১১
বৃদ্ধ অন্ধ অসহায় দৃষ্টি মেলে বারান্দা থেকে শুধু বললেন, ‘কী হল? ডেভিল! লছমী! অবিনাশ! কেউ সাড়া দিল না। বৃদ্ধ অনুমানে বুঝলেন পরবর্তী ঘটনার অনুক্রম। লছমী ছুটে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে। তার মানে মেয়েটি বাগানে নেমে গেল। তারপরেই ভেসে এল ডেভিলের গর্জন। অবিনাশের ‘লিস্! লিস্’ আর লছমীর আর্ত চিৎকার বুঝতে অসুবিধা হয়নি গোকুলের। অবিনাশ এ সুযোগ ছাড়েনি। বাড়িতে আর কোনো প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী নেই! লছমীর মৃত্যু কেমন করে হল তার কোনো প্রমাণ থাকবে না। বৃদ্ধ মেঝের উপর বসে পড়েছিলেন—ঐ বারান্দাতেই। চমক ভাঙল একটি লোমশ স্পর্শে। ডেভিল ওঁর পায়ের উপর মুখ ঘষছে। প্রথমে দুরন্ত ক্রোধে ওকে মারতে উঠেছিলেন—তারপর হাতটা নামিয়ে ওকে ঠেলে দেন। আপন মনেই বলে ওঠেন…তোর কী দোষ? তোকে আমরা যা শিখিয়েছি, তাই তো শিখবি তুই! তারপর ডেভিলের গলা জড়িয়ে হু-হু করে কেঁদে ফেলেছিলেন অন্ধ বৃদ্ধ—এ তুই কী করলি ডেভিল!
হঠাৎ আবার বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো উঠে বসেন। একটি নারীকণ্ঠের রুদ্ধ ক্রন্দনের ক্ষীণ রেশ কানে গেছে তাঁর। অন্ধ দৃষ্টি মেলে বৃদ্ধ বলেন, – কে? কে ওখানে কাঁদছে?
আবার পায়ের উপর একটা লোমশ স্পর্শ। হাত বুলিয়ে বোঝেন, মাথার চুল! লছমী!
—তুই!…বেঁচে আছিস্! ডেভিল তোকে…
বৃদ্ধের পায়ের উপর মাথা রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে হতভাগিনী। বলে, না, দাদু না! ডেভিল তো মানুষ নয়! ও যে কুকুর!
এরপর লছমী আর শোনাতে পারেনি বাসু-সাহেবকে। কান্নায় ভেঙে পড়েছিল সে।
মোটকথা সেই নিভৃত সন্ধ্যায় লছমী নাকি তার সব দুঃখের কথা তার দাদুকে শোনায়। বাবার মৃত্যু থেকে শুরু করে অবিনাশচন্দ্রের বিতাড়ন-পর্ব পর্যন্ত। কেন সে এতদিন সব কথা স্বীকার করতে পারেনি সেই গ্লানিকর অধ্যায়টাও অকপটে নিবেদন করে।
বাসু বলেন, উপায় নেই মিনতি। সেই গ্লানিকর ইতিহাসটা আর একবার আমাকে বলতে হবে। তুমি ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার-চার্জের আসামি। উকিল হিসাবে সব কথা আমার জানা থাকা দরকার।
মমতা দেবী উঠে দাঁড়ান। বাধা দিল মিনতি। বললে, যাবেন না মাসিমা! কথাগুলি আপনাদেরও শোনা দরকার। দাদুকে আমি খুন করিনি—কিন্তু আমি…নিষ্পাপ নই!
মমতা জড়িয়ে ধরেন ভাবী পুত্রবধূকে! বলেন, না রে পাগলি। পাপ তুই করিসনি, করতে পারিস না! তবে তুই কী বলতে চাস্ তা আমি বুঝেছি! আমার সিদ্ধান্ত তাতে এক চুল বদলাবে না। তবে আমি তো মা! বসে বসে ও-কথা আমি শুনতে পারব না। রঞ্জু থাক! তার সব কথা জানা দরকার। সে পুরুষমানুষ! তাকে সহ্য করতে হবে।
ঝড়ের বেগে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন মমতা দেবী। রঞ্জনও উঠে দাঁড়িয়েছিল। মিনতি যেন ধমক দিল তাকে—তুমি বস রঞ্জুদা। শুনলে না মা কি বলে গেছেন?
রঞ্জন আবার বসে পড়ে তার আসনে।
.
লছমীকে গ্রেপ্তার করা হল না আদৌ। বস্তুত পুলিশ মামলা সাজালোই না। কারণ অটোপ্সি সার্জেন স্থির সিদ্ধান্তে এসেছেন— গোকুলচন্দ্রের মৃত্যু সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। অত্যন্ত মানসিক উত্তেজনায় মধ্যরাত্রে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বার্ধক্যজনিত কারণে বন্ধ হয়েছিল তাঁর। বিষ প্রয়োগে হত্যার কেস এটা আদৌ নয়।
ফৌজদারি মামলার পালা চুকল, সম্পত্তি নিয়ে দেওয়ানি মামলাও হল না! ওখানকার স্থানীয় এম. এল. এ সন্তোষবাবু গোকুলচন্দ্রের ছাত্র। তিনি মধ্যস্থ হয়ে একদিন সকলকে ডেকে পাঠালেন। এলেন সবাই—আরাধনা, গিরিনবাবু, রঞ্জন, দুর্গামণি. সলিসিটর বিজন দত্তকে নিয়ে অবিনাশ এবং লছমীর তরফে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং পি. কে বাসু।
সন্তোষবাবু বললেন, মাস্টার মশায়ের সম্পত্তি নিয়ে একটা বিশ্রী মামলা হয় এটা আমরা কেউই চাই না। মাস্টারমশাই কোনও উইল করে যাননি। ফলে ‘ইনহেরিটেন্স অ্যাক্ট’ অনুযায়ী সে সম্পত্তি কে পাবে তা নির্ধারণ করতে মামলা মোকদ্দমা নিষ্প্রয়োজন। প্রশ্ন তো একটাই—লছমী দেবী প্রকৃতপক্ষে মিনতি রায়চৌধুরী কি না! সেটা কোনও আর্বিট্রেটারের মাধ্যমে আপনারা চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করুন। লছমী দেবী যদি মিনতি হয়, তাহলে অবিনাশবাবুর দাবি টেকে না। না হলে অবিনাশবাবুই নিকটতম আত্মীয়।
অবিনাশ বলেন, ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। আর্বিট্রেটারের রায় যদি আমাদের পছন্দ না হয়, তাহলে আমরা আপিল করতে পারব?
—না, পারবেন না। ইন্ডিয়ান আর্বিট্রেশান অ্যাক্ট নাইন্টিন ফর্টি’ অনুযায়ী ঐ মধ্যস্থের রায়ের উপর কোনো আপিল চলে না–যদি না প্রমাণ করা যায় তিনি পক্ষপাতদুষ্ট হয়েছেন, বা উৎকোচ গ্রহণ করেছেন।
অবিনাশ ইতস্তত করতে থাকেন। সন্তোষবাবু বলেন, কিন্তু আর্বিট্রেটর তো আপনার সম্মতি সাপেক্ষে নির্ধারিত হবে। তিনি তো আপনার বিশ্বাসভাজন লোক—
অবিনাশ বলেন, আপনি নিজে সালিশি করলে আমার আপত্তি নেই।
বাসু বলেন, আমার মক্কেল এ প্রস্তাবে স্বীকৃত।
সন্তোষবাবু বলে, আজ্ঞে না। আমার নিজেরই আপত্তি আছে। প্রথম কথা, আমি বর্তমানে অত্যন্ত ব্যস্ত। অ্যাসেমব্লি খোলা। দ্বিতীয়ত, আমি আইনজ্ঞ নই-উত্তরাধিকার আইন সম্বন্ধে ভাল জানি না। আমি বরং একজন দ্বিতীয় ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করছি। দেখুন আপনারা রাজি কি না। আমি কলকাতা বারের প্রবীণতম ব্যারিস্টার এ. কে. রে-র কথা বলছি। তিনি রিটায়ার্ড, আইনজ্ঞ, বিচক্ষণ, আইনের বিষয়ে প্রগাঢ় পণ্ডিত এবং তাঁর সততার বিষয়ে কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
অবিনাশ নিম্নস্বরে তার উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করে বললে, আমরা রাজি!
বাসু বলেন, আমার মক্কেলও রাজি। তবে একটা কথা বলে রাখি—আমি এককালে, এ. কে. রে সাহেবের জুনিয়র হিসাবে বারে প্রবেশ করেছিলাম।
বিজন দত্ত বাধা দিয়ে বলেন, মিস্টার বাসু! রে-সাহেবকে চেনে না এমন আইনজীবী কলকাতায় নেই—–জুনিয়র কেন, আপনি তাঁর একমাত্র পুত্র হলেও আমরা রাজি হতাম! তিনি পক্ষপাত দোষের ঊর্ধ্বে থাকতেন তা সত্ত্বেও! তবে তিনি কি রাজি হবেন?
সন্তোষবাবু বলেন, হবেন। গোকুলবাবুর সঙ্গে অতি নিকট সম্পর্ক ছিল তাঁর।
বাসু বলেন, তাই নাকি? নিকট সম্পর্ক! তা তো জানতাম না।
—হ্যাঁ। রক্তের সম্পর্ক নয়। পাণ্ডিত্যের সম্পর্ক।