৪
বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে ওদের গাড়িতে তুলে দেবার পর রঞ্জন বাড়ি ফিরল না। চুপটি করে গিয়ে বসল সামনের পার্কে। সে জানে, মা উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছে। আর যার চোখকেই ফাঁকি দেওয়া যাক মায়ের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারেনি। ও জানে, যে মা জানে। মা জানত। মায়ের কাছ থেকে লুকোনো যায়নি, লুকানো যায় না।
রঞ্জন কিছু শিশু নয়— চোদ্দো বছর কদিন হয় তার হিসাব ভালোমতই জানা। যে নিদারুণ আঘাতে চোদ্দো বছর আগে পাঁজরটা গুঁড়িয়ে গিয়েছিল এতদিনে তার ধার খয়ে যাওয়ার কথা— গিয়েছিলও তাই। রঞ্জন হাসত, খেলত সিনেমা দেখত বন্ধুদের নিয়ে হৈ চৈ করত। কে বলবে তার বুকের পাঁজরায় একটা প্রকাণ্ড ক্ষতচিহ্ন। এম এ পাস করা পর্যন্ত মা. কোনো তাগাদা দেয়নি—তারপর চাকরি পাওয়ার পর থেকে নানাভাবে প্রসঙ্গটা পেড়েছে। মায়ের বয়স হয়ে যাচ্ছে, একা হাতে আর পেরে ওঠে না—রঞ্জন বুঝত সবই, কিন্তু রাজি হয়নি। একটা অতীত স্মৃতিকে মূর্খের মতো আঁকড়ে থাকার যে কোনো অর্থ হয় না, এটা ভালমতোই জানে; কিন্তু কী করতে পারে সে? ও বিষয়ে আর কোনোদিনই উৎসাহ বোধ করেনি। এত এত মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, ঘনিষ্ঠতা হয়েছে কিন্তু ওর ছত্রিশ বছরের জীবনে দ্বিতীয়বার আর বসন্ত আসেনি। কারও পথ চেয়ে সে প্রতীক্ষা করছিল কি না?
—নিশ্চয় নয়। সে তো পাগল নয়। তবে ঐ! ও বিষয়ে সে নির্লিপ্ত। মা যে জানত তার প্রমাণ— আজ চোদ্দো বছরের মধ্যে একবারও ছেলের কাছে ঐ নামটা উচ্চারণ করেনি; একবারও সরাসরি জানতে চায়নি, হ্যাঁরে খোকা! সেই হতভাগীটাকে ভুলতে পারিসনি, না রে?
সচেতনভাবে নিজের কাছেও সে-কথা ও স্বীকার করত না। তার কথা মাঝে মাঝে ঘুম না-আসা রাতে মনে পড়ত –ভাবত, সে তো মারা যায়নি; এই দুনিয়ারই কোনো এক অচেনা গৃহের অজানা কক্ষে হয়তো সে হতভাগীও বিনিদ্র বালিশ আঁকড়ে পুরনো দিনের রোমন্থন করছে— সেই প্রথম সাক্ষাতের উষ্ণ বাক্য বিনিময় থেকে শেষ সাক্ষাতের উষ্ণ স্পর্শ পর্যন্ত। চোদ্দো বৎসরেও সে উত্তাপ শীতল হয়ে যায়নি। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে—হঠাৎ একদিন রঞ্জন ঘটনাচক্রে তার মুখোমুখি হয়ে পড়ল। দুজনে দুজনকে চিনতে পারবে তো? কী পরিবেশে? একদিন প্রথম সম্বোধনের অনড় পাঁচিলটা ভেঙে ফেলতে দুজনেই যেমন উদ্গ্রীব ছিল, অথচ ভাষা খুঁজে পেত না— আবার কি তাই হবে? রঞ্জন কি পেশ করবে সেই চিরাচরিত প্রশ্নটা –আমাদের গেছে যা দিন, তা কি একেবারেই গেছে, কিছুই কি নেই বাকি?
আর মিনতি জবাবে জানাবে ও প্রশ্নের একমাত্র জবাব –রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে!
কিন্তু পটভূমিটা যদি রেলগাড়ির কামরায় না হয়? যদি হয়, অন্য কোনো অবাঞ্ছনীয় পরিবেশে! অকৃতদার রঞ্জন যদি কামনার তাড়নায় বন্ধুদের সঙ্গে উপস্থিত হয় কোনো বারবিলাসিনীর ডেরায় –আর সেখানে সাক্ষাৎ পায় তার? মনে মনে শিউরে উঠত রঞ্জন! না! তা কখনই হবে না! নিজের অজ্ঞাতেই মিণ্টি ওকে রক্ষা করবে—কোনো দিন ওসব পাড়ায় পা বাড়াতে দেবে না! যদি হঠাৎ দেখা হয়ে যায়— এই ভয়ে!
কি সব আবোল তাবোল ভাবছে! এখানে ওখানে জোড়ায় জোড়ায় বসে আছে কয়েকজন। যাদের নীড় তছনছ করে দিয়ে যায়নি ডাকাতে। রঞ্জন ওদের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল। না, এখন বাড়ি ফিরবে না সে। মায়ের মুখোমুখি হবার আগে একবার নিজের মুখোমুখি হওয়া দরকার।
গোকুলচন্দ্র মাত্র বছর তিনেক ছিলেন ওদের একতলার ভাড়াটে হিসাবে। রঞ্জন যখন ফার্স্ট-ইয়ারে ঢোকে তখন ওঁরা আসেন, যে বছর সে বি. এ. দেয় সে বছর চলে যান। রঞ্জনের বাবা হরিবিলাসবাবু তখনও জীবিত। তখনও কোর্টে বের হতেন। দ্বিতলে বাপ- মা- ছেলের ছোট সংসার। একতলায় ভাড়া ছিলেন অধ্যাপক গোকুলচন্দ্র, তাঁর পুত্র-পুত্রবধূ আর একমাত্র নাতনিকে নিয়ে। আর ছিল প্রকাণ্ড একটা কুকুর। ওঁরা যেদিন প্রথম এলেন সেদিনটার কথা ওর স্পষ্ট মনে আছে। সেদিনই লক্ষ্য করেছিল মিনতিকে—এগারো বছরের নেহাত বাচ্চা মেয়ে। বাড়ন্ত গড়ন কিন্তু। রঞ্জন সাহস করে তার সঙ্গে আলাপ করতে পারেনি। মিনতি ভর্তি হয়েছিল মেয়েদের স্কুলে। বেণী দুলিয়ে স্কুলে যেত আসত। দ্বিতলের বারান্দা থেকে একজন যে তাকে লক্ষ্য করে এটা সে নিশ্চয় জানত, কারণ ভুলেও উপর দিতে তাকিয়ে দেখত না। দুটি পরিবারে ঘনিষ্ঠতাও ছিল যথেষ্ট। গোকুলের পুত্রবধূ দ্বিতলে ওর মায়ের কাছে আসতেন, মিনতিও আসত মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে। অথচ কী আশ্চর্য, দুজনেই দুজনকে এড়িয়ে চলত। রঞ্জন লক্ষ্য করত, পাড়ার আর পাঁচটা ছেলের সঙ্গে প্রয়োজনে মিনতি কথা বলে; পূজা প্যান্ডেলে ওকে বাবলু সুখেনের সঙ্গে গল্প করতে দেখেছে। কি জানি কেন, এক ছাদের নিচে বাস করেও মেয়েটা কোনোদিন ওর সঙ্গে কথা বলেনি। আঠারো-উনিশ বছরের একটি ছেলের এ জন্য আত্মসম্মানে আঘাত লাগলে দোষ দেওয়া যায় না। সে কোনোদিন ভেবে দেখেনি, ব্যাপারটা উল্টো দিক থেকেও সত্য। এক ছাদের নিচে বাস করা একটা বারো বছরের মেয়ের সঙ্গে সে-ও তো এগিয়ে গিয়ে আলাপ করতে পারত। আত্মসম্মানে তো এ পক্ষেরও লাগতে পারে? এ-কথাটা সে বয়সে তার খেয়াল হয়নি।—এমন ভাব দেখাত যেন খেয়ালই নেই, একতলার ভাড়াটে বাড়িতে বেণী দোলানো একফোঁটা একটা মেয়ে ক্লাস সেভেন না এইটে পড়ে।
বাবলু হয়তো কৌতূহলী হয়ে মাঝে মাঝে ওকে প্রশ্ন করত, এই রঞ্জু তুই সিংহবাহিনীর সঙ্গে কথা বল্সি না কেন রে? ভাব নেই?
গোকুলচন্দ্রের পোষা কুকুরটা ছিল সিংহের মতো। মিনতির ন্যাওটা। তাই বন্ধুমহলে মিন্টিকে সবাই ঠাট্টা করে বলত –সিংহবাহিনী।
রঞ্জন বলত, ভাব আবার কী? এক বাড়িতে থাকি, ও আমাকে চেনে আমি ওকে চিনি। ব্যাস। অত আদিখ্যেতা আমার নেই।
সুখেন ফোড়ন কাটত, তাতেই তো ভয় হয় কেলেঙ্কারিয়াসই কিছু করছিস না তো! অত লোক দেখানো নির্লিপ্ততা কেন বাওয়া? সিঙ্কিং সিঙ্কিং…
রঞ্জন ধমক দিয়ে থামিয়ে দিত ওদের। এ সব রসিকতা বরদাস্ত হত না।
এক একবার ভাবত কথা বলে দেখলেই হয়—দেখাই যাক না, ও আলাপ করতে আগ্রহী কি না। সিঁড়ির মুখে, সদর দরজায় আচমকা দেখা হত। দুজনেই পাশ দিত! চমকে উঠত—সম্বোধনের বাধাটা কেউই অতিক্রম করতে পারত না। আচ্ছা ও তো, ঠিক চারটে দশে স্কুল থেকে ফেরে; ঠিক তখনই যদি রঞ্জন হঠাৎ ঘটনাচক্রে সদর দরজায় দাঁড়ায়? ওকে দেখে বলে স্কুল থেকে ফিরছ বুঝি?
যা মুখফোড় মেয়ে। হয়তো জবাবে বলবে, না গঙ্গাস্নান করে।
হ্যাঁ মুখফোঁড়। বাবলু-সুখেন দুজনেই বলে, সিংহবাহিনী কথার পিঠে কথা বলায় ওস্তাদ!
তারপর একদিন আলাপ হল নিতান্ত অ-রোমান্টিক পরিবেশে।
কলিং বেল বাজতে রঞ্জন উঠে গিয়েছিল সদর দরজা খুলে দিতে, মনে আছে, ছুটির দিন, হয়তো রবিবার। বাপি বাড়িতে। সকালবেলা। বাপি দক্ষিণের বারান্দায় ইজিচেয়ারে খবরের কাগজ পড়ছেন; মা রান্নাঘরে। দরজাটা খুলে দেখে একতলার সেই সিংহবাহিনী; আজও স্পষ্ট মনে আছে দৃশ্যটা। ফ্রক ছেড়ে সবে শাড়ি ধরেছে। মাথার চুল খোলা। রঞ্জনকে দেখে একটু হকচকিয়ে যায়। তারপর সামলে নিয়ে বলে, দাদু পাঠিয়ে দিলেন।
ওর হাতে একটা খাম। বুঝতে অসুবিধে হল না মাসের এটা প্রথম সপ্তাহ। অর্থাৎ বাড়ি ভাড়ার টাকা। সেই আলাপই হল, অথচ একটা বিশ্রী অ-রোমান্টিক পরিবেশে। হাত বাড়িয়ে খামটা নিল। বললে, ও!
পুরো দশ সেকেন্ড দুজনেই চুপচাপ। চৌকাঠের দু-প্রান্তে দুজন শেষ পর্যন্ত রঞ্জনই মরিয়া হয়ে বলে বসল, ভিতরে আসবে?
বলেই খেয়াল হল—ওর বাক্যটা প্রশ্নবোধক চিহ্নে শেষ হওয়াটা ঠিক হয়নি। ওর বরং বলা উচিত ছিল।— ভিতরে এস না।
মেয়েটি জবাবে বললে, না! আপনি টাকাটা বরং গুনে দেখুন।
রঞ্জন হেসেই বলেছিল, গুনে দেখার কী আছে? তোমার দাদুই তো গুনে দিয়েছেন।
—তা হোক।
মেজাজের ব্যারোমিটারে পারদ ঊর্ধ্বগামী। মেয়েটা কী বলতে চায়? রঞ্জন ঐ খাম থেকে দুখানা নোট হাতাবে? পরে বলা হবে— গুনতিতে কম ছিল। কুঞ্চিত ভ্রুভঙ্গে বলে, কেন বলো তো?
—সেটাই নিয়ম। টাকা গুনে নিতে হয়।
ব্যস্! মেজাজ সপ্তমে। রঞ্জন শ্লেষ মিশিয়ে বললে, তাই বুঝি? দুদিন পরে যখন বিয়ে হবে তখন বরের কাছ থেকে মাসকাবারি টাকা গুনে নেবে?
উড়ন তুবড়িতে যেন আগুনের স্পর্শ। মেয়েটা ছিটকে সরে গেল এক পা। এতক্ষণে সিংহবাহিনী হয়ে বললে, আপনি ইতর।
চেঁচামেচিতে মা বের হয়ে এসেছে রান্নাঘর থেকে —কী রে? ও মা মিন্টি, কখন এলি?
রঞ্জন খামটা মায়ের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললে, ভাড়ার টাকাটা ঐ সিংহবাহিনীর সামনে গুনে নিও—হাত সাফাই কোরো না!
মা তো তাজ্জব। কিছু বলবার আগেই রঞ্জন হাওয়া। সেই ওদের প্রথম সাক্ষাৎ। পরে রঞ্জন বুঝেছিল, দোষটা তারই। মেয়েটা এমন কিছু অপমানকর কথা বলেনি। অহেতুক কড়া কথা না বললেই হত। আসলে ওর রাগ হয়েছিল মেয়েটার ওপর নয়, ভাগ্যদেবতার ওপর। প্রথম সাক্ষাতের মুহূর্তটাতে অমন টাকা-পয়সার ভেজাল ঢুকে যাওয়ায়। ভুলটা শুধরে নেবার সুযোগ হয়ে গেল অবশ্য কিছুদিনের মধ্যে। মা পৌষ-পার্বণের পিঠে ভাজছিল; হঠাৎ বললে— এই পাত্রটা একতলার মাসিমাকে দিয়ে আসবি খোকা?
রঞ্জন জানত, এ জাতীয় আদান-প্রদান প্রায়ই হয়ে থাকে। একতলার পায়েস দোতলায় আসে। দোতলার মালপোয়া একতলায় যায়। গোকুল পিঠের বাটিটা নিয়ে রঞ্জন নেমে গিয়েছিল নিচে। ঘটনাচক্রেই বলতে হবে—কলিং বেল বাজাতে ডেভিলের ঘেউ ঘেউ অগ্রাহ্য করে দরজা খুলে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল মিনতি। কনভার্স থিয়োরেম। এবার ও সিঁড়ির চাতালে ও চৌকাঠের এ পারে, মেয়েটি ওপারে। একই ভঙ্গিতে পাত্রটা বাড়িয়ে ধরে বলেছিলে, মা পাঠিয়ে দিলেন।
মেয়েটি সপ্রতিভের মতো বললে, ও! পৌষ-পার্বণের পিঠে বুঝি?
—হ্যাঁ! কারও পৌষমাস, কারও সর্বনাশ!
—সর্বনাশ! কার আবার সর্বনাশ?
—আমার! সামনে পরীক্ষা।
মিনতি কিন্তু সে ভুল করেনি। প্রশ্নবোধক চিহ্নে শেষ করেনি পরবর্তী বাক্যটা। বলেছিল, সিঁড়ির মধ্যে কেন? ভিতরে আসুন না?
গেলেই হত; কিন্তু মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, না থাক।
—কেন? ডেভিলের ভয়ে? ও কিছু বলবে না। আমি যে সিংহবাহিনী।
—জানি! সেজন্য নয়। সামনে পরীক্ষা।
—ও তবে থাক।
আবার পুরো দশ সেকেন্ডে দুজনেই চুপচাপ। শেষ রঞ্জন মরিয়া হয়ে বলল, গুনে নাও।
—গুনে নেব? কী গুনে নেব?
—বারোটা পিঠে আছে। গুনে নেওয়াই নিয়ম।
খিলখিলিয়ে হেসে উঠল মেয়েটা। কি মিষ্টি হাসি ওর। বলে, তাই বুঝি? দুদিন পরে যখন বিয়ে হবে তখন বউকে নিশ্চয় মাসকাবারি টাকা গুনে নিতে বলবেন।
রঞ্জন হেসে ফেলে। বলে, এ-কথার জবাবে আমার যা বলার কথা, তা আমি বললাম না কিন্তু।
—কী আপনার বলার কথা?
—আমি বলতে পারতুম — ‘তুমি ইতর।’
আবার খিলখিলিয়ে হাসি! বললে তাহলে কী বলবেন?
ইচ্ছে করে বলেনি। নেহাৎ মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল কথাটা। বস্তুত ও স্বেচ্ছায় বলেনি— ভিতর থেকে কে যেন ওর কানে কানে ‘প্রম্পট’ করল। রঞ্জন ‘রিপিট’ করল শুধু — ‘তুমি সুন্দর!’
মনে হল কথা নয়, এক মুঠো আবির ছুড়ে মেরেছে।
সেই শুরু। তারপর অতিক্রান্ত-কৈশোর ওরা দুজনে সকলের অগোচরে কেমন করে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিল একটা গোপন দুনিয়া তা শুধু ওরা দুজনেই জানে। বাইরের পৃথিবী সে কথা জানতে পারেনি। সুখেন তখনও বলত আয় না একদিন সিংহবাহিনীকে ডেকে তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। রঞ্জন একই ভঙ্গিতে নির্লিপ্ততার ভান করে বলত— দায় পড়েছে আমার।
এমনকি ডেভিল ছাড়া বাড়ির লোকেরাও জানত না। জানত না যে, ওদের দুজনের ভাব হয়েছে, আড়ালে দুজনে বকম্ বম করে—সিঁড়ির কোনায়, চিলেকোঠায়; এমনকি ক্বচিৎ কখনও ক্লাস পালিয়ে ম্যাটিনির সিনেমাতেও। ঠিক চারটের সময় রঞ্জন গিয়ে হাজির হত ওদের স্কুলের গেটের অদূরে। তারপরে ঘুরপথে দুজনে বাড়ি ফিরত, অনেকটা আগুপিছু করে।
মনে পড়েছে সেই দুর্ঘটনার কথাও। সিঁড়ির মধ্যে ওদের দুজনকে আবিষ্কার করে অধ্যাপক গোকুলচন্দ্র স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। হঠাৎ সুইচ জ্বেলে তিনি যেন ভূত দেখলেন—এ কি! কী করছিস তোরা ওখানে? অন্ধকারের মধ্যে?
মিনতি ছুটে পালিয়ে গিয়েছিল। রঞ্জন পালাতে পারেনি। আত্মসম্মানে বেধেছিল তার।
ঐ ঘটনার কিছুদিন পরেই মিনতির বাবা কাশীতে চলে যান।
মা তখনই আন্দাজ করে। হয়তো পুরোপুরি বুঝতে পারেনি।
সবটা বুঝতে পেরেছিল যেদিন কাশীর বাড়িতে ডাকাতি হবার খবরটা এল। গোকুলচন্দ্র বজ্রাহত হয়ে গেলেন। রঞ্জনই তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল কাশীতে। ফিরে এল তিন দিন পরে। মিনতির মায়ের দেহ মণিকর্ণিকার ঘাটে দাহ করে। বৃদ্ধ যেন পাষাণ হয়ে গেলেন। তাঁর আঘাতটার তবু অর্থ হয়—একমাত্র পুত্রবধূ। আর একমাত্র নাতনি। কিন্তু রঞ্জন? প্রতিবেশী পরিবারের মর্মান্তিক আঘাতে কে না আহত হয়—কিন্তু এ কী! রঞ্জন যেন পাষাণ হয়ে গেল। তখন তার অবস্থা এমন যে, কে-কী ভাবছে তা বুঝতে পারত না। তখনই বুঝতে পেরেছিল মা।
কিন্তু সে তো বারো চোদ্দো বছর আগেকার কথা। সব শোকই সময়ে মানুষ সহ্য করে। রঞ্জনও করেছে। সে হাসে, খেলে গান, গায়, সিনেমা দেখে কিন্তু তার যৌবনে দ্বিতীয় বার আর বসন্ত আসেনি। ও কিছুতেই ভুলতে পারেনি তার সিংবাহিনীর সেই বিদায় বেলার প্রতিশ্রুতি –কথা দাও। যত যাই হোক, তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করবে?
বাহুবন্ধন দৃঢ়তর করে রঞ্জন বলেছিল, ভয় তো সেদিকে নয় মিন্টি, ভয় তোমার তরফে। মাসিমা আর মেসোমশাই যদি তোমার অন্য কোথাও বিয়ের ঠিক করেন?
—আমি কিছুতেই রাজি হব না। দরকার হলে সব কথা মাকে খুলে বলব।
—তাই বোলো। আমিও বলব। মাকে। তোমার দাদু তো কিছুটা জানেন—
—হ্যাঁ! স্বচক্ষেই তো দেখেছেন সেদিন!
—তোমাকে বকাবকি করেননি?
—না। তোমাকে?
—বিশেষ কিছু নয়। উনি ভেবেছেন, এ আমাদের ছেলেমানুষি।
সেই ওদের শেষ সাক্ষাৎ। তারপর আর দুজনের দেখা হয়নি। পত্র বিনিময়ও নয়। দুপক্ষের কেউই সাহস পায়নি চিঠিপত্র লিখতে।
আশ্চর্য! সেই মিন্টি আজ এতদিন পরে, চোদ্দো বছর পরে, এসে দাঁড়াল শাঁখারিপাড়া লেনের বাসায় অথচ তার রঞ্জনদাকে চিনতে পারল না! কিছুই তার মনে নেই। মায়া শেফালী, বাবলু সুখেন—কারও কথা তার মনে পড়ে না।
তাই রঞ্জন আজ বাড়ি ফিরতে ইতস্তত করছিল। সে জানত, নিশ্চিত জানত— যে কথাটা আজ চোদ্দো বছর ধরে সঙ্গোপনে রেখেছে ওর মা, আজ তাই জানতে চাইবে। একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবে। খোকার ধনুর্ভঙ্গপণ ভাঙা যায় কি না পরখ করতে চাইবে।
কী বলবে রঞ্জন?