পটলা সমগ্র ১
পটলা সমগ্র ২

কুষ্মাণ্ড মাহাত্ম্য

কুষ্মাণ্ড মাহাত্ম্য

ম্যাপের বাইরে কোন ধাপধাড়া গোবিন্দপুরে দামোদরের বালিয়াড়ি পার হয়ে শালিখপোঁতা । আমরা যেতে চাইনি সেখানে। পটলা তো সাফ বলে দেয়, নট গোয়িং। ইদানীং পটলা সাধ্যমত ইংরাজিতেই বাতচিত করে। কারণ বাংলা ভাষাটা তার জিভে এমন জড়িয়ে যায় মাঝে মাঝে যে লোকে হাসে। আড়ালে বলে তোতলা। তাই এখন সে বঙ্গভাষা প্রসার আন্দোলনেও ইংরাজির প্রচলনই রাখতে চায়।

পটলা বেঁকে বসতে পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের বাকি সভ্য অর্থাৎ আমি আর হোঁৎকা যেতে চাই না। হোঁৎকা বলে, নিখিল বঙ্গ কুমড়ো ব্যবসায়ী সমিতির বার্ষিক উৎসব ওই শালিখপোঁতায়, আমরা কি করুম সেখানে?

আমারও যাবার তেমন আগ্রহ ছিল না। আমরা কেউ কুমড়ো ব্যবসায়ী নই, উপরন্তু কুমড়োর ঘ্যাঁট দেখলেই আমার আতঙ্ক জাগে। কী করব? গোবর্ধনের মামা ওই কুমড়ো সমিতির প্রেসিডেন্ট, এখানের বিরাট কুমড়ো মার্চেন্ট। গোবর্ধন আবার আমাদের ক্লাবের মেম্বার। ওই সমিতির বার্ষিক সভায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হবে। গোবর্ধন তার উদ্যোক্তা। ক্লাবের আরেক সভ্য আর গায়ক ফটিককে সে সেখানে নিয়ে যাচ্ছে সঙ্গীত পরিবেশন করার জন্য। সঙ্গে হোঁৎকা যদি তার দেশজ ভাষায় কমিক স্কেচ করে—ওকেই জীবিত ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় বলে চালিয়ে দেবে শালিখপোঁতায় ।

ফটিক এমন কুমড়ো সমিতির অনুষ্ঠান মিস করতে চায় না। তাই সে বলে, এখান থেকে গাড়িতে করে যাবি। একটা রাত থেকে পরদিন ফেরা যাবে। বেশ হৈচৈ হবে, চল না। গোবর্ধন তার সঙ্গে যোগ করে, একদম ভিলেজ, মানে পাড়াগাঁ। সিনসিনারি খুব ভালো রে। আর হোঁৎকা, সমিতির সেক্রেটারির বাড়িতে যা জোর খ্যাঁটটা হবে না! পুকুরের মাছ, তাজা মুর্গি । আমাকেও বলে, ওখানে বৌদ্ধ আমলের কোন রাজার গড় আছে। সেই রাজার গড়ে এখনও অনেক কিছু দেখার আছে। প্রাচীন অনেক কিছু-

টোপ গেলা ছাড়া আমাদের উপায়ান্তর থাকে না। শেষ অবধি পটলাকে বলি, চল, এত করে বলছে যখন ঘুরেই আসি। আমরা রাজি হতে ফটিক বলে, তোরা যাচ্ছিস তাই ভরসা করে যাচ্ছি রে।

অবশ্য ফটিকের ফাংশনে ভয় আমাদেরই। আগেও দু’একবার তো দেখেছি, ক্লাবের ফাংশনে ওর গান শুনে খুশি হয়ে লোকে টম্যাটো-পচা ডিম উপহার দিয়েছে, কেউ আবার খুশিতে ঢিল-পাটকেলও ছুড়েছে, সে সব সামলাতে হয়েছে আমাদেরই। কুমড়ো সমিতির ফাংশনে যদি তেমনি কেউ কুমড়ো ছোড়ে তাহলেই গেছি। তবু যেতে রাজি হয়ে যাই। তারকেশ্বর অবধি চেনা পথ। তবে পথের যা অবস্থা তাতে পথ না চষা মাঠ তা বোঝার উপায় নাই। একটা ছোট ভ্যানে যাচ্ছি আমরা। ফটিক ইদানীং গানের চর্চার সঙ্গে সঙ্গে নাচের তালিমও দিচ্ছিল পাড়ার ছোটদের। পাড়ার সেই কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়েও চলেছে। তারা ফটিকের পরিচালনায় নৃত্যনাট্য করবে। হোঁৎকা বলে, এক রামে রক্ষা নাই, সুগ্রীব দোসর। ফটকে নিজে কি শেখছে তাই জিগা, ও আবার নৃত্যনাট্য করবো। দর্শকগো আমাগোরই ফিনিস্ না কইরা দেয়।

সত্যি ভাবনার কথা। ওই বাচ্চাদের নিয়ে বিপদে না পড়ি।

তারকেশ্বর অবধি তবু ভাঙা ফুটো রাস্তা দিয়ে গেলাম। গাড়িই সারা পথ নানা ভঙ্গিতে নৃত্য করে গেল। কখনও কখক, কখনও কথাকলি, কখনও বা তাণ্ডব নৃত্য। মুড়ির টিনে মুড়ি পুরে জোরে ঝাঁকালে মুড়িগুলোর যা অবস্থা হয়, আমাদের অবস্থাও তেমনি। কলকাতা থেকে সকালে যা খেয়ে বের হয়েছিলাম, বাবা তারকনাথের কাছাকাছি আসার আগেই সব শেষ । হোঁৎকা বলে, ক্ষুধা পাইছে। গাড়ি থামা।

গোবর্ধন এমনিতে হিসাবী। কমিটি তার কাছে জলখাবারের খরচা কিছু দেয়নি, গাড়ি দিয়েছে মাত্র। তাই গোবরা বলে, আর বেশি দূর না। দামোদর পার হয়ে এইটুন পথ। হোঁৎকা গর্জে ওঠে, রাখ তোর দামোদর। গাড়ি থামা। ফটকে, ফিইরা চল ট্রেনে। লিভার ফাংশান ঠিক না হইলে, ফাংশন হইব না। ক্ষুধা পাইছে।

সমূহ বিপদ। অগত্যা পথের ধারে একটা দোকানে গাড়ি থামিয়ে সেখানে আর কিছু না পেয়ে মুড়ি, আলুর চপ আর দু’দিনের বাসি রসগোল্লার স্টকই শেষ করা গেল। দোকানদারও এমন রসালো পার্টি পেয়ে কাঁচালঙ্কা, পিঁয়াজ, শেষপাতে তিনদিনের বাসি রসগোল্লার রসটা ফ্রি দিয়ে দিল। মুড়ির সঙ্গে তাই খেয়ে আবার যাত্রা শুরু হল।

এ পথে গাড়ি বোধহয় এই প্রথম চলেছে। যা যায় তা কুমড়ো আর আলু বোঝাই ট্রাক, তারও দু’একটাকে দেখলাম মাটির সড়ক থেকে ছিটকে তার চাক্কা উপর হয়ে পড়ে আছে, আর মাঠময় স্রেফ হরেক সাইজের কুমড়ো গড়াগড়ি খাচ্ছে। দেখে মনে হল কুমড়োই যেন এখানের জাতীয় ফসল। মাঠে মাঠে ছড়িয়ে আছে কুমড়ো। মড়ার মাথার সাইজ থেকে শবযাত্রায় যে খোল বাজিয়ে কেত্তন গাওয়া হয়, তেমনি খোলের সাইজের কুমড়োও আছে। কোনোটা বেশ কালচে সবুজ, কোনোটা ঘন সবুজ, কেউ আধা হলদে, কেউ পুরো।

শুধু মাঠের মাটিতে নয়, গ্রামের প্রতি ঘরের চালেও দেখি চালকুমড়ো। সেগুলোও যেন পাউডার মেখে সেজেগুজে রোদ পোয়াচ্ছে। গোবর্ধন বলে, এবার কুমড়োর ফলন বেশ ভালোই রে। ওদিকে ফটিক কি বলতে যাচ্ছিল, গাড়িটা আচমকা চল্লিশ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে গোঁৎ খেয়ে আবার ঝটকা মেরে সিধে হতে ফটিকও ছিটকে পড়ে—ওফ, বাপরে। হোঁৎকা কোনোরকমে সামলেছে। ড্রাইভারকে বলে, এভাবে গাড়ি নে যাবা? যা রাস্তা!

এবার দেখি রাস্তার হাল। দু’দিকেই ডোবা পুকুর। সব পানায় ঢাকা। কত গভীর কে জানে। পড়লে কচুরিপানার জঙ্গলেই হারিয়ে যাব। গোবর্ধনের সঙ্গে ছিল কুমড়ো কমিটির এক মেম্বার শীর্ণ লগার মত পটকা মার্কা চেহারা। সে বলে, হ্যাঁ, গাড়ি যাবে। কুমড়োর গাড়ি যায় মাল নে আসতে।

ড্রাইভার বলে, এ তো মানুষের গাড়ি। ডোবায় নামলে বিপদ হবে। আর কতটা পথ?

লোকটা আঙুল দেখায়, ওই যে হোথায় নদীর বাঁধ দেখছনি?

কোনোমতে রামনাম জপ করতে করতে নদীর বাঁধের নীচে এসে পৌঁছলাম। কয়েকটা দোকান, বসতি রয়েছে। আর খড়ের চালায় স্রেফ কুমড়ো। ওদিকে একটা কোল্ড স্টোরেজও রয়েছে।

এখানে গাড়ি রেখে এবার নদী পার হয়ে ওদিকে আরও দু’মাইল গেলে তবে শালিখপোঁতা। গোবর্ধন বলে, এই তো নদী পার হয়ে বাঁধ ধরে গেলেই ব্যস।

দু’মাইল মানে এক ক্রোশ।

আমি বলি, একা নদী ষোল ক্রোশ। এখনও সতের ক্রোশ পথ যেতে হবে।

হোঁৎকা গর্জে ওঠে, ফটিক, তরে মার্ডার করুম। এহানে কে তর গান শুনবো, কেউবা তগোর নেত্য দেখবো? ফিইরা চল।

ফেরার তেলের পয়সা কুমড়ো পার্টির অফিসে, তাই যেমন করেই হোক টেনে হিঁচড়ে শালিখপোঁতা যেতেই হবে। তাই নদীর হাঁটুভোর বালি ভেঙে চলেছি হাঁপাতে হাঁপাতে। জল এইটুন, বাকি সব ধুধু বালি ।

ভুজঙ্গ দারোগা শালিখপোঁতায় এসে বেশ আরামেই ছিল। গ্রামটার চারিদিকে শুধু ধ্বংসস্তূপ। সরু চিলতে ইঁটের স্তূপ, তাতে বনজঙ্গল গজিয়েছে। এককালে ছিল কোন সামন্ত রাজার রাজধানী, প্রাসাদ। সব এখন ওই বনজঙ্গলে ভরা। দু’একটা মন্দির রয়েছে। কোনটায় দেবতা কোনোমতে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছেন কিঞ্চিৎ আলোচাল সেবা করে। কোনটা পতিত, সাপখোপের ডিপে। ভুজঙ্গ দারোগা এখানে এসে খাঁটি দুধ, ডিম, মাছ, মাংস সেবন করে আর ঝিমোয়। হঠাৎ তার টনক নড়েছে।

কুমড়ো সমিতির বার্ষিক উৎসব হচ্ছে এখানে, আর উদ্বোধন করতে আসছেন কোন মন্ত্রী। তাই ক’দিন ধরে ধ্বজামার্কা ক’জন সেপাইকে থানার মাঠে দাঁড় করিয়ে লেফট রাইট করাচ্ছে। দুটো রাইফেলকে সাফসুতরো করে ওদের দিয়েছে। কিন্তু ওরা বহুদিন পর রাইফেল নিয়ে চলতে হিমশিম খাচ্ছে। দারোগাবাবু তারকেশ্বর বাজার থেকে ব্রাশো আনিয়ে জং ধরা পিতলের বেল্ট-বোতাম এসব সাফ করাচ্ছে।

কুমড়ো সমিতির মেম্বাররা আসবে, নাচগান হবে, সারা এলাকার যেন ঘুম ভেঙেছে। তারা এখন থেকেই সামিয়ানা টাঙানো, স্টেজ বাঁধা দেখতে ভিড় করেছে। স্কুলবাড়ির ঘরে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে কুমড়ো পার্টির অতিথিদের। সেখানে রান্নার আয়োজন হচ্ছে।

দারোগাবাবুও ব্যস্ত। এমনি দিনেই ঘটনাটা ঘটে যায়। কুমড়ো সমিতির সেক্রেটারি ই এখানকার জমিদার। ওদের মন্দিরে ছিল প্রায় হাজার বছরের পুরনো এক বিষ্ণুমূর্তি। অষ্টধাতুর তৈরি সেই প্রাচীন মূর্তিকে এদের পূর্বপুরুষ কোন পুকুর খুঁড়তে গিয়ে উদ্ধার করেছিল। সেই মূর্তির দাম নাকি পঞ্চাশ লাখ টাকা। তবু এরা সেটা হাতছাড়া করেনি। সেই মূর্তিই হঠাৎ দু’দিন আগে চুরি হয়ে গেছে। আর তাই নিয়ে এরই মধ্যে খবরের কাগজে উঠেছে এখানের খবর। খোদ এস-পি সাহেব আসছেন তদন্তে। কারণ ওই মন্ত্রীর মামার বাড়িতেই চুরি হয়েছে এই মহামূল্যবান মূর্তি।

ভুজঙ্গ দারোগার কাছে কড়া ভাষায় মেসেজ এসেছে। চোরদের ধরতেই হবে। তাই ভুজঙ্গ দারোগা চারিদিকে কড়া পাহারা রেখেছে, যেন মূর্তি নিয়ে কেউ চলে যেতে না পারে। বাঁধের ওপরেও রয়েছে পাহারা। আমাদের দলকে দেখে কে হুঙ্কার ছাড়ে, হল্ট !

আমরা থামলাম। ওদিক থেকে বিড়ালের ল্যাজমার্কা গোঁফওয়ালা দারোগা এসে আমাদের দেখে শুধোয়, কোথা থেকে আ-আ-আসা হচ্ছে? এখানে কি ব্যা-ব্যা-ব্যাপার? গোবর্ধনের সেই লম্বুমার্কা মেম্বারই সব কথা জানাতে দারোগা আমাদের নিরীক্ষণ করে বলে, খুব সা- সাবধান। কোনো বে-বে-বেচাল দেখলে অ্যা-অ্যারেস্ট করব।

পটলা শুধোয়, হোয়াট ইজ ইট? কি-কি-

চোপ! গর্জে ওঠে দারোগা—আমাকে ভ-ভ-ভ্যাংচানো হচ্ছে? ফ-ফাজিল ছোকরা?

অনেক লোককেই তোতলা হতে দেখেছি, কিন্তু কখনও তোতলা দারোগা দেখিনি। বলি—ও আপনার মতই স্যার। জিবটার ব্রেক ফেল করে ওরও। সরি !

আমরা এবার ছাড়া পেয়ে গ্রামে ঢুকলাম। ওদিকে কলাগাছ, ঘট, তার উপর ডাব নয়, ডাবের সাইজের কুমড়ো। হোঁৎকা বলে, পুলিশ এত ক্যান রে?

খবরটা আমরাও জানতে পারি। এখানে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা দামের প্রাচীন মূর্তি চুরি হয়ে গেছে।

ভুজঙ্গ দারোগা বসে নেই। বড়সাহেব এখানে জমিদারের মন্ত্রী ভাগ্নেকে তার এলেম দেখাবার জন্য এর মধ্যে আশপাশের গ্রামের ডজন খানেক ছিঁচকে চোরদের ধরে এনে ফটকে পুরে গর্জাচ্ছে, তু-তুই জানিস। বল কোথায় সেই মূ-মূর্তি!

গবা হাঁড়ি দাগি চোর। তার গায়ে রেড়ির তেল এখনও শুকোয়নি। সে বলে, আমরা গেরস্থের ঘটি-বাটি নিই হুজুর। ওসব ঠাকুর-দ্যাবতা নে কি করবো ?

নন্দ বারুই নিজে, নিজেরাই খেতে পাই না, ঠাকুর-দ্যাবতার সেবা জুটুবো কোত্থেকে? ওসব ফ্যাসাদে কেনে যাবো বলেন?

ওদের কারোর কাজ যে নয়, তা বোঝে দারোগা সাহেব। কিন্তু সে এবার বিপদেই পড়েছে। হন্যে হয়ে সারা গাঁয়ের ডোবা, পুকুলে জাল ফেলছে। কই, চ্যাং, ল্যাঠা মাছই ওঠে। সেই মূর্তি আর ওঠে না।

গ্রামটা ঘুরতে বের হই আমরা পঞ্চপাণ্ডব। গ্রাম নয়, যেন কুমড়োর কারখানা। সারা এলাকার কুমড়ো, চালকুমড়ো আসে এখানে। বহু জায়গায় দেখি আখের শালের মত বড় বড় কড়াই-এ কুমড়ো সেদ্ধ হবার পর হাত পা দিয়ে সেইগুলো চটকানো হচ্ছে, তারপর আবার দলাই-মালাই করে সেগুলো ক্বাথের মত করে টিনবন্দী করা হচ্ছে। কুমড়োর এহেন অবস্থা দেখিনি। গোবর্ধন বলে, ওর থেকে টম্যাটো সস তৈরি হবে।

কুমড়োর টম্যাটো সস ?

গোবর্ধন বলে, ওতে রং মিশিয়ে টম্যাটো সস করা হবে। টম্যাটোর কত দাম জানিস ? কুমড়োর মহিমা অপার। অন্যত্র দেখি স্রেফ চালকুমড়োর পাহাড়। সেগুলোও কেটে পিস পিস করে সেদ্ধ করা হচ্ছে। ওর থেকে চালকুমড়োর মিঠাই হবে।

কুমড়ো সমিতির মিটিং-এ তখন মন্ত্রী মশায় তারস্বরে কুমড়োর মহিমা কীর্তন করে চলেছেন। আয়রন-প্রোটিন কতরকম ভিটামিন-ম্যাঙ্গানিজ রয়েছে ওই কুমড়োর মধ্যে তারই বর্ণনা করে দেশবাসীকে কুমড়ো উৎপাদনের জন্য উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানিয়ে দেশমাতৃকার সেবায় আত্মনিয়োজিত করতে বলেন !

কুমড়োর মাহাত্ম্য বক্তৃতার পর্ব মিটল। এরপর ফটিকদের অনুষ্ঠান শুরু হল। আমরা রেডি হয়ে আছি, কখন কি হয় অবস্থা। এই বোধহয় টম্যাটো, পচা ডিম পড়ল! এটা কুমড়োর দেশ। আস্ত কুমড়ো শূন্যপথে ধেয়ে এলেও আসতে পারে। কারণ ফটিকের ফাংশন শান্তিতে শেষ হয় না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এখানে সেটা শেষ হল। দর্শকরাও এবার হ্যারিকেনের পলতে উসকে আলো নিয়ে দল বেঁধে যে যার ঘরের দিকে গেল। ফটিক বলে, ক্যামন ফাংশন হল বল। একেবারে পিনড্রপ সায়লেন্স।

পটলা বলে, ওরা সব ঘুমিয়ে প-পড়েছিল।

শান্তিতে অনুষ্ঠান শেষ হল। প্রেসিডেন্ট গোবর্ধনের মামা, ওই কুমড়ো পার্টির সেক্রেটারিও খুব খুশি। তারপর দিন দুপুরে ভুরিভোজনের পর এবার ফেরার পালা। পুকুরের মাছই কতরকম। ইয়া ট্যাংরা, রুই, সরেস গলদা চিংড়ি, তার ওপর পায়েস, রসগোল্লা – আয়োজন প্রচুর। ফিরছি। তার আগেই গরুর গাড়িতে করে এরা সামান্য উপহার পাঠিয়ে দিয়েছে নদীর এপারে। ওখানেই গাড়ি থাকবে।

হেঁটে নদী পার হয়ে এসে দেখি গরুর গাড়িতে ছোটবড় খোলের মত সাইজের আট-দশটা কুমড়ো। গরুর গাড়ির গাড়োয়ানের চেহারাটা মুষকো। ইয়া গোঁফ, চোখ দুটো লাল করমচার মত। ওদিকে আজ কমিটি আমাদের জন্য তারকেশ্বর থেকে অন্য একটা গাড়ি ভাড়া করে এনেছে। সেই ভ্যানের ড্রাইভার আর গাড়োয়ান দু’জনে কি কথা বলছে আর আমাদের দিকে চেয়ে দেখছে।

শীতের বেলা, তাড়াতাড়ি দিন শেষ হয়। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যার আবেশ নামে নদীর বুকে । তাড়া দিই ড্রাইভারকে, চলো। কলকাতা ফিরতে রাত হবে।

ড্রাইভার যেন কানেই শোনে না। সে বনেট খুলে কি নাড়াচাড়া করছে। ওদিকে সন্ধ্যা নামছে বালুচরে। ড্রাইভার এবার গাড়ি ছাড়ল। ভ্যানের মেঝেতে বেশ কয়েকটা কুমড়ো, গাদাগাদি করে আমরা। তবু একখানা করে কুমড়ো রোজগার কবে চলেছি।

গাড়ি চলছে সেই খানা ডোবা বাঁশবনের বুক চিরে। গাড়ির সামনে ড্রাইভার, ক্লিনার আর গাড়ির সঙ্গে আসা লোকটাও রয়েছে। ও নাকি শেওড়াফুলির আড়তে থাকে, সেখানেই নেমে যাবে।

সন্ধ্যা নেমেছে। রাস্তাটা নির্জন। হঠাৎ গাড়িটা থেমে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন লোক অন্ধকার বাঁশবন ভেদ করে এসে গাড়িটাকে ঘিরে দমাদ্দম লাঠি মারতে থাকে ৷ সামনে ফাঁকা রাস্তা। চিৎকার করি—ডাকাত ডাকাত! পটলা বলে, গ-গাড়ি ছোটাও। কুইক। কিন্তু গাড়ি তবু স্টার্ট নেয় না। আমাদের চিৎকারে ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে কিছু লোকজন হৈহৈ করে ছুটে আসে। ওদের দেখেই বোধহয় সেই ডাকাতের দল বনের অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।

আমরাও অবাক হই। ডাকাতরা কিইবা নিত! তবু ডাকাত—ডাকাতই। তারা চলে যেতে গ্রামের মানুষজন মিলে ঠেলতে ইঞ্জিনটা চালু হয়। পটলা বলে, সো-সোজা ক্যালকাটা ।

তারকেশ্বর ছাড়িয়ে গাড়ি চলেছে। রাত্রির অন্ধকারে গাড়িটা ছুটছে। ঝিমুনি আসে। হঠাৎ ঝাঁকানি দিয়ে গাড়িটা আবার থেমে যায় মাঠের মধ্যে। এবার একটা গাড়ি এসে সামনে পথ আটকে দাঁড়িয়েছে। অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় দেখা যায় গাড়ি থেকে চার-পাঁচজন নেমে আমাদের গাড়িতে এসে ওঠে। ওরা কি যেন খুঁজছে। একজন তো ফটিকের তানপুরাটাই আছড়ে ভেঙে ফেলে। ফটিক আর্তনাদ করে ওঠে। লোকটা ধমকায়, চোপ। চেল্লালে খতম করে দেবো। ওর হাতে ভোজালি। অন্য আরেকজন গাড়ির মধ্যে থেকে লাথি মেরে কুমড়োগুলোকে ফেলে দিতে চায়। একজন আমাদের ব্যাগগুলো হাঁটকাচ্ছে।

এমন সময় দূরে হাইওয়েতে পুলিশের জিপের লাল আলো আর হুটারের শব্দ শুনতেই ওরা নেমে পড়ে। রাস্তায় ছিটকে পড়া দুটো ফুলসাইজ কুমড়ো তুলে নিয়ে গাড়িতে উঠে

পালায় ।

পুলিশের গাড়িটা আসতে দেখে আমাদের গাড়ির ড্রাইভার এবার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফুলস্পিডে দৌড়তে থাকে। আমরা চিৎকার করি—গাড়ি থামাও, পুলিশকে জানাতে হবে ডাকাতির কথা। কিন্তু কে শোনে আমাদের কথা? সোজা বের হয়ে এসে শেওড়াফুলিতে ঢুকল । এখানে সঙ্গে আসা লোকটাকে নামিয়ে দিয়ে আবার চলেছি আমরা।

গাড়িতে দু’দুবার ডাকাত পড়েছে। শেষবারের দলটা ছিল অনেক হিংস্র। হোঁৎকাকে মেরেছে। পটলার নাকে একটা ঘুষি ঝেড়েছে। ফটিকের তানপুরার শোক তখনও যায়নি। একটা ঘুষির চোটে চোখের উপর আব গজিয়ে গেছে। গালে চড়ের দাগ। তবু বলে, এমন সুন্দর তানপুরাটা গেল রে! হুগলির লাউ।

হোঁৎকা গর্জে ওঠে, চুপ মাইরা থাক। লাউ-কুমড়োর নাম করবি না। কুমড়োর পার্টির জন্যই মার খাইছি।

ওদিকে ড্রাইভার তখন একটা ধাবায় দাঁড়িয়েছে। তাকে বলি, আর দেরি কেন ড্রাইভার সাব? কলকাতায় ছেড়ে দিয়েই খেতে। ড্রাইভার কোনো কথাই বলে না। গিয়ে খাটিয়াতে বসল। ক্লিনার বলে, ইঞ্জিনে পেট্রল দিতে হয়। ড্রাইভারে পেটেও খাবার লাগে বাবু। খেয়ে নিই। দেরি হবে না ।

এরা যেন কলকাতা যেতেই চায় না। ধাবায় শুয়ে-বসে তারপর খাবার খেয়ে নেয় ওরা। আমাদের পেটে তখন খোলকর্তাল বাজছে। কিন্তু কমিটি পথের খরচের পয়সা দেয়নি। যেন স্রেফ হাওয়া খেয়েই যাবে। ফাংশনের পর শিল্পীদের কদর আর থাকে না।

গাড়ি ছাড়তে একঘণ্টা দেরি হয়ে গেল। চারিদিক নিঝঝুম অন্ধকার। হঠাৎ পথের ওপর কারা গাছ ফেলে রেখেছে দেখে গাড়িটা থামাতেই আবার দু’দিক থেকে কয়েকজন লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে। তাদের মধ্যে দেখি সেই গাড়োয়ানও রয়েছে। ওরা আমাদের ব্যাগ, তবলার কেস, মায় কুমড়োগুলোও রাস্তায় ফেলছে। বারবারই আমরা ডাকাতের পাল্লাতেই পড়ছি। এবার আর বাধা দেবার চেষ্টাও করি না। কুমড়ো নিয়েই যদি খুশি হয় হোক।

এমন সময় অন্ধকার ফুঁড়ে একটা পুলিশ ভ্যান এসে হাজির হয়। আমরা চিৎকার করি—ডাকাত, ডাকাত। ফটিক, গোবর্ধন মরিয়া হয়ে দু’জনকে ধরে ফেলে। আমিও হাতের কাছে একটা ইট কুড়িয়ে সেই গাড়োয়ানের ঘাড়ে জোরে একটা আঘাত করতে সে ছিটকে পড়ে।

ততক্ষণে পুলিশ ঘিরে ফেলেছে গাড়িটাকে।

ওই কুমড়ো, ভাঙা তানপুরা ও অন্য মাল সমেত গাড়িটাকে থানায় আনা হল। দারোগাবাবু আমাদের মুখে সব শুনে বলেন, কুমড়োর জন্যই ডাকাতি! কোথা থেকে আসছ তোমরা ?

শালিখপোঁতা থেকে। ওরাই ক’টা কুমড়ো দিয়েছিল। ওই লোকটাই গাড়িতে করে এনে তুলে দেয়। তারপর মাঝপথে ও নেমে যায়। আর ড্রাইভার ধাবাতে ঘণ্টা দেড়েক দেরি করে, যাতে ওই লোকটা দলবল এনে ডাকাতি করার সময় পায় ।

দারোগাবাবু কি ভাবছেন। বলেন, শালিখপোঁতা থেকে আসছ? তারপরই কুমড়োগুলোকে নিরীক্ষণ করতে থাকেন। বিশাল সাইজের কুমড়ো। হঠাৎ একটা কুমড়োর গায়ে সরু দাগ দেখে সেটাকে ধরে টানতে কুমড়োর কিছুটা অংশ উঠে আসে। তার ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দারোগাবাবু সাবধানে একটা ইঞ্চি ছয়েক সাইজের অষ্টধাতুর মূর্তি বের করে টেবিলে রাখেন। গোবরা এর আগে শালিখপোঁতায় এসেছে, মন্দিরে ওই মূর্তি সে দেখেছে। ওই প্রাচীন মূল্যবান মূর্তিটাই চুরি হয়েছে আর সেটা বের হল এখানে ওই বিশাল কুমড়োর মধ্যে থেকে ! গোবর্ধন বলে, এই মূর্তিটাই চুরি হয়েছে ওখানে। পঞ্চাশ লাখ টাকা দাম ।

দারোগাবাবু ওই রাতেই শালিখপোঁতা থানায় রেডিও মেসেজ দিতে ভোরেই ওখান থেকে দারোগাবাবু, সেই মন্দিরের মালিক কুমড়ো পার্টির সেক্রেটারিবাবু, গোবরার মামা, গ্রামের দু’একজন লোক এসে পড়ে। তারা মূর্তি শনাক্ত করে আর ভুজঙ্গ দারোগা সেই গাড়োয়ানকে সপাটে একটা চড় মেরে বলে, ব্যাটা তখন বললি কিছুই জানি নে। ছিঁচকে চুরি করি, ঠাকুর-দেবতাকে ছুঁই না । এখন !

একা ওই গাড়োয়ানই নয়, তদন্তে বের হয় গ্রামের দু’একজন এমনকী ওই ড্রাইভারও জড়িত। তারাই বারবার চেষ্টা করেছিল কুমড়োটা নিয়ে যেতে কিন্তু অন্য কুমড়োর সঙ্গে মিশে যাওয়ায় ঠিক মাল বাছতে পারেনি। তাই এবার সব কুমড়োগুলো নিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই ধরা পড়ে যায়।

কুমড়ো পার্টির সেক্রেটারি, পুলিশ সাহেব, দারোগাবাবু সকলেই খুব খুশি। আমরা নাকি শালিখপোঁতা গ্রামকে চরম অকল্যাণের হাত থেকে বাঁচিয়েছি। গোবরার মামা বলেছে, আমাদের ক্লাবের বালকভোজনে বরাবর ফ্রিতে কুমড়ো সাপ্লাই দেবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *