কৃত্তিবাস রহস্য – ১০

১০

নাকমুখ ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে শান্তিলালের। বাঁচোখ ফুলে ঢোল। থাপ্পড় খেয়ে খেয়ে গালের চামড়া ফেটে গেছে। মা কসম আমি কিছু জানি না স্যার। 

জানিস জানিস একটু পরে সব বলবি। বলে গেলাস থেকে দুই ঢোক জল খেলেন সিদ্ধার্থ। তারপর রুমাল বার করে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে শান্তিলালকে বললেন, জানবি জানবি সব জানবি সব বলবি। আমাকে আরেকটু সময় দে। দেখবি সব মনে পড়ে গেছে। 

বিশ্বাস করুন স্যার আমাকে। আমি ওসব প্যাকেট-ট্যাকেট কিছুই জানি না। আমি মোবাইলের কাজ করি, ওই সারানো। সিম রিচার্জ… 

কথা শেষ হলো না প্রবল জোরে একটা থাপ্পড় আছড়ে পড়ল শান্তিলালের গালে। ওই চড় খেয়ে আবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। 

চোওওপ একদম ন্যাকাকান্না কাঁদবি না। এখনো অনেক বাকি। তোকে তুলেছি কোনো রিপোর্ট নেই। আজ জানে মেরে দিয়ে কাল ভোরবেলায় খালে ফেলে দিয়ে আসব হাত পা মুণ্ডু সব কেটে। 

থানার এসআই প্রাণজয় বেশ অবাক। স্যারকে এমন উত্তেজিত হয়ে মারধর করতে ও আগে কখনো দেখেনি। কী কেস সেটাও ঠিক স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। থানায় একটা ফাঁকা রুম রয়েছে ওখানে জেরা হয়। ফার্স্ট থেকে থার্ড সবরকমের ডিগ্রির ব্যবস্থা রয়েছে। দুপুরে স্যার একমাত্র তার প্রিয় কনস্টেবল রামধন ছাড়া আর কাউকে অ্যালাউ করেননি আজ। কয়েকঘণ্টা ধরে চলছে জেরা, টর্চার। প্রাণজয় একবার গিয়েছিল স্যারের রুমে। চেয়ারে বসে থাকা লোকটা প্রায় এলিয়ে পড়েছে মার হজম করতে করতে। মেঝেতে রক্ত। নিরুপায় হয়ে স্যারকে বলেই ফেলেছে, স্যার আপনি এত টেনশন নেবেন না। একটু সাবধানে। মরেটরে গেলে… 

মরেটরে গেলে ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে আসব। ঝাঁঝিয়ে উঠেছেন সিদ্ধার্থ। প্রাণজয় সরে এসেছে সেই ঘর থেকে। 

থানার ক্যানটিন রুম থেকে এক বালতি ফুটন্ত জল এনে শান্তিলালের পায়ের সামনে এনে রাখল রামধন। শান্তিলালের বুক কেঁপে উঠল। আবার হাউমাউ করে একটা কিছু বলে উঠতে যাচ্ছিল তার আগেই হাঁটুতে রুলের সপাটে বাড়ি খেয়ে ককিয়ে উঠল 

শোন শান্তি, আমি ঠিক দশ গুনব। এবার যদি সত্যি কথা বলিস তাহলে তোকে চুপচাপ ছেড়ে দেবো, নইলে রামধন স্নান করাতে ওস্তাদ। এই থানাতে ও অনেককে স্নান করিয়েছে। এই যে জল এসে গেছে। এবার তোর জামাকাপড় ছাড়িয়ে এই জলে স্নান করাবে। কী আরাম লাগবে দেখবি 

শান্তিলাল ওর মারের চোটে প্রায় বুজে যাওয়া চোখে ওই ধোঁয়াওঠা ফুটন্ত জলের দিকে তাকাল। তারপর আবার কেঁদে উঠে কিছু বলতে গেল। সেই কথায় কান না দিয়ে সিদ্ধার্থ রামধনকে হুকুম দিলো, বালতিটা ওর মাথার কাছে তুলে ধরল রামধন। 

সিদ্ধার্থ এক দুই তিন গুনতে থাকল ছয়ও পেরোল না। শান্তিলাল বলে উঠল বলছি স্যার বলছি দয়া করুন গায়ে ঢালবেন না। ওকে নামাতে বলুন স্যার বালতি। 

সিদ্ধার্থ ইশারায় রামধনকে বালতি নামাতে বলল। 

একটু জল দিন স্যার। 

সিদ্ধার্থ জলের বোতলটা ওর মুখের সামনে ধরে ঠিক এক ঢোক জল খেতে দিলেন। তারপর বললেন, যা বলবি একেবারে ঠিক ঠিক বলবি। 

হ্যাঁ স্যার। 

এই প্যাকেটটা তোকে কে দিয়েছিল? 

যে দিয়েছিল তাকে আমি চিনি না স্যার।

এবার কী ঘটল পুরোটা বল। 

স্যার আমি সবরকমের কাজের দালালি করি। অনেক রকমের জিনিস আমাকে দেওয়া-নেওয়া করতে হয়। সেসব জিজ্ঞাসা করে আর লজ্জা দেবে না। কয়েকদিন আগে ফোন এলো। অচেনা নম্বর। বলল একটা মাল সাপ্লাই দেওয়ার রয়েছে। আমি রাজি কি না। কোথায় কাকে দিতে হবে সেসব পরে জানানো হবে। মাল হিসেবে আমি রেট ফিক্স করি। বোমা, বন্দুক, ড্রাগস, জুয়েলারি, ডলার সব আলাদা আলাদা রেট। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কী আইটেম। তো জানাল একটা খালি ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর কিছুই থাকবে না। ওরাই রেট দিলো পাঁচ হাজার। 

আমি রাজি হয়ে গেলাম। পরেরবার ফোন এলো অন্য নম্বর থেকে। আমাকে জানানো হলো কোথায় কখন দাঁড়াতে হবে আর একজন এসে আমার হাতে প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে যাবে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম মাল জমা দিতে হবে কাকে? তো বলল সেটা পরে ফোনে বলে দেওয়া হবে। তবে কাজের শর্ত হলো, আমাকে নেক্সট ফোনে ডিটেল জানানোর জন্য একটা নতুন সিম নিতে হবে সেই নম্বর ওদের বলতে হবে এবং কাজ হয়ে যাওয়ার পর সেই সিম নষ্ট করে দিতে হবে এবং মোবাইল ফ্যাক্টরি সেটিং মানে পুরো ডেটা সাফ করে দিতে হবে। আমি স্যার মোবাইলের দোকানেই থাকি, এসব আমার কাছে নতুন কিছু নয়। রসিকের কাছ থেকে একটা পুরোনো মোবাইল সেট নিয়ে তাতে নতুন একটা সিম সেট করে ওয়েট করলাম। আবার আরেকটা নতুন নম্বর থেকে ফোন এলো। আমার নতুন নম্বর জিজ্ঞাসা করল, বললাম। সেই নম্বরে আবার অন্য নম্বর থেকে ফোন এলো। 

প্রতিবার নতুন নম্বর? 

হ্যাঁ স্যার প্রতিবার। আমি এতদিন এই লাইনে রয়েছি। এমন পার্টি কখনো পাইনি। সেই নম্বরে আমাকে ফোন করে বলে দিলো ঐ মোবাইল সঙ্গে নিয়ে স্পটে গিয়ে দাঁড়াতে। মাল হাতে পেলে তারপর আমাকে ওই নতুন নম্বরে জানিয়ে দেওয়া হবে কখন কোথায় কাকে ডেলিভারি দিতে হবে। 

আমাকে সকাল সাড়ে দশটার সময় পানবাজারে গোলাম রসুলের যে ড্রাইক্লিনার রয়েছে তার উলটোদিকের ল্যাম্পপোস্টে সাদা জামা আর কালো প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলা হলো। আমার পেমেন্ট আর প্যাকেট দুটোই হাতে হাতে দিয়ে দেওয়া হবে। 

আমি ওদের জিজ্ঞাসা করলাম, মাল যে আমি ডেলিভারি পেয়েছি সেটা তোমাদের জানাব কীভাবে? কারণ ওদের ওই নম্বরগুলোতে স্যার ফোন করলে কেউ তুলত না। নট রিচেবল, কিংবা সুইচড অফ বলত। ওরা জানাল যে আমার হাতে মাল পৌঁছলে ওরা ঠিক খবর পেয়ে যাবে। তো ঠিক তাই-ই হলো। আমি গিয়ে ঠিক টাইমে দাঁড়ালাম। একটা লোক বাইকে এসে কাগজে মোড়ানো মালটা আমার হাতে দিয়েই বেরিয়ে গেল। হেলমেট পরা ছিল চোখে সানগ্লাস, মুখ চিনতে পারিনি। ওই প্যাকেটের ভেতরেই আমার টাকার বান্ডিলটা ছিল। আমি আগে ওটা পকেটে ভরে নিয়ে আর তারপরেই ফোন। যার কাছে মাল পৌঁছতে হবে তার নাম আর কোথায় দিতে হবে বলেই আমাকে বলল সিম ফেলে দিয়ে মোবাইল ফরম্যাট করে দিতে। অনস্পট। তাই করলাম। ভয় লাগছিল সাহেবি নাম, বাইচান্স যদি নামটা ভুলে যাই আর ফোন করে জানার উপায় থাকবে না…তাই পকেট থেকে পেন বার করে ওই প্যাকেটের গায়েই সাহেবের নাম আর যে হোটেলের সামনে গিয়ে দিতে হবে সেই নামটা লিখে নিয়েছিলাম। ওটাই সব… 

ওটাই সব সর্বনাশ করে দিলো তোর। 

শান্তিলাল আবার জল চাইল। এবার রামধন মগে করে জল দিলো ওকে। 

জলটুকু ঢকঢক করে খেয়ে আবার এলিয়ে পড়ল শান্তিলাল। 

সিম ফেলে দিয়েছিস? সত্যি? 

সত্যি বলছি স্যার। বিশ্বাস করুন। 

মোবাইল ফরম্যাট করে ফেললি তখনই? 

হ্যাঁ স্যার তেমনই নির্দেশ ছিল। টাকা দিচ্ছে পার্টি, তাদের কথা তো শুনতেই হবে। এখানে গাদ্দারি করি না। 

হুঁ। 

ব্যাগটা যে তোর হাত থেকে ছিনতাই হয়ে গেল তারপর তোর কাছে আর ফোন আসেনি? 

এসেছিল স্যার একবার। ওরা সব জানে। আমাকে শুধু জিজ্ঞাসা করল যে ছিনতাই করেছে তাকে দেখলে আমি চিনতে পারব কি না। আমি বললাম পারব। কিন্তু স্যার ছেলেটা চেনা চেনা হলেও ঠিক ভালো করে মনে নেই। আমার পায়ের সমস্যা রয়েছে ভালো দৌড়তে পারি না। ওই শালা সাহেব দুই কদম দৌড়লেই ছেলেটাকে ধরে ফেলতে পারত কিন্তু নিজে বেশি দৌড়ল না, আমাকে বলল যাও ধরো, বলে নিজে দাঁড়িয়ে রইল। আমি দৌড়লাম। তারপর যেই পুলিশকে দেখলাম ছেলেটাকে ধরতে পিছু নিয়েছে অমনই আমি আর রিস্ক নিইনি। অন্য রাস্তা দিয়ে পালিয়ে গেলাম। পরে আমার কাছে যখন ফোন এলো আমাকে বলা হলো ঐ সাহেবের সঙ্গে যেন আর দেখা করতে না যাই। আর যেভাবে হোক ছেলেটাকে খুঁজে বার করতে। 

খুঁজেছিলি? 

সত্যি বলব স্যার, আমি খুঁজিনি। আমি আমার হাত থেকে সাহেবের হাতে মালটা সবে তুলে দিয়েছি তখন ওই সাহেবের হাত থেকেই ছেলেটা ছিনতাই করে, এত দ্রুত করে পালায় যে আমরা কেউ প্রথমটায় বুঝতেই পারিনি। কিন্তু আমার মাল তুলে দেওয়ার দায়িত্ব মিটে গিয়েছিল, টাকাও পেয়ে গিয়েছিলাম তাই আর খুঁজিনি। তবে আমাকে একটা কথা ফোনে বলে দেওয়া হয়েছিল। আমি এই বিষয় নিয়ে কোথাও যেন মুখ না খুলি। কাউকে যদি কিছু জানাই, তাহলে আমার বিপদ হবে। 

হুঁ। 

কিন্তু বিশ্বাস করুন স্যার আমি ওই ব্যাগ ঘেঁটে দেখেছি পুরো ফাঁকা ছিল জিনিসটা। ব্যাগে কিচ্ছু ছিল না। 

জানি। বলে রামধনকে সিদ্ধার্থ বললেন চা দিতে। শান্তিলালকেও চা দিতে বললেন। 

নিজের রুমে এসে চেয়ারে চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইল। সেই দুপুর থেকে জেরা করে, ঠেঙিয়ে এখন ক্লান্ত লাগছে। শান্তিলাল এখন যে স্টেটমেন্ট দিচ্ছে তা কতটা বিশ্বাসযোগ্য সত্যিই বোঝা যাচ্ছে না। একটা ব্যাগ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দেওয়ার জন্য এতবার এত রকমভাবে হাত বদল, এত চূড়ান্ত সাবধানতা ভাবাই যায় না। অবশ্য ব্যাগটা যেমন তার উপযুক্ত ব্যবস্থাই বটে। কিন্তু যেসব নম্বরগুলো থেকে শান্তিলালের লাছে ফোনগুলো এসেছিল সেগুলো আর পাওয়ার উপায় নেই। তাহলে এবার উপায়? কী উপায়? মাথায় কিচ্ছু আসছে না। যারা ব্যাগটা শান্তিলালের হাত দিয়ে অ্যাকিনকে দেওয়ার জন্য পাঠিয়েছিল তারা নিশ্চয়ই সবকিছুই জানে। এখন প্রশ্ন হলো পাতাখোর রাসু এই থানার লকআপে রয়েছে সেটাও জানে কি না আর শান্তিলালকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে সেই খবরও ওদের কাছে পৌঁছেছে কি না। এই গ্যাংটা যে অত্যন্ত চতুর এবং অর্গানাইজ্ড সেটা বোঝা যাচ্ছে এদের কাজের ধরনে। সরাসরি কিছুই করে না। অনেক ধাপ পেরোয়। ফলে কাউকে ধরলেও মুড়ো পর্যন্ত পৌঁছনো বেশ কঠিন। 

চা দিয়ে গেল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন সিদ্ধার্থ। বাইরে ততক্ষণে সন্ধে নেমে এসেছে। 

১১

সন্ধে ছ-টার মধ্যেই সিদ্ধার্থর অফিসে পৌঁছল অরণ্য আর দিয়া। গিয়ে দেখল রাকেশ আগেই চলে এসেছেন। আজ অরণ্য আর দিয়ার মন খুব ভালো। ক্রেটের সঙ্গে দিনটা অসামান্য ভালো কেটেছে। ক্রেটের ম্যানেজার নিজের শক্ত আবরণ ভেঙে অনেকটাই আজ বেরিয়ে এসেছিলেন অরণ্য দিয়ার কাছে। ভদ্রলোক গত তেরো বছর ধরে ক্রেটের ছায়াসঙ্গী। ওর মুখ থেকে ক্রেটের জীবনের অনেক কথা আজ শোনার সৌভাগ্য হয়েছে দুজনের। যত শুনেছে ততই অবাক হয়েছে। এই যুগে এমন মানুষও হয়! যখন মানুষ পরস্পরে ভয়ংকর হানাহানিতে ব্যস্ত তখন ক্রেটের মতো কয়েকজন মানুষ নিঃস্বার্থে মানুষের জন্য করে যাচ্ছেন বলেই আজ পৃথিবীটা এত সুন্দর। কত-যে গোপন দান রয়েছে ওর। ফিলিপ বলছিলেন ওর নিজেরও জানা নেই। নিজের দেশে তো বটেই এশিয়া এবং আফ্রিকার অনেকগুলো দেশে ওর একার অনুদানে চলে এমন অনেকগুলো সংস্থা রয়েছে যারা অসহায় একাকী বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য কাজ করে। তাদের বিনামূল্যে আবাসন, চিকিৎসা খাওয়াপরা সবকিছুর ভার নেয় ক্রেটের ম্যানেজমেন্ট। ভারত-বাংলাদেশ, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা আবার কেনিয়া, নাইজেরিয়ার মতো দেশেও রয়েছে ক্রেটের দান। কিন্তু সবটাই প্রচারবিহীন। 

উনি কি শুধু বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্যই সেবামূলক কাজ করেন? জিজ্ঞাসা করেছিল দিয়া। 

হ্যাঁ অনেকটা তাই-ই। ওর এই ধরনের চ্যারিটি মূলত বয়স্কদের জন্যই। গৃহহীন, অসহায় অসুস্থ একা অনেক বুড়ো মানুষ ক্রেটের জন্যই শেষজীবনটা একটু আনন্দে কাটাচ্ছে। এবং তারা কেউ জানেও না তাদের প্রকৃত পৃষ্ঠপোষক কে? কঠোরভাবে বারণ করা রয়েছে ক্রেটের। একমাত্র সেই দেশের সংশ্লিষ্ট গভর্নমেন্ট অফিসিয়াল আর ট্রাস্টের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মী ছাড়া আর কেউ জানে না এই কর্মকাণ্ড। 

ওঃ! মানে আমাদের দেশের গভর্নমেন্টও জানেন যে ক্রেট এই গৌহাটিতে এমন অর্গানাইজেশন প্যাট্রনাইজ করে? 

নিশ্চয়ই গভর্নমেন্টকে না জানালে কী করে হবে? না হলে পুরো ব্যাপারটাই ইললিগাল হয়ে যাবে। আর শুধু গৌহাটি নয় তোমাদের ইন্ডিয়ার আরও তিনটি স্টেটে ক্রেটের গ্রান্টে মোট পাঁচটা অর্গানাইজেশন চলে। সব মিলিয়ে অন্তত কুড়িটা এমন সংস্থা রয়েছে যা ক্রেটের টাকায় চলে। 

ওঃ তাই! সবকটা অর্গের কি একই নাম? 

না না প্রত্যেকের আলাদা আলাদা। আর ক্রেট নাম নিয়ে ভাবেও না। কারণ ও কোনোকালেই প্রচার চায় না। নিজের প্রফেশনেও তাই। তোমরা ওর সম্পর্কে কতটা জানো আমি জানি না। কিন্তু ও হচ্ছে প্রকৃত একজন জিনিয়াস। এমন সৃষ্টিশীল এবং দয়ালু মহানুভবী মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। 

সত্যি আমরাও যত শুনছি আর অবাক হচ্ছি বলেছিল অরণ্য। আজ সকালে ওরা একটি সংস্থায় গিয়েছিল যেটা একটি বেসরকারি বৃদ্ধাবাস। প্রায় চল্লিশজনের মতো বৃদ্ধবৃদ্ধা রয়েছেন এখানে। কিন্তু অর্থাভাবে হোমটির খুবই দৈন্যদশা। সরকারি বেসরকারি কোনো সাহায্যই না পাওয়ার কারণে অনেকদিন ধরে ধুঁকছে। আবাসিকদের দুর্দশাও চূড়ান্ত। ইন্টারনেটে এদের যে ওয়েব রয়েছে তার মাধ্যমেই ক্রেট জানতে পারেন এদের সমস্যা। যোগাযোগ করেন, তারপর যথারীতি আসল চিত্রটা দেখার জন্য আচমকাই আজ সকালে চলে গিয়েছিলেন সেই হোমে। সঙ্গে অরণ্য আর দিয়াকেও যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। গতকালের পর থেকে ক্রেট এই ছেলেমেয়েদুটির প্রতি বেশ সন্তুষ্ট। যদিও চিরকালই ক্রেট স্বল্পবাক। তবে আজ মাঝে মাঝেই কথা বলেছেন দিয়া অরণ্যর সঙ্গে। সঙ্গে মশকরাও। একবার দিয়াকে বলেছেন, তোমার বয়ফ্রেন্ড তো শরীরচর্চা করে বোঝা যায়, কিন্তু তুমি কি শুধু পেটচর্চা করো? 

আসলে ইঙ্গিতটা ছিল দিয়ার একটু বাল্কি চেহারার প্রতি। এমন মজা করে কথাটা বলেছিলেন যে সকলেই হেসে উঠেছিল। আরেকবার বললেন, আমি চাই পৃথিবীর একজন বৃদ্ধবৃদ্ধাও যেন অনাহারে, নিরাশ্রয় না থাকে। আমি যতদিন বাঁচব তাদের জন্য কাজ করব। 

বয়স্কদের প্রতি ক্রেটের এই অতিরিক্ত আবেগের কারণটা দিয়া জানতে পেরেছিল ফিলিপের কাছ থেকে। ক্রেট তার কিশোরবয়সেই বাবা-মা দুজনকেই একটা দুর্ঘটনায় হারান। তারপর তাকে বড়ো হতে হয়েছিল বহু কষ্টের মধ্য দিয়ে। অনেক লড়াই করে সে আজ এখানে পৌঁছেছে, ওর জীবন নিয়ে উপন্যাস লেখা কিংবা সিনেমা বানানো যায়। 

আজ প্রায় ঘণ্টা তিনেক ক্রেট ছিলেন ওই হোমে। আবাসিকদের সঙ্গে খুব সহজে মিশে গিয়ে তাদের সুবিধা-অসুবিধা কী প্রয়োজন সবকিছু খুঁটিয়ে খেয়াল করেছেন, শুধু তাই নয় ওরা দুপুরে যা খান নিজেও ওদের সঙ্গে বসে তাই-ই খেলেন। দিয়া অরণ্য আর ফিলিপ তাই করল। কী বিস্বাদ সামান্য খাবার! এই খাবার দিনের পর দিন অসহায় মানুষগুলো খেয়ে চলেছে। 

ম্যানেজার ফিলিপ সবকিছু নোট নিচ্ছিলেন। এই অর্গানাইজাররা খবর পেয়ে প্রায় দৌড়ে চলে এসেছিলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। তাদের সঙ্গে মিটিং করলেন ক্রেট। সব শুনে নিয়ে আশ্বাস দিলেন খুব দ্রুত তিনি সাহায্য করবেন। 

গাড়িতে ফেরার পথে অরণ্যকে একটা কথা বললেন তিনি, ফিলিপকে খুঁচিয়ে তোমরা নিশ্চয়ই আমার সম্পর্কে কিছু খবর আদায় করে ফেলছ। আর ফিলিপও নিশ্চয়ই সুযোগ পেয়ে আমাকে ঈশ্বর বানানোর চেষ্টা চালিয়েছে, এটাই ও বরাবর সুযোগ পেলে করে থাকে। যদিও এর জন্য ওকে আমি এক্সট্রা পেমেন্ট করি না। তবে কী জানো অরণ্য, জীবনে সকলেরই টাফ সিচুয়েশন আসে। তুমি সেই সিচুয়েশনকে যদি তোমার সুযোগ বলে ধরে নাও তাহলে তুমি জিতবে। ওই যে কথায় বলে না কঠিন পরিস্থিতি আসলে একটা পরীক্ষা, কীসের পরীক্ষা জানো? ওই খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে লুকিয়ে থাকা সেরা সুযোগটাকে তোমাকে খুঁজে বার করতে হবে, ওটাই পরীক্ষা। 

কথাগুলো এমনভাবে বলছিলেন ক্রেট যে পুরো মনের ভেতরে গেঁথে যাচ্ছিল। একজন মানুষ এমনি এমনি এই লেভেলে পৌঁছয় না, অনেক পজিটিভ এনার্জি লাগে। ফেরার সময় থানার কাছে রয়্যাল মার্কেটের সামনে নামিয়ে দিয়ে গেল ক্রেট। অরণ্য ইচ্ছে করেই বলেনি যে ওরা থানায় যাবে। দরকার নেই বলার। রয়্যাল মার্কেটটা থানা থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্ব তাই আগের দিনই দেখে নিয়েছিল অরণ্য তাই ওখানেই নামবে বলেছিল। তারপর মার্কেটের সামনে নেমে সেখান থেকে হেঁটে দুজনে ঢুকে পড়ল থানার ভেতরে। 

সিদ্ধার্থ রুমেই ছিলেন, সামনে রাকেশ। অরণ্য আর দিয়াকে দেখে সিদ্ধার্থ বললেন আসুন আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। 

অরণ্য ওদের দুজনের মুখ দেখে বুঝতে পারল কেস বেশ সিরিয়াস।

কোনো বড়ো সমস্যা হয়েছে স্যার? 

আপনারা বসুন বলছি। বেল বাজিয়ে চায়ের অর্ডার করলেন সিদ্ধার্থ। তারপর বললেন, হ্যাঁ খুব বিশেষ কারণেই আপনাদের দুজনকে ডেকেছি। ব্যাগের রহস্য সামান্য জানা গিয়েছে, কিন্তু যেটা জানা গেছে তা অতি ভয়ংকর। 

কী ব্যাপার স্যার? কী পাওয়া গেছে ব্যাগে? 

বলছি। তার আগে আপনাদের দুজনকে একটা কথা দিতে হবে। এই খবর আপাতত আমাদের চারজন ছাড়া যেন আর কেউ না জানে। আর আমি এই কেস সলভ করার জন্য আপনাদের সাহায্য চাইছি। জানি এই চাওয়াটা জাস্টিফায়েড নয় এবং আপনারা এখানে এসেছেন সম্পূর্ণ অন্য কাজে, কিন্তু আমি আপনাদের আগের কাজ সম্পর্কে ডিটেলে জেনেছি, আমার মনে হয় আপনারা সাহায্য করতে পারবেন। আসলে আমি এই কেসটা এখনই ছড়াতে চাইছি না। কিন্তু… 

একটু ডিটেলে বলা যায়? কী এমন পাওয়া গেছে ব্যাগে? একটু অধৈর্য হয়েই জিজ্ঞাসা করে ফেলল অরণ্য। 

ব্যাগের ভেতরে কিছু পাওয়া যায়নি। ব্যাগটা আসলে যা দিয়ে তৈরি তা শুনলে আপনি চমকে যাবেন। 

দেখে লেদার বলেই তো মনে হয়েছিল। বলল দিয়া। 

হ্যাঁ ম্যাডাম লেদারই কিন্তু ওটা যে প্রাণীর লেদার তা অকল্পনীয়।

কীসের? 

প্রশ্নের উত্তরে সিদ্ধার্থ যা উত্তর দিলেন তা শুনে নিজের কানকে বিশ্বাস করল না অরণ্য। চমকে উঠল। চোখমুখ কুঁচকে আবার জিজ্ঞাসা করল, কী! কী বলছেন আপনি! 

ঠিকই বলছি। 

এমন আবার হয় নাকি? 

না হওয়ারই কথা, অন্তত এই একবিংশ শতাব্দীতে এমনটা না হওয়ারই কথা তবু এটা হচ্ছে। 

আপনার ল্যাবটেস্টে এটাই বেরোল! অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল দিয়া। 

হ্যাঁ এবং আমি শিয়োর হওয়ার জন্য একাধিকবার টেস্ট করেছি। এবং 

আরও ভয়ংকর ব্যাপার হলো এই লেদার খুব পুরোনো নয়। 

মাই গড! 

অরণ্য দুহাত মাথায় রাখল। 

তাহলে? মানে এটা কারা বানাচ্ছে কী হতে যাচ্ছিল জিনিসটা নিয়ে? 

জিনিসটার আলটিমেট ডেস্টিনেশন কী আর কোথায় ম্যানুফ্যাকচারিং এই দুটোই তো জানার। এর মধ্যে যে-কোনো একটা অন্তত জানতে পারলে অন্যটা জানা সোজা হবে। 

আপনি কি কিছু ক্লু পেয়েছেন? 

খুব সামান্য। সেদিন অ্যাকিন ছাড়াও আরও একজন ছিল যে কি না ওই ছিনতাইবাজের পেছনে তাড়া করেছিল আমি আজ তাকে অ্যারেস্ট করতে পেরেছি একপ্রস্থ জেরাও হয়েছে। শান্তিলাল, একটা দালাল, ওর শুধু দায়িত্ব ছিল মালটা অ্যাকিনের হাতে তুলে দেওয়া। আর বিশেষ কিছু জানে বলে মনে হয় না। 

কী কী জানা গেল সেটা একটু বলবেন? জিজ্ঞাসা করল অরণ্য। 

হ্যাঁ শিয়োর। সংক্ষেপে পুরো জেরাটাই গুছিয়ে বললেন সিদ্ধার্থ। 

এ তো সাংঘাতিক! আর কিছুই জানা গেল না? 

নাঃ, আর আমার হাতে ও আজ যা খেয়েছে তাতে মনে হয় না আর কিছু লুকোনোর সাহস পাবে বলে। 

কোথায় রয়েছে লোকটা? লকআপে? 

না ওখানে রাখিনি। আমার একটা জেরাঘর রয়েছে সেখানেই আলাদা রেখেছি ওকে। আমি চাইছি না কারও সঙ্গে ওর ইন্টারেকশন হোক। 

আমরা কি একবার কথা বলতে পারি? জিজ্ঞাসা করল অরণ্য। 

হ্যাঁ নিশ্চয়ই চলুন। 

উঠল সকলে। পাশেই ঘর। দরজা বন্ধ ছিল। ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল ঘরের মাঝে চেয়ারে এলিয়ে বসে রয়েছে একটা লোক, ঝিমোচ্ছে। ঘরে শুধু একটা ডুম জ্বলছে। গুমোট গরম। লোকটার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেদম মার খেয়েছে পুলিশের কাছে। ওকে ধাক্কা দিয়ে জাগালেন সিদ্ধার্থ। বললেন, এই যে এই মহাপুরুষের নাম হলো শান্তিলাল। 

শান্তিলাল কোনোমতে মুখ তুলে ওদের দিকে দেখল। তারপর আবার মুখ ঝুলিয়ে নিল। 

চা খেয়েছিস? জিজ্ঞাসা করলেন সিদ্ধার্থ । 

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল শান্তিলাল। 

শোন তোকে এই স্যার আর ম্যাডাম আরও কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবে ঠিকঠাক উত্তর দিবি। 

ফোলা, রক্ত জমে ওঠা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে শান্তিলাল বলল, আমি তো সবই বলে দিয়েছি স্যার আর কিছু জানি না। বিশ্বাস করুন আর কিছু জানি না। 

ঠিক আছে আমরা জেনেছি তুমি সব বলে দিয়েছ তাও কয়েকটা প্রশ্ন তোমাকে আমি করছি, খুব ভালো করে ভেবেচিন্তে জবাব দেবে। ভয় নেই আমরা তোমাকে মারধর করব না। 

শুনে একটু যেন আশ্বস্ত হলো শান্তিলাল। বেশ কষ্ট করেই তাকাল অরণ্যর দিকে। 

খুব মন দিয়ে শোনো শান্তিলাল। তুমি স্যারকে বলেছ তোমাকে যতবার ফোন করেছে প্রতিবারই নতুন নম্বরে? 

হ্যাঁ স্যার। 

তুমি কখনো ওই নম্বরগুলোতে ফোন করার চেষ্টা করোনি? 

একবার করেছিলাম সুইচড অফ ছিল। আর ওদের নির্দেশমতো আমি ওই সিম ফেলে দিয়েছি স্যার। 

হুঁ মালটা যে ঠিক হাতে পৌঁছল না তার জন্য ওরা তোমাকে পরে কিছু বলেনি? মানে বকাঝকা কিছু বা হুমকি? 

আমার তো দোষ ছিল না। আমি মাল ওই নিগ্রো সাহেবের হাতে তুলে দিয়েছিলাম প্যাকেটটা ছিনতাই হয়েছিল ওই লোকটার হাত থেকে। সেটা ওরা নিশ্চয়ই দেখেছে। শুধু একটা ফোন এসেছিল স্যার, জিজ্ঞাসা করেছিল যে ছিনতাই করেছে তাকে আমি চিনি কি না। আমি বললাম ভালো করে দেখতে পাইনি। বাস। 

হুঁ, এবার একটা কথা খুব ভেবেচিন্তে উত্তর দাও। মাথা ঠান্ডা করে। 

বলুন স্যার। তোমার কাছে যেসব ফোনগুলো আসত সেগুলো কি কোনো নির্দিষ্ট কোম্পানির নম্বর মানে ভোডাফোন বা এয়ারটেল, বা জিও… 

না স্যার সব মেশানো। 

আচ্ছা তোমাকে কি একজনই ফোন করত? মানে গলা শুনে কী মনে হয়েছে? 

সেটা বলতে পারব না। মনে হয় একজনই হবে।…না দুজনও হতে পারে। 

একটা কিছু মনে করার চেষ্টা করো শান্তিলাল, তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমান লোক, এমন একটা কিছু স্পেশালিটি ওই ফোন কলগুলোর মধ্যে পেয়েছ? মানে ধরো কোনো শব্দ যেমন কারখানার ভোঁ বা ধরো বা… 

না স্যার ওইসব কিছু পাইনি…বলেই আচমকা থেমে গেল শান্তিলাল তারপর বলল তবে একবার…না না দুবার আমি ফোনের মধ্যে গান শুনেছি। 

গান? কী গান? 

মনে হয় ঠাকুরের গান। খুব হালকা করে শুনতে পেয়েছি মিউজিক চলছিল… 

দুবারই এক গান শুনেছ? 

হ্যাঁ গান ঠিক নয় স্যার মন্ত্র মনে হয় সিডিতে বাজছিল। 

কী মন্ত্র শান্তিলাল? মনে করো। মনে করে বলো। 

একটাই শব্দ মনে রয়েছে স্যার, সূর্য। বাকি কীসব হাং হুং ওগুলো মনে নেই। 

হাং হুং আর সূর্য? গানটা শুনলে তুমি চিনতে পারবে? 

হ্যাঁ তা হয়তো পারব। 

দিয়ার দিকে অরণ্য তাকাতেই দেখল দিয়া ততক্ষণে মোবাইলে খুটখাট করা শুরু করে দিয়েছে। 

দিয়া মোবাইলে ইউটিউবে সূর্যপ্রণাম সার্চ করে প্লে করল। 

ওঁম জবাকুসুম সঙ্কাশং… 

না স্যার এটা নয়। 

দিয়া আবার সার্চ করে আরেকটা চালাল সূর্যের ধ্যানমন্ত্র।

ওঁম ভাস্করায় বিদ্মহে মহাতেজায় ধীমহী… 

না না এটাও না। 

দিয়া তুই হুং হাং দিয়ে সূর্যের একটা কিছু খোঁজ। 

হুঁ দেখছি। আবার মোবাইল ইন্টারনেটে খুঁজতে শুরু করল দিয়া। প্ৰায় গোটা ছয়েক সূর্যের নানারকমের স্তব, প্রার্থনা, ইত্যাদি মন্ত্র শোনাল ওকে। প্রতিটাতেই না এটা নয় বলে শান্তিলাল হাতজোড় করে অনুরোধ করল, স্যার মাইরি বলছি আমি এর বেশি কিছু জানি না, আমাকে ছেড়ে দিন স্যার। 

হুঁ দেবো। আগে এই স্যারের প্রশ্নগুলোর ঠিকঠাক উত্তর দে। 

আচ্ছা এটা শুনে দেখো তো, বলে দিয়া আবার একটা গান চালাল। এত সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী ও নয়। এটা সূর্যের তান্ত্রিক মন্ত্র। তবে গান নয় সমবেতভাবে বৈদিক মন্ত্র যেভাবে মুনিঋষিরা উচ্চারণ করেন ঠিক সেরকম— 

ওং ঘৃণিঃ সূর্যাদিত্তম 
ওং ঘৃণিঃ সূর্য আদিত্য শ্রী 
ওং হ্রাং হ্রীং হৌং সঃ সূর্যাং নমঃ 
ওং হ্রীং হ্রীং সূর্যায় নমঃ 

এই যে এই তো…এটাই বলে উঠল শান্তিলাল। 

সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজিত হয়ে পড়ল সকলে। সিদ্ধার্থ শান্তিলালকে বলল খুব 

ভালো করে শুনে বলো। 

হ্যাঁ স্যার এটাই এই যে হিং হিং আর সূর্য…এটাই তবে এই গলায় নয়।

কিন্তু এটা তো গান নয়, তুই যে গান বললি। 

ওই তো সুর করে বলছে স্যার। 

শান্তিলালের কথায় হেসে ফেলল সকলে। অবশ্য সুরে মন্ত্রোচ্চারণ আর গানের সুরের পার্থক্য শান্তিলালকে বোঝানোর দরকার নেই। 

যতবার তুমি এই গানটা শুনেছ একই গলায়? মানে শুনে তোমার কি মনে হয়েছে সিডিতে বাজছে নাকি…. 

সেটা বলতে পারব না স্যার খুব নিচে ভলিউমে বাজত…তবে…তবে স্যার আমার মন বলছে সিডি, আবার নাও হতেও পারে। 

তোমার এমন কনফিউশন কেন হচ্ছে বলো? 

আসলে এই মন্ত্রটা এরকমই হলেও গলাটা যেন অন্যরকম লেগেছিল। 

হুঁ। এবার শেষ প্রশ্ন, তোমাকে যে এই ব্যাগটা ডেলিভারি দেওয়ার জন্য দেওয়া হয়েছিল সেটা তোমার হাতে পৌঁছনোর আগে ওরা তোমাকে ফোন করেছিল নিশ্চয়ই। 

হ্যাঁ স্যার করেছিল। 

কী বলেছিল? 

ওই তো, বলেছিল মালটা আজ আমাকে ডেলিভারি দেবে, সকাল দশটায় দাঁড়াতে। 

উঁহুঁ এভাবে নয়, খুব মাথা ঠান্ডা করে ভেবে বলো ঠিক কী লাইনগুলো বলেছিল। আমাকে হুবহু সেইগুলো বলো। ভেবে বলো তাড়াহুড়ো কোরো না। বলল অরণ্য। 

দিয়া বুঝল না অরণ্য এমন প্রশ্ন কেন করছে। 

শান্তিলাল মিনিটখানেক ভাবল, তারপর বলল মনে রয়েছে স্যার। বলব?

হুঁ বলো। 

ফোনটা এলো সকাল আটটায়। ফোনে আমাকে একজন জিজ্ঞাসা করল, তুমি এখন কোথায়? 

আমি বললাম বাড়িতে। 

তখন বলল সকাল সাড়ে দশটার সময় পানবাজারে গোলাম রসুলের যে ড্রাইক্লিনার রয়েছে তার উলটোদিকের ল্যাম্পপোস্টে সাদা জামা আর কালো প্যান্ট পরে দাঁড়াতে। 

আমি প্রথমে বললাম ঠিক আছে। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম কতক্ষণ দাঁড়াতে হবে? 

বলল মাল নিয়ে লোক একটু পরেই বেরোবে, জ্যাম না থাকলে সাড়ে দশটায় পৌঁছে যাবে। যদি একটু দেরিও হয় তাহলে যেন আমি চলে না যাই। আর সাড়ে দশটার মধ্যে আমাকে ওখানে দাঁড়াতেই হবে। আমার যেন লেট না হয়। 

এই কথা শুনে অরণ্য খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ল বুঝতে পারল দিয়া।

আচ্ছা তোমাকে এই কথা যখন বলছিল তখন কি এই মন্ত্রের গান শুনতে পেয়েছিলে? 

হুঁ পেয়েছি স্যার। খুব হালকা, কিন্তু কানে পৌঁছয়। 

দ্যাটস ইট। বলে ডানহাত মুঠো করে একবার ঝাঁকাল অরণ্য। 

সিদ্ধার্থ, দিয়া এবং রাকেশ তিনজনেই তাকাল অরণ্যর দিকে। ও যে একটা কিছু ক্লু পেয়েছে সেটা আন্দাজ করল। 

ঠিক আছে আমার কোয়ারি শেষ। 

সিদ্ধার্থ শান্তিলালকে আবার ফেরত পাঠিয়ে দিলেন সেই জেরা ঘরটায়। তারপর অরণ্যকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী বুঝলেন? 

অরণ্য আচমকাই সিদ্ধার্থকে পালটা প্রশ্ন করলেন, স্যার আপনি কি চাইছেন আমি আর দিয়া এই কেসটা নিয়ে মুভ করি? 

হ্যাঁ ঠিক এটাই চাইছি। 

কিন্তু স্যার আপনি জানেন তো আমরা এখানে এসেছি অফিসের অ্যাসাইনমেন্টে। তাই ওটা না করলে… 

বেশ তো আপনারা অফিস অ্যাসাইনমেন্ট করুন না, তার মধ্যে এটা একটু দেখুন। আসলে আপনাদের রিকোয়েস্ট করার আমার বেশ কয়েকটা কারণ রয়েছে। নম্বর ওয়ান আমি চাইছি এই কেসটা খুব গোপনে ইনভেস্টিগেট করতে, এখানে আপনাদের কেউ চেনে না যদি আপনারা ইনভস্টিগেশনের দায়িত্ব নেন তাহলে আপনাদের চট করে কেউ সাসপেক্ট করবে না। অ্যালার্টও হবে না। নম্বর দুই, আপনাদের আগের কেসটা আমি জানি, আপনারা দুজনে যেমন ইন্টেলিজেন্ট তেমনই সাহসী। আপনারা যদি রাজি থাকেন আমি আপনাদের সবরকম সাপোর্ট দেবো। প্লিজ একটু ভেবে দেখুন। আর বুঝতেই পারছেন কেসটা কত সিরিয়াস, এই চক্রকে যেভাবে হোক আটকাতেই হবে। 

কিন্তু সিদ্ধার্থ, একটা ব্যাপার কিন্তু ভেবে দেখো, ওরা যদি রাজি হয়ও আমরা কিন্তু কেউ জানি না শত্রুপক্ষ কতটা শক্তিশালী, কতদূর তাদের হাত ছড়ানো। তুমি কি ওদের দুজনের সিকিউরিটির দায়িত্ব নিতে পারবে? কথার মাঝেই বলে উঠলেন রাকেশ। 

হ্যাঁ কিংবা না তে যদি শুনতে চাও তাহলে বলব, না। পুরো সিকিউরিটির দায়িত্ব আমার পক্ষে নেওয়া সত্যিই সম্ভব নয়। আর নিতে গেলে আসল মিশনটাই ফেল করবে। আমি সেই কারণেই আপনাদের জোর করতে পারি না, খুব জোর রিকোয়েস্ট করতে পারি। আসলে আপনাদের আগের ওই ডার্কওয়েব কেসটা জেনে আমার মনে হয়েছিল আপনাদের বুদ্ধিমত্তা তো রয়েছেই এবং বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহসও রয়েছে। আসলে এই কেসটা যদি আপনারা নেন তাহলে ওই স্পাইয়ের ভূমিকা নিতে হবে আর কি। পুরোটা না হলেও অনেকটাই আপনাদের নিজেদের রিস্ক। তবে আগেও তো আপনারা এমনভাবে বিপদে ঝাঁপিয়েছেন। 

কিন্তু স্যার আগের কেসটায় আমার দাদা জড়িত ছিলেন, সেই কারণে আমরা ঝাঁপাতে বাধ্য ছিলাম। 

হুঁ. আবার এটাও ঠিক আপনার দাদা নিঃস্বার্থভাবেই বহুমানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্য নিজের জীবনকে বিপন্ন করেছিলেন। এখানে ওই মোবাইল গেমটেম না হলেও কেসটা কোনো অংশে কম ভয়ংকর নয়। 

দিয়া বলল, ঠিক আছে স্যার আমরা আজ একটু ভেবে নিই। আজকের রাতটা আমাদের সময় দিন। আর আমাদের অফিসকেও জানাতে হবে। ওখানে না জানিয়ে আমরা কিছু করতে পারব না। 

কিন্তু অফিসে জানালে… 

সেটা চিন্তার কিছু নেই স্যার। আমরা যদি কেসটায় নাও মুভ করি তাহলেও গোপনীয়তা এতটুকুও নষ্ট হবে না। 

বেশ তাহলে দেখুন কথা বলে। আমি আশা করে থাকব। 

আচ্ছা স্যার। আমরা তাহলে এখন চলি। আর একটা আমার সাজেশন রয়েছে, যদি শান্তিলালকে আপনার জেরা করা শেষ হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে ওকে ছেড়ে দিন।  

ছেড়ে দেবো? 

হ্যাঁ ওর পেছনে কাউকে লাগিয়ে দিয়ে ওকে ফ্রি করে দিন। ওর গতিবিধিটা খেয়াল করা দরকার। তাছাড়া ওই ব্যাগ কোম্পানি ওর সঙ্গে আবার যোগাযোগ করে কি না সেটাও জানা প্রয়োজন। 

বেশ তাই করছি। আজই ছেড়ে দিচ্ছি ওকে। 

আচ্ছা স্যার। আমরা চলি তাহলে। 

হ্যাঁ আশায় রইলাম। বলে হাসল সিদ্ধার্থ। অরণ্য আর দিয়া সিদ্ধার্থ এবং রাকেশের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বেরিয়ে এলো। বেশ ঠান্ডা নেমেছে। 

১২

সিদ্ধার্থর ফোনটা এলো রাত পৌনে এগারোটা নাগাদ। ডিনার সেরে হোটেলরুমে বসে দিয়া ওর ল্যাপটপে ক্রেটের ইন্টারভিউ নোট করছিল আর অরণ্য টিভি চালিয়ে নিউজ শুনছিল। অরণ্য মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখল স্ক্রিনে সিদ্ধার্থর নাম। 

এত রাতে আবার কেন? টিভি সাইলেন্ট করে কলটা রিসিভ করল অরণ্য। বলুন স্যার। 

সরি অরণ্য এত রাতে ডিস্টার্ব করার জন্য। আসলে একটা খারাপ খবর রয়েছে। 

কী হয়েছে স্যার? 

শান্তিলাল খুন হয়েছে। 

খুন! 

ওঃ মাই গড। কী করে? কোথায়? 

অরণ্যর কথায় দিয়াও কাজ থামিয়ে তাকাল অরণ্যর দিকে। ইশারায় জিজ্ঞাসা করল কী হয়েছে? 

অরণ্যও ইশারায় জানাল শান্তিলাল খুন হয়েছে। 

সিদ্ধার্থ খুব সংক্ষেপে জানালেন, আজ রাত ন-টা নাগাদ আমি আপনার সাজেশন মতো শান্তিলালকে একটু খাবারটাবার খাইয়ে ছেড়ে দিই এবং তার আগে আমার একটা খবরিকে জুড়ে দিই শুধু ওকে সারাক্ষণ ফলো করার জন্য। আমার খবরি ট্যাক্সি চালায়। ও জানাল, থানা থেকে ছাড়া পেয়ে শান্তিলাল প্রথমে থানার উলটোদিকের দোকানে চায় খায়। তারপর সিগারেট ধরিয়ে একটা অটো ধরে। পেছনে ফলো করতে থাকে খবরি। অটো পল্টনবাজার ছাড়িয়ে শুখাবস্তির সামনে থামে। ওখানেই শান্তিলালের ঘর। শান্তি অটো থেকে নেমে ভাড়া মেটাচ্ছিল সেই সময়েই বাইকে করে দুজন ঐ অটোর পাশ দিয়ে ঝড়ের গতিতে চলে যাওয়ার সময় শান্তিলালকে শুট করে। একেবারে নিখুঁত নিশানা। শান্তিলাল ওখানেই শেষ। দুই আরোহীই হেলমেট পরে ছিল বলে মুখ চেনা যায়নি। রাস্তাও ওই সময় বেশ ফাঁকা। খবরি বাইকের নম্বরও দেখার সুযোগ পায়নি। 

পুরোটা শুনে আফসোসের শব্দ বার করল অরণ্য। বলল শান্তিলালকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটা ভুল হয়ে গেল। ওরা সব খবরই রাখছে। 

হ্যাঁ সবকিছুই নজরে রাখছে ওরা। 

মানে আমাদেরও নজর করে ফেলেছে হয়তো। তবে শান্তিলালকে যে ওরা ছেড়ে দেবে না সেটা আন্দাজ করাই যাচ্ছিল। কপাল ভালো যে ওকে ইন্টারোগেট করার আগে মেরে দেয়নি। তাহলে আমরা কিছুই জানতে পারতাম না। 

হুঁ সেটাই। যাক আপনারা কিছু ঠিক করলেন? 

হুঁ করেছি। আমি আপনাকে কাল সকালেই ফোন করতাম। আমরা কেসটা দেখব স্যার। 

থ্যাঙ্ক গড়। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। 

তবে আপনাকে কিছু বলার রয়েছে। 

হ্যাঁ বলুন। 

এবার থেকে আমরা আপনার থানায় গিয়ে দেখা করব না। বেশিরভাগটাই ফোনে অথবা অন্য কোথাও মিট করব। 

বেশ। 

আরেকটা ইনফরমেশন আপনাকে যেভাবে হোক জোগাড় করতে হবে খুব দ্রুত। ওটা আপনার পক্ষেই সম্ভব। 

কী বলুন? 

গৌহাটিতে বা তার আশেপাশে কোথায় কোথায় সূর্যদেবের মন্দির রয়েছে সেটা আপনাকে জানতে হবে। 

সূর্যদেবের মন্দির! আপনি কি ওই স্তবমন্ত্রটা নিয়ে… 

ইয়েস। একেবারেই ওয়াইল্ড গেস করছি যদিও। 

কিন্তু ওই মন্ত্রটা মন্দিরের নাও তো হতে পারে। হয়তো কারও বাড়িতে বাজানো হয়। 

বাড়িতে সারাদিন মন্ত্র বাজে না, গান বাজতে পারে। ওটা সাধারণত মন্দিরেই হয়। তবু আপনার যুক্তি আমি অস্বীকার করছি না। মন্দির না হতেই পারে। আবার হতেও তো পারে। আগে সম্ভাবনার দিকটা ধরেই এগোনো যাক। না মিললে অন্যকিছু। এই মুহূর্তে আমাদের হাতে এই সামান্য ব্লুটুকুই রয়েছে। 

কিন্তু যদি ধরে নিই ওটা কোনো সূর্যদেবের মন্দির তাহলেও ওটা গৌহাটিতে বা তার আশেপাশেই হবে তার গ্যারান্টি কি? দেশের যে-কোনো প্রান্তেই তো হতে পারে। 

হুঁ, আমিও সেটাই ভেবেছিলাম কিন্তু শান্তিলালের ওই কথাটা মনে রয়েছে? ওকে লাস্ট ফোনে বলা হয়েছিল মাল নিয়ে লোক একটু পরেই বেরোবে, জ্যাম না থাকলে সাড়ে দশটায় পৌঁছে যাবে। ওই ফোনটা এসেছিল সকাল আটটার সময়। একটু পরে মানে যদি সাড়ে আটটাও ধরি তাহলে সাড়ে আটটা থেকে সারে দশটা এই দু-ঘণ্টার মধ্যে একমাত্র শহরের মধ্যে থাকলেই পৌছনো সম্ভব। প্লেনেও চেকিং, বোর্ডিং-এ আগেপরে তিন-চার ঘণ্টা লেগে যায়। তাই সেটা সম্ভব নয়। 

কিন্তু ট্রেন? 

হুঁ। কিন্তু ওদের লোক মালটা শান্তিলালকে দিতে এসেছিল বাইকে করে। অবশ্য ট্রেনের পর বাইকেও আসা যায়। কিন্তু এভাবে ভাবতে গেলে এগোনোই যাবে না। 

হুঁ বুঝলাম। বেশ আমি খোঁজ লাগাচ্ছি। 

একটাই সুবিধা আমাদের দেশে সূর্যের মন্দির খুব বেশি নেই। আশা করি পেয়ে যাবেন। মন্দিরটা পাওয়া গেলে কাজ শুরু করতে সুবিধা হবে। তারপর বাকি প্ল্যান। 

ও কে। গুড নাইট। বলে ফোন রেখে দিলেন সিদ্ধার্থ। 

অরণ্য দিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, খেল জমে গেছে। 

আমার মন বলছিল শান্তিলালকে ওরা ছেড়ে দেবে না। এতদিন যে বাঁচিয়ে রেখেছিল সেটাই আশ্চর্যের। 

দিয়া বলল, উঁহুঁ আমার মনে হয় ওরা শান্তিলালকে মারত না। কারণ ব্যাগ ছিনতাইয়ের ব্যাপারে শান্তিলালের কোনো দোষ ছিল না। কিন্তু পুলিশ ওকে যে গ্রেফতার করেছে সেটা ওদের কানে যেতেই আর রিস্ক নেয়নি। সরিয়ে দিয়েছে। তবে এটাও ঠিক আমার মন বলছে ওরা এতটা যখন ওয়াচ 

করছে আমাদেরও হয়তো খেয়াল রাখছে। 

হুঁ হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। তবে আমাদের সাবধান থাকতে হবে। 

কিন্তু অরণ্য আমরা দুদিক সামলাব কী করে বল তো? একদিকে ক্রেট, অন্যদিকে শিলং আর একদিকে এই ব্যাগ রহস্য, কখন কী করব মাথায় আসছে না। 

হুঁ ঠিক বলেছিস। কিন্তু একটা ব্যাপার আমাদের আরও একবার ভেবে দেখার। আমার মন বলছে এই ব্যাগ তৈরির পেছনে বিশাল চক্র কাজ করছে এবং সেটা ওই ডার্কওয়েবের থেকে কম কিছু নয়। নইলে এই জিনিস দিয়ে ব্যাগ বানানো… শালা বাপের জন্মে ভাবিনি। লোকে এই জিনিসও কেনে আবার ইউজও করে! মানুষের মতো চিজ আর হয় না! 

আসলে যা নিষিদ্ধ, যা বেআইনি তাতেই মানুষের চিরকাল আগ্রহ। এর জন্য যেমন মানুষের উন্নতিও হয়েছে তেমন বিকৃতিও। বলল অরণ্য। 

আজ হোটেলে ফেরার পর অঞ্জনদাকে ফোন করেছিল দিয়া, পুরো ব্যাপারটাই খুলে বলেছে। 

শুনে অঞ্জনও অবাক হয়ে গিয়েছিল। এমনও হয়! 

হ্যাঁ গো সত্যিই! আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না। বাট এটাই ফ্যাক্ট। এবার মিস্টার কলিতা চাইছেন অরণ্য আর আমি মিলে কেসটার ইনভেস্টিগেট করি, আনঅফিসিয়ালি অ্যান্ড সিক্রেটলি। 

বলিস কী! কেমন ফেমাস হয়ে গিয়েছিস তোরা এবার বুঝতে পারছিস? আমার তো মনে হচ্ছে আর কিছুদিন পর এফবিয়াই থেকেও তোদের ডাকা হবে কেস সলভ করতে। সব ইন্টারন্যাশনাল কেস তোদের হাতে আসছে। 

আজ্ঞে না, অত খায় না। এটা একেবারেই দিশি ব্যাপার। তবে ভয়াবহতায় সত্যিই আন্তর্জাতিক বটে। মানে আমার মন বলছে। 

হুঁ, আমারও তেমনই মনে হচ্ছে। তবে মনে হয় এসব জিনিস এখানকার নয়, বুঝলি বাইরের মাল। এখানে কোনোভাবে ঢুকে গেছে। যাহোক, তোদের ইচ্ছে কেসটা হাতে নেওয়ার তাইতো? 

হুঁ। 

তা আমাকে কী করতে হবে? 

খুব সামান্য কাজ। বসকে বলে-কয়ে রাজি করাতে হবে। 

বটে, তুই এখন নিজের অ্যাসাইনমেন্ট ছেড়ে অরণ্যদেবের সঙ্গে যাবি রহস্য উন্মোচনে আর সেই পারমিশন করাতে হবে আমাকে। ভালো মজা তো! হ্যাঁ পারমিশন তোমাকেই করাতে হবে। আর বস যে তোমার কথাতেই কনভিনসড হবে সেটাও খুব ভালো করে জানি। সো মিস্টার অঞ্জন প্লিজ প্রসিড। 

খুব বেড়েছিস!… আচ্ছা দেখছি। কাল জানাচ্ছি। বলে ফোন রেখে দিয়েছিল অঞ্জন। 

অঞ্জনের দেখছি মানে যে কাজটা হয়েই গেছে সেই ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। এমন সিনিয়র পাওয়া ভাগ্যের। 

অরণ্য বিছানায় বসল। দিয়া বলল, একটা ভালো ব্যাপার হয়েছে, আমরা যদি শিলং ভালো করে কভার নাও করতে পারি তবুও ক্রেটের ইন্টারভিউ করতে পেরেছি এটাই বিশাল ব্যাপার। শিলং এই বছর না হলে আসছে বছর হবে কিন্তু ক্রেটকে তো বছর বছর পাব না। 

কিন্তু ইন্টারভিউ কি বলতে পারবি এটাকে? উনি নিজের কথা কিন্তু কিছু‍ই বলেননি সেই অর্থে। 

আরে কাছে তো কিছুটা আসতে পেরেছি। বিশ্বাসও করেছে লোকটা আমাদের, নইলে ওই মাপের লোক আমাদের কাল লাঞ্চে ডাকে। 

হুঁ…আসলে লোকটা কিন্তু বেসিক্যালি একটা পাগল। বাইরেরটা এমন কঠিন কিন্তু ভেতর খুব নরম। সেটা খেয়াল করেছিস? 

হুঁ ভেতর নরম না হলে কেউ এমন করতে পারে না। দেখ পৃথিবীতে অনেক ধনকুবের অনেক সেলিব্রিটি রয়েছে যাদের অনেক দানধ্যান চ্যারিটি রয়েছে কিন্তু কজন এমন নিজের দেশ থেকে উড়ে চলে এসে তার অনুদানে চলা হোমের আবাসিকরা কেমন রয়েছে তা নিজে দেখা, তাদের সঙ্গে মিশে যাওয়া এমনকি আরও নতুন হোম তৈরির প্ল্যান…জাস্ট এই লোকগুলো রয়েছে বলেই পৃথিবীটা এখনো সুন্দর। 

ঠিকই বলেছিস, এটা শুধু ইন্ডিয়াতে নয় ওর ম্যানেজারের কাছে শুনলি তো বেশ কয়েকটা থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিতে ওর এমন দানধ্যান রয়েছে। নিশ্চয়ই ওগুলোতেও যায়। রিয়্যালি হ্যাটস অফ। 

আজ বিকেলেই ক্রেট ওদের ইনভাইট করেছিল আগামীকাল লাঞ্চের জন্য। কাল সন্ধের ফ্লাইটে ক্রেট চলে যাবে দিল্লিতে। ওদিকেও ওদের আরেকটা এমন হোম রয়েছে। আগ্রার দিকে। ওটা ভিজিট করবে, সেখান থেকে অন্ধ্রপ্রদেশ, তারপর আবার ফিরবেন এখানে। তখন হয়তো আর দেখা হবে না। দিয়া আর অরণ্যকে ওর পছন্দ হয়েছে তাই তিনি ওদের সঙ্গে লাঞ্চ করতে চান। এমন লোভনীয় প্রস্তাব মিস করার কোনো মানেই হয় না, সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গিয়েছে ওরা দুজন। কাল বেলা বারোটার মধ্যে ক্রেট যে হোটেলে রয়েছে সেখানে পৌঁছতে হবে। 

তবে একটা জিনিস খেয়াল করেছিস ক্রেটের একটা ছবিও কিন্তু আমরা কেউ তুলতে পারলাম না। 

দেখি কাল যদি সেলফি তুলতেও রাজি হয়। বলল দিয়া। 

আসলে ক্রেটের ম্যানেজার প্রথমেই বলে দিয়েছিলেন ক্রেট ফটো তোলা একেবারেই পছন্দ করেন না তাই প্লিজ ওর কোনো ছবি তুলবেন না বা ওর সঙ্গে ছবি তোলার অনুরোধ করবেন না। 

সেই কথা মেনে নিয়েছে দিয়া আর অরণ্য। মুডি লোক, যা মানতে বলছে তা মেনে নেওয়াই ভালো। বরং উনি যা দিয়েছেন তা অপ্রত্যাশিত। 

অরণ্য বলল, বুঝলি দিয়া, এই ব্যাগের শিকড় বহুদূর পর্যন্ত গাঁথা রয়েছে। জানি না আমরা আদৌ সেখানে পৌঁছতে পারব কি না। 

আর পৌঁছলেও ফেরত আসতে পারব কি না। 

আচ্ছা আমরা কি শেষ পর্যন্ত গোয়েন্দা হয়ে উঠলাম নাকি বল তো? 

অরণ্যর প্রশ্নে হেসে উঠল দিয়া। বলল, যা বলেছিস মাইরি! আমিও ঠিক এই কথাটাই ভাবছি। দুজনের কারোরই ডিটেকটিভ হওয়ার শখ নেই, কীভাবে ডিটেকটিভগিরি করে তাও জানা নেই। অথচ আমাদের কপালেই … 

সত্যিই তাই। আমার তো ওই ফেলুদা আর কাকাবাবু টাইপ কিছু নভেল ছাড়া আর কোনো ডিটেকটিভ নভেলও পড়া নেই। কী চাপ রে ভাই! 

যাক এখন হ্যাঁ বলে ফেলেছিস, সো এগোতেই হবে। 

হুঁ আসলে নিজেরও খুব আগ্রহ হচ্ছে, এমন ভয়ংকর একটা বিজনেস এই ভারতেই চলছে সেটার উৎস কী না জানতে পারলে ঘুমোতে পারব না। 

দেখ হয়তো এটাও ওই ডার্কওয়েবের মাধ্যমেই কেনাবেচা হয়। 

হুঁ, তা তো নিশ্চয়ই হয়। তবে এবার আর ভারচুয়াল গেম নয় রিয়্যাল লেদারের ব্যাগ। অ্যান্ড দা ব্যাগ ইজ… 

ভাবলেই কেমন গা শিউরে উঠছে আমার! মানুষ কী হয়ে গেছে রে! পিশাচের থেকেও অধম! 

চিরকালই তাই ছিল। আর সভ্য হবে না। 

এর থেকে পশুপাখিরা ভালো। 

শুনে হাসল অরণ্য। তারপর বলল, যাক গে শোন আগে ঠিক করে ফেল তুই কী হবি? 

কী হবি মানে? 

মানে দুজন ডিটেকটিভ তো আর হতে পারে না, একজন মেইন আরেকজন অ্যাসিসট্যান্ট হয়। তুই কী হবি ব্যোমকেশ, ফেলুদা, কাকাবাবু নাকি অজিত, তোপসে, সন্তু? 

কেন অ্যাসিসট্যান্ট একজনকে হতেই হবে তোকে কে বলল? জয়ন্ত- মানিক কিংবা বিমল-কুমারও তো হতে পারি আমরা। 

ওঃ রাইট হেমেন্দ্রকুমার। ঠিক ঠিক! তবে ওটা জয়ন্তী-মানিক অথবা বিমলা-কুমার হবে আমাদের ক্ষেত্রে। মেল-ফিমেল কেস তো। 

দুজনেই হেসে উঠল। 

অরণ্য ঘরের লাইট নিভিয়ে দিলো। ঘরে নাইটল্যাম্পের নীল আলো। ব্ল্যাঙ্কেটটা গায়ে জড়িয়ে নিল অরণ্য। দিয়া অরণ্যর গা ঘেঁষে শুলো। 

অরণ্য বলল, বুঝলি দিয়া… 

উঁহুঁ এখন আর অন্য কোনো কথা নয়। অরণ্যর ঠোঁটে আঙুল রাখল দিয়া। 

১৩

সকালে অরণ্যর ঘুম ভাঙল যখন দিয়া বিছানায় নেই। ওর ভোরবেলার মধ্যে উঠে পড়া স্বভাব হয়েছে। মাস ছয়েক হলো ওর মাথায় ঢুকেছে ওজন কমাতে হবে। তাই ভোরে উঠে জগিং, যোগাসন ইত্যাদি করে। যদিও ওজন ওতে খুব যে কমেছে তা মনে হয় না। অরণ্য এই নিয়ে খুব পেছনে লাগে। দিয়াও চ্যালেঞ্জ নিয়ে বলেছে। এক বছরের মধ্যে যদি আমি দীপিকা পাড়ুকোন না হয়েছি তো দেখিস… 

ইস প্লিজ দীপিকা হোস না। অমন জিরো ফিগার আমার পছন্দ নয়। তার থেকে আমার এই গাবলুকুমারীই ভালো। 

চোখ মেলে অরণ্য দেখল রুমের মেঝেতে বসে দিয়া প্রাণায়াম করছে। বিছানা ছেড়ে উঠে বসল অরণ্য। বালিশের পাশে রাখা মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল বউদি মেসেজ করেছে। ঘুম ভাঙলে একটা কল কোরো। বউদি মেসেজটা করেছে ভোর পাঁচটার সময়ে। 

ভয়ে বুক ধক করে উঠল অরণ্যর। সব ঠিক আছে তো? সঙ্গে সঙ্গে ফোন করল বউদিকে। বেশ কিছুক্ষণ রিং হয়ে গেল, অস্থির হয়ে উঠল অরণ্য। কেটে যাওয়ার শেষমুহূর্তে ফোন রিসিভ করল বউদি। 

হ্যালো। 

বউদি ফোন তুলছ না কেন? 

বাথরুমে গিয়েছিলাম। শুনতে পাইনি। 

কী হয়েছে তোমার মেসেজ দেখলাম এখন?

সব ঠিক আছে তো?

হ্যাঁ ঠিক আছে। 

আঁখি কোথায়? 

ও তো স্কুলে গেছে। 

আচ্ছা। সব ঠিক আছে শুনে একটু স্বস্তি পেল অরণ্য। 

তোমরা রয়েছ কেমন? দুদিন ধরে কোনো ফোন নেই কিছু নেই। 

হ্যাঁ বউদি আমরা ভালোই আছি। কাজ ঠিকঠাক এগোচ্ছে। 

আসলে কাল রাতে একটা বাজে স্বপ্ন দেখলাম ওই জন্য মেসেজ করলাম তোমাকে। 

কী স্বপ্ন? 

তোমার দাদাকে দেখলাম। বলে একটু থামল বউদি। সঙ্গে সঙ্গে মনটা বিষণ্ণ হয়ে উঠল অরণ্যর। গলা নামিয়ে বলল ওঃ…তাই… 

হ্যাঁ। দেখলাম আমরা সবাই বেড়াতে গিয়েছি। বেশ বড়ো একটা জঙ্গল। সেখানে ঘুরছি। হঠাৎ তুমি হারিয়ে গিয়েছ, তোমার দাদা তোমাকে খুঁজতে গেল। আমি আঁখিকে নিয়ে একা দাঁড়িয়ে। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। সন্ধে নেমে আসছিল তোমরা কেউ ফিরছিলে না। আঁখি কাঁদছিল আমার খুব ভয় লাগছিল…ঘুমটা আচমকা ভেঙে গেল। তারপরেই ভাবলাম তোমাকে ফোন করি, চিন্তা হচ্ছিল তোমার জন্য। তারপর ভাবলাম তোমরা ঘুমোচ্ছ, এখন বিরক্ত করব না। মেসেজ করলাম। 

ঘুমোচ্ছিলাম তো কী হয়েছে? তোমাকে বলে রেখেছি না যখনই মনে হবে কল করবে। মনটা খারাপ হয়ে উঠল অরণ্যর। 

তোমরা কাজে গিয়েছ সারাদিন খাটাখাটনি করে রাতে শোও, সেজন্যই…আচ্ছা অরণ্য। তোমরা ঠিক আছো তো? কোনো সমস্যা নেই তো? 

বউদির প্রশ্নটায় অরণ্যর প্রথমেই মনে পড়ল ওই ভয়ংকর ব্যাগটার কথা আর তারপর সেই রহস্য সমাধানে ঝাঁপানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা। কিন্তু এই অভিযানে যে ওরা দুজনে যাবে সেটা বউদিকে ও জানাবে না ঠিক করেই নিয়েছিল। টেনশন করবে বউদি। দাদা চলে যাওয়ার পর বউদি অরণ্যর ওপরে অনেকটাই নির্ভরশীল। অরণ্যও নিজের মায়ের মতো আগলে রাখে বউদিকে। আঁখির দায়িত্বও অনেকটা সামলায়। বাবার অভাব কিছুটা কাকাই মেটানোর চেষ্টা করে। অরণ্যর খুব অদ্ভুত লাগল এই ভেবে যে যেইমাত্র ও ভেবেছে এই বিপদের ঝুঁকিটা ও নেবে তখনই বউদির মনও কেমন অজান্তেই উদবিগ্ন হয়ে গিয়েছে যার প্রকাশ ওই স্বপ্ন। আর দাদাও যেন এখনো…মন বিষণ্ণ হয়ে উঠল অরণ্যর। দিয়া উঠে এসে অরণ্যর পাশে বসল। কিরে … 

দিয়া তোমার পাশে? 

হ্যাঁ বউদি। 

ও ভালো আছে তো? 

হ্যাঁ ভালো আছে। 

আচ্ছা। সাবধানে থেকো তোমরা। আর কাজ সেরেই চলে এসো। কোনোরকম ঝামেলা অশান্তিতে জড়িয়ো না কিন্তু। 

আচ্ছা বউদি নিশ্চিন্তে থেকো তুমি। আঁখির খেয়াল রেখো। বলে ফোনটা রেখে দিলো অরণ্য। 

দিয়া জিজ্ঞাসা করল এত সকালে বউদির ফোন? সব ঠিক তো? 

হুঁ, আশ্চর্য ব্যাপার দেখ দিয়া, আমরা যেই ভাবলাম এই ব্যাগের র‍্যাকেটটা ইনভেস্টিগেট করব অমনই বউদির মন কেমন কু ডেকেছে। মায়ের মন একেই বলে।…হ্যাঁ রে দিয়া….. 

উঁ বল। 

কী মনে হয় আমরা জিতব না হারব? 

সেটা আগে ফিল্ডে নামি তারপর বুঝে নেব। সব লড়াই-ই যে জিততে হবে এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে? নে এবার রেডি হ। 

বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল অরণ্য। দিয়াকে বউদির স্বপ্নের কথাটা জানাল। দিয়া শুনে বলল কী করবি তাহলে বউদিকে বলে দিবি? 

খেপেছিস? বউদি এমনিতেই প্রচুর টেনশনে থাকে। এসব বললে আর দেখতে হবে না অসুস্থ হয়ে পড়বে। 

আর যদি অন্য কোনোভাবে জেনে যায়? 

নাঃ! তা কী করে জানবে? এখানে তার উপায় নেই। 

তবু আমার মনে হয় বলে রাখা ভালো। 

হুঁ…। বলে চুপ করল অরণ্য। দাদার মুখটা মনে পড়ছে। মন খারাপ লাগছে হঠাৎ। দিয়া একটা কিছু আন্দাজ করল, তারপর উঠে এসে জড়িয়ে ধরল অরণ্যকে। ছেলেটা বড়ো হলেও আসলে মনের কোথাও এখনো ছেলেমানুষ, আবেগী রয়ে গেছে। 

মন খারাপ করিস না, যা রেডি হ। অরণ্যর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল দিয়া। 

১৪

হোটেল ভিনিতার দিকে যাচ্ছিল অরণ্য আর দিয়া। আর সামান্যই পথ বাকি তখন অরণ্যকে ফোন করলেন সিদ্ধার্থ- 

সুপ্রভাত। সূর্যমন্দিরের খোঁজ অলরেডি শুরু করে দিয়েছি। গৌহাটি ও তার আশেপাশে কোথাও কোনো সূর্যমন্দির রয়েছে কি না তার ইনফরমেশন পেতে দিন কয়েক লাগবে। 

দিন কয়েক তো অনেকটাই দেরি হয়ে যাবে স্যার। 

হুঁ…আসলে বোঝেনই তো আমাদের দেশ মন্দিরের দেশ। আর গৌহাটি- আসামেও অজস্র মন্দির। জায়গাটাও নেহাত ছোটো নয়, একটু সময় লাগবে। আমি সব জায়গাতেই খবর পাঠিয়েছি। ডেটা কালেক্ট করতে একটু সময় তো লাগবে। 

সেটা ঠিক। আসলে যত দিন পেরোবে ততই সময় নষ্ট হবে। ওরা আরও সতর্ক আরও প্রস্তুত হয়ে পড়বে। 

হুঁ… কিন্তু… 

আচ্ছা সেই অ্যাকিনের কোনো খবর পেলেন? সে কি দেশ ছেড়ে পালাল? 

নাঃ এখনো খোঁজ পাইনি। তবে দেশ ছেড়ে পালাতে আপাতত পারবে না। ইমিগ্রেশনেই আমার কাছে খবর চলে আসবে। আসলে আমি অ্যাকিনকে একটু বেশি ইনিশিয়েটিভ নিয়ে ধরে ফেলতেই পারি, কিন্তু তাহলে রাঘব বোয়াল ধরতে হয়তো কঠিন হয়ে যাবে। সেজন্যই কিছুটা ছেড়ে রেখেছি আসলে। বেশ কিছু বর্ডারেও আমার ইনফো পাঠানো রয়েছে। চেকপোস্টে ধরা পড়ে যাবে। তো আমার মনে হয় অ্যাকিন খুব বেশিদূর যায়নি। 

বেশ। তবে স্যার আপনাকে একটা সাজেশন, কাল আমিও রাতে নেট ঘেঁটে একটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছিলাম গৌহাটির সূর্যমন্দির বা সূর্যের আরাধনা হয় এমন কোনো সংস্থা আশ্রম কিছু আছে নাকি কোথাও? তো শুধু সূর্যপাহাড় বলে একটা জায়গার খোঁজ পেয়েছি গোয়ালপাড়াতে আর কিছুই তেমন পাচ্ছি না। 

হ্যাঁ এটাই তো সমস্যা। সূর্যের মন্দির তেমন নেই। 

আর এটাই কিন্তু সুবিধা, এই যদি রাম, কৃষ্ণ, শিব কিংবা দুর্গা মন্দির হতো তাহলে কিন্তু এভাবে একটা স্তবগানকে বেস করে খোঁজাটা অসম্ভব হতো। কারণ ভারতের কথা বাদ দিন, এই গৌহাটিরও হয়তো প্রতিটি পাড়ায় এমন মন্দির দু-দশটা করে রয়েছে। 

হুঁ। কী করা যায় বলুন তো? 

খোঁজার জন্য বিকল্প কোনো পথ ভাবুন। মানে এই মন্দির-টন্দিরের বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন এমন কেউ… 

অরণ্যর কথা শেষ হলো না। তার আগেই সিদ্ধার্থ খুব উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন ওঃ রাইট…একেবারে ঠিক বলেছেন আপনি। আমি ঠিক এটাই ভাবছিলাম এই মুহূর্তে। হ্যাঁ একজন রয়েছেন, গৌহাটি ইউনিভার্সিটির প্রফেসর মানস বোরা। আমি এখনই যোগাযোগ করছি তার সঙ্গে। আমার ধারণা উনি একটা গাইডলাইন দিতে পারবেন। 

প্লিজ তাহলে সেটাই দেখুন। 

হ্যাঁ এখনই দেখছি। 

গাড়ি এসে থামল হোটেল ভিনিতার সামনে। 

অরণ্য বলল স্যার আমি এখন রাখছি তাহলে ভিনিতা হোটেলে জাস্ট পৌঁছলাম। এখানে আমরা ঘণ্টাখানেক থাকব। আপনি এর মধ্যে যোগাযোগ করতে চাইলে প্লিজ আমাকে একটা টেক্সট করে দেবেন। 

ও কে। থ্যাঙ্কস। বলে ফোন রেখে দিলেন সিদ্ধার্থ। তারপরেই ডাকলেন তার অধস্তন এসআই প্রশান্তকে। প্রশান্ত পুলিশে চাকরির পাশাপাশি সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চাও করে। ওর সঙ্গে অনেক কবি সাহিত্যিক, পণ্ডিতদের যোগাযোগ রয়েছে। ফোন নাম্বারও রয়েছে। এই মাস ছয়েক আগেই পল্টনবাজার থানা একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। সেখানে সঞ্জয়ের উদ্যোগেই প্রধান অতিথি করে আনা হয়েছিল ডক্টর বোরাকে। ওই সময়ই সিদ্ধার্থর সঙ্গে পরিচয়। কথাসূত্রে সিদ্ধার্থ জেনেছিলেন সোশিওলজির শিক্ষক এই অধ্যাপক আসামের প্রাচীন ইতিহাস, স্থাপত্য, সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেককিছু জানেন। 

বলুন স্যার। 

প্রশান্ত, প্রফেসর মানস বোরার সঙ্গে আমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফিক্স করো। আজই। 

ও কে স্যার। ওনাকে কি ডাকব এখানে? 

না না আমিই যাব। তুমি শুধু জেনে নাও আজ কখন উনি বাড়িতে থাকবেন।

ও কে স্যার। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *