কুষ্টিয়া – শিলাইদহ ভেড়ামারা

কুষ্টিয়া

শিলাইদহ

প্রমত্তা নদী পদ্মা। জলকল্লোল প্রাণের জোয়ার, প্রাচুর্যের প্লাবন। সে প্লাবনে দু-তীরের গ্রামের মানুষদের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। তাই গ্রামবাসীরা বড়ো দুঃখে প্রাণ-প্রবাহিনী পদ্মাকে নাম দিয়েছে কীর্তিনাশা। শুধু ধাও, শুধু ধাও, উদ্দাম উধাও। এই উদ্দামতার অত্যাচার সন্তানের আবদারের মতোই যেন সহ্য করে এসেছে আমার জননী, আমার প্রিয় জন্মভূমি শিলাইদহ। জনশ্রুতি আছে শেলি নামে একজন কুঠিয়াল সাহেবের নামানুসারেই গ্রামের নামকরণ হয়েছে শিলাইদহ। নদীর ধারে তাঁর কবরটি অনেকদিন পর্যন্ত গ্রামবাসীর কৌতূহল মিটিয়ে এসেছে। দুরন্ত পদ্মা এখন তা গ্রাস করে নিয়েছে। এমনি করে মানুষের কীর্তি নাশ করেছে পদ্মা এক দিকে, আবার অন্য দিকে নতুন কীর্তি গড়ে তোলার কাজে অকৃপণ সহায়তাও করেছে। কিন্তু আজ পদ্মাতীরের মানুষ পদ্মাকে ছেড়ে এসেছে যে দুঃখে, পদ্মা নিজেও ততখানি দুঃখ দেয়নি কখনো। এ দুঃখের মূল পদ্মা নয়, মানুষের জাতভাই মানুষ।

হাজার গ্রামের মধ্যে শিলাইদার এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল না যার জন্যে বাংলাদেশের মানুষ তাকে মনে রাখতে পারে। কিন্তু সে বৈশিষ্টতা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ সোনারতরীর যুগে অনেক কবিতা রচনা করেছেন এই শিলাইদার কোল ছোঁয়া পদ্মার বোটে বসে বসে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িরই জমিদারির অন্তর্গত ছিল এই শিলাইদা।

গ্রামের মাটির স্পর্শ ভুলতে পারি না। ভুলতে পারি না দু-কূল-প্লাবিনী পদ্মকে। বেশ বুঝতে পারছি আজকের এই পরমাশ্চর্য সকালের রোদে নদীর ওপারে ঝাউগাছের দীর্ঘ সারির ফাঁক দিয়ে রোদের ঝলক সারাশিলাইদার গায়ে লুটিয়ে পড়ছে। নদীর ওপরে গাঙচিলগুলো মাছের লোভে চরকির মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। আর জলের বুকে নৌকো বেয়ে চলেছে পদ্মানদীর মাঝিরা। কলকাতার এই মধুবংশীয় গলির প্রায়ান্ধকার কুঠুরিতে কোনোরকমে মাথা গুঁজে আজ অনুভব করছি শরতের প্রাক্কালে পদ্মা-স্নাতা শিলাইদার প্রকৃতি ও পরিবেশ। অকাল বর্ষণে নদী পদ্মার যৌবনমদিরতা হয়তো এখনও শেষ হয়নি। হয়তো জলতরঙ্গ এখনও তেমনই প্রবলতায় আছড়ে পড়ছে শিলাইদার দু-তীরে। সে কূলভাঙা ঢেউয়ের শব্দে কত রাত্রে ঘুম গেছে ভেঙে। কত ঝড়ের রাতে পদ্মানদীর মাঝিদের হাঁকাহাঁকিতে সচকিত হয়ে উঠত আমার কিশোরমন। ভাবতাম এই দুরন্ত, দুর্বার পদ্মার বুকে ভগবান যে-মানুষদের জীবন-সংগ্রামে ঠেলে দিয়েছেন তারা যেন প্রকৃতির পরিহাসকে অনায়াসে ভ্রুকুটি দেখিয়ে এই দুর্দম ঝড়ের মধ্যেও নদী পারাপার করছে। এ শক্তি মানুষ অর্জন করেছে নিজেদের বাঁচবার অধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে। কিন্তু সেই মানুষেরাই আবার আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ভুলে গিয়ে আত্মধ্বংসী সংগ্রামে কী করে মেতে ওঠে?

পুজো এগিয়ে আসছে। প্রতিবছরই এ সময়টাতে শিলাইদা যাওয়ার জন্যে মন উন্মুখ হয়ে উঠত। কুষ্টিয়া স্টেশনে নামলেই মন এক অপরিসীম আনন্দে ভরে যেত। সামনে গড়াই। নৌকো দিয়ে গড়াই নদী পার হয়ে গিয়ে পৌঁছোতাম কয়াতে। আর দূর নয়। আর মাত্র তিন মাইল হাঁটাপথ। দু-পাশে অতিপরিচিত আমবন, বাঁশঝাড় আরও কত বনলতার শ্যামল স্নিগ্ধ

স্পর্শ। ভাঙা রাস্তা। তার ওপর দিয়ে আবার রহিম ভায়ের গোরুর গাড়ির অত্যাচার। তবুও কলকাতার পিচঢালা রাস্তার চেয়ে সে পথকেই আপন বলে জেনেছি, সে-পথ যে আমার গ্রামের ভিটার সন্ধান দিত আমাকে। বর্ষাকালে জল, শীতকালে ধুলো। তবু যেন কী এক প্রশান্তি সারামন জুড়ে থাকত সে পথে চলবার সময়, তা আজ বোঝাই কী করে? পথ-চলতি মানুষদের সুবিধের জন্যে ঠাকুরবাড়ির লোকেরা পথের দু-পাশে অনেক বাবলা গাছ লাগিয়ে দিয়েছিলেন। কয়া থেকে কুঠিবাড়ি, কুঠিবাড়ি থেকে শিলাইদহ কাছারি পর্যন্ত এই বাবলা গাছের সারি। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত সে বাবলা শ্রেণিকে কোনোদিনই তো ভুলতে পারব na। গাছগুলোকে দেখলেই মনে হত যেন আপনার ছত্রছায়ায় আশ্রয় দেওয়ার জন্যে দূরদেশের প্রবাসী সন্তানদের পথ চেয়ে ব্যাকুল আগ্রহে তারা অপেক্ষারত। শুধু গাছ নয়, পথিকদের সুবিধের জন্যে ঠাকুরপরিবারের কর্তারা রাস্তার পাশে একটি বড়ো পুকুর ও টিউবওয়েল খনন করিয়ে দিয়েছেন। বাড়ি যাওয়ার পথেই কত কুশল প্রশ্ন। কেউ বলে : ‘বাবু কখন আসতিছেন?’ কিছুদূর যেতেই আবার প্রশ্ন : ‘আপনি বাড়ি আসেন না কো? আপনের মা আমার কাছে কত প্যাচাল পাড়েন! বাড়ি গিয়ে হয়তো শুনি ওইলোক অনেকদিন আসেইনি আমাদের বাড়ি। তবু সহজ আন্তরিকতায় কুশল প্রশ্ন করতে কার্পণ্য করে না কেউ। হয়তো বলি : ‘তা তোমাদের দেখবার জন্যেই তো এতদূর থেকে এলাম।’

‘তা কয়েকদিন আছেন তো? কাইল আমার খাজুর গাছ নাগাইছি। আপনার জন্যে এক হাড়ি রস দিবার মন করি।’–কোথা থেকে ছুটে এসে জিজ্ঞেস করে জব্বর। কাছারির গোরুর গাড়ির গাড়োয়ান জব্বর মুনশি। ওর বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে দেখলেই জোর করে নিয়ে যাবে বাড়িতে। কিছু না খাইয়ে কিছুতেই আসতে দেবে না। এমন মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সবার সঙ্গে।

বাড়ি থেকে আধ মাইল দূরে। খোরশেদপুর এম. ই. স্কুল। এই স্কুলেই বিদ্যা শিক্ষার হাতেখড়ি আমার। খোরশেদপুরের স্কুলজীবনে মাত্র তিনদিন স্কুল পালিয়েছিলাম। বড়ো রাস্তা ছাড়া একটা জঙ্গলের পথেও স্কুলে যাওয়া যেত। এই জঙ্গল সম্পর্কে নানারকম জনশ্রুতি রয়েছে। ভূতের জঙ্গল বলে ছিল এর পরিচয়। বলা বাহুল্য কোনোদিন ভূত কিংবা ভূতের বাসস্থানের আমরা সাক্ষাৎ পাইনি। স্কুল পালিয়ে খেত থেকে মটরশুটি চুরি করে এনে বনের ভেতর গাছতলায় বসে বসে খেতাম। একদিন ধরা পড়ে যাওয়ার পর আর স্কুল পালাইনি। মাঝে মাঝে আবার শিকারে বের হতাম। কোনোদিন নদীর ধারে খরগোশ শিকারের আশায়, কোনোদিন দক্ষিণ দিকের জঙ্গলে বাঘের বাচ্চা ধরবার উদ্দেশ্যে মহড়ায় বের হতাম। কিন্তু কোনোদিন একটা ফড়িংও ধরতে পারিনি। এমনই সব অদ্ভুত খেয়ালে পাঠ্যজীবনটা কাটিয়েছি বেশ। একবার দেবুর আর আমার মাথায় খেয়াল চাপল যে ডাকাতি করে গরিবদের দান করতে হবে। যে কথা সেই কাজ। খেলার ছোটো পিস্তলটি নিয়ে রাত দশটার সময় বাইরের ঘর থেকে চুপি চুপি বেরিয়ে পড়লাম আমি আর লেফটেন্যান্ট দেব। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারিনি। পাশের বাড়িতেই প্রথম মহড়া দিতে গিয়ে কী যে নাকাল হয়েছিলাম সে করুণ কাহিনি প্রকাশ না করাই ভালো। অবশ্যি এমন সব বুদ্ধি হত ডিটেকটিভ বইয়ের নানা আজগুবি গল্প পড়ে।

কিশোরজীবনের এই রূপকথার রাজ্যে মূর্তিমান বাস্তব ছিলেন গফুর মাস্টার। আমার জন্মের পূর্ব থেকেই গফুর মাস্টার আমাদের গৃহশিক্ষক। দাদা-দিদিদের হাতেখড়ি দিয়েছেন তিনিই। কলকাতায় এসে অনেক কৃতবিদ্য শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষালাভ করে ধন্য হয়েছি, কিন্তু কোনোদিন গফুর মাস্টারকে ভুলতে পারিনি। কলকাতার পথে চলতে চলতে রেডিয়োতে একটা গান শুনলাম : নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে। ওগো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে। গানটা শুনে আমার মন চলে গেল অনেক দূরের স্মৃতির রাজ্যে শিলাইদার এক প্রান্তে, কোন এক মুগ্ধ কিশোরমনের চিত্র সেটি। ঢল নেমেছে পদ্মার দু-তীরে। সারাটা আকাশে কে যেন কালি ঢেলে দিয়েছে। পুবদিকের জানলাটা খোলা। মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথ এমন দিনেই হয়তো এখানকার পদ্মার বোটে ‘সোনার তরী’ আর ‘খেয়া’র কবিতাগুলি রচনা করেছিলেন। সেদিনও আকাশ হয়তো এমন মেঘাবৃত ছিল। সেই মেঘমেদুর অম্বরের প্রান্তঘেঁষা তাল-তমাল বন লক্ষ করে একদিন, সে বহুদিন আগে, আরও একজন কবি ‘শতক যুগের গীতিকা’য় সুর সংযোজন করেছিলেন। মন তখন অতীতমুখর। শুনতে পেলাম পদ্মানদীর মাঝি সুর ধরেছে : ‘কুল নাই, কিনারা নাই, নাইকো গাঙের পাড়ি, সাবধানেতে চালাইও মাঝি আমার ভাঙা তরি। সে দিন আর বুঝি ফিরে আসবে না!

রবিবার আর বুধবার এই দু-দিন বাজার বসত গ্রামে। বাকি পাঁচদিন গোপীনাথ দেবের মন্দিরের সামনে বসত বাজার। বাজারের পাশ দিয়েই পদ্মা প্রবাহিতা। চৈত্র-বৈশাখ মাসের পদ্মা আর বর্ষাকালের পদ্মা যেন আকাশপাতাল তফাত। পদ্মার এই দুটো রূপকেই আমি ভালোবাসি। দারুণ গ্রীষ্মের দাবদাহে পদ্মা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। আবার বর্ষার কালোমেঘ দেখলেই পদ্মা যেন উন্মাদের ন্যায় উত্তাল তরঙ্গ ভেঙে দুর্বার হয়ে ওঠে।

এই আমার শিলাইদা। আজ তার পরিচয় দিতে গিয়ে কেবলই মনে হচ্ছে শিলাইদহে জন্মগ্রহণ করে আমি ধন্য হয়েছি। রবীন্দ্রনাথ এই শিলাইদহকে খুব ভালোবাসতেন। এখানকার কুঠিবাড়িটি ছিল তাঁর নিজস্ব। এখানে থাকতেই তিনি ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদে হাত দেন। এখান থেকে কিছু দূরেই স্বৰ্গত সাহিত্যসেবী জলধর সেনের বাড়ি কুমারখালি। সব স্মৃতির বন্ধনই অটুট আছে, কেবল দেশের ব্যবধান গেছে বেড়ে। তবুও আমি শিলাইদহকে ভুলতে পারি না। মনে হয় আবার আমার গ্রামকে ফিরে পাব, ফিরে পাব গফুর মাস্টার, জব্বর মুনশি, সবাইকে।

.

ভেড়ামারা

পথে যেতে ডেকেছিলে মোরে।
পিছিয়ে পড়েছি আমি, যাব যে কী করে।।
এসেছে নিবিড় নিশি, পথরেখা গেছে মিশি;
সাড়া দাও, সাড়া দাও আঁধারের ঘোরে।।

কবিগুরুর গানটি আজ আমাদের মনের কথা ব্যক্ত করছে। পথের ডাককে অগ্রাহ্য করতে না পেরে আজ আমরা মৃত্যুর পথে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছি অন্ধকার নিশিতে। অপটু-চরম ক্লান্তিতে পড়েছে ভেঙে, পথরেখা মুছে গেছে সম্মুখ থেকে, ফলে জীবনযাত্রায় আমরা পড়েছি পিছিয়ে–এ সময় এমন একটি ধ্রুবতারারও সন্ধান পাচ্ছি না যার আলোর নির্দেশে আমরা এগিয়ে গিয়ে নির্বিঘ্নে জীবনে হব সুপ্রতিষ্ঠিত। আমরা মায়ের কোল থেকে ছিটকে পড়েছি দূরে। শস্যশ্যামলা গ্রাম্য পরিবেশ ছেড়ে রুক্ষ শহুরে আবহাওয়ায় যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ললাটে জন্মভূমির কোমল স্পর্শের জয়তিলক নিয়ে জন্মের প্রথম শুভক্ষণে কান্নার সুরে ‘মা-মা’ বলে আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলাম একদিন আজ জীবন-মধ্যাহ্নে কাঁদতে কাঁদতে আবার আশ্রয় প্রার্থনা করছি দেশজননীর কাছে। সেদিন পেয়েছিলাম গ্রাম-জননীর কোল, আজ তাঁর কাছ থেকে বিতাড়িত। সেদিন আর এদিনের মধ্যে পার্থক্য অনেক, আজ আমার চলার পথে কাঁটা, শ্বাস প্রশ্বাসে নাগিনির সুতীক্ষ বিষ! দ্বীপান্তরিত লাঞ্ছিত জীবন নিয়ে সর্বদাই বিব্রত। কেবল নিজের চিন্তায় সব সময় বিভোর। তবু মন পড়ে আছে সেই সুদূরে হারানো মায়ের কোলে, পল্লির ছোট্ট কুটিরে, আমার গাঁয়ের শ্যামঘন-নীলাকাশে। সেসব দিনকে আজ দিকচক্রবালে স্বপ্নের মতো মনে হয়। জানি না দেশজননী আবার মা-জননীর মতো কোলে ঠাঁই দেবেন কি না, আবার আত্মপ্রতিষ্ঠার সুযোগ পাব কি না!

জীবনের ওপর বিতৃষ্ণা এলেই চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে ওঠে আমার গ্রামখানি। আমার গ্রাম ভেড়ামারা আমার কাছে অতুলনীয়, বার-বার গ্রামের নাম উচ্চারণে শান্তি পাই মনে। মনের কোনো গোপন কোণে সেই ‘ভেড়ামারা” নামটি বোধহয় খোদাই হয়ে আছে, না হলে আজ এই দুঃসময়ের মধ্যেও তাকে এত নিবিড়ভাবে মনে পড়ে কেন? কেন তাহলে এই অখ্যাত অজ্ঞাত গ্রামটির তুলনা খুঁজে পাই না? কেন সেই শান্তির নীড় স্নিগ্ধ সমীর’-এর কথা চিন্তা করলে চোখ জলে ভরে আসে? আজ ভেবে আশ্চর্য লাগে আমার গ্রাম আমার কাছে কেন বিদেশ হয়ে গেল একরাত্রির মধ্যে? প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা গ্রামখানি কেন হঠাৎ লক্ষ্মীছাড়া হয়ে গেল?

আমার গ্রাম পূর্বে ছিল নদিয়া জেলায়, আজ হয়েছে কুষ্টিয়া জেলার কুক্ষিগত। আগে এই কুষ্টিয়াও ছিল নদিয়া জেলারই একটি মহকুমা। এককালে একটি ব্যাবসা-বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র ছিল আমার গ্রাম। কলকাতার পণ্যের বাজারে তাই ভেড়ামারার একটি নির্দিষ্ট স্থান ছিল বাঁধা। একদিন এখান থেকেই পাট আর পান রপ্তানি হত ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে রেল ওয়াগন ভরতি হয়ে। ইলিশ মাছও বাদ যেত না সে তালিকা থেকে। মাইল তিন চার উত্তরে পদ্মা নদীর ধারে ‘রাইটা’ থেকে বরফ দিয়ে মাছের সেরা ইলিশ মাছ আসত ভেড়ামারা স্টেশনে বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি হওয়ার জন্যে। বৃদ্ধদের মুখে শুনেছি একদা এখানে নাকি বাইশ তেইশটি ইলিশ মাছ মিলত একটাকায়। কুটুম্ববাড়ি যেতে হলে তাঁরা একটাকার ইলিশ মাছ কিনে নিয়ে যেতেন মুটের মাথায় চাপিয়ে! সেই মাছ অবশ্যি শুধু কুটুম্বরাই খেতেন না, আশপাশের আরও অনেকেই রসাস্বাদন করতেন তার। আমরা অতটা না দেখলেও তার খানিকটা আভাস পেয়েছি। খাদ্যদ্রব্য খুব সস্তাই ছিল এখানে, আজ আর অবশ্যি সেদিন নেই। এখন সব কিছুই অগ্নিমূল্য। এখন মাছ থাকলে তেল থাকে না, তেল থাকলে মাছের অভাব ঘটে। সেদিনের রাম যখন নেই, তখন অযোধ্যার অন্বেষণ করা বৃথা। কেন হল এই দৈন্য? গরিব মানুষের কি সুবিধে হয়েছে দেশ-দ্বিখন্ডিত হয়ে? দেশমাতার অঙ্গচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষেরও যে অঙ্গচ্ছেদ হয়েছে সে-কথা মোটেই আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। আগেকার কথা ভেবে তাই অস্থির হয়ে পড়ি সময় সময়, কিন্তু আমার অস্থিরতার মূল্যই বা কী? চেষ্টা করলে পারি না কি আবার আমরা এক হতে? পারি না কি দেশের বুকের ওপর যে শ্বাসরোধক প্রাচীরটা তোলা হয়েছে তাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিতে পারি নাকি আবার আমরা পরস্পরকে বিশ্বাসভরে আলিঙ্গন করতে? কাকে ছেড়ে কার চলবে? তবে কেন সমস্ত মানবিকতাকে বিসর্জন দিয়ে আমরা সাম্প্রদায়িক দৈত্যের দাসত্ব করব জীবনভোর?

গ্রামে বাস করার কোনো অসুবিধেই ছিল না। সরকারি হাসপাতাল, হাই স্কুল, থানা, স্টেশন, নদী ইত্যাদি কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। আশ্বিন-কার্তিক মাসে গ্রামখানিতে যেন লক্ষ্মীশ্ৰী ফুটে উঠত। সব দিকে ব্যস্ততা। সে সময় এত পাট আমদানি হত যে পাটের কাঁচা গন্ধে বাতাস হয়ে উঠত ভারী। একমাত্র পাটকে কেন্দ্র করেই লক্ষ লক্ষ টাকার আদান-প্রদান চলত প্রতিদিন। কলে পাট চাপানো হত–সেই সময়ে কুলিদের সমস্বরে গাওয়া খুশিভরা বিচিত্র ‘হো-আই-লো’ গানের সব টুকরো টুকরো কলি আজও সময় সময় কানে এসে বাজে যেন। অন্য সময় চাল-ধান, ছোলা-মটর আর পানের ফলাও কারবারে ব্যাবসায়ীরা থাকতেন ব্যতিব্যস্ত। লক্ষ্মীর ধ্যানে সকলেই থাকতেন মশগুল, অন্য দিকে মন দেওয়ার তেমন অবসরই থাকত না কারও। দুঃখ হয় সেদিনের কথা ভেবে, কোথায় গেল সেই মধুর দিনগুলো।

মনে পড়ে পুণ্যাহে’র সময় জমিদারের কাছারিতে সে কী খাওয়া-দাওয়ার ঘটা! আকণ্ঠ চর্ব্য-চুষ্য-লেহ্য-পেয়ের পর বাড়ি ফিরতাম শোলার একটা মালা গলায় দিয়ে। এই ‘পুণ্যের আসরে কোনোদিন জাতিভেদ দেখিনি। হিন্দু প্রজা মুসলমান প্রজা সমান উৎসাহের সঙ্গেই জমিদার বাড়িতে খেয়ে এসেছে, গল্পগুজবে মশগুল হয়ে একই সঙ্গে ফিরে এসেছে আপন আপন বাড়িতে। জানি না হঠাৎ সেই মধুর সম্পর্কের মধ্যে কী করে ফাটল ধরল, ‘পুণ্যের মধুর বন্ধনে পাপের প্রবেশ ঘটল কখন কী করে!

আমাদের বাড়ির সামনেই বসত হাট। সপ্তাহে দু-দিন। মনিহারি, জামা-কাপড় থেকে শুরু করে মাটির হাঁড়ি, কলসি, মশলা, প্রায় সব কিছুই পাওয়া যেত হাটে। তরিতরকারি এবং মাছ-মাংস তো বটেই। গ্রামের হাটের সঙ্গে কোথায় যেন একটা বিরাট পার্থক্য আছে শহুরে বাজারের। হাটের সঙ্গে গ্রামের অতিসাধারণ মানুষেরও একটা সুনিবিড় সম্পর্ক আছে। তেমন সম্পর্কের কোনো হদিশ মেলে না শহুরে বাজারে। আমাদের গ্রাম্য হাটটি তাই ছিল একাধারে মিলনক্ষেত্র এবং শিক্ষাক্ষেত্র। সপ্তাহে দু-দিন কেনাকাটা করতে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে দূরগ্রামের লোকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎও হয়ে যেত হাটে। আমরা জিনিস কেনার জন্যে যত না হাটে। গেছি তার চেয়ে বেশি গেছি বন্ধুজন ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে চাক্ষুষ আলাপের জন্যে। এই যে আমাদের গ্রামকেন্দ্রিক আত্মীয়তাপূর্ণ মন তা বিনষ্ট হল কেন? সেই সুন্দর পল্লিজীবন, সেই গোচারণ ক্ষেত্র, সেই মর্মরধ্বনি মুখরিত বেণুকুঞ্জ কোন পাপে আমাদের জীবন থেকে নির্বাসিত হল কে জানে! পল্লিজীবনের সুস্নিগ্ধতা, সরলতা আর বনপ্রান্তরের সৌন্দর্য ও পাখির কাকলি দিয়ে যে জীবন ছিল ঘেরা সে জীবন কি আবার ফিরে পেতে পারি না? পল্লিগ্রামগুলো বাঙালির জাতীয়জীবনের মূল আশা এবং আশ্রয়স্থল। সেই পল্লি থেকেই আমরা হলাম বিচ্যুত! কিন্তু আমাদের কী দোষ?

আজ বেশি করে মনে পড়ছে ‘মায়ের বাড়ি’র কথা। গ্রামবাসীর প্রাণকেন্দ্র হিসেবেই ধরা হত ‘মায়ের বাড়ি’কে। এখনও পর্যন্ত সেই মায়ের কথা চিন্তায় এলেই আপনা আপনি কপালে হাত দুটি উঠে প্রণামের মুদ্রায় রূপান্তরিত হয়ে যায়। বিনা প্রণামে মায়ের কথা বলা ভেড়ামারার লোকেরা চিন্তাই করতে পারে না। দুর্গাপুজো হত এখানে অত্যন্ত ধুমধামের সঙ্গে। মানতের চিনি সন্দেশের যে হাঁড়ি পড়ত তার সংখ্যানির্ণয়ে ফুরিয়ে যেত ধারাপাতে শেখা যত সংখ্যাসমষ্টি! এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত শ্রেণিবদ্ধ হাঁড়ির সারি দেখে শৈশবে বিস্ময়াবিষ্ট হতাম। সারাবছরের মানত শোধ করা হত এই পুজোর সময়। পাছে গোলমাল হয়ে যায় এই ভয়ে প্রতিটি হাঁড়ির গায়ে খড়ি দিয়ে স্পষ্টাক্ষরে নাম লেখা থাকত গৃহস্বামীদের। ছোটো গ্রামখানির বুকে পুজোর কটাদিন ধরে চলত জীবনের জোয়ার। দূর-দূরান্তরের নর-নারীরা আসত মেলা দেখতে, বিগ্রহ দর্শন করতে, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে। একই সঙ্গে পুজো দেখা, আত্মীয়দর্শন এবং জিনিসপত্র কেনাকাটার সুযোগ পল্লিগ্রামে বড়ো বেশি আসে, তাই-দর্শনার্থীর প্রাচুর্য চোখে লাগার মতোই হত। আজও সেইদিনকার ছবি স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠেছে চোখের সামনে। কী সুন্দর গ্রামবাসীদের হাসিখুশি মাখানো মুখগুলো, তাদের ত্বরিত চরণ ধ্বনি, বিশ্রাম ও ব্যস্ততায় হিল্লোলিত অপূর্ব জীবনছন্দ। মনে হচ্ছে যেন দেখতে পাচ্ছি মা দুর্গার সামনে করজোড়ে অঞ্জলি দেওয়ার দৃশ্য–শুনতে পাচ্ছি বৃদ্ধ পুরোহিতের উদাত্ত কণ্ঠের মন্ত্রপাঠ,

অন্ধ্যং কুষ্ঠংচ দারিদ্রং রোগং শোকংচ দারুণম।
বন্ধুস্বজনবৈরাগ্যং হরমে হরপার্বতি।

দুর্গাপুজো সমগ্র বাংলারই পুজো। সেখানে, জাতিভেদের কথা ওঠে না। পুজোর সময় সারাগ্রামে একটা জাতিই চোখে পড়ত তা হল মনুষ্যজাতি। সেইজন্যেই অঞ্জলির পর প্রসাদ গ্রহণের ব্যস্ততা দেখেছি শুধু হিন্দুদের মধ্যে নয়, মুসলমান ভাইদের মধ্যেও। অস্থিমজ্জায় এই যে একাত্মবোধ সেদিন ছিল তা কোথায় গেল আজ? সেদিন তো দেখেছি হরপার্বতী বা উমাকে নিয়ে যে গান হত তাতে উমার দুঃখে কত মুসলমান ভাই-বোনও অশ্রুবিসর্জন করেছেন।

ভুলতে পারছি না ঝুলনের সময় ঠাকুরবাড়ির যাত্রাগানের কথা। সেদিনটি যেন ছিল সমস্ত গ্রামবাসীর জীবনের একটি পরমলগ্ন। সারাবছরের প্রতীক্ষার পর আসত ওই দিনটি। আমার বয়েস ছিল অল্প, তাই উৎসাহও ছিল অনন্ত। সন্ধে না হতেই খেয়েদেয়ে ঠিকঠাক হয়ে যাত্রার আসরে চলে যেতাম। জায়গা না পাওয়ার ভয়ে অভিনয়ের বহুপূর্বেই জায়গা সংগ্রহ করে উদগ্র প্রতীক্ষায় বসে থাকতাম সমস্ত ঠাট্টা-বিদ্রূপ অগ্রাহ্য করেই! ভিড় হত অসম্ভবরকম। ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাড়োয়ারিরা। গ্রামের লোক ঠাকুরবাড়িকে খুব শ্রদ্ধা করত। বাড়ির সামনে কালীঘরে কালীপুজো উপলক্ষ্যে গান বাজনার আসর বসত হামেশাই। কালীপুজোর দিন বাড়ির গুরুজনেরা আমাদের টিকিটি দেখতে পেতেন না, আমরা সবাই থাকতাম মহাব্যস্ত। বলির পাঁঠাদের তত্ত্বতল্লাশ করতাম, মহাযত্নে তাদের কাঁঠালপাতা খাওয়াতাম, তাদের কোলে করে আদর করতাম সমস্ত দিন! কিন্তু এত আদরযত্নে যাদের লালন করলাম সমস্তটা দিন ধরে সেই স্নেহের জীবটিকে মুহূর্তে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে কোনো ব্যথাই অনুভব করিনি! মনের এই দ্বৈতপরস্পর-বিরোধিতার গুণগত ব্যাখ্যা করার বয়েস তখন না হলেও আজ খুব বিস্ময় লাগে তা ভাবতে। সেই জিনিসই কি গোটা বাংলার বুকে ঘটে গেল না?

‘নরমেধযজ্ঞ’ বা ‘নহুস উদ্ধার’ অভিনয় আমাদের একদিন সকলকেই মোহাবিষ্ট করত আজও বেশ মনে পড়ে। অভিনয়ে সুদখোর রতন দত্তের চাপে পড়ে দরিদ্র ব্রাহ্মণ সিদ্ধার্থ তার শিশুপুত্র কুশধ্বজকে তুলে দিলেন রাজা যযাতির নরমেধযজ্ঞে বলি দেওয়ার জন্যে। এই দৃশ্য দেখে আমরা সেদিন জাতিধর্ম-নির্বিশেষে ডুকরে কেঁদে উঠেছি। লক্ষ করেছি আসরের আবহাওয়া মুহূর্তে পালটে গেছে শোকের গভীরতায়, কোনো দর্শকের চোখ সেদিন শুকনো ছিল না। অভিনয় সার্থক হয়ে যেন বাস্তবের রূপ পেত। আজ নহুসের কথাই বেশি করে মনে পড়ছে এইজন্যে যে তার প্রেতাত্মা কেঁদে কেঁদে বেড়াচ্ছে শুনতে পাচ্ছি। তার উদ্ধারের জন্যে মানুষের রক্ত চাই,–সে রক্তক্ষরণ তো হল এই বিশ শতকের শেষার্ধে! এখনও কি আমার উদ্ধার আশা করা যায় না নহুসের সঙ্গে সঙ্গে? এত রক্ত কি বিফলে যাবে? আমার মনে হয়, এই যে বিচ্ছেদ আজ এসেছে তা মিলনেরই ভূমিকামাত্র। সীতা’ অভিনয়ে আমরাই তো জোরগলায় শ্রোতাদের শুনিয়েছি,

জননি আমার
হেন প্রশ্ন তুমি কর দেবী?
বাল্মীকির রাম-সীতা চির-অবিচ্ছেদ;
অন্তরে অন্তরে চিরন্তন
মিলনের প্রবাহ বহিছে।

মনে হয় এই মিলন-প্রবাহ অধুনা ক্ষীণ হলেও একদা প্রাণগঙ্গায় জোয়ার এসে সমস্ত ক্লেদ নিয়ে যাবে ভাসিয়ে। বাল্মীকি মহাকবি, তাঁর কথা মিথ্যে হতে পারে না। আমরা সে মিলনের জন্যে আগ্রহে প্রতীক্ষা করব। ‘আসিবে সে দিন আসিবে।’

হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, মাড়োয়ারি বলে আমাদের গ্রামে কোনো পার্থক্য দেখিনি। বহু মাড়োয়ারি এসে বাস করতেন ভেড়ামারায়, কিন্তু লক্ষ করেছি সবাই থাকতেন মিলেমিশে এক হয়ে। দেখেছি দু-পাঁচশো টাকা দরকার হলে চেয়ে আনত একজন অন্য আর একজনের কাছ থেকে। লেখাপড়ার কোনো দরকার হত না তার জন্যে। এই যে আত্মবিশ্বাস এর ওপরেই ছিল সেদিনকার প্রাত্যহিক জীবন। পরিশোধের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। এই লেনদেনে কোনোদিন কোনো কলহবিবাদ দেখিনি আজকের মতো। এত সুবিধে-সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেউ কাউকে বড়ো একটা ঠকায়নি বা অবিশ্বাসের কোনো কাজ করেনি। পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করত, পরামর্শ দিত, পরামর্শ শুনত, পরামর্শমতো কাজও করত দ্বিধাহীনচিত্তে। সেখানে হিন্দু-মুসলমান বা মাড়োয়ারির গন্ডি টেনে জনজীবনকে কেউই সীমাবদ্ধ করত না। মাড়োয়ারি বন্ধুদের বাড়িতে প্রায়ই জুটত নিমন্ত্রণ। খাওয়াতে তাঁরা ছিলেন মুক্তপ্রাণ। বাড়িতে বেড়াতে গেলেও খাওয়ার ঘটা দেখে চোখ উঠত কপালে! তাঁদের ‘লাড়ু-মন্ডা-টিকরা’র স্বাদ এখনও ভুলতে পারিনি। সেই ঘিয়ে জবজবে খাবার এখনও জিভকে সরস করে তোলে সময় সময়! কোথায় সেদিন? কোথায় সেই মনের আত্মীয়তা? কোথায় সেই ভেড়ামারা?

অনেক সময় বাবাকে গ্রামের বাইরে যেতে হত দীর্ঘদিনের জন্যে। আমরা তখন ছোটো। মা থাকতেন একা অতবড়ড়া বাড়িতে আমাদের ক-জন নাবালককে নিয়ে। ক্ষুদিরামদাদা কিংবা ভবতারণ জ্যাঠার বাড়ি একটু দূরে ছিল বলে সব সময় খোঁজখবর নিতে পারতেন না তবু আমরা অসহায় বোধ করিনি কোনোদিন। সামনের রিয়াজুদ্দিন মন্ডল আর পাশের গৌরীশংকর আগরওয়ালা সর্বদাই খোঁজ নিতেন। আমাদের কোনোকিছুর প্রয়োজন হলে সঙ্গে সঙ্গে তার ব্যবস্থা করতেন। বাড়িতে পাহারা দিত জমিজমা তদারককারী আলিমুদ্দিন কিংবা কলিমুদ্দিন। তাদের আমি ‘দাদা’ বলে ডাকতাম। কোনোদিন তাই মনে হয়নি তারা মুসলমান বলে দূরের কেউ। তারা আমার অগ্রজতুল্য, যেখানেই থাকুক তারা সুখে থাকুক এই কামনাই করছি।

মনে পড়ছে এই আলিমুদ্দিনদা আর কলিমুদ্দিনদাই আমাদের প্রথম এসে বাধা দিয়ে ছলছল চোখে বলেছিল, ‘জমি-জায়গা বিক্রি করবেন না, বাবু! দেশ ছেড়ে কোথায় যাবেন? কতদিন থেকে আপনাদের খেয়ে আপনাদেরই কাছে পড়ে রয়েছি। এত সহজেই মায়া কাটিয়ে চলে যেতে পারবেন?’ কই তারা তো সম্প্রদায়ের গন্ডি টেনে আমাদের দূরে সরাতে চায়নি, রাজনীতির যূপকাষ্ঠে দেশকে দ্বিখন্ডিত করতে চায়নি, দেশের এবং জনগণের অভিশাপে অভিশপ্ত হয়ে উৎসাহ দেখায়নি। তারা গ্রামের নির্বিরোধ নিরীহ প্রজা, তাদের সামনে লোভের মোহ নেই। তাই তারা কেঁদেছিল আমাদের চলে আসার সময়।

যাবার বেলা সকলেই পিছু ডেকেছে, বাধা দিয়েছে পিতৃভিটে বিক্রির বিরুদ্ধে। আত্মীয়-অনাত্মীয়েরা কেঁদেছে, মাড়োয়ারিদের মা-বউরাও স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেছে। গাড়ির জানলা দিয়ে দেখেছি আমার অতিপ্রিয়জনরা প্ল্যাটফর্মে করুণ মুখে, সিক্ত নয়নে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকের চোখেই ফিরে আসার মিনতি। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করেছে–তোমরা তো চলে গেলে, আমরা কী করব? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। কাপুরুষের মতো মুখ লুকিয়ে এড়িয়ে গেছি সে-কথা। আজ ধিক্কার দিই নিজেকে,–জানি না যারা সেদিন এ প্রশ্ন তুলেছিল তারা আর কোথাও সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছে কি না। জানি না আজ তারা কোন ক্যাম্পে মাথা গুঁজে মৃত্যুকে এড়িয়ে চলেছে? আমাদের বাড়ির বুড়ি ঝি এখনও কি বেঁচে আছে?

এখনও চোখ বন্ধ করলে, কান ঢাকলে শুনতে পাই রেলগাড়ি চলার শব্দ। সেদিন যে ট্রেন ভেড়ামার থেকে বাঁশি বাজিয়ে ছেড়েছে আজও যেন তার গতিরোধ হয়নি। জানি না নিরবধি কালের কোন পর্যায়ে সে আমাদের নির্বিঘ্নে স্টেশনে পৌঁছে দেবে,–সেই গতিহীন অনন্তযাত্রার সমাপ্তির রেখা কবে দেবে টেনে।

স্বপ্নে হঠাৎ হঠাৎ প্রায়ই যেন কানে আসে–’কোথায় যাবেন বাবু, এত সহজেই কি গাঁয়ের মায়া কাটিয়ে চলে যেতে পারবেন?’–চমকে উঠে বলি–আলিমুদ্দি-কলিমুদ্দি দাদা! তোমাদের কথাই ঠিক, তোমাদের মায়া কাটানো সোজা নয়, তোমরা আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাও। আমাদের কথা কি আলিমুদ্দিনদাদাদের কানে কেউ পৌঁছে দেবে? আবার কি আমরা ফিরে পাব পল্লিজীবনের সেই মধুর পরিবেশ?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *