কুহেলিকা – ০৮
পরদিন অসহ্য গরমে অতি প্রত্যুষেই জাহাঙ্গীরের ঘুম ভাঙিয়া গেল। সে উঠিয়াই বাহিরবাটী হইতে হারুণকে চিৎকার করিয়া ডাকাডাকি আরম্ভ করিয়া দিল। হারুণ ঘুম-বিজড়িত চক্ষে উঠিয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘কী হয়েছে জাহাঙ্গীর? কিছু হয়েছে নাকি?’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘আরে তৌবা, তোমাদের দেশটা দেখছি জ্যৈষ্ঠি বুড়ির একেবারে উনোনের পাশ! কাল রাত্তির থেকে সকাল পর্যন্ত আমার অন্তত তিন কলসি ঘাম ঝরেছে! বাপ!’
হারুণ হাসিয়া ভালো করিয়া কাছাটা গুঁজিতে গুঁজিতে বলিল, ‘আমি তো সেই জন্যেই কাল ভিতরে গিয়ে শুতে চাইনি। তোমার কাছে থাকলে অন্তত খানিকক্ষণ পাখা করতে পারতাম।’ বলিতে বলিতে আবার বসিয়া পড়িল!
জাহাঙ্গীর হাসিয়া উঠিল। প্রভাতের আকাশের মতো খোলা প্রাণের হাসি, সুন্দর উজ্জ্বল! বলিল, ‘বন্ধু তোমার ব্যাক-টাইটা আগে ভালো করে এঁটে নাও গিয়ে! আমি বরং ততক্ষণ একটু সাঁতার কাটি তোমাদের ওই এঁদো পুকুরটাতে!’ – বলিয়াই জাহাঙ্গীর তাহার বেতের বাক্সটা খুলিয়া চায়ের সরঞ্জাম বাহির করিয়া স্টোভটা জ্বালাইয়া চায়ের জল চড়াইয়া দিয়া তোয়ালে সাবান লইয়া পুকুরে ঝাঁপাইয়া পড়িল। হারুণ সস্মিত আননে তাহার সাঁতার-কাটা দেখিতে লাগিল।
সাঁতার কাটিতে কাটিতে জাহাঙ্গীর বলিল, ‘হারুণ, পানিটা গরম হয়ে গেলে তোমার বোনকে নিয়ে একটু চা-টা তৈরি করে নিয়ো ভাই। চা দুধ চিনি সব ওই বাক্সে আছে। দোহাই তুমি তৈরি করতে যেয়ো না যেন! সব ভণ্ডুল করবে তা হলে!’ – বলিয়াই জাহাঙ্গীর এক ডুবে মাঝপুকুর হইতে ঘাটে আসিয়া চুলগুলো পিছন দিকে সরাইয়া বলিয়া উঠিল, ‘হারুণ, তখন বলছিলে, রাত্রে আমার কাছে থাকলে খানিকক্ষণ পাখা করতে পারতে, না? তা হলে যেটুকু ঘুম আমার হয়েছিল, তা-ও হত না! বাপ! পাশে শুয়ে একটা মদ্দ মিনশে পাখা করছে দেখলে ঘুম বেচারি ঘোমটা টেনে তিন লাফে ঘর ছেড়ে পালাত। পুরুষের সেবা – উঃ সে কী ভয়ানক! ভাদ্দর বউকে ভাসুর সেবা করতে এলে তার যেমন অবস্থা হয়, তেমনই আর কী।’
হারুণ এইবার একটু জোরেই হাসিয়া ফেলিল। বলিল, ‘দোহাই ভাই, ওই দুঃখে তুমি জলে ডুবো না যেন! আমি কোনোদিনই তোমার সেবা করতে যাচ্ছিনে। চা-টা ভূণীকেই করতে বলছি। তবে সেও আমার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ নয়।’
তাহার কথার অর্থ অনুরূপ দাঁড়াইল দেখিয়া জাহাঙ্গীর একটু লজ্জিত হইয়া উঠিল। তবে সে তুখোড় ছেলে, সহজে মুষড়াইয়া যায় না। বলিল, ‘তা হোক গে, মা খাবার না রেঁধে যদি বাবা ও কর্মটা করতেন, তা হলে এর অনেকটা স্বাদ কমে যেত হে!’ বলিয়াই জাহাঙ্গীর আবার সাঁতার কাটিতে আরম্ভ করিল।
হারুণ বাড়িতে গেয়ে তাহার বোন ‘ভূণী’কে হাসিতে হাসিতে বলিল, ‘ওরে ভূণী, জাহাঙ্গীর স্টোভে চা চড়িয়ে নাইতে গেছে। তুই চা-টা একটু তৈরি করে রাখ গিয়ে। চা, দুধ, চিনি, কাপ, চামচ সব ওইখানেই আছে। ওর ওই একটা দোষ, কোথাও যাবার সময় চায়ের সরঞ্জাম সাথে না নিয়ে যায় না।’
ভূণী হারুণের বোন দুটির মধ্যে বড়ো। বয়স পনেরো পার হইয়া গিয়াছে। দেখিতে কিন্তু আরও একটু বেশি বয়সের বলিয়াই মনে হয়। চমৎকার জ্বলজ্বলে চোখমুখ। সমস্ত শরীরে বুদ্ধির প্রখর দীপ্ত জ্যোতি যেন ঠিকরিয়া পড়িতেছে। সে তাহার ভ্রাতার আদেশে বাহিরবাটীতে যাইতে একটু ইতস্তত করিল। ওর ঘর হইতে পুকুরটা একেবারে সামনে। তাছাড়া সে ভালো চা করিতেও জানে না। বাড়িতে ও পাট একেবারেই নাই।
হারুণ বুঝিতে পারিয়াই একটু দুষ্টুমি করিয়া বলিল, ‘ওরে ভূণী, জাহাঙ্গীর বলেছে, তুই – এই তোরা কেউ চা তৈরি করে না দিলে ও কিছুতেই খাবে না। পুরুষ লোকের সেবা আর রান্না জিনিসের উপর ওর ভয়ানক আক্রোশ! আমি চা করলে ও হয়তো তা আমার মুণ্ডুতেই ঢেলে দেবে।’
ভূণী যাইতেছিল, আর তাহার যাওয়া হইল না। সে লজ্জার রাঙা হইয়া বলিল, ‘আমি যেতে পারব না, মোমিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
ভূণীর ছোটো বোন মোমি আজও দ্বাদশীর চাঁদ। ভূণীর মতো আজও সে ষোলো কলায় পূর্ণ হইয়া ওঠে নাই। সে কাছেই দাঁড়াইয়া সব শুনিতেছিল এবং তাহার চোখে-মুখে দুষ্টুমির হাসি দেখিয়া বেশ বোঝা যাইতেছিল যে, সে এই ব্যাপারের রহস্যটুকু রীতিমতো উপভোগ করিতেছে।
এ দেশের সম্ভ্রান্ত মুসলমান ঘরেও ‘দিদি’-কে পূর্ববঙ্গের মতো ‘আপা’ না বলিয়া ‘বুবু’ বলিয়াই ডাকে।
তাহার বুবুর কথা শুনিয়া মোমি ঝংকার দিয়া বলিয়া উঠিল, ‘ইস! আমি যেতে গেছি আর কী! তোমায় ডেকেছেন, তুমি যাও।’
ভূণী কোপ প্রকাশ করিয়া বলিল, ‘এই মোমি! যা তা বললে তোমার পিঠে চ্যালাকাঠ ভাঙব কিন্তু!’
হারুণ হাসিয়া বলিল, ‘নে আর ঝগড়া করতে হবে না। চল, আমরা তিন জনেই যাই। আমি বসে থাকব, তোরা চা করবি।
মোমি খুশি হইয়া উঠিল। ভূণী কিন্তু একটু সলাজ সংকোচেই গেল।
বাহির বাড়িতে যাইয়া ভূণী পুকুরের দিকে চাহিতেই জাহাঙ্গীরের সাথে চোখাচোখি হইয়া গেল। জাহাঙ্গীর চোখ নামাইয়া লইল। ভূণী কিন্তু ইচ্ছা করিয়াও চোখ নামাইতে পারিল না। রাত্রিবেলায় বনহরিণীর চোখে শিকারির ফ্লাশ-লাইটের জ্যোতিঃধারা গিয়া পড়িলে সে যেমন মুগ্ধবিস্ময়ে সেই আলো হইতে চোখ ফিরাইয়া লইতে পারে না, তেমনি করিয়া ভূণী জাহাঙ্গীরের অনাবৃত সুঠাম সুডৌল বলিষ্ঠ দেহের পানে চাহিয়া রহিল। ইচ্ছা করিয়াও চক্ষু ফিরাইতে পারিল না। ইহা যে লজ্জার, ইহা যে অন্যায়, ইহা সে ভাবিবার অবকাশ পর্যন্ত যেন পাইল না।
জাহাঙ্গীরের বিরাট বক্ষ স্নানের শ্রমে ঘন ঘন আন্দোলিত হইতেছিল, শরীরের সমস্ত মাংসপেশী পরিপূর্ণভাবে ফুলিয়া উঠিয়াছিল। সে এইবার ঘাটে পিছন ফিরিয়া বসিয়া সাবান মাখিতে মাখিতে স্পষ্ট অনুভব করিতে লাগিল, তাহার পৃষ্ঠে একজোড়া খরদৃষ্টির উষ্ণতা আসিয়া লাগিতেছে!
জাহাঙ্গীর এইখানে একটু লাজুক। সে মহিলাদের সঙ্গে অতিমাত্রায় মিশিতে পারে, মিশিতে চায়ও। কিন্তু কোনো মেয়ে একটু খরদৃষ্টিতে চাহিলে সে আর চোখ তুলিতে পারে না। মেয়েদের সে যেমন পছন্দ করে, তেমনই ভয়ও করে। অশ্রদ্ধা মিশ্রিত ভয়।
সে একবার হাজারিবাগের জঙ্গলে শিকারে গিয়াছিল। একদিন রাত্রে সে ফ্লাশ-লাইট দিয়া শিকার খুঁজিতেছিল। হঠাৎ একটা হরিণের চোখে সেই লাইট পড়ায় হরিণ এমন করিয়া সুন্দর ভীতির চাহনি দিয়া তাহার দিকে চাহিয়াছিল, যে, সে আর তাহাকে গুলি করিতে পারে নাই। আজও ইচ্ছা করিয়াই পিছন ফিরিয়া ঘাটে বসিয়া সাবান মাখিতে লাগিল। যে হরিণী তাহার দিকে এখনই এমনি করিয়া তাকাইয়াছিল, জাহাঙ্গীর জানে, ইচ্ছা করিলেই তাহাকে হত্যা করিতে পারে, তবু সে বিরত হইল। তাহার কেমন যেন দয়া হয় উহাদের দেখিলেই! উহাদের চোখ জাদু জানে। উহাকে এড়াইয়া চলাই ভালো – জাদুকরিকে হত্যা করায় পৌরুষ নাই।
নারী – তাহাকে সে যেমন অশ্রদ্ধা করে তেমনই ভালোও বাসে – উহারা সুন্দর জাদুকরি।… জাহাঙ্গীরের রক্ত টগবগ করিয়া ফুটিয়া উঠে, দেহের মাংসপেশীসমূহ প্রস্তরকঠিন হইয়া উঠে। একবার মনে করে, ওই সুন্দর চোখের সুন্দর জীবগুলোকে নির্মম হস্তে সে হত্যা করিতে পারে! উহাদের চোখ সুন্দর, উহাদের মন ছলনায় কুটিল!…
জাহাঙ্গীর যখন স্নান সারিয়া উঠিয়া আসিল, তখন চা হইয়া গিয়াছে।
ভূণী ভিতরে চলিয়া যাইবার জন্য উঠিয়া দাঁড়াইতেই দেখিল, সদ্যস্নাত জাহাঙ্গীর তাহার গ্রিক ভাস্করের নির্মিত মর্মরমূর্তির মতো অনাবৃত দেহ লইয়া দাঁড়াইয়া আছে।
আদিম মানব প্রথম অরুণোদয় দেখিয়া যেমন বিস্ময়ান্বিত চোখে জবাকুসুমসংকাশ তরুণ অরুণের পানে চাহিয়া দেখিয়াছিল, এ তেমনই দৃষ্টি।
জাহাঙ্গীর তাহাকে অপ্রতিভ হইবার অবসর না দিয়া বলিয়া উঠিল, ‘দাঁড়াও ভাই ভূণী, পালিয়ে যেয়ো না। চা-টা যখন তৈরিই করলে, তখন না খাইয়ে আর যেয়ো না। কেমন?’ বলিয়াই মোমির দিকে চাহিয়া বলিল, ‘তোমার এখনও লজ্জা হওয়ার মতো বয়স হয়নি, তুমি কেন অমন জড়-পুঁটুলি হয়ে বসে আছ ভাই?’
মোমি সত্যিই এতক্ষণ বিয়ের কনেটির মতো কাপড় ঢাকা দিয়া এক কোণে বসিয়াছিল, এইবার খুক খুক করিয়া হাসিতে লাগিল এবং একটু পরেই ঘোমটা খুলিয়া হাসিতে হাসিতে দৌড়িয়া ভিতরে চলিয়া গেল।
জাহাঙ্গীর কাপড় বদলাইয়া চৌকাঠটার উপর বসিয়া ভূণীর দিকে হাত বাড়াইয়া বলিল, ‘দাও ভাই, চা-টা দাও!’
ভূণীকে কে যেন মন্ত্র দিয়া বশ করিয়াছে।
মন্ত্রাহত সাপিনির মতো সে না পারিল পালাইতে, না পারিল ফণা তুলিতে।
সে আস্তে আস্তে এক কাপ চা হারুণকে দিয়া দ্বিতীয় কাপটা কাঁপিতে কাঁপিতে জাহাঙ্গীরের হাতে দিল। আর একটু হইলেই পেয়ালাটা পড়িয়া গিয়াছিল আর কী! জাহাঙ্গীর তাড়াতাড়ি পেয়ালাটা ধরিতে গিয়া ভূণীর কয়েকটা আঙুল ধরিয়া ফেলিল। লজ্জা ঢাকিবার জন্য তাড়াতাড়ি চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়া জাহাঙ্গীর চিৎকার করিয়া উঠিল, ‘বাঃ বাঃ কী চমৎকার চা-ই হয়েছে ভূণী!’
ভূণী ততক্ষণে লজ্জায় ঘামিয়া লাল হইয়া উঠিতেছিল। আর একটু থাকিলেই হয়তো সে মূর্ছিত হইয়া পড়িত। কিন্তু তাহাকে আর থাকিতে হইল না। তাহার অন্ধ পিতা উঠিয়া তাহাকে বাড়ির ভিতর হইতে ডাকাডাকি শুরু করিয়া দিলেন। সে তাড়াতাড়ি পালাইয়া বাঁচিল।
হারুণ এতক্ষণে কী যেন ভাবিতেছিল। তাহার আদরের বোনের এই ভাবান্তর সে লক্ষ করিয়াছিল। ইহা লইয়া সে আপন মনে কত কী আকাশ-কুসুমের সৃষ্টি করিতেছিল। কত সুখের স্বপন, কত ভবিষ্যতের রাঙা উৎসবের রাঙা দিন, আরও কত কী!
জাহাঙ্গীর চা খাইতে খাইতে বলিল, ‘ছেলেমানুষ এরা, নাস্তা তৈরি করতে দেরি হবে হারুণ, এসো দুটো বিস্কুট খাই।’ হারুণ আপত্তি করিল না। অন্যমনস্কভাবে বিস্কুট ও চা খাইতে লাগিল।
জাহাঙ্গীর হঠাৎ চিৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিল, ‘এই মোমি! মোমি! আমার চায়ের কাপটা শেষ হয়ে গেছে। তুমি এসে না দিলে আর এক কাপ চা কিছুতেই খাচ্ছিনে!’
মোমি বেড়ার পাশেই উঁকি মারিতেছিল। একটু বাঁকিয়া বাঁকিয়া কাছে আসিয়া চায়ের কাপটা জাহাঙ্গীরের হাতে দিয়া পলাইবার চেষ্টা করিতেই জাহাঙ্গীর খপ্ করিয়া তাহার হাত ধরিয়া ফেলিয়া বলিল, ‘আমার সঙ্গে চা না খেলে আমি কিচ্ছু খাব না কিন্তু!’
হারুণ হাসিয়া বলিল, ‘খা না, এও তোর দাদাভাই!’ জাহাঙ্গীরকে বলিল, ‘ওকে তুমি চেন না জাহাঙ্গীর, ভয়ানক দুষ্টু। একটু আলাপ জমে গেলে তোমায় নাকাল করে ছাড়বে। কোনোদিন রাতে হয়তো তোমার কাছায় বেড়াল-বাচ্চা বেঁধে দেবে। ওর দুষ্টুমির জ্বালায় বাড়ির সকলে অস্থির!’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘সত্যি! তবে রে দুষ্টু, কিছুতেই চা না খাইয়ে ছাড়ছি না তা হলে!’….
একটু পরেই দেখা গেল, মোমি কলিকাতা সম্বন্ধে তাহার অদ্ভুত অদ্ভুত ধারণা লইয়া প্রশ্ন করিয়া জাহাঙ্গীরকে চা খাইবার অবসর পর্যন্ত দিতেছে না।
জাহাঙ্গীরও অকুতোভয়ে বলিয়া যাইতেছিল, ‘কলকাতার লোকগুলোর দাড়ি হয় না, সেখানে কাপড় ময়লা হয় না, চুলের তেড়ি ভাঙে না। সেখানে মানুষ পায়ে হাঁটে না, তারা কোমর পর্যন্ত মানুষ, তার পর চারটে চাকা। তাদের চারটে চারটে চোখ। পুরুষের গোঁফ দাড়ি হয় না। মেয়েরা ছেলেদের মতো করে চুল কাটে; ছেলেরা মেয়েদের মতো চুল বড়ো রাখে। পুরুষে রান্না করে, মেয়েরা থিয়েটার দেখে, নাচে। ছেলেরা বাঁদর হয়ে বাবাকে ভল্লুক করে তার পিঠে চড়ে শ্বশুরবাড়ি যায়, মেয়েরা ডুগডুগি বাজায়!’
এমন সময় হারুণের ছোটো ভাইটি তাহার অন্ধ পিতার হাত ধরিয়া বৈঠকখানায় লইয়া আসিল।
জাহাঙ্গীর তাড়াতাড়ি উঠিয়া তাঁহার পায়ে হাত দিয়া সালাম করিয়া বলিল, ‘কাল আর আপনার সাথে ভালো করে আলাপ করতে পারিনি। আমরা চা খাচ্ছি, একটু দেব? খাবেন?’
হারুণের পিতা খুশি হইয়া বলিলেন, ‘দাও বাবা, দেখি ভূণী কেমন চা করলে! ভূণী চা করতে পেরেছে তো? আমরা তো কেউ খাইনে। আমিও এক কালে প্রায় তোমার মতো চা-খোর ছিলাম বাবা।’ বলিয়াই গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কোনো সুখময় অতীতকে তাঁহার অন্ধ চক্ষু দিয়া যেন দেখিবার চেষ্টা করিলেন!
জাহাঙ্গীরের মন করুণায় ভিজিয়া উঠিল। মুখের চা বিস্বাদ হইয়া উঠিল।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়াই হারুণের পিতা বলিয়া উঠিলেন, ‘সত্যিই, ভূণী চমৎকার চা করেছে তো রে! ভূণী! ও ভূণী!’
ভূণী সলজ্জভাবে দরজার পাশে আসিয়া অধোমুখে আঙুলে আঁচলের প্রান্ত লইয়া জড়াইতে লাগিল।
হারুণ বলিল, ‘ওই ভূণী এসেছে। কিছু বলছিলে তাকে?’
পিতা হঠাৎ কেমন যেন বিষাদের সুরে বলিলেন, ‘না, কিছু না। মোবারক কোথায় গেলি?’
মোবারক হারুণের ছোটো ভাই। ছেলেটি অদ্ভুত – শান্ত ধীর প্রকৃতির। এই বয়সেই যেন বিশ্বের বিষণ্ণতা আসিয়া তাহাকে ছাইয়া ফেলিয়াছে। মুখে চোখে আনন্দের এতটুকু ক্ষীণ রেখাটিও নাই। বর্ণ ফ্যাকাশে সাদা, লিকলিকে, পাঁজরের হাড় কটি গোনা যায়।
মোবারক চা খাইতেছিল। পিতার ডাকে চকিত হইয়া শান্তস্বরে বলিল, ‘এই যে চা খাচ্ছি!’
এরই মাঝে জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘আমরা সকলে চা খাচ্ছি, ভূণী যদি না খাও তাহলে…’
জাহাঙ্গীর আর কিছু বলিবার আগেই হারুণের পিতা বলিয়া উঠিলেন, ‘আয় ভূণী, তোর মা তো এখনও ঘুমুচ্ছেন, তুইও খা না একটু! এমন সোনার ছেলের কাছে কি লজ্জা করতে আছে? মনে কর না, ও তোর মিনা ভাই!’ – বলিয়াই পিতা চায়ের কাপ মাটিতে রাখিয়া পাঁজরফাটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিলেন!
ভূণী আর দ্বিরুক্তি না করিয়া নিজের হাতে চা করিয়া খাইতে খাইতে বলিল, ‘বাবা তুমি চা খাও, এই আমি খাচ্ছি।’
জাহাঙ্গীর দেখিল, ভূণীর দুই আয়ত চক্ষু জলে টইটুম্বর হইয়া উঠিয়াছে। সে আর এ দৃশ্য সহিতে পারিতেছিল না। হঠাৎ সে বলিয়া উঠিল, ‘মোমি এসো তো ভাই, আমরা ওই তোরঙ্গটা খুলি। ওতে কলকাতার বড়ো বড়ো বাঁদর আছে, দেখবে?’
মোমি চিৎকার করিয়া বলিল, ‘ওরে বাপরে! ও কামড়ে দেবে, আমি কুছুতেই খুলতে পারব না!’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া নিজের তোরঙ্গটা খুলিয়া একরাশ কাপড়জামা বাহির করিয়া হারুণের পিতাকে বলিল, ‘আমি এদের জন্য কিছু কাপড়জামা এনেছি, আপনি আদেশ না দিলে ওরা হয়তো নেবে না। ওরা তো আমারও ভাই-বোন!’ একটু থামিয়া আবার বলিল, আমার একটিও ছোটো ভাইবোন নেই বলে আমার এত দুঃখ হয়। তাই বন্ধুদের ভাইবোন নিয়ে সে সাধ মেটাই। ভাই মোমি, এসব নেবে তো ? না নিলে কিন্তু আজই চলে যাব আমি।’
হারুণ একটু উচ্চকণ্ঠেই বলিয়া উঠিল, ‘এসব আবার করেছ কী? এসব দামি কাপড় কিনতে তোমার তিন চারশো টাকার কম পড়েনি যে! এসব কখন করলে বলো তো! মিষ্টি সন্দেশ তো এনেছ বাগবাজার আর শিউড়ি উজাড় করে!’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া একটু নিম্নকণ্ঠে বলিল, ‘এই স্টুপিড, তুমি চুপ করো। সরকার কা মাল, দরিয়া মে ডাল! জমিদারির এত টাকা নিয়ে কী করব? পাপের ধন পরাচিত্তিতে যাক! আমার ভাইবোন থাকলে খরচ করতাম না?’
হারুণের পিতা অত্যধিক খুশি হইয়া একটু ভারীকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, ‘এর পরে আর কী বলব বাবা! খোদা তোমাকে সহি-সালামতে রাখুন, হায়াতদারাজ করুন! তুমি সত্যই আমার ছেলের চেয়ে বড়ো। যে দানে অহংকার নেই, তাকে কি উপেক্ষা করতে আছে?’
ভূণী তাহার জলভরা বড়ো বড়ো দুইটি চোখ তুলিয়া জাহাঙ্গীরের দিকে তাকাইয়া থাকিল। সেই দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা করুণা স্নেহ যেন উছলিয়া পড়িতেছিল।
হারুণের পিতা হঠাৎ হাসিয়া বলিলেন, ‘ওরে ভূণী, মোমি, মোবারক! তোরা যা, নতুন কাপড় পরে দেখা, কেমন মানাল! আর সালাম কর জাহাঙ্গীরকে। নতুন কাপড় পরে যে সালাম করতে হয়।’
মোমি কাপড়ের রাশ লইয়া ভূণীকে হাত ধরিয়া টানিতে টানিতে লইয়া গেল। মোবারক উঠিল না। শান্তভাবে বসিয়া রহিল। কাপড় জামা পাইয়া সে খুশি না বিরক্ত হইয়াছে, কিছুই বোঝা গেল না।
জাহাঙ্গীর একটু আশ্চর্য হইয়া বলিল, ‘মোবারক, অমন করে বসে যে। তোমার বুঝি কাপড় পছন্দ হল না? আচ্ছা দেখো তোমার জন্য কী এনেছি।’
বলিয়াই একটা ফুটবল বাহির করিয়া বলিল, ‘এই নাও। আজ বিকেলে সকলে মিলে ফুটবল খেলা যাবে, কেমন?’
মোবারক তাহার আনত চক্ষু তুলিয়া বিষণ্ণ মলিন দৃষ্টিতে জাহাঙ্গীরের দিকে তাকাইয়া বলিল, ‘আমি তো ফুটবল খেলিনে। ও সময় বাবাকে নিয়ে একটু বেড়িয়ে আসি।’
জাহাঙ্গীরের মন দুঃখের ম্লানিমায় মলিন হইয়া উঠিল। সে কেমন যেন হাঁপাইয়া উঠিতে লাগিল। এত দুঃখের মাঝেও মানুষ বাঁচে কেমন করিয়া।
একটু আলাপ-সালাপ হইতেই মোমি তাহার সিল্কের জামাকাপড় পরিয়া আসিয়া জাহাঙ্গীরের পায়ে হাত দিয়া সালাম করিয়া বলিল, ‘তোমরা সকলে ভিতরে এসো, নাস্তা করবে।’
ভিতরবাটীতে যাইতে যাইতে হারুণ হাসিয়া বলিল, ‘গ্রিন রংটা তোকে বেড়ে মানিয়েছে তো রে মোমি! দেখেছ, মোমির আর্ট-জ্ঞান হয়েছে!’ বলিয়াই তাহার মাদ্রাজি ঢং-এ কাপড় পরিবার ধরনটার দিকে ইঙ্গিত করিল।
জাহাঙ্গীরও সে হাসিতে যোগ দিয়া বলিল, ‘সত্যই ওকে তো সুন্দর মানিয়েছে! কাপড় পরাটাও সুন্দর হয়েছে।’
মোমি জাহাঙ্গীরের হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া যাইতে যাইতে বলিল, ‘ও আল্লা! এ আমি বুঝি পরেছি? বুবু পরিয়ে দিয়েছে! বুবুকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে! দেখবেন চলুন!’
জাহাঙ্গীর তাড়া দিয়া বলিল, ‘আবার আপনি? “তুমি” বলবে। আর “দাদা ভাই” – কেমন?’
মোমি বড়ো বড়ো দু-চক্ষু কপালে তুলিয়া বলিয়া উঠিল, ‘ও মা! কী হবে! এক দিনেই নাকি একটা মিনসেকে তুমি বলা যায়!’ সকলে হোহো করিয়া হাসিয়া উঠিল। মোমি লজ্জা পাইয়া ছুটিয়া পলাইল।
ভিতরে গিয়া বসিতেই শোনা গেল, হারুণের মাতা জাগিয়া উঠিয়া ভূণীর সাজসজ্জা দেখিয়া কাঁদিয়া বলিলেন, ‘ওরে মা, তুই শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে আমি থাকব কী করে? আমার মিনার মতোই যে তোর চোখ মুখ। মা তুই শ্বশুরবাড়ি যাসনে! দামাদ মিয়াঁকে (জামাই) বল, সে ঘরজামাই থাকবে।’
জাহাঙ্গীর হাসিবে না কাঁদিবে ভাবিয়া পাইল না। হারুণ তাড়াতাড়ি ভিতরে গিয়া ভূণীকে বলিল , ‘ভূণী তুই বাইরে চলে আয় না!’ কিন্তু আর কিছু বলিবার আগেই ভূণীকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, ‘সত্যি ভূণী, এতে আর দোষ কী! আমিই যে চিনতে পারছিনে! মনে হচ্ছে বিয়ের কনে! কী সুন্দরই মানিয়েছে, দেখ দেখ।’ বলিয়াই আয়না লইয়া মুখের কাছে ধরিল।
ভূণী মুখ সরাইয়া লইয়া বলিল, ‘যাও! তা হলে সব খুলে ফেল বলছি! আমি কিছুতেই বাইরে যেতে পারব না। মা গো! কেন এ সব পরলুম!’
সে প্রায় কাঁদিয়া ফেলিল!
জাহাঙ্গীর বাহির হইতে বলিল, ‘কী হচ্ছে হারুণ? তুমিও তো কম দুষ্টু নও!’
হারুণ হাসিয়া বলিল, ‘জাহাঙ্গীর! তোমার পাওনা সালামটা নিতে তুমিই ভিতরে এসো ভাই। ও বলেছে, এ রকম করে সেজে কিছুতেই বাইরে যাবে না। অর্থাৎ কিনা তোমার সামনে বার হবে না।’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া ভিতরে যাইতেই ভূণী একবার তাহার দিকে তাকাইয়াই তাহার মায়ের বিছানায় বসিয়া পড়িয়া বালিশে মুখ লুকাইল। জাহাঙ্গীর কেমন যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া গেল।
হারুণ ভূণীর মুখ জোর করিয়া তুলিয়া বলিল, ‘ওরে, একবার দেখা ভালো করে! আর, যে সালামের লোভে জাহাঙ্গীর বেচারা পা দুটোকে ভিতরবাড়ি পর্যন্ত টেনে আনলে, তার থেকেই বঞ্চিত করলি বেচারাকে? ওঠ, সালাম কর।’
কিন্তু উঠাইতে গিয়া হারুণ দেখিল, চোখের জলে ভূণীর মুখ ভাসিয়া গিয়াছে। সেই অশ্রুসিক্ত চোখ না মুছিয়া সে যেমন জাহাঙ্গীরকে সালাম করিতে যাইবে, অমনি এক অভাবনীয় কাণ্ড হইয়া গেল!
ভূণীর উন্মাদিনী মাতা এতক্ষণ উদাস নির্বিকার চক্ষে সমস্ত দেখিতেছিলেন। কিছু বুঝিতেছিলেন বলিয়া বোঝা যাইতেছিল না।
ভূণীর উন্মাদিনী মাতা এতক্ষণ উদাস নির্বিকার চক্ষে সমস্ত দেখিতেছিলেন। কিছু বুঝিতেছিলেন বলিয়া বোঝা যাইতেছিল না।
মাথার ওপর বজ্রপাত হইলেও বুঝি সকলে এমন স্তম্ভিত হইত না! হারুণ, জাহাঙ্গীর, ভূণী ওরফে তহমিনা সকলে যেন প্রস্তরীভূত হইয়া গিয়াছে।
হঠাৎ ভূণীর চোখের দিকে তাকাইয়া জাহাঙ্গীর কাঁপিয়া উঠিল। সে ধরিবার পূর্বেই ভূণী মূর্ছিতা হইয়া তাহার স্কন্ধে এলাইয়া পড়িল!
উঠানের আমগাছটায় বসিয়া একটা পাপিয়া পাখি ডাকিয়া উঠিল, চোখ গেল! চোখ গেল! উঁহু উঁহু চোখ গেল!