কুহেলিকা – ১৪
জাহাঙ্গীর সুখ ও দুঃখের নানা স্বপ্ন দেখিতে দেখিতে কখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল।
জাগিয়া দেখিল, তাহার মাতা শিয়রে বসিয়া অতন্দ্রনয়নে তাহার পানে চাহিয়া আছেন।
সে চোখ মেলিতেই মা বলিয়া উঠিলেন, ‘জেগে উঠলি খোকা? ঘুমো আরও খানিক।’
জাহাঙ্গীর উঠিয়া বসিয়া বলিল, ‘না মা, আর ঘুম হবে না।’ বলিয়াই উসখুস করিতে লাগিল।
মা হাসিয়া বলিলেন, ‘তুই কী ভাবছিস বলতো! আমি কালই হারুণের বাড়ি যাব। দেওয়ান সাহেবও যাবেন, তোকেও যেতে হবে।’
জাহাঙ্গীর কোনোরূপে শুধু বলিতে পারিল…’মা!’
মা বলিলেন, ‘হাঁ, এ তোর মায়ের আদেশ।’ বলিয়াই একটু থামিয়া বলিলেন ‘তোর পাঞ্জাবিটা ধুতে দিতে গিয়ে তার পকেটে বউমার লেখা চিঠি দেখেছি। এমন মেয়ে পেয়েও যদি তুই মাথায় তুলে না নিস, বুঝব তোর কপালে বড়ো দুঃখ আছে। তুই না নিস, আমি আমার ঘরের লক্ষ্মীকে মাথায় করে নিয়ে আসব। আমি হজ করতে যাব বলে বেরিয়েছিলুম – খোদা আমার হজের পুণ্য রাস্তাতেই দিয়েছেন। তাকে না নিতে পারলে খোদা নারাজ হবেন!’
জাহাঙ্গীর ফাঁসির আসামির মতো দয়া ভিক্ষার স্বরে বলিয়া উঠিল, ‘দোহাই মা, আমায় এত বড়ো শাস্তি দিয়ো না। এ শাস্তির অংশ তাকেও নিতে হবে তা হলে। তা ছাড়া সে যা মেয়ে – তুমি গেলেও সে আসবে না – যদি না আমি তাকে সত্যিকার বিয়ে করি।’
মা হাসিয়া বলিলেন, ‘তোর বিয়েতে এত ভয় কেন খোকা বল তো! তোকে তো কেউ ফাঁসি দিচ্ছে না!’ – বলিয়া জিভ কাটিয়া ‘ষাট ষাট বালাই’ বলিয়া পুত্রের শিরশম্বন করিয়া বলিলেন, ‘কী বদখেয়ালি কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় গো মা! – যাক, এখন যদি তুই রাজি নাই হোস – তার ব্যবস্থাও দেওয়ানজি করে রেখেছেন। হারুণকে আমার স্টেটে এখন শ-তিনেক টাকার চাকরি দিয়ে ওদের সপরিবারে কলকাতায় নিয়ে আসব। চব্বিশ পরগনায় রায়েদের একটা বড়ো জমিদারি বিক্রি হচ্ছে – সেটা কিনে নেবার ব্যবস্থা করেছি। হারুণ সেই স্টেটের ম্যানেজার হবে। তারপর যা করবার, করা যাবে।’
জাহাঙ্গীর এক মুহূর্তে সব ভুলিয়া গিয়া বলিয়া উঠিল, ‘সত্যি মা, তুমি হারুণকে নিয়ে আসবে? আহা, বেচারার বড়ো দুঃখ মা! এইবার বি.এ. দেবে, কিন্তু পাশ করলেও সে চাকরি পেত কোথায়? অথচ ওর চাকরি না হলে ওরা সব কটি প্রাণী উপোস করে মরবে! ওকে যদি চাকরি দিয়ে আনতে পার তা হলে আমার কৃতকার্যের অনেকটা অনুশোচনা কমে।’
মা হাসিয়া বলিলেন, ‘তোর পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয় বল।’– মা মনে মনে ভাবিলেন, ছেলে শুধু হারুণের চাকরির জন্যই খুশি হইয়া উঠে নাই, তাহার সাথে মেয়েটাও যে আসিবে, ইহাও তাহার খুশি হইয়া উঠার অন্যতম কারণ। তাঁহার মনের মেঘ অনেকটা কাটিয়া গেল! ছেলেবেলা হইতেই তাঁহার খোকা বিবাহ ব্যাপারে অতিরিক্ত লজ্জা অনুভব করে। ওরূপ খেয়াল অনেক ছেলেরই থাকে এবং তাহা কাটিয়া যাইতেও দেরি হয় না। তাঁহার খোকাও হয়তো মনে মনে রাজি আছে, শুধু লজ্জার খাতিরে এতটা করিতেছে। তাই অত্যন্ত প্রসন্ন মনে উঠিয়া পড়িয়া বলিলেন, ‘বেশি রাত্রি হয়নি এখনও। এখনই আমার সব দরকারি জিনিসপত্র কিনে ফেলতে হবে, তুইও আমার সাথে চল। দেওয়ানজি গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছেন বাইরের ঘরে।’
জাহাঙ্গীর উঠিতে উঠিতে বলিল, ‘কিন্তু আমাকে আর যেতে হবে না তো সাথে?’
মা বলিলেন, ‘সে কাল সকালে বোঝা যাবে। সকালেই ট্রেন, আমি টেলিগ্রাম করে দিয়েছি হারুণের ওখানে। হারুণ শিউড়ি স্টেশনে থাকবে! তুই মুখ হাত ধুয়ে কাপড় ছেড়ে প্রস্তুত হয়ে নে, আমি আসছি!’ জাহাঙ্গীর মুখ হাত ধুইয়া কাপড় ছাড়িয়া চা খাইতে খাইতে নানান আকাশ-কুসুমের কল্পনা করিতে লাগিল। তাহার আর সেখানে যাওয়া উচিত কিনা। অথচ সে না গেলে যদি তাহারা আসিতে অসম্মত হয়। সত্যই তাহার পাপের যদি কিছু মাত্রও প্রায়শ্চিত্ত হয় হারুণকে দারিদ্রের কবল হইতে রক্ষা করিয়া, তাহা হইলেও তাহার যাওয়াই উচিত। কিন্তু তাহাকে দেখিয়া যদি আবার ভূণীর অভিমান উথলিয়া উঠে! হারুণই যদি এই অনুগ্রহ লইতে অসম্মত হয়! তাহার পিতা যদি পৈতৃক ভিটা ছাড়িয়া আসিতে না চান। কিন্তু এ সকলের ঊর্ধ্বে সে তাহার বুদ্ধিমতী মাতার স্নেহপ্রবণ হৃদয়ের ও দেওয়ান সাহেবের বৈষয়িক বুদ্ধির উপর বেশি ভরসা রাখে। তাঁহারা ইহার একটা কিনারা করিয়া উঠিতে পারিবেন নিশ্চয়। কিন্তু তবু ওই দলিতা নাগিনির মতো তহমিনা? সে যদি ফণা তুলিয়া দাঁড়ায়! হঠাৎ জাহাঙ্গীরের চিত্ত বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল। না, তাহার কিছুতেই যাওয়া হইতে পারে না। মাতা যাইতেছেন, যান, সে অপমানিত হইতে কিছুতেই সেখানে যাইবে না!
মাতা আসিয়া বলিলেন, ‘খোকা ওঠ, রাত্রি সাড়ে আটটা বেজে গেল। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাবে আবার।’
জাহাঙ্গীর সুবোধ বালকের মতো মাতার সহিত গিয়া গাড়িতে বসিল। দেওয়ানজি অন্য গাড়িতে উঠিলেন।
মাতার বাজার করিবার ঘটা দেখিয়া জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘মা, তুমি যে জুয়েলারির আর কাপড়ের দোকান উজাড় করে নিয়ে যাবে দেখছি!’
মা হেসে বলিলেন, ‘এতদিন পরে মেয়ে পেলুম, তাকে দেবার মতন গয়না-কাপড় কি তবু পাওয়া গেল! তুই ওকে যা দুঃখ দিয়েছিস, এত গয়না-কাপড় দিয়েও তো তা ঢাকতে পারব না খোকা!’
জাহাঙ্গীর আর কোনো কথা বলিতে সাহস করিল না।
দেওয়ান সাহেবের ভ্রুকুটি মুখেও খুশি যেন আর ধরে না। ফররোখ সাহেব শুধু তাঁহার প্রভু ছিলেন না, তাঁহার প্রিয়তম বন্ধুও ছিলেন। তিনি বাঁচিয়া থাকিতে এবং আজও দেওয়ান সাহেব কোনোদিন ভাবিবার অবকাশ পান নাই যে, তিনি বেতনভোগী ভৃত্য। পরম বিশ্বাসে তাঁহার হাতে জমিদারির সমস্ত দায়িত্ব অর্পণ করিয়া ফররোখ সাহেব আনন্দ করিয়া কাটাইয়াছেন। জাহাঙ্গীরের মাতাও তেমনি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা সহকারে দেওয়ান সাহেবকে সম্মান করিয়া আসিতেছেন। দেওয়ান সাহেবের দুইটি পুত্র। দুইটি পুত্রই বিলাতে গিয়াছে। বন্ধুজ ও প্রভুপুত্র জাহাঙ্গীরকে পুত্রাধিক স্নেহের চক্ষে দেখিতেন বলিয়াই তাহার ভাবী সুখের সম্ভাবনায় এতটা উল্লসিত হইয়া উঠিয়াছেন।
এত বড়ো বিষয়ী ও মিতব্যয়ী দেওয়ান সাহেবও সেদিন যেন অতি বড়ো অমিতব্যয়ী হইয়া উঠিলেন। জাহাঙ্গীর ইহা লইয়া একবার বলিয়া ফেলিল, ‘আজ দেওয়ান সাহেবের আঙুলগুলো অতিরিক্ত ফাঁক হয়ে গেছে! যে আঙুল দিয়ে কখনও জল গলেনি, সেই আঙুলের ফাঁক দিয়ে হাজার হাজার টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে!’
দেওয়ানজি শুনিতে পাইয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘কিন্তু এ টাকা তো জলে পড়ছে না বাবাজি! যার টাকা তাকেই দিচ্ছি। এই জমিদারিই দু-দিন পরে যার কাছে বিকিয়ে দিতে যাচ্ছি, এই দু-দশ হাজার টাকা নজরানাও তার কাছে কিছুই নয়। তুমি তো জমিদারি দেখলে না বাবা, এইবার যে দেখবে – তাকে এ কয়-টাকার জিনিস আর দিলুম?’
জাহাঙ্গীরের মাতা অশ্রুভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলিলেন, ‘তুই কী বলছিস খোকা, তোর বাবা মরবার সময় যে ওই দেওয়ানজির হাতেই তোকে দিয়ে গেছিলেন । আজ তোর আনন্দের দিনে উনি কি হিসেব করে আনন্দ করবেন?’
পরদিন সকালে হাওড়া প্ল্যাটফর্মে স্তূপীকৃত হইয়া উঠিল রাশি রাশি জিনিসপত্র একটা স্যালুনের সামনে! দেওয়ানজি প্ল্যাটফর্মে ছুটাছুটি করিয়া চেঁচাইয়া হইচই বাধাইয়া তুলিলেন।
জাহাঙ্গীর কলের পুতুলের মতো দেওয়ান সাহেব ও তাহার মাতার আদেশ পালন করিয়া যাইতে লাগিল। স্টেশনে হঠাৎ এক জন মউলবি সাহেব চলিয়া যাইতে যাইতে যেন জাহাঙ্গীরকে ছড়ির মৃদু আঘাত করিয়া গেল। জাহাঙ্গীর ফিরিয়া দেখিবামাত্র মউলবি সাহিব ইঙ্গিতে তাহাকে ডাকিলেন। কাছে যাইতেই মউলবি সাহেব বলিলেন ‘আমি সব জানি। শিউড়িতে নেমে আমার সাথে দেখা করিস। আমিও সেখানেই নামব।’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া নমস্কার করিতে গিয়া সামলাইয়া লইয়া আদাব করিয়া চলিয়া আসিল।
মাতা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘উনি কে খোকা?’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘উনি আমাদের কলেজের আরবির প্রফেসর। উনিও শিউড়ি যাচ্ছেন, তাই আমায় শিউড়িতে নেমে দেখা করতে বললেন।’
মাতা আর প্রশ্ন করিলেন না। জাহাঙ্গীর তাহার প্রমতদার এই হঠাৎ আবির্ভাবে একটু চিন্তান্বিত হইয়া পড়িল। সে হঠাৎ এই ভাবিয়া খুশি হইয়া উঠিল, যে সুখের স্বর্গ সে রচনা করিতে চলিয়াছে – এইবার তাহা হয়তো তাহার অদৃশ্য ভাগ্যদেবতার রুদ্র আশীর্বাদে আগুনে পুড়িয়া যাইবে।
মাতা হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন, ‘খোকা, তোর মউলবি সাহেবকে আমাদের স্যালুনেই ডেকে নে না। দেওয়ান সাহেবের কামরায় তিনি থাকবেন। যা, ডেকে এনে খেতেটেতে দে।’
জাহাঙ্গীর প্রমাদ গণিল! তাহার মনে হইল মাতা বোধ হয় সন্দেহ করিয়াছেন।
সে বলিল, ‘আর তো ট্রেন ছাড়বার সময় নেই মা। ওঁকে বরং বর্ধমান স্টেশনে ডেকে নেব আমাদের গাড়িতে।’
মাতা বলিলেন, ‘না, না, যথেষ্ট সময় আছে! এখনও আধ ঘণ্টা দেরি। ভদ্রলোকের হয়তো কত কষ্ট হবে। তিনি তোর মাস্টার, কী মনে করবেন বল তো! তা ছাড়া ওঁকে দিয়ে আমার কাজ আছে।’
জাহাঙ্গীর একেবারে ভয় খাইয়া গেল। পাছে মাতার সন্দেহ আরও বাড়ে, তাই সে দ্বিরুক্তি না করিয়া মউলবি সাহেবকে খুঁজিতে নামিয়া গেল।
জাহাঙ্গীর অহেতুক ভয়চিত্ত। তাহার তথাকথিত মউলবি সাহেবকে বলিতেই তিনি সানন্দে দেওয়ান সাহেবের গাড়িতে আসিয়া বসিলেন এবং বিনা ওজরে খাদ্যাদির সৎকার করিলেন।
জাহাঙ্গীর অহেতুক ভয়চিত্ত। তাহার তথাকথিত মউলবি সাহেবকে বলিতেই তিনি সানন্দে দেওয়ান সাহেবের গাড়িতে আসিয়া বসিলেন এবং বিনা ওজরে খাদ্যাদির সৎকার করিলেন।
দেওয়ান সাহেব মউলবি সাহেবের সাথে জাহাঙ্গীরের কথা লইয়া আলোচনা করিতে লাগিলেন। জাহাঙ্গীর দেখিল, তাহার প্রমতদা নকল মউলবি হইলেও আসল মউলবির চেয়েও দুরস্ত-জবান। চমৎকার উর্দু-ফারসির আমেজ দিয়া তিনি কথা বলিতেছেন।
পাশের কামরা হইতে জাহাঙ্গীরের মাতা বাঁদি দিয়া বলিয়া পাঠাইলেন, মউলবি সাহেবকেও তাহাদের এই খুশিতে শরিক হইতে হইবে। অর্থাৎ তাহাদের সাথে তাঁহাকেও যাইতে হইবে।
মউলবি সাহেব বলিয়া পাঠাইলেন, তিনি অবশ্যই হুজুর আম্মার এ হুকুম পালন করিতেন যদি না শিউড়িতে তাঁহার রোগ-শায়িতা বহিনকে দেখিতে না যাইতেন!
মউলবি সাহেব জাহাঙ্গীরকে এক সময় একলা পাইয়া চুপি চুপি বলিলেন, ‘তোদের স্যালুনে জায়গা গেয়ে আমার ভালোই হল, শালার টিকটিকি আর পিছু নিতে পারবে না!’
জাহাঙ্গীর প্রশ্ন করিল, ‘কিন্তু প্রমতদা, আমার কী হবে? আমাকে যে যূপকাষ্ঠে নিয়ে যাচ্ছে!’
মউলবি সাহেব হাসিয়া বলিলেন, ‘খোদার মর্জি বাচ্চা! সব মেঘ কেটে যাবে! মাকে অসন্তুষ্ট কোরো না, খোদার রহম আপনি তোমার ওপর নাজেল হবে!’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, ‘সোবহান আল্লাহ্ মউলবি সাহেব! ক্যা তরিকা বাতায়া আপনে!’
মউলবি সাহেব এধার ওধার দেখিয়া লইয়া বলিলেন, ‘তোকে পিনাকীর মাসিমা ডেকেছেন, তা ছাড়া আমারও কাজ আছে। তুই হারুণের বাড়ির ফেরতা ওখান হয়ে যাবি।’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘কিন্তু মা যে সাথে আছেন!’
মউলবি সাহেব বলিলেন, ‘তার ব্যবস্থা করা যাবে খন।’
গাড়ি ছাড়িয়া দিল। জাহাঙ্গীরের বুক অজানা অশঙ্কায় কাঁপিয়া উঠিল।