3 of 8

কুসংস্কার

কুসংস্কার

কুসংস্কার একটা ছেলেমানুষি ব্যাপার। একটা বোকামি। কেউ কেউ বলবেন নির্বুদ্ধিতা।

কিন্তু বলুন তো, অফিসে বেরবার সময়ে রামকৃষ্ণ ঠাকুরের ছবিতে একটা নমস্কার করে বেরতে ঠিক কয় পয়সা খরচ হয়। কিংবা ট্রামে যেতে যেতে কালীঘাট পার্কের পাশে কেউ যদি মাথা একটু নিচু করে, চোখ একটু বুজে থাকে তাতে কার ক্ষতি?

হ্যাঁ ক্ষতি হতে পারে। ক্ষতি হয়।

দৈবদূর্বিপাক, গ্রহের ফের কাটানোর জন্যে আমাদের জানাশোনার মধ্যে কত লোক মাদুলি-কবচে, যাগযজ্ঞে, হোম-স্বস্ত্যয়নে বহু টাকা ব্যয় করে। বহু অর্থ যায় জ্যোতিষী, পুরোহিত, মোল্লার পিছনে।

কত লোক বাড়ি থেকে বেরতে গিয়ে চৌকাঠে অন্যমনস্কভাবে হোঁচট খেয়ে সেটাকে বেরনোর পক্ষে বাধা বা অমঙ্গল ধরে নিয়ে ঘরের মধ্যে ফিরে এসে আবার পাঁচ মিনিট বসে ফাঁড়া কাটিয়ে তার পর বেরয়। অনেকে হাঁচির সঙ্গে বা টিকটিকির ডাক শুনেও এ রকম করতে পারে, কিন্তু ওই পাঁচ মিনিট দেরি করে বেরনোয় তার ট্রেন ফেল হয়ে যায় কিংবা ছুটোছুটি, দৌড়োদৌড়ি করে ট্রেনে উঠতে গিয়ে তার কোনো দুর্ঘটনাও হতে পারে এবং হয়েও থাকে।

হাঁচি, কাশি, টিকটিকির ডাক, পেছন থেকে ডাকা কিংবা ফাঁড়া, খারাপ সময় তুঙ্গে বৃহস্পতি অথবা বক্ৰী শনি— এসব শুধু যে আমাদের মতো গরিব দেশের অশিক্ষিত, আধা-শিক্ষিত দৈব-নির্ভর মানুষেরাই মেনে চলে তা নয়। পৃথিবীতে এমন কোনো জাতি নেই, এমন কোনো দেশ নেই যেখানে কুসংস্কার নেই, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ নেই।

পাঁঠা-মানত থেকে সতীদাহ, অনামিকায় মূল্যবান নীলাধারণ থেকে কপালে দইয়ের ফোঁটা দিয়ে পরীক্ষার হলে বা চাকরির ইন্টারভিউতে যাওয়া— এসবই কুসংস্কারের নানারকম হেরফের। কোনোটা মৃদু, কোনোটা বেশ জোরালো, কোনোটা সামান্য, কোনোটা মারাত্মক।

কতরকম কুসংস্কার যে কত দেশে রয়েছে তার আর কোনো ইয়ত্তা নেই। আমাদের দেশে কালো বেড়াল অমঙ্গল, অথচ সাহেবদের কাছে কালো বেড়াল সৌভাগ্যসূচক।

বাঙালির কুসংস্কারের একটা দীর্ঘ তালিকা পাওয়া যাবে খনার বচনে। পথিমধ্যে মৃতদেহ চোখে পড়লে মঙ্গল, শেয়াল বাঁদিকে পড়লে শুভ কিন্তু ডানহাতে অশুভ— এইরকম খুঁটিনাটি ছোট-বড় আরো কত কী।

আমাদের অল্প বয়সে ভাতের থালায় আঁকিবুকি কাটলে মা-ঠাকুরমারা বলতেন অমঙ্গল হবে। বাড়িতে ধার দেনা হবে। আসলে অনেক কুসংস্কারই প্রয়োজনীয় বিধিনিষেধের একটা বেড়াজাল।

কুসংস্কার সম্পর্কে এক সাহেব বলেছিলেন যে, কুসংস্কার হল মনের বিষ। আর সেই বিখ্যাত বাগ্মী এডমন্ড বার্ক বলেছিলেন, কুসংস্কার হল দুর্বল মনের ধর্ম। তবে ভলতেয়ার সরাসরি বলেছিলেন কুসংস্কারকে ধ্বংস করে ফেলতে।

তবে সব প্রচলিত কুসংস্কার পরিবেশ বা সমাজ থেকে পাওয়া বা পারিবারিক সূত্রে লব্ধ তা নয়। একজন হয়তো একজোড়া নতুন চপ্পল প্রথম দিনেই পায়ে দিয়ে ট্রামে উঠতে একটু হোঁচট খেয়েছিল, তার মনে কিন্তু সেই নতুন চপ্পলজোড়া সম্পর্কে একটু খট্‌কা জন্মাল, পরের দিন ওই চপ্পল পায়ে দিয়ে আবার সে যদি কোথাও সামান্য হোঁচট খায় বা আঘাত পায়— সে হয়তো আর কখনও ওই নতুন জুতোজোড়া পায়ে দেবে না।

চরম বিজ্ঞান ও মুক্তমনের দেশ বলে যার খ্যাতি— সেই মার্কিন দেশে কুসংস্কার মজ্জায় মজ্জায়, হাড়ে হাড়ে।

পুরো আমেরিকায় এমন কোনো শহর পাওয়া যাবে না যেখানে কোনো গলিতে বা রাস্তায় তেরো নম্বর বাড়ি আছে। ঠিক একইভাবে হোটেলে তেরো নম্বর ঘর নেই, বহুতল অট্টালিকায় ত্রয়োদশতল নেই— বারোর পরেই চৌদ্দ, তেরো একেবারেই অদৃশ্য।

আগামী উনিশশো সাতানব্বই খুবই খারাপ বছর। কারণ এক-নয়-নয়-সাত (১৯৯৭) হল ছাব্বিশ অর্থাৎ তেরোর দ্বিগুণ। শুধু তেরোই মারাত্মক, ডবল তেরো ভাবাই যায় না!

কুসংস্কারের অন্য একটা অতি সাধারণ উদাহরণ দিচ্ছি।

আমেরিকায় যে-কোনও হোটেলের ঘরে থাকুন, অবশ্যই দেখবেন বিছানাটা বাঁদিকের দেওয়াল ঘেঁষে লাগানো। অর্থাৎ বিছানা থেকে নামতে গেলে ডানদিক থেকে নামতে হবে।

এর কারণ আর কিছুই নয়, একটা বহু প্রাচীন কুসংস্কার। যা-কিছু শুভ এবং ঈশ্বরীয় সব দেহের ডানদিকে রয়েছে, আর খারাপ, শয়তানীয় ব্যাপার-স্যাপার শরীরের বাঁদিকে অবস্থান করে। ফলে কেউ সকালবেলায় বিছানার বাঁদিক দিয়ে নামলে, সারাদিন নানা খারাপ ব্যাপার তার ওপরে প্রভাব বিস্তার করবে। তার সারাদিন খারাপ যাবে।

এই রম্য নিবন্ধটি কেমন যেন গুরুগম্ভীর প্রবন্ধের মতো হয়ে গেল। বলা বাহুল্য, বিষয়গুলোই এমন ঘটেছে।

তবু সাহেবি কুসংস্কারের অন্তত একটা মজার গল্প বলি।

বিলেত দেশটায় মইয়ের নীচে দিয়ে হেঁটে যাওয়া খুব অশুভ বলে পরিগণিত হয়। কেউ যদি দেখে কোথাও দেওয়ালে বা গাছের সঙ্গে একটা মই ঠেস দিয়ে রাখা আছে, সে পারতপক্ষে সেই মইয়ের তলা দিয়ে হেঁটে যাবে না। যদি ভুল করে বা না দেখে কেউ হেঁটে যায় তবে তার খুবই অশুভ কিছু, খুব অমঙ্গল হওয়ার আশঙ্কা।

এই ব্যাপার নিয়ে এক সাহেবের আধুনিকা মেমসাহেব একদিন স্বামীকে পরিহাস করে বলেছিলেন, ‘ওগো, তোমার সেই আমাদের প্রথম আলাপের দিনটি মনে আছে? সেই যে তুমি হঠাৎ খেয়াল করলে, আমরা দু’জনে একটা মইয়ের নীচে দাঁড়িয়ে আছি আর তুমি বললে, এবার খুব সাংঘাতিক কিছু আমার জীবনে ঘটবে। কই, তারপরে তো দশ বছর হয়ে গেল, সেরকম সাংঘাতিক কিছু কি ঘটল?’ সাহেব গলা নামিয়ে বললেন, ‘ঘটেনি?’

পুনশ্চঃ

একঃ আমরা অনেকেই মুখ ফুটে বলি বটে আমাদের কোনো কুসংস্কার নেই। কিন্তু একবার বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, যদি পাশাপাশি দুলে শুভবিবাহের তারিখ থাকে মাসের বারো, আর তেরো, যদি বিয়েটা হয় নিজের মেয়ের, তাহলে কি তেরো তারিখটা বাদ দিয়ে বারো তারিখটাই নির্দিষ্ট করবেন না?

দুইঃ এক ফাঁসির আসামিকে জেলারবাবু জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনার ভাগ্যে এ রকম ঘটল কেন?’

ফাঁসির আসামি বললেন, ‘আর বলবেন না। তেরোর গেরো।’

জেলারবাবু বললেন, ‘মানে?’

সেটা ছিল জুরির বিচারের যুগ, ফাঁসির আসামি বললেন, ‘বারোজন জুরি আর একজন জজ—এই তেরোজনে মিলে আমার এই সর্বনাশ করল।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *