কুহেলিকা – ০৯
কালবৈশাখীর মেঘ এমনি করিয়াই দেখা দেয়। যেখানে দুঃখের বরষা, বজ্রপাতও হয় সেইখানেই। শান্ত নদীতীরে তারও চেয়ে শান্ত ভগ্নকুটির এমনি করিয়াই কোনো এক দুর্যোগের নিশীথে ভাসিয়া যায়!
দুঃখ যে কত বড়ো বন্ধুর রূপ ধরিয়া আসে, হারুণ তাহাই ভাবিতেছিল – একাকী দাওয়ায় বসিয়া।
অন্ধ পিতা এক মনে কলিকার পর কলিকা তামাক পোড়াইতে ছিলেন। অগ্নিগিরির গর্ভ হইতে যে ধূম্রপুঞ্জ নির্গত হয়, তাহার জ্বালাও বুঝি এত ভয়াবহ নয়। ঘর পোড়ে, সকলে দেখে, পোড়ারও অবধি আছে; কিন্তু মনে যদি একবার আগুন লাগে – তাহা কেহ দেখেও না, তাহার অন্তও নাই।
মোমি তাহার সিল্কের শাড়ি খুলিয়া ফেলিয়া আবার সেই ছিন্ন মলিন শাড়িটি পরিয়া গৃহকর্মে রত হইয়াছে। ওইটুকু মেয়ে, তাহার এই দুঃখ ঢাকিবার কঠোর প্রয়াস দেখিয়া অশ্রু সংবরণ করা দায় হইয়া উঠে! এ যে কত বড়ো দুঃখ, কোথা দিয়া কী হইল, সে হয়তো ভালো করিয়া বুঝিতেই পারে নাই। তাহার চারিপাশে সে যেন কাহাদের দীর্ঘশ্বাস, কাহাদের নিঃশব্দ ক্রন্দন অনুভব করিতেছে। কীসের এ বিষাদ, সে তাহা জানে না! তাহাকে সবচেয়ে বেশি বেদনা দিয়াছে – জাহাঙ্গীরের আজই কলিকাতা চলিয়া যাওয়ার আয়োজন!
উন্মাদিনী মাতা অঘোরে ঘুমাইতেছেন – উন্মাদিনী নিয়তির মতোই নির্বিকার নিশ্চিন্ত আরামে!
ভূণী তাহার সকালের-পরা সাজসজ্জা লইয়া পাষাণ-প্রতিমার মতো বসিয়া আছে। হারুণ একবার চুপি চুপি তাহাকে ও অলক্ষুণে বস্ত্র খুলিয়া ফেলিতে বলায় সে অশ্রুরুদ্ধকণ্ঠে বলিয়াছিল, ‘ওকে যেতে দাও ভাই, তার পর চিরকালের জন্যই খুলে ফেলব!’ ইহার পর হারুণ আর কিছু বলিতে সাহস করে নাই।
দ্বিপ্রহর উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। জাহাঙ্গীর সমস্ত বাঁধিয়া ছাঁদিয়া সহজ শান্তভাবে হারুণদের আঙিনায় আসিয়া দাঁড়াইল। হারুণ তাহাকে কিছু বলিবার আগেই ভূণী ভিতর হইতে ডাকিল, ‘মেজোভাই, শুনে যাও।’
হারুণ জাহাঙ্গীর দু-জনারই বুক কাঁপিয়া উঠিল।
ভূণী তাহার সেই বধূবেশ লইয়া অকুতোভয়ে বাহিরে আসিয়া বলিল, ‘বা-জান! তুমি দলিজে যাও তো একটু!’
ইহা যেন অনুরোধ নয়, আদেশ।
মনে হইল, অন্ধ পিতা সব বুঝিয়াছেন। মোবারককে ডাকিয়া গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া তিনি বাহির হইয়া গেলেন।
জাহাঙ্গীরের ভয় করিতে লাগিল, বুঝি মাতার মতো কন্যারও মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটিয়াছে। সে আঙিনায় দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া ঘামিতে লাগিল – নিজের জন্য নয়; এই হতভাগিনির দুঃখে! তাহার জীবনদেবতা জীবন লইয়া কী খেলা খেলেন, তাহা দেখিবার জন্য সে নিজেকে অম্লান বদনে তাঁহার হাতেই সঁপিয়া দিয়াছে। আজিকার বজ্রপাতকেও সে তাই মাথা পাতিয়াই গ্রহণ করিবে!
ভূণী একটু জোরেই হারুণকে বলিল, ‘মেজোভাই, আমি তোমার বন্ধুর সাথে দুটো কথা বলতে পারি?’
হারুণ অবাক হইয়া ভূণীর মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল।
ভূণী তেমনই সতেজ কণ্ঠেই বলিয়া উঠিল, ‘বুঝেছি মেজোভাই, তুমি কী ভাবছ। কিন্তু ভাববার কিছুই নেই এতে। আমার মঙ্গল-অমঙ্গলের কথা আমার চেয়ে কেউ বুঝবে না। আমি তোমারই তো ছোটো বোন। আমায় দিয়ে অন্যায় কিছু হবে না, এ তুমি জেনে রেখো। আমি আমার দুর্ভাগ্যের শেষটুকু জেনে নিতে চাই।’
হারুণের দুই চোখ জলে ভরিয়া উঠিল, সে আর দাঁড়াইতে পারিল না। সে চোখের জল মুছিতে মুছিতে তাহার মাতার পায়ের কাছে মাথা রাখিয়া শুইয়া পড়িল।
ভূণী জাহাঙ্গীরের চোখের দিকে চাহিয়া জড়িতকণ্ঠে বলিল, ‘আপনার সঙ্গে দুটো কথা আছে, একটু ভিতরে এসে বসবেন?’
জাহাঙ্গীর কলের পুতুলের মতো সে আদেশ পালন করিল।
ভূণী একেবারে জাহাঙ্গীরের পায়ের নীচে বসিয়া পড়িয়া অশ্রু-টলমল ডাগর চক্ষু দুটি ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়া বলিল, ‘আপনি কি এখনই চলে যাচ্ছেন?’
জাহাঙ্গীর তাহার পা চৌকিতে তুলিয়া তো লইলই না, কোনোপ্রকার অসোয়াস্তির ভাবও তাহার ব্যবহারে ফুটিয়া উঠিল না। সহজ শান্ত কণ্ঠেই সে বলিয়া উঠিল, ‘হাঁ ভাই, আমি যাচ্ছি!’ একটু থামিয়া বলিল, ‘দুঃখের পসরা খোদা আমার মাথায় তুলে দিয়েছেন, তার জন্য দুঃখ করিনে ভাই, কিন্তু এর তাপ যে অন্যের গায়ে গিয়ে লাগে, এ দুঃখ রাখবার আর ঠাঁই নাই। আমি এসেছিলাম দুঃখ ভুলতে, কিন্তু সে দুঃখ যে এত বিপুল হয়ে উঠবে, সে দুঃখ যে অন্যেরও ঘর পোড়াবে – এ আমি জানতাম না।’
ভূণী একটু হাসিয়া শাড়ির আঁচলটায় পাক দিতে দিতে মুখ না তুলিয়াই বলিল, ‘সত্যই কি তাই? আপনাদের বড়োলোকের কি কোনোরকম দুঃখবোধ আছে?’
জাহাঙ্গীর আহত হইয়া বলিয়া উঠিল, ‘ও কথা কেন বলছ ভাই? আমরা তোমার কথায় “বড়োলোক” হলেও মানুষ। অন্তত আমার হৃদয় নেই – এমন কিছুরই হয়তো পরিচয় দিইনি এখনও।’
ভূণী তেমনই ম্লান হাসি হাসিয়া বলিল, ‘দেন নাই, পরে দেবেন! আচ্ছা, আপনি তো মহৎ হৃদয়বান এবং সেইজন্যই হয়তো তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাচ্ছেন। আপনি স্বেচ্ছায় এসেছেন, স্বেচ্ছায় যাবেন, এতে কারই বা বলবার কী আছে। কিন্তু আমার কী হবে, বলতে পারেন?’ – আবার সে তাহার দুই আয়ত লোচনের অশ্রুর আবেদন জাহাঙ্গীরের পানে তুলিয়া ধরিল!
জাহাঙ্গীর একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, ‘আমি বুঝেছি ভূণী, আজ কী সর্বনাশ হয়েছে! কিন্তু তুমিও কি এত বড়ো মিথ্যাটাকেই সত্য বলে গ্রহণ করলে? পালিয়ে আমি যাচ্ছি না, আমি যাচ্ছি এই লজ্জার হাত এড়াতে। হারুণ আমার কত বড়ো বন্ধু, তা হয়তো তুমি জান না। আমার হাত দিয়েই তোমাদের এত বড়ো লাঞ্ছনা ছিল, তা আমি জানতাম না। কিন্তু তুমি তো জান, এতে আমাদের কারুরই অপরাধ নেই। অপরাধ শুধু আমার দুরদৃষ্টের!’
ভূণী উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘দূরদৃষ্ট শুধু আপনার নয়, আমার। যে আগুন লাগায়, সে জানে না যার বুকে আগুন লাগল – তার কতটুকু পুড়ল! সে যাক, আপনি যেটাকে মিথ্যা বলছিলেন, আপনি বোধ হয় জানেন না, সেটার চেয়ে বড়ো সত্য আমার কাছে নেই! আপনি বলবেন, মা আমার উন্মাদিনী। তবু তিনি আমার মা। আমরা নারী, আমরা হয়তো সকল কিছু অন্ধের মতো বিশ্বাস করি। খোদার ইঙ্গিত না থাকলে এ অভাবনীয় দুর্ঘটনা আমার উন্মাদিনী মায়ের হাত দিয়ে ঘটত না!’ তাহার পর একটু থামিয়া সে শান্তকণ্ঠে বলিল, ‘আমি খুলেই বলি আপনাকে, মা যার হাতে আমায় সঁপে দিয়েছেন, তার চেয়ে বড়ো সত্য আমার কাছে নেই!’
জাহাঙ্গীরের মনে হইতে লাগিল, পৃথিবীর চন্দ্রসূর্য সমস্ত ডুবিয়া গিয়াছে। একাকী অন্ধকারে সে অতল হইতে অতলতর গহ্বরে তলাইয়া যাইতেছে।
কিন্তু সে মুহূর্তকালের জন্য। একটু পরেই সে সামলাইয়া উঠিল। সে আর কিছু বলিতে যাইবার পূর্বেই ভূণী ক্ষীণ হাসি হাসিয়া বলিল, ‘আপনি যা বলবেন তা আমি জানি। ফাঁসির আসামি যেমন করে তার দণ্ডাজ্ঞা শোনে, আপনার কাছ থেকে হয়তো তেমনি করেই তেমনই কঠোর কিছুই শুনতে হবে; আমি তার জন্য প্রস্তুত আছি। তবুও আমি আমার যা বলবার বললাম। আপনি আমায় পাগল বা ওই রকম অদ্ভুত কোনো কিছু ভাবছেন, না?’ – আবার সেই অস্তমান শশীকলার মতো কান্নাভরা হাসি!
জাহাঙ্গীর এতক্ষণে তাহার পরিপূর্ণ দৃষ্টি দিয়া ভূণীর দিকে তাকাইয়া দেখিল। তাহার চকচকে চোখ নিমেষে ব্যথায় ম্লান হইয়া উঠিল। ওই নিমেষের দৃষ্টি বিনিময়। তাহার মনে হইল, ওই অপূর্ব সুন্দর দুইটি চক্ষুর জন্যই সে সর্বত্যাগী হইতে পারে!… হঠাৎ তাহার সুপ্ত আহত অভিমান যেন নিদ্রোত্থিত কেশরীর ন্যায় জাগিয়া উঠিল। বন-হরিণীর মতো চক্ষু ইহাদের, হরিণীর মতোই মায়াবী ইহারা, তবু ইহারা শিকারের জীব! ইহাদের হত্যা করায় পৌরুষও নাই, করিলে লজ্জাও নাই! তাহার মনে হইতে লাগিল, সে জাহাঙ্গীর নয় – সে শুধু মদ্যপ চরিত্রহীন ফররোখ সাহেবের পুত্র!
এইবার সে একটু বক্র-হাসি হাসিয়াই বলিল, ‘তোমার মা উন্মাদিনী হলেও তোমায় তা ভাবতে পারি না ভূণী। আর কোনো মেয়ে হলে তাকে ধূর্ত বলতাম – প্রগল্ভা না বলে; কিন্তু তোমায় তা বলতে আমার মতো কশাই-এরও বাধবে! আমার কপালই এই রকম। যারাই আমার জীবনে বিপর্যয় এনেছে, তাদের সকলেই অদ্ভুত এক-একটি জীব। কিন্তু সে কথা যাক। তুমি এখনই বলছিলে – ফাঁসির আসামির মতোই আমার দণ্ডাজ্ঞা শুনতে প্রস্তুত আছ। আমি যদি সত্যিসত্যিই তোমার যাবজ্জীবন নির্বাসনের দণ্ডাজ্ঞা দিই, তুমি তা সইতে পারবে?’ বলিয়াই নিষ্ঠুরের মতো হোহো করিয়া হাসিয়া উঠিল।
ভূণী মুহূর্তের জন্য অন্তরে কাঁপিয়া উঠিল। কিন্তু তাহার পরেই সে গলবস্ত্র হইয়া জাহাঙ্গীরের পায়ে হাত দিয়া সালাম করিয়া বলিল, ‘আপনার ওই দণ্ডাজ্ঞা গ্রহণ করলাম!’ তাহার পর ভিতরে চলিয়া যাইতে যাইতে বলিল, ‘অনেক অদ্ভুত জীবই তো দেখেছেন জীবনে, এবং সে জীব-হত্যায় আপনার হাতযশও আছে মনে হচ্ছে, এইবার আরেকটা জীব দেখে গেলেন! কিন্তু মনে রাখবেন, যাদের জীব-হত্যাই পেশা, তাদের সে ঋণ একদিন শোধ করতে হয় ওই বন্যজীবের হাতেই!’ – সে রানির মতো সগর্বে চলিয়া গেল।
জাহাঙ্গীর একটু চিৎকার করিয়াই বলিয়া উঠিল, ‘আমার শেষ কথা শুনে যাও তহমিনা, নইলে আমায় নিয়ে সবচেয়ে বড়ো দুঃখ পোহাতে হবে তোমার!’ ভূণী ভিতর হইতে বলিল, ‘আমি এখান থেকেই আপনার চিৎকার শুনতে পাচ্ছি বলুন।’
জাহাঙ্গীর সহসা এই ব্যঙ্গোক্তিতে ক্রুদ্ধ হইলেও তাহার অপূর্ব আত্মসংযমের বলে কণ্ঠ যথাসম্ভব শান্ত করিয়া বলিল, ‘আমি প্রেমও বিশ্বাস করিনে, পৃথিবীর কোনো নারীকেও বিশ্বাস করিনে! মনে হচ্ছে, তোমার সব কথাই আর-কারুর শেখানো, অথবা ও-গুলো অতিরিক্ত নভেল পড়ার বদহজম! তোমাদের জাতটারই নির্বাসন হওয়া উচিত। একেবারে কালাপানি!’
ভূণী রেকাবিতে করিয়া এক রেকাবি সন্দেশ ও এক গ্লাস পানি লইয়া জাহাঙ্গীরের সামনে রাখিতে রাখিতে সহজ কণ্ঠেই বলিল, ‘আপনি বড্ড দুর্মুখ! যাবেনই তো, যাবার সময় একটু মিষ্টিমুখ করে যান।’ বলিয়াই সে হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, ‘মাফ করবেন, আপনার দেওয়া মিষ্টি দিয়েই আপনার তেতো মুখ মিষ্টি করতে হচ্ছে! জানেনই তো, আমরা কত গরিব! তাতে আবার পাড়াগেঁয়ে। একটা ঘরের মিষ্টি দিয়ে আপনার জমিদারি মুখের ঝাল মিটাতে পারলাম না! আপনি খান, আমি দুটো পান সেজে আনি।’ বলিয়াই সে ভিতরে চলিয়া গেল।
জাহাঙ্গীর আর একটি কথাও না বলিয়া সুবোধ বালকের মতো রেকাবির মিষ্টি গলাধঃকরণ করিতে লাগিল। তাহার আজ কেবলই মনে হইতে লাগিল, মিষ্টি যে এত মিষ্টি হয় – তাহা সে জীবনে উপলব্ধি করে নাই, হয়তো আর কখনও করিবেও না। কিন্তু এই নারী, এই প্রগল্ভা তরুণী! এ কোথা হইতে আসিল? বনফুলের এই সৌন্দর্য, এত সুবাস! গহন বনের অন্ধকারে এ কোন কস্তুরীমৃগ তাহার মেশ্ক-খোসবুতে সারা বন আমোদিত করিয়া তুলিতেছে? কয়লার খনিতে এ কোন কোহিনূর লুকাইয়া ছিল? জাহাঙ্গীর যেন দিশা হারাইল। সে জাহাঙ্গীর নয়, বিলাসী ফররোখ সাহেবের পুত্র নয়, সে ‘শিভালরি’ যুগের বীরনায়ক, বিংশ শতাব্দীর সভ্য যুবক! সে এই মহীয়সী নারীর অবমাননা করিবে না! আপনার অজ্ঞাতেই তাহার কণ্ঠ দিয়া উচ্চারিত হইল, ‘তহমিনা! তহমিনা!’
ভূণী তশতরীতে পান লইয়া আসিতেছিল। জাহাঙ্গীরের এই অস্বাভাবিক স্বরে একটু বিস্ময়ান্বিত হইয়াই সে নিকটে আসিয়া বলিল, ‘আমায় ডাকছিলেন?’
জাহাঙ্গীর অপ্রতিভ হইয়া ঘাড় হেঁট করিয়া বলিল, ‘না?’ জাহাঙ্গীর নিজেই চমকিত হইয়া উঠিল। তাহার নিজের কণ্ঠস্বরে যে এত মধু আছে তাহা সে নিজেও জানিত না।
ভূণী স্নেহ-গদগদ কন্ঠে বলিয়া উঠিল, ‘এই তো বেশ লক্ষ্মী ছেলের মতো সব মিষ্টিই খেয়েছেন দেখছি। দেখুন, আপনি বড্ড বদরাগী! হয়তো আপনার কোনো অসুখ-বিসুখ আছে, দোহাই! কলকাতা গিয়ে একটু চিকিৎসা করাবেন!’ বলিয়াই হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, ‘তাই তো বলি, যে লোক দু-হাতে এত হাঁড়ি হাঁড়ি মিষ্টি বিলাতে পারে, তার মেজাজ কি এত তেতো হয়? আর দুটো মিষ্টি এনে দেই, লক্ষ্মীটি, “না” বলবেন না। সেই কখন দুপুর রাত্তিরে কলকাতা পৌঁছোবেন, আর খিদের চোটে রাস্তায় হয়তো কাউকে খুন করেই বসবেন! যা মেজাজ, বাপরে!’ বলিয়াই জাহাঙ্গীরের দিকে গভীর সানুরাগ দৃষ্টি দিয়া তাকাইতেই দেখিল, জাহাঙ্গীর মুখে ক্রমাগত পান ঠাসিতেছে।
ভূণী এবার ছেলেমানুষের মতো তরল কণ্ঠে চেঁচাইয়া উঠিল, ‘অ মা! কী হবে! পান খেয়ে ফেলেছেন? ফেলে দিন, ফেলে দিন! বেশ! ফেলবেন না তো!’ বলিয়াই বহুদিনের রোগক্লান্ত রুগির মতো শান্তকণ্ঠে বলিতে লাগিল, ‘চির-নির্বাসনই তো দিয়ে গেলেন। আপনাকে যতটুকু জেনেছি, তাতে এ আমার ধ্রুব ধারণা যে, আর আমাদের কোনোকালেই দেখা হবে না।’ তাহার পরে একটু থামিয়া চোখমুখ ডাঁশা আপেলের মতো লাল করিয়া সলজ্জকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, ‘আমাদের যদি আজ সত্যিসত্যিই বিয়ে হয়ে যেত, তাহলে এক বছরেও হয়তো এত কথা এমন করে বলতে পারতাম না আপনার কাছে। দুর্দিন মানুষকে এমনই বেহায়া করে তোলে! আমার যে এক মুহূর্তেই জীবনের সাধ মিটিয়ে ফেলতে হবে। আমার মতো দুর্ভাগিনি এক কারবালার সকিনা ছাড়া বুঝি কেউ নেই!’ বলিয়াই সে ফোঁপাইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে ভিতরে চলিয়া গেল!
জাহাঙ্গীরের কেবলই মনে হইতে লাগিল সে বুঝি ইহজগতে নাই। সে যেন স্বপ্ন দেখিতেছে। তাহার সমস্ত অঙ্গ যেন কাহার অভিশাপে প্রস্তরীভূত হইয়া যাইতেছে! সে না পারিল নড়িতে, না পারিল একটা বাক্য উচ্চারণ করিতে! কিন্তু তাহার আর বিস্ময়ের অবধি রহিল না, যখন সে দেখিল, অল্প পরেই ভূণী আর এক রেকাবি সন্দেশ লইয়া তাহার সম্মুখে রাখিতেছে। তাহার মনে হইল, কে যেন জাদু করিয়া তাহাকে এই রহস্যপুরীতে বন্দি করিতেছে! সে যেন সকল দেশের সকল গল্প-কাহিনির নায়ক – রূপকুমার। হঠাৎ সে অভিভূতের মতো বলিয়া ফেলিল, ‘তহমিনা! তুমি আমার সাথে যাবে? জানি না, তুমি কারবালার সকিনা, না, সিস্তানের তহমিনা। বলো, তুমি যাবে?’
ভূণী দৃপ্তকণ্ঠে বলিল, ‘না!’
জাহাঙ্গীরের স্বপ্ন টুটিয়া গেল। সে আবার বহুক্ষণ ধরিয়া ভূণীকে দেখিল। দেখিয়া যখন সাধ মিটিতে চায় না; হায় রে ভুখারি অবিশ্বাসী চোখ! তবু সে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কেন যাবে না? তুমিই না বলছিলে, তোমার মা যার হাতে তোমায় সঁপে দিয়েছেন, তার চেয়ে বড়ো সত্য তোমার আর নেই।’
ভূণী মৃদুকণ্ঠে বলিল, ‘এখনও তাই বলছি। তবু এমন করে তো যাওয়া যায় না। আপনাকে আমি উপদেশ দিতে পারি, এত বড়ো স্পর্ধা আমার নেই। আমার অন্তরের সত্য যত গভীরই হউক, তবু তাকে সমাজের কাছে রং বদলিয়ে নিতে হবে। নইলে কেউই সুখী হতে পারব না।’
জাহাঙ্গীর অনেকক্ষণ ধরিয়া কী ভাবিল, তাহার পর কম্পিত কণ্ঠে বলিল, ‘তা হতে পারে না ভূণী, আমি এতক্ষণ ভুল বকছিলাম। আমায় ক্ষমা করো। যে প্রেমে অবিশ্বাস করে, তার মতো হতভাগ্য বুঝি বিশ্বে কেউ নেই। তার কোথাও কোনো কিছুতেই সুখ নেই। আমায় নিয়ে তুমি সুখী হতে পারবে না, আমিও তোমায় নিয়ে – শুধু তোমায় বলে নয় – কোনো নারীকে নিয়েই সুখী হতে পারব না। যে সত্যকে আমি চোখের সামনে দেখি, তাকেও বিশ্বাস করতে পারিনে, আমার রক্তে রক্তে যেন প্রতিধ্বনি ওঠে, ভুল, ভুল, এ সব মিথ্যা, ছলনা! আমি তোমায় আমারও অজানিতে দুঃখ দিয়ে গেলাম। কিন্তু তুমি তো জান – আমার অপরাধ কতটুকু! তোমার কোনোদিন কোনো উপকার করেও যদি আমার এ অনিচ্ছাকৃত অপরাধের লাঘব করতে পারি, তবে নিজেকে ধন্য মনে করব – শুধু এইটুকুই মনে রেখো। আমার আর সব ভুলে যেয়ো!’ শেষের কথা কয়টি বলিবার সময় তাহার কণ্ঠ যেন ভাঙিয়া আসিতেছিল! – সে তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িয়া বলিল, ‘তবে যাই এখন!’
ভূণী ভগ্নকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, ‘অনুগ্রহ করে আপনার এই কাপড় কয়খানা নিয়ে যান! একটু বসুন, আমি আসছি।’
জাহাঙ্গীর চলিয়া যাইতেছিল! ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘আমি তো তোমায় নির্বাসনই দিলাম, ওই শাড়ি তোমার জেলের পোশাক!’
তহমিনা সেইখানেই ছিন্নকণ্ঠ কপোতীর মতো লুটাইয়া পড়িয়া ডুকরাইয়া কাঁদিয়া উঠিল, ‘আমি পারব না, পারব না এ শাস্তি বইতে! নিষ্ঠুর, আমায় তুমি প্রাণদণ্ড দিয়ে যাও, এ নির্বাসন দিয়ো না , দিয়ো না!’
দুটো পাপিয়ায় তখনও আঙিনায় যেন আড়াআড়ি করিয়া ডাকিতেছিল, ‘পিউ কাঁহা! পিউ কাঁহা! চোখ গেল, চোখ গেল!’