১
রাত প্রায় আড়াইটা। চারদিকে আজ এমনই কুয়াশা আর অন্ধকার যেন মনে হচ্ছে বিশাল এক দৈত্য তার নিজের শরীর দিয়ে গোটা গৌহাটি শহরটাকে আকাশসমেত ঢেকে ফেলেছে। স্ট্রিটলাইটের আলোও ডুবে গিয়েছে এমন কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকারের করাল গ্রাসে। ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে আজ রাতেই এত ঘন কুয়াশা। কনকনে না হলেও যথেষ্ট ঠান্ডা। শহর অঘোরে ঘুমোচ্ছে। চারদিক নিশ্চুপ। এমনই নৈঃশব্দ্য, যেন সে অপেক্ষা করছে ভয়ংকর একটা কিছু ঘটার। এই নিশুতি রাতে রাস্তায় জনপ্রাণী থাকা তো দূরের কথা একটা কুকুরেরও দেখা নেই। শুধু কিছু ফুটপাতবাসী চাদর মুড়ি দিয়ে গভীর ঘুমে মগ্ন। গৌহাটির চাঁদমারি এলাকায় যে বিশাল ওভারব্রিজ রয়েছে তার নিচে ফুটপাতে বেশ কিছু মানুষ থাকে। তারা সার সার ঘুমোচ্ছে পরম নিশ্চিন্তে। সুনসান রাস্তায় সহসাই শোনা গেল একটি মোটর ভ্যানের শব্দ। অনেক দূর থেকে শব্দটি এগিয়ে আসছে। ইঞ্জিনের শব্দ নিকট থেকে নিকটতর হচ্ছে। খোঁড়া ভিখারি শাকিলের আজ ঘুমটা ভালো আসছিল না। সে তার নিজের নির্দিষ্ট স্থানটিতে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। আকাশে আজ চাঁদ তারা কিছুরই দেখা নেই। কুয়াশায় মোড়া গৌহাটি শহর যেন বেশি চুপচাপ। সে টের পেল অনেক দূর থেকে কুয়াশার চাদর কেটে একজোড়া আলো এগিয়ে আসছে, সঙ্গে মৃদু শব্দ। গাড়ির হেডলাইট, আর গাড়ির শব্দ শুনতে শুনতে অনেকগুলো বছর পার করে ফেলা শাকিলদের মতো মানুষদের এই শব্দে, এই আলোতে সামান্যতম ঘুমের ব্যাঘাত হয় না। কিন্তু আজ শাকিলের ঘুম আসছে না, কারণ ওর খুব পেট ব্যথা করছে। সম্ভবত সন্ধেবেলায় আজ যে খাবারটুকু ওর কপালে জুটেছিল সেটা খারাপ ছিল। খিদের জ্বালায় সেটাই খেয়ে ফেলেছিল শাকিল। অবশ্য শাকিলের মতো ফুটপাতে থাকা ভিখিরি, ভবঘুরেদের কেইবা কবে টাটকা গরম গরম খাবার পরিবেশন করে? ওরাও এসব বাসি পচা উচ্ছিষ্ট খেয়েই জীবনটুকু কাটিয়ে দেয়। এটাই এই অসহায় মানুষগুলোর নিয়তি।
পেটের ভেতরটা গুড়গুড় করছে আবার। শাকিল যেখানে শুয়ে রয়েছে তার পেছনেই চাঁদমারির মস্ত মাঠ। এই মাঠে শহরের অনেক অনুষ্ঠান হয়। যে মানুষগুলো রাতে মাঠের পাশে, ওভারব্রিজের নিচে শুয়ে থাকে তাদের প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জায়গা হলো ওই মাঠ। শাকিল বুঝতে পারল ওকে আবার মাঠে যেতে হবে। গাড়িটা কাছে চলে এসেছে। আচমকাই হেডলাইট নিভে গেল। ফলে রাস্তায় যে দুটি সরলরৈখিক আলোর সঞ্চার হয়েছিল তা আবার ডুবে গেল ঘন অন্ধকারে। গাড়িটা শুধু হেডলাইটই নেভাল না, যেখানে শাকিলের মতো মানুষরা শুয়ে রয়েছে তার সামনে এসে গাড়িটা তার ইঞ্জিনও বন্ধ করে ফেলল। শাকিল একটু অবাক হলো। পেট হালকা করার জন্য মাঠের দিকে যেতে গিয়েও গেল না। মারুতি ভ্যান গাড়িটার রং কালচে হওয়ার ফলে সেটাও যেন অন্ধকারে মিশে গিয়েছে। শাকিল ভাবল গাড়ি নিশ্চয়ই খারাপ হয়েছে। দেখল গাড়ি থেকে বেশ দ্রুত পায়ে নেমে এলো তিনজন লোক। প্রত্যেকেই আপাদমস্তক শীতপোশাকে ঢাকা। লোকগুলো চটপট এগিয়ে এলো যেখানে শাকিলরা শুয়ে রয়েছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। একজন শুধু একটা টর্চ জ্বালাল। তারপর ছেঁড়া কম্বল, লেপ, চাদর ঢাকা ঘুমন্ত মানুষগুলোর শরীরে টর্চ ফেলতে থাকল। যেন কাউকে খুঁজছে। এত রাতে কাকে খুঁজতে পারে? কে লোকগুলো? শাকিলের ভয় লাগল। পেট আরও গুড়গুড় করছে। হঠাৎই টর্চের আলোটা থেমে গেল একটা শরীরের ওপর। টর্চটা যে ধরে রয়েছে সেই লোকটা টর্চ ধরা হাতটা নাড়িয়ে বাকি দুজনকে একটা কিছু ইশারা করল। আর তারপর মুহূর্তেই যেটা ঘটল তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না শাকিল। ওর থেকে মাত্র ফুট দশেক দূরে ঘুমিয়ে থাকা একজনকে কম্বলসমেত মুহূর্তের মধ্যে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল ওই দুজন। একজন চেপে ধরল মুখ অন্যজন দুহাতে ওকে জাপটে ধরে দুজনে মিলে নিয়ে গেল গাড়ির দিকে। কাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে? কাকে? কেন নিয়ে যাচ্ছে? ওরা কারা? ভয়ে গলা দিয়ে আওয়াজ পর্যন্ত বেরোচ্ছে না শাকিলের। লোকগুলো ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! টর্চ ধরা লোকটাও ছুটে গেল গাড়ির দিকে। ভ্যানের দরজা খোলাই ছিল। গাড়ি স্টার্ট নিল। লোকগুলো ঢুকে পড়ল গাড়ির ভেতর। গাড়িটা মিনিটখানেকের মধ্যে আবার ঘন অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। শাকিলের মনে পড়ল আজ থেকে দিন কুড়ি আগে আচমকাই এক রাতে উধাও হয়ে গিয়েছিল বছর চৌদ্দর বিট্টু, সারাদিন জুতো পালিশের কাজ সেরে ছেলেটা এখানেই শুতো। একদিন রাতে শুলো, পরের দিন সকালে ওকে আর দেখা গেল না, আর এলোই না। এখানে যারা থাকে তারা পাশাপাশি থাকলেও কেউ কারও ব্যাপারে তেমন খোঁজখবর নেয় না। নিজের পেট ভরানোর তালেই ব্যস্ত থাকে। তাই বিট্টুর নিরুদ্দেশ হওয়া নিয়েও কেউ মাথা ঘামায়নি। তাহলে কি…তাহলে কি বিট্টুও এভাবেইইই…!
২
বেলা এগারোটা বাজে। গৌহাটির পল্টনবাজার থানায় নিজের চেয়ারে বসেছিলেন অফিস ইনচার্জ সিদ্ধার্থ কলিতা। মধ্য চল্লিশ এই অসমিয়া পুলিশ অফিসার অত্যন্ত বিচক্ষণ। দেখতেও সুপুরুষ। সিদ্ধার্থর টেবিলের উলটোদিকে বসে রয়েছে দিয়া, অরণ্য এবং সিদ্ধার্থর কলেজ জীবনের বন্ধু রাকেশ জোশী। দিয়া আর অরণ্য আজ সকালের ফ্লাইটেই কলকাতা থেকে গৌহাটি এসেছে। গৌহাটি আসার কারণ অফিস অ্যাসাইনমেন্ট। যদিও অ্যাসাইনমেন্টটা ঠিক গৌহাটিতে নয়, শিলং-এ, আর অ্যাসাইনমেন্টটাও বেশ ইন্টারেস্টিং। গত সপ্তাহে অফিস মিটিং-এ অঞ্জনদা যখন অ্যাসাইনমেন্টটা কে নিতে চায় বলে প্রশ্ন ছুড়েছিল সবার প্রথমে দিয়া বলে উঠেছিল আমি যাব। আমাকে প্লিজ পাঠাও।
অঞ্জন হেসে বলেছিল, আমি জানতাম প্রথম রেসপন্ড তুই-ই করবি। ও কে ডান। পুরো জমিয়ে দিতে হবে কিন্তু। এটা এক্সক্লুসিভ।
দিয়া আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিল নিশ্চিন্তে থাকতে পারো। এই বছর আমাদের রোজ খবর পেপারে ক্রিসমাস নিয়ে বেস্ট স্টোরি হবে।
দিয়ার কলিগ জার্নালিস্টদের মধ্যে কারও সুপ্ত ইচ্ছে থাকলেও আর উপায় ছিল না। কারণ দিয়া মিত্রর ইচ্ছের কোনো অ্যাসাইনমেন্টে তাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তবে তার সংগত কারণও রয়েছে। গতবছরে অরণ্যর সঙ্গে সেই ডার্কওয়েব রহস্য ভেদ করার পর সেই ঘটনা নিয়ে বিশাল একটা স্টোরি করেছিল দিয়া। সেটা পাঠকমহলে বিরাট সাড়া ফেলেছিল। তারপর থেকেই অফিসে তো বটেই মিডিয়ামহলে দিয়ার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। সিনিয়র জার্নালিস্ট হিসেবে প্রমোশনও হয়। অঞ্জনদা বলেছিল কিরে আমার মতো ক্রাইম ডেস্কে চলে আসবি নাকি? বল, তাহলে বসকে সুপারিশ করছি।
দিয়া নাক কুঁচকে আপত্তি জানিয়েছিল। ইস মোটেই না, আমি যেমন আছি বেশ আছি। ওসব ক্রাইমটাইম আমার পোষাবে না।
অঞ্জন হেসে বলেছিল, কপালে তোর কী লেখা রয়েছে কি জানিস?
যদিও তারপর এক বছরে দিয়া যত অ্যাসাইনমেন্ট করেছে সেগুলোর প্রায় কোনোটাই ক্রাইম রিলেটেড নয়। আসলে দিয়ার ক্রাইম ডেস্ক ভালোও লাগে না। গৌহাটি আসার কারণটা হলো, দিন কয়েক আগে অফিসে কয়েকজন মিলে গল্প হচ্ছিল। আর কিছুদিন পরেই ক্রিসমাস। তো ক্রিসমাস নিয়ে স্পেশাল কী স্টোরি করা যায় তাই নিয়ে বিভিন্ন প্ল্যানিং। সেই আলোচনায় দিয়ার সিনিয়র ফিচার এডিটর দীপ্তদা তো ছিলই, অঞ্জনদাও ছিল। দীপ্ত তার টিমের ছেলেমেয়েদের বলেছিল এবারে নতুন কিছু ভাব তোরা। ওই সেই সান্তাক্লজের জন্ম, জীবনবেত্তান্ত আর নিউমার্কেট কেকশপ, পার্কস্ট্রিটের অ্যাংলোপাড়া, সেলেবদের লালটুপি পরা ছবি নিয়ে প্রচুর ডাঁটা চেবানো হয়েছে, গিভ সামথিং স্পেশাল।
দিয়া বলেছিল তাহলে কোম্পানিকে বলো আমাদের আমেরিকা ইউরোপে পাঠাতে। জমিয়ে স্টোরি করব। ওই নেট ঘেঁটে সস্তার স্টোরি সারতে গেলে এমনই আলুনি হবে।
অঞ্জন বলেছিল কেন? ভারতে কি স্পেশাল ক্রিসমাসের অভাব ঘটেছে নাকি? জার্নালিস্ট হয়েছিস একটু চোখকান খোলা রাখ। খোঁজখবর নে কোথায় জমজমাট ক্রিসমাস সেলিব্রেট হয়।
সুস্মেলি বলেছিল তুমি কি গোয়ার কথা বলছ?
অঞ্জন উত্তর দিয়েছিল হ্যাঁ গোয়াতেও জমাটি সেলিব্রেশন হয়, এটা ঠিকই কিন্তু সেটা অনেক বেশি ফোকাস্ড। আরেকটু প্রচার কম বাট নিজস্বতা রয়েছে এমন একটা জায়গার ক্রিসমাসের আমি সাক্ষী হয়েছিলাম। অসাধারণ এক্সপিরিয়েন্স। তাও অবশ্য বছর আষ্টেক আগের কথা বলছি। আমার আগের কোম্পানিতে আমি বেশ কিছুদিন গৌহাটিতে পোস্টেড ছিলাম, সেখানে আমার এক বন্ধু ছিল চন্দ্রকান্ত বরুয়া। ও আমাকে গৌহাটি থেকে বাইকে বসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল শিলঙের ক্রিসমাস দেখাতে। শিলঙের ক্রিসমাসের বৈশিষ্ট্য জানিস তো? একদিন আগে সেলিব্রেশন হয়, মানে চব্বিশে ডিসেম্বর হয়। চব্বিশের রাতে দারুণ পার্টি, হইহুল্লোড়, কিন্তু পঁচিশে গেলে দেখবি চারদিক সুনসান। দুরন্ত লেগেছিল। পুরো রাস্তাঘাট সাজানো হয় আলো দিয়ে, সকলে আনন্দ করে।
আরেব্বাস দারুণ তো? তাহলে শিলং কভার করলেই ভালো হয়। বলেছিল দীপ্ত।
হাতে সময় বেশি ছিল না। চটপট মিটিং। এডিটর ইন চিফ শাম্বদা রাজি হয়ে গেলেন।
অঞ্জন তখন বলেছিল, তবে আমার আরও একটা সাজেশন রয়েছে, দিয়া যদি একেবারে ক্রিসমাসের সময় না পৌঁছে কটা দিন আগে যায়। তাহলে ক্রিসমাসের জন্য ওদের যে প্রস্তুতি, সেটাও কভার করতে পারবে এবং সেটাও কিন্তু দারুণ স্টোরি হতে পারে।
শাম্ব সঙ্গে সঙ্গে রাজি। গুড আইডিয়া। দিয়া দিন দশ-বারো আগে চলে যাক। আগে ক্রিসমাসে গৌহাটি-শিলং-এর ওপর রোজ ছোটো ছোটো স্টোরি করে পাঠাক, মানে ওখানকার টুরিজম, কালচার ইত্যাদি নিয়ে, তারপর শেষে ক্রিসমাস কভার করে ফিরে আসবে। কিরে কী বলিস?
দিয়া ঘাড় কাত করে বলেছিল, নো প্রবলেম। তারপরেই ওর মনে পড়েছিল অরণ্যর কথা। অতদিন অরণ্যর সঙ্গে দেখা না করে থাকা…তারপর আবার ক্রিসমাসের সময়ও যদি দেখা না হয়, ছেলেটা মুখে কিছু না বললেও মনে খুব কষ্ট পাবে।
কী ভাবছিস? জিজ্ঞাসা করেছিল শাম্ব।
উঁ…ভাবছি আমার সঙ্গে তো একজন ফটোগ্রাফার লাগবে। আমার ফটো তোলার জ্ঞান তো তুমি জানো…
হুঁ তাও তো ঠিক, তাহলে কি পিন্টুকে বলব তোর সঙ্গে…
শাম্বর কথা শেষ না হওয়ার আগেই দিয়া বলেছিল আমার একটা সাজেশন রয়েছে, মানে জাস্ট সাজেশন আর কি একবার ভেবে দেখতে পারো।
আরে আগে সাজেশনটা তো বল।
ওই আসলে অরণ্য তো শখের ফটোগ্রাফিটা ভালোই করে দেখেছি, আর ক্যামেরাটাও দেখে বেশ জম্পেশ বলেই মনে হয়। বুঝেছ তো…মানে…
অঞ্জনদা ঠোঁট চেপে হেসে বলেছিল, সব বুঝছি বলে যা বলে যা।
এটুকুই বলার ছিল।
ও কে শোনো শাম্বদা, দিয়া মিত্র যেটা বলতে চাইছে তার স্পষ্ট অর্থ হলো সে এই টুরে তার বয়ফ্রেন্ড ফ্যান্টম অর্থাৎ অরণ্যদেবকে ছাড়া যেতে রাজি নয়। এবং সে একা গেলে কাজকর্ম ফেলে রাখার কিী হইল অন্তরে ব্যথা বলে বসে রইবে। সুতরাং কী করা উচিত এডিটর হিসেবে তুমিই সিদ্ধান্ত নাও।
শাম্বও হেসে বলেছিল সে তো বুঝলাম ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার আমরা পেয়ে যাচ্ছি কিন্তু বাকি ব্যবস্থা…
না না ওর যাতায়াত থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব সব ওর, কোম্পানিকে বিয়ার করতে হবে না। ওটা ওর নিজের দায়িত্ব।
ও কে তাহলে কোনো ব্যাপার না। তবে শুধু অরণ্যর এয়ারফেয়ারটাই ওকে বিয়ার করতে হবে। বাকি ফুড অ্যান্ড লজিং তো আলাদা করার কোনো ব্যাপার নেই। ওই একসঙ্গেই বিল করে রাখবি। ম্যানেজ হয়ে যাবে।
থ্যাঙ্ক ইউ শাম্বদা।
তবে দেখিস শুধু প্রেম করে বেড়াস না, কাজের কথাও একটু মাথায় রাখিস। টিপ্পনী কেটেছিল অঞ্জন।
খালি বাজে কথা! অরণ্যর সঙ্গে আবার বেশ কিছুদিন একটানা একসঙ্গে থাকতে পারার আসন্ন সুযোগ দিয়াকে আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছিল। মিটিং রুম থেকে বেরিয়েই অরণ্যকে ফোন, অ্যাই শোন একটা দারুণ খবর রয়েছে…
.
হাতে আর মাত্র কয়েকদিন সময় ছিল। তার মধ্যেই প্রস্তুতি। কোম্পানি থেকে দিয়ার অ্যাকাউন্টে বেশ কিছু টাকা অ্যাডভান্স দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকেই দুজনের গৌহাটি যাওয়ার ফ্লাইটের টিকিট কেটে নিয়েছিল দিয়া। অরণ্য বলেছিল আমার ফেয়ারটা আমাকে বিয়ার করতে দে প্লিজ।
সেই কথা শুনে দিয়া খটাং করে অরণ্যর মাথায় একটা গাঁট্টা হাঁকিয়ে বলেছে শালা সাতজন্মের বেকার, আবার পয়সার দেমাক দেখাচ্ছে! ফ্রিতে চাপাচ্ছি চেপে নে। পরে জিন্দেগিতে যদি কোনোদিন চাকরিবাকরি পাস তাহলে উশুল করে নেব। তারপর দুজনেই হো-হো করে হেসে উঠেছিল। দুজনে রেডি।
বেরোনোর ঠিক আগের দিন রাতে দীপ্তদার ফোন, তখন দিয়া নিজের সুটকেস গুছোচ্ছে, ‘এই শোন তোর জন্য দুর্দান্ত খবর রয়েছে। তুই কাল গৌহাটি পৌঁছচ্ছিস, আর পরশুদিন সকালে ক্রেট গৌহাটি পৌঁছচ্ছেন। ইট ইজ অ্যা গোল্ডেন অপরচুনিটি বোথ ফর ইউ অ্যান্ড আওয়ার পেপার। আমি ওর সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলে একটা ইন্টারভিউ ফিক্স করার ট্রাই নিচ্ছি, জানি না ক্রেট রাজি হবেন কি না, কিন্তু যদি বাইচান্স রাজি হয়ে যান তাহলে তুই জাস্ট অরণ্যকে নিয়ে চলে যাবি। ও কে? বাকি ডিটেল আমি তোকে সব জানিয়ে দেবো। আর অঞ্জনকে একবার ফোন করে নিস।
আচ্ছা। বলে ফোনটা কেটেই দিয়া মনে মনে আনন্দে হুররে বলে উঠেছিল। ক্রেটের ইন্টারভিউ…জাস্ট ভাবাই যাচ্ছে না। দা ওয়ার্ল্ড ফেমাস ফ্যাশন ডিজাইনার ফিলিপ ক্রেট, যার ফ্যাশন অ্যাকসেসরিজ, আউটফিটের বিশ্বজোড়া সুনাম। পৃথিবীর প্রায় সব দেশের বড়ো বড়ো শহরে ক্রেটের আউটলেট রয়েছে। ক্রেটস কালেকশন লেখা লোগো। ইন্ডিয়াতেও রয়েছে। তবে ওইসব আউটলেটে ঢোকার জন্য যথেষ্ট দমদার হওয়া দরকার। মানে মধ্যবিত্তের নাগালের অনেক বাইরে। ক্রেটের জিনিসপত্র যেমন নাগালের বাইরে ক্রেট নিজেও তাই। ক্রিয়েটিভ ডিজাইনার হিসেবে ওয়ার্ল্ডের সেরাদের মধ্যে তার নাম উচ্চারিত হলেও এই ভদ্রলোক নিজেকে বরাবর আলোর বাইরে রাখতেই ভালোবাসেন। ফলে ওর সম্পর্কে মিডিয়ার আগ্রহ চিরকালই তুঙ্গে, আর যেহেতু তিনি প্রায় ধরাছোঁয়ার বাইরে তাই তাকে নিয়ে মার্কেটে গসিপও প্রচুর। অবশ্য এস বকিছু থেকেই শতযোজন দূরে থাকেন ক্রেট। তিনি আসছেন ইন্ডিয়াতে এবং গৌহাটিতে যখন কাকতালীয়ভাবে দিয়ারও গৌহাটিতে থাকার কথা। উফ যদি ইন্টারভিউটা সত্যিই নেওয়া যায় জীবনের একটা অ্যাচিভমেন্ট হবে! উত্তেজনায় হাত-পা ঘেমে গিয়েছিল দিয়ার। দিয়া ফোন করেছিল অঞ্জনদাকে। অঞ্জনদা বলেছিল দীপ্ত আমাকে জানিয়েছে, দেখ যদি ফিলিপ রাজি হয়, যা খ্যাপা লোক… আর তোকে যে কারণে ফোন করেছিলাম সেটা হলো গৌহাটিতে তোদের হোটেল ঠিক করা হয়েছে পল্টনবাজারে। পল্টনবাজার থানার ওসি সিদ্ধার্থ কলিতা আমার বিশেষ পরিচিত। ওখানে গিয়ে তোরা এসেছিস, কোথায় থাকবি এবং নিজেদের ফোন নাম্বার এই ডিটেলগুলো ওকে দিয়ে রাখিস। বাইচান্স কোনো দরকার পড়লে… কী ব্যাপার অঞ্জনদা? আবার পুলিশ কেন? আমি কি ক্রাইম রিপোর্ট করতে যাচ্ছি নাকি? তুমি না সত্যি…
আরে তা না…মানে জাস্ট জানিয়ে রাখা।
আমি জানি কেন বলছ? দিয়া মিত্রর পাশে স্বয়ং অরণ্যদেব থাকছে। কোনো আলফা বিটা গামা আমার কিচ্ছু করতে পারবে না। বুঝেছ?
বেশ মা বুঝেছি। কিন্তু যা বললাম সেটা করে রেখো দয়া করে। আর যদি ট্যাক্সির বদলে কোনো কার হায়ার করিস তাহলে ড্রাইভারের ডিটেলটাও সিদ্ধার্থকে দিয়ে রাখিস।
ও কে স্যার।
গুড নাইট।
পরের দিন সকাল সাতটার ফ্লাইট ছিল। কলকাতা থেকে ঘণ্টাখানেকের পথ। গৌহাটি এয়ারপোর্ট থেকে চেক-আউট করে একটা ট্যাক্সি হায়ার করে নিয়েছিল অরণ্য। দিয়াকে বলেছিল আগেই কার হায়ার করার কোনো দরকার নেই। ওদের হোটেলের নাম পার্পল রেসিডেন্সি। মেইন রাস্তার ওপরেই চার তলা বেশ ছিমছাম ভালো হোটেল। অফিস থেকে বুক করে রাখা ছিল। রুমে পৌঁছে আগে দুজনে একটু ফ্রেশ হয়ে নিল। তারপর ব্রেকফাস্ট-চা ইত্যাদি খেয়ে আবার দুজনেই বেরোল পল্টনবাজার থানার উদ্দেশে।
৩
ওখানে সিদ্ধার্থ ছিলেন। দিয়া গিয়ে নিজের পরিচয় দিতেই হ্যাঁ হ্যাঁ বসুন বলে দিব্যি স্পষ্ট বাংলায় দিয়া আর অরণ্যকে আপ্যায়ন করল সিদ্ধার্থ। সিদ্ধার্থর সামনে রাকেশ জোশী আগে থেকেই বসেছিলেন তার সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিলো সিদ্ধার্থ। রাকেশ গৌহাটি ফরেনসিক ল্যাবে রয়েছেন। দিয়া জার্নালিস্ট এবং কলকাতা থেকে কেন এসেছে সেটা রাকেশকে বলার পর রাকেশ বেশ খুশি হয়েই বলল, খুব ভালো অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে এসেছেন। বেস্ট অফ লাক। তারপর অরণ্যর দিকে তাকিয়ে রাকেশ জিজ্ঞাসা করলেন আপনিও কি জার্নালিস্ট?
অরণ্য সবে না বলতে যাবে, তার আগেই সিদ্ধার্থ অসমিয়া ভাষায় রাকেশকে বলল, ওরে বাবা উনি বিশাল বিখ্যাত লোক। গতবছর ডার্কওয়েব থেকে একটা ইন্টারন্যাশনাল র্যাকেটকে ধরেছিলেন, কী যেন একটা কম্পিউটার গেম… ব্লু হোয়েল নাকি?
না লিটল হার্ট। শুধরে দিলো দিয়া।
হ্যাঁ সেটার পান্ডাকে এই অরণ্যবার আর এই ম্যাডাম মিলে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। এফবিয়াই কেস। আমারও যেন ঝাপসা মনে ছিল কেসটা। কাল রাতে অঞ্জন ফোন করে বলল যখন মনে পড়ে গেল!
রাকেশ শুধু গ্রেট বলে অরণ্যর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো হ্যান্ডশেকের জন্য।
গল্প বেশ জমেই উঠল। দিয়া নিজেদের টুর প্ল্যান, কনট্যাক্ট নম্বর ইত্যাদি জানানোর পর সিদ্ধার্থ জিজ্ঞাসা করলেন, কীভাবে টুর করবেন ভেবেছেন? গৌহাটি থেকে শিলং-এর ডিসট্যান্স কিন্তু খুব বেশি নয়। আরামে সকালে গিয়ে বিকেলে চলে আসা যায়। তো আপনারা ট্যাক্সি করতে পারেন কিংবা কার হায়ারও করতে পারেন। যেটা আপনাদের সুবিধা। আমাকে অঞ্জন বলে দিয়েছে আপনাদের খেয়াল রাখতে। ও আমার পুরোনো বন্ধু। অ্যান্ড ভেরি ডিয়ার ফ্রেন্ড। আমি কলকাতায় গেলে ওর সঙ্গে অবশ্যই দেখা করি।
অরণ্য বলল আপনার কী মনে হয়? কার হায়ার করা সুবিধাজনক নাকি ট্যাক্সিতেই কাজ করব?
আমার তো মনে হয় প্রাইভেট কার ইজ বেস্ট অপশন। আপনাদের কাজের পক্ষে ইউজফুল হবে, কী বলো সিদ্ধার্থ?
হুঁ, আমারও তাই মত।
তাহলে প্লিজ দেখুন না আপনার চেনাশোনা বিশ্বস্ত যদি কোনো ট্র্যাভেল…
এক মিনিট। মোবাইল বার করে একটা নাম্বার সার্চ করে রিং করে কানে চেপে ধরল সিদ্ধার্থ। এই ফাঁকে জিজ্ঞাসা করল আপনারা টুয়েন্টি ফিফথ পর্যন্ত থাকছেন তাইতো?
হুঁ।
…হ্যাঁ প্রাণজয়…
কাউকে একজন অসমিয়াতে পুরো ব্যাপারটা বলে গাড়ি বুক করে ফেলল সিদ্ধার্থ। তারপর ফোন রেখে বলল গাড়ির ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পরেই এখানেই চলে আসবে। আমার চেনাশোনা এজেন্সি। কোনো টেনশন নেই। আরামে কাজ করুন।
চা এলো।
চায়ে সবে ওরা চুমুক দিতে যাবে। দুজন কনস্টেবল রুমে ঢুকল। তাদের মধ্যে একজন একটা ছেলের কলার পেছন থেকে চেপে ধরে রয়েছে। অন্য কনস্টেবলের হাতে ধরা একটি চমৎকার দেখতে লেডিস ব্যাগ।
সকলেই চায়ের চুমুক বন্ধ রেখে তাকাল ওদের দুজনের দিকে।
অসমিয়া ভাষাটা বাংলার খুব কাছাকাছি। একটু মন দিয়ে শুনলে যে- কোনো বাঙালি হুবহু না বুঝলেও মোটের ওপর বক্তব্য আন্দাজ করে নিতে পারবে। তাই দিয়া আর অরণ্যর বুঝতে অসুবিধা হলো না হাতে ব্যাগ ধরা কনস্টেবল কী বলছে। ব্যাপার হলো এই রোগাপাতলা ছোকরা ছিঁচকেটিকে ওরা পাকড়াও করেছে হোটেল ক্লাসিকের সামনে থেকে। কনস্টেবল দুজন বাইকে চেপে থানার দিকে আসছিল তখন খেয়াল করে হোটেলের সামনে একজন ফরেনারকে একজন লোক পেপারপ্যাকে মুড়ে একটি জিনিস দিচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই এই ছিঁচকেটি ওই দুজনের মাঝে এসে আচমকা প্যাকেটটা ছিনতাই করে নিয়ে দৌড় লাগায়। ওই দুজন প্রথমে হতভম্ব হয়ে যায়, তারপরেই দুজনে তাড়া করে চোরের পেছনে, কনস্টেবল দুজনও বাইক চালিয়ে ধাওয়া করে ছেলেটির পেছনে। যাদের ছিনতাই হয়েছিল তাদের কনস্টেবল বলে যায় আপনারা ওইখানেই দাঁড়ান আমরা এখনই ধরে ফেলব। পুলিশকে চেজ করতে ওই লোক দুজন থেমে যায়। বেশ কিছুক্ষণ এইগলি- ওইগলি ঘুরে শেষে চোর বমালসমেত ধরা পড়ে। ছিঁচকেটাকে দুই ঘা দিয়ে তাকে চাপায় বাইকে তারপর ওরা ফিরে যায় প্যাকেটের মালিককে ওটা ফেরত দেবে বলে। কিন্তু তারপর সেই দুজন লোককে ওরা আর খুঁজে পায়নি। দুজনেই উধাও। ফলে রাস্তাতেই প্যাকেট খুলে ওরা ভেতরের জিনিস চেক করার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু খুলে দেখে ভেতরে একটা চামড়ার সুন্দর ব্যাগ ছাড়া আর কিছুই নেই। ওরা এরপর কী করবে না বুঝতে পেরে ব্যাগ আর চোরসমেত থানায় চলে এসেছে।
চোর ছেলেটার চেহারা দেখেই বোঝা যায়। বারবার নাক টানছে, অল্প অল্প কাঁপছে। মুখে কোনো কথা নেই।
সিদ্ধার্থ ভুরু নাচিয়ে বলল, কিরে পাতা কেনার পয়সা শেষ নাকি?
ছেলেটা চুপ।
এই নিয়ে কবার হলো? তুই কোনোদিন পুলিশের হাতে না মরলেও পাবলিকের ঠ্যাঙানি খেয়ে মরে যাবি, আমি শিয়োর। যা থাক ভেতরে দুদিন।
এ আর শোধরাবে না স্যার, বলে একজন কনস্টেবল ছেলেটার কলার চেপে ধরেই নিয়ে গেল অন্যদিকে। সিদ্ধার্থ হাত বাড়ালেন ব্যাগটার দিকে। দেখি এটা?
হ্যান্ডব্যাগটার সুন্দর ডিজাইন। একবার চোখ পড়লে সিদ্ধার্থ ব্যাগটায় হাত বুলিয়ে বলল, বাঃ খুব নরম তো! বেশ দামি কোম্পানির ব্যাগ, বলে ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখতে শুরু করলেন। না কোনো কোম্পানি লোগো নেই। কনস্টেবলের দিকে তাকিয়ে বললে ব্যাগের ভেতরে কিছুই ছিল না?
না স্যার। একটা কাগজে মোড়া ছিল। আমরা ব্যাগটা দেখে কাগজটা এর ভেতরেই ভরে রেখেছি।
হুঁ। ব্যাগের চেন খুলে একটা ব্রাউন কাগজ বার করে আনল সিদ্ধার্থ। ওটাকে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে কনস্টেবলকে জিজ্ঞাসা করল অজয় তুমি কত বছর চাকরি করছ পুলিশে?
স্যার তেরো বছর হয়ে গেল।
ভালো করে হিসেব কোরো তো। আমার মনে হচ্ছে এখনো ট্রেনিং পিরিয়ডও শেষ হয়নি তোমার।
কেন স্যার? সত্যি স্যার ব্যাগে ব্যাগ ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
তোমার মুণ্ডু ছিল না। পুলিশ হতে গেলে আগে নিজের চোখদুটো পরিষ্কার রাখতে হয়। এটা কী? বলে ওই র্যাপারের এক কোণে আঙুল দিয়ে দেখাল। ঐখানে খুব ছোটো অক্ষরে ডটপেন দিয়ে লেখা রয়েছে অ্যাকিন ন্যানসেল। হোটেল ক্লাসিক। আর ব্যাগের স্ট্র্যাপে খুব খুদে অক্ষরে ইন্সক্রাইব করা কে আর টুয়েনটি ফোর। কোনো কোম্পানির লোগো নেই।
এটা চোখে পড়েনি নিশ্চয়ই দুজনের? প্যাকেটের লেখাটা দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করল সিদ্ধার্থ।
না স্যার মানে…এত ছোটো করে কেন থাকবে?
হুঁ এত ছোটো করে…রাইট। এটা ভালো কোয়েশ্চেন। হরিকে গাড়ি লাগাতে বলো। বেরোব। বলে সিদ্ধার্থ রাকেশকে বলল তুমি চলো তোমাকে অফিসে নামিয়ে দেবো। আর আপনারাও চলে আসুন। ঐ হোটেল থেকে আর খানিকটা দূরেই আপনাদের হোটেল আপনাদেরও ড্রপ করে দেবো।
অরণ্য একটু হেজিটেট করছিল। সিদ্ধার্থ বলল নো ইসু। আপনারা আমাদের গেস্ট। একটু ভালো ভালো লিখবেন আমাদের অসমকে নিয়ে হাহাহা।
হেসে উঠল সকলেই। তারপর থানার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা জিপে সকলে উঠে বসল।
৪
মিনিট পনেরোর রাস্তা। জিপ এসে থামল হোটেল ক্লাসিকের সামনে। সিদ্ধার্থ জিপ থেকে নেমে বলল, তোমরা পাঁচ মিনিট ওয়েট করো আমি এখনই আসছি। বলে প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ঢুকে পড়ল হোটেলের ভেতর। হোটেলের রিসেপশনিস্ট সিদ্ধার্থকে চেনে। দেখামাত্রই উঠে দাঁড়িয়ে বলল মর্নিং স্যার।
মর্নিং।
ব্রেকফাস্ট করবেন স্যার?
না না।
তাহলে ঠান্ডা গরম কিছু…
কিচ্ছু লাগবে না। বলে সিদ্ধার্থ বলল রেজিস্ট্রার খুলে দেখুন তো অ্যাকিন ন্যানসেল নামে আপনার এখানে কেউ রয়েছেন কি না।
নিশ্চয়ই। রিসেপশনিস্ট রেজিস্ট্রারের পাতা ওলটাতে শুরু করল। দুই পাতা পেছতেই বলল হ্যাঁ স্যার, অ্যাকিন রয়েছেন। উনি তিনদিন আগে চেক– ইন করেছেন। কোনো সমস্যা হয়েছে কি স্যার?
না তেমন কিছু নয়। ওর একটা ব্যাগ ছিনতাই হয়েছিল সেটা উদ্ধার করা গেছে। ফেরত দেওয়ার জন্য এলাম।
আপনি এলেন কেন স্যার? ফোন করে দিতে পারতেন আমরা ব্যবস্থা করে ফেলতাম।
সিদ্ধার্থ ওর এখানে নিজে আসার কারণটা চেপে রেখে বলল, অ্যাকিনবাবু এসেছেন কোন দেশ থেকে?
লন্ডন থেকে। পাসপোর্টের ফটোকপি রয়েছে স্যার। দেখবেন?
উঁ না থাক, একটা কপি পরে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। আর উনি কি রয়েছেন রুমে?
একবার খোঁজ নিচ্ছি। থাকলে কি ডাকব?
হ্যাঁ ডাকুন।
রিসেপশনিস্ট ইন্টারকমে কল করল। অ্যাকিন রুমেই ছিলেন। ওকে ব্যাগের ডিটেলটা জানানোর পর রিসেপশনিস্ট রিসিভারের মুখটা চেপে ধরে সিদ্ধার্থকে বলল, কিন্তু স্যার উনি বলছেন ওর কোনো ব্যাগ ছিনতাই হয়নি।
সিদ্ধার্থর ভুরু কুঁচকে গেল। তাই বলছেন? আচ্ছা ওকে নিচে একবার আসতে বলুন তো। আমি কথা বলতে চাইছি।
আচ্ছা। রিসেপশনিস্ট আবার অ্যাকিনের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধার্থকে জানাল অ্যাকিন বলছেন ওর নিচে নামতে একটু সময় লাগবে, স্নান করছেন।
কোনো ব্যাপার না। আমি ওয়েট করছি।
স্যার আপনি প্লিজ বসুন।
আচ্ছা। বাইরে জিপে আমার তিনজন গেস্ট অপেক্ষা করছেন ওদের কাইন্ডলি একটু ডেকে আনার ব্যবস্থা করুন।
শিয়োর স্যার।
রিসেপশনিস্ট সঙ্গে সঙ্গে হোটেলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার সিকিউরিটিকে কল করে নির্দেশ দিয়ে দিলো। রিসেপশনের ঠিক উলটোদিকেই ছোটো মাপের একটি পরিপাটি সাজানো লাউঞ্জ। সেখানে সোফায় বসল সিদ্ধার্থ। জিপ থেকে নেমে অরণ্য, দিয়া আর রাকেশও চলে এসেছে। সিদ্ধার্থর মনে কেমন একটা খটকা লাগছে, সেটার মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত ওর শান্তি হচ্ছে না। প্রায় মিনিট পনেরো বসে থাকার পর লিফ্ট থেকে নেমে এলো ছয় ফুট হাইট তেমনই চওড়া একজন নিগ্রো। পরনে লাল রঙের স্লিভলেস গেঞ্জি এবং ফুলছাপ বারমুডা। গুঁড়িগুঁড়ি কোঁকড়ানো চুল, কানে, ঠোঁটের নিচে দুল। দুই বাহুতে, বিচিত্র ট্যাটু। পায়ে স্নিকার। লোকটা লিফট থেকে বেরিয়ে আগে রিসেপশনিস্টের সঙ্গে কথা বলল তারপর এগিয়ে এলো লাউঞ্জের দিকে। সিদ্ধার্থর সামনে এসে সটান হাত বাড়িয়ে দিলো হ্যান্ডশেক করার জন্য। তারপর ভাঙা ইংরেজিতে বলল আমি অ্যাকিন। দেরি করানোর জন্য দুঃখিত। বলুন কী ব্যাপার?
সিদ্ধার্থ হ্যান্ডশেক করে অ্যাকিনকে বসতে বলল। অ্যাকিন বসল। অরণ্য, দিয়া এবং রাকেশ তিনজনেই খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকল অ্যাকিনকে। দৈত্যাকৃতির যাকে বলে অ্যাকিন হলো তাই। দুহাতের মাসল এবং পায়ের বাস দেখলে মাদুর্গার অসুরও হীনম্মন্যতায় ভুগতে শুরু করবে।
সিদ্ধার্থ কোনো বাড়তি কথায় না গিয়ে সরাসরি প্রসঙ্গে চলে এলো। নিজের হাতে ধরা ব্যাগটা দেখিয়ে ইংরেজিতেই বলল, মিস্টার অ্যাকিন আপনি নিশ্চিত যে এই ব্যাগটি আপনার নয়?
অ্যাকিন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, আমি তো আপনাকে আগেই বললাম আমার কোনো ব্যাগ হারায়নি, ছিনতাইও হয়নি। আর তাছাড়া এই ব্যাগটি দেখছি লেডিস, আমার স্ত্রী বা বান্ধবী কেউই নেই। এবং আমি লেডিস ব্যাগ ব্যবহার করি না।
সিদ্ধার্থ বলল, হুঁ আপনার কথা আমি মেনে নিলাম কিন্তু সমস্যাটা হলো যে ছিনতাইকারীর কাছ থেকে আজ ব্যাগটি উদ্ধার হয়েছে সেই ব্যাগের র্যাপারে আপনার নাম ও এখানকার ঠিকানা লেখা রয়েছে।
আমার নাম-ঠিকানা? বেশ অবাক হলো অ্যাকিন। তাহলে আজ সকালে যে লোকটা আমাকে এই ব্যাগটা গছাতে এসেছিল সেই নিশ্চয়ই নাম-ঠিকানা লিখেছে।
তাহলে যে বললেন এই ব্যাগ আপনার নয়?
অবশ্যই নয়। যে ব্যাগ আমি কিনিইনি সেটা আমার কী করে হবে?
হুঁ, তা কে এসেছিল আপনাকে ব্যাগটা গছাতে? আর কীভাবে সে আপনার নাম-ঠিকানা পেল সেটা বলা যাবে?
নিশ্চয়ই স্যার। ব্যাপার হলো আমি গতকাল গিয়েছিলাম পানবাজারের মার্কেটে। সেখানে ফুটপাতে যেসব দোকানিরা জিনিস নিয়ে বসে আমি সেগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। একটা ব্যাগের দোকানে মানে ওই ফুটপাতেই ব্যাগ বেল্ট ইত্যাদি নিয়ে বসে বিক্রি করছিল একজন। আমার একটা ব্যাগ কেনার প্রয়োজন ছিল সেই দোকানে দাঁড়িয়ে আমি কিছু ব্যাগ দেখি, কিন্তু জিনিসগুলোর কোয়ালিটি ভালো নয় বলে আমি চলে আসছিলাম তখন দোকানদার আমাকে প্রায় চেপে ধরল। আমার কেমন ব্যাগ চাই, কত দামের রেঞ্জ আরও দুনিয়ার সব প্রশ্ন। হকাররা যেমন হয় আর কী। আমি ওর থেকে নিজেকে বাঁচাতে চাইছিলাম। আমি বললাম আমি দামি কোয়ালিটির চামড়ার ব্যাগ খুঁজছি। সে বলল যত দামের চাইবেন পেয়ে যাবেন। বলুন, কত দামের দেখাব? দশ হাজার?
আমি হেসে ফেলে বললাম অত টাকা নিয়ে আমি বেরোইনি। সেও নাছোড়, বলল আপনার নাম আর কোথায় রয়েছেন বলুন আমি মাল নিয়ে কাল সকালে চলে আসব। আমি প্রথমে ভাবলাম সত্যি নাম-ঠিকানা বলব না, তারপর ভাবলাম সত্যি বললেই বা কী হবে? ও তো আর আসবে না, দশ হাজার টাকা দামের ব্যাগ ওই হকার পাবেই বা কোথায় আর চোরাই জিনিস যদি পায়ও সেটা কেনার ইচ্ছে আমার মোটেই নেই। তাই সেসব ভেবে ওকে আমি আমার নাম আর এই হোটেল ক্লাসিকের ঠিকানা বলে দিই। আর আজ সকালে লোকটা সত্যি সত্যিই একটা প্যাকেট নিয়ে চলে আসে হোটেলে। রিসেপশনে খবর দেয় যে তার নাকি আমার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট রয়েছে। আমি নিচে আসি দেখা করতে, দেখি কালকের সেই লোকটা এই র্যাপে মোড়া প্যাকেট নিয়ে এসে বলছে খুব দামি একটা ব্যাগ ও জোগাড় করেছে আমার জন্য। আমাকে কিনতেই হবে। আমি বললাম কিনব না, লোকটা জোরাজুরি করছিল ঠিক তখনই একটা ছিনতাইবাজ এসে ওই প্যাকেট নিয়ে পালাল। লোকটা ওই ছিনতাইবাজের পেছনে তাড়া করল। আমিও ওর থেকে রেহাই পেয়ে রুমে ঢুকে গেলাম এবং বললাম আমাকে লোকটা ডাকলে যেন বলা হয় আমি নেই। বাস, এই হলো গল্প।
সিদ্ধার্থ, পুরোটা শুনে বলল, বেশ বুঝলাম। আপনাকে মাত্র কয়েকটা প্রশ্ন করব। এই প্যাকেটের মধ্যে যে লেডিস ব্যাগ রয়েছে আপনি জানতেন?
না।
সেই হকারকে দেখলে আপনি চিনতে পারবেন?
হুঁ পারব।
আপনি কোথা থেকে এসেছেন?
আমি জন্মসূত্রে নাইজিরিয়ান। কিন্তু লন্ডনে থাকি কাজের সূত্রে। এই প্রথম এলেন ভারতে?
না, আগেও কয়েকবার এসেছি। আমি আসলে একজন ট্রটার। বিশেষ করে সেন্ট্রাল এবং সাউথ এশিয়ার দেশগুলোতে ঘুরতে আমার খুব ভালো লাগে। আর ইন্ডিয়া তো অসাধারণ। তবে মনে হয় এই-ই শেষবার।
কেন?
এই দেশে হকার থেকে পুলিশ সকলেই বড্ড ন্যাগিং করে।
সিদ্ধার্থ এই খোঁচাটা গায়ে মাখল না। আবার জিজ্ঞাসা করল এবারে এখানে আসার আর কোনো বিশেষ কারণ?
আপনাকে আগে আমি দেশ ঘুরতে ভালোবাসি। এই বছর এসেছি গৌহাটি, শিলং ঘুরতে। আগেরবার রাজস্থান, দিল্লি, আগ্রা ঘুরেছিলাম। ডিসেম্বর অ্যান্ড পর্যন্ত রয়েছি। আর কিছু?
না ধন্যবাদ। আপনার সময় নষ্ট করার জন্য দুঃখিত।
ঠিক আছে, আশা করি আপনাকে সহযোগিতা করতে পেরেছি। বলে দৈত্যাকৃতির অ্যাকিন উঠে দাঁড়াল। ওরা চারজনও দাঁড়াল। অ্যাকিনের সামনে ওদের চারজনকে ছেলেমানুষ লাগছে। অ্যাকিন আবার লিফটের দিকে চলে গেল। জিপে উঠে অরণ্য বলল, কথাগুলো ঠিক বিশ্বাস হলো না।
রাকেশ বলল, সেই, একেবারেই হলো না।
সিদ্ধার্থ বলল, অ্যাকিন মিথ্যেই বলছে সেটা শিয়োর। কিন্তু কেন? একটা ফাঁকা ব্যাগ সেটা নিজের বলতে ও কেন অস্বীকার করছে? কী ফরেনসিক এক্সপার্ট কী মনে হয়?
রাকেশ বলল, ব্যাগটা আরেকবার দেখি।
সিদ্ধার্থ ব্যাগটা দিলো রাকেশের হাতে। রাকেশ বেশ কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখল। গন্ধ শুঁকল তারপর বলল, নাঃ অ্যাবনরমাল কিছুই দেখছি না। কিন্তু জিনিসটা এক্সক্লুসিভ। একটা রাস্তার হকার এই ব্যাগ নিয়ে আসবে…কেমন যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। অনেক সময় ব্যাগের মধ্যেই… কথা অসমাপ্ত রেখে রাকেশ বললেন, স্রেফ কৌতূহল মেটানোর জন্যই জিনিসটা একবেলার জন্য নিতে পারি?
ওঃ শিয়োর!
আরও বেশ কিছুক্ষণ কথা চলল, তারপর জিপ এসে থামল হোটেল পার্পল রেসিডেন্সির সামনে।
অরণ্য বলল, স্যার আমাদেরও খুব আগ্রহ থাকল কেসটা কী জানার জন্য। আপনাদের যদি অসুবিধা না থাকে তাহলে যদি একটু জানান …
ওঃ! শিয়োর। আপনি এবং ম্যাডাম একজন ন্যাশনাল লেভেলের ইয়ং ডিটেকটিভ, নিশ্চয়ই জানাব। বলে মৃদু হেসে সিদ্ধার্থ বলল চলি তাহলে।
ও কে বাই।