কুহেলিকা – ১০
সন্ধ্যার পূর্বেই জাহাঙ্গীর গোরুর গাড়িতে চড়িয়া শিউড়ি চলিয়া গেল।
সন্ধ্যার বিষণ্ণতা এমন করিয়া বুঝি আর কখনও নামে নাই হারুণদের বাড়িতে।
ভূণীর যখন জ্ঞান হইল, তখন তাহার সর্বপ্রথম এই প্রার্থনাই অন্তর ভরিয়া গুমরিয়া ফিরিতে লাগিল, ‘ধরণি দ্বিধা হও! এ মুখ যেন আর দেখাইতে না হয়!’
সেও কি সত্যসত্যই তাহার মাতার ন্যায় উন্মাদিনী হইল? নহিলে এত কথা এমন লজ্জাহীনার মতো সে বলিল কেমন করিয়া?… সন্ধ্যার এ অন্ধকার যেন আর না কাটে! সে আর আলোকের মুখ দেখিতে পারিবে না।
কেহ সন্ধ্যা-দীপ জ্বালিলও না। কেহ জ্বালিতেও বলিল না। আলো জ্বলিয়া উঠিলে বুঝি এ বেদনা এ লজ্জার কালিমা দ্বিগুণতর হইয়া দেখা দিবে।
বাড়ির প্রত্যেকেই যেন প্রত্যেকের কাছে অপরাধী!
উন্মাদেনী মাতার আবোল-তাবোল বকুনির মাঝে ক্রন্দনও শোনা যাইতেছিল, ‘মিনা আমার! বাপ আমার! এসে আবার চলে গেলি?’
হারুণ এতক্ষণ একটি পুকুরের নির্জন পাড়ে বসিয়া আকাশ-পাতাল চিন্তা করিতেছিল। জাহাঙ্গীরের তো কোনো অপরাধই নাই। কিন্তু নাই বা বলি কেমন করিয়া? সে কেন এ দরিদ্রের বাড়ি আসিতে চাহিল? যদি আসিলই এবং দৈবক্রমে এ দুর্ঘটনা ঘটিলই যদি, সে কেন ইহার মীমাংসা করিয়া গেল না? হতে পারে, তাহারা দরিদ্র, কিন্তু বংশ গৌরবে তাহারা তো একটুও খাটো নয়। আর ওই ভূণী, অমন অপরূপ সুন্দরী, অপূর্ব বুদ্ধিমতী মেয়েও কি তাহার বধূ হইবার অযোগ্য? তাহাকে যে অবহেলা করিয়া গেল, এই বেহেশ্তী ফুলের মালাকে যে পদদলিত করিয়া গেল, সে কি মানুষ? ভালোই হইয়াছে, ওই হৃদয়হীন বাঁদরের গলায় এ মুক্তার মালা শোভা পাইত না বলিয়াই এ অঘটন ঘটিয়া গেল!… কিন্তু ভূণী! উহার কী হইবে? জাহাঙ্গীরের সাথে তাহার সমস্ত কথাই সে শুনিয়াছে, ভূণীকে সে ভালো করিয়াই চিনে। সে ভাঙিবে কিন্তু নোয়াইবে না! সে ভয় করিতে লাগিল, এইবার তাহার অন্ধ পিতা আর বাঁচিবে না!
হঠাৎ তাহার মনে হইল জাহাঙ্গীরের বিদায়-ক্ষণের কথা। সে হারুণকে আড়ালে ডাকিয়া বলিয়াছিল, ‘আমার সব কথা শুনলে তুমিই আমায় তোমার বোন দিতে রাজি হবে না হারুণ!’ হারুণ পীড়াপীড়ি করাতে সে বলিয়াছিল, ‘সব কথা আমার বলতে চাইনে ভাই। হয়তো বা আামার সব কথা আমি নিজেই জানিনে। কিন্তু আমার যেটুকু কৃতকর্মের জন্য আমি দায়ী, অন্তত সেইটুকু শুনলেই তোমার রক্ত হিম হয়ে যাবে!… আমি খুলেই বলি, আমি বিপ্লবী।’
চলিতে চলিতে হঠাৎ গোখরো সাপের গায়ে পা পড়িলে – মানুষ যেমন চমকাইয়া ওঠে, হারুণ তেমনই চমকিয়া উঠিয়া বলিয়াছিল, ‘জাহাঙ্গীর, তুমি – তুমি – বিপ্লবী?’
অবশ্য, বিপ্লবী – রিভোলিউশনারি যে কোন ভয়ানক জীবকে বোঝায় তাহা সে স্পষ্ট করিয়া জানিত না। আর স্পষ্ট করিয়া জানিত না বলিয়াই, তাহার অত ভয়! ভূত দেখা যায় না বলিয়াই না লোকের এত ভূতের ভয়! হারুণ ছেলেবেলা হইতেই একটু অতিরিক্ত ভীরু। আজও সে রাতে একা ওঠা তো দূরের কথা – একা ঘরে শুইতেও ভয় করে। কাজেই চোখের সামনে একজন বিপ্লবীকে দেখিয়া তাহার মনে হইতে লাগিল, সে সত্য সত্যই ভূত দেখিতেছে! সে জানিত বিপ্লবীদের তাহারা তো দূরের কথা, সি.আই.ডি পুলিশেও দেখিতে পায় না! উহারা আকাশলোকে অভিশাপের মতোই ধরাছোঁয়ার বহু ঊর্ধ্বে থাকিয়া বিচরণ করিয়া বেড়ায় এবং হঠাৎ বজ্রপাতের মতোই কখন শিরে আসিয়া পতিত হয়।
সে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল, ‘কিন্তু বিপ্লবীরা যে ভীষণ লোক জাহাঙ্গীর! তুমি তো তা নও!’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া ফেলিয়া বলিয়াছিল, ‘ভয় নেই হারুণ, বিপ্লবীরা তোমার আমার মতো ঘরের মানুষ, বনের বাঘ নয়! আর যদি আমাদের সত্যিই তা মনে কর, তা হলে তো তোমারই এ বিয়েতে সর্বপ্রথম অসম্মত হওয়া উচিত! কিন্তু আসল কথা কী জানো হারুণ, আমি বিয়ে করতে পারি না, আমাদের বিয়ে করতে নেই!’
হারুণ কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো জাহাঙ্গীরের মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল।
জাহাঙ্গীর হঠাৎ একটু কর্কশ কণ্ঠেই বলিয়া উঠিল, ‘তুমি এত বেশি ভীরু, তা আমি জানতাম না হারুণ। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তোমায় আমার এ পরিচয় দিয়ে ভালো করিনি। আমরা সত্যিসত্যিই বাঘের চেয়েও ভীষণ – কিন্তু শুধু তারই জন্য যে বিশ্বাসঘাতকতা করে। আমি যে কথা তোমায় বললাম তা ঘুণাক্ষরেও যদি প্রকাশ পায়, তা হলে বন্ধু’ – বলিয়াই সে বুকের তলা হইতে যে অস্ত্র বাহির করিয়া দেখাইল, তাহাতে হারুণ পতনোন্মুখ বংশপত্রের মতো কাঁপিতে লাগিল!
জাহাঙ্গীর পরক্ষণেই হাসিয়া তাহাকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, ‘আশা করি – কোনো দিনই এর প্রয়োজন হবে না বন্ধু। অনেক দুঃখ দিয়ে গেলাম, তবে এর এক কণা ঋণও যদি পরিশোধ করতে পারি কোনোদিন, তা হলে আমার মনের অনুশোচনা অনেক কমে যাবে।… আর দেখ, তুমি একটু চেষ্টা করলেই ভূণী সব ভুলে যাবে। হাজার হোক সে ছেলেমানুষ বই তো নয়! তা ছাড়া মা উন্মাদিনী হলে ছেলেমেয়ে একটু অতিরিক্ত ভাবপ্রবণ হয়। তবে, এ মাটির পৃথিবীতে ও সব টেকে না ভাই, এই যা ভরসার কথা!’
শেষের দিককার কথা কয়টার নিষ্ঠুরতা ও বিরসতা হারুণকে গভীরভাবে বাজিলেও সে শুষ্ককণ্ঠে কোনোরকমে বলিয়াছিল, ‘তা হলে এসো ভাই! আশা করি, এর পরেও আমরা বন্ধু থাকব!’ জাহাঙ্গীর ‘নিশ্চয়’ বলিয়া গাড়িতে উঠিয়া বসিল।
হারুণ কেবলই ভাবিতে লাগিল, একটা লোকই একসঙ্গে এত ভালো এবং এত মন্দ কী করে হতে পারে!
এমন সময় অন্ধ পিতার ডাক শুনিয়া হারুণের দুঃস্বপ্ন টুটিয়া গেল। ভিতরে ঢুকিয়া সে একটু উচ্চকন্ঠেই বলিয়া উঠিল, ‘আজ কি বাতি জ্বলবে না বাড়িতে?’
ভূণী উঠিয়া আলো জ্বালিতে চলিয়া গেল।
হারুণ দাওয়ায় উপবিষ্ট তাহার পিতার নিকট বসিয়া পড়িল, ‘আমায় ডাকছেন আব্বা!’
অন্ধ পিতা ক্লান্তকণ্ঠে বলিলেন, ‘হুঁ!’ তাহার পর একটু থামিয়া বলিলেন, ‘এখন কী করা যায় – ঠিক করলে কিছু?’
হারুণ নম্রস্বরে বলিল, ‘এর কী আর ঠিক করবার আছে?’
তাহার পিতা উত্তেজিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, কিছু করবার নাই? বেশ! তোমার কিছু না থাকতে পারে কিন্তু আমার আছে। আমি পিতা হয়ে চোখের সামনে মেয়ের সর্বনাশ দেখতে পারব না। আমি কালই জাহাঙ্গীরের মাকে সব কথা জানিয়ে চিঠি দেব। দেখি, উনি কী বলেন, তারপর আমরা যা করবার করব।’
হারুণ মিনতি-ভরা কণ্ঠে বলিল, ‘না আব্বা, তা তুমি করতে পারবে না। ওতে আমাদের মান-ইজ্জতের হানি ছাড়া লাভ কিছু হবে না।’
অন্ধ পিতা বহুক্ষণ ধরিয়া কী চিন্তা করিতে লাগিলেন। তারপর ধীরে ধীরে বলিলেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ বাবা, কিন্তু এ ছাড়া তো উপায়ও দেখছি না। তুই তো জানিস হারুণ, ভূণী কেমন ধাতের মেয়ে। ওকে কি কেউ বিয়ে দিতে পারবে মনে করিস? তোর কাছে যা শুনেছি, তাতে মনে হয়, জাহাঙ্গীরের মার সত্যিকারের বুদ্ধিসুদ্ধি আছে, হৃদয়ও আছে। আমার এই দুঃখের কাহিনি শুনলে তিনি ছেলেকে বুঝিয়ে এর একটা সমাধান করবেনই।’
হারুণ বলিল, ‘তুমি জাহাঙ্গীরকে চেন না আব্বা, ওর মা কেন ওর বিধাতা এসেও ওকে টলাতে পারবে না। তুমি ও-চেষ্টা কোরো না।’
পিতা অসহিষ্ণু হইয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘তুই থাম হারুণ, তুই আমার চেয়ে বেশি বুঝিস না। ভূণীর কপাল যদি পুড়েই থাকে, তা হলে ভালো করেই পুড়ুক! আমিও আমার দুঃখের শেষ সীমা দেখে নিই! তারপর উপরে খোদা আছেন, আর পায়ের নীচে তো গোর আছেই।’