প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
ফিরে পড়া : সুধীরকুমার মিত্রের দশটি বই

কুলুজি বৃত্তান্তে ইতিহাসের উপাদান – তারাপদ সাঁতরা

কুলুজি বৃত্তান্তে ইতিহাসের উপাদান – তারাপদ সাঁতরা

আমাদের দেশে বর্ধিষ্ণু বেশ কিছু পরিবারে যেসব পারিবারিক কুলুজি বা বংশলতিকা সংরক্ষিত হয়েছে, সেগুলির মধ্যে তৎকালীন ভৌগোলিক বিবরণ ও সামাজিক ইতিহাস তথা ঘটনাবলির বেশ কিছু নিহিত উপাদান ও তথ্যকে আধুনিককালের ইতিহাস রচয়িতারা কোনো গুরুত্ব দিতে চান না বা এর ঐতিহাসিকতাকে সোজাসুজি অস্বীকার করতেও দ্বিধা করেন না। তবে একথা সত্য যে, পারিবারিক এসব কুলপঞ্জিকায় সেইসব পরিবারের গৌরবগাথা-সম্পর্কিত বিবরণ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে এমনভাবে পরিবেশন করা হয়, যার ফলে সেটির সত্যতা নির্ণয় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাহলেও সেসব অতিরঞ্জিত পারিবারিক তথ্যের মধ্যে এমন কিছু ঐতিহাসিক বা সামাজিক ধ্যানধারণার উপাদান জীবাশ্মের (ফসিল) মতো আত্মগোপন করে থাকে, যার সরেজমিন অনুসন্ধানের ভিত্তিতে ও জনশ্রুতির আলোকে মর্মোদ্ধার করতে পারলে, সেটি ক্রমে সামাজিক বা স্থানীয় ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এক অপরিহার্য উপাদান হয়ে পড়ে। তা ছাড়া, এগুলির যে একেবারেই কোনো ঐতিহাসিক মূল্য নেই, তা নয়। এর যে যথেষ্ট মূল্য আছে তার কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, কুলুজিতে উল্লিখিত বংশের উৎপত্তি ও প্রতিপত্তি-সম্পর্কিত পরস্পর বিরোধী বক্তব্যকে বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করলে তার মধ্যে অনেক প্রামাণিক ও গুরুত্বপূর্ণ গোপন তথ্যের ইঙ্গিতও পাওয়া যেতে পারে।

এখন পারিবারিক কুলপঞ্জির স্বপক্ষে যতই গুরুত্ব আরোপ করি না কেন, এগুলি যে বর্তমানে ক্রমশ লুপ্ত হয়ে যেতে বসেছে এবং পারিবারিক গৃহকর্তাদের উদাসীনতার ফলে কীটদষ্ট হয়ে আবর্জনার স্তূপে পরিণত হতে চলেছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যেই এইসব কুলুজিকে পরবর্তী বংশধরেরা জঞ্জাল আখ্যায় অপ্রয়োজনীয় মনে করায়, সেগুলিকে যে বিনষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, তেমন দৃষ্টান্তেরও অভাব নেই।

সম্প্রতিকালে মেদিনীপুর জেলার ইতিহাস ও পুরাবস্তু সম্পর্কে অনুসন্ধানকালে ওই জেলা থেকে এমন কিছু পারিবারিক কুলপঞ্জির সন্ধান পেয়েছি, যার ওপর ভিত্তি করে তৎকালীন সামাজিক ইতিহাসের বেশ কিছু অজানা তথ্য পাদপ্রদীপের আলোয় আনতে সক্ষম হওয়া গিয়েছে। এ বিষয়ে একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল, স্থানীয় শোলাঙ্কি-সম্প্রদায়ের উত্থানপতন-সম্পর্কিত তথ্যবহুল একটি রচনা ইতিপূর্বে মৎপ্রণীত মেদিনীপুর : সংস্কৃতি ও মানবসমাজ গ্রন্থে ‘মুন্ডমারীর ইতিকথা’ অধ্যায়ে বিবৃত করতে সমর্থ হয়েছি। এ ছাড়া, এ জেলায় অন্য আরও যেসব পারিবারিক কুলপঞ্জির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, সেগুলিও অবলুপ্তির পূর্বে যাতে লিখিতভাবে নথিবদ্ধ থেকে ভবিষ্যতের গবেষকদের আলোচনায় সহায়ক হতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে প্রাপ্ত বংশলতিকাগুলির প্রাসঙ্গিক উল্লেখ করা গেল।

এ বিষয়ে প্রথমেই আলোচনা করা যাক, সবং থানার এলাকাধীন কসবা-সবং-এর পাহান-পরিবারে রক্ষিত কুলুজি-সম্পর্কে। এ পরিবারটির বংশলতিকার প্রারম্ভে যে সংক্ষিপ্ত ইতিহাসটি ছিন্নভিন্ন একটি তুলোট কাগজে লিপিবদ্ধ ছিল, অতি কষ্টে তার পাঠোদ্ধার করে সেটির হুবহু বিবরণ তুলে ধরা হল। এই নথিটি থেকে বেশ বোঝা যায়, কীভাবে অন্যস্থান থেকে আগত এই পরিবারটি শেষ অবধি ভাগ্যচক্রে স্থানীয় এক ভূস্বামীতে পরিণত হয়েছেন। এ ছাড়াও, সমসাময়িককালে তদানীন্তন ওড়িশার নৃপতিদের অধীনে প্রান্তীয় এলাকার রাজ্যশাসন তথা রাজস্ব আদায় কীভাবে সম্পন্ন হত তার এক প্রথাগত দিক সম্পর্কেও এই কুলপঞ্জিকা আলোকপাত করে। বর্ণিত কুলপঞ্জির বিবরণটির যে হুবহু পাঠ নীচে দেওয়া গেল, সেটির বন্ধনীর মধ্যে উল্লেখ করা হল শব্দটির যথার্থ পাঠ ও ক্ষেত্রবিশেষে জটিল শব্দগুলির অর্থ। যথা :

ইঃদাস্ত হকিকত পঞ্চাবলী তালুকে শ্যামচরণ পাহান পঃ সবঙ্গ সরকার গোওাল পাড়া সন ১১৯৯ সাল তারিখ ২৫ শ্রাবণ আমাদের উপর বংসের বসবাস বর্দ্ধমান চাকলার তপন গ্রামে বাড়ি ছিল। তখন বাঙ্গালা পাতসা গৌড়েস্বরের অধিকার ছিল। ৺প্রজাপতি পাহান সেই গৌড়েস্বরের সরকারের ইজারদার ছিলেন। ইজারার বাকি পড়িবাতে এহাঁর উপর পেঁচ [চক্রান্ত] হইল। এহাতে সে দেশত্যাগ করিয়া শ্রীশ্রী ৺জগননাথ জীউ দক্ষিণ উড়িষ্যা আইলেন। দর্সন করিয়া ফেরতি সময় সবঙ্গ বলরামপুরে মোকাম করিলেন। রাত্রে এহাঁর ইষ্টদেবতা শ্রীশ্রী ৺জয়চন্ডী ঠাকুরানি সপনে কহিলেন এই জে হুইভূমি পরগনার রাজা শান্তিরাম হুইর অধিকার তিহঁ মন্ত্রিহিন হইয়াছেন। তুমি আপনার দেশকে জাবে না গেলে পর দুঃখ পাইবে। এই রাজা তোমাকে মন্ত্রি করিয়া রাখিবেন। এই ভূর্ম্য তোমাকে লর্ভ্য হইবেক। এইরূপ রাজাজীকেও স্বপ্ন হইল। প্রাতকালে রাজাজি আপন তরফ লোক পাঠাইয়া পাহান মজকুরকে ডাকাইয়া কহিলেন তুমি আমার এখানে চাকরি কবুল করিয়া দেওানি [দেওয়ানি] কাজ জোগ করহ। ইহঁ দেবতার অনুগ্রহে কবুল করিলেন। তখন এই দেস নাড়া দেউল [নেড়া দেউল, বর্তমানে তলকুঁয়াই, তৎকালীন বাদশাহী সড়কের ধারে অবস্থিত বর্তমানে কেশপুর থানায় অবস্থিত] হইতে উড়িষ্যা জগতেস্বরের অধিকার কটকের তলে মালগুজারি [ভূমিকর বা খাজনা]। তারপর কথোক দিন পর তালুক ফোউত [দেউলিয়া] হওাতে ৺শান্তিরাম হুই রাজা ফৌত [উত্তরাধিকারশূন্য অবস্থায় মৃত] হইলেন। এহাতে পাতসাই হইল দক্ষীণ কটক তক উড়িস্যার পাতসাই আমল হইল। পাতশাহি আপন তরফ আমীন পাঠাইয়া সর্ব্বদেস কবজ [কবজা] করিয়া কাগজ জমিদারের কাছে লইয়া জমা বন্দিলেন। হুইভূমের রাজা ফৌত হাজীর নাই তখন হুইর দেওান প্রজাপতি পাহানকে তলপ হইল। কাগজ জাহা ছিল তাহা হাজির করিয়া দিলেন। পাতশার হুকুম হইল হুইভূমের জমিদারী কবুল কর। ইহঁ কহিলেন আমি চাকর নিমক খাইয়াছি। আমি জমিদারি কোরিতে পারিব না তবে অনুগ্রহ করিয়া জদি হুকুম হয় জে গ্রামে বসবাস করি সেই গ্রামখানি সবঙ্গ বলরামপুর [বলরামপুর গ্রামটি সবঙ্গ থানার অন্তর্গত দুজিপুর বেলাড় গ্রামের পাশে অবস্থিত] খোদ মুক্তারি সনন্দ হুকুম হয়। জখন যে জমিদারের আমল হউক আমি ইহার বরাবর মাল গুজারি করিবো। এই দরখাস্ত মঞ্জুর করিয়া পাতশাই পাঞ্জা সনন্দ করিয়া দিলেন। সে আমি আমাকে লইয়া তেইস পুরুষ হইল। পাঞ্জা সনন্দ আমাদের স্থানে নাই। কোন পুরুষের আমলে ফোত হইয়াছে আমরা জানি নাই। তখন চৌধরি কানুনগোইর স্রেস্তা ছীল নাই। জমিদার লোকের কাছে মাল বিলে বন্দ না হবাতে পাতসাই হইতে চাকলাকে চৌধরি মুনসফ দিয়া শ্রেস্তা রাখিতে হুকুম দিলেন তুমি নানকার রষুম পাইবে সরকারের মাল জে রূপে বিলে বন্দ হয় করিবে। চৌধরি স্রেস্তা রাখিয়া অনেক পর্যটনে মাল বিলে বন্দ করিতে পারিলেন নাই। তারপর হুকুম হইল কানগোই মুনসফ দিয়া স্রেস্তা রাখিয়া মান বিলে বন্দ করেন। কানগোই হুকুম বমজ্জীন স্রেস্তা রাখিয়া বাকী বিলে বন্দের অনেক পর্য্যটন করিলেন বাকী বিলে বন্দ করিতে পারিলেন নাই। তারপর হুকুম হইল চাকলার চৌধরি ও কানগোহ জমিদার এই তিনজনের মহল জমা ওয়ারি করিয়া দেহ। হুকুম বমজীম চৌধুরি।০ চারি আনা কানগোই।০ পাঁচ আনা জমিদার।৯০ সাত আনা এইরূপে জন্মওারি হইয়া কোথোক দিন মালগুজারি করিলেন। এঁহাদের জর্ম্মাওারি হবাতক আমরা সেই পূর্ব্ব বানন্দে খোদ মুক্ত্যারি মাল গুজারি চৌধরি কানগোই জমিদার এই তিনজন আপন আপন নিজ মুর্ম্মা বিক্রয় করিলেন। জে কেহ খরিদ করিয়া লইলেন তাঁহারা মালগুজারি করিতে পারিলেন নাই। সরকারের বাকি আটকিল। ততক্ষণ আপনাপন নিজ জর্ম্মা তালুক বিক্রয় করিলেন। জে কেহ খরিদ করিয়া লইলেন তাঁহারা এঁহাদের ইতমাম ছাড়িয়া খোদ মুক্ত্যারি সরকারে মাল গুজারি করিয়া তালুকদার হইলেন। এইরূপ হুইভূমে আজিতক তালুকদারি হইতেছে। আমি কাহার কাছে তালুক খরিদ করিয়া লই নাই। এইরূপ আজীতক তৈইস পুরুষ আমা হইতে ভোগ করিয়া আসিতেছী ইতি। হাল লিখা আমা হইতে চোব্বিস পুরুস হইল। সন ১২৯৪ সাল তারিখ ৫ মাহা চৈত্রী শ্রীদনার্দ্দন পাহানস্য—কসবা সবঙ্গে বসবাস ১০০৫ সালাবধি ক্রম সম্বন্দে জানিবে বিজ্ঞাপন ইতি।

পরবর্তী কুলুজিটির আলোচনায় এলে দেখা যাবে, আলোচ্য জেলার দাঁতন থানার এলাকাধীন সাউরি গ্রামের চৌধুরি পরিবারের বংশপরিচয়টির মধ্যে ছায়া ফেলেছে সমসাময়িককালের এক ইতিহাস। এই বংশের শ্রীশচন্দ্র চৌধুরি দাস মহাপাত্রের কাছে হাতে-লেখা যে কুলুজিটি সংরক্ষিত আছে, সেটির মুখবন্ধে উল্লিখিত পূর্ণ বিবরণ নিচে বিবৃত করা হল :

রায় পরিবারের পূর্বপুরুষগণের মধ্যে লালা পঞ্চানন রায় মহাশয়ের আদি নিবাস শ্রীগয়াক্ষেত্র। ইনি আমলী সন ৬৬৫ সালে স্বীয় জন্মভূমি ত্যাগ করিয়া বর্তমান কন্টাই রোড রেল স্টেশনের ন’মাইল দূরে যখন সাউরি (গৌরিপুর) গ্রামে আগমন করেন তখন ইনি প্রায়ই ক্ষীত্রির বেশে থাকিতেন। সর্বাঙ্গে লোহার সাঁজোয়া পরা, হাতে ঢাল ও তরবারী এবং কটীদেশে একটা অসি ঝুলিত। এই অসিখানি এখনো আমাদের বাটীতে রহিয়াছে। এই লালা যখন এদেশে আসেন তখন এক প্রাচীন প্রাচীন জমিদার-পরিবার অপুত্রক ছিলেন এবং লালাকে আশ্রয় দেন। যেহেতু এই রায় মহাশয় গয়াভূম বিহার অঞ্চল হইতে আসিয়া এতদঞ্চলে বসবাস করিতে থাকেন, সেই নিমিত্ত তাঁহার অধিকৃত এই জমিদারী উত্তরবিহার পরগনা নামে তদবধি প্রচলিত হইয়া আসিতেছে। ইঁহার কৌলিক উপাধি রায়, তবে রায় মহাশয় যখন এখানের জমিদার তখন গৌড়ের বাদশাহের নিকট হইতে চতুদ্ধরীণ (চৌধুরী) এবং উৎকলরাজের নিকট হইতে মহাপাত্র উপাধি লাভ করেন। ইনি উত্তরবিহার পরগণার অধিকারী হইলেও পরে ইনি মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণ অংশ কংসাবতী নদীতীর হইতে উড়িষ্যার উত্তর অংশ সুবর্ণরেখা নদীতীর পর্যন্ত বিপুল ভূখন্ডের শাসনকর্তা নিযুক্ত হইয়াছিলেন। ১৫৪০ খ্রীষ্টাব্দে শেরশাহ দিল্লীর সিংহাসন অধিকার করেন এবং বাংলাকে কয়েকটি সুবাতে বিভক্ত করিয়া প্রত্যেক সুবাতে একজন করিয়া সুবাদার বা শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। এইসময় শ্রীরামচন্দ্র খানও এক সুবাদার পদে নিযুক্ত হন। তাঁহার সুবার সীমানা ছিল বর্তমান মেদিনীপুরের দক্ষিণ কংসাবতী থেকে হিজলী কাঁথি পর্যন্ত এবং উড়িষ্যার উত্তরপ্রান্ত সুবর্ণরেখা নদীতীর পর্যন্ত। এই সুবার রাজস্ব আদায়, শাসনকার্য পরিচালনার এবং প্রজারক্ষার জন্য লালা শ্রীপঞ্চানন রায় শ্রীরামচন্দ্র খানের সহকারীপদে নিযুক্ত হন। কিছুকাল পরে বঙ্গেশ্বর উক্ত সুবার মধ্যে উত্তর বিহার পরগনা জায়গীরস্বরূপ শ্রীপঞ্চানন রায়কে প্রদান করেন এবং ঐ পরগণা স্থায়ীভাবে ভোগ করিবার জন্য একটি পাঞ্জাযুক্ত সনন্দ প্রদান করেন।

১৫০৯ খ্রীষ্টাব্দে গৌড়ের সুবাদারের সহিত উৎকলের স্বাধীন নরপতি শ্রীল প্রতাপরুদ্রদেবের সীমান্ত প্রদেশ লইয়া বিবাদ আরম্ভ হইলে ১৫১০ খ্রীষ্টাব্দে হোসেন শাহর সেনাপতি ইসমাইল গাজি উড়িষ্যা আক্রমণ করে। এই সময় শ্রীমহাপ্রভু শ্রীধাম পুরীর পথে ছত্রভোগে উপস্থিত হইলে শ্রীরামচন্দ্র খান শ্রীপ্রভুর কৃপালাভ করেন। শ্রীচৈতন্য-ভাগবতে দেখিতে পাই—‘সেই গ্রাম অধিকারী রামচন্দ্র খান। /যদ্যপি বিষয়ী তবু মহাভাগ্যবান’

এই সময়ে দুই রাজার সৈন্যগণ সুবর্ণরেখা নদী ও ভাগীরথীর মধ্যবর্তী প্রদেশে স্থানে স্থানে শিবির স্থাপন করিয়া পথিকগণের যাতায়াত রুদ্ধ করিয়াছিল। যথা, শ্রীচৈতন্য ভাগবতে—‘রাজারা ত্রিশূল পুঁতিয়াছে স্থানে স্থানে। /পথিক পাইলে জ্যান্ত বলি লয় প্রাণে’।

এইজন্য শ্রীমহাপ্রভু পুরী গমনের প্রসিদ্ধ রাজপথ ত্যাগ করতঃ জলপথে ছত্রভোগে উপস্থিত হইয়াছিলেন এবং শ্রীরামচন্দ্র খানকে সাহায্য করিতে বলিয়াছিলেন। আর শ্রীরামচন্দ্র খানও নিজের প্রাণ তুচ্ছ করিয়া সপরিকর শ্রীমহাপ্রভুকে রাত্রিকালে নৌকাযোগে উৎকলসীমান্তে পৌছাইয়া দিয়াছিলেন।

এই ছত্রভোগে প্রতিবৎসর চৈত্র মাসে মেলা হয়। এস্থান হইতে শ্রীগঙ্গাদেবী শত ধারায় প্রবাহিতা। অদ্যাপিও তাহার সুস্পষ্ট নিদর্শন আছে। তটপ্রদেশে অম্বুলিঙ্গ মহাদেবের মন্দিরও বিদ্যমান আছে। ইহারই অনতিদূরে কোলাঘাট নদীতটে শ্রীযুধিষ্ঠির স্থাপিত ‘মহেশ’ নামক শিব বিদ্যমান। এই স্থানটি এখনও ‘প্রয়াগঘাটা’ নামে প্রসিদ্ধ আছে। দুঃখের বিষয়, উক্ত শ্রীশিবমন্দিরের নির্মাণকার্য শেষ হয় নাই। এখনও সেখানে অসমাপ্ত মন্দিরের সুবৃহৎ প্রস্তরখন্ডগুলি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হইয়া রহিয়াছে। কিম্বদন্তী এই যে, এই সুবৃহৎ প্রস্তরখন্ডগুলি নাকি শ্রীপান্ডবগণ দ্বারা আনীত। ইহার নিকটে একটি মন্দিরে শ্রীশ্রীগৌর-নিতাই সীতানাথের শ্রীবিগ্রহ বিরাজিত এবং অদ্যাপি তাঁহাদের সেবা-পূজাদি হইতেছে। প্রবাদ আছে যে, শ্রীমহাপ্রভু এই গ্রামে ভিক্ষা করিয়াছিলেন। একথা শ্রীচৈতন্য-ভাগবতেও বর্ণিত আছে, ‘হেনমতে মহাপ্রভু সংকীর্তন রসে/ প্রবেশ হইয়া আসি শ্রীউৎকল দেশে।।/ উত্তরিলা গিয়া নৌকা শ্রীপ্রয়াগ ঘাটে।/ নৌকা হৈতে মহাপ্রভু উঠিলেন তটে।।/ সেই স্থানে আছে তার গঙ্গাঘাট নাম।/ তঁহি গৌরচন্দ্র প্রভু করিলেন স্নান।/ যুধিষ্ঠির-স্থাপিত মহেশ তথি আছে।/ স্নান করি তাঁরে নমস্করিলেন পাছে।।/ এক দেবস্থানে প্রভু থুইয়া সবারে।/ আপনে চলিলা প্রভু ভিক্ষা করিবারে’।।

পরে শ্রীমহাপ্রভু ওই স্থান হইতে প্রসিদ্ধ রাজপথে (বর্তমান কাপসিয়া বাঁধ) সাউরী গ্রামের মধ্য দিয়া দাঁতনে উপস্থিত হইয়াছিলেন। বাড়ির অতি নিকটেই শ্রীক্ষেত্র গমনাগমনের এই প্রসিদ্ধ রাজপথটি থাকায় সাউরী গ্রামের রায় (চৌধুরী) পরিবারের বাটীতে বহু যাত্রীর আগমন হইত।

১৭৫৯ সালে শ্রীধাম-বৃন্দাবন হইতে গঙ্গাসাগর যাত্রাকালে সাউরী গ্রামের এই বাড়িতে একজন সাধু উপস্থিত হন। লালা পঞ্চানন রায় চৌধুরীর অধস্তন পঞ্চম পুরুষ গঙ্গাদাস চৌধুরী মহাশয় ওই ব্রজবাসী সাধুর নিকট হইতে শ্রীশ্রীবৃন্দাবনচন্দ্র জীউ ও শ্রীশ্রীগোবিন্দ জীউ নামক দুইটি বিগ্রহ লাভ করিয়া তাহা সেবা প্রকাশ করেন। এখনও ওই স্মৃতি উপলক্ষে প্রতি বৎসর তুলসী চারায় পৌষ সংক্রান্তিতে বিরাট মেলা হইয়া থাকে এবং উক্ত শ্রীবিগ্রহও তথায় শুভবিজয় করে। কিছুকাল পরে তাহারই বংশধর একটি পাকা দেউল নির্মাণ করাইয়া দেন।

সুতরাং দাস মহাপাত্র পরিবারে রক্ষিত আলোচ্য এ বংশলতিকাটি থেকে আমরা যেমন ওই পরিবারের এদেশে প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত তথ্য সম্বন্ধে অবগত হতে পারি, অন্যদিকে এটি থেকে জানা যায়, চৈতন্য মহাপ্রভু ছত্রভোগ থেকে হাঁটাপথে কাপাসিয়ার (মতান্তরে নন্দকাপাসিয়ার) বাঁধ ধরে সাউরি গ্রামের মধ্য দিয়ে দাঁতনে উপস্থিত হইয়াছিলেন। এক্ষেত্রে পারিবারিক বিবরণটি অবশ্য কতটা যুক্তিগ্রাহ্য হবে, সে সম্পর্কে সন্দেহ থাকলেও, কাপাসিয়া বা নন্দকাপাসিয়ার ওই পথটি যে দাঁতন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, এ বক্তব্য মোটেই অমূলক নয়। কারণ, দাঁতন থানার মধ্যবর্তী নন্দকাপাসিয়া নামে যে জনবসতিহীন মৌজাটি দেখা যায়, সেটি অতীতে একটি বিরাটাকার বাঁধ-রাস্তা ছিল, যা পরে মৌজার নামকরণে ভূষিত হয়।

সেকালে ঠগি ও ঠ্যাঙাড়েদের উৎপাতে গ্রামবাংলায় যে বিভীষিকা সৃষ্টি হয়েছিল, তার নিদর্শন রয়ে গিয়েছে স্থানীয়ভাবে প্রচলিত কিছু ছড়া-প্রবাদে। এ জেলার জাড়া-রামজীবনপুরের কাছে তারাজুলি নামে প্রবাহিত একটি ছোটো নদীর ধারে একদা ঠ্যাঙাড়েদের আড্ডা ছিল বলে স্থানীয়ভাবে যে ছড়াটি প্রচলিত, তা হল : ‘যদি পেরুলি তারাজুলী, তবে জানবি ঘরকে এলি’। পুরোনো দিনের ঠ্যাঙাড়ের সেই বিভীষিকার স্মৃতি শুধু ছড়ার মধ্যেই আমরা খুঁজে পাই না, পারিবারিক বংশলতিকাতেও এই ধরনের ঠগি ও ঠ্যাঙাড়ের অত্যাচারের কথা জানতে পারি। মেদিনীপুর জেলার চন্দ্রকোণা থানার অন্তর্গত অযোধ্যা গ্রামের দত্ত সরকার বংশের কুলুজিতে উল্লিখিত হয়েছে যে, গর্গ-গোত্রীয় এই কায়স্থ দত্ত পরিবারটির একদা বাস ছিল হুগলি জেলার আরামবাগ মহকুমার গোঘাট-থানার এলাকাধীন নকুন্ডা গ্রামে। সেখানকার অধিবাসী জনার্দন দত্তের চার পুত্রের মধ্যে দুই পুত্র ঠগির হাতে এবং এক পুত্র ঠ্যাঙাড়ের হাতে নিহত হন। পিতা জনার্দন শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ছোটো ছেলে শ্যামসুন্দর ও গৃহদেবতা ভুবনেশ্বরীর বিগ্রহ নিয়ে দেশত্যাগী হয়ে চলে আসেন অযোধ্যা গ্রামে। পুত্র শ্যামসুন্দর পরে ভুবনেশ্বরীর মন্দির প্রতিষ্ঠার সঙ্গে মৃত দুই ভাই অম্বিকানাথ ও রামেশ্বরের নামে শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। চন্দ্রকোনার অযোধ্যা গ্রামে এই পরিবার এখনও বর্তমান এবং সেখানে প্রতিষ্ঠিত উল্লিখিত ভুবনেশ্বরী, অম্বিকানাথ ও রামেশ্বরের শিবমন্দিরও কুলজি-বর্ণিত বিবরণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সে সময়ে গ্রামীণ সমাজে ঠগি ও ঠ্যাঙাড়েদের অত্যাচারের ফলে দেশে আইন-শৃঙ্খলার অবস্থা কেমন ছিল, তার এক আভাস পাওয়া যায় আলোচ্য এই বংশলতিকাটিতে।

এই জেলার চন্দ্রকোনা থানার জাড়া গ্রামের রায়বংশের মুদ্রিত এক কুলুজি গ্রন্থের লেখক মৃগাঙ্কনাথ রায়। তিনি এই বংশের পত্তন ও পরবর্তী ইতিহাস সম্পর্কে কুলুজির শুভারম্ভে উল্লেখ করেছেন যে, এই বংশ প্রথমে মুরশিদাবাদ, পরে বর্ধমান জেলার সাতগেছে, তারপর বামুনপাড়া থেকে বর্ধমানের তেলমাড়ুই গ্রামে বসবাস করেন। পরে বর্ধমানরাজ কীর্তিচন্দ্রের দেওয়ান হিসাবে এই বংশের রামেশ্বর রায়কে ১৭৪৭ খ্রিস্টাব্দে বরদা-বেতুয়া, চন্দ্রকোনা ও ব্রাহ্মণভূম পরগনায় জরিপ জমাবন্দি ও খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা করার জন্য প্রেরণ করেন। রামেশ্বর রায়ের তৃতীয় পুত্র রামগোপাল রায় বর্ধমানরাজ তেজচন্দ্রের আমলে বহু ভূসম্পত্তি লাভ করে জাড়া গ্রামেই বসতি স্থাপন করেন। রামগোপালের পুত্র মদনমোহন এবং মদনমোহনের জ্যেষ্ঠ পুত্র রামকান্ত বর্ধমান থেকে জাড়া আসার পথে কৃষ্ণগঞ্জ গ্রামে এক গ্রাম ও সেই সঙ্গে এক হাটের পত্তন করেন। মদনমোহনের তৃতীয় পুত্র রাজীবলোচন সম্পর্কে ওই কুলুজী গ্রন্থে লেখা হয়েছে :

রাজা রামমোহন রায় রাজীবলোচনের সমসাময়িক এবং বিশিষ্ট বন্ধু ছিলেন। জাহানাবাদ (আরামবাগ) মহকুমায় কৃষ্ণনগরের নিকট রাধানগর লাঙ্গলপাড়া রাজা রামমোহনের জন্মস্থান। উক্ত রাধানগর গ্রামের বন্দ্যোপাধ্যায় বংশের গৌরহরি বন্দ্যোপাধ্যায়ের (রায়) সহিত রাজীবলোচনবাবুর ভগ্নীর বিবাহ হয়। উক্ত রাধানগর গ্রাম জাড়া হইতে ১২।১৪ মাইল দূরে অবস্থিত। রাজীবলোচনবাবুর সহিত রাজার সৌহার্দ্দ্য এত বেশি ছিল যে, একটি আসল কোবালাপত্র হইতে জানিতে পারা যায় যে, রাজা রামমোহন যখন দিল্লীর শেষ বাদশাহের পেনসন বৃদ্ধির জন্য তাঁহার প্রতিনিধি লইয়া বিলাত যান তখন তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি রাজীবলোচনবাবুর নামে কোবালা লিখিয়া বেনামী করিয়া রাখিয়াছিলেন।

আলোচ্য কুলুজির মধ্যে চিত্তাকর্ষক ঘটনাটি ঘটেছিল কথিত রাজীবলোচনবাবুর পুত্র শিবনারায়ণের আমলে। তাঁর সময়ে কুলুজিটিতে যে উল্লেখযোগ্য ঘটনার বিবরণ দেওয়া হয়েছে সেটি হল, ব্রাহ্মধর্ম প্রবর্তক রামমোহন রায়ের শ্রাদ্ধকার্য সম্পন্ন সম্পর্কে স্থানীয় ব্রাহ্মণদের বাধা দানের ফলে রামমোহনের পুত্ররা যে জটিল অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন, তা মোচনে তিনি রামমোহনপুত্রদের সাহায্য করেন। এ বিষয় কুলুজি গ্রন্থের বিবরণে আছে :

রাজা রামমোহন রায়ের পুত্র বাবু রমাপ্রসাদ রায় ও বাবু রাধাপ্রসাদ রায় উভয়ের সহিত শিবনারায়ণবাবুর খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি রাজাকে বিশেষ শ্রদ্ধা করিতেন এবং ব্রহ্মসংগীত তাঁর খুব প্রিয় ছিল। তিনি নিজেও সংগীতজ্ঞ ছিলেন। বৃষ্টলে রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যু হয়। তিনি অ্যালবিয়ান নামক জাহাজে বিলাত যাত্রাকালে তাঁর পুত্রগণকে উপদেশ দিয়া যান যে, যদি বিদেশে তাঁর মৃত্যু হয় তারা যেন এদেশে তাঁর শ্রাদ্ধকার্য সম্পন্ন করে। কিন্তু পল্লিগ্রামে তখন রাজা রামমোহন পতিত বলিয়া ব্রাহ্মণসমাজে গণিত হইয়াছেন। লাঙ্গলপাড়া গ্রামে খানাকুল কৃষ্ণনগরের সমাজের খুবই প্রভাব, উক্ত ব্রাহ্মণসমাজ রাজা রামমোহনের শাস্ত্রানুসারে শ্রাদ্ধকার্যে মহা বিঘ্ন হইয়া দাঁড়াইল। রমাপ্রসাদবাবু শিবনারায়ণবাবুর সাহায্য চাহিয়া পাঠাইলেন। রাজার উপর শিবনারায়ণ বাবুর প্রগাঢ় শ্রদ্ধা এবং রমাপ্রসাদবাবুর উপর অত্যন্ত ভালোবাসা। তাঁহার সভাপন্ডিত-সহ শিবনারায়ণবাবু লাঙ্গলপাড়া গেলেন। সেখানকার পন্ডিতগণের সহিত তর্ক শুরু হইল। শিবনারায়ণবাবুর গাম্ভীর্যপূর্ণ আবেদনে কৃষ্ণনগরের পন্ডিতসমাজ অভিভূত হইয়া পড়েন। দুই-দিন তর্কের পর তাঁহারা আনন্দিত চিত্তে শ্রাদ্ধ করিবার সম্মতি দিয়াছিলেন। রাজা রামমোহনের শ্রাদ্ধ তাঁরই মর্যাদা অনুসারে খুব ধুমধামের সহিত সম্পন্ন হয়। রমাপ্রসাদবাবু শ্রাদ্ধ শেষ করিয়া শিবনারায়ণবাবুকে আলিঙ্গন করিয়া বলিয়াছিলেন, ভাই তুমি না আসিলে এ কার্য সম্পন্ন হইত না।

কুলুজী গ্রন্থ থেকে পরিষ্কারভাবে জানা গেল, রাজা রামমোহনের পিতৃভূমি খানাকুল-কৃষ্ণনগরের ব্রাহ্মণসমাজের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অবশেষে ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্তক মহোদয়ের পারলৌকিক কার্য ব্রাহ্মমতে না হয়ে, হিন্দু-ব্রাহ্মণ্য মতেই সম্পন্ন করেছিলেন তাঁর পুত্ররা।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি

তারাপদ সাঁতরা : মেদিনীপুর : সংস্কৃতি ও মানবসমাজ, ১৯৮৭, পুরাকীর্তি সমীক্ষা : মেদিনীপুর, ১৯৮৭, পশ্চিমবঙ্গের পুরাসম্পদ, ১৯৮৭

দেবাশিস বসু : পারিবারিক ইতিহাসে সমাজতত্ত্বের উপাদান (প্রবন্ধ), কৌশিকী, ১৯৮৫।

মৃগাঙ্কনাথ রায় : মেদিনীপুর জেলার জাড়া রায় বংশের পরিচয় (১৩৬৮)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *