কুলের কাঁটা – ৩

মাস তিনেকের ভিতরে গোকুল সত্যই অন্ধ হয়ে গেলেন। আরও মাসতিনেক পরে অবিনাশ ‘দুর্লভ-নিকেতন’ ছেড়ে নিজের শালার কাছে ফিরে এলেন। দুর্জনে বলে তিনি নাকি বৃদ্ধের অন্ধত্বের সুযোগে তাঁর সব খাতাপত্র তন্ন তন্ন করে হাতড়ে দেখেছেন। গুপ্তধনের কোনো সন্ধান তো দূরের কথা ইঙ্গিতও পাননি। ব্যাঙ্কের পাস বইয়ে তার হদিশ নেই, বাক্সে ড্রয়ারে কোনো শেয়ার, ক্যাশ সার্টিফিকেট, বা সম্পত্তির দলিল খুঁজে পাননি। রাতারাতি এত টাকা তাহলে কোথায় সরিয়ে ফেললেন বৃদ্ধ? এর কিছুদিন পরেই অবিনাশ সস্ত্রীক রাজগিরে চলে যান, বাতগ্রস্তা সহধর্মিণীর চিকিৎসা করাতে।

শনিচরী ফিরে আসার আগেই রওনা হলেন ওঁরা। আরাধনা বেশ উপকার পাচ্ছিলেন, তবু কি জানি কেন তিনিও বাড়ি ফেরার জন্য উদ্‌গ্রীব। লছমী তো উঁচিয়ে আছে কলকাতা শহর দেখার লোভে। হিসাবপত্র মিটিয়ে অবিনাশ পাণ্ডাজিকে বললেন, আর একটা কথা। বলি বলি করেও কথাটা আপনাকে এতদিন বলিনি। আমার স্বর্গগতা ভগ্নীর একটি কন্যাকে চোদ্দো বছর আগে ডাকাতে ধরে নিয়ে যায়। আমাদের সেই হারানো নাতনির সঙ্গে লছমীর চেহারায় বেশ মিল আছে। আমার বৃদ্ধ ভগ্নীপতি জীবিত। কিন্তু তিনি অন্ধ। আমি স্থির করেছি, লছমীকে নিয়ে গিয়ে বলব, তাঁর হারানো নাতনিকেই আমি নিয়ে এসেছি। অন্তত শেষ জীবনের বাকি কটা দিন অন্ধ বৃদ্ধ কিছু শান্তি পাবেন।

স্তম্ভিত হয়ে গেল পাণ্ডাজি। আমতা আমতা করে বলল, তাঁকে কী বলবেন? কোথায় কেমন করে মেয়েটিকে পেলেন?

—বলব যে আজ থেকে চোদ্দো বছর আগে আপনি –রাজগিরের পাণ্ডা শ্রীরামপ্রসাদ শর্মা—কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাটে একটি দশ বছরের মেয়েকে কাঁদতে দেখে তাকে কুড়িয়ে এনে কন্যার মতো মানুষ করেছেন।

বাদ বাকি সত্যি কথা বলব—অর্থাৎ লছমীর এগারো বছর বয়সে বিয়ে হয়, তারপর দ্বিরাগমনের সময় তার নামে মিথ্যা বদনাম দিয়ে-

বাধা দিয়ে পাণ্ডাজি বলে, এতে পাপ হবে না বাবুজি?

—না, হবে না! আপনি তো গীতা পড়েছেন। ফলের আকাঙ্ক্ষাই হচ্ছে পাপ। আমার উদ্দেশ্য কী? একটা মরণোন্মুখ অন্ধ বৃদ্ধকে সান্ত্বনা দেওয়া।

—কিন্তু আজ থেকে চোদ্দো বছর আগে আমি তো কাশী যাইনি?

—সেটা কীভাবে প্রমাণ হবে বলুন? ঐ চোদ্দো বছরের কথাই বলতে হবে। না হলে চার-পাঁচ বছরের ফাঁক থাকলে অনেক বাধা-আপত্তি দেখা দেবে। আত্মীয়-স্বজনরা কেমন মানুষ তা তো জানেনই। হয়তো তারা বলে বসবে, ঐ কয় বছর মেয়েটি ঘৃণিত জীবন যাপন করেছে। তাহলে আমাদের নিষ্ঠাবান গোঁড়া পরিবারে—বুঝতেই তো পারছেন।

পাণ্ডাজি বলল, মেয়েকে যখন আপনার হাতে তুলে দিলাম তখন ভালমন্দর ভারও আপনার। আমার তো হাত-পা ধোওয়া।

—না পাণ্ডাজি। প্রথমত, লছমীকে আপনি এখন কিছু বলবেন না। সে হয়তো ঘাবড়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, এর পর কেউ কখনও যদি আপনার কাছে খোঁজ নিতে আসে তবে আপনি বলবেন, সে আপনার পালিতা কন্যা। কাশীতে তাকে কুড়িয়ে পেয়েছেন। রাজি?

পাণ্ডাজি তার টাকে হাত বুলোতে থাকে নীরবে।

অবিনাশ একশ টাকার পাঁচটা নোট ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন, মিথ্যাভাষণের জন্য যদি কোনো পাপ হচ্ছে মনে হয়, তবে একটা পুজো টুজো চড়িয়ে দেবেন।

পাণ্ডাজি বজ্রাহত হয়ে গেল।

ট্রেন ছাড়তে লছমী বললে, একী? এ গাড়ি তো পশ্চিমুখো যাচ্ছে।

আরাধনা বলেন, হ্যাঁ রে আমরা আগে কাশী যাচ্ছি। কাশী ঘুরে কলকাতা ফিরব।

লছমী বলে, কেন মাইজি?

—মাইজি নয়, তুই আমাকে রাঙাদিদা বলে ডাকবি। মিন্টু আমাকে ঐ নামেই ডাকত।

লছমী অবাক হয়ে বলে মিন্টু! মিন্টু কে?

রেলগাড়িতে বসেই আরাধনা লছমীকে তাঁদের পরিকল্পনার কথাটা শোনালেন। আসল কথাটা অবশ্য ভাঙলেন না। গোকুলচন্দ্র যে লক্ষপতি এবং তাঁর সঞ্চিত অর্থের সন্ধানই যে মূল লক্ষ্য এ তথ্যটা গোপন থাকল। সে শুনল –একজন মরণোন্মুখ অন্ধ বৃদ্ধকে সান্ত্বনা দিতে তাকে কিছু অভিনয় করতে হবে। আদ্যন্ত শুনে লছমী শিউরে উঠেছিল— মাপ করবেন মাইজি। ও আমি পারব না পারব না, কিছুতেই পারব না।

আরাধনা চাপা ধমক দিয়ে ওঠেন, মর ছুঁড়ি। মাইজি কিরে? রাঙাদিদা নয়?

অবিনাশ পাকা লোক। একেবারে গোড়া বেঁধে কাজে নামতে চান। কাশীতে একটি ধর্মশালায় উঠলেন। প্রথমেই বাজার থেকে কিনে আনলেন—শাড়ি ব্লাউজ সায়া থেকে রোল গোল্ডের চুড়ি দুল মালা। লছমীর এত সাধের এক হাত কাচের চুড়ি ভেঙে ফেলতে হল। দু-পায়ে যে রূপার চুটকি ছিল তা গেল। মায় আরাধনা ওর তেল মাখা পর্যন্ত বন্ধ করে দিলেন। —এক বেলা ধরে শ্যাম্পু ঘষলেন মাথায়। মোটকথা লছমীর অপমৃত্যু ঘটল, নবজন্ম পেল মিনতি রায়চৌধুরী।

দুর্গাবাড়ি ছাড়িয়ে চোদ্দো পনেরো বছর আগে যে নির্জন বাড়িতে মিনতির বাবা থাকতেন সেই ঘনবসতি অঞ্চলে হাজির হলেন। সে বাড়ির নতুন বাসিন্দা কাশী বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার অশোক মেহতা অবাক হলেন। এ বাড়িতে একটি ডাকাতি হয়েছিল। তা তিনি জানতেনই না। তিনি অবাক হচ্ছিলেন এ কথা ভেবে ডাকাতি যদি হয়েই থাকে, সেটা এমন কিছু সুখস্মৃতি নয় যে, সেই নৃশংস ঘটনা কোথায় ঘটেছিল তা দেখতে এঁরা আসবেন। যা হোক তবু অবিনাশের অনুরোধে তিনি সবকিছু ঘুরিয়ে দেখালেন।

লছমীকে যতটা বোকা ভাবা গিয়েছিল আসলে সে কিন্তু অতটা বোকা নয়। রাত্রে সে আরাধনাকে ধরে বসল, রাঙাদিদা একটা কথা আমাকে বুঝিয়ে বলুন তো। আপনি বলছেন, একজন অন্ধ বুড়োকে ধোঁকা দেবার জন্য আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন। তাহলে আমাকে এ ভাবে সব কিছু চিনিয়ে দিচ্ছেন কেন? সেই অন্ধ বুড়ো তো আমাকে জেরা করবে না?

—বুড়ো না করুক, আর পাঁচজন করতে পারে। বুড়োর আত্মীয়স্বজন—

—তাদের খোলাখুলি সত্যি কথা বলে দিলেই হয়? তাঁরা যদি বুড়োর কাছে ব্যাপারটা গোপন রাখেন তাহলেই তো আনাদের উদ্দেশ্য সফল হবে? সকলের কাছে এ মিথ্যা কথা বলার কী দরকার?

আরাধনা জবাব দিতে পারেন না। স্বামীর দিকে বিহ্বলভাবে তাকান। জবাব দিলেন অবিনাশ—একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি। বুড়োর অনেক টাকা। তার কোনো ওয়ারিশ নেই। ওঁর আত্মীয়-স্বজনেরা ওত পেতে বসে আছে— কবে বুড়ো মরে। গোকুলবাবু যদি তোমাকে নাতনী বলে মেনে নেন, তাহলে হয়তো তাঁর সব সম্পত্তি তোমাকেই দিয়ে যাবেন।

লছমী উঠে দাঁড়ায়। বলে বাবুজি, এতদিনে আপনাদের অভিসন্ধি আমি ঠিকমত বুঝে উঠতে পেরেছি। আমি এ তঞ্চকতার মধ্যে নেই। আপনারা দয়া করে আমাকে রাজগিরে নামিয়ে দেবেন, কলকাতা ফেরার সময়ে।

অবিনাশ বিচিত্র হাসলেন শুধু।

.

দিন সাতেক কাশীবাস করে অবিনাশ ফিরে এলেন কলকাতায়। বলা বাহুল্য ফেরার পথে লছমীকে রাজগিরে নামিয়ে দেননি। মেয়ে মানুষের ভাগ্যটাই যে ঐ রকম। ঘরের বাইরে আসা সহজ, ঘরে ফিরে যাওয়া কঠিন। অবিনাশ ধীরে ধীরে ওকে তালিম দিচ্ছিলেন—কখনও মিষ্টি কথায়, কখনও ধমক দিয়ে।

কলকাতায় ফিরে সরাসরি ‘দুর্লভ নিকেতনে’ গেলেন না কিন্তু। এসে উপস্থিত হলেন নিজের বাসায়। আরাধনার ভাই সুরজিৎ অবাক হল লছমীকে দেখে। বললে, এ মেয়েটি কে দিদি?

আরাধনা বলেন, ভাল করে দেখ তো তাকিয়ে, চিনতে পারিস?

সুরজিৎ পূর্ণযৌবনা মেয়েটিকে ভাল করে দেখল। দেখল, মেয়েটিও অসঙ্কোচে তাকে দেখছে। সুরজিৎ অবাক হয়ে বললে, মিন্টু! কিন্তু তা কেমন করে হবে?

আরাধনা সে কথার জবাব না দিয়ে লছমীকে বলেন, কি রে চিনতে পারছিস না? তোর সুরজিৎদা।

লছমী এতক্ষণে নতনেত্র হল। রাম-গঙ্গা কিছুই বলল না। সুরজিৎ রীতিমতো অবাক হয়েছে। মিনতিকে তার স্পষ্ট মনে আছে। থাকারই কথা; মিনতিকে সে শেষ যখন দেখে তখন মিনতির বয়স দশ-বারো; ওর নিজের আঠারো-উনিশ। কিন্তু মেয়েটির দৃষ্টিতে পূর্ব পরিচয়ের আভাসমাত্র ছিল না। কাজলকালো দুই চোখে ছিল শুধু বিস্ময়। এবারে সে নিজেই প্রশ্ন করে, আমাকে চিনতে পারছ না মিন্টু?

নতনেত্রেই মাথা নাড়ে লছমী না, সে চিনতে পারছে না।

অবিনাশ এ সম্ভাবনার কথাও ভেবে রেখেছেন। বললেন, তোমাকে সব কথা পরে বলব সুরজিৎ। সে অনেক কথা।

সময় ও সুযোগমতো যে আষাঢ়ে গল্পটা সুরজিতকে শোনালেন অবিনাশ, সেই গল্পটাই আবার আরাধনা শোনালেন লছমীকে। এ ছাড়া উপায় ছিল না. এ না হলে যে-কোনো মুহূর্তেই সমস্ত পরিকল্পনাটার বনিয়াদ ধসে যেতে পারে

আজ থেকে চোদ্দো বছর আগে সেই ভয়াবহ রাত্রের ঘটনাই। মিনতির মাথায় নাকি একজন ডাকাত লাঠির আঘাত হেনেছিল। সে সংজ্ঞা হারায়। কতদিন অজ্ঞান হয়েছিল সে জানে না। জ্ঞান হলে দেখে একজন পাণ্ডার বাড়িতে সে শুয়ে আছে। সমস্ত পূর্ব অভিজ্ঞান নাকি সে হারিয়ে ফেলে মায় নিজের নাম এবং পরিচয়। চিকিৎসাশাস্ত্রে একে বলে ‘প্যারামনেশিয়া’ বা স্মৃতিভ্রংশ। পাণ্ডাজি সে জন্যই পুলিশে খবর দেননি। মেয়েটি যখন তার পূর্বজীবনের কথা কিছুই স্মরণ করতে পারছে না তখন পুলিশ তাকে অনাথ আশ্রমে পাঠাত। পাণ্ডাজি ছিলেন নিঃসন্তান। তিনি তাই তাকে কন্যার স্নেহে মানুষ করেছেন। এতদিনে মেয়েটির কিছু কিছু পূর্বস্মৃতি ফিরে আসছে বটে, তবু অনেক কিছুই সে মনে করতে পারে না।

সুরজিৎ এ গল্প শুনে বলেছিল, অদ্ভুত ঘটনাচক্র। রীতিমতো নাটকীয়। ভালো সিনেমার প্লট।

লছমী সে কথা বলেনি। আরাধনার কাছে গল্পটা শুনে সে লুটিয়ে পড়েছিল তাঁর পায়ে। বলেছিস, এ আমি পারব না, কিছুতেই পারব না। আপনারা আমাকে দয়া করে ছেড়ে দিন মাইজি।

—আবার বলে ‘মাইজি’!

চোখের জল মুছে লছমী বলেছিল, হ্যাঁ হ্যাঁ রাঙাদিদা। কিন্তু এবারে আপনারা আমাকে রেহাই দিন। আমি ঠিক ধরা পড়ে যাব।

—যাবি না। যাতে না যাস তাই তো তোর রাঙাদাদু এ গল্প ফেঁদেছে। শোন্ এই দ্যাখ আমাদের ফটো অ্যালবাম। আয় তোকে সব চিনিয়ে দিই। এই তোর আসল, মানে নকল দাদু–গোকুলচন্দ্র রায়চৌধুরী, এ হল তার বাড়ির চাকর শিবনাথ, আর শিবনাথের পাশে তার বউ দুর্গামণি। বুঝলি? এই বাঘের মতো কুকুরটার নাম ডেভিল। এবার তো সব চিনে গেলি; ভয় কী?

অবিনাশের গোড়া বেঁধে কাজ। স্মৃতিভ্রংশতার অজুহাত সর্বক্ষেত্রে চালালে সন্দেহ হবে। সুরজিতের বিস্ময়টা তিনি ভুলতে পারেননি। তাই প্রথমেই তিনি লছমীকে নিয়ে গেলেন ভবানীপুরের শাঁখারিপাড়া লেনে।

কৈশোরে মিনতি এখানকার একটা বাসায় ভাড়া থাকত, গোকুলের সংসারে। বাড়িটা পাড়াটা লছমীর চিনে রাখা ভাল।

লছমীকে নিয়ে সে পাড়ায় একটা বাড়িতে উপস্থিত হলেন অবিনাশ। কড়া নাড়তেই দরজা খুলে দিল একজন যুবক। বছর চৌত্রিশ বয়স। বললে, কাকে খুঁজছেন।

—হরিবিলাস সরকার মশাই আছেন?

যুবকটি ওদের আপাদমস্তক ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, তিনি তো বছর আট দশ আগে স্বর্গলাভ করেছেন। আপনারা কোথা থেকে আসছেন?

অবিনাশ বলেন, সরকার মশাই গত হয়েছেন। দশ বছর! কী আশ্চর্য আমরা কোনো খবরই রাখি না।

ছেলেটি বললে, আসুন, ভিতরে এসে বসুন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেন?

বৈঠকখানায় জাঁকিয়ে বসলেন অবিনাশ। বললেন আমাকে আপনি চিনবেন না, আচ্ছা আপনি কি অধ্যাপক গোকুলচন্দ্র রায়চৌধুরীর নাম শুনেছেন?

ছেলেটি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে ওঠে। অবিনাশের কথার জবাব না দিয়ে সরাসরি নতমুখী মেয়েটিকে বলে ওঠে, কিছু মনে করবেন না, আপনি কি মিনতি?

অবিনাশ আটখানা! কিন্তু সে আহ্লাদ ক্ষণস্থায়ী। লছমী কিছুতেই স্বীকার করতে পারল না। মাথা নিচু করে বসেই রইল। অবিনাশ বলেন, তবে তো চিনতেই পেরেছেন।

ছেলেটি এবারও সে কথা কানে নিল না। পুনরায় লছমীকে বললে, কী আশ্চর্য! তুমি আমাকে চিনতে পারছ না মিন্টু? আমি রঞ্জন, তোমার রঞ্জুদা!

নতমুখী লছমী এবারেও জবাব দিল না। মাথা নেড়ে জানালো–না!

কোনো মানে হয়? শুনছিস্ তোরা যে বাড়িতে ভাড়া ছিলি তারই দোতলার বাড়িওয়ালার ছেলে। নামও তো শুনলি? এখন ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো ঘটঘট করে মাথা নাড়ার কোনো মানে হয়? ভগবান এমন সুযোগ পাইয়ে দিলেন অথচ মেয়েটার ঐ নিরেট মাথায় একটু ঘিলু দিতে পারলেন না?

রঞ্জন অনেক কথা বক্‌বক্ করে বকে গেল। মিনতিকে উদ্দেশ করে। অবিনাশকে সে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনছে না। তাতে তাঁর দুঃখ নেই। তিনি মনে মনে অঙ্কের হিসাব কষছেন। রঞ্জনের বর্তমান বয়স চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ। তার মানে চোদ্দো বছর আগে তার বয়স ছিল কুড়ি-একুশ। মিনতির তেরো চোদ্দো। বাড়িওয়ালার ছেলে আর ভাড়াটের মেয়ে একতলা আর দোতলা। অতনু কি অহৈতুকী কৌতুকে দু-একটি বাণ ছুড়েছিলেন? কাফ্ ল্যভ! না হলে মিনতির রঞ্জুদা এমন চুলবুল করছে কেন? কিন্তু মেয়েটা হাবার বেহদ্দ। ক্রমাগত তাঁতের মাকুর মত মাথাটা দুদিকে দোলাচ্ছে না পুজোপ্যান্ডেলে জলসার কথা, মায়া, শেফালী বালু, সুখেন –কারও কথা তার মনে নেই

অবিনাশ শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলেন তোমার মা? তিনি

—হ্যাঁ মা এখানেই আছেন। এস মিণ্টি, মায়ের সঙ্গে দেখা করবে এস-

লছমী দশ মিনিটের ভিতরেই মিন্টি হয়ে গেল। অথচ রঞ্জন ‘রঞ্জুদা’ হবার কোনও লক্ষণ নেই। গোঁয়ার আর কাকে বলে!

মেয়েটি সব কিছু অস্বীকার করা সত্ত্বেও রঞ্জন এবং তার মা অসঙ্কোচে মেনে নিলেন মিনতিকে। অবিনাশ জনান্তিকে রঞ্জনকে শুনিয়ে দিলেন মিনতির স্মৃতিভ্রংশতার আষাঢ়ে গল্পটা। রঞ্জন বললে, মিনতির হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা সে ভালভাবেই জানে। গোকুলচন্দ্রকে সে ঘনিষ্ঠভাবে চেনেনা, চিনত নয়, চেনে। এখন মাঝে মাঝে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে আসে। কারণও আছে। রঞ্জন ইতিহাসের এম. এ.। সে যখন য়ুনিভার্সিটিতে পড়ত তার আগেই অবশ্য গোকুল অবসর নিয়েছেন, তবু ইতিহাসের ঐ প্রগাঢ় প্রাক্তন অধ্যাপকটির স্নেহধন্য ছিল সে। মাস কয়েক আগেও সে গিয়েছিল দুর্লভ নিকেতনে। তবে ইতিমধ্যে তিনি যে অন্ধ হয়ে গেছেন এ খবর রঞ্জন জানত না।

রঞ্জন ওদের বড় রাস্তার বাস-স্টপ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল। বললে, মিটি কাল-পরশুর মধ্যে একদিন যাব তোমাদের বাড়ি। মানে দুর্লভ নিকেতনে!

লছমী এতক্ষণে অনেকটা সহজ হয়েছে। বললে, আমি আপনাকে আদৌ চিনতে পারলাম না, তবু আপনি যাবেন?

—সেটা তোমার দোষ নয় মিণ্টি। ও একটা অসুখ। ক্রমে ক্রমে সবই তোমার মনে পড়বে। আমি মনে পড়িয়ে দেব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *