কুসুম্ভার কারুয়া

কুসুম্ভার কারুয়া

হাজারিবাগ শহর থেকে টুটিলাওয়া এবং সিমার-এর দিকে যে রাস্তা চলে গেছে সেই রাস্তাতেই কবরখানা পেরিয়ে ডানদিকে সবুজ মেঘের মতো খুব উঁচু গোঁন্দা বাঁধ দেখা যায়৷ সেই বাঁধ গোঁন্দার রাজার তৈরি৷ বাঁধের ওপাশে যে কী আছে তা দেখা হয়ে ওঠেনি আমাদের৷ কিন্তু সেখানে রাস্তার পাশে একটি কাঠের স্তম্ভের উপরে লেখা আছে বনাদাগ৷ লাল মাটির এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা দিয়ে তিন কিলোমিটারের মতো গেলে একটি বস্তিতে পৌঁছানো যেত, যে বস্তির নাম ছিল কুসুম্ভা৷ পথে পড়ত শীর্ণ বোকারো নদী৷ সে নদী পায়ে হেঁটেই আমরা পেরোতাম৷

নদীর দুটি পাশই ছিল খাড়াই এবং পুরো পথটি খোয়াই-এ ভরা৷ দু-পাশে ঝাঁটি জঙ্গল এবং পুটুসের ঝাড়৷ সেই পথের দু-পাশে টাঁড়-এ ছিল তিতিরদের আখড়া৷ তার মধ্যে কালি তিতিরও ছিল৷ কালো শরীরে সোনালি ছিটে ভরা সেই পাখিগুলি সাধারণত অন্য তিতিরদের মতো জমিতে না ঘুরে বেড়িয়ে ঝোপঝাড়ের উপরেই বসে থাকত৷ এই কালি তিতিরদের যম ছিল আমার হাজারিবাগী বন্ধু গোপাল সেন৷ কুসুম্ভার দিকে যেতে যেতে সে মাঝে মাঝে তাদের ডাক শুনে পুটুসের ঝোপে ভরা টাঁড়-এ নেমে যেত বন্দুক হাতে৷ এবং গুলি করার পরেই সেই তিতির বন্দুকে ঝুলিয়ে বন্দুকটি কাঁধে ফেলে এসে আমার সঙ্গে মিলত ওই রাস্তাতে৷ যার কথা বলতে বসেছি সেই কারুয়ার বাড়ি ছিল ওই কুসুম্ভা গ্রামে৷ তার সঙ্গে আমার পরিচয় এক বর্ষার দুপুরে৷ টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল৷ এবং গ্রামসংলগ্ন ধানখেত এবং নতুন খোঁড়া একটি পুকুরের (যার নাম ছিল নয়া তালাও) পাশে খেটো ধুতি এবং ফতুয়া পরা একটি বিকটদর্শন খুব লম্বা কালো মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে৷ গোপাল-ই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল৷ কারুয়ার মাথায় কদমছাঁট চুল এবং একটি লম্বা টিকি শোভা পেত৷ তার মুখে ছিল সর্বক্ষণ একটি অমায়িক হাসি৷ কুৎসিত মুখটিকে সেই হাসি এক অসামান্য সৌন্দর্য দিত৷ কারুয়া ছিল আমাদের দেশের কোটি কোটি সরল, অতি গরিব এবং সহজে সুখী হওয়া একজন ভারতীয় গ্রামীণ মানুষ৷ কারুয়ার পায়ে জুতো ছিল না, খালি পা৷ গোপাল আমার সঙ্গে আলাপ করে দেওয়ার পরেই আমার পায়ে হাত দিয়ে সে প্রণাম করল৷ আমি ভালো জামাকাপড়, দামি জুতো পরে আছি এবং আমার সঙ্গে দামি বিলেতি বন্ধু, সেই কারণেই সে আমাকে প্রণম্য বলে ভাবল৷ আমার ইচ্ছা করছিল আমি ওর কাদামাখা পা দুখানিতে হাত দিয়ে প্রণাম করি৷ সে ছিল গরিবস্য গরিব৷ আর এই ভারতীয় প্রেক্ষিতে আমি ছিলাম বড়োলোক৷ আমি বড়োলোক সেই সুবাদে আমি তার প্রণম্য, প্রণাম পাওয়ার কোনো যোগ্যতা যদিও আমার ছিল না৷

কুসুম্ভা গ্রামের দিকে একটি পায়ে চলা পথ চলে গিয়েছিল একটি প্রাচীন নিমগাছের পাশ দিয়ে৷ সেখানে একগাদা ছোট ছোট বাড়ি৷ মাথায় পুরোনো হয়ে যাওয়া খাপড়ার চাল৷ সেইসব ঘরে কোনো জানালা ছিল না, ছিল একটি করে দরজা৷ পুরো গ্রামটি প্রদক্ষিণ করে সে পথ চলে গিয়েছিল গভীর জঙ্গলের দিকে৷ জঙ্গল শুরুর আগে ছিল বনদেবতার থান একটি ঝাঁকড়া অশ্বত্থ গাছের পায়ের কাছে বাঁধানো বেদির ওপরে ছোট্ট মন্দিরের মধ্যে৷ সেই জঙ্গল ছিল হরজাই জঙ্গল, যাতে সবরকমের গাছ ছিল ছোটবড়ো এবং জানোয়ারও ছিল সবরকমের৷ বড়ো বাঘ, চিতা, নানারকম হরিণ, শুয়োর, শজারু ইত্যাদি৷ তবে সে জঙ্গলে হাতি অথবা বুনো মোষ দেখিনি৷ তবে কালেভদ্রে দলছুট কোনো হাতি চলে আসত৷ এসে কুসুম্ভা গ্রামের ঘরবাড়ি ভেঙে দিত, গরু-মোষকে আছড়ে মারত এবং পুরো অঞ্চলে ভয়ানক ত্রাসের সঞ্চার করত৷

কুসুম্ভায় গেলে আমরা নয়া তালাও-এর কাছে একটি একচালা মাটির ঘরে রাতের আশ্রয় নিতাম৷ আমাদের হাজারিবাগের শিকারের সঙ্গী মঃ নাজিমের ঘর ছিল সেটি৷ নাজিম সাহেব চাষবাস করার অছিলায় ওই ঘরে সপ্তাহান্তে গিয়ে থাকতেন৷ এবং যা চাষবাস হত তার ফসল খেতে যেসব প্রাণী আসত, তাদের শিকার করতেন৷ আসলে শিকারের বাহানাতেই সেই মাটির একচালা ঘরটি তিনি তৈরি করেছিলেন৷ ফসল কিছুই পেতেন না৷ হাজারিবাগের বড়ো দোকান থেকে উৎকৃষ্ট চাল-ডাল এবং অন্যান্য জিনিস কিনে নিয়ে গিয়ে বিবিকে বলতেন, সেগুলো খেতের ফসল৷

কারুয়ার একটি গাদা বন্দুক ছিল মুঙ্গেরের৷ তখন এবং এখন বেপাশী বন্দুক এবং রিভলভারের জন্য বিখ্যাত ছিল মুঙ্গের৷ গাদা বন্দুকের নলের সামনে দিয়ে বারুদ গাদতে হত এবং গাদাগাদির পরে সিসের বল গেদে দেওয়া হত৷ একনলা বন্দুকের ঘোড়া টিপলেই তা তখন বন্দুকে লাগানো পারকারশান ক্যাপে লাগত, তখনই আগুন জ্বলে সেই বারুদেও আগুন লেগে গিয়ে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় বন্দুকের নলের মধ্যে বসানো সেই সিসের গুলি ছিটকে বেরুত৷ শিকারের প্রাণীর বিভিন্নতার উপরে এই গাদাগাদির ভেদাভেদ হত৷ বড়ো প্রাণী যেমন বাঘ, চিতা কিংবা ভালুকের জন্য বারুদ বেশি গাদতে হত এবং তৃণভোজী প্রাণীদের জন্য কম বারুদ গাদতে হত৷ গাদা বন্দুকে একবার গুলি করার পর পরের বার গুলি করার আগে আবার নতুন করে বারুদ গাদতে হত৷ তাতে অনেক সময় লাগত এবং তা অত্যন্ত বিপজ্জনক ছিল৷ কারণ বড়ো জানোয়ার যদি আহত হয়ে আক্রমণ করত তাহলে শিকারির প্রাণ বাঁচানোই মুশকিল হত৷

কুসুম্ভা গ্রামে মাঝে মাঝেই একটি মস্ত বড়ো দাঁতাল শুয়োর এসে হামলা করত৷ সেই শুয়োর একদিন কারুয়ার শিকারি বন্ধু পুনোয়াকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দাঁত দিয়ে তার পেট চিরে দিয়েছিল এবং তাতেই পুনোয়ার প্রাণ গিয়েছিল৷ পরে পুনোয়া নাকি ভূত হয়ে যায়৷ এবং তাকে প্রায়ই দেখা যেত বোকারো নদীর বুকের বালিতে বসে বড়ো বড়ো নখ দিয়ে শুয়োরের মাংস ফালা ফালা করে বড়ো বড়ো দাঁত দিয়ে চিবিয়ে খেতে৷

পুনোয়ার মৃত্যুর পর কারুয়া ঠিক করেছিল বন্ধুর মৃত্যুর প্রতিশোধ সে নেবে৷ সেই শুয়োর ওই গ্রামে এমনই আলোড়ন তুলেছিল যে আমি একটি ছড়া লিখেছিলাম :

রে রে শুয়ারোয়া বড়কা শুয়ারোয়া

কা কহি তুমহারি বাত

ছুপকে ছুপকে গাঁওমে ঘুসকা

হর শনিচ্চর রাত৷

গোপালবাবু লায়া ভূপাল সে বন্দুক

নিকাল লেগা তেরা দাঁত

রে রে শুয়ারোয়া বড়কা শুয়ারোয়া

কা কহি তুমহারা বাত৷

কারুয়ার গাদা বন্দুক তার মাটির ঘরে দেওয়ালের গজাল থেকে ঝুলত৷ এবং মাঝে মাঝেই বিশেষ করে বর্ষামুখর অন্ধকার রাতে তার সঙ্গে কথা বলত৷ বর্ষাকালেরই এক রাতে ওই বন্দুক কারুয়াকে ফিসফিস করে বলল, রে কারুয়া, শটী খেতয়া মে শুয়ার আউলবা৷

সকলেই জানত যে গ্রাম সংলগ্ন শটীখেতে ওই শুয়োরটি আসত মাঝে মাঝে৷ ওই শুয়োরই তার বন্ধুকে দাঁত দিয়ে চিরে মেরে ফেলেছিল৷ তাই কারুয়া প্রতিজ্ঞা করেছিল ওই শুয়োরকে মেরে সে প্রতিশোধ নেবে৷ তাই কারুয়া বন্দুকের বাণী শুনে একটুও দেরি না করে দেওয়াল থেকে বন্দুক নামিয়ে তাতে বারুদ গেদে নিল৷ বড়ো সিসার বলও গেদে নলের গোড়াতে পারকারশান ক্যাপ লাগিয়ে বন্ধুর হত্যাকারীর উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল৷

টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল৷ পা টিপে টিপে কাদামাখা জমিতে সাবধানে সেই শটীখেতে গিয়ে সে উপস্থিত হল৷ দেখল, সেই সাংঘাতিক বিরাট বিরাট বাঁকানো দাঁতওয়ালা প্রকাণ্ড শুয়োরটি শটীখেত তছনছ করে শটী খাচ্ছে৷ কারুয়া একটা গামহার গাছের নীচে গুঁড়ি মেরে বসে শুয়োরকে লক্ষ করতে লাগল৷ এতক্ষণ চারধার অন্ধকার ছিল৷ টিপটিপ বৃষ্টি ছিল৷ যদিও তখন শুক্লপক্ষ, কিন্তু চাঁদের দেখা পাওয়া যাচ্ছিল না কালো মেঘের ভিড়ে৷ কিছুক্ষণ পরে বৃষ্টি থামলে মেঘের ফাঁক দিয়ে ত্রয়োদশীর চাঁদ দেখা ছিল৷ সেই বৃষ্টিমাখা চাঁদের আলোয় কারুয়া শূকরটিকে স্পষ্ট দেখতে পেল৷ সেই অতিকায় প্রাণীটিকে দেখে তার ভয় করতে লাগল৷ একটি গুলিতে যদি সে শুয়োরটিকে ধরাশায়ী করতে না পারে তাহলে তার নিজের প্রাণও চলে যাবে ওই শুয়োরের দাঁতে৷ কারুয়া ঠিক করল যদি ‘হুম্মচকে’ সে শুয়োরের ‘কানপাটিয়ামে’ তার গাদা বন্দুকের গুলিটি লাগাতে পারে তাহলে শুয়োর যতই জবরদস্ত হোক না কেন তার মৃত্যু অনিবার্য হবে৷ এই ভেবে বনদেবতার নামে একটি প্রণাম ঠুকে সে বন্দুক তাক করে শুয়োরের কানপাটিয়ার খোঁজ করতে লাগল৷ শুয়োর একবার মুখ নামিয়ে যেই শটী খেতে মনোসংযোগ করেছে অমনি কারুয়া সঠিক লক্ষ্যে তার গাদা বন্দুকের ঘোড়া টিপল৷ সঙ্গে সঙ্গে বিকট চিৎকার করে মাটিতে পড়ে গিয়ে শুয়োরটি চরকির মতো ঘুরতে লাগল এবং ফুলঝুরির মতো ভেজা মাটি ছিটকাতে লাগল৷ এইভাবে মিনিট পনেরো ঘুরপাক খেতে খেতে শুয়োর শান্ত হল এবং তারও পরে একেবারে স্থির হয়ে গেল৷ তখনই কারুয়া দেখল বন্দুক কাঁধে তার বন্ধু পুনোয়া একটি শ্যাওড়া গাছ থেকে নেমে এল, তারপর কারুয়াকে বলল, কামাল কর দিয়া মেরা দোস্ত, বাধাই বাধাই, বহুত বাধাই তুমকো৷ বলেই পুনোয়া বৃষ্টিভেজা চাঁদে সপসপ করা জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেল৷



Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *