কুহেলিকা – ১৩
জাহাঙ্গীর আসিয়া পৌঁছাইতেই তাহার মাতা একেবারে তাহাকে বুকে জড়াইয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন, ‘খোকা, এ কী চেহারা হয়েছে তোর?’
জাহাঙ্গীর কিছু না বলিয়া মায়ের কোলে মাথা রাখিয়া শুইয়া পড়িল। জননী উদ্গত অশ্রু সংবরণ করিতে করিতে নীরবে ছেলের মাথায় মুখে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন।
জাহাঙ্গীর হঠাৎ উঠিয়া পড়িয়া বলিল, ‘তোমার খাওয়া হয়নি দু-দিন থেকে! আগে খেয়ে নাও, তার পর সব কথা হবে।’
অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুত্রের পীড়াপীড়িতে তাঁহাকে উঠিয়া খাইয়া আসিতে হইল।
জাহাঙ্গীর ততক্ষণে ঘরের চতুর্দিকে ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখিতে লাগিল, সত্যসত্যই কোনো দূরদেশে যাইবার জন্যই তাহার মা প্রস্তুত হইয়া আসিয়াছেন। বুঝিতে তাহার বাকি রহিল না, মায়ের এ অভিমান কাহার উপর! সে সংসারী হইল না, ঘর সংসারের কোনোকিছু দেখিল না শুনিল না বলিয়াই মা স্বেচ্ছায় সংসার হইতে সরিয়া দাঁড়াইতেছেন। এ হয়তো অভিমান করিয়া পুত্রকে শাস্তিই দিতেছেন তিনি। জাহাঙ্গীর গভীর দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া একটা সোফায় বসিয়া অস্ত-আকাশের রং-এর খেলা দেখিতে লাগিল। রং তো নয়, ও মায়া, স্বপ্ন। ও রং লাগিতেও যতক্ষণ মুছিতেও ততক্ষণ।
ওই গোধূলিবেলার রং-এর মতো সুখের স্বপ্নের ছোপ তাহার চিত্তে লাগিয়াই আবার পরক্ষণে মুছিয়া যায়। ওই অস্ত-আকাশের মতোই নির্লিপ্ত তার মন। কত রং আসে, খেলিয়া যায়, তার পরে একেবারে নিশ্চিহ্ন হইয়া মুছিয়া যায় কঠোর বাস্তবের দিবালোকে। এই রং-এর মায়ায় সে ভুলিবে না। ইহাকে প্রশ্রয় দিবে না। তাহার কাছে শুধু দিনের আলো আর রাতের আঁধারই সত্য। নিষ্ঠুর বাস্তবতা আর অসীম দুঃখ সূর্যালোক আর আঁধারের মতো তাহার জীবনকে জড়াইয়া আছে। ইহাকে অতিক্রম করিয়া যাহা কিছু তাহা কেবলই রং-এর মায়া, মরীচিকার প্রতারণা।
সে কী করিবে ভাবিতে লাগিল।
কিন্তু বেশি ভাবিবার অবকাশও সে পাইল না। মাতা খাইয়া আসিয়া পার্শ্বে বসিয়া বলিলেন, ‘সত্য বল দেখি খোকা, তোর কী হয়েছে! দিন দিন তোর চেহারাই বা অমন হচ্ছে কেন? কী হয়েছিস, একবার আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখ দেখি।’
জাহাঙ্গীরের মেসে বড়ো আয়না ছিল না। তাছাড়া চুলটুল চিরুনিও করে সে সাধারণত কম। করিলেও এত অন্যমনস্কভাবে করে, যে তাহার নিজের চেহারার দিকে লক্ষ করিবার মতো মনের অবস্থা তাহার থাকে না। মায়ের কথায় হঠাৎ সামনের বড়ো আয়নার দিকে তাকাইয়া সে নিজেকে এতদিন পরে ভালো করিয়া দেখিল। দেখিয়া লজ্জিত হইয়া মুখ ফিরাইয়া লইল। সত্যই তাহার চেহারা অতিমাত্রায় লক্ষ্মীছাড়া হইয়া গিয়াছে। এই ঘরে তাহাকে যেন মানাইতেছিল না।
তাহার কেবলই মনে হইতে লাগিল, রাজবাড়িতে ভিক্ষুককে যেমন অশোভন দেখায়, তাহাকে তেমনই বিশ্রী বেখাপ্পা দেখাইতেছে। সে মনে মনে সংকুচিত হইয়া উঠিতে লাগিল!
সে জানে, রাজ-ঐশ্বর্য এই ঘরবাড়ি ধনদৌলত সমস্ত তাহারই একদিন হইবে। অথবা ইচ্ছা করিলে আজই সে এসবের মালিক হইতে পারে। তবু তাহার মন কেন যেন কেবলই বলিতে লাগিল, এ ঐশ্বর্য আর কারুর, তোর নয়, তোর নয়! কেন যেন তাহার মন এত বড়ো অধিকার, এত বেশি ঐশ্বর্যকে স্বীকার করিয়া লইতে পারে না, তাহা সে নিজেই জানে না।
দেশের কাজে নিয়তই তাহাকে দুঃখী আতুরদের মাঝেই বেশিরভাগ ঘুরিয়া বেড়াইতে হইয়াছে। তাহাদের শত অপরাধের মাঝে থাকিয়াও তো সে এ অস্বস্তি অনুভব করে নাই। বরং পরম শান্তির সঙ্গে এই দুঃখের দৈন্যের বুকে বসিয়া সে ভাবিয়াছে, সে যেন এই দৈন্য-দুঃখপীড়িত দলেরই এক জন। ঐশ্বর্যের প্রলোভন মায়া তাহার জন্য নয়। সে ঐশ্বর্যকে ঘৃণা করে, ঐশ্বর্যশালীদের ঘৃণা করে। উহারাই সকল পাপের মূল। উহারাই শয়তানের গুপ্তচর। ওই ঐশ্বর্যই সকল অকল্যাণের হেতু।
তাহার জন্মবৃত্তান্ত আজ তাহার কাছে অবিদিত নাই। ইহা লইয়া প্রথমে যে চিত্তবিক্ষোভ হইয়াছিল, তাহাও অনেকটা আজ প্রশমিত হইয়া গিয়াছে – তাহার আত্ম-অবহেলায় আত্ম-নির্যাতনেও প্রমত্তের উপদেশ। তবু তাহার মনে হইতে লাগিল, আজ যদি আমার মা ওই দুঃখীদের মতোই এক জন হইত, সে আজ এমন করিয়া মাকে পর ভাবিতে পারিত না। তাহার কেবলই মনে হইতে লাগিল, এই বাহিরের ঐশ্বর্যই তাহার অন্তরের ঐশ্বর্যকে আড়াল করিয়া রাখিয়াছে। মনে মনে বলিল, দেবতার অভিশাপের মতোই দেবতার বরও ব্যর্থ হইবার নয়; সুতরাং এ বরের বর্বরতা যেদিন তাহার স্কন্ধে আসিয়া চড়িবে, সেদিন সে যেন তাহাকে পরিপূর্ণ চিত্তে অগাধ জলে বিসর্জন দিতে পারে।
এই সোনার লঙ্কাকে দগ্ধ করিতে পারে। বহু সীতার চোখের জলে এ লঙ্কা কলঙ্কিত।
বেদনাতুর আঁখি তুলিয়া মাতা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কী ভাবছিস খোকা অমন করে? কী হয়েছিস তুই? কেবলই কী যেন ভাবছিস! কথা কইছিস অন্যমনস্ক হয়ে। যেন অন্য বাড়ির ছেলে। আমার যে কত কথা আছে তোর সাথে!’
জাহাঙ্গীর ম্লান হাসি হাসিয়া বলিল, ‘বড্ড শরীরটা খারাপ লাগছে মা! আমি একটু শুই, শুয়ে শুয়ে সব কথা শুনব তোমার। তা ছাড়া পরীক্ষা কাছে কিনা, এবার পাশ করতে পারব কিনা ভাবছি।’
মাতা হাসিয়া ফেলিয়া বলিলেন, ‘দেখ, মার মন অন্তর্যামী। আমার কাছে তোর আর লুকাতে হবে না। তোর মনের কথা না বলিস না-ই বললি, তবু এ লুকোবার চেষ্টা করিসনে। আর পরীক্ষায় ফেলের কথা? তুই তো চিরকাল না পড়েই পাশ করে এলি। আমি জানি, এবারও তুই পাশ করবি। কিন্তু তুই তো ও কথা ভাবছিসনে, অন্য কী কথা ভাবছিলি বল?’
জাহাঙ্গীর বিছানায় শুইয়া পড়িল, উপরের দিকে হাঁ করিয়া তাকাইয়া থাকিল।
একটু থামিয়া ধরা গলায় মা বলিয়া উঠিলেন, ‘খোকা আমি মা, আমি তোর মনের কথা যেন সব বুঝি। আচ্ছা বাবা, তোর কথায় আমি তো খেলুম, এখন তুই এ বাড়ির কিছু খাবি কি? তুই পেটের ছেলে, তবু যেন ও-অনুরোধটুকু করতেও আমার ভয় হয়!’– বলিতে বলিতে কান্নায় মাতার স্বর জড়িত হইয়া গেল!
জাহাঙ্গীরকে কে যেন চাবুক দিয়া আঘাত করিল। সে জ্যা-ছিন্ন ধনুকের মতো লাফাইয়া উঠিয়া মায়ের কোলে মাথা রাখিয়া কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল, ‘মা! মা! তোমার পায়ে পড়ি, আর অমন করে বোলো না, আমিও আজ তিন দিন থেকে শুধু চা খেয়ে আছি। এতক্ষণ বলিনি। খাবার আনো, তুমি খাইয়ে দেবে!’
জাহাঙ্গীরকে বুকে জড়াইয়া ‘খোকা’ বলিয়া ডাকিয়া ফোঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিলেন।
অনেকক্ষণ কাঁদিয়া চোখ মুছিয়া বলিলেন, ‘কী নিষ্ঠুর তুই খোকা, নিজে না খেয়ে আছিস তিন দিন, আর তা লুকিয়ে আমায় মাথার দিব্যি দিয়ে খাওয়ালি?’
জাহাঙ্গীর দুষ্টু ছেলের মতো আবদারের সুরে বলিয়া উঠিল, ‘বা রে, তুমি বুঝি জিজ্ঞাসা করেছিলে আমি খেয়েছি কিনা?’
চোখে আঁচল দিয়া মাতা চলিয়া গেলেন। পরিপাটি করিয়া ছেলেকে খাওয়াইবার পর মাতা বলিলেন, ‘তুই এখন শো দেখি। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সব কথা বলি।
জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘আর সব কথা বলতে হবে না তোমার। আমি সব জানি। এরই মধ্যে হাজিবুড়ি হতে যাচ্ছ, এই তো!’
মাতা হাসিয়া বলিলেন, ‘তা বুড়ো তো হয়েছি বাবা। এইবার তোর জিনিস তুই নে। আমি আর যখের ধন আগলাতে পারিনে।’
জাহাঙ্গীরও তরল হাসি হাসিয়া বলিল, ‘অর্থাৎ যক্ষ ভূত হয়ে আমিই এ টাকাকড়ি নিয়ে পাহারা দিই! তা মা, জ্যান্ত ছেলেকেও যখ দেওয়া যায় না!’
মা ছেলের মুখ চাপিয়া বলিলেন, ‘তুই থাম খোকা। ষাট! বালাই! নিতে হবে না তোকে কিছু। দেওয়ান সাহেবই সব দেখবেন। তুই ঘরেরও হবিনে। অথচ আমায়ও মুক্তি দিবিনে। আমি কতদিন আর এ শাস্তি বইব, বল তো?’
জাহাঙ্গীর দুষ্টুমির হাসি হাসিয়া বলিল, ‘আচ্ছা মা, আমি যদি তোমার বউমা এনে দিই, তা হলে হজ করতে যেতে পারবে?’
মা যেন হাতে স্বর্গ পাইয়া বলিলেন, ‘তোর মুখে ফুলচন্দন পড়ুক খোকা! ও অদৃষ্ট নিয়ে আমি আসিনি। বাড়িতে যদি আমার বউমা আসে, তুই ফিরে আসিস, তা হলে কাজ কী আমার মক্কার হজে! ওই হবে আমার মক্কা-কাবা সব!’
জাহাঙ্গীর হো হো করিয়া মায়ের মুখের কথা কাড়িয়া লইয়া বলিল, ‘বলো কী মা, তোমার বউমাই হবে সব! কাবার চেয়েও বড়ো!’ – বলিয়াই কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘থাক, আমিই বানে ভেসে এসেছিলুম!’
মা এইবার রাগিয়া উঠিয়া বলিলেন, ‘চুপ কর হতভাগা ছেলে! যা নয় তাই বলা হচ্ছে!’ – বলিয়াই স্নেহ বিগলিত স্বরে বলিলেন, ‘সত্যি খোকা বল, তুই আমার ঘরে বউ এনে দিবি? আর ভূতের মতো একলা বাড়ি আগলাতে পারিনে! কেমন? তা হলে জিনিসপত্র খুলতে বলি?’ – বলিয়া হাঁক-ডাক দিতে আরম্ভ করিলেন, ‘ওরে মোতিয়া, দেওয়ানজিকে একবার খবর দে তো !’
মোতিয়া বাড়িরই পুরাতন ঝি। সে এতক্ষণ সব শুনিতেছিল আড়ালে থাকিয়া। এই খোশখবরে সে আর থাকিতে না পারিয়া বলিয়া উঠিল, ‘বেগম আম্মা, আপনি দেইহ্যা বুঝবার পারছেন না, ভাইজানের মুখ ক্যামন শুরুষকু অইয়্যা গিয়াছে! জোয়ান পোলার শাদি না দিলে সে তাই ব্যাওরা অইয়্যা যাইব না?’
জাহাঙ্গীর হো হো শব্দে হাসিয়া উঠিল। মা-ও হাসিয়া ফেলিয়া বলিলেন, ‘তুই যা দেখি, আগে দেওয়ান সাহেবকে ডেকে আন, তার পর তোর ভাইজানের শাদির কথা হবে।’
জাহাঙ্গীর বলিয়া উঠিল, ‘তার আগে মা তোমার সব কথা ভালো করে শোনা দরকার!’
মোতিয়া তাহার কাজলায়িত চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া জাহাঙ্গীরের দিকে তাকাইয়া চলিয়া গেল।
মাতা পুত্রের রুক্ষ চুলের মধ্যে অঙ্গুলি চালনা করিতে করিতে বলিলেন, ‘কতদিন তেল মাখিসনে খোকা, বল তো! তুই কি সন্ন্যাসী হয়ে যাবি নাকি শেষে?’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘কিন্তু তুমি তো সন্ন্যাসী হতে দেবে না। সে যাক, তুমি যে আসল কথাটাই শুনতে চাচ্ছ না!’
মা হাসিয়া বলিলেন, ‘সে কথা না শুনেই আমি বুঝেছি। সে মেয়েটি কোথায় থাকে বল, তার পর আমার যা করবার আমি করব!’
জাহাঙ্গীর লজ্জিত হইয়া বলিল, ‘তুমি যা মনে করছ মা তা নয়। আমি তোমার কাছে কিছু লুকোব না। সব শুনে তুমি যা করতে বলবে তাই করা যাবে।’
জাহাঙ্গীর হারুণদের বাড়ি যাওয়া হইতে আরম্ভ করিয়া তাহার উন্মাদিনী মাতার কীর্তি পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা বলিয়া গেল। বলিল না শুধু তাহার বিপ্লবীদলের সহিত সংশ্লিষ্ট থাকার কথা।
মাতা বিস্ময়াভিভূত হইয়া অনেকক্ষণ বসিয়া রহিলেন, তাঁহার মুখ দিয়া কোনো কথা উচ্চারিত হইল না। ক্ষণে ক্ষণে তাঁহার মুখে আনন্দ ও শঙ্কার আলোছায়া খেলিয়া যাইতে লাগিল।
হঠাৎ জাহাঙ্গীর বলিয়া উঠিল, ‘কিন্তু মা তাকে কিছুতেই এ বাড়িতে আনা যেতে পারে না। তোমাকে বলতে ভুলে গেছি – সে অতিমাত্রায় অহংকারী মেয়ে। আমার মা গিয়ে তাকে অভ্যর্থনা করে আনলে তবে নাকি তিনি আমাদের ঘরে শুভ পদার্পণ করলেও করতে পারেন। বিষ নেই মা, কিন্তু ফণা-আস্ফালন আছে!’
মা হাসিয়া ফেলিয়া বলিলেন, ‘সে ঠিকই বলেছে খোকা। তা যদি সে না বলত, আমি তাকে আনবার কথা ভাবতে পারতুম না। যে সাপ ফণা ধরে – তার বিষও থাকে, সে জাতসাপ।’
জাহাঙ্গীর ভয় পাইয়া বলিয়া উঠিল, ‘তুমি কি তাকে এ বাড়িতে আনবে মা?’
মা হাসিয়া বলিলেন, ‘তা আনতে হবে বইকী! খোদা নিজে হাতে যে সওগাত পাঠিয়েছেন তাকে মাথায় তুলে নিতে হবে।’
জাহাঙ্গীর ক্লান্ত কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, ‘কিন্তু মা আমি তো তাকে বিয়ে করতে পারি না। তাকে কেন, কাউকেই বিয়ে করবার অধিকার আমার নেই!’
মা চমকিয়া উঠিয়া কী ভাবিলেন। তাহার পর আদেশের স্বরে বলিলেন, ‘তোর তো বিয়ে হয়ে গেছে খোকা। তুই তাকে অস্বীকার করতে পারিস, কিন্তু সে মেয়েকে না দেখলেও তোর কাছে তার সম্বন্ধে যা শুনেছি – তাতে মনে হচ্ছে – সে তোকে অস্বীকার করতে পারবে না। তুই যদি তাকে না নিস, সে তার নিয়তিকে মেনে নিয়ে চিরকাল দুঃখ ভোগ করবে। জানি না, তার অদৃষ্টে কী আছে, কিন্তু আমার ছেলে যদি তার কাছে চির-অপরাধীই থেকে যায় আমাকে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে!’
জাহাঙ্গীর শূন্যদৃষ্টিতে একবার তাহার মাতার পানে চাহিয়া অসহায়ভাবে শুইয়া পড়িল।
মা ম্লান হাসি হাসিয়া বলিলেন, ‘কিন্তু তোর এত ভয় কেন খোকা? সে কি সুন্দরী নয়? না অন্য কারণে তোর মনে ধরেনি?’
জাহাঙ্গীর রুগ্ণ-কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, ‘না মা, তা নয়। তার মতো সুন্দরী মেয়ে খুব কমই চোখে পড়ে। তুমি তো হারুণকে দেখেছ। তার চেয়েও সে সুন্দর। আর, মনে ধরার কথাই উঠতে পারে না, কেননা সে মনই আমার নেই। আমায় বিয়ে করতে নেই – তাই বলছিলুম।’
মাতা স্থিরদৃষ্টিতে পুত্রের পানে তাকাইয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘বিয়ে করতে নেই মানে? তুই কি ফকির-দরবেশের ব্রত নিয়েছিস?’
জাহাঙ্গীর অন্যদিকে চাহিয়া বলিল, ‘কতকটা তাই!’
মাতার দুই চোখ অশ্রুতে পুরিয়া উঠিল! তবে কি পুত্র তাহার জন্ম-কাহিনির বেদনা আজও ভুলিতে পারে নাই? আজও কি সে তার জন্মের জন্য অনুতপ্ত?
মোতিয়া আসিয়া খবর দিল, দেওয়ান সাহেব আসিয়াছেন। মাতা মোতিয়াকে বলিলেন, ‘তুই তোর ভাইজানের কাছে থাক, দেওয়ান সাহেবের সাথে আমার কথা আছে।’ বলিয়া পাশের কামরায় উঠিয়া গেলেন।
মোতিয়া জাহাঙ্গীরের পানে পৌনে দুই চোখে তাকাইয়া মুচকি হাসিয়া বলিল, ‘ভাইজান, পা টিপ্যা দিবাম নি?’
জাহাঙ্গীর কোনো উত্তর দিল না। হয়তো সে তাহার কথা শুনিতেই পায় নাই।
মোতিয়া জাহাঙ্গীরের পা কোলে তুলিয়া লইয়া টিপিতে লাগিল।
জাহাঙ্গীর আপত্তি করিল না।
তখন মনে তাহার ঝড় বহিতেছিল। তাহার মনে পড়িল, ভূণীর চিঠির কথা। পর দিন অর্থের লোভে গোরুর গাড়ির সেই গাড়োয়ান সত্যসত্যই শিউড়ি স্টেশনে পত্রের উত্তর লইয়া আসিয়াছিল।
ভূণী লিখিয়াছিল: ‘যদি মা আমাকে আপনার হাতে সঁপিয়া না দিতেন, আমি আপনার পত্রের উত্তর দেওয়া অপমানজনক মনে করিতাম! আপনি যাহাকে চিরজীবনের নির্বাসন-দণ্ড দিয়া গিয়াছেন, হঠাৎ তাহার প্রতি এই করুণার হেতু কী, জানি না। আমি আপনাকে যতটুকু বুঝিয়াছি – তাহাতে আমার ধারণা – হৃদয় ছাড়া অপনার সকল কিছুই আছে। কিন্তু সে সকল লইয়া তো – নারী আমি – আমার কোনো লাভ নাই। দুঃখের সমুদ্রে কলার ভেলায় আমরা ভাসিতেছিলাম। হঠাৎ আপনার বিপুল অর্ণবপোত আমাদের কাছে আসিল। উদ্ধার পাইবার আশা করি নাই, বরং মনে যে ভয়ের সঞ্চার হইয়াছিল – তাহাই ফলিয়া গেল। আপনার জাহাজের ঢেউ লাগিয়া আমাদের কলার ভেলাখানি ডুবিয়া গেল। এখন তরঙ্গের সঙ্গে যুদ্ধ করা ছাড়া অন্য পথ নাই। যতদিন শক্তি থাকিবে যুদ্ধ করিব।
আপনি কূলে উঠিয়াছেন। যাহারা তরঙ্গে ডুবিতেছে – তাহাদের লইয়া এ বিদ্রুপ কেন?
ইচ্ছা করিলেই কি আপনার কূলে উঠিতে পারি? আপনি কী ভাবিয়া আমায় ডাকিয়াছেন, জানি না।
যে অধিকার আমার মা আপনাকে দিয়াছেন – সেই অধিকারের দাবি লইয়া যেদিন শুধু আপনি নয় – আপনার অভিভাবিকা জননী আসিয়া ডাকিবেন – সেই দিন হয়তো যাইতে পারি। কিন্তু তাহার পূর্বে নয়। লোকসমাজের শ্রদ্ধা হারাইয়া আপনার কাছে গেলে – আপনিই আমায় শ্রদ্ধা করিতে পারিবেন না। অন্তরে যাহাকে স্বীকার করিয়া লইয়াছি, বাহিরের দিনের আলোকে তাহাকে স্বীকার করিবার সৌভাগ্য যদি অর্জন করি, সেদিন আপনার আদেশে আমি মৃত্যুর মুখোমুখি গিয়া দাঁড়াইতে পারিব।
আশা করি, আপনি আমায় ভুল বুঝিবেন না। এবং আর এরূপ ছেলেমানুষিও করিবেন না। আমার আত্মসম্মান আপনার আত্মসম্মানের চেয়ে কোনো অংশে হীন বা ন্যূন নহে!
বাহিরের ঐশ্বর্যের দম্ভ আমার নাই, আমরা দরিদ্র; কিন্তু অন্তরের ঐশ্বর্যের গৌরব আমার অন্তত আপনার অপেক্ষা কম নাই।
আমাদের মাঝে যে অকূল পারাবার বহিয়া চলিত – তাহাই হয়তো আমার নিয়তি।
এ কূলে আপনি আসিয়াছেন, ইহাই আমার পরম সৌভাগ্য বলিয়া মানিব। ও কূল হইতে আর হতছানি দিয়া ডাকিবেন না। মানুষেরই তো মন, একবার যদি ঝাঁপাইয়া পড়ি প্রলোভনের বশে এ কূল ও কূল দুই কূল হারাইব।
মা আপনার জন্য এখনও কাঁদেন। বলেন, “মিনা এসে চলে গেল! ও আর আসবে না!” যদি উপযুক্ত চিকিৎসা হইত, মা হয়তো ভালো হইলেও হইতে পারিতেন।
এইবার বাবার আর দাদার পাগল হইতে বাকি, আপনার অনুগ্রহে হয়তো তাহারও আর বিলম্ব নাই।
আপনি কি জাদু জানেন? মোমি আর মোবারক আজও আপনার ওকালতি করে! দুটো কাপড় আর দু হাঁড়ি সন্দেশের এমনই মোহ! চির-দুঃখী কিনা!
আমাকে ভুলিয়াও যে স্মরণ করিয়াছেন, তজ্জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আরও ধন্যবাদ দিব, যদি স্মরণ করিয়া ভুলিয়া যান এবং এইরূপ অসম্মানজনক পত্রাদি প্রেরণ না করেন! ইতি –
আপনার দয়া – ঋণী
তহমিনা।”