কুহেলিকা – ০৪
স্বদেশমন্ত্রে দীক্ষা লওয়ার কয়েক মাস পরেই জাহাঙ্গীরের পিতা খান বাহাদুর ফররোখ সাহেবের হৃদরোগে মৃত্যু হইল। জাহাঙ্গীর তখন পঞ্চদশ বর্ষীয় বালক, সবেমাত্র সেকেন্ড ক্লাস হইতে ফার্স্ট ক্লাসে প্রমোশন পাইয়াছে। এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় তাহার মনে হইল, সে যেন পথ চলিতে চলিতে সহসা এক ইঁদারার মধ্যে পড়িয়া গিয়াছে। কিন্তু যে ভয় সে করিয়াছিল, তাহা হইতে মুক্তি দিলেন আসিয়া তাহার মাতা – ফিরদৌস বেগম। আঁখির অশ্রু না শুকাইতেই তিনি সমস্ত স্টেট পরিচালনের ভার স্বহস্তে গ্রহণ করিলেন। জাহাঙ্গীর পরিপূর্ণ মুক্তির আনন্দে একেবারে ছোটো খোকাটির মতো তাহার মায়ের কোলে শুইয়া আদর-আবদারে মাকে অভিভূত করিয়া ফেলিল। মা অঞ্চলে অশ্রু মুছিয়া পুত্রের ললাট চুম্বন করিয়া বলিলেন, ‘আচ্ছা, এ সবকে যে এত ভয় করিস, আমি মরলে তখন করবি কী বল তো? এত বড়ো জমিদারি তুই না দেখলে আমি মেয়েমানুষ কি একা দেখতে পারব? পাঁচ-ভূতে হয়তো সব চুরি করে খেয়ে নেবে।’ জাহাঙ্গীর সব বুঝিল। তার চক্ষু অশ্রুভারাক্রান্ত হইয়া উঠিল। সে পিতাকে একটু অহেতুক ভয় করিলেও ভালোবাসিত প্রাণ দিয়া। মায়ের কোলে মুখ লুকাইয়া সে অনেকক্ষণ ধরিয়া কাঁদিল; মা বারণ করিলেন না, শুধু গাঢ় স্নেহে পুত্রের মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন – যেন তাহার সমস্ত অকল্যাণ দুই হস্তে মুছিয়া লইবেন!…
পিতা-মাতা জাহাঙ্গীরকে যেন অতিরিক্ত সতর্কতার সহিত রক্ষা করিতেন। জাহাঙ্গীর তাহাকে অতি-স্নেহ ব্যতীত আর কিছু মনে করিতে পারে নাই। সে কিন্তু এতদিন একটু-আধটু বুঝিতেছিল যে, তাহাকে পিতা তাঁহার আত্মীয়দের সাথে মেলামেশা তো দূরের কথা, দেখাশুনা পর্যন্ত করিতে দিতে নারাজ। তাহাদের দেশ ও জমিদারি কুমিল্লায় – কিন্তু আজও সে কুমিল্লা দেখিল না। ছুটি হইলেই তাহার পিতামাতা তাহাকে ওয়ালটেয়ার, পুরী, আগ্রা, ফতেপুর, দিল্লি, লাহোর লইয়া ফিরিতেন। জমিদারি-সংক্রান্ত ব্যাপারে কুমিল্লা আসিতে হইলে ফররোখ সাহেব একাই আসিতেন। স্ত্রী-পুত্র কাহাকেও সঙ্গে লইতেন না।
জাহাঙ্গীর ছেলেবেলা হইতে একটু পাগলাটে ধরনের। লোকে বলিত, ‘বড়োলোকের ছেলে বলেই ইচ্ছা করে ওই রকম পাগলামি করে রে বাবা! বাপের অত টাকা থাকলে আমরাও পাগল হয়ে যেতাম। আদুরে গোপাল, “নাই” পেয়ে বাঁদর হয়ে উঠছে!’ –অবশ্য, বলিত তাহারা গোপনেই এবং তাহারা ফররোখ সাহেবেরই কর্মচারী।
বড়োলোকের ছেলের পাগলামির মধ্যে তবু একটা হয়তো শৃঙ্খলা থাকে – মানে থাকে, কিন্তু জাহাঙ্গীরের চলাফেরা বলা-কওয়ার না ছিল মাথা, না ছিল মুণ্ডু। এই হয়তো বাচালের মতো বকিয়া যাইতেছে, পরক্ষণেই ধ্যানীর মতো অতল নীরবতায় মগ্ন হইয়া গেল। এবং এই রকম নীরব সে দিনের পর দিন থাকিতে পারিত। তাহার এই মগ্নতার দিকটাই প্রমত্তকে এত আকৃষ্ট করিয়াছিল এবং তাই সে জাহাঙ্গীরকে বিপ্লবের গোপনমন্ত্রে দীক্ষা দিতে সাহস করিয়াছিল।…
ইহারই কয়েক দিন পর জাহাঙ্গীর ঝটিকা-উৎপাটিত মহিরুহের মতো মায়ের পদতলে আছাড় খাইয়া পড়িয়া আর্তনাদ করিয়া বলিল, ‘বলো মা, এ কি সত্যি? এ-সব কী শুনি?’
ফিরদৌস বেগম পুত্রের এই অগ্ন্যুৎদ্গার-উন্মুখ আগ্নেয়গিরির মতো ধূমায়মান চোখমুখ দেখিয়া রীতিমতো ভয় খাইয়া গিয়াছিলেন। তাহার মুখ দিয়া কথা সরিতেছিল না। সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করিয়া তিনি কোনো-রূপে শুধু বলিতে পারিলেন, ‘কী হয়েছে খোকা? ও কী, অমন করছিস কেন?’
জাহাঙ্গীর বজ্রকণ্ঠে চিৎকার করিয়া বলিল, ‘বাবার ভাগিনেয়রা সম্পত্তির দাবি করে নালিশ করেছে – আমি-আমি – আমি নাকি জারজ পুত্র, তুমি মুন্না বাইজি – তাঁর বিবাহিতা স্ত্রী নও – তাঁর রক্ষিতা – আমি খান বাহাদুরের রক্ষিতার পুত্র!’ – কান্নায়, ক্রোধে, উত্তেজনায় জাহাঙ্গীরের কণ্ঠ ক্ষুব্ধ দীর্ণ হইয়া উঠিল! মুখে তাহার ফেনা উঠিতেছিল, লেলিহান অগ্নিশিখার মতো সে জ্বলিয়া উঠিতেছিল! বিদীর্ণ কণ্ঠে সে তাহার জননীর পায়ে মুখ রাখিয়া বলিতে লাগিল – ‘বলো মা, এ মিথ্যা – মিথ্যা! ওরা সব মিথ্যা কথা বলছে! আমি যে সূর্যালোকে আর আমার মুখ তুলতে পারছিনে! মা! মা!’
যাঁহাকে লইয়া এ কেলেঙ্কারি, সেই মা তখন বজ্রাহতের মতো কাঠ হইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন! যেন জীবন্ত তাঁহাকে কে পোড়াইয়া দিয়া গিয়াছে! তাঁহার প্রাণ-দেহ সব যেন এক মুহূর্তের অভিশাপে প্রস্তরীভূত হইয়া গিয়াছে!
জাহাঙ্গীর ক্ষিপ্তের মতো উঠিয়া তাহার মাতার হাত ধরিয়া প্রচণ্ডবেগে নাড়া দিয়া বলিয়া উঠিল, ‘বলো – নইলে খুন করব তোমাকে! বলো – তুমি খান বাহাদুরের রক্ষিতা, না আমার মা?’ বলিয়াই সে যেন চাবুক খাইয়া চমকিয়া উঠিল! ও যেন উহার স্বর নয়, ও স্বর উহার পিতার, ও রসনা যেন ফররোখ সাহেবের! তাহার মাঝে তাহার পিতাকে এই সে প্রথম অনুভব করিল! হঠাৎ সে স্তব্ধ হইয়া গেল। তার পর, বিচারকের মতো তীব্র দৃষ্টি দিয়া মাতাকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। অভিভূতা মাতা শুধু করুণ-কাতর চক্ষে পুত্রের পানে চাহিয়াছিলেন!
জাহাঙ্গীর আর একটিও কথা না বলিয়া মন্ত্র-ত্রস্ত সর্পের মতো মাথা নোয়াইয়া টলিতে টলিতে বাহির হইয়া আসিল। চলিতে চলিতে তাহার মনে হইতে লাগিল, ধরণি যেন তাহার চরণদ্বয় গ্রাস করিতেছে – যেন একটা ভীষণ ভূমিকম্প হইতেছে – দানবী ধরা এখনই বিদীর্ণ হইয়া তাহাকে গ্রাস করিয়া পিষিয়া চিবাইয়া মারিবে!
যাইতে যাইতে শুনিল, মুমূর্ষু ভিখারিনি যেমন করিয়া ভিক্ষা মাগে, তেমনি করিয়া তাহার মাতা ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকিতেছেন, ‘ফিরে আয়, ফিরে আয় খোকা, ফিরে আয়!’
জাহাঙ্গীরের প্রাণ যেন তাহারই প্রত্যুত্তরে বলিতে লাগিল, ‘ওরে হতভাগিনি! হয়তো জাহাঙ্গীর আবার ফিরবে, কিন্তু তোর খোকা আর ফিরবে না!’
সে সোজা প্রমত্তের বাসা অভিমুখে চলিতে লাগিল। যাইতে যাইতে সে কেবলই আপনার মনে বলিতে লাগিল, ‘ওগো ধরিত্রী মা, আজ হতে আমি তোমার ক্লেদাক্ত ধূলিমাখা সন্তান – এই হোক আমার সবচেয়ে বড়ো পরিচয়! আজ হতে আমি মানব-পরিত্যক্ত নিখিল-লজ্জিত নরনারীর দলে!… ওগো সর্বংসহা মা, যে বুকে কোটি কোটি জারজ শিশুদের নিয়ে দোলা দিয়েছ, সেই বুকে নিয়ে আমায় দোলা দাও, দোলা দাও! যে স্পর্ধায় কুমারীর পুত্রকে করেছ মহাবীর, মহর্ষি, পয়গম্বর – সেই স্পর্ধার অক্ষয় তিলক আমায় পরাও মা!’…
জাহাঙ্গীর যখন উন্মত্ত মাতালের মতো প্রমত্তের বাসায় আসিয়া পৌঁছিল, তখন মৃত দিবসের পাণ্ডুর মুখ সন্ধ্যার কালো কাফন দিয়া ঢাকা হইতেছে। সান্ধ্য আজান ধ্বনি তাহারই ‘জানাজা’ নামাজের আহ্বানের মতো করুণ হইয়া শুনাইতেছিল। মাথার উপর দিয়া চিৎকার করিতে করিতে ক্লান্ত বায়স উড়িয়া চলিতেছিল – যেন মৃত দিবসের শবযাত্রী। ম্লান আকাশের আহিনায় শুধু একটি তারা ছলছল করিতেছিল ক্ষীণ করুণ করণে – যেন সদ্য পুত্রহীনার চোখ!
প্রমত্ত জাহাঙ্গীরকে দেখিয়া ভয় খাইয়া গেল। সে নিজেদের বিপদের কল্পনা করিয়া বলিয়া উঠিল, – ‘কী রে, কোনো খারাপ খবর আছে না কি?’ জাহাঙ্গীর বলিল, ‘আছে’, – বলিয়াই ঘরে ঢুকিয়া দ্বারে অর্গল দিয়া দিল।
বস্তির মধ্যে খোলার ঘর। যতদূর পরিষ্কার রাখা যায় স্যাঁতসেতে নোংরা ঘরকে, তার চেষ্টার ত্রুটি হয় নাই; তবু তাহার দীনতা ফুটিয়া বাহির হইতেছে – ঘষামাজা বিগত যৌবনের মতো। ক্ষীণ মৃৎ-প্রদীপালোকে দেখা যাইতেছে শুধু একটি ছিন্ন অজিনাসন ও ভারতের ম্লান মানচিত্র। ধূপ-গুগ্গুলের ধোঁয়ায় আর ভিজে মাটির গন্ধে মিশিয়া ঘরের রুদ্ধ বাতাসকে ভারাক্রান্ত করিয়া তুলিতেছে।
প্রমত্ত উদ্বেগ-আর্ত কণ্ঠে বলিল, ‘কোথায় কী হয়েছে, বল তো!’
জাহাঙ্গীর বিরস-কঠোর কণ্ঠে বলিল, ‘দেশসেবার পবিত্র ব্রত আমায় দিয়ে হবে না প্রমতদা।’
প্রমত্ত স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘যাক যা ভয় করছিলাম, তার কিছু নয় তা হলে! – আবার কার সঙ্গে ঝগড়া করলি?’
জাহাঙ্গীর বলিল, ‘বিধাতার সঙ্গে। আমি এ পবিত্র ব্রত নিতে পারি না প্রমতদা! না জেনে নিয়েছিলাম, তার জন্যে যা শাস্তি দেবেন দিন। আমার রক্ত অপবিত্র – আমি জারজ পুত্র!’ শেষ দিকে জাহাঙ্গীরের কণ্ঠ বেদনায় ঘৃণায় কান্নায় ভাঙিয়া পড়িল।
প্রমত্ত চমকিয়া উঠিল। তাহার পর গভীর স্নেহে জাহাঙ্গীরকে বুকের কাছে টানিয়া লইয়া বলিল, ‘ যা ভয় করেছিলাম, তাই হল।… যাক ওতে তোর লজ্জার কী আছে বল তো! যদি লজ্জিতই হতে হয় বা প্রায়শ্চিত্তই করতে হয় তো তা করেছে, করবে বা করছে তারা, যারা এর জন্যে দায়ী। কোনো অসহায় মানুষই তো তার জন্মের জন্যে দায়ী নয়!’ – জাহাঙ্গীর যেন পথহারা অন্ধকারে কাহার বলিষ্ঠ হাতের স্পর্শ পাইল – তাহাই সে বজ্রমুষ্ঠিতে ধরিতে চায়।
সে খাড়া হইয়া বসিয়া উত্তেজিত কণ্ঠে বলিল, ‘সত্যি বলছেন প্রমতদা? আমি তা হলে নিষ্পাপ? পিতার লালসা, মাতার পাপ আমার রক্ত কলুষিত করেনি? করেছে, করেছে! আজ আমি তার পরিচয় পেয়েছি। আমার মাঝে আজ প্রথম আমি আমার পশু-পিতাকে দেখতে পেয়েছি! দেখুন প্রমতদা, আমি জীবনে কখনও কুকথা উচ্চারণ করিনি, কিন্তু আজ আমি এক নারীকে পিতার রক্ষিতা বলে গালি দিয়ে আমার রসনা কলঙ্কিত করেছি; – সে নারী আমারই জন্মদাত্রী! না প্রমতদা আমার প্রতি রক্তকণা অপবিত্র – আমার অণু-পরমাণুতে আমার পিতার কুৎসিত ক্ষুধা, মাতার দূষিত প্রবৃত্তি কিলবিল করে ফিরছে বিছের বাচ্চার মতো – যে কোনো মুহূর্তে তা আত্মপ্রকাশ করতে পারে আজকের মতো। আপনার মহান যজ্ঞে আমার আত্মদান দেবতা গ্রহণ করতে পারেন না প্রমতদা। পাপের যূপকাষ্ঠে আমার বলি হয়ে গেছে।’ জাহাঙ্গীর হাঁপাইতে লাগিল – মনে হইল, এখনই বুঝি তাহার নিশ্বাস বন্ধ হইয়া যাইবে।
প্রমত্ত শান্ত দৃঢ়স্বরে বলিল, ‘আমাদের মন্ত্র তুমি ভুলে যাচ্ছ জাহাঙ্গীর। “জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী” আমাদের ইষ্টমন্ত্র। জননী জন্মভূমির বিচার করবার অধিকার আমাদের নেই।’ – শেষ দিকটা আদেশের মতো শুনাইল।
জাহাঙ্গীর লুটাইয়া পড়িয়া বলিতে লাগিল, ‘মিথ্যা ও মন্ত্র! জননী নয়, জননী নয়, – শুধু জন্মভূমিই স্বর্গাদপি গরীয়সী!’
প্রমত্ত জাহাঙ্গীরকে মায়ের মতো বুকে করিয়া সান্ত্বনা দিতে লাগিল, ‘পাপ যদি তোর থাকেই জাহাঙ্গীর, দুঃখের আগুনে পুড়িয়ে তোকে খাঁটি নেব, তুই কাঁদিসনে।’
জাহাঙ্গীর তখনও চিত্র-ভারত বুকে ধরিয়া উপুড় হইয়া কাঁদিতেছিল, ‘শুধু তুমি, জন্মভূমি আমার, শুধু তুমি একা স্বর্গাদপি গরীয়সী, – আর কেউ নয়, আর কেউ নয়!’
বুকের তলায় চিত্র-ভারত অশ্রু-সিক্ত হইয়া উঠিল।