাচীন।
প্রাচীন? অবাক হয়েছিলেন সিদ্ধার্থ।
হুঁ। বেশ কিছু বছর আগে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে বহু প্রাচীন বইগুলো নিয়ে গবেষণা করছিলেন একদল গবেষক। শুধু বইয়ের বিষয়বস্তু নয়, কী কী মেটেরিয়াল দিয়ে বইগুলো তৈরি হয়েছিল সেটাও ছিল তাদের গবেষণার বিষয়। গবেষণা চলার সময় তারা এমন তিনটি বই হাতে পেলেন যেগুলো সপ্তদশ শতকে তৈরি। একটা বই ছিল রোমান কাব্যের অন্যটি ফরাসি দর্শনের আর আরেকটি স্পেনীয় আইনের। যে চামড়া দিয়ে বই তিনটি বাঁধানো হয়েছিল তার টেস্ট করে তারা স্তম্ভিত। কারণ তিনটে বই-ই বাঁধানো হয়েছিল মানুষের চামড়া দিয়ে। এবং ওই তিনটি বইয়ের কোনোটিতেই প্রকাশকের কোনো নাম উল্লিখিত ছিল না অর্থাৎ প্রকাশকরা কেউই চাননি এই বইগুলো কারা প্রকাশ করেছিল তা যেন কেউ জানতে না পারে। এবং তারপরেই এই বিষয়টি নিয়ে চারদিকে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। গোটা পৃথিবীর কৌতূহলী গবেষকরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন এই বিষয় নিয়ে আরও জানতে। কাজ শুরু করলেন তারা এবং একের পর এক বিস্ফোরক তথ্য উঠে আসতে থাকল। শেষে পৃথিবীর নানা দেশে সব মিলিয়ে মানবশরীরের চামড়া দিয়ে বাঁধানো মোট আঠারোটি বইয়ের সন্ধান মিলল। মানুষের চামড়া দিয়ে বই বাঁধানোর এই যে চর্চা এর একটা খটমটে নামও রয়েছে, অ্যানথ্রোপোডার্মিক বিবলিওপেজি।
বাপ রে! এর মানে কী!
পুরোটাই গ্রিক শব্দ। বিবলিওপেজির মানে হলো বই বাঁধানো এবং অ্যানথ্রোপোডার্মিক শব্দটার মানে হলো মানুষের চামড়া। তবে বইগুলো বানানোর ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল বেশিরভাগ বই-ই তৈরি হয়েছে বিভিন্ন অস্বাভাবিক ঘটনার প্রেক্ষিতে। এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই অধিকাংশক্ষেত্রেই এই চামড়ার বই বাঁধানোর সঙ্গে যুক্ত ছিল কোনো অস্বাভাবিক মৃত্যু। এই যেমন প্রায় দুশো বছর আগে চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের অ্যানাটমিক্যাল ডিসেকশন সম্পর্কে হাতেকলমে জ্ঞান দিতে দরকারি মৃতদেহের অভাব দেখা দিয়েছিল ব্রিটেনে। এই অভাব পূরণের উপায় হিসেবেই শেষে জন্ম নিয়েছিল ভয়ংকর দুই সিরিয়াল কিলার উইলিয়াম বার্ক ও উইলিয়াম হেয়ার। একসঙ্গে তারা মোট ষোলোজনকে খুন করেছিল। এবং হত্যার পর মৃতদেহগুলো বিক্রি করে টাকা কামাত তারা। এক সময় দুজনই ধরা পড়ল পুলিশের হাতে। যদিও পুলিশকে সহযোগিতা করায় বেঁচে গিয়েছিল হেয়ার। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সাজা খেটে মুক্তিও পেয়েছিল সে। কিন্তু রেহাই পায়নি বার্ক। বার্ককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো। প্রায় পঁচিশ হাজার মানুষের সামনে বার্ককে হত্যা করা হলো। পরদিন এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে সকলের সামনে কাটা হলো বার্কের দেহ। তাকে কাটার সময় অ্যালেক্সান্ডার মনরো নামের এক প্রফেসর তার কুইলটিকে বার্কের রক্তে চুবিয়ে লিখেছিলে, “Th।s ।s wr।tten w।th the blood of W।ll।am Burke, who was hanged at Ed।nburgh. Th।s blood was taken from h।s head।” বার্কের কঙ্কাল এখন এডিনবার্গ মেডিক্যাল স্কুলের অ্যানাটমি মিউজিয়ামে প্রদর্শনের জন্য রাখা আছে। তার ডেথ মাস্ক এবং শরীরের চামড়া শুকিয়ে বানানো বইটি সার্জনস হলো মিউজিয়ামে রাখা আছে।
সিদ্ধার্থ যত শুনছিলেন ততই অবাক হচ্ছিলেন।
তারপর ধরো ব্রিস্টল রেকর্ড অফিসেও এমন একটি বই রয়েছে সেই বইটিও এক প্রেমিকের শরীরের চামড়া দিয়ে তৈরি। প্রেমিকটির নাম ছিল জন হরউড। সে তার প্রেমিকাকে আবেগের বশে খুন করে ফেলেছিল তার ফলে জনের সাজা হলো মৃত্যুদণ্ড। মৃত্যুর পর চিকিৎসক জনের শবব্যবচ্ছেদ করার সময় হঠাৎ ভাবলেন শরীর থেকে কিছুটা চামড়া ছাড়িয়ে একটা বই বাঁধালে মন্দ হয় না। ভাবামাত্র কাজ। তিনি ওই কেস রেকর্ডের কাগজপত্রগুলো সেই জনের চামড়া দিয়ে বাঁধাই করে ফেললেন। বইয়ের ওপরে লিখে দিলেন জন হরউডের আসল চামড়া।
এরকমই ম্যাসাচুসেটসের জেমস অ্যালেন নামের এক ডাকাত ধরা পড়ে মৃত্যুদণ্ড পায়। মরার আগে সে স্টেট প্রিজনের ওয়ার্ডেনের কাছে তার জীবনে করা যাবতীয় অপরাধ স্বীকার করার ইচ্ছা প্রকাশ করে বলেছিল মৃত্যুর পর তার এই অপরাধের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করে শরীরের চামড়া ছাড়িয়ে যেন একটা বই করা হয়। তাই করা হয়েছিল। এমন আরও অনেক অপরাধী রয়েছে যাদের মৃত্যুর পর তাদের শরীরের চামড়া দিয়ে বই বানানো হয়েছে। মানে একটা জিনিস বুঝতে পারছ নিশ্চয়ই এই মানুষের চামড়ায় বাঁধানো বইগুলোর যে ইতিহাস তার সঙ্গে ক্রাইমের একটা সম্পর্ক রয়েছে।
হুঁ সেটাই দেখছি। উত্তর দিলেন সিদ্ধার্থ। কিন্তু তুমি যে কেসগুলো বললে সবকটাই বইয়ের কভার।
শুনে হাসলেন রাকেশ। বললেন, না স্যার শুধু বই নয়, যুগে যুগে ওয়ালেট, জুতো থেকে সিগারকেস কি না বানানো হয়েছে এই মানুষের চামড়া দিয়ে। ফরাসি বিপ্লবের সময়ে পাবলিক সেফটি কমিটির এক হোমরাচোমরা কর্তা ছিলেন সন্ত জাস্ট রোজ। খুব মেজাজি মানুষ। একদিন বিকেলে রোজের কাছে বন্দি বানিয়ে নিয়ে আসা হলো এক অপরূপ সুন্দরী রমণীকে। রোজ জানলেন মহিলাটি বিরোধী পক্ষের গুপ্তচর। রোজ মেয়েটির রূপ দেখে প্ৰথম একটু মজা করতে গিয়েছিলেন কিন্তু সেই মেয়ে রোজের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে এমন গালাগাল দিতে শুরু করল যে রোজ মেয়েটির প্রাণ তো নিলেনই তারপরেও তার অপমানের জ্বালা মিটল না, সার্জন ডেকে নিহত মেয়েটির গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে তাই দিয়ে একটা ওয়েস্টকোট বানিয়েছিলেন এবং দীর্ঘদিন সেই কোট তিনি পরেওছিলেন। আরও পুরোনো ইতিহাস যদি ঘাঁটা যায় তাহলে দেখা যায় আজ থেকে প্রায় চারশো বছর আগে ফ্রান্সের রাজা ত্রয়োদশ লুই তাঁর প্রাসাদে একটা মিউজিয়াম তৈরি করেছিলেন সেখানে মানুষের চামড়া দিয়ে তৈরি একজোড়া জুতো রাখা ছিল। এবং মানুষের চামড়ায় তৈরি জুতোর তো ছড়াছড়ি। এছাড়া ওয়ালেট, সিগারকেস, বেল্ট, এমনকি ঢোলও তৈরি হয়েছে মানুষের চামড়া দিয়ে।
ঢোল! মানে বাজানোর ঢোল! আঁতকে উঠলেন সিদ্ধার্থ।
হ্যাঁ ভাই বাজানোর ঢোল। সে আজ থেকে প্রায় ছশো বছর আগে চেক প্রজাতন্ত্রের এক জেনারেল তার নাম ছিল জান জিসকা, সেই সময়ের এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিলেন। এই যে যুদ্ধে ট্যাংক ব্যবহার করা হয় সেটার ভাবনাও ওনার মাথাতেই প্রথম এসেছিল তারপর ধরো এই যে গানপাউডার ব্যবহার, সেটাও ওনারই মস্তিষ্কপ্রসূত। তো এই জান জিসকা ১৪২৩ সালে সিভিল ওয়ার ঠ্যাকানোর জন্য হাঙ্গেরি থেকে অস্ট্রিয়া তারপর মরাভিয়ার দিকে রওনা দিয়েছিলেন। পথে প্লেগ রোগে আক্রান্ত হন। যখন বুঝতে পারলেন আর বাঁচবেন না তখন অনুচরদের ডেকে নিজের শেষ ইচ্ছে জানালেন যে তার মৃত্যু হলে যেন তার শরীর থেকে চামড়া ছাড়িয়ে তা দিয়ে একটি ঢোল বানানো হয় এবং তার সৈনিকরা যেন সেই ঢোল প্রথমে বাজিয়ে তারপর যুদ্ধ শুরু করে। ভাবো মরে গিয়েও কেমন যুদ্ধ করার বাসনা ছিল তার। এবং সেই ঢোল সত্যিই বানানো হয়েছিল।
এরপর আরও অনেক অনেক প্রাচীনকালের তথ্য রাকেশ দিলেন সিদ্ধার্থকে। এসব শোনার পর সিদ্ধার্থ শুধু একটাই প্রশ্ন করলেন, কিন্তু এসবই ইতিহাসের কথা। এখনো এসব!
তাহলে তোমাকে আরও একটা তথ্য দিই সিদ্ধার্থ। এই মাসকয়েক আগে ইউকের একটা ওয়েবসাইটকে ব্যান করা হয়। সাইটটার নাম ছিল হিউম্যানলেদার ডট কো ডট ইউকে। আমি এমন সাইটের কথা জানতাম না। আমার ওই বন্ধুই সাইটটার কথা উল্লেখ করেছিল ওর ওই লম্বা ইনফোতে। সাইটটা জানার পর নেটে এই বিষয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে দেখতে পেলাম সত্যিই সাইট ব্লক্ড হয়েছে কিন্তু অন্যকিছু সাইটে ওই লেদার সাইটের হোমপেজে আরও কিছু বেসিক ইনফোর কপি পেস্ট রয়েছে। পড়ে বেশ অবাক হলাম। এই একবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের মতো একটি সভ্য দেশের একটি কোম্পানি গলার শির ফুলিয়ে দাবি করছে তারা মৃত মানুষের চামড়া দিয়ে নানারকমের জিনিস বিক্রি করে। তবে সব প্রোডাক্টই খুব দামি। একটা এটুকু জেন্টস ওয়ালেটের দামও ন্যূনতম চৌদ্দ হাজার ডলার থেকে শুরু হয়। এবং ওই কোম্পানির কী বক্তব্য ছিল তোমাকে দেখাচ্ছি দাঁড়াও, বলে মোবাইলে নেট খুলে একটা সাইট ওপেন করে বললেন, এটা পড়ে দেখো। কিছুটা আন্দাজ পাবে।
সিদ্ধার্থ দেখলেন ওই কোম্পানির হোমপেজের স্ক্রিনশট এই সাইটের ওয়ালে পেস্ট করা। ওই হিউম্যান লেদার কোম্পানির দাবি ছিল তারা তাদের উচ্চমানের ক্রেতাদের জন্য সব থেকে ভালো মানের মানুষের চামড়ার জিনিসপত্র বিক্রি করে। সেসব জিনিসের মান এবং কদর এই পৃথিবীর খুব কমসংখ্যক উচ্চবিত্ত এবং শৌখিন মানুষই দিতে পারবেন। তবে তাদের কোনো আউটলেট নেই। ফোন নম্বর ঠিকানা কিছুই নেই। এবং তাদের প্রোডাক্টের পরিমাণও খুবই সীমিত। যদি কেউ কিছু কিনতে আগ্রহী হয় তাহলে নিজের ডিটেল দিয়ে সাবমিট করলে কোথায় কীভাবে পেমেন্ট করতে হবে তা জানিয়ে দেওয়া হবে। জিনিসের মান নিয়ে কোনো আপস তারা করে না। তাই আগ্রহী ক্রেতা নিশ্চিন্তে আগে পেমেন্ট করতে পারেন। তবে অর্ডার দেওয়ার পর কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। কারণ কোনো মালই আগে থেকে তৈরি করা থাকে না। অর্ডার পাওয়ার পর তৈরি করা হয়।
এবং তার নিচে লেখা কেন তাদের প্রোডাক্টগুলোর এমন অত্যধিক দাম! কারণ মানুষের চামড়া এমনিতেই সহজলভ্য নয়, তারপর সেই স্কিনকে অনেকরকম প্রসেসিং-এর মাধ্যমে লেদারে পরিণত করে তারপর খুব দক্ষ কারিগরের দ্বারা সেটা বানানোতে অনেক খরচ ও সময়সাপেক্ষ। তাই এসব জিনিসের দাম অনেক বেশি।
এরপর মানুষের চামড়ার কোন প্রোডাক্টের কত দাম তার একটা লিস্ট ছিল। সেই দামের বহর দেখে চোখ কপালে উঠল সিদ্ধার্থর।
হিউম্যান লেদার ওয়ালেট- ১৪০০০ ডলার
হিউম্যান লেদার বেল্ট- ১৫৭৪০ ডলার
হিউম্যান লেদার শু- ২৭০০০ ডলার
হিউম্যান লেদার ব্যাগ- ৩২০০০ ডলার
হিউম্যান লেদার জ্যাকেট- ৫০০০০ ডলার।
নিজেদের সম্পর্কে আরো বেশ কিছু কথা বলা রয়েছে সাইটটায়। সেগুলোয় চোখ বুলিয়ে মোবাইল রাকেশকে ফেরত দিয়ে সিদ্ধার্থ বললেন, মানুষের রুচি কী বিকৃত! মানুষ হয়ে একটা মৃত মানুষের চামড়ার জিনিস ব্যবহার করতে গা ঘিনঘিনও করে না! আবার লাখ লাখ টাকা দিয়ে সেগুলো কেনে! ছি! আর সব থেকে বড়ো কথা হলো এমন একটা কোম্পানি ব্রিটেনের মতো জায়গায় বুক চিতিয়ে এমন ইললিগাল ব্যবসা করে যাচ্ছিল!
হুঁ, তবে এটা নিয়ে খুব শোরগোল শুরু হয়, বহুমানুষ আপত্তি জানাতে শুরু করেন। এটা অমানবিক, বিকৃতরুচির এবং বিশেষ করে এত মানুষের চামড়া তারা পাচ্ছে কোথা থেকে সেই প্রশ্নও উঠতে থাকে নানা মহল থেকে। তখন গভর্নমেন্ট উঠেপড়ে লাগে। সাইটটা ব্যান করে দেয়।
এখন প্রশ্ন হলো সাইট না হয় ব্যান হয়েছে কিন্তু কাজকর্ম ব্যান হয়েছে কি?
হুঁ সেটাই কথা। আর তার থেকেও বড়ো দুশ্চিন্তার বিষয় হলো ভারত এমন ভয়ংকর একটা বিজনেসের ইউনিট কীভাবে হলো? ইন্ডিয়ানরা এসব প্রোডাক্ট ব্যবহার করবে বলে মনে হয় না। প্রথমত, তাদের হাতে এত টাকা নেই। আর দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় সংস্কারে বাধবে।
ধর্মের কথা আর বোলো না ভাই, যা দেখছি আমাদের দেশে ধর্মের আড়ালেই সব থেকে বেশি অধর্মের ব্যবসা হয়।
হুঁ সেই।
রাকেশ চলে যাওয়ার পরে সিদ্ধার্থ বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তারপর পুলিশ কমিশনারের দপ্তরে ফোন করে একটা আর্জেন্ট অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইলেন। আর দেরি নয়, এবার অ্যাকশনের সময় হয়ে এসেছে। উঁচুমহলের সাহায্য দরকার।
২৮
দিয়া, অরণ্য আর চুনিলাল — তিনজনকে মেঝেতে বসিয়ে রাখা ছিল। তিনজনেরই হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। পা-ও বাঁধা। ওদের ঘিরে দাঁড়িয়েছিল অন্তত জনাদশেক আশ্রমিক। শেষরক্ষা হয়নি। বেরোনোর ঠিক মুখেই ওদের ধরে ফেলেছিল আশ্রমের গোপন রক্ষীরা। তারপর তিনজনেরই মুখ কাপড়ে ঢেকে বেশ কিছুটা পথ টেনে নিয়ে গিয়েছিল কোথাও। মুখের ঢাকনা যখন সরানো হলো তখন তিনজনই দেখল একটা ঘরের মাঝখানে তিনজন বসে। ওদের ঘিরে রয়েছে অনেকজন। ওই অনেকজনের মধ্যে চুনি বেশ কয়েকজনকে চিনতে পারল, তবে তাদের মধ্যে নিজের চাচাকে দেখতে পেল না।
লোকগুলো চুপ করে দাঁড়িয়েছিল ওদের তিনজনকে ঘিরে। অরণ্য শুধু সামান্য মাথা নিচু করে দেখে নিল ওর গায়ে পরা জ্যাকেটটা ঠিকমতো রয়েছে কি না। কারণ এটাই একমাত্র অস্ত্র ওর। মিনিটকয়েক কাটল চুপ করে। অরণ্য তাকাল দিয়া আর চুনিলালের দিকে। চুনিলাল থিরথির করে কাঁপছে। দিয়াও অরণ্যর দিকে তাকাল। কেউ কোনো কথা বলল না। চোখের ইশারাতেই দুজনে বুঝে গেল পরের পদক্ষেপ। অপেক্ষা করতে থাকল।
কিছুক্ষণ পরেই ঘরের মধ্যে ঢুকলেন বাবাজি সঙ্গে আরও তিনজন যাদের মধ্যে চুনিলালের চাচাও রয়েছেন। বেশ হন্তদন্ত হয়েই ঢুকলেন বাবাজি। চোখ লাল, মেজাজ যে তার কাঁচা ঘুম ভাঙার ফলে তিরিক্ষে হয়ে আছে সেটা স্পষ্ট। ঘরে এসেই আগে দুলারামকে বাবাজি জিজ্ঞাসা করলেন কোনটা? এইটা? প্রশ্ন করে আর উত্তরের অপেক্ষা করলেন না তিনি, চুনিলালের সামনে এসে ওর বুকে গদাম করে এক লাথি মারলেন। চুনিলাল ওই আঘাতে ককিয়ে উঠল। আবার পেটে একটা লাথি। আরও একটা। কাতর আর্তনাদ করতে শুরু করল রুণ ছেলেটা।
শুয়োরের বাচ্চা, কালসাপ হয়েছ? এই কাল সকালে এটার জ্যান্ত ছাল ছাড়াবি। গর্জে উঠল বাবাজি। সকালের সেই হাসিহাসি প্রশান্ত মুখ এখন ক্রুদ্ধ বাঘের মতো, চোখদুটো ধকধক করে জ্বলছে।
বাবাজি ফিরে তাকালেন দুলারামের দিকে। কাকে কাজে নিয়েছিস? এতদিন কাজ করছিস মাথায় এটুকু বুদ্ধি নেই কাকে দিয়ে কোন কাজ হয়? সব অপদার্থের দল! আর মনিটরে কারা বসে? রাতে কি ডিউটি ফেলে ঘুমানো কাজ তাদের? জানি না বস কী সিদ্ধান্ত নেবেন। সবকটার ছাল ছাড়াতে বলবেন।
শুনে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সকলের মুখ শুকিয়ে গেল। দুলারাম এগিয়ে এসে তার ভাইপোর চুলের মুঠি ধরে গদাম করে একটা ঘুসি মারল মুখে। নাক ফেটে রক্ত বেরোতে শুরু করল চুনিলালের। বেচারা আর সহ্য করতে পারল না, অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে।
অরণ্য আর চুপ থাকতে পারল না। বলে উঠল ওকে মারবেন না। ওর কোনো দোষ নেই। কাজটা করতে আমি ওকে বাধ্য করেছিলাম।
তোর ব্যবস্থা হচ্ছে। দাঁড়া। বস একটু পরে ফোন করবে। তারপর দেখি কী বলেন।
একজন একটা চেয়ার এনে রাখল ঘরের মাঝখানে। বাবাজি বসলেন। অরণ্যর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, যা যা জিজ্ঞাসা করব তা ঠিক ঠিক জবাব দিবি।
দেবো। বলুন কী জানতে চান?
এই ওদের বডি চেক করেছিস?
হ্যাঁ। উত্তর দিলো একজন। শুধু মেয়েটার কাছ থেকে একটা মোবাইল পাওয়া গেছে।
কেন ছেলেটার নেই?
না।
তোর মোবাইল কই?
জানি না, পকেটেই তো ছিল, তখন ধস্তাধস্তির সময় কোথাও পড়ে গেছে।
হুঁ, এই ওর মোবাইল দেখ কোথায় পড়েছে। ওটা দেখা দরকার।
অরণ্য মনে মনে ভাবল, প্রথমত, দিয়ার মোবাইল ঘেঁটে তেমন কিছুই পাবে না। কারণ আজ বেরোনোর আগে প্ল্যানমাফিক ওর মোবাইল থেকে কল লগহিস্ট্রি ইত্যাদি যাবতীয় যা যা সন্দেহযোগ্য সবকিছু ডিলিট করে দিয়েছিল। এমনকি রুমে ল্যাপটপেও তাই। এসব প্ল্যান অবশ্য পুলিশ ইনস্পেকটর সিদ্ধার্থরই। ধরা পড়ে গেলে কী কী হতে পারে তার প্রিকশনের ব্যাপারে দুরন্ত সব প্ল্যান দিয়েছিলেন উনি। সেমতোই এগিয়েছে ওরা। এখনো সেই প্ল্যানমাফিকই চলছে, অবশ্য প্ল্যানমাফিক চলছে কি না তা বোঝার উপায় অরণ্যর নেই, আর চললেও শেষরক্ষা হবে কি না তাও জানা নেই। আর জঙ্গলে রুমালে প্যাচানো অরণ্যর মোবাইল যদি এখনো তার কাজ করতে থাকে তাহলে হয়তো সামান্য সম্ভাবনা রয়েছে নয়তো শেষ পর্যন্ত কপালে কোনো ধনকুবেরের বেল্ট কিংবা ওয়ালেট হয়ে থাকা রয়েছে।
বাবাজি অরণ্যকে জিজ্ঞাসা করল, তোরা কে? কীজন্য এসেছিস এখানে? কোথা থেকে এসেছিস?
অরণ্য বলল, আমরা সাংবাদিক। কলকাতা থেকে গৌহাটি ঘুরতে এসেছিলাম। এই আশ্রমের কথা শুনে এমনিই ঘুরতে এসেছিলাম, কিন্তু যখন সূর্যমন্দিরে গেলাম সেখানে ওই পূজারিজি কারো সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন সেটা আমরা শুনতে পাই, শুনে সন্দেহ হয় আমাদের। তারপরই রহস্যটা জানার জন্য এখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। এবং ওই পূজারিজির সঙ্গে ভাইপো চুনিলালের সম্পর্কও যে ভালো নয়, এরা বাইরের লোকের সামনে ওপেনলি এমন ঝগড়া করে তা শুনলে যে-কেউ সন্দেহ করবে যে এখানে কিছু গন্ডগোল রয়েছে।
বাজে কথা সব বাজে কথা! গর্জে উঠল দুলারাম।
বাজে কথা যদি হয় তাহলে বলুন আপনি ঠিক গতপরশু বেলার দিকে মন্দিরে বসে আপনার ভাইপোকে শাসাচ্ছিলেন কি না। এবং কী কী বলেছিলেন আমরা দুজনেই শুনেছি। এই বলে গড়গড় করে কাকা-ভাইপোর সেই আলোচনা বলে দিলো অরণ্য। ওটা যে স্পাই ক্যামেরার রেকর্ডিং শুনে বলা সেটা কারও মাথায় এলো না।
বড়ো বাবাজি কটমট করে তাকালেন দুলারামের দিকে। অপদার্থ, সব গরু গাধাদের নিয়ে আমি কাজ করতে নেমেছি! কাকে বিশ্বাস করব আমি? কাকে করব? হুংকার দিয়ে উঠলেন তিনি।
দুলারাম পুরো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কী বলবে বুঝতে পারল না। হাঁ করে তাকিয়ে থাকল অরণ্যর দিকে।
দিয়া বলল, তবে আপনি যে বিশ্বাসঘাতক সেটা কিন্তু বাবাজিকে এখনো বলিনি। বলব?
কী বললি আমি বিশ্বাসঘাতক! মেজাজ হারিয়ে দিয়াকে মারার জন্য ছুটে যেতে গেল দুলারাম। পারল না, বাবাজি থামাল ওকে। দিয়াকে বলল কী করেছে দুলারাম?
বলতে পারি, কিন্তু সকলের সামনে নয়।
কেন?
এমন অনেককিছুই আমরা শুনেছি, দেখেছি যা হয়তো এই ঘরের অনেকে জানে না, তাদের সামনে বলা কি ঠিক হবে? আপনি যদি বলেন তাহলে বলতে পারি।
বাবাজি থমকাল। ঘরের সকলকে বাইরে বেরিয়ে যেতে বলল।
এবার ঘরে শুধু বাবাজি। বাজখাঁই গলায় জিজ্ঞাসা করল, বল কী বলবি?
আপনার এখানে অনেক বিশ্বাসঘাতক রয়েছে। ওই যে দুলারাম যাকে আপনি নিজের খাস লোক ভাবেন সে কিন্তু ভেতরে ভেতরে দল পাকাচ্ছে, আপনাকে শেষ করে নিজে সবকিছুর দখল নেবে।
শুনে হো-হো করে হাসল বাবাজি। বলল এসব গালগল্প শুনিয়ে সময় নষ্ট করিস না। কাজের কথা কিছু থাকলে বল।
অরণ্য বুঝল বিপদ। সিদ্ধার্থ যদি এখন ওদের অবস্থা জেনেও থাকে তাহলেও এখানে ঢুকতে যতক্ষণ সময় লাগবে ততক্ষণ সময় যেভাবে হোক কাটাতেই হবে।
আমার কিছু বলার ছিল।
কী? বলে অরণ্যর দিকে তাকাল বাবাজি। তখনই ওর ফতুয়ার পকেট থেকে মোবাইল বেজে উঠল। স্ক্রিনে নম্বরটা দেখেই বেশ তটস্থ হয়ে কানে ফোন নিয়ে বলে উঠল, হ্যাঁ স্যার বলুন…না স্যার মনে হয় না…বলছে সাংবাদিক…হুঁ কলকাতা থেকে স্যার। হুঁ…কথা বলতে বলতে অরণ্যর দিকে তাকিয়ে বাবাজি জিজ্ঞাসা করলেন কী নাম তোদের?
আমি অরণ্য আর ও আমার বন্ধু দিয়া। সত্যি কথাই বলল অরণ্য। ফালতু নাম লুকিয়ে কোনো লাভ নেই।
স্যার নাম বলছে অরণ্য আর দিয়া।
নামদুটো বলার পরেই মহন্ত একটু থমকাল… কী স্যার… দেখবেন স্যার? আচ্ছা এখুনি দিচ্ছি…হ্যাঁ। বলে ফোন কেটে অরণ্য আর দিয়ার একটা ছবি তুলল মোবাইলে, তারপর কাউকে সেই ছবি পাঠাল।
এক মিনিটও পার হলো না। আবার ফোন এলো বাবাজির নম্বরে। হ্যাঁ স্যার… অ্যা…কথা বলবেন? মেয়েটার সঙ্গে? আচ্ছা দিচ্ছি স্যার…বলতে বলতে মোবাইল দিয়ার দিকে এগিয়ে দিতে গিয়ে ওর খেয়াল হলো দিয়ার হাত পিছমোড়া করে বাঁধা, ফোন হাতে ধরতে পারবে না। তখন মোবাইলের স্পিকার অন করে দিয়ে বলল হ্যাঁ স্যার এই নিন কথা বলুন।
ফোনের ওপ্রান্ত থেকে বিশুদ্ধ সাহেবি অ্যাকসেন্টে ইংরেজিতে প্রশ্ন হ্যালো, ইয়ং লেডি কেমন আছো?
কে? চমকে উঠল দিয়া।
চিনতে পারলে না? কিন্তু তুমি ওখানে পৌঁছলে কী করে? আর এসব কেন করতে গেলে বলো তো! খুব খারাপ লাগছে আমার।
আপনি কে?…গলাটা বড্ড চেনা তবু চিৎকার করে উঠল দিয়া, কে আপনি?
চিনতে পারছ না? আমি কিন্তু তোমাকে একজন বুদ্ধিমতী সাংবাদিক ভেবেছিলাম।
আমি চিনতে পারছি আপনার গলা, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছি না।
হাহাহা আচ্ছা বলো দেখি আমার নাম?
ক্রেট! আপনি! শিউরে উঠে বলল দিয়া। নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না ও।
অরণ্যও হতভম্ব! এ সত্যিই অভাবনীয়। শেষ পর্যন্ত ক্রেট!
যাক চিনেছ তাহলে। ভেরি গুড। খুব ঠান্ডা গলায় বলল ক্রেট। কিন্তু তোমরা এসেছিলে শিলং-গৌহাটি টুর করতে এবং আমার ইন্টারভিউ নিতে, আমার তোমাকে বেশ ভালো লেগেছিল। কিন্তু তোমরা এখানে কীভাবে ঢুকলে বলো তো? আগে থেকে কোনো ইনফরমেশন ছিল নাকি?
দিয়া কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই অরণ্য বেশ জোর গলায় বলে উঠল তার মানে এই পুরো কর্মকাণ্ডের নাটের গুরু হলেন আপনি। মিস্টার ক্রেট। তাইতো?
অরণ্যর গলা শুনে ক্রেট বলল, মোবাইল স্পিকারে রেখেছ রামচরণ? হ্যাঁ স্যার আসলে ওদের হাত বাঁধা।
আচ্ছা। যাহোক ইয়ং লেডি, আমি ভেবেছিলাম তুমি একদিন ভালো সাংবাদিক হবে, কিন্তু এই জন্মে আর সেই সুযোগ তো পেলে না।
দিয়া বলল না পেলাম না। আপনার কারখানায় আমাদের চামড়া ছাড়িয়ে একটা কিছু বানিয়ে বিক্রি করে দেবেন আর কি। কিন্তু আপনি কি গৌহাটিতে ফিরে এসেছেন?
কেন বলব?
অরণ্য উত্তরে বলল, দুজন বন্দি মানুষ, যারা আর কিছুক্ষণ পর আপনার চ্যালাদের হাতে খুন হবে, তাদেরও সত্যি কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন! খুব লজ্জা পেলাম। কথাগুলো বলে আপ্রাণ উসকানোর চেষ্টা করছিল অরণ্য। যদিও ক্রেটের মতো ধুরন্ধর ব্যক্তি এসব উসকানিতে সাড়া দেবে না তা ধরাই যায় তবু চেষ্টা করল।
ক্রেট উত্তর দিলো, কী হবে জেনে?
দিয়া বুঝতে পারল অরণ্য কেন জানতে চাইছে ক্রেটের বর্তমান অবস্থান। তাই ও-ও জিজ্ঞাসা করল আপনি তো দিল্লি গিয়েছিলেন, ওখানেই রয়েছেন?
কী করবে জেনে? আমার ইন্টারভিউ নেবে?
না, আপনাকে কাছে পেলে আপনার গালে সজোরে একটা থাপ্পড় মারতাম। আপনি আসলে মানুষ নামের একটা পিশাচ। ওপরে মানুষের সেবা করার ভড়ং দেখিয়ে গোপনে নিরীহ মানুষকে খুন করে তাদের শরীর নিয়ে ব্যবসা করেন। ছি!
আবারও হো-হো করে হেসে উঠল ক্রেট। বলে উঠল তা ঠিক। কিন্তু এটাই আমার পছন্দ। ভালোকথা, রামচরণ শোনো মেয়েটির স্কিন কোয়ালিটি বেশ ভালো। ওরটা দিয়ে ভালো ব্যাগ হবে। আর ছেলেটারটা দেখছি, অ্যাকিন আছে নাকি সামনে?
না স্যার ওকে ডাকিনি, ডাকব?
নাঃ থাক, ঘুমোচ্ছে, কাল ওকে বলে দেবো।
আচ্ছা স্যার।
অ্যাকিন…অ্যাকিন…ওঃ সেই হোটেলের নিগ্রোটা যে চামড়ার ব্যাগটা নিজের বলতে অস্বীকার করেছিল তারপর আচমকাই হোটেল ছেড়ে গায়েব। মানে অ্যাকিন এখানেই গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে।
কথাগুলো এমনভাবে বলল ক্রেট যেন মুরগি কেমনভাবে ছাড়ানো হবে সেই বিষয়ে দোকানিকে পরামর্শ দিচ্ছে। অবশ্য এর বেশি কিছু এই বিকৃত মানুষটির কাছ থেকে কিইবা আশা করা যায়। তবু বিশ্বাস হচ্ছিল না।
তাহলে আপনি বলবেন না আপনি কোথায়?
অতি কৌতূহলে বিড়াল মরে জানো তো?
আমরা তো মরতেই চলেছি, কিন্তু অবাক হচ্ছি আপনি এতদূরে থেকে এই সামান্য খবরটুকু দিতেও ভয় পাচ্ছেন।
হাহাহা। আচ্ছা ইয়ং লেডি আর কোনো শেষ ইচ্ছা রয়েছে নাকি?
নাঃ আপনার কাছে শেষ ইচ্ছে জানানোর কোনো ইচ্ছে নেই আমাদের। তবে আমাদের সত্যিই বিশ্বাস হচ্ছে না ক্রেট আপনিই যে…
আমারও তো বিশ্বাস হচ্ছে না তোমরা খামোখা এর মধ্যে জড়ালে কী করে! কিন্তু এটা স্বীকার করছি তোমাদের বুদ্ধি রয়েছে। ঠিক আছে। তাহলে কোনো শেষ ইচ্ছে নেই বলছ?
আছে। আপনার ইন্টারভিউ নেওয়া। সাংবাদিক হিসেবে একজন জ্যান্ত পিশাচের ইন্টারভিউ নেওয়ার লোভ আমি ছাড়তে পারছি না মিস্টার ক্রেট।
শুনে আবারও হো-হো করে হেসে উঠল ক্রেট। বলল, তুমি সত্যিই জিনিয়াস। অনেককিছু করতে পারবে, যাক এবারে হলো না। পরের জন্মে আশা করি। গুড বাই। রামচরণ…
হ্যাঁ স্যার বলুন।
বুঝে নিয়ো তুমি।
হ্যাঁ স্যার। কাল দীক্ষার দিন রয়েছে। আমি ব্যস্ত থাকব। তবে অ্যাকিন সাহেব থাকবেন।
ও কে। আর এসব কী হচ্ছে বাবাজি? কী সিকিউরিটি রেখেছ আশ্রমের! তিনটে লোক রাতে আন্ডারগ্রাউন্ডে ঢুকে পড়ল, এতক্ষণ ঘোরাঘুরি করল আর সেটা এত পরে জানা গেল। যদি ওরা বেরিয়ে যেত কী হতো তাহলে? এবার ছেড়ে দিচ্ছি, আবার এমন ভুল হলে এর ফল কিন্তু তোমাকে ভুগতে হবে। কাদের নিয়ে কাজ করছ তুমি? কীভাবে বাইরের লোক পৌঁছে যাচ্ছে? এবার থেকে মন্দিরে যারা আসবে সকলের ভালোমতো চেকিং এবং ডিটেল নেবে, আর আশ্রমে সন্দেহজনক যতজন রয়েছে সকলের লিস্ট আমার কাছে পাঠাও আমি ব্যবস্থা করব।
হ্যাঁ স্যার। সরি স্যার, আমি দেখছি। আর হবে না।
হুঁ, মনে থাকে যেন। এটা শেষবার। ফোন কেটে দিলো ক্রেট।
আর ঠিক তখনই বাইরে থেকে একজন ছুটে এসে ঘরে ঢুকে বলল, বাবাজি পুলিশ!
২৯
আজ রাতে মিশনে বেরোনোর সময় সিদ্ধার্থ যে জ্যাকেটটি অরণ্যকে পরতে বলেছিলেন সেটার বুকের প্রথম বোতামটি একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন নাইট ভিসন স্পাই ক্যামেরা। অডিয়ো এবং ভিডিয়ো দুটোই গ্রহণ করার ক্ষমতা এর রয়েছে। জ্যাকেটের বাকি বোতামগুলোও হুবহু একইরকম ফলে একেবারে সামনে এসে প্রতিটি বোতাম খুঁটিয়ে না দেখলে কারও বোঝার সাধ্য নেই এর মধ্যে প্রথমটি স্পাই ক্যামেরা। তবে এই ক্যামেরার ট্রান্সমিট করার ক্ষমতা খুব দূর পর্যন্ত নয়। তবে পাঁচশো গজ রেডিয়াস পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। সেজন্য সিদ্ধার্থ অরণ্যর মোবাইলে একটি বিশেষ অ্যাপ ডাউনলোড করে দিয়ে ওকে সেদিনই শিখিয়ে দিয়েছিলেন কীভাবে এই অ্যাপ অ্যাকটিভ করে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকা ওই স্পাই ক্যামেরার যাবতীয় অডিয়ো-ভিডিয়ো অনেক দূরে বসে থাকা কোনো ব্যক্তি লাইভ ওয়াচ করতে পারেন। মানে স্পাই ক্যামেরা তার ভিডিয়ো পাঠাবে মোবাইলে আর মোবাইল সেটা ট্রান্সমিট করবে পৃথিবীর যে- কোনো প্রান্তে থাকা নির্দিষ্টি ব্যক্তিকে। শুধু মোবাইল সিগন্যাল ঠিকঠাক থাকা দরকার। মানে হোয়াটস অ্যাপ ভিডিয়ো কল যেমন হয় আর কি। অরণ্য ব্যাপারটা শিখে নিয়েছিল এবং সেমতো আজ রাতে অ্যাকশনে বেরোনোর পর ওই সূর্যমন্দির থেকে একটু দূরে মোবাইলে সেই অ্যাপটা অন করে, ক্যামেরার সঙ্গে ম্যাচ করিয়ে অন্ধকারে লুকিয়ে রেখে দিয়েছিল। এবং তারপরে আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্যাক্টরিতে ঢুকেছিল। আর তারপর থেকে প্রতিটি মুহূর্ত শব্দসমেত দেখে গেছেন সিদ্ধার্থ। পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে অরণ্য ও দিয়ার পরিচয়সমেত সব কথাই ডিটেলে জানিয়েছিলেন তিনি। এবং আজ রাতে যে বড়োসড়ো মিশন হতে চলেছে সেটাও বলেছিলেন। সবকিছু শুনে, এবং কিছু তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে কমিশনার সিদ্ধার্থকে বলেছিলেন এই মিশনে তাকে সবরকমের সাহায্য করা হবে। আজ সেই প্ল্যানমাফিক বিশেষ প্রশিক্ষিত পুলিশবাহিনীকে প্রস্তুত করা হয়েছিল। সিদ্ধার্থ ছিলেন এই মিশনের ক্যাপ্টেন। অরণ্য আর দিয়ার আন্ডারগ্রাউন্ডে ঢোকা থেকে প্রতিটি বিষয় দেখা এবং শেষে ধরা পড়া সবই নিজের ডিভাইসে লাইভ দেখছিলেন। স্পাই ক্যামেরার জিপিএস বলে দিচ্ছিল অরণ্যর লোকেশন। ঘরের ভেতরে যখন ওদের তিনজনকে ধরে জেরাপর্ব চলছে তখন স্পেশাল ফোর্স ধীরে ধীরে ঢুকল আশ্রমচত্বরে। চারদিকে ঘিরে ফেলে শেষে আচমকাই হানা দিলো সেই ঘরে যেখানে বড়ো বাবাজি এবং অরণ্যরা রয়েছে। কেউ আর পালানোর সুযোগ পেল না। গ্রেফতার হলো সব কালপ্রিট। পুলিশ ভ্যানে চেপে যখন ওরা রওনা দিলো এই আশ্রম ছেড়ে তখন ভোরের আলো সবে ফুটছে।