কুসংস্কার

কুসংস্কার

আমরা যখন ছোট ছিলাম, মেমদের ইস্কুলে পড়তাম, তখন মাঝে মাঝে আমাদের ফিরিঙ্গি দিদিমণিরা দুঃখ করে বলতেন, ‘তোমাদের জন্য আমাদের বড়ই কষ্ট হয়। কী রকম সুপারস্টিশাস্ তোমরা। ছি ছি! ব্রাহ্মিণরা মরে গেলে, তাদের মাথার চুটকি আকাশের দিকে রেখে, লম্বা গর্তে খাড়া দাঁড় করিয়ে পুঁতে রাখ! মাই গড্‌!’ অমনি আমাদের আধা-কালো সহপাঠিনীরা বলতে থাকত, ‘হিন্ডুজ্‌ বিশ্বাস করে তাহলে ডে-অফ-জাজমেন্টে গড্‌ ওদের টিকি ধরে টেনে সোজা স্বর্গে তুলে নেবেন।’

একথা শুনে আমরা যতই ব্যস্ত হয়ে বোঝাতে চেষ্টা করি বামুনরা মোটেই মরা লোকদের খাড়া করে পোঁতে না। সবাইকে তারা পুড়িয়ে ফেলে। তাতে ওরা ভীষণ শক্‌ড্‌! ‘শেম! শেম! ঠাট্টা করেও ওকথা বলতে হয় না। এডুকেটেড লোকরা মরা মানুষদের ভক্তি করে। পুড়িয়ে ফেলে দেয় না!’

আধা-কালো দিদিমণিরা বলতেন, ‘অল হিন্ডুজ বেজায় সুপারস্টিশাস! কী করবে বেচারিরা, হেবেনে তো আর যেতে পারবে না, তা সে যত ভালই হোক না কেন!’ এটা আমাদের অবিচার বলে মনে হত। বলতাম, ‘কেন? ভাল লোকরাও হেবেনে যাবে না কেন?’

‘ওমা, তাও জান না? রোমান ক্যাথলিক ছাড়া কেউ যে হেবেনে যেতে পারবে না। আর সবাই বড্ড পাপী। তবে যদি পাপ স্বীকার করে আমাদের কিছু প্রেজেন্ট দাও, তা হলে পাপ কমে যাবে।’

বাড়িতে গিয়ে মাকে প্রেজেন্টের কথা বলতেই, মা খুব হাসতেন। বলতেন, ‘ওদের বড় কুসংস্কার কিনা’—

‘কুসংস্কার আসলে কী মা?’

‘কুসংস্কার হল গিয়ে সুপারস্টিশন। যেসব বিশ্বাসের কোনও কারণ নেই, তাই মানা আর কী।’ ভারী আশ্চর্য লাগত। ওরা তো আমাদের সুপারস্টিশাস্‌ বলে। মা আবার উলটো কথা বলছেন! ছেড়ে দিতাম তর্ক।

কিন্তু ছেড়ে দিলেই তো আর হল না। ওরা ছাড়ত না। আমাদের বলত প্রটেস্টান্ট। মা বলতেন, ‘মোটেই না, প্রটেস্টান্টরাও খ্রিস্টান।’ ‘কিন্তু ওরা যে বলে প্রটেস্টান্টরা হেবেনে যায় না।’ ‘ওরা বড্ড গোঁড়া, ক্যাথলিক ছাড়া কাউকে খ্রিস্টান বলেই মানে না। তা ছাড়া হেবেন বলতে কিছু নেই। যারা ভাল কাজ করে, তাদের ভাল হয়। যারা খারাপ কাজ করে, তাদের খারাপ হয়।’

একবার ইস্কুলের হলঘর রং হচ্ছিল। একটা বড় মই দেওয়ালে ঠেকিয়ে, তাতে চড়ে মিস্ত্রিরা দেয়ালে ফিকে গোলাপি রং লাগাচ্ছিল। মেরি নিঢ্যাম তার বন্ধুদের বলল, ‘মইয়ের তলা দিয়ে যেয়ো না। ভয়ানক আন্‌লাকি!’ পরদিন নিজের চোখেই দেখলাম কত আন্‌লাকি। দুটো দুষ্টু ছেলে কোনও বারণ না শুনে ওই মইয়ের তলা দিয়েই ছুটে গেল। মইতে ঠ্যাং লটকে গেল, মইটি মিস্ত্রিসুদ্ধ হুড়মুড় করে পড়ল। মিস্ত্রির কনুইতে লাগল আর ছেলে দুটো মাথা থেকে পা অবধি তেলতেলা রং মেখে ভূত!

আরও কত নিয়ম ছিল ওদের। টেবিলে খেতে বসে কেউ নুন ফেললে, আরেক খাবলা নুন নিজের কাঁধের ওপর দিয়ে ছুড়ে না দিলেই সর্বনাশ! তেরোজন এক টেবিলে খেতে বসলে সাংঘাতিক বিপদ হবে। যিশু নাকি ওই করেই বিপদ ডেকে এনেছিলেন!

একদিন কে জিজ্ঞাসা করল, গলায় মাছের কাঁটা ফুটলে হিন্ডুজরা কী করে? শৈলবালা বলল, ‘কী আবার করব? কেশে তুলতে চেষ্টা করি। জল খাই, ভাতের দলা গিলি, আলু গিলি, কাঁদি, তবু যদি না যায় ডাক্তারের কাছে যাই। তিনি একটা সরু লম্বা চিমটে দিয়ে কাঁটা তুলে দেন।’

শুনে ওরা স্তম্ভিত। ‘মাই গড্‌! ওসব কিছুই করবার দরকার নেই। সত্যি তোমরা বড্ড গোঁড়া। স্রেফ একটা বোলে একটু জল নিয়ে, তার ওপর ছুরি দিয়ে একটা ক্রুশ্‌ চিহ্ন আঁকলেই বাপ বাপ বলে কাঁটা নেমে যায়! এও জান না? রিয়েলি!’

শুধু ওরা কেন, অন্যরাও নানারকম অদ্ভুত কথা বলতেন। পাশের বাড়ির দিদিমা একদিন তাঁর নাতিদের ডেকে বকাবকি করতে লাগলেন, ‘তোদের কি কোনও আক্কেল নেই? ঠ্যাং ফাঁক করে, মাথা ঝুলিয়ে, ঠ্যাঙের ফাঁক দিয়ে পেছন দিকে ফের তাকাচ্ছিস্‌! তাই তো তোদের কাকিমার একটার পর একটা খালি মেয়েই হয়!’

দিদিমা আরও বলতেন, ছাগলের দড়ি ডিঙোলে নাকি খারাপ কিছু হয়। তা অবিশ্যি হতেই পারে, যদি ঠিক সেই সময় ছাগলটা উঠে পড়ে তেড়ে আসে, কিংবা দৌড় মারে। তিন বামুন একসঙ্গে গেলে নাকি রেলের কলিশন হয়। বিষ্যুৎবারের বারবেলায়—অর্থাৎ বেলা বারোটার পর—যাত্রা করলে কী হয়, সে অভিজ্ঞতা তো আমাদের হাতেনাতে হয়েছিল। শুনুন বলি।

শান্তিনিকেতন থেকে পৌষ উৎসবের পর কলকাতায় ফিরছি। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর রওনা হয়ে শক্তিগড় ছাড়িয়ে নিরাপদে আরও মাইল বারো গিয়ে, রসুলপুরের লেভেল ক্রসিং-এর কাছে সেই যে গাড়ি বিগড়ে গেল, সে আর চলল না। বাকি দিনটা চেষ্টা চরিত্তির করবার পর যখন বোঝা গেল যে মোক্ষম একটা অংশ ভেঙে দু’টুকরো হয়ে গেছে, কারখানা ছাড়া উপায় নেই। তখন রাত প্রায় দশটা।

বর্ধমানগামী শেষ বাসটার সঙ্গে জাহাজের কাছির মতো মোটা দড়ি দিয়ে গাড়ি বেঁধে, আবার বর্ধমান ফিরে চললাম। সেখানকার কারখানায় সারা রাত গাড়ি সারানোর কাজ হয়।

আমরা বাসে উঠে বসতেই, সামনের সিট থেকে একজন বুড়ো ভদ্রলোক বললেন, ‘কিছু মনে কর না মা, কটার সময় রওনা হয়েছিলে?’

বললাম ‘এই পৌনে একটা হবে।’

মহাখুশি হয়ে তিনি তাঁর পাশে বসা খিটখিটে চেহারার লোকটিকে বললেন, ‘এবার বিশ্বাস হল তো? আপনারা লেখাপড়া শিখেছেন, এসব বিশ্বাস করেন না। বিষ্যুৎবারের বারবেলায় বেরিয়ে এনাদের অমন ভাল গাড়িটার দফা-রফা! আর আপনার মামলার ওইসব জরুরি কাগজপত্র বেমালুম চুরি হয়ে গেল! এক ঘণ্টা আগে বেরোতে কী হয়েছিল? এসব কিছুই ঘটত না।’ আরেকটা গল্প এক বোডিং-স্কুলের দিদিমণি বলেছিলেন। মেয়েরা লেখাপড়া শিখছে, অথচ কিছু কিছু কুসংস্কার মন থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না। ওঁদের বোর্ডিং-এ খাবার টেবিলে এক ছড়া মর্তমান কলা দিয়েছে। তার মধ্যে একটা জোড়া-কলা, তা সেটি কেউ খাচ্ছে না। দিদিমণি ভাবলেন, এই তো কুসংস্কার সম্বন্ধে ছোটখাটো একটা ভাষণ দেবার সুযোগ পাওয়া গেল।

এই ভেবে তিনি শুরু করলেন, ‘জোড়া-কলা খাবে না কেন? কী হয় খেলে?’ বড় মেয়েগুলো এ-ওর দিকে তাকাতে লাগল। এরই মধ্যে ছোট্ট একটা সাত বছরের মেয়ে বলে উঠল, ‘কিচ্ছু হয় না দেখুন। ওরা বলে নাকি জোড়া-কলা খেলে জোড়া-খোকা হয়। কিন্তু আমি অনেকবার খেয়ে দেখেছি, কিচ্ছু হয় না। জোড়া কেন, একটাও হয় না!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *