কৃতজ্ঞ শেয়াল
এক পুরুত তার আছে এক আঙুর খেত। আঙুর পাকতে শুরু করলেই কোত্থেকে এসে জোটে এক শেয়াল। রোজ রাত্তিরে সে হাজির হয় মিষ্টি আঙুর ফলের ভোজের আশায় পুরুতের আঙুর খেতে। দেখ-না-দেখ থোকা থোকা আঙুর ভরা লতা টেনে মাটিতে নামিয়ে সব আঙুর দেয় সাফ করে। বেচারি পুরুত কী করবে ভেবেই পায় না। কী করে বাঁচাবে তার এত সাধের মিষ্টি ফলগুলো। কতবার ফাঁদ পাতলে। কিন্তু ধূর্ত শেয়াল কিছুতেই ফাঁদে পড়ে না। পুরুত ধূর্ত শেয়ালের নষ্টামির সঙ্গে আর কিছুতেই এঁটে উঠতে পারে না। খালি ভাবে কী করা যায়। ভেবে ভেবে ঠিক করল টাকা দিয়ে এক পাহারাদার রাখবে। একজন লোকের সঙ্গে তার কথাও হয়ে গেল। লোকটির নাম তুরাণ।
তুরাণ আঙুর খেতে চালা বানালে। তারপর চালায় বসে শেয়ালের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। সেদিনও শেয়াল এসে হাজির। তুরাণ পুরনো বন্দুকটার ঘোড়া টিপে দিলে— গুড়ুম, কিন্তু তাক গেল ফসকে। তবে শব্দ শুনেই শেয়াল হাওয়া। ছোটে আর বলে,
‘দৌড় দৌড় পালা পালা
আঙুর খাওয়ার বড়ই জ্বালা।’
পরদিন তুরাণ একটা ফাঁদ পাতলে ঠিক বেড়ার ধারে।
চুপি চুপি তুরাণ এসে
ফাঁদটি রাখে পেতে,
ধূর্ত শেয়াল ফেলল দেখে
পথে যেতে যেতে।
শেয়াল ভাবে আর বলে, ‘আমি তো কানাও নই আর বোকাও নই যে ফাঁদে পড়ব।’ তুরাণ সব শোনে, রা’টি কাড়ে না। রাত হল। রাত বাড়ল। তুরাণ বসে বসে পাহারা দিচ্ছে। হঠাৎ শোনে ‘উ… হু… হু… হু… গেলাম মলাম,
আঙুর খেতে এসে
ও ভাই তুরাণ কোথায় আছিস?
বাঁচিয়ে দে না এসে।’
তুরাণ ছুটে গেল ফাঁদের কাছে। ওমা দেখে কী শেয়ালভায়া ফাঁদে আটকা। তুরাণ শেয়ালকে ঠাট্টা করে হেসে বলে,
‘কানা তুমি নও
এই বলে ভায়া কত গরবই না করলে,
তবু শেষকালে গুটিগুটি এসে,
তুরাণেরই ফাঁদে পড়লে?
এসো তবে ভাই
চামড়া ছাড়াই
কুর্তা বানাব বলে।’
তুরাণ ইয়া এক ছুরি বের করল। ইচ্ছেটা,
চামড়া ছাড়াব,
কুর্তা বানাব।
শেয়াল দেখলে ভারী বিপদ। অনেক অনুনয় বিনয় করে কেঁদে কেঁদে বলে,
‘তুরাণদাদা, তুরাণদাদা
দাও না ছেড়ে মোরে,
শপথ করে বলছি তোমায়
সোনায় দেব মুড়ে।
যা চাইবে হাতে দেব
কান মলছি ধিক
রাজার মেয়ের সঙ্গে তোমায়
বিয়ে দেবই ঠিক।’
তুরাণ শেয়ালের কথায় বিশ্বাস করে তাকে ছেড়ে দিল। শেয়াল তখন তুরাণকে বলল, ‘যাও তোমার কুর্তাটা বেচে এসো। টাকার দরকার।’ শেয়ালের কথামতো বাজারে গিয়ে তুরাণ তার কুর্তা বেচে এল। পেল মাত্র তামার কয়েকটা পয়সা। শেয়াল চলল রাজার কাছে। রাজবাড়ি মস্ত প্রাসাদ। কাছে গিয়ে শেয়াল হেঁকে বলে, ‘হুজুর, ধর্মাবতার কোথায় আপনি? একবার দয়া করে দেখা দিন।’
হাঁক ডাক শুনে রাজামশাই বললেন, ‘দেখো তো কে ডাকে আমাকে।’ রাজার লোকজন ছুটল ফটকের কাছে দেখতে রাজামশাইকে কে ডাকে। গিয়ে দেখে এক শেয়াল। রাজার পেয়াদারা শুধোয়, ‘রাজামশাইকে ডাকাডাকি করছ কেন? কী দরকার?’
শেয়াল বললে, ‘আমাকে একটা বালতি দিতে বলো। আমার ভাই তুরাণের এত ধন যে সে কুনকে করে মাপে না। মাপে বালতি ভরে।’
রাজার পেয়াদারা কথাটা রাজামশাইকে গিয়ে বলল। রাজা হুকুম দিলেন, ‘এক্ষুনি শেয়ালকে বালতি দাও।’ বালতি নিয়ে শেয়াল চলে গেল। একটু পরেই শেয়াল ফেরত এল। বালতির তলায় বেশ কয়েকটা তামার পয়সা লেগে ছিল। বালতি রেখে শেয়াল চলল ফিরে। ফটক পার হয়েছে কি হয়নি রাজার লোক দৌড়ে এসে বলে, ‘শোনো শোনো শেয়ালভায়া, তোমার বালতির তলায় যে পয়সা লেগে আছে।’
‘ওগুলো তো তামার চাকতি। ওকে পয়সা বলো তোমরা?’ শেয়াল মুচকি হেসে উত্তর দেয়। তারপর শেয়াল ফিরে চলল তুরাণের কাছে।
বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। শেয়াল আবার তুরাণকে বললে, ‘যাও ভাই এবার তোমার জামাকাপড় বেচে এসো। টাকার দরকার। এবার চাই রুপোর টাকা।’
শেয়ালের কথামতো তুরাণ যত কাপড়জামা ছিল একটা পোঁটলা করে বাঁধলে। তারপর চলল বাজারে। কাপড় বেচে শেয়ালকে এনে দিল কয়েকটা রুপোর টাকা। শেয়াল চলল রাজার কাছে। প্রাসাদের ফটকের কাছে গিয়ে হেঁকে বললে, ‘রাজামশাই, ও রাজামশাই, একটা বালতি দিন তো।’ রাজার হুকুমে রাজার সেপাই এনে দিল শেয়ালকে একটা বালতি। শেয়াল মনের আনন্দে বালতি বাজাতে বাজাতে চলল তুরাণের কাছে। তারপর আবার ফিরে এল রাজবাড়িতে। বালতি পেয়েই রাজার লোকজন উলটে দেখলে। ওমা— দেখে খাঁটি রুপোর কয়েকটি টাকা বালতির তলায় লেগে রয়েছে। রাজার সেপাই বলে, ‘ও ভাই শেয়াল, তোমার টাকা নিয়ে যাও ভাই। এতগুলো টাকা বালতির তলায় লেগে রয়েছে যে। রুপোর টাকাগুলো কি অদানে অব্রাহ্মণে খোয়া যাবে শেষে?’ শেয়াল বলে, ‘আরে ছিঃ ছিঃ আরে রাম রাম ওকে তোমরা টাকা বলো? থাকুক।’ এই বলে শেয়াল নিজের পথ ধরল। ফিরে চলল তুরাণের কাছে।
বছর ঘুরে নতুন বছর এল। একদিন সক্কালবেলা ছাতা মাথায় শেয়ালভায়া আবার উপস্থিত হল রাজবাড়ির সামনে। রাজার প্রহরীরা তো শেয়ালকে চিনে গেছে। জিজ্ঞেস করে, ‘কী ভাই, বালতি চাই?’ শেয়াল একগাল হেসে বলে, ‘ঠিক বলেছ ভাই বড়সড় দেখে একটা বালতি চাই।
বালতি পেলে তবে
(মোহর) মাপা শুরু হবে।’
রাজামশাইয়ের অনুমতি নিয়ে প্রহরীরা শেয়ালকে এনে দিল একটা বড়সড় বালতি। ঘাড়ে বালতি নিয়ে শেয়াল চলল তুরাণের কাছে। শেয়ালের কথায় এবার তুরাণ হাটে গিয়ে বেচে এল তার সোনার সুতোর কাজ করা সালোয়ার আর কুর্তা। নিয়ে এল বেশ কয়েকটা সোনার মোহর।
শেয়াল আবার গেল রাজার বাড়ি। হাঁক ডাক শুনে রাজা লোকজনদের ডেকে বললেন, ‘যাও তো, দেখে এসো। কী চায় ওই শেয়ালব্যাটা।’ ‘শেয়াল বালতি ফেরত এনেছে রাজামশাই। তার তলায় লেগে আছে বেশ কয়েকটা মোহর।’ চোখ কপালে তুলে রাজার সেপাইরা বলে।
শেয়ালের গলা শোনা গেল, ‘হুজুর ধর্মাবতার একবার দর্শন দিন।’
প্রহরীরা শুধোয়, ‘রাজামশাইকে তোমার কীসের দরকার?’
‘কথা আছে ভাই, জরুরি কথা।’
রাজার লোকজন কী আর করে শেয়ালকে নিয়ে গেল রাজার কাছে। সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করে শেয়াল নিবেদন করল অতি বিনয়ের সঙ্গে মোলায়েম গলায়। ‘মহারাজ আমার ভাই তুরাণ আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। তাই আমাকে পাঠিয়েছে। অবশ্য আপনার যদি মত হয় তবেই কথা এগোবে।’
রাজামশাই এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। বললেন, ‘তা বেশ আমার আপত্তি নেই। তা কবে বিয়ে হবে? দিনক্ষণ তো ঠিক করতে হবে।’
শেয়াল বলে, ‘আমরা তো আজ হলে আজই দিই। তবে রাজার মেয়ে বলে কথা, আপনার সুবিধেটাও তো দেখতে হবে। যদি অনুমতি করেন আগামী রবিবারই ঘটক পুরুত সব নিয়ে সোজা আপনার প্রাসাদে চলে আসব। আর আপনারা এদিকে বিয়ের সব জোগাড় করে রাখবেন।’
‘ভাল কথা আমি রাজি,’— রাজা বললেন।
রবিবার দিন সক্কাল হতে না হতে তুরাণকে বর সাজিয়ে শেয়ালকে নিয়ে যেতে হবে বিয়ে দিতে। কিন্তু তুরাণকে রাজার সামনে নিয়ে যায় কী করে? জামাকাপড় তো সব ছেঁড়ার হদ্দ ছেঁড়া। শেয়াল ভারী ভাবনায় পড়ল। পথ চলে আর ভাবে। হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি এল।
রবিবার সকাল হতে না হতে শেয়াল বলে, ‘তুরাণদাদা ও তুরাণদাদা চলো, আজ তোমার বিয়ে।’ আগে যায় শেয়াল, পিছে পিছে আসে তুরাণ। হঠাৎ শেয়াল পিছন ফিরে তুরাণকে এক ধাক্কা মেরে ফেলে দিল কাদায়। তুরাণের ছেঁড়া কাপড় চোপড় তো বটেই সারা গায়ে একেবারে কাদা মাখামাখি। তুরাণ উঠে দাঁড়াল। আপাদমস্তক কাদায় ঢাকা। শেয়াল তখন নিজের লোমওয়ালা মোটা লেজে বেঁধে নিলে একটা গাছের ডাল। সবুজ সদ্যভাঙা ডালটা লেজে বেঁধে মাটিতে ঘষতে ঘষতে চলল শেয়াল রাজবাড়ি। চলে আর ধুলো ওড়ে। সারা আকাশ ধুলোয় ঢেকে গেল। তুরাণ বলে, ‘ও ভাই শেয়াল। করো কী করো কী। একে কাদা মাখা তায় ধুলো খাওয়া এমন চেহারা দেখলে রাজা কি আর বিয়ে দেবেন?’
শেয়াল বলে, ‘চুপ, কথাটি কোসনে।’
এদিকে জানলা দিয়ে রাজামশাই দেখেন কী ধুলোই না উড়ছে। কত বরযাত্রীই না আসছে। একা বর আর শেয়াল কি এত ধুলো ওড়াতে পারে?
রাজা হাঁকেন, ‘ওরে কে আছিস?’
রাজামশাই ডাকছেন দৌড়ে এল লোকজন, সেপাই-সান্ত্রি, দাসদাসী, পাইক-বরকন্দাজ।
রাজা বলেন, ‘ওহে ভাল করে আয়োজন করো। দেখছ তো ধুলোর মেঘ উড়িয়ে বর নিয়ে বরযাত্রী দল আসছে। কুটুমদের উপযুক্ত খাতির করা চাই। কোনও ত্রুটি বা কোনও গাফিলতি সইব না।’
খানিক পর তুরাণকে নিয়ে শেয়াল এসে পৌঁছোল রাজার কাছে। ভাল করে চারদিক দেখে নিয়ে রাজা বললেন, ‘ও হে শেয়াল, জামাই কোথায়?’
শেয়াল রাজামশাইয়ের পায়ের কাছে লুটিয়ে লুটিয়ে কাঁদে আর বলে, ‘হুজুর আপনি যদি জানতেন পথে আমাদের কী দশাই না হয়েছে। পথে আমরা ডাকাতের হাতে পড়েছিলাম হুজুর। বরযাত্রীদল তাই সব পালিয়েছে। আপনার হবু জামাই তো কোনওরকমে প্রাণে বেঁচে গেছে। বরের গায়ের জামাকাপড়, সাজপোশাক সব টেনে খুলে নিয়েছে হুজুর। কী আর বলব… হুঁ… হুঁ…হুঁ’ শেয়াল রাজার পায়ের কাছে গড়াগড়ি দেয় আর কাঁদে।
রাজামশাইয়ের ভারী দুঃখ হল। ‘আ… হা, কেঁদো না, কেঁদো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ রাজামশাই হাততালি দিলেন। একবার, দু’বার, তিনবার। কোথা থেকে শতশত দাসদাসী, সেপাইসান্ত্রি, লোকজন এসে হাজির। রাজা হুকুম দিলেন, ‘এক্ষুনি আমার জামাইয়ের জন্য বরের সাজ তৈরি হোক— চাই জোব্বা, চাই তাজ, চাই চুস্ত, কিছু যেন বাদ না পড়ে।’
রাজামশাইয়ের মুখের কথা খসতে না খসতেই নতুন সব জামা, জোব্বা, চুস্ত, তাজ নিয়ে দর্জি হাজির। তুরাণ তো এমন সাজ কোনওদিন চোখেই দেখেনি। তাই নতুন সাজ পরে ঘুরে ফিরে দেখে কেমন লাগছে। রাজবাড়ির মস্ত আয়নায় নিজেকে দেখে তুরাণ তো ভ্যাবাচ্যাকা। ভাবে আমার ছেঁড়া লুঙ্গি আর ফতুয়াই ছিল ভাল। জামাইয়ের বেজার মুখ দেখে রাজামশাই শুধোলেন শেয়ালকে, ‘কী হে শেয়ালভায়া, জামাইয়ের বুঝি সাজ পছন্দ হয়নি?’ শেয়াল আকাশ পানে মুখ তুলে গম্ভীরভাবে বলে, ‘তা নয় তো কী? এসব জামা, জোব্বা, তাজ তুরাণ ঘরেও পরে না। হপ্তার সাধারণ দিনে হাটে বাজারে গেলেও এর চেয়ে ভাল সাজ করে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ রাজামশাই, এই আপনার দর্জি! বললেই হত আমরাই বরের কাপড় জামা নিয়ে আসতুম।’ রাজা তো ভারী অপ্রস্তুত। তাড়াতাড়ি আরও ভাল সাজের হুকুম দিলেন। দর্জির দল মাথা নিচু করে হুকুম শুনলে। তারপর লেগে গেল সবচেয়ে দামি আর সবচেয়ে সুন্দর জামা বানাতে। এবার এল এক অপূর্ব সাজ। ঘন নীল রঙের জোব্বা তাতে জরি পুঁথির কাজ, চুস্ত যেন সাদা রুপোর জরি দিয়ে তৈরি। তাতে নীল পাড়। সাজ পোশাক দেখে তুরাণের তো চক্ষু চড়কগাছ। জন্মে এমন জামা চোখেও দেখেনি। পরা তো দূরের কথা। তুরাণ কী করবে ভেবে পায় না। রাজামশাই তুরাণের দ্বিধা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী শেয়ালভায়া এ সাজটাও তেমন মনে ধরেনি বোধ হচ্ছে?’ শেয়াল উত্তর দেয়, ‘কী আর বলি বলুন। এমন জামা তুরাণ গায়েই তোলে না। গাঁয়ের পালা পাব্বণেই এর চেয়ে ঢের ভাল জামা পরে। এখানে তো জামাই বলে কথা। তবে যদি আপনার দর্জিরা এর চেয়ে ভাল জামা নাই করতে পারে, তবে হুকুম করুন,
এবার আসি তবে
মনের মতো সাজ পেলে
তবেই তুরাণ জামাই হবে।’
রাজামশাইয়ের তো ভারী অপমান হল। রাজ্যের উত্তর, দক্ষিণ, পূব, পশ্চিম সব দিকে খবর পাঠালেন। দেখতে দেখতে উত্তর, দক্ষিণ, পূব, পশ্চিম সব দেশের দর্জির দল হাজির হয়ে গেল। সবাই সেলাম করে বলে, ‘হুকুম করুন মহারাজ।’
আগের দুটো সাজ দেখিয়ে রাজামশাই বলেন, ‘এ কি বরের সাজ হয়েছে? এমন জামা আমার জামাই গায়েই তোলে না। এক্ষুনি যদি পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর পোশাক না করে এনে দিতে পারো, তবে সব ব্যাটার গর্দান যাবে।’
তুরাণ সব শুনছে আর করুণ চোখে শেয়ালের দিকে তাকাচ্ছে। শেয়াল চোখ টিপে টিপে মুচকি হাসে। ফিসফিস করে বলে, ‘কথাটি বোলো না। চুপ করে দেখোই না। কী হয়।’
সারা রাজ্যের সব দর্জি মিলে সে এক অপূর্ব সাজ বানালে। শেয়াল এবার মহাখুশি। মাথা নেড়ে বললে, ‘রাজামশাই, এবার ঠিক হয়েছে।’ তারপর তুরাণকে পরিয়ে দিলে জোব্বা, চুস্ত, পাগড়ি। ‘কী সুন্দর মানিয়েছে, দেখুন তো মহারাজ!’ শেয়াল এক গাল হেসে বলে।
বিয়ের বাদ্যি বেজে উঠল। তুরাণের সঙ্গে রাজার মেয়ের বিয়ে মহা ধুমধাম করে হয়ে গেল।
এবার রাজকন্যা শ্বশুরবাড়ি যাবে। শেয়াল বললে, ‘পথে ডাকাতের উৎপাত। সেপাই-সান্ত্রি, পাইক-বরকন্দাজ সঙ্গে দিয়ে দেবেন। পথে আবার যদি কিছু অঘটন ঘটে। বলা তো যায় না।’
তুরাণ তো চুপচাপ শেয়ালের কথা শুনে যা বলছে তাই করছে। এবার শেয়াল তুরাণকে ফিসফিস করে বলল, ‘আমি আগে আগে চলব। তোমরা পিছে পিছে আসবে। যেখানে ধোঁয়া দেখবে সেখানে কুটুমদের নিয়ে তুলবে।’
রাজকন্যা নিয়ে তুরাণ যাত্রা করল। শেয়াল দৌড়ে অনেকটা এগিয়ে গেল। রাজকন্যা, তুরাণ, সেপাই, পাইক, বরকন্দাজ ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। এদিকে শেয়াল তো ছুটছে। ছুটতে ছুটতে পথে দেখে এক মস্ত প্রাসাদ। শেয়াল প্রাসাদের চৌকাঠ পেরোতে যাবে দেখে রাস্তা জুড়ে শুয়ে আছে ইয়া বড় একটা সাপ। প্রাসাদের সেই তো মালিক। শেয়াল মুখ নিচু করে বলে, ‘ও সাপদাদা, সাপদাদা তুমি তো বেশ ঘুমোচ্ছ, আর এদিকে যে কত লোক তোমাকে মারতে আসছে দেখতেই পাচ্ছ না।’ শেয়ালের কথা শুনে সাপ তো ভারী ভয় পেয়ে গেল। চটপট গিয়ে লুকোল ঘর গরম রাখা চুল্লির মধ্যে। আর শেয়াল করেছে কী শুকনো পাতা দিয়ে চুল্লিটা ঠেসে ভরে তাতে দিয়েছে আগুন লাগিয়ে। তারপর লাফিয়ে উঠে চুল্লির উপর চুল্লির মুখে লাগাবার ফুটোওয়ালা ঢাকনাটা দিয়ে চুল্লিটার মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। চিমনি দিয়ে কালো মেঘের মতো ধোঁয়া বেরোতে লাগল। আর সাপদাদা ওখানেই পুড়ে মরল।
এদিকে রাজকন্যা আর তুরাণকে নিয়ে রাজার লোকজন, সেপাই, সান্ত্রি, পাইক, বরকন্দাজের দল দূর থেকে ধোঁয়া দেখতে পেয়ে ঠিক সেই দিকেই এগোতে লাগল। সাপটা ছিল ভারী দুষ্টু। চারপাশের গাঁয়ের লোক সেই সাপ মরেছে শুনে শেয়ালকে নিয়ে কী করবে ভেবে পায় না। কেউ বলে খাবার দেবে, কেউ বলে টাকা দেবে। শেয়াল বলে, ‘আমার কিচ্ছুটি চাইনে। আমার দাদা রাজকন্যা বিয়ে করে আনছে, তাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে দাও তো।’ অমনি রাশি রাশি মণ্ডা, মিঠাই, হাঁড়ি হাঁড়ি পোলাও মাংস, ঝুড়ি ঝুড়ি লুচি, গামলা গামলা পায়েস, সে কী আয়োজন। শেয়াল বলে, ‘গাঁ সুদ্ধ লোকেরও নেমন্তন্ন।’
তুরাণ রাজকন্যাকে নিয়ে এসে পৌঁছোল। সব দেখে তো তুরাণ অবাক। কী আদর, কী আপ্যায়ন, কী খাওয়া দাওয়া। রাজবাড়ির লোকেরা বলে, ‘সাদা চোখে তো এমনটি দেখিইনি, এমনকী স্বপ্নেও নয়।’ লোকজন এবার ফিরে যাবে। কেবল তুরাণ, রাজকন্যা, আর শেয়াল থাকবে সেই মস্ত প্রাসাদে। লোকজন ফেরার কথা মুখে আনতেই শেয়াল বলল, ‘শুধু হাতে কি কুটুমবাড়ি থেকে ফিরে যায়? দাঁড়াও আমি আসছি।’
সাতমহলা সাপের প্রাসাদ। হিরে জহরত মণিমাণিক্য ঠাসা। সিন্দুক খুলে শেয়াল রাজকন্যার বাড়ির সকলকে হাত ভরে নয়, কোঁচড় ভরে মণিমাণিক্য সোনাদানা দিল। তারপর মধু খাইয়ে বিদায় দিল।
সন্ধ্যা হয়ে আসে। তুরাণ আর রাজকন্যাকে নিয়ে শেয়াল সাপের সেই মস্ত প্রাসাদ ঘুরে ঘুরে দেখাল। তুরাণ তো ভারী খুশি। একে তো রাজকন্যা বউ, তায় মস্ত প্রাসাদ, বিশাল সম্পত্তি। তুরাণ শেয়ালকে বললে, ‘শেয়ালভাই তুমি আমার কত উপকার করলে, এবার বলো তো, আমি তোমার জন্যে কী করি?’ শেয়াল বললে, ‘বেশি কিছু নয়, যতদিন বাঁচব রোজ আমাকে এক জোড়া করে হাঁস উপহার দিতে হবে।’ এই বলে শেয়াল চুল্লির ধারে পাতা নরম গালিচার উপর আরাম করে শুয়ে পড়ল। তুরাণ গেল রাজকন্যার হাত ধরে সোনার পালঙ্কে ঘুমোতে।
ভোর হয়েছে কি হয়নি, আলো ফুটেছে কি ফোটেনি শেয়ালের ঘুম ভেঙে গেল। মাথায় একটা বুদ্ধি এল। ভাবলে আমি তো কথা রেখে তুরাণের এত উপকার করলাম। দেখি তো তুরাণ আমার উপকার মনে রাখে না ভুলে যায়। শেয়াল বাইরে গেল। একটু ঘুরে ফিরে এসে ওই গালিচাটার উপরেই মড়ার মতো জিভ বের করে পড়ে রইল। সকাল হল। তুরাণ রাজার মেয়েকে বলল, ‘নিজের কাজ নিজে করাই ভাল। চাকর দাসী তো আমি অনেক রাখতে পারি। কিন্তু রাখব না। যাও তো, ঘরগুলো ঝাঁট দিয়ে দাও গে।’ রাজার মেয়ে শেয়াল যে-ঘরে শুয়েছিল, সেই ঘরেই ঢুকল ঝাঁট দিতে। কাছে গিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলে, কত ধাক্কা মারল। শেয়াল নড়েও না চড়েও না। নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখল নিশ্বাসও পড়ছে না। রাজার মেয়ে পা দিয়ে মারলে এক লাথি। তারপর দৌড়ে তুরাণের কাছে গিয়ে বলল, ‘কী করে বাবা বাড়িতে মরা শেয়াল শুইয়ে রেখেছ?
যদি আমায় রাখতে চাও,
শেয়ালটাকে দূর করে
ছুড়ে ফেলে দাও।’
হাজার হোক নতুন বউ তো! কাজেই কী আর করে তুরাণ? মরা শেয়ালটাকে একটানে দিলে জানলা দিয়ে ছুড়ে ফেলে। শেয়াল তক্ষুনি এক লাফ মেরে, গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর সোজা গিয়ে ঢুকল তুরাণের ঘরে। তারপর? তারপর শেয়ালের সে কী গালাগালি। সে কী ধমকানি। ‘আমি তোমার এত উপকার করলাম, আর তুমি কিনা আমায় বউয়ের কথায় ছুড়ে ফেলে দিলে? অকৃতজ্ঞ এতটুকু লজ্জা নেই, এতবড় দালান, এত সম্পত্তি, এত সুন্দর রাজকন্যে, সব পেয়ে আমাকেই ভুলে গেলি?’ এবার শেয়াল তুই তোকারি করে বকতে লাগল। তুরাণের ভারী লজ্জা হল। সত্যিই তো শেয়াল না থাকলে তো আর এত বড় প্রাসাদ, বিশাল সম্পত্তি, সুন্দরী রাজকন্যে কিছুই পেত না। হাঁটু গেড়ে হাতজোড় করে তুরাণ বলল, ‘ক্ষমা করো ভাই, ঘাট হয়েছে। আর কোনওদিন অমন ব্যবহার করব না।’
শেয়ালের মন তো নরম, দিলে ক্ষমা করে। তারপর থেকে প্রতিদিন দুটি করে হাঁস শেয়ালের বরাদ্দ হল। ভোর না হতেই রোজ তুরাণ নিজে হাতে হাঁসদুটি পৌঁছে দেয়। আর শেয়াল ভায়া দুটি হাঁস খেয়ে মহা আনন্দে ঘুরতে যায়।
রইল তুরাণ রাজার হালে,
ভাত খায় সে সোনার থালে।
বউকে নিয়ে রোজ বেড়ায়
বনের পথে গাছের ছায়।
শেয়ালভায়া পথ দেখায়।
লাফটি মেরে সামনে যায়।
সুখের আর শেষ নেই। তিনজন মিলে আজও বোধহয় তেমনি সুখেই আছে। তোমাদের কী মনে হয়? একবার দেখে আসবে নাকি?