কুহেলিকা – ১৭
স্টেশনে পঁহুছিয়াই জাহাঙ্গীর দেখিল, সারা গায়ে ভস্ম-বিভূতি মাখা জটাজূটধারী এক পৌনে-ষোলো-আনা নাগা সন্ন্যাসী তাহার চিমটার ইঙ্গিতে তাহাকে যেন আহ্বান করিল।
জাহাঙ্গীর দেখিল সন্ন্যাসী ইঙ্গিত করিয়াই রেললাইনের অপর পারে এক বৃক্ষনিম্নে গিয়া বসিলেন। সেখানে আরও বহু সন্ন্যাসী – কেহ ধুনি জ্বালাইয়া, কেহ ধ্যান করিতেছে, কেহ গাঁজা টানিতেছে, কেহ ভজন-গান করিতেছে।
জাহাঙ্গীর কাহাকেও কিছু না বলিয়া সন্ন্যাসীর অনুসরণ করিল। জিনিসপত্র নামানোর হ্যাঙ্গামে কেহ অত লক্ষ করিল না।
সন্ন্যাসী দল হইতে কিছু দূরে একটু নিরালায় গিয়া সেই সন্ন্যাসী বলিল, ‘তুমি আমাকে চেন না। অবশ্য, আমি তোমায় চিনি। আমাদের অত্যন্ত বিপদ। আজ ভোরে তোমার প্রমতদা ও পিনাকীর মাসিমা অস্ত্রশস্ত্র সমেত ধরা পড়েছেন। তোমার গাড়িতে তুলে দেবেন বলে তাঁরা গোরুর গাড়িতে করে সেসব আনছিলেন, রাস্তায় পুলিশ পাকড়েছে। এ খবর পুলিশ বাইরে প্রকাশ হতে দেয়নি, অন্যান্য সকলকে ধর-পাকড়ের জন্য। মাসিমাকে বাঁচাতে গিয়ে প্রমত্তকে ধরা দিতে হয়েছে – আমরা সকলে পালিয়ে এসেছি। পুলিশদের দু-জন মারা গেছে আমাদের গুলিতে । তোমার উপর বজ্রপাণির আদেশ, মাসিমার মেয়ে চম্পাকে নিয়ে কলকাতায় আপাতত তোমাদের বাসায় রাখবে। তার পর দু-এক দিনের মধ্যে বজ্রপাণি লোক পাঠিয়ে তাকে নিয়ে যাবেন। চম্পাকে বোরখা পরিয়ে মুসলমান মেয়ে সাজিয়ে রেখেছি। সে একটু পরেই স্টেশনে আসবে – তুমি তাকে তোমাদের গাড়িতে তুলে নিয়ো। খুব সাবধানে কিন্তু, পুলিশ ভয়ানক কড়া পাহারা দিচ্ছে প্ল্যাটফর্ম। চম্পার সাথে এক বাক্স মালপত্র আছে। সাবধান! প্রাণ দিতে হয় দিয়ো, তবু সেসব যেন বেহাত না হয়। যাও!’ – বলিয়াই সন্ন্যাসী সেখানে বসিয়া গাঁজার কলিকায় দম দিতে দিতে চিৎকার করিয়া উঠিলেন, – ‘বোম কালী কালকাত্তাওয়ালি।’…
জাহাঙ্গীর চক্ষে যেন অন্ধকার দেখিতে লাগিল। কিন্তু ভয় পাইলে চলিবে না, ভাবিবারও অবকাশ নাই। তাহাকে প্রাণ দিয়া কর্তব্য পালন করিতে হইবে। সে স্টেশনে আসিয়া দেখিল, জিনিসপত্র স্যালুনে উঠানো হইতেছে। গাড়ি আসিবার তখনও অনেক দেরি।
তাহার মাতা ভূণী মোমি প্রভৃতি স্যালুনে উঠিয়া বসিয়াছিলেন। স্যালুনটা প্ল্যাটফর্ম হইতে কিছু দূরে ছিল। সে দেখিল, আর একখানা পালকি তাহাদের স্যালুনের দিকে আসিতেছে। সে তাহার মাতাকে বলিল, ‘মা, বলতে ভুলে গেছি, আমাদের মউলবির ভাগনি আমাদের সাথে যাবে। দু-একদিন আমাদের বাড়িতে সে থাকবেও। ডায়াসেশান কলেজে সে পড়ে। মউলবি সাহেব বিশেষ কাজে আজ যেতে পারলেন না, উনি দু-এক দিনের মধ্যেই কলকাতা এসে পঁহুচবেন।’
বলিতে বলিতে পালকি আসিয়া স্যালুনের নিকট থামিল এবং একটি বোরখা-পরা তরুণী নামিয়া স্যালুনে উঠিয়া আসিল। আসিয়াই সে মুসলমানি কায়দায় জাহাঙ্গীরের মা-র পদধূলি লইল। বাঁদিরা তাহার বাক্স-প্যাঁটরা স্যালুনে তুলিয়া লইল। মাতা আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন, ‘এবার বোরখাটা খুলে ফেলো মা, যা গরম সেদ্ধ হয়ে গেছ বুঝি।’
চম্পা সামনের খড়খড়ি ফেলিয়া দিয়া বোরখা খুলিয়া ফেলিল। তাহার রূপে সকলের চক্ষু যেন ঝলসিয়া গেল। ভূণীর মুখ ম্লান হইয়া গেল। সত্যসত্যই চম্পার কাছে তাহার রূপ নিষ্প্রভ হইয়া পড়িল।
বাঁদিরা বলিয়া উঠিল, ‘বিবিসাব, আপনার বাস্কে কী রাখছেন কন তো। পাতর রাখছেন না তো? মাইয়ো মা, যা ভারী!’
চম্পা হাসিয়া বলিল, ‘বই-পত্তর আছে কিনা, তাই অত ভারী!’
মা মুগ্ধনেত্রে তাহাকে দেখিতেছিলেন। দেখিতেছিলেন, এ রূপ নয়, রূপের শিখা। রূপের চেয়ে তেজ দীপ্তি আরও বেশি। চক্ষুতে অদ্ভুত জ্যোতি, তাকানো যায় না।
মা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তোমার নামটা কী মা?’ চম্পা কিছু বলিবার আগেই জাহাঙ্গীর বলিল, ‘ওর নাম আমিনা।’
মাতা বলিলেন, ‘এঁর কথা তো তুই কখনও বলিসনি খোকা!’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘ওঁর কথা তো আমি আগে জানতুম না মা। আমি স্টেশনে আসতেই মউলবি সাহেব ওঁকে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে আমাদের সাথে নিয়ে যাবার জন্য দিয়ে গেলেন। মউলবি সাহেব আমাদের সাথে সেদিন যেতে পারেননি বলে লজ্জায় আর তোমার সঙ্গে দেখা করলেন না। তা ছাড়া ওঁর কাজও ছিল।’
মাতা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তোমার মার অসুখ করেছিল শুনেছিলুম, এখন তিনি ভালো আছেন তো?’
চম্পা ওরফে আমিনা বলিল, ‘জি হাঁ। মা চেঞ্জে যাবেন কাল, তাই আমি কলকাতা চলে যাচ্ছি। আমার পড়াশুনার ক্ষতি হবে বলে তাঁর সাথে গেলুম না। কয়দিন আপনাদের তকলিফ দেব।’
মা ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, ‘ছি মা, ও কথা বলতে নেই। ও তোমার নিজের বাড়িই মনে করবে। হাঁ দেখো, তোমার সাথে মা পরিচয় করে দিতে ভুলে গেছি, এই হচ্ছে তহমিনা – আমার হবু-বউমা। এ হচ্ছে ওর ছোটো বোন মোমি, ইনি হচ্ছেন ওর মা – শরীর খারাপ তাই ঘুমোচ্ছেন।
চম্পা ভূণীর পাশে আসিয়া বসিল, কিন্তু তাহার মুখ যেন কেমন ম্লান হইয়া গেল। ভূণীর তাহা চক্ষু এড়াইল না। চম্পা ভূণীর সহিত ভাব করিবার চেষ্টা করিল। কিন্ত দুই জনে কেহই যেন সহজ হইতে পারিল না।
জাহাঙ্গীর বিস্ময়-বিমুগ্ধ নেত্রে চম্পার পানে চাহিয়া দেখিতে লাগিল। অপূর্ব তাহার আত্মসংযম! আজই সকালে যে এত বড়ো দুর্ঘটনা হইয়া গিয়াছে – তাহার কোনো দুর্ভাবনার ছায়া পর্যন্ত পড়ে নাই তাহার চোখে মুখে। ও যেন বহু পূর্ব হইতেই ইহার জন্য প্রস্তুত হইয়াছিল।
চম্পা হঠাৎ জাহাঙ্গীরের দিকে চাহিয়া বলিয়া উঠিল, ‘বেশ লুকিয়ে লুকিয়ে বউ চুরি করতে এসেছিলেন তো! কাউকে এতটুকু জানতে দেননি!’ বলিয়াই জাহাঙ্গীরের মাতাকে সম্বোধন করিয়া বলিল, ‘মা হয়তো কী ভাবছেন! কলেজে পড়ে আমরা হয়তো বেহায়া হয়ে গেছি!’
মা হাসিয়া বলিলেন, ‘না মা! আমাদের বাড়িতেও পর্দার অত কড়াকড়ি নেই। তোমার মুখে বোরখা দেখে একটু বরং আশ্চর্য হয়ে গেছিলাম।’
চম্পা হাসিয়া বলিল, ‘কী করি মা, মামার জন্য আমায় বোরখা নিতে হয়েছিল, মামা একটু গোঁড়া!’
বলিয়াই ভূণীর পানে ফিরিয়া বলিল, ‘আমি কিন্তু তাই তোমায় “আপনি” বলতে পারব না, আর বউদি বলে ডাকব – কেমন? ভাবি-টাবির চেয়ে বউদি অনেক ভালো শোনায়।’
ভূণী এইবার হাসিয়া মুখের ঘোমটাটা বেশি করিয়া টানিয়া দিল।
এমন সময় ক্লান্ত হারুণ আসিয়া বলিল, ‘মা, সব জিনিসপত্র উঠে গেছে।’ মাতা তাহাকে গাড়িতে উঠিতে বলিয়া চম্পাকে বলিলেন, ‘এর বোধ হয় নাম শুনেছ আমিনা, এই আমাদের কবি হারুণ, তহমিনার বড়ো ভাই। আর হারুণ, ইনি আমিনা, তোমাদের প্রফেসর আজহার সাহেবের ভাগনি। আমাদের সাথে কলকাতা যাচ্ছেন। ডায়াসেশানে পড়েন।’
চম্পা আদাব করিয়া বলিল, ‘আপনার যথেষ্ট নাম শুনেছি। কিছু কিছু কবিতাও পড়েছি। চমৎকার লেখেন আপনি। আমার সৌভাগ্য যে, আপনার দেখা পেলুম।’
হারুন অভিভূতের মতো চম্পার পানে চাহিয়াছিল, সে যেন তাহার কল্পলোকের মানস-লক্ষ্মীকে স্বপ্নে দেখিতেছে! চম্পার এই প্রশংসায় তাহার মনে হইল, তাহার কবি-জীবন ধন্য হইয়া গেল। সে ইহার প্রত্যুত্তরে একটি কথাও বলিতে পারিল না, সমস্ত মুখ তার আরক্তিম হইয়া উঠিল।
ট্রেন আসিয়া পড়িল। তাহাদের স্যালুনকে টানিয়া ট্রেনের পশ্চাতে জুড়িয়া দিল। জাহাঙ্গীর দেখিল, জনকতক টিকটিকি তাহাদের কামরার সম্মুখ দিয়া কেবলই যাতায়াত করিতেছে।
জাহাঙ্গীর কিছু বলিবার আগেই দেওয়ান সাহেবের হুংকার শোনা গেল। তিনি নামিয়া তাহাদের এক তাড়া দিতেই তাহারা প্রার্থনা করিয়া চলিয়া গেল। গাড়ি ছাড়িয়া দিল।
জাহাঙ্গীর চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। আজিকার বিপদের ছায়া তাহার মুখে ঘন বেদনার ছাপ মারিয়া দিয়াছিল। সে ভাবিতে লাগিল, যে কোনো মুহূর্তে তাহার জীবন বিপন্ন হইতে পারে। বাথরুমে ঢুকিয়া সে তাহার পিস্তলটা পরীক্ষা করিয়া ভালো করিয়া তলপেটে কোঁচার নীচে সামলাইয়া রাখিল। আসিয়া চম্পাকে কী যেন ইঙ্গিত করিল, চম্পাও চক্ষু ইঙ্গিতে কী যেন বলিল। ভূণী ঘোমটার আড়াল হইতে তাহা দেখিতে পাইল। তাহার শরীর মন জ্বালা করিয়া উঠিল। ইহারা তাহা হইলে শুধু আজিকার পরিচিত নয়।
মাতা জাহাঙ্গীরের মুখ চোখ দেখিয়া বলিলেন, ‘খোকা, তোর মুখ চোখ অমন কালো হয়ে গেছে কেন? কিছু খাসনি বুঝি এখনও? তুই আর হারুণ কিছু খেয়ে নে তো। কী রকম মুখ চোখ বসে গেছে তোর !’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘না মা, খিদে পায়নি মোটেই, এমনি শরীরটা কেমন খারাপ লাগছে।’
মা বলিলেন, ‘শরীর খারাপ করেছে কেন রে? যা ছেলে তুই, কারুর কথা তো শুনবিনে। অতটা রাস্তা হেঁটে এলি, কিছুতেই পালকিতে চড়লিনে! দেখি’ – বলিয়া কপালে হাত দিয়া বলিলেন, ‘তোর গাও যে গরম হয়েছে খোকা! শুয়ে পড় শুয়ে পড় এইখানে।’
জাহাঙ্গীর শুইয়া পড়িল। গাড়ির সকলে ব্যস্ত হইয়া পড়িল। চম্পা হাসিয়া বলিল, ‘ব্যস্ত হবেন না মা, নতুন দায়িত্ব ঘাড়ে নিচ্ছেন কিনা, তারই চিন্তায় ওঁর শরীর হয়তো একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।’
মা ম্লান হাসি হাসিয়া বলিলেন, ‘না মা, তুমি জান না, ওর শরীরের উপর একটুও যত্ন নেই, সত্যিই ওর শরীর খারাপ করেছে।’
চম্পা বলিল, ‘তা তো দেখেই বোধ হচ্ছে! ওঁর শরীরটা যেন সন্ন্যাসীর, যত রকমে পেরেছেন, ওকে নির্যাতন করেছেন। লক্ষ রাখবেন মা, সন্ন্যাসী-টন্ন্যাসী না হয়ে যান!’
মা হাসিয়া বলিলেন , ‘এবার যার উপর লক্ষ রাখার ভার পড়েছে – সেই দেখবে মা। আমি তো ওকে বাগে আনতে পারিনি – দেখি অন্য কেউ পারে কিনা।’
চম্পা ভূণীর কানে কানে বলিল, ‘তুমি বেশ ভালো ঘোড়সওয়ার তো বউদি? জোর লাগাম কশে রেখো। নইলে এ বেহেড ঘোড়া ছুটতে শুরু করলে আটকে আর রাখতে পারবে না।’
ভূণী জোর করিয়া হাসিয়া বলিল, ‘যদি তোমার মতো কথার চাবুক থাকত হাতে ভাই, তা হলে হয়তো পারতুম। ও ঘোড়া হয়তো একা তুমিই বাগে আনতে পার।’
চম্পা রাম-চিমটি কাটিয়া বলিল, ‘এই ননদ-নাড়া শুরু হল তা হলে!’
ভূণী উঃ করিয়া শব্দ করিয়া বলিল, ‘তুমি দেখছি শূর্পণখা!’
চম্পা হাসিয়া বলিল, ‘আর উনি বুঝি রাবণ, তুমি সীতা?’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘ওধারে রাম-লীলা শুরু হল, হারুণও কবিতার খাতা নিয়ে বসল, আমি ততক্ষণ কুম্ভকর্ণের ডিপুটিগিরি করি।’
বলিয়া চক্ষু বুজিয়া শুইয়া পড়িল। মাতা হাসিয়া পুত্রের ললাটে সস্নেহ কর সঞ্চালন করিতে লাগিলেন।