কুহেলিকা – ০৬
শিউড়ি যখন তাহারা পঁহুছিল, তখন রাত্রি বেশ ঘনাইয়া আসিয়াছে।
হারুণ বলিল, ‘এখন, কী করা যায় বলো তো? এখানেই রাত্রিটা কাটিয়ে দেবে না শহরে যাবে! শহরে আমার এক দূর-সম্পর্কীয় আত্মীয় আছেন, যদি তোমার মত হয় সেখানেও যেতে পারি।’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘দূর সম্পর্কের আত্মীয়বাড়ির চেয়ে স্টেশনের প্লাটফর্ম ঢের বেশি সোয়াস্তিকর হারুণ। ব্যাস! খোলো গাঁঠরি! এমন চাঁদনি রাত, প্লাটফর্মে শুয়ে দিব্যি রাত্তির কাটিয়ে দেওয়া যাবে। আর, যদি বল রাত্তিরেই তোমার বক্কেশ্বর পাড়ি দিতে হবে, তাতেও রাজি।’
হারুণও হাসিয়া বলিল, ‘বেশ, সেই ভালো। কিন্তু প্লাটফর্মের কাঁকরগুলো সারা রাত্তির হয়তো পিঠের সঙ্গে রসিকতা করবে।’
জাহাঙ্গীর তোরঙ্গটার উপর বসিয়া পড়িয়া বলিল, ‘কাঁচকলার কবি তুমি। এমন চাঁদনি রাতের চাঁদোয়ার তলে শুয়েও যে পিঠের তলায় কাঁকরগুলোকে তুলতে পারে না, সে হচ্ছে – কী বলে ইয়ে এই – পাটের দালাল!’
হারুণ হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, ‘এ কীরকম উপমাটা হল?’
জাহাঙ্গীর কৃত্রিম কোপ প্রকাশ করিয়া বলিল, ‘ড্যাম ইয়োর উপমা! তোমার ওই উপমার লেসবুনুনি দিয়ে মানুষের মোক্ষলাভ হবে না! যত সব কুঁড়ে আঁস্তাকুঁড়।’
হারুণ বলিল, ‘কিন্তু এই কুঁড়ের আস্তাকুঁড়েই পদ্মফুল ফোটে জাহাঙ্গীর!’
জাহাঙ্গীর সিগারেটের মুখাগ্নি করিতে করিতে বলিল, ‘সে আস্তাকুঁড়ে নয় কবি, সে ফোটে তোমাদের ওই মাথার গোবরে! কিন্তু ও কাব্যালোচনা এখন চুলোয় যাক, এ সিগারেটের ধোঁয়ায় তো আর পেট ভরবে না। পেটের ভিতর যে এদিকে বেড়াল আঁচড়াচ্ছে। তুমি এই সব পাহারা দাও, আমি চললাম খাদ্যান্বেষণে।’
হারুণ কী বলিতে যাইতেছিল, তাহাকে এক দাবড়ানিতে থামাইয়া দিয়া জাহাঙ্গীর চলিয়া গেল। হারুণ নিরুপায় হইয়া প্লাটফর্মে পরিপাটি করিয়া বিছানা পাতিয়া গা এলাইয়া শুইয়া পড়িল।
গ্রীষ্মের সচন্দ্রা যামিনী। তাপদগ্ধ আকাশের নীল দেহে কে যেন গোপী-চন্দন অনুলিপ্ত করিয়া দিয়াছে। রৌদ্রদগ্ধ দিবস, রাত্রির শীতলকোলে মাথা রাখিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। বাঁদির মতো তরুর সারি দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া কেবল বীজন করিতেছে।
আবেশে তন্দ্রায় হারুণের চক্ষু জড়াইয়া আসিল। এই দুঃখের অভাবের ধুলার পৃথিবী তাহার স্বপ্নে অপরূপ হইয়া ফুটিয়া উঠিল। ইহার হাসি যেমন মায়াবী, ইহার অশ্রুও তেমনই জাদু জানে। এই মায়াবিনীকে তাহার একটি ক্ষীণাঙ্গী বালিকার মতো করিয়া বুকে চাপিয়া ধরিতে ইচ্ছা করিল!
হঠাৎ জাহাঙ্গীরের রাম-ঠেলায় সচকিত হইয়া হারুণ উঠিয়া বসিয়া দেখিল, ‘জাহাঙ্গীরের খাদ্যান্বেষণ’ ব্যর্থ হয় নাই। শিউড়ির যাহা কিছু ভালো বলিয়া প্রসিদ্ধি আছে, সে তাহার সব কিছুই চ্যাঙারি বোঝাই করিয়া আনিয়াছে।
হারুণ বলিল, ‘শিউড়ির খবর আমার চেয়ে তুমিই বেশি রাখ দেখছি। তুমি শহরে গিয়ে বুঝি এই সব কাণ্ড করে এলে? কিন্তু এই সব খেয়ে শেষ করতে হলে সকাল পর্যন্ত খেতেই হবে, ঘুমটুম বাদ দিয়ে।’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘আচ্ছা, আরম্ভ তো করা যাক, তার পর তোমার কপাল আর আমার হাতযশ!’
খাওয়া শেষ হইলে জাহাঙ্গীর একা প্লাটফর্মে অন্যমনস্কভাবে পদচারণা করিতে লাগিল। হারুণ জাহাঙ্গীরের এই অন্যমনস্কতায় বিস্মিতও হইল না, ব্যাঘাতও জন্মাইল না। অনেককেই সে বলিতে শুনিয়াছে, জাহাঙ্গীরের মাথায় ছিট আছে। সে ইহা বিশ্বাস করে নাই। জাহাঙ্গীরের সঙ্গে বন্ধুত্ব তাহার যথেষ্ট হইয়াছে, কিন্তু তাহাকে সে আপনার চোখ ও মন দিয়া যতটুকু দেখিয়াছে, তাহার অধিক জানিবার মতো অতি-কৌতূহল তাহার কোনোদিনই জাগে নাই। তাহার স্বভাবই এই। তাহা ছাড়া সে ইহাও মনে করে যে, যে স্বেচ্ছায় যতটুকু পরিচয় দেয়, তাহার অধিক জানিতে চেষ্টা করা খুব সুমার্জিত রুচির পরিচয় নয়। সে বলিত, কৌতূহল জিনিসটাই কদাকার। যাহা কেহ নিজে বলিতে চাহে না, তাহার উপর জুলুম করা বর্বরতারই কাছাকাছি। জাহাঙ্গীরকে যখন আর সকলে পাগল মনে করিত, তখন কেবল হারুণই ইহার পাগলামির, ইহার ছন্নছাড়া জীবনের মূলে কোনো সুগভীর বেদনা-উৎসের সন্ধান করিত। মানুষের বেদনাকে সে অশ্রদ্ধা করিতে শিখে নাই। তাই জাহাঙ্গীরের বেদনার উৎস-মূল জোর করিয়া খুঁড়িয়া বাহির করিতে চাহে নাই।
জাহাঙ্গীরের ইতিহাস সে তো জানেই না, অন্য ছাত্ররাও জানে না! জাহাঙ্গীরের পিতার মৃত্যুর পর যখন তাহার পিসতুতো ভায়েরা সম্পত্তি দাবি করিয়া নালিশ করিল, তখন তাহার বুদ্ধিমতী জননী এ কেলেঙ্কারি বেশি দূর পড়াইবার পূর্বে কী করিয়া যে ইহা চাপা দিয়া ফেলিল, তাহা দুই চারিজন ছাড়া কেহই জানিতে পারিল না। অবশ্য, ইহার জন্য তাহাদের বিপুল জমিদারির প্রায় এক চতুর্থাংশ আয় কমিয়া গেল। তাহার পিসতুতো ভায়েদের অবস্থা অত বড়ো মামলা চালাইবার মতো স্বচ্ছল ছিল না। জাহাঙ্গীরের মনও ধূমে বিষাক্ত হইয়া উঠিল, কিন্তু একেবারে দগ্ধীভূত হইল না। এই সান্ত্বনাটুকুই তাহার জীবনে বড়ো সম্বল হইয়া রহিল। এতদিন হয়তো সে সত্যই পাগল হইয়া যাইত, অথবা আত্মহত্যা করিত, শুধু স্বদেশ উদ্ধারের মন্ত্রই তাহাকে বাঁচিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছে, তাহার দগ্ধ জীবনকে প্রদীপ-শিখা করিয়া ঊর্ধ্বেতুলিয়া ধরিয়াছে। মরিতেই যদি হয়, জন্মের মতো অপরাধকে জীবনের জ্যোতিতে জ্যোতির্মহিমান্বিত করিয়া সে মরিবে।
কাজেই তাহারা এত সহজে অভাবনীয় রূপে যে সম্পত্তি পাইল, তাহাতে সন্তুষ্ট হইয়া তাহাদের সমস্ত দাবি পরিত্যাগ করিল, এমনকী, তাহারা আদালতে স্বীকারও করিল যে, জাহাঙ্গীর সত্যসত্যই খানবাহাদুরের বিবাহিত পত্নীর পুত্র। ইহা লইয়া ‘রায়-বাঘিনী’ জমিদারনির প্রতাপে জমিদারিতে কানাঘুষাও হইতে পারিল না। কাজেই এ ব্যাপার অনেকের মনে মনে ধোঁয়াইলেও আগুন হইয়া দেখা দিল না।
জাহাঙ্গীর যখন তন্ময় হইয়া পায়চারি করিতেছিল, তখন হারুণ আস্তে আস্তে উঠিয়া স্টেশন হইতে শহরে বেড়াইতে গেল। এই বেদনাতুর জাহাঙ্গীরকে সে যেন সহ্য করিতে পারিত না। তাহার এই মূর্তি সে যখনই দেখিয়াছে, তখনই তাহার বুক ব্যথায় মোচড় খাইয়া উঠিয়াছে। আজও সে সহিতে না পারিয়াই সরিয়া গেল। জাহাঙ্গীরের সম্মুখ দিয়াই সে চলিয়া গেল, কিন্তু জাহাঙ্গীর একটি কথাও বলিল না। এমনকি, তাহাকে দেখিয়াছে বলিয়াও মনে হইল না। কোন আবর্তে পড়িয়া সে তখন হাবুডুবু খাইতেছি, তাহা তাহার অন্তর্যামী ছাড়া কেহ জানিল না।
অন্যমনস্কভাবে পথ চলিতে চলিতে হারুণ যখন শহরে আসিয়া পড়িল, তখনও সমস্ত দোকানপাট বন্ধ হইয়া যায় নাই। সম্মুখে এক মনোহারীর দোকান দেখিয়া তাহার মনে পড়িয়া গেল, টাকার অভাবে সে তাহার ভাই বোনদের জন্য কলিকাতা হইতে তেমন কিছু আনিতে পারে নাই। জাহাঙ্গীর জোর করিয়া তাহাকে টিকিট কিনিতে দেয় নাই। রাস্তায়ও তাহার কোনো খরচ হয় নাই। ইহাতে তাহার যে চার পাঁচটি টাকা বাঁচিয়াছে, তাহা দিয়া সে তাহার ভাই-বোনদের জন্য সাবান, চিরুনি, ফিতা, গন্ধতেল প্রভৃতি কিনিল। ওই কয়টি টাকায় যাহা ক্রয় করিল, তাহা তাহার মনঃপুত হইল না। নিজের অসহায় অবস্থার কথা ভাবিয়া তাহার দুই চক্ষু জলে ভরিয়া উঠিল। হঠাৎ তাহার মন খুশিতে ও বেদনায় ভরিয়া উঠিল, একটা কথা স্মরণ করিয়া। জাহাঙ্গীরের তোরঙ্গটা সে প্রথমে দেখে নাই, কিন্তু দেখা অবধি তাহার আর জানিতে বাকি নাই যে, জাহাঙ্গীর তাহার ভাই-বোনদের জন্যই কাপড়-চোপড় কিনিয়া লইয়া যাইতেছে।
অত খাবার যে সে একটু আগে লইয়া গিয়াছে – তাহার অর্থও সে বুঝিল। ইহাতে সে তাহাদের অভাবের সংসারে লালিত ভাই-বোনগুলির জন্য যেমন খুশি হইয়া উঠিল, তেমনই – বন্ধুর নিকট হইলেও – সেই আত্মীয়তাকে কিছুতেই প্রসন্ন মনে গ্রহণ করিতে পারিল না। তাহার মন কেবলই বলিতে লাগিল, জাহাঙ্গীর এই পাগলামি করিয়া আমাদের দুর্দশার কথাটা স্মরণ না করাইয়া দিলেই ভালো হইত। ব্যথায় তাহার মন অপ্রসন্ন হইয়া উঠিল। বহুক্ষণ ধরিয়া উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘুরিয়া ফিরিয়া সে যখন প্লাটফর্মে আসিয়া উপস্থিত হইল, তখনও জাহাঙ্গীর তেমনই পায়চারি করিয়া ফিরিতেছে। সে কিছু না বলিয়া শুইয়া পড়িল। এই উন্মাদকে দেখিয়া তাহার মনের অনেকটা জ্বালা শান্ত হইয়া আসিল। ইহার বিরুদ্ধে তাহার মন যেটুকু অপ্রসন্ন হইয়া উঠিয়াছিল, তাহা তাহার কবি-মনের করুণ সহানুভূতির প্রীতিতে ধুইয়া মুছিয়া গেল।
আজ তাহার প্রথম মনে হইল, জাহাঙ্গীর শুধু তাহার চেয়ে দুঃখীই নয়, – তাহার চেয়েও সে দরিদ্র, সে সর্বহারা!