কুহেলিকা – ১২
জাহাঙ্গীর কলিকাতা ফিরিয়া আসিয়াই দেখে দুই তিনখানা টেলিগ্রাম আসিয়া পড়িয়া আছে। একখানা দেওয়ানজির, দুইখানা তাহার মায়ের প্রেরিত। পর পর দুইখানা টেলিগ্রাম করিয়াও তাহার উত্তর না পাইয়া স্নেহবৎসলা জননী আবার ‘রিপ্লাই-পেড’ টেলিগ্রাম করিয়াছেন। এইবার উত্তর না দিলে দেওয়ানজিকে লইয়া তিনি নিজেই কলিকাতা আসিয়া তাহাকে পাকড়াও করিবেন – এমন ইঙ্গিতও দিয়াছেন টেলিগ্রামে।
জাহাঙ্গীরের মাতা ঘুণাক্ষরেও জানিতেন না যে তাঁহার পুত্র বিপ্লব-মন্ত্রে দীক্ষা লইয়াছে, বা সে কলিকাতায় মাঝে মাঝে থাকে না – ওই মন্ত্রের উপাসনার জন্য। কাজেই তিনি মনে করিতেছিলেন, হয় জাহাঙ্গীর পীড়িত, নয় সে ইচ্ছা করিয়াই উত্তর দিতেছে না।
জাহাঙ্গীর ভয়ে ভয়ে শেষ টেলিগ্রামের তারিখ দেখিয়া বুঝিল, ও টেলিগ্রামও দুই দিন আগেকার। সে সর্বাপেক্ষা অধিক বিস্মিত হইল, টেলিগ্রাম খোলা দেখিয়া। অনেক অনুসন্ধান করিয়াও সে জানিতে পারিল না, কে তাহার টেলিগ্রাম খুলিয়াছে। শেষে তাহার বুঝিতেও বাকি রহিল না, এ কীর্তি কাহাদের। সে শ্রান্তভাবে ধূলি-ধূসরিত বিছানায় শুইয়া পড়িয়া সিগারেট ফুঁকিতে ফুঁকিতে গলা-ছাড়িয়া গান ধরিয়া দিল, ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে!’
তখন কুম্ভীর মিয়াঁ ছাড়া আর প্রায় সকলেই আপন আপন কাজে বা কলেজে চলিয়া গিয়াছে। কাজেই কেহ আসিয়া আর জাহাঙ্গীরের অনুপস্থিতি লইয়া প্রশ্ন করিয়া বিব্রত করিল না।
আসিল কেবল কুম্ভীর মিয়াঁ তাহার ভুঁড়ি আন্দোলিত করিতে করিতে। কিন্তু সে ঘরে ঢুকিয়া জাহাঙ্গীরের মূর্তি দেখিয়া ভয় পাইয়া গেল। জাহাঙ্গীরের এমন ছন্নছাড়া মূর্তি সে যেন আর কখনও দেখেনি। দুঃখে, বেদনায়, বিস্ময়ে সে স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
জাহাঙ্গীর বুঝিতে পারিয়া গম্ভীরভাবে কুম্ভীর মিয়াঁর ভুঁড়িতে তাকিয়া থাপড়ানোর মতো করিয়া থাপ্পড় মারিয়া বলিয়া উঠিল, ‘আমি উলঝলুল! দেখছিস কী হাঁ করে? আমি কি তোর বউ-এর ছোটো বোন?’ – বলিয়াই সিগারেট-কেস আগাইয়া দিয়া হুস করিয়া তাহার মুখের উপর একরাশ ধোঁয়া ছাড়িয়া দিল।
অন্য দিন হইলে কুম্ভীর মিয়াঁ ছাড়িয়া কথা বলিত না। কিন্তু আজ সে সমস্ত অত্যাচার নীরবে সহ্য করিয়া গেল। সে কত কথা জিজ্ঞাসা করিবে, কত কথা জানাইবে বলিয়া ছুটিয়া আসিয়াছিল, কিন্তু সব যেন তাহার ঘুলাইয়া গেল জাহাঙ্গীরের এই চেহারা দেখিয়া। জাহাঙ্গীরকে সে এতদিন ধরিয়া দেখিতেছে, তবু সে যেন বিস্ময়ের দেশের রাজকুমার মায়াবী। উহাকে শুধু দেখিতে হয়, বুঝিবার চেষ্টা করা বৃথা। অথবা সে উন্মাদ।
ভাবিতে ভাবিতে সে নীরবে সিগারেট ধরাইয়া টানিতে লাগিল। জাহাঙ্গীরও কোনো কথা জিজ্ঞাসা করিল না। ঘুমে তখন তাহার চক্ষু যেন জড়াইয়া আসিতেছে। পুলিশের চক্ষে ধুলা দিবার জন্য আজ তিন দিন তিন রাত্রি তাহার নিজের চক্ষুকে নিস্তন্দ্র নির্ঘুম করিয়া রাখিতে হইয়াছে। সে জানিত, সে এতটুকু অবহেলা করিলে তাহার সহিত আরও বহু যুবকের জীবন বিপন্ন হইয়া পড়িবে। সে ক্ষণে ক্ষণে নানা রূপের আড়ালে নিজেকে লুকাইয়া বেড়াইয়াছে। কিন্তু আজ আর যেন সে পারে না।
সবচেয়ে বেশি ভয় হইতে লাগিল তাহার মাতার টেলিগ্রাম দেখিয়া। যদি তিনি কলিকাতায় আসিয়া পড়েন। কিন্তু কেন যে তাহাকে কুমিল্লা যাইবার জন্য এত অনুরোধ, তাহাও সে বুঝিতে পারিতেছিল না। তাহার মা তো জানেন, জমিদারি সংক্রান্ত ব্যাপারে সে হস্তক্ষেপ করিতে নারাজ এবং অপারগ – দুই-ই।
কুম্ভীর মিয়াঁ এক নিশ্বাসে তিন-তিনটা সিগারেটের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনপূর্বক হঠাৎ বলিয়া উঠিল, ‘এই! চা খাবি?’
জাহাঙ্গীর লাফাইয়া উঠিয়া বলিল, ‘দে না ভাই লক্ষ্মীটি।’ বলিয়াই কুম্ভীর মিয়াঁর দাড়িতে হাত বুলাইয়া চুমু খাইল।
কুম্ভীর মিয়াঁ ম্লান হাসি হাসিয়া চলিয়া গেল। একটু পরে চা লইয়া আসিয়া দেখিল, জাহাঙ্গীর শেভ করিতে বসিয়া গিয়াছে।
এক পাশের আধ-কামানো গাল লইয়া জাহাঙ্গীর চায়ের কাপ টানিয়া লইল। চা খাইতে খাইতে বলিল, ‘দেখেছিস মুখের অবস্থা? আজ সাত দিন ক্ষৌরী না করে মুখ যেন ধান-কাটা মাঠের মতো হয়ে উঠেছে!’ বলিয়াই হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিয়া বলিল, ‘হাত বুলোতে মনে হচ্ছিল, যেন কাটা-ধানের নাড়ার ওপর দিয়ে বাবলা গাছ টেনে নিয়ে যাচ্ছে!’ – আবার সেই হাসি!
কুম্ভীর মিয়াঁ এতক্ষণে যেন একটু হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিয়া বলিল, ‘উঃ, এতক্ষণে যেন মেঘ কাটল! ভাগ্যিস চায়ের সৃষ্টি হয়েছিল, নইলে এমন বিপদে বিপদহন্ত্রীর বেশে আর কে দেখা দিত!’ – বলিয়ায় রাস্তার কাঁসারির কংসনিনাদের মতো বাজখাঁই হাসি!
জাহাঙ্গীরও সে হাসিতে হাসিতে যোগদান করিয়া বলিল, ‘যা বলাছিস! চা আর সিগারেট–যেন একসঙ্গে বউ আর শালি!–আঃ কী চা-ই করেছিস! তোর শালির বিয়েচে আমি চালনি দিয়ে জল বয়ে দিব!’ কুম্ভীর মিয়াঁ জাহাঙ্গীরের ঊরুতে এক রাম-থাপ্পড় কষাইয়া বলিয়া উঠিল, ‘তুই কী এমনই সতী!’
জাহাঙ্গীর ঊরুতে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিল, ‘তুই ভীম হতে পারিস, তাই বলে আমি দুর্যোধন নই! এখনই ঊরুভঙ্গ হয়েছিল আর কী!’
কুম্ভীর মিয়াঁ এতক্ষণে যেন কূল পাইয়া বলিয়া উঠিল, ‘আচ্ছা দুর্যোধনের মতো কোন হ্রদে লুকিয়েছিলি বল তো?’
জাহাঙ্গীর কোনো উত্তর দিল না। চা শেষ করিয়া সিগারেট টানিতে টানিতে দাড়ি কামাইতে লাগিল।
কুম্ভীর মিঁয়া বলিয়া উঠিল, ‘আরে তোমায় খবর দিতে ভুলে গেছি, তোমাদের দেওয়ানজি এসেছেন যে!’
জাহাঙ্গীর চমকিয়া উঠিতেই খানিকটা গাল কাটিয়া গেল। ক্ষতস্থানটা চাপিয়া ধরিয়া জাহাঙ্গীর বলিয়া উঠিল, ‘কোথায় তিনি? কখন এসেছেন?’
কুম্ভীর মিঁয়া বিস্মিতনেত্রে জাহাঙ্গীরের দিকে তাকাইয়া থাকিয়া বলিল, ‘তা তো জানিনে। তবে তিনি কাল দু-তিনবার এসেছিলেন তোমার খোঁজ করতে। আজও সকালে একবার এসেছিলেন যেন। যাক, তোর চিন্তার কিছু নেই। তিনি নিজেই আজ আর একবার অন্তত আসবেন।’
জাহাঙ্গীর কেমন যেন অন্যমনস্ক হইয়া গেল, এবং একটু চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়া নিঃশব্দে দাড়ি কামাইয়া স্নান করিতে চলিয়া গেল। স্নান করিয়া ফিরিয়া সে শুইয়া পড়িয়া বলিল , ‘আমি এখন একটু ঘুমুব! শরীরটা কেমন খারাপ করছে যেন। দেওয়ানজি এলে আমায় উঠিয়ে দিস।’
জাহাঙ্গীরের যখন ঘুম ভাঙিল, তখন বেলা গড়াইয়া পড়িয়াছে। ঘুম ভাঙিতেই দেখিল সামনে চেয়ারে বসিয়া দেওয়ানজি। জাহাঙ্গীর উঠিয়া শশব্যস্তে তাঁহার পায়ের ধুলা লইল।
দেওয়ানজি তাহাকে একেবারে বুকে চাপিয়া ধরিয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘বাবা, বেগম মা অস্থির হয়ে উঠেছেন। তুমি এখনই চলো। আজ দু-দিন তিনি না খেয়ে আছেন।’
জাহাঙ্গীর কুঁজো হইতে জল গড়াইয়া লইয়া চোখে মুখে দিতে দিতে বিস্ময়ান্বিত কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, ‘মা? মাও এসেছেন নাকি?’
দেওয়ানজি বলিলেন, ‘হাঁ বাবা, তোমার কোনো খবর না পেয়ে অসুখ-বিসুখ হয়ছে মনে করে কাল আমরা এসেছি। এসে অবধি তোমায় খুঁজছি। তুমি সাত দিন ধরে এখানে নেই শুনে তিনি সেই যে শয্যা নিয়েছেন আর ওঠেননি। কেউ এতটুকু পানি মুখে দিতে পারেনি!’
জাহাঙ্গীর জামা পরিতে পরিতে ক্লান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কোন বাড়িতে উঠেছেন এসে?’
দেওয়ানজি উঠিতে উঠিতে বলিলেন, ‘লোয়ার সার্কুলার রোডের বাড়িতে। অন্য বাড়ি তো সব ভাড়া দেওয়া হয়ে গেছে। ওটাই শুধু খালি হয়েছে মাত্র সেদিন!’- বলিয়াই একটু থামিয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘তুমি তো কোনো খবরই রাখ না বাবা। নিজের বাড়িঘরগুলোরও না।’
জাহাঙ্গীর উচ্চবাচ্য না করিয়া বাহির হইয়া পড়িল।
দেওয়ানজি নামিতে নামিতে দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া বলিলেন, ‘কী চেহারা হয়েছে তোমার, দেখো তো! কে বলবে নওয়াব বাড়ির ছেলে! যেন পথের ভিখিরি!’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, ‘আমি তো সত্যই ভিখিরি দেওয়ান সাহেব! বাপের জমিদারি, ও তো আমি অর্জন করিনি!’
জাহাঙ্গীরের চোখে-মুখে এক অব্যক্ত-ব্যথার ছাপ ফুটিয়া উঠিল। দেওয়ানজি কিছু বুঝিতে না পারিয়া বিমূঢ়ের মতো তাকাইয়া থাকিলেন।
মোটরে যাইতে যাইতে জাহাঙ্গীর সাহস পাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘আচ্ছা দেওয়ান সাহেব, খবর সব ভালো তো? এত ঘন ঘন টেলিগ্রাম করা কেন বলুন তো! এ অকর্মণ্যকে নিয়ে কেন এ অনর্থক টানাটানি?’– তাহার কথায় সুরে তিক্ত শ্রান্তি ফুটিয়া উঠিল।
দেওয়ানজি স্টেট চালাইয়া ঝানু হইয়া গিয়াছেন। কিন্তু মানুষের বিশেষ করিয়া আজকালকার যুবকদের অন্তর লইয়া কখনও তাঁহার মাথাব্যথা হয়ও নাই, আর চেষ্টা করিয়াও ওর কূল পান না। তবু তাঁহার হঠাৎ মনে হইল তরুণ যুবক হয়তো-বা কোথাও লভ-টভ করিয়া বসিয়াছে। তিনি মনে মনে এ রোগের ওষুধের কথা চিন্তা করিয়া প্রসন্ন হইয়া উঠিলেন।
বলিয়া উঠিলেন, ‘খবর ভালোই বাবা। শুধু আমাদের বেগম-মা জিদ ধরেছেন, তিনি মক্কা যাবেন হজ করতে। আর এক হপ্তার মধ্যেই জাহাজ ছাড়বে। তিনি তোমায় সমস্ত বুঝিয়ে দিয়ে যেতে চান । তাই এত তাড়াতাড়ি!’
জাহাঙ্গীর আর শুনিতে পারিল না। কেমন যেন এক অজানা আতঙ্কে তাহার সারা দেহ মন শিহরিয়া উঠিল। অসহায়ভাবে মোটরে হেলান দিয়া শুইয়া পড়িয়া বলিল, ‘দেওয়ান সাহেব, এখন থাক, মার কাছে গিয়েই সব শুনব!’