কুহেলিকা – ০৫
গ্রীষ্মের ছুটি হইয়া গিয়াছে। ছাত্রদের যৌবনোন্মুখ মন অকারণ সুখে কানায় কানায় পুরিয়া উঠিয়াছে। তাহারা আজ তাহাদের সুদূর পল্লির নব-মুকুলিত আম্রবীথির গন্ধস্বপন দেখিতেছে।
হারুণ বাড়ি যাইবার জন্য সমস্ত গুছাইয়া তাহার খালি তক্তপোশের উপর শুইয়া কী যেন চিন্তা করিতেছিল। তাহার দেশের ট্রেন ছাড়িবার তখনও পাঁচ ছয় ঘণ্টা দেরি। পশ্চাৎ হইতে কাহার কেশাকর্ষণে চমকিয়া উঠিয়া সে দেখিল, জাহাঙ্গীর ওরফে উলঝলুল দাঁড়াইয়া সিগারেট টানিতেছে! হঠাৎ সে বলিয়া উঠিল, ‘তোমার ট্রেন কয়টায় হারুণ?’
হারুণ মৃদু হাসিয়া বলিল, ‘কেন, তুমিও যাবে নাকি আমার সাথে।’
জাহাঙ্গীর পকেট হইতে দুইখানা টিকিট বাহির করিয়া দেখাইল, সে আগেই শিউড়ি পর্যন্ত দুইখানা টিকিট করিয়া রাখিয়াছে।
হারুণ বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া জাহাঙ্গীরের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। হঠাৎ সে কণ্ঠে করুণ আবেদন ঢালিয়া বলিয়া উঠিল, ‘কিন্তু তোমার তো সেখানে যাওয়া হতে পারে না ভাই।’
জাহাঙ্গীর গম্ভীরভাবে হাই তুলিয়া তুড়ি মারিয়া আলস্য-জড়িত-স্বরে বলিল, ‘তুমি জান না হারুণ, আমার যাওয়া হবেই, তোমার যদি না-ই হয়।’
হারুণ তাহার বলিবার ভঙ্গি দেখিয়া হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, ‘তুমি জান না জাহাঙ্গীর, সে কী রকম অজপাড়াগাঁ। সেখানে চামচিকের মতো মশা–’
হারুণ আর কিছু বলিবার আগেই জাহাঙ্গীর কৃত্রিম ভীত স্বরে বলিয়া উঠিল, ‘বাদুড়ের মতো মাছি, বন্য বরাহের মতো ইঁদুর, হারুণের মতো বাঁদর! এই তো, না আর কিছু?’
হারুন হতাশ হইয়া বলিল, ‘সত্যি ভাই লক্ষ্মীটি! তুমি কিছু মনে কোরো না! সেখানে তোমার অসুবিধার একশেষ হবে! সর্বপ্রথম তো, শিউড়ি থেকে পাঁচটি কোশ পথ “শ্রীচরণ মাঝি ভরসা” করে পাড়ি দিতে হবে। মাঝরাস্তায় বক্কেশ্বর নদী –’
জাহাঙ্গীর নিশ্চিন্ত-আরামে সিগারেট টানিতে টানিতে বলিল, ‘সে বৈতরণিতে তরণি নাই, কর্ণধার নাই, ভীষণ স্রোত, স্রোতে ভীষণ হাঙর, কুম্ভীর, তিমি, সর্প, এই তো? কিন্তু আমি জানি হারুণ, এ-সবের একটাও নেই সেখানে। আর যদি থাকেও তবে –
‘আল্লা আল্লা বইল্যা রে বাই নবি কইর্যা সার, মাজা বাইন্দ্যা চইল্যা যাইবাম ভব নদীর পার!’ বুঝলে? অদৃশ্য কর্ণধারকে একেবারে অষ্টরম্ভা দেখিয়ে গোপালকাছা হয়ে উসপার!’
হারুণ এইবার একেবারে হাল ছাড়িয়া দিয়া বসিয়া পড়িল। বন্ধু তাহার বাড়ি যাইবে, ইহাতে সে আনন্দিত যেমন হইতেছিল, তেমনই তাহার অসোয়াস্তির আর অন্ত ছিল না তাহার বাড়ির দুরবস্থার কথা ভাবিয়া। উপবাস অবশ্যই সেখানে করিতে হইবে না, কিন্তু জাহাঙ্গীরের মতো এত সুখে লালিতপালিত জমিদার-পুত্রকে যথেষ্ট আদর-আপ্যায়ন করিবার মতো সম্বলও তাহাদের নাই। এই দৈন্যের স্মৃতিই তাহার মনকে পীড়িত করিয়া তুলিতেছিল। অসহায়ের নিষ্ফল ক্রন্দনের বাষ্পে তাহার আঁখি বারেবারে করুণ হইয়া উঠিতেছিল। কিন্তু জাহাঙ্গীরের এই অকপট বন্ধুত্বের সরলতায়, এই আত্মীয়তার দাবিতে তাহার কবি-মন ভিজিয়া উঠিল। এতক্ষণ সে ‘মরিয়া হইয়া’ চেষ্টা করিতেছিল, জাহাঙ্গীরের কিছুতেই যাওয়া হইতে পারে না, কিন্তু এখন আর সে প্রতিবাদ করিল না। উলটো, কেমন এক খুশিতে তাহার সারা মন অভিষিক্ত হইয়া উঠিল। তাহার কল্পনাপ্রবণ হৃদয় সকল কিছু ত্রুটি অভাবকে রঙিন করিয়া দেখিতে লাগিল তাহার সুদূর পল্লি-নীড় যেন তাহার সকল অভাব অপূর্ণতার জন্যই বেশি করিয়া সুন্দর মনে হইতে লাগিল। তাহার স্বাভাবিক বিষন্ন মুখ খুশিতে প্রভাতের ফুলের মতো সুন্দর দেখাইতে লাগিল।
জাহাঙ্গীর ইচ্ছা করিয়াই অতি সাদাসিধে গোটাকতক জামা-কাপড় লইয়া একটা ছোটো বেতের বাক্সে ভরিল। তাহার পর দুই জন এক সঙ্গে স্নান আহার সারিয়া স্টেশন অভিমুখে যাত্রা করিল। হ্যারিসন রোড ও কলেজ স্ট্রিটের জংশনে টাক্সি আসিতেই জাহাঙ্গীর কী মনে করিয়া হঠাৎ গাড়ি হইতে নামিয়া পড়িল। ট্যাক্সিওয়ালাকে সেইখানে থামিতে বলিয়া হারুণের দিকে তাকাইয়া বলিল, ‘এক্ষুনি আসছি’ বলিয়াই সে কলেজ স্ট্রিট মার্কেট অভিমুখে দ্রুতপদে চলিয়া গেল।
আধ ঘণ্টা পরে যখন সে মস্ত একটা তোরঙ্গ নিজেই ঘাড়ে করিয়া আসিল, তখন হারুণ যেন কোথায় কোন স্বপ্নলোকে হারাইয়া গিয়াছে। জাহাঙ্গীর তোরঙ্গটা ট্যাক্সিতে দিয়া ট্যাক্সিচালককে যখন যাইতে বলিল, তখনও হারুণ তন্দ্রাবিষ্ট হইয়া কী যেন ভাবিতেছে।
জাহাঙ্গীর হারুণের বাহুতে এক রাম-চিমটি দিয়া গম্ভীরভাবে অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া সিগারেট ফুঁকিতে লাগিল।
হারুণ প্রায় লাফাইয়া উঠিয়া বলিল, ‘উহ্ঃ! এ কী! তুমি এলে কখন?’ – বলিয়া বাহুতে হাত বুলাতেই লাগিল।
জাহাঙ্গীর উদাস স্বরে বলিল, ‘জগতে শুধু কবির স্বপ্নই নাই কবি, অ-কবির রাম চিমটিও আছে!’
হারুণ হাসিয়া বলিল, ‘এর পরেও যদি তাতে সন্দেহ প্রকাশ করি, তা হলে হয়তো তুমি ট্যাক্সি থেকে ঠেলে ফেলে দিয়ে বলবে, যে, কবির স্বপ্নলোকের চেয়েও সত্যি এই মাটির পৃথিবীটা এবং ওই মাড়োয়ারি-কণ্টকিত ফুটপাথটা!’
হঠাৎ হারুণ দেখিতে পাইল ট্যাক্সি হাওড়া স্টেশনের দিকে না যাইয়া বাগবাজারের দিকে ছুটিতেছে। সে একটু চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, ‘ওহে জাহাঙ্গীর, এ যে, বাগবাজার এসে পৌঁছলুম আমরা। এখানে হাওড়া স্টেশন পাওয়া যায় নাকি?’
জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘না, এখানে পাওয়া যায় চণ্ডু আর রসগোল্লা।’
হারুণ হাসিয়া বলিল, ‘ বুঝেছি! তুমি আজকাল ওই প্রথম চিজটা একটু বেশি করেই টানছ মনে হচ্ছে।’
ট্যাক্সি এক সন্দেশের দোকানের সামনে আসিয়া থামিতেই জাহাঙ্গীর হাসিয়া বলিল, ‘দেখলে! ট্যাক্সিরও রসবোধ আছে!’ বলিয়াই সে নামিয়া পড়িল।
হারুণ হতাশ হইয়া বলিল, ‘আজ স্টেশনে বসে বসে ওই মিষ্টিই খেতে হবে। ট্রেন আর পাওয়া যাচ্ছে না।…
গ্রীষ্মের রৌদ্রদগ্ধ মধ্যাহ্ন।….
উল্কাবেগে মাঠ-ঘাট-প্রান্তর বাহিয়া চলিয়াছে ট্রেন। সুখে আলস্যে হারুণ ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। শুধু জাহাঙ্গীর জানালার বাহিরে মুখ রাখিয়া রৌদ্র-প্রতপ্ত আকাশের চোখে চোখ রাখিয়া চাহিয়া আছে। ট্রেনের প্রচণ্ড গতিবেগকে ছাড়াইয়া ছুটিয়া চলিয়াছে তাহার মন ওই তাপদগ্ধ আকাশের পানে। সে যেন আকাশের ওই তপ্ত ললাটে ললাট রাখিয়া তাহার ললাটের জ্বালা অনুভব করিবে। মধ্যাহ্নের দীপ্ত সূর্য তখন আগুন বৃষ্টি করিতেছে। তপ্ত চুল্লির সম্মুখে বালিকাবধূর মতো ধরণি এলাইয়া পড়িয়াছে।
জাহাঙ্গীর দুই হাত তুলিয়া ললাট স্পর্শ করিয়া মধ্যাহ্ন-দিনের সূর্যকে নমস্কার করিল। তাহার চক্ষু জলে টইটুম্বুর হইয়া উঠিল। সেই অশ্রুসিক্ত চক্ষু সূর্যের পানে তুলিয়া ধরিয়া সে আপন মনে বলিতে লাগিল, জানি না বন্ধু, তোমার বুকে কীসের এ জ্বালা! কোন অভিমানে তুমি পুড়াইয়া মারিতেছ এই শান্ত ধরণিকে! আমার এ-বুকে তোমারই মতো জ্বালা বন্ধু! কিন্তু সে জ্বালায় জ্বলিয়া আমিও কেন তোমার মতো মধ্যাহ্ন-দিনের সূর্য হইয়া উঠি না? কেন আমার জ্বালা তাহার জ্বালার সাথে আলোও দান করিতে পারে না?
ছোট! ছোট! ওরে যন্ত্ররাজের দুরন্ত শিশু! ছোট তুই আরও – আরও – আরও বেগে! নিয়ে চল একেবারে ওই সূর্যের বহ্নিপিণ্ডের বুকে। চল–চল ওরে ধরার ধূমকেতু। চল ওই জ্বালা-কুণ্ডের হামাম-সিনানে! ঝাঁপাইয়া পড়, যেমন করিয়া কোটি কোটি উল্কাপিণ্ড ঝাঁপাইয়া পড়িতেছে ওই জ্বালা-কুণ্ডে!
হুম