নয়
রাশেদ সাহেবের আজকাল ভয়ানক ক্লান্তি লাগে। যেন যোজন-যোজন পথ অতিক্রম করে এসেছেন। চোখ মেলে থাকতেও কষ্ট হয়। ইজিচেয়ারে বসার অভ্যাস তাঁর। বসেনও, কিন্তু আগের মতো মেঘ, কি তারা, কি পাখি, কি দূরের বাড়ির ছাদ, অনেকক্ষণ ধরে দেখেন না। চোখ আপনা থেকেই বুজে আসে। চোখ বোজেন, কিন্তু ঘুম পায় না। একেক দিন লাইব্রেরিতে যান, খবরের কাগজ পড়েন, বই নিয়ে আসেন, বই পড়েন। কিন্তু কী যে পড়েন, কিছুই বুঝতে পারেন না। কেমন করে বুঝবেন? পৃষ্ঠার লাইনে লাইনে শব্দের ওপর দিয়ে নজর চলে যায় ঠিকই— কিন্তু মন? মন যে তখন অন্যখানে। একটা চাকরি নিয়েছেন সম্প্রতি, একটা মিলের আইনসংক্রান্ত উপদেশ দেয়ার কাজ। অফিসে যান সকাল আটটায়, কিন্তু ফেরার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। কোনোদিন দশটাতে ফেরেন, কোনোদিন পাঁচটা বেজে যায়।
যেদিন অবসর নিয়েছিলেন সেদিন ভয় হয়েছিল, কাজ না করে কেমন করে থাকবেন? অবসরের বিপুল ভারের কথা ভেবে তখন ভয় লেগেছিল। একাকী, প্রয়োজনহীন এবং নিঃসঙ্গে মনে হয়েছিল নিজেকে। কিন্তু এখনকার ভয় সে ভয় নয়। এখন চারদিকটাকে ভয় তাঁর। তাই এখন নিজেকে লুকোতে চান। অন্যের কাছ থেকে নয়, নিজের কাছ থেকেই যেন নিজেকে লুকোনো
বুলুকে কেমন আলাদা করে দিল তার নিজেরই সংসার। সন্তান এসেও এল না, স্বামী দূরে চলে গেল। দুচোখে শূন্যতা ঘনাতে ঘনাতে এখন এমন হয়েছে যে ওর দুচোখের দিকে তাকাতে পারেন না। রাখীর ওপর তাঁর আশা ছিল। রাখী স্বাবলম্বী হয়েছে, রাখী সংসারকে চেনে, রাখীর ভুল হবে না— এইরকম অস্পষ্ট বিশ্বাস ছিল তাঁর। কিন্তু শেষে এ কী হল? জানেননি, দেখেননি, কেউ বলে দেয়নি, কিন্তু রাখীর দুর্ঘটনার ব্যাপারটা ঘটে যাওয়ায় তাঁর বুকের ভেতরকার বিশ্বাসটা চলে গেল। কেমন অনুভব হয়েছিল- রাখী নিজের থেকেই ঐরকম একটা অঘটন ঘটিয়েছে। তবু একেবারে বিশ্বস্ত হননি। রাখী বাঁচবে ভাবেননি, যখন রাখী সুস্থ হয়ে উঠছে, তখন আবার তাঁর মনের ভেতরকার আশা নড়েচড়ে উঠল। মনে হল, সবকিছু শেষ হয়নি একেবারে। এখনো জীবন তাঁকে কিছু দিতে পারে- অন্তত সান্ত্বনাটুকু নিশ্চয়ই শেষপর্যন্ত থেকে যাবে। মনে হয়েছিল, একটুখানি স্থিতি পেলেই সে নিজের জন্যে পথ করে নেবে। সংসারকে সে গ্রহণ করবে। ভেবেছিলেন, অনেক ভাঙচুরের পরও যেটুকু অবিশষ্ট থাকবে তাই নিয়ে ও সুখী হতে পারবে। সুস্থ হবার পর যেদিন সন্ধেবেলা রাখী বেড়াতে বার হল— সেদিন প্রায় নিজেরই সঙ্গে বাজি ধরার মতো অবস্থা হয়েছিল তাঁর। হ্যাঁ, রাখীর দুচোখের দিকে তাকিয়ে বড় রকমের বাজি ধরেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, রাখী গ্রহণ করতে যাচ্ছে জীবনকে। নিঃসঙ্গতাকে, একাকীত্বকে, নিজের বন্দিত্বের খোলসটাকে সে বাইরে ছুড়ে ফেলে দেবে এবার। সে বন্ধুদের সঙ্গে মিশবে আবার আগের মতো, জামানকে গ্রহণ করবে, সন্দেহ ঘৃণা আর অবিশ্বাসের পালা এবার ঘুচবে। কিন্তু এ কী হল? রাখী যখন ফিরে এল তখন যে কী দেখলেন বলতে পারবেন না। শুধু বুকের ভেতরে কষ্ট হল। না, সর্বস্ব হারানোর সেই দিশেহারা ভাব নয়— বিয়ের আগেই সেই ব্যাকুল হয়ে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো চেহারা নয়- বরং শান্ত, গম্ভীর স্থির চেহারা তখন রাখীর। রাশেদ সাহেবের মনে হয়েছিল, ঐ শান্ত, স্থির চেহারার মধ্যে আরো কী যেন আছে। সেটা সংকল্প, নাকি শপথ, নাকি কঠিন কোনো রাগ, ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি। সেদিন পারেননি, এখনও পারেন না। এখন অবশ্যি আর তিনি বুঝতে চানও না। কেমন মনে হয়, প্রকাণ্ড একটা পতন শুরু হয়েছে- কিছুই করার নেই কারুর। এখন শুধু অপেক্ষা- কখন প্রচণ্ড আঘাতটা এসে লাগবে। সেই অপেক্ষাতেই তাঁকে থাকতে হবে।
একেক সময় মনে হয়, তাঁর ভুল হয়েছে গোড়াতেই। ছেলেমেয়েদের অতখানি স্বাধীনতা না দিলেও পারতেন। যদি না দিতেন, যদি মনিকে রাজনীতিতে ঢুকতে না দিতেন, যদি রাখীকে চাকরি করতে যেতে বাধা দিতেন— তাহলে?
তাহলে কী হত? রাশেদ সাহেব হিশেব করেন। অনেকেই তো করেন অমন, তাঁর বন্ধুদের সবাইকে দেখছেন ভীষণ শাসনে রেখেছেন ছেলেমেয়েদের। নিজেদের পছন্দমতো পথে চলতে বাধা করেছে। একেবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে তাঁদের- তোমরা কি সুখী হয়েছ, হায়দার, মীজান? তোমার ছেলেমেয়েরা কি সুখ দিয়েছে তোমাদের? হায়দারের দু ছেলের একটি ঠিকেদার, একটি চাকুরে, ফুড-এ। দুজনারই বাড়ি-গাড়ি হয়েছে- হায়দার বেশ গর্বের সঙ্গে ছেলেমেয়েদের খবর জানায়। মীজানের ছেলেটি সিএসপি, মেয়েটি পিআইএ-তে চাকরি নিয়েছে। সেও গর্বের সঙ্গে ছেলেমেয়েদের গল্প করে। গর্ববোধ করে, নিশ্চিন্ত বোধ করে, দুশ্চিন্তা নেই কোনো— কিন্তু সুখ?
রাশেদ সাহেব বোঝেন, ওদের মতো সুখ তিনি কখনো চাননি। মীজানের ছেলে কিংবা হায়দারের ছেলের মতো মনিকে তিনি কল্পনা করতে পারেন না। মনিকে একদিন দেখেছিলেন তোপখানার রাস্তায়— বোধহয়’-এর সেপ্টেম্বরে। মিছিলের সামনে, মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশের দিকে ছুড়ে স্লোগান দিচ্ছিল। শুকনো চুল বাতাসে উড়ছে, ঘাড়ের কাছে শার্টের রক্তের দাগ- বোধহয় আহত কাউকে রাস্তা থেকে সরিয়েছিল কোথাও। রাশেদ সাহেব দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। আকাশে সেদিন ঝকঝক করছিল নীল রঙ, সেপ্টেম্বরের বাতাস ছিল ইতস্তত আর মাঝখানে মনির ওই রোদজ্বলা ধারালো মুখ। ঐ মুখ তিনি ভুলতে পারেন না। ওইরকম মুখ না হয়ে মনির মুখ হবে পলিশ করা, বিগলিত হাসিতে মাখামাখি, দুচোখে লোভের চটচটে আঠালো দৃষ্টি ল্যাপটানো— নাহ্ অসম্ভব।
রাশেদ সাহেবের ওইরকম হিশেবে মন ওঠে না। অমন চেহারায় মনিকে তিনি কল্পনাও করতে পারেন না। নিজেকে অপমানিত বোধহয়। অমন মুখের তাঁর দরকার নেই।
কিন্তু এসবই তাঁর চিন্তার কথা। মনের ভেতরে যেখানে তিনি বাবা, সেখানে তাঁর অহোরাত্র হাহাকার। এরকম তো তিনি চাননি। একেক সময় মনে হয়, জীবন সম্পর্কিত তাঁর এখনকার ধারণাটাই বোধহয় ঠিক। আসলে জীবন এরকমই। তিনি শুধু অন্যরকম একটা কাল্পনিক ধারণা নিয়ে জীবন গড়তে চেয়েছিলেন। জীবনে বোধহয় কিছু করা যায় না, সবকিছু আপন নিয়মে ঘটে যায়।
বুলুকে দেখলেন একদিন, হাসানের সঙ্গে বেরুচ্ছে। বুলুর সাজগোজ দেখে অবাক লাগল তাঁর। বুলু তো এমন করে সাজত না কখনো। লক্ষ করলেন বুলুর পোশাকে, চলাফেরায়, কথাবার্তায়, একটা প্রখর উগ্রতা ফুটে বেরুচ্ছে। ব্যাপারটা কীভবে ঘটল ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না। দূর থেকে তাকিয়ে দেখলেন শুধু।
সেদিন নয় শুধু, ঐরকম উগ্র সাজে বুলুকে আরো কয়েকদিন দেখলেন। ক্রমে বুলুর পরিবর্তনটা চারদিকেও ছড়াতে লাগল। ঘরে বাবুর্চি এল, রান্নাঘরের দিকে থেকে বুলুর গলার স্বর আর শুনতে পান না। বরং বসবার ঘর থেকেই বুলুর হাসি উচ্চকিত হয়ে ওঠে। একদিন দেখলেন, বসবার ঘরে জমজমাট আসর। পর্দার ফাঁক দিয়ে যেটুকু দেখা গেল, তাতেই অবাক হওয়ার পালা তাঁর। মনে হল না, ঐ ঘরটা তাঁর নিজের বাড়ির অংশ। আসবাবপত্র পর্দাটদা পাল্টে কে যেন একেবারে সম্পূর্ণ বিলাস একেবারে উপচে পড়ছে। তাঁর মনে হল, এ বুলু নয়, এ যেন অন্য কোনো মেয়ে। আর ঐসময় ভয়ানক কষ্ট হল তাঁর। কিন্তু কী করবেন, কিছুই বলবার নেই তাঁর, কিছুই জানাবার নেই- শুধু দেখা। দিনের পর দিন শুধু দেখা।
হ্যাঁ, এও দেখতে হল তাঁকে। হাসানের এক পার্টনারের সঙ্গে বুলু সিনেমায় যাচ্ছে, ক্লাবে যাচ্ছে, পার্টি দিচ্ছে। একদিন শুনলেন, বুলু বাসায় নেই, কাপ্তাই গেছে। ওখানে এক প্রজেক্টে কাজ হচ্ছে হাসানের
ঐসময় একেকবার রাখীর কথা মনে হয়েছে। রাখী কি দেখছে এসব? ঐ ভিড়ের মধ্যে ঐ হাসি আর উচ্চকিত উল্লাসের মধ্যে রাখীকে দেখতে পান না। রাখী নেই ওদের মধ্যে। পারভিনকে দেখা যায়, ওদের বন্ধু বন্দনা- চন্দনারা আসে, রাখীর বন্ধু নার্গিসকেও দেখলেন, কিন্তু রাখী নেই।
রাখী নেই বলেই চিন্তা, বরং ও থাকলেই যেন শোভন হত ব্যাপারটা। ব্যাপারটা বোঝা সম্পূর্ণ হত তাঁর। বুঝে নিতেন, জীবনের স্বাভাবিক ধারা আজকাল তাহলে এরকমই। আসলে তাঁরই জীবন সম্পর্কে ধারণাটা ভুল। সুতরাং তাঁর চিন্তার সঙ্গে এদের চিন্তা মিলবে কেন?
বাবুর্চিকে শুধালেন, সে বলতে পারে না। রহিমের মাও কিছু জানে না। অল্পবয়সী একটা ছেলে রাখা হয়েছে, জয়নাল মিয়া- সেও বলতে পারে না। শুধু জানাল, ছোট আপা রোজ দুপুরে বাইরে যায়।
রাশেদ সাহেব অনুমান করতে চেষ্টা করেন- কোথায় যায় রাখী? কার কাছে যায়?
সত্যি তো, কোথায় যাই আমি?
একেক দিন রাখী নিজেকেও শুধায়। শুধায়- কিন্তু উত্তরটা যদি নিজেই বলতে পারত! না-বেরিয়ে থাকতে পারে না বলে বেরুতে হয়। কিন্তু কোথায় যাবে তার কিচ্ছু ঠিক থাকে না। কোনোদিন হয়তো সারাটা দুপুরই কাটিয়ে দিল সুমিতার ঘরে। কোনোদিন খুঁজে খুঁজে বার করল হয়তো একটা অফিস- মিছিমিছি চাকরির খোঁজ করে এল। কোনোদিন বা পাবলিক লাইব্রেরির পড়ার ঘরে বসে বসে সন্ধ্যা পার করে তবে বাসায় ফিরল। আর এরই মাঝে হঠাৎ একদিন সে একটা দৃশ্য দেখে ফেলল। অবাক হল না, আজকাল অবাক হতে সে ভুলে গেছে। দেখল, পারভিন আর হাসান ভাই গাড়ি থেকে একসঙ্গে নামছে, নেমে তারা হোটেলের ভেতরে গিয়ে ঢুকল।
না, এমনিতে রাখীর অবাক হওয়ার কারণ ছিল না। হাসান ভাইয়ের সঙ্গে পারভিনের বাইরে বেরুনো নতুন নয়। কিন্তু সেদিন, সেই দুপুরবেলা, কী যে ছিল পারভিনের তাকাবার ভঙ্গিতে, তার চলার ছাঁদে— সে না-দেখে পারল না।
দেখল আর বুবুকে মনে পড়ল তখন। আজকাল তো বুবুও বাইরে বেরুচ্ছে। অনেক বদলেছে বুবু। বলা যায়, হাসান ভাইয়ের মনের মতো হতে চেষ্টা করছে। এখন ক্লাবে যাচ্ছে, পার্টির হুল্লোড়ে মাতছে, পুরুষবন্ধুদের সঙ্গে জমিয়ে আলাপ করছে— হাসান ভাইয়ের সঙ্গে তো এখন বুবুর থাকবার কথা।
বাসায় ফিরে সেদিন তার টাকার দরকার পড়ল। নিজের জমানো টাকার কিছুটা সে জামানের জন্যে একটা প্লেয়ার কেনার সময় খরচ করেছিল। বাকি টাকাটা ছিল- সেটাও একদিন দেখল খরচ হয়ে গেছে। আর তাই তাকে সেদিন বুবুর ঘরে যেতে হল।
রাখীকে নিজের ঘরে দেখে বুলু যেন থমকাল। দুচোখের ভেতরে তখন একটা জ্বালা কড়কড় করছে, চোখের পাতা ভারী হয়ে বুজে আসতে চায়। তবু শুধাল বুলু, কিছু বলবি?
রাখী বুবুকে দেখে কেমন বিমূঢ় চোখে তাকিয়েছিল কিছুক্ষণ। বুবুর নিশ্বাসে মদের গন্ধ। রাখী বলল না কিছু, আজকাল সে কিছু বলতে চায় না। শুধু শুধাল, তোমার কাছে কিছু টাকা হবে?
কত?
যা হয়- আমার হাতে একদম পয়সা নেই।
দেখি, বলে ব্যাগ হাতড়াল বুলু। রাখী দেখল, বুবুর পরনে গাঢ় নীল পোশাক, গলায় জড়োয়া নেকলেস, কানে হীরের ফুল, নাকেও জ্বলজ্বল করছে হীরে— ঠোঁটের লিপস্টিকে ম্যাটম্যাটে একটা ফ্যাকাশে রঙ।
বুলু তখন ব্যাগ হাতড়ে চেকবই বার করল। বলল, চেক দিই তোকে- কাল ভাঙিয়ে নিস। বাজারের টাকাটাও দিলাম, বাবুর্চিকে দিয়ে দিস- আমাকে সকালেই বেরুতে হবে।
রাখী কিছু বলল না। দেখল বুবু চেকবই থেকে পাতা ছিঁড়ছে, আঙুলের রঙিন নখগুলো রক্তের মতো লাল। চেকটা যখন রাখীর হাতে দিল তখনও রাখী দেখছে। দেখছে বুবুর চোখের ধারালো দ্যুতি নেই, ক্লান্তির ভারে দুচোখ যেন জড়িয়ে আসছে। গলার স্বরে সাংসারিকতার কথা কেমন যেন বেমানান শোনাচ্ছে। রাখী হঠাৎ সেই মুহূর্তে হাত বাড়িয়ে চেকটা নিতে ইতস্তত বোধ করল। কেউ যেন তার বুকের ভেতরে ফিসফিস করে বলছে— নিস না রাখী, নিস না।
কিন্তু তবু নিল। নিতে হল, না-নেয়ার কোনো কারণই ছিল না।
এও এক বিচিত্র ব্যাপার, পরে রাখীর মনে হয়েছে। কেন যে এমন হয়। কথা নেই, বার্তা নেই— হঠাৎ বুবুর কাছ থেকে টাকা নিতে তার সঙ্কোচ বোধ হচ্ছিল। নিজের মনের এই অর্থহীন সঙ্কোচ, দেখে হাসে রাখী। হাসে, কিন্তু ব্যাপারটা থেকে-থেকে তার মনে ঘোঁট পাকাতে থাকে।
তাহলে বুবুর কাছ থেকেও কি আলাদা হয়ে যাচ্ছে সে? নাকি বুবুই আলাদা হচ্ছে তার কাছ থেকে। এখন ক্রমেই কি বেড়ে চলবে এই সঙ্কোচটা? বুবুর ওপর কি কোনোরকম বিতৃষ্ণা জাগছে তার মনের ভেতরে? নাকি কোনোরকম ঈর্ষা? রাখী ব্যাপারটা নিয়ে বেশিদূর ভাবতে পারে না। একসময় আবার নিজেরই ওপর বিরক্ত হয় সে। আসলে পাগলামিতে পাচ্ছে তাকে। যতসব আজগুবি চিন্তা ঢোকে তার মগজে।
সেদিন বিকেলে আব্বার ঘরে গেল। আব্বা তাঁর ইজিচেয়ারে চুপ করে বসেছিলেন। ছোট মেয়েকে দেখে ডাকলেন, কী খবর রাখী?
রাখী হাসল। বলল, কিছু না- আপনি বাইরে গেলেন না?
না, আজ আর বেরুব না ভাবছি। একটু থেমে শুধালেন, তুই কোথাও যাবি?
না।
আজকাল সেজান আসে না?
না, কেন? রাখী কিছুটা অবাক হয়। হঠাৎ সেজানের প্রসঙ্গ কেন, সে বুঝতে পারে না।
ছেলেটার জন্যে মাঝে মাঝে খারাপ লাগে।
অস্পষ্ট মন্তব্য শুনে রাখী আব্বার পাশে দাঁড়ায়। বাইরে একটা গাড়ির হর্ন শোনা যাচ্ছে। রাশেদ সাহেব ইজিচেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিয়েছেন আবার, চোখ বুজে এসেছে। ঐ অবস্থাতেই বললেন, ছেলেটা বোধহয় আবার জেলে যাবে।
কেন?
রাখীর নির্বোধ প্রশ্নের উত্তরে কিছু না বলে রাশেদ সাহেব নিজের মনেই বললেন, ছেলেটার অনেক গুণ ছিল, কিন্তু কী যে খেয়াল ওদের!
রাখী আব্বার দীর্ঘশ্বাসটুকু স্পষ্ট শুনল। বুঝল আব্বার মনে স্মৃতি এখন সোচ্চার হচ্ছে। এখন হয়তো মনি ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে তাঁর। চোখ বুজে আছেন, ভারি শান্ত চেহারা।
শুনতে পেলাম, মফস্বলের দিকে কোথায় নাকি গুলি চলেছে আজ।
রাখী আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। আব্বার আজকাল এইরকম হচ্ছে। এক কথা থেকে আরেক কথায় চলে যান।
আব্বার ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছে, ঠিক ঐসময় সে চাপা গলার স্বর শুনল। বুঝল বুবু আর হাসান ভাইয়ের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে। রাখী দাঁড়াল। মনে হল, বুবু যেন বলছে, আমি যাব, আমি যদি না পারি তখন ব’লো। পারভিন পারবে, আমি পারব না?
আহা, বুঝছ না কেন— একেবারেই ব্যবসার ব্যাপার- খুব সাবধানে ট্যাল করতে হবে, শাহবাজ খাঁ খুব ঘোড়েল লোক। পারভিনকে স্টেনো বলে চালিয়ে দেব- কিন্তু তুমি?
আমি জানি, তুমি আমাকে নিতে তো চাও না। ঠিক আছে- আমি যেখানে খুশি চলে যাব।
হ্যাঁ, তাই যাও, প্লিজ।
রাখী আর দাঁড়ায় না। দাঁড়াবার দরকার নেই আর। কিছু ভাবে না। শুধু বুবুর জন্য কষ্ট হয়। বুবু এ কী আরম্ভ করেছে! হাসান ভাইয়ের সঙ্গে সব জায়গায় না গেলে কী হয়?
সেদিন সে ঘরে ঢোকেনি, তখনও বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধ্যা হচ্ছে তখন— উত্তর থেকে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। গরম জামা-কাপড় বার করতে হবে এবার। শীতটা ক্রমেই বাড়ছে। সে সিঁড়ির দিকে মুখ ফিরিয়েছে আর অমনি দেখল, কে যেন দৌড়ে সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়াল। রাখীর মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বর বেরুল, আপনি?
হ্যাঁ, সেজান হাসল না। বলল, আলোটা নেভাও।
কেন? রাখী অবাক হয়।
সেজান তখনও বারান্দায় এসে দাঁড়ায়নি। বলল, তোমার ঘরে চলো রাখী, তোমার সাহায্য আমার খুব দরকার।
বারান্দা থেকে রাস্তা দেখা যায়, সেখানে লোকজনের চলাচল। সেদিকে তাকিয়ে সেজান জানতে চাইল, বাড়িতে কেউ নেই?
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে রাখী জানাল, না, এসময় তো সবাই বাইরে যায়। আব্বা আছেন, ডাকব আব্বাকে?
ঘরের বাতি জ্বললে দেখল সেজানের দুচোখ লাল, মাথার চুলে ধুলো, হাতে একটা ব্যাগ— ব্যাগটা টেবিলের ওপর রাখল। রেখে বলল, এক গ্লাস পানি খাওয়াতে পারো?
বিমূঢ় রাখী তখনো কিছু বুঝতে পারছে না। সেজানের আচরণ ভারি অদ্ভুত লাগছিল তার। তবে পানি খেতে চাওয়ায় যেন সজাগ হল রাখী। ছুটে গেল নিচে। গ্লাসে ঠাণ্ডা পানি ঢালল, ফ্রিজ খুলে ভেতর থেকে শুকনো মিষ্টি বার করে এনে ছোট একটা প্লেটের ওপর রাখল- তারপর ছুটতে ছুটতে এল ওপরে। প্লেট এগিয়ে দিল। পানির গ্লাস তুলে দিল হাতে। তারপর দেখতে লাগল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। সেজান মিষ্টি একটুখানি মুখে দিয়ে পুরো গ্লাস পানি খেল। তারপর জামার হাতায় মুখ মুছে বলল, আমার এই ব্যাগটা কিছুদিনের জন্য তোমার কাছে রেখে যাচ্ছি— সাবধানে লুকিয়ে রেখো।
রাখী শুনল। শুনে বলল, আপনি এখন কোত্থেকে আসছেন?
বেশি দূরে নয়, কয়েক মাইলের ভেতরেই ছিলাম, শিবপুরে আজ ভুখা মিছিল হয়েছিল- গুলি চলেছে— চারজন মারা গেছে। অল্প আগে শহরে এসেছি, লুকিয়ে বাসায় গিয়েছিলাম দু’মিনিটের জন্যে— ভাগ্য ভালো যে তখনো পুলিশ ওখানে যায়নি। এই কাগজগুলো সরানো দরকার- কিন্তু কোথাও ভরসা হচ্ছে না। এখন তুমি ছাড়া লোক নেই।
রাখী দেখছিল, শুনছিল, ঈষৎ উত্তেজিত, কিছুটা বা দ্রুত সেজানের কথা শুনছিল আর রাগ হচ্ছিল তার। মনি ভাইয়ের মুখ মনের মধ্যে ভেসে উঠেছিল বারবার। ইচ্ছে হচ্ছিল, বলে, আপনি কেন আমাদের জড়াচ্ছেন? এভাবে আমাদের জড়াবেন না। কিন্তু বলতে পারছিল না স্পষ্ট করে। সেজান রাখীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল একবার। তারপর যেন মিনতি করল। বলল, প্লিজ রাখী, খুব দরকারি এসব কাগজ— মাত্র ক’টা দিন। দুসপ্তাহের মধ্যে এসে যদি কেউ নিয়ে না যায়, তাহলে এগুলো পুড়িয়ে ফেলো।
রাখী ফের শুনল, ফের দেখল। ঘরের বাতিটা কেমন ম্লান দেখাচ্ছে বলে মনে হল। শেষে মাথা নাড়াল, যেন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে অনেক চিন্তার পর। বলল, না, ঐ ব্যাগ আমি রাখতে পারব না, অন্য কোনো জায়গায় রেখে আসুন।
কেন, কী অসুবিধা তোমার? সেজানের স্বরে কেমন জেদ প্রকাশ পায়।
না, অসুবিধার কথা নয়। রাখী বলে, কেন রাখব ঐসব ঝামেলার জিনিস? আপনাদের কাজের সঙ্গে তো আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি কেন ঝামেলা পোয়াব?
সেজান শেষবারের মতো অনুরোধ করে। বলে, তর্ক নয় রাখী- আমাকে এখন অনেক জায়গায় যেতে হবে। বিশ্বাস করো, আমার এক মুহূর্ত সময় নেই। ওয়ারেন্ট বেরিয়ে যাবার আগেই আমাকে গোছগাছ করে নিতে হবে— যদি না পারি, তাহলে শুধু আমি নই, আমরা অনেকে একসঙ্গে বিপদে পড়ব।
রাখী আর একবার ব্যাগটার দিকে তাকায়। অনুমান করে সম্ভবত ওর ভেতরে দলের কোনো গোপন পরিকল্পনা আছে, কিংবা আছে কর্মীদের প্রতি নির্দেশ— কারো কারো নামধামও থাকতে পারে। রাখীর কেবলি মনে হচ্ছিল—এসবের সঙ্গে নিজেকে কেন জড়াবে সে? এসব করে তার কী লাভ? সেজান তখন উঠে দাঁড়িয়েছে। বলল, চলি রাখী। কথাটা বলেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেল।
সেজান চলে গেল। রাখী ডাকতে চাইল পেছন থেকে। কিন্তু ডাকতে পারল না। শুধু অনুভব করল মানুষটা সিঁড়ির নিচে অন্ধকারে নেমে কোথায় যেন হারিয়ে গেল।
সেজান যাবার পর রাখী টেবিলের ওপর রাখা ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। যত দেখল তত রাগ হল— মানুষটা এমন কেন? কেন রাখী ওর এইসব বিপজ্জনক জিনিস রাখতে যাবে? এসব জিনিস রাখার দায়ে যদি বাড়ির কেউ বিপদে পড়ে যায়? যদি আব্বাকে ধরে নিয়ে গিয়ে জেরা শুরু করে দেয় পুলিশ, তখন?
একবার ভাবল ব্যাগটা রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেয়। কিন্তু তক্ষুনি আবার মনে হল, ব্যাপারটায় রাগ-দেখানো ছেলেমানুষির মতোই দেখাবে। বরং তার চাইতে সহজ কাজ এক্ষুনি রান্নাঘরে গিয়ে উনুনের মধ্যে ফেলে দেয়া। কোনো চিহ্ন পর্যন্ত থাকবে না তাহলে। সেজান এসে ফেরত চাইলে বলতে পারবে, পুড়িয়ে ফেলতে বলেছিলেন, তাই পুড়িয়ে ফেলেছি।
পোড়ানোর পরিকল্পনাটা মাথায় এসে যাওয়ায় সে কিছুটা স্বস্তিবোধ করল। সে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে— এমন সময় নিচে বুবুর গলার স্বর শোনা গেল, কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। কে এল আবার? রাখী নিচে নামল। ভদ্রলোককে চিনতে পারে না রাখী। অথচ ওদিকে ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অহেতুক বুবু হেসে যাচ্ছে।
রাখী পুরো সিঁড়িটা নামল না, মাঝখান থেকেই আবার ওপরে উঠে গেল।