কুহেলিকা – ১১
জাহাঙ্গীরের জীবনে এই প্রথম গোরুর গাড়ির অভিজ্ঞতা।
জাহাঙ্গীর যখন বলিল, সে কিছুতেই তাহার বোঝা আর এক জন মানুষের অর্থাৎ কুলির মাথায় চড়াইয়া দিয়া তাহার অবমাননা করিবে না, বরং সে তাহার এই আভিজাত্যের অভিশাপ নিজেরই মাথায় তুলিয়া বাহির হইয়া যাইবে, তখন হারুণ একরকম জোর করিয়াই তাহার জন্য গোরুর গাড়ির ব্যবস্থা করিয়া দিল।
গোরুর গাড়িতে চড়িতে জাহাঙ্গীরের শহুরে সংস্কারে একটু বাধিলেও সে আর আপত্তি করিল না। একটু কৌতূহল ও যে হইল না, এমন নয়!
হারুণ হাসিয়া বলিয়াছিল, ‘আশা করি গো-জাতির প্রতি তোমার মানবত্ববোদ আজও প্রবল হয়ে ওঠেনি!’
জাহাঙ্গীরও হাসিয়া বলিয়াছিল, ‘না বন্ধু! বাঙালির বুদ্ধি আজও সেরকম আচ্ছন্ন হয়ে পড়েনি। ওরা হনুমান ও গোরুর পূজা করেনি কখনও! ওই দুটো জীব বাংলার বাইরেরই দেবতা হয়ে আছেন!…’
গোরুর গাড়িতে চড়িয়া ক্রোশ-খানেক যাইবার পর জাহাঙ্গীরের কৌতূহল ও উৎসাহ একেবারে জল হইয়া গেল। অসমান গ্রাম্যপথে ঘন্টায় প্রায় এক মাইল গতিতে সনাতন গো-যান যে বিচিত্র শব্দ করিয়া ধূলি-পটল উড়াইয়া চলিতেছিল, তাহাতে জাহাঙ্গীরের ধৈর্য ধরিয়া বসিয়া থাকা একপ্রকার অসহ্য হইয়া উঠিল। অনবরত ঝাঁকুনি খাইতে খাইতে তাহার মনে পড়িল বহু পূর্বে তাহার একবার ডেঙ্গু জ্বর হইয়াছিল, তাহাতে যে গা-হাত-পায়ের ব্যথা হইয়াছিল, সে বোধ হয় ইহার কাছে কিছুই নয়। সে আর থাকিতে না পারিয়া নামিয়া পড়াতে বেচারা গাড়োয়ান বিনয়-নম্রস্বরে বলিয়া উঠিল, ‘জি, নামলেন কেনে?’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘তোমার “জি” সাধ করে নামলেন না বাপু, তোমার গাড়ি তাকে নামিয়ে তবে ছাড়লে।’
গাড়োয়ান গাড়ি থামাইয়া বলিল, ‘জি, গাড়িতে উঠে বসুন, আমি একুটুকু চাঁওড় করে হাঁকিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। এই শালার গোরু হুজুর একটু বেয়াড়া, তাইতে ভয় করে – কোথায় গোবোদে ফেলিয়ে দিবে। নইলে দাঁদাড়ে নিয়ে যেতুম!’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, ‘তুমি “দাঁদাড়ে” নিয়ে চলো বাপু, আমি খানিকটা হেঁটে যাই!’ বলিয়াই গাড়ির পিছনে পিছনে আস্তে আস্তে হাঁটিয়া চলিল।
ধূলিধূসরিত জনবিরল গ্রাম্যপথ। দুই পাশে মাঠ ধু ধু করিতেছে। যেন উদাসিনী বিরহিণী। দূরে ছায়ানিবিড়পল্লি – ঝিল্লির ঘুমপাড়ানিয়া গানে যেন মায়ের কোলে শিশুর মতো ঘুমাইতেছে। জাহাঙ্গীরের মন কেমন যেন উদাস হইয়া গেল।
পথ চলিতে চলিতে তাহার মনে হইল, সে যেন উদাস বাউল , না-জানার সন্ধানে এই পথে পথে গান গাহিয়া ফিরিতে আসিয়াছে। যাহারা তাহার পথে আসিতেছে পরিচিতের রূপে তাহারা তাহার কেহ নয়। যে উদাসিনীর অভিসারে সে চলিয়াছে, সে এই পল্লিবাটের না-জানা উদাসিনী। তাহাকে অনুভব করা যায়, রূপের সীমায় সে অসীমা ধরা দেয় না…
এমন সময় গাড়ির গো-বেচারি গো-যুগলকে গাড়োয়ান এমন ভাষায় সম্ভাষণ করিয়া চেঁচাইয়া উঠিল যাহাতে জাহাঙ্গীরের স্বপ্ন এক নিমিষে টুটিয়া গেল। হাসিতে হাসিতে সে পথের ধারেই ধুলার উপর বসিয়া পড়িল। একটু পরে পথ চলিতে চলিতে তাহার মনে হইল, কেন এ দেশে এত বাউল এত চারণ এত কবির সৃষ্টি হইল। এই উদাস, তপস্বীর ধ্যানলোকের মতো শান্ত নির্জন ঘাটমাঠ যেন মানুষকে কেবলই তাহার আপন অতলতার মাঝে ডুব দিতে ইঙ্গিত করে। এ তেপান্তরে পথের মায়া যেন কেবলই ঘর ভুলায়, একটানা পুরবি সুরের মতো করুণ বিচ্ছেদ-ব্যথায় মনকে ভরিয়া তোলে, গৃহীর উত্তরীয় বাউলের গৈরিকে রাঙিয়া উঠে!…
এতক্ষণ যতবার তাহার ভূণীকে মনে পড়িয়াছে, ততবারই তাহার মন অবিশ্বাসের কালিতে কালো হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু এই জনবিরল উদাস প্রান্তরে আসন্ন সন্ধ্যায় চলিতে চলিতে তাহার মনে হইল, এমনই একটি শান্ত পল্লিপ্রান্তে ছায়া-সুশীতল কুটির রচনা করিয়া তাহাকে লইয়া সে স্বর্গ রচনা করিতে পারে। কিন্তু তাহা হইতে পারে না! তাহার পিতার পাপ তাহার রক্তকে কলুষিত করিয়াছে। যে-কোনো মুহূর্তে সে তাহার পিতার মতোই ব্যভিচারী হইয়া উঠিতে পারে! সে জানে, তাহার রক্তের চঞ্চলতাকে, তাহার ভীষণ উদ্দাম প্রবৃত্তিকে সংযত করিতে তাহার কত বেগ পাইতে হইয়াছে। তাহার স্বর, তাহার অবয়ব, তাহার রক্ত সমস্তই ফররোখ সাহেবের। উহার মধ্যে যেটুকু জাহাঙ্গীর, তাহা এই পশুর কাছে টিকিতে পারে না। পাপই যদি করিতে হয়, পশুর কবলেই যদি আত্মাহুতি দিতে হয়, তবে সে একাই দিবে, এ পাপের সাথি অন্যকে করিবে না!
তাহার পিতার কথা ভাবিতে ভাবিতে হঠাৎ তাহার মাথায় যেন খুন চাপিয়া গেল। বুকের কাছে লুকানো রিভলভারটা একটানে বাহির করিয়া নিজের ললাটের কাছে ধরিল। আবার কী মনে করিয়া সেটাকে যথাস্থানে রাখিয়া দিয়া গোরুর গাড়িকে পিছনে ফেলিয়া দৃপ্তপদে পথ চলিতে লাগিল।
যাইবার সময় গাড়োয়ানের দিকে রোষ-কষায়িত দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিয়া গেল, ‘শালা, তুমি যদি তাড়াতাড়ি গাড়ি না চালাও, তাহলে এই বনের মধ্যে তোমায় মেরে পুঁতে ফেলব!’
গাড়োয়ান বেচারা ভয়ে অভিভূত হইয়া প্রাণপণে জাহাঙ্গীরের সাথে গাড়ি চালাইবার চেষ্টা করিতে লাগিল! জাহাঙ্গীরের রক্তবর্ণ চোখ-মুখ দেখিয়া মনে হইল, সে ইচ্ছা করিলে সত্যসত্যই তাহাকে মারিয়া ফেলিতে পারে!…
শিউড়ি যখন তাহারা আসিয়া পৌঁছিল, তখন রাত্রি প্রায় দ্বিপ্রহর হইয়া গিয়াছে। গাড়োয়ান কাঁদো-কাঁদো স্বরে বলিল, ‘হুজুর, বলদ দুটো আর বাঁচবে না, মর মর হয়ে গিয়েছে হুজুর! সারা রাস্তা আমি মেরে দৌড়িয়ে নিয়ে এসেছি হুজুর!’
জাহাঙ্গীর একটিও কথা না বলিয়া একটা পাঁচ টাকার নোট গাড়োয়ানের হাতে দিয়া গাড়ি হইতে সমস্ত জিনিস নিজে বহিয়া প্ল্যাটফর্মে আনিল। গাড়োয়ান এই আশ্চর্য লোকটির কোনো কিছুই যেন বুঝিতে পারিতেছিল না। সে আর গোলমাল না করিয়া চলিয়া যাইতেছিল। হঠাৎ জাহাঙ্গীর তাহাকে ডাকিয়া বলিল, ‘এই, শোন!’ বলিয়াই সে ল্যাম্পপোস্টের কাছে দাঁড়াইয়া চিঠি লিখিতে লাগিল।
চিঠি লেখা শেষ করিয়া গাড়োয়ানকে বলিল, ‘দেখ, এই চিঠি যদি ভূণীকে লুকিয়ে দিতে পারিস – তোকে দশ টাকা বকশিশ দেব। পারবি?’
গাড়োয়ান হতভম্ব লইয়া জাহাঙ্গীরের মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল।
জাহাঙ্গীর তাড়া দিয়া বলিয়া উঠিল, ‘শালা হাঁদারাম! হাঁ করে তাকিয়ে আছিস কী? ভূণীকে চিনিস? হারুণের বোন?’
গাড়োয়ান কম্পিতকণ্ঠে বলিল, ‘হুজুর উয়াকে চিনব না? এই তো সেদিন আমাদের কাছে ড্যাংডিঙিয়ে বড়ো হয়ে উঠল!’
জাহাঙ্গীর তাহার কাছে গিয়া কণ্ঠস্বর কমাইয়া বলিল, ‘তাকেই পৌঁছে দিতে হবে এই চিঠিটা, বুঝলি? তোর মেয়ে-টেয়ে কেউ নেই বাড়িতে? তার হাত দিয়ে… বুঝলি এখন?’
গাড়োয়ান একটু কী যেন ভাবিল, তাহার পর বলিল, ‘পারব হুজুর। দেন!’
জাহাঙ্গীর চিঠিটা ও দশ টাকার নোট তাহার হাতে দিয়া বলিল, ‘কাল সন্ধ্যায় আমায় এইখানে পাবি এসে। কী উত্তর দেয়, নিয়ে আসবি। তা হলে আরও দশ টাকা বকশিশ, বুঝলি?’
গাড়োয়ান আনন্দ-গদগদ কণ্ঠে বলিল, ‘হুজুর মা বাপ! কালই সনঝেবেলা আমি হাজির হব এসে। হুজুর এইখেনেই থাকবেন তো?’
জাহাঙ্গীর ‘হুঁ’ বলিয়া অন্যমনস্কভাবে স্টেশনের ভিতরে চলিয়া গেল।
ওয়েটিং রুমে ঢুকিয়াই সে একেবারে চমকিয়া উঠিল। সেখানে ইজিচেয়ারে শুইয়া সাহেবি পোশাকপরা এক জন লোক নিশ্চিন্ত আরামে সিগার ফুঁকিতেছিল। জাহাঙ্গীর লোকটিকে আর একবার ভালো করিয়া নিরীক্ষণ করিল, তাহার পর কাছে গিয়া বলিল, ‘প্রমতদা এখানে?’
প্রমত্তও চমকিয়া উঠিয়াছিল। জাহাঙ্গীরকে দেখিয়া বলিয়া উঠিল, ‘চুপ! এখানে প্রমতদা বলে কেউ আসেনি!’ বলিয়াই চতুর্দিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিল, ‘বস এইখানে। তার পর তুই এখানে কোথা?’
জাহাঙ্গীর সমস্ত বলিল।
প্রমত্ত সমস্ত শুনিয়া হাসিয়া বলিল, ‘বেশ বেড়াচ্ছিস তা হলে উপন্যাসের নায়ক হয়ে! কিন্তু ভালো করিসনি জাহাঙ্গীর তুই এখানে এসে। যাক, তুই আজই কোলকাতা চলে যা। একটু পরেই ট্রেন আসবে!’
জাহাঙ্গীর বিস্মিত হইয়া বলিল, ‘আর আপনি?’
প্রমত্ত বলিল, ‘আবার প্রশ্ন? আমার অন্য জায়গায় কাজ আছে।’
কী যে কাজ জাহাঙ্গীরের তাহা বুঝিতে বাকি রহিল না। ইহা লইয়া আর কিছু প্রশ্ন যে সে করিতে পারে না, তাহাও সে জানে। তবু সে একটু ঘুরাইয়া বলিল, ‘আমাকে যে কাল পর্যন্ত থাকতে হচ্ছে প্রমতদা!’ বলিয়াই সে হাসিয়া বলিল, ‘থুড়ি, মিস্টার চাকলাদার!’
প্রমত্ত হাসিয়া বলিল, ‘আমার সুটকেসের লেখা নাম পড়ে ফেলেছিস বুঝি? কিন্তু দেয়ালগুলোরও চোখকান আছে রে! একটু সাবধানে কথাবার্তা বলবি। সে যাক, তুই এখানে থাকবি কেন, বল তো! আমার জন্য তোর কোনো চিন্তা নেই।’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘আপনার নেই, কিন্তু আমাদের তো থাকা উচিত। তা ছাড়া’ – বলিয়াই একটু থামিয়া চক্ষু নত করিয়া বলিল, ‘কাল চিঠির উত্তর আসবে আমার!’
প্রমত্ত হাসিল না। জাহাঙ্গীরের দিকে তাকাইয়া অনেকক্ষণ কী ভাবিল। তাহার পর আস্তে আস্তে বলিল, ‘তবে তুই থাক। কিন্তু খুব সাবধান। পিছনে টিকটিকি লেগেছে! অবশ্য, তোর ভাবনা নেই। কেননা মুসলমান যুবককে তারা এখনও সন্দেহ করেনি। সাবধানের মার নেই।’
প্রমত্ত আবার যেন কী ভাবিতে লাগিল।
একটু পরে সে বলিয়া উঠিল, ‘দেখ জাহাঙ্গীর, তোর আচকান পায়জামা আছে সঙ্গে?’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘আছে।’
প্রমত্ত বলিল, ‘এক্ষুনি নিয়ে আয়!’ বলিয়াই ঘড়ির দিকে তাকাইয়া বলিল, ‘আর বেশি সময় নেই! যা, শিগগির আন!’
জাহাঙ্গীর তাহার আচকান পায়জামা আনিলে প্রমত্ত বাথরুমে ঢুকিয়া একটু পরে যখন তাহা পরিয়া বাহির হইয়া আসিল, তখন জাহাঙ্গীর একটু জোরে হাসিয়া বলিল, ‘আদাব আরজ মউলবি সাব! আপকে ইসমে শরিফ!’
প্রমত্ত হাসিয়া বলিল, ‘কেফায়েতুল্লা।’ তার পর নিম্নকন্ঠে বলিল, ‘আমি যাচ্ছি এখনই! কেমন যেন গন্ধ পাচ্ছি রে! তুই এইখানেই ঘুমো। দরকার হলে ডাকব!’ বলিয়াই প্রমত্ত টার্কি-ফেজ মাথায় দিয়া ছড়ি ঘুরাইতে ঘুরাইতে বাহির হইয়া গেল!
জাহাঙ্গীর সেইখানে ইজিচেয়ারে শুইয়া শুইয়া আকাশ-পাতাল ভাবিতে ভাবিতে ঘুমাইয়া পড়িল।
রাত্রি প্রায় তিনটার সময় সে কাহার ঠেলায় জাগিয়া উঠিয়া দেখিল, সামনেই একজন ইউরোপিয়ান সাহেব। তাহার পিছনে তিন-চার জন বাঙালি বাবু।
সে একটু বিরক্ত হইয়াই ইংরাজিতে বলিল, ‘আপনি কী চান? এরূপভাবে জাগাবার রীতি ভদ্রতা-বিরুদ্ধ!’
সাহেব একটু থতমত খাইয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া বলিল, ‘মাপ করবেন, আমি আপনাকে আমার বন্ধু মি. চাকলাদার মনে করেছিলুম। তিনি বোধ হয় এখানেই ছিলেন, বলতে পারেন , তিনি কোথায় গেছেন?’
জাহাঙ্গীর তেমনি বিরক্তির সুরে বলিল, ‘জানি না কে আপনার চাকলাদার! আমি কাউকেই দেখিনি এখানে।’
সাহেব আবার ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া চলিয়া গেল।
জাহাঙ্গীরের বুঝিতে বাকি রহিল না ইনি কোন সাহেব!
এক অজানা আশঙ্কায় তাহার বুক কাঁপিতে লাগিল। সে আর একবার পরীক্ষা করিয়া দেখিল, তাহার বুকের কাছে তাহার শ্রেষ্ঠ বন্ধু – তাহার আত্মরক্ষার অস্ত্র আছে কি না।
প্রমত্তকে সে জানিত। সে জানে, ইহাদের চক্ষে ধুলা দিতে এক জাহাঙ্গীরই যথেষ্ট, প্রমত্তের ন্যায় সেনানীর দরকার পড়ে না। তবু তাহার কেমন যেন ভয় করিতে লাগিল!
হঠাৎ অন্য দ্বার দিয়া ঢুকিয়া প্রমত্ত বলিয়া উঠিল ‘আসসালামো আলায়কুম! ক্যা মিয়াঁসাব শ্বশরুয়া চলা গিয়া?’
জাহাঙ্গীর লাফাইয়া উঠিয়া বলিল, ‘জি হাঁ! মগর আপ ইস ওক্ত ক্যেঁও’ – বলিয়াই এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করিয়া গলা খাটো করিয়া বলিল, ‘আপনি সরে পড়ুন প্রমতদা, স্যাঙাতরা নিশ্চয় এইখানেই কোথাও আছে!’
প্রমত্ত পরম নিশ্চিন্তভাবে চেয়ারে বসিয়া বলিল, ‘তোকে সে ভাবনা ভাবতে হবে না। তুই চল দেখি আমার সাথে, এখখুনি এক জায়গায় যেতে হবে।’
জাহাঙ্গীর কোনো প্রশ্ন না করিয়া মিলিটারি কায়দায় উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল ‘রেডি স্যার।’
সমস্ত জিনিসপত্র স্টেশন মাস্টারের হেফাজতে রাখিয়া সে বাহিরে আসিয়া দেখিল, একখানা মোটরের সম্মুখে প্রমত্ত সন্ন্যাসীর সাজে সাজিয়া দাঁড়াইয়া আছে। দুইজনে মোটরে উঠিয়া বসিলে মোটর বিদ্যুদ্বেগে ছুটিয়া চলিল।
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘কী করতে হবে দাদা আমায়, জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?’
প্রমত্ত হাসিয়া বলিল, ‘আর কেউ হলে বলতাম না, আমি তোকে জানি বলেই বলছি। একটু দূরেই কোনো গ্রামে যাচ্ছি। সেখানে আমাদের কিছু অস্ত্রশস্ত্র আছে। পুলিশ তা টের পেয়েছে বলে খবর পেয়েছি। আজ ভোরের মধ্যেই তা সরিয়ে আর কোথাও রেখে যেতে হবে – আমার ওপর বজ্রপাণির এ হুকুম।’
জাহাঙ্গীর কিছু প্রশ্ন করিল না। উত্তেজনা উৎসাহে তাহার রক্ত গরম হইয়া উঠিল। হঠাৎ সে প্রশ্ন করিয়া বসিল, ‘রাস্তায় যদি পুলিশের সঙ্গে দেখা হয়?’
প্রমত্ত উত্তর দিল না। মাঝে মাঝে উঁকি দিয়া রাস্তার দিকে দেখিতে লাগিল। হঠাৎ এক জায়গায় গাড়ি থামাইতে বলিয়া একটি ক্ষুদ্র শিস দিল। দেখিতে দেখিতে অন্ধকার ভেদ করিয়া চার পাঁচজন লোক আসিয়া নিঃশব্দে মোটরে বসিতেই আবার মোটর ছুটিতে লাগিল।
ঘণ্টাখানেক পরে তাহারা একটি গ্রামের ভিতর প্রবেশ করিয়া বাঁশবন-ঘেরা একটি ক্ষুদ্র মেটে ঘরের সম্মুখে আসিয়া থামিল। জাহাঙ্গীর সেই স্বল্প তারকালোকেই দেখিতে পাইল, গাড়ি থামিবামাত্র একটি স্ত্রীলোক দুয়ারে আসিয়া দাঁড়াইল। প্রমত্ত গিয়া তাঁহার পায়ের ধুলা লইল।
প্রমত্তের ইঙ্গিতে সকলে নামিয়া পড়িল এবং সকলের সাথে জাহাঙ্গীরও মহিলাটিকে প্রণাম করিল, কিন্তু সে যেন দায়ে পড়িয়া।
ঘরের ভিতরে গিয়া স্বল্প দীপালোকেই জাহাঙ্গীর যে মহীয়সী জ্যোতির্ময়ী মূর্তি দেখিল, তাহাতে এই নারীকে প্রণাম করিতে গিয়া তাহার মন যে-টুকু বিস্বাদ হইয়া উঠিয়াছিল, তাহার জন্য নিজেকে ধিক্কার না দিয়া পারিল না।
মহিলার বয়স ছত্রিশ সাঁইত্রিশের বেশি হইবে না। পরনে শুধু একখানি পরিষ্কার সাদা ধুতি। যেন গায়ের রং-এর সাথে মিশিয়া গিয়াছে। ঘাড় পর্যন্ত ছোটো করিয়া কাটা চুল – অনেকটা বাবরি চুলের মতো। তাহারই কতকগুলো ললাটে ও মুখের আশেপাশে আসিয়া পড়িয়াছে। বড়ো বড়ো চক্ষু, কিন্তু তাহা যেন একটু অতিরিক্ত প্রখর, সহজে চোখের দিকে চাওয়া যায় না। চোখ যেন ঝলসিয়া যায়। মুখ পুরুষের মতো দৃপ্ত, মহিমোজ্জ্বল!
জাহাঙ্গীর মনে মনে বলিল, ‘নারী যদি নাগিনি হয়, তুমি নাগেশ্বরী।’
জাহাঙ্গীরের চিন্তায় বাধা পড়িল। প্রমত্ত নিম্নস্বরে বলিল, ‘এদের সব কে বুঝি চেন না জয়তীদি?’
জাহাঙ্গীর মনে মনে বলিল, ‘তুমি সত্যই জয়তী দেবী।’ জীবনে সে বুঝি এই প্রথম নারীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখিল। জয়তী দেবী সকলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখিতে দেখিতে জাহাঙ্গীর দিকে তাকাইয়া বলিলেন, ‘এ ছেলেটিকে তো আগে দেখিনি!’
প্রমত্ত হাসিয়া বলিল, ‘এ পথ-ভোলা ছেলে দিদি। এ আমাদের গোষ্ঠীর নয়।’
প্রমত্তের এই কথায় অন্যান্য সকলে চঞ্চল হইয়া উঠিল। শুধু জয়তী দেবী বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রে জাহাঙ্গীরকে দেখিতে লাগিলেন! হঠাৎ তিনি প্রশ্ন করিয়া বসিলেন ‘তোমার মা বেঁচে আছেন?’
জাহাঙ্গীর উত্তর করিল, ‘আছেন।’ জয়তী যেন আরও আশ্চর্য হইয়া তাহাকে দেখিতে লাগিলেন।
প্রমত্ত হাসিয়া বলিল, ‘দিদি বোধ হয় ভাবছ, মা থাকতে ওর অমন লক্ষ্মীছাড়ার মতো চেহারা কেন, না? সত্যিই ও লক্ষ্মীছাড়া। হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে পেরেছে বলেই ওকে দলে নিয়েছি।’
জয়তীর প্রখর চক্ষু স্নেহে কোমল হইয়া আসিল। স্নেহসিক্ত কণ্ঠে তিনি বলিয়া উঠিলেন, ‘তুমি আমায় দিদি না বলে মাসিমা বলে ডেকো, কেমন?’ বলিয়াই জয়তী অন্য ঘরে চলিয়া গেলেন।
জাহাঙ্গীর ব্যতীত আর সকলেরই চক্ষু জলে পুরিয়া উঠিল! জয়তীর এই অনুরোধের অর্থ বুঝিতে তাহাদের বাকি রহিল না।
জয়তীর ছোটো বোন সন্তান-প্রসব করিয়াই মারা যায়। সেই ছেলেকে জয়তী লইয়া আসিয়া মানুষ করেন। নাম রাখেন পিনাকপাণি। সকলে ‘পিনাকী’ বলিয়া ডাকিত। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলিয়া গত বৎসর তাহার ফাঁসি হইয়া গিয়াছে! ফাঁসির মঞ্চেও সে জীবনের জয়গান গাহিয়াছে!
যেদিন পিনাকীর ফাঁসি হয়, সেইদিনই জয়তী গঙ্গাস্নান করিয়া রক্তবস্ত্র পরিধান করিয়া স্বয়ং বজ্রপাণির কাছে স্বদেশি মন্ত্রের দীক্ষা গ্রহণ করেন। আজ জয়তী বিপ্লবীদের শক্তি-স্বরুপা হইয়া দাঁড়াইয়াছেন।
জয়তীর ওই উক্তির পর সকলে এমনকি প্রমত্ত পর্যন্ত বিস্মিত হইয়া দেখিল, জাহাঙ্গীরের সঙ্গে পিনাকীর বেশ খানিকটা সাদৃশ্য আছে।
পিনাকীকে বিপ্লব-সংঘে সকলেই অতিরিক্ত স্নেহ করিত। সে ছিল তাহাদের দলের বয়োকনিষ্ঠদের অন্যতম। তাহা ছাড়া, সে যাইত সর্বাপেক্ষা দুঃসাহসের কাজে সর্বাগ্রে।
মৃত্যুকে সে রাঙা উত্তরীয়ের মতো সারা গায়ে জড়াইয়া ধরিতে চাহিত!
তাহার ফাঁসির দিন বজ্রপাণি হইতে আরম্ভ করিয়া বিপ্লবীদের প্রত্যেকে শিশুর মতো রোদন করিয়াছিল।
ফাঁসির পূর্বে ম্যাজিস্ট্রেট যখন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, ‘তুমি কি কাউকে দেখতে চাও?’
পিনাকী হাসিয়া বলিয়াছিল, ‘চাই, কিন্তু তুমি তা দেখাতে পারবে না!’
ম্যাজিস্ট্রেট তার শিশুর মতো মুখের পানে তাকাইয়া জোরের সঙ্গে বলিয়াছিল, ‘নিশ্চয়ই পারব! বলো কাকে দেখতে চাও?’
পিনাকী তেমনি মধুর হাসিতে মুখ আলো করিয়া বলিয়াছিল, ‘আমি চাই ভারতের স্বাধীনতা দেখতে! পারবে দেখাতে?’
ম্যাজিস্ট্রেট তৎক্ষণাৎ তাহার মাথার টুপি খুলিয়া বালককে অভিবাদন করিয়া অশ্রুপূর্ণনেত্রে বলিয়াছিল, ‘আমি তোমায় প্রণাম করি বালক। মৃত্যুমঞ্চই তোমার মতো বীরের মৃত্যুঞ্জয়ী সম্মান। তোমার মতো বীরের বন্দনা করবার সম্বল জীবনের নাই।’
আজ জয়তী দেবীর জাহাঙ্গীরের প্রতি এই অদ্ভুত অনুরোধ শুনিয়া সকলের সেই সব কথাই স্মরণ হইতে লাগিল!
একটু পরেই জয়তী আসিয়া বলিলেন, ‘তোমরা তোমাদের কাজ করো গিয়ে, আমি একটু ওর সঙ্গে আলাপ করি।’
প্রমত্ত অন্যান্য ছেলেদের লইয়া চলিয়া গেল। জাহাঙ্গীর একা কেমন একটু অস্বস্তি অনুভব করিতে লাগিল।
জয়তী কাছে আসিয়া বসিয়া বলিলেন, ‘তোমায় পিনাকী বলে ডাকব, কেমন?’ –কণ্ঠ তাঁর যেন ভাঙিয়া আসিল।
জাহাঙ্গীরের চক্ষে এতক্ষণে যেন এই রহস্যের কুহেলিকা কাটিয়া গেল। এখন সে বুঝিতে পারিল, কেন জয়তী দেবী তাহাকে মাসিমা বলিতে অনুরোধ করিলেন। তাহারও চক্ষু জলে ভরিয়া উঠিল। দেখিতে দেখিতে তাহার দুই চক্ষু বহিয়া টসটস করিয়া জল গড়াইয়া পড়িতে লাগিল। হঠাৎ সে বলিল, ‘তুমি কি বীর পিনাকীর মাসিমা?’
জাহাঙ্গীরের এই তুমি সম্ভাষণে এমন পাষাণ-প্রতিমার মতো কঠিন জয়তীও যেন ভাঙিয়া পড়িলেন। জাহাঙ্গীরের শিরশ্চুম্বন করিয়া বলিলেন, ‘হাঁ বাবা ‘আমিই সে দুর্ভাগিনি।’
তাহার পর একটু থামিয়া বলিলেন, ‘তোকে দেখতে অনেকটা পিনাকীর মতো।’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘তুমি দুর্ভাগিনি নও মাসিমা, ভাগ্যবতী। কিন্তু সে যাক, তোমায় না ভেবে ছুঁয়ে ফেলেছি, তোমায় হয়তো আবার স্নান করতে হবে!’
জয়তী বেদনায় নীল হইয়া বলিলেন, ‘ও কথা বলিসনে বাবা, ও কথা শুনলেও পাপ হয় মানুষকে মানুষ ছুঁলে স্নান করতে হয়, মানুষের এত বড়ো অবমাননাকর শাস্ত্র সৃষ্টি হয়েছিল বলেই আমাদের এই দুর্দশা। জানিনে তুই কী জাত, কিন্তু তুই যদি হাড়ি-ডোমও হতিস তা হলেও তোকে ছুঁতে এতটুকু ইতস্তত হত না আমার! ওরে, জন্মটা তো দৈব। যেদিন আরেকজনকে আরেকজাতের ভেবে ঘৃণা করব, সেই দিনই আমার স্বাধীনতা মন্ত্র আমার কাছে ব্যর্থ হয়ে যাবে! তা ছাড়া, তোরা তো আগুনের শিখা, তোদের ছোঁয়ায় সেসব অশুচি শুচি হয়ে ওঠে বাবা!’
জাহাঙ্গীর অবাক হইয়া জয়তীর মুখের পানে তাকাইয়া বলিল, ‘এই যদি আমাদের অন্তরের কথা হয় মাসিমা, তা হলে এই আমাদের সবচেয়ে বড়ো মন্ত্র। আর শুধু এই মন্ত্রের জোরেই বিনা রক্তপাতে আমরা ভারত স্বাধীন করতে পারব।’
এমন সময় অন্য ঘর হইতে জয়তীর একমাত্র কন্যা ঘুম হইতে জাগিয়া ‘মা মা’ বলিয়া ডাকিতে লাগিল।
জয়তী কন্যাকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘এইখানে উঠে আয় চম্পা, তোর একজন নতুন দাদা এসেছে।’
চম্পা আলুথালু বেশে তাহার মাতার নিকট আসিয়া বলিল, ‘কই মা?’ বলিয়াই জাহাঙ্গীরকে দেখিয়া একটু থতমত খাইয়া গেল।
জয়তী মলিন হাসি হাসিয়া বলিলেন, ‘ওকে অনেকটা পিনাকীর মতো দেখাচ্ছে, না?’
পিনাকীর নাম করিতেই চম্পার দুই চোখে অশ্রুর বান ডাকিল। সে সেই অশ্রুসিক্ত চক্ষু দিয়া জাহাঙ্গীরকে দেখিতে দিখিতে হঠাৎ তাহার কাছে আসিয়া প্রণাম করিয়া বলিল, ‘দাদাকে কী বলে ডাকব মা?’
জয়তী হাসিয়া ফেলিয়া বলিলেন, ‘দাদাকে আবার কী বলে ডাকবি? দাদাই বলবি!’
চম্পা লজ্জা পাইয়া জয়তীর পশ্চাতে আসিয়া মুখ লুকাইল!
জাহাঙ্গীর দেখিল, চম্পা যেন শুক্লা চতুর্দশীর চাঁদ। সহসা তাহার ভূণীকে মনে পড়িল। ইহারা মায়াবিনীর জাত। ইহারা সকল কল্যাণের পথে মায়াজাল পাতিয়া রাখিয়াছে। ইহারা সকল কল্যাণের পথে মায়াজাল পাতিয়া রাখিয়াছে। ইহারা গহনপথের কণ্টক, রাজপথের দস্যু। সে নিঃশব্দে উঠানে আসিয়া দাঁড়াইল। দেখিল, দূরে বনানীর অন্ধকারে নিশীথের চাঁদ মলিনমুখে অস্ত যাইতেছে, আর পূর্বগগন নবারুণের উদয় আশায় রাঙিয়া উঠিতেছে!