ত্রয়ী উপন্যাস -প্ৰথম পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - দ্বিতীয় পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - তৃতীয় পৰ্ব

কুলায় কালস্রোত – ৫

পাঁচ

জীবন কী অদ্ভুত, রাখীর মনে হয়েছে শান্তিনগরে এসে। বাইরে কত কী যে ঘটে যাচ্ছে। যেন স্রোত, যে স্রোত তাকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে অনবরত। অথচ মজা, সে নিজে স্থির, আব্বা স্থির, বুবু স্থির। আর এমন যে পারভিন, যে পারভিন এই সেদিনও উল্লাসে-উচ্ছ্বাসে সারা বাড়ি মাথায় তুলে রাখত— সেই পারভিনও আজকাল বাসায় থাকে কি না টেরই পাওয়া যায় না।

এদিকে দিনের পর দিন কাটছে। জামান দেখা করতে আসছে মাঝে মাঝে। আব্বার সঙ্গে কথা বলছে-ডাক্তার, রাখীর স্বাস্থ্য, মেটারনিটি ক্লিনিক, এইসব নিয়ে কথা হচ্ছে। রাখী দেখছে, আর কেবলি তার মনে হচ্ছে— এইবার যেন ধরা পড়তে যাচ্ছে সবাই। যেন মস্ত একখানা জাল ফেলেছে কেউ। সেই জাল ফেলে এখন টানতে শুরু করেছে। চারিদিকে ঘের ছোট হয়ে আসছে। যারা আটকা পড়েছে এখন, যেন তাদের সবাইকে কাছাকাছি দেখা যাবে।

একাকী সময়ে রাখী ডুবে থাকে নিজেরই ভেতরে। একেক দিন নিজের ভেতরকার সন্তানের কথা মনে হয়। স্পষ্ট বুঝতে পারে, তলপেটের ভেতরে একটা বিচিত্র স্পন্দন সর্বক্ষণ কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কেমন যেন নড়েচড়ে ওঠে। আর অবাক কাণ্ড, নিজেরই অজান্তে সারা শরীরে অদ্ভুত একটা খুশি দোল খেয়ে যায়। রাখীর তখন ভারি আশ্চর্য লাগে। কাকে শুধাবে, ভারি গোপন যেন ব্যাপারটা। এই স্পন্দন এই শরীরময় খুশির প্রবাহ- এ যেন একেবারেই তার নিজের গোপন ব্যাপার। কাউকে জানাতে ইচ্ছে করে না। কেমন মনে হয়, অন্য কাউকে জানালেই যেন এই খুশির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবে।

রাখী, তুই তাহলে মা হচ্ছিস? কেউ যেন বুকের ভেতরে শুধায়। আর রাখী তখন বুক ভরে নিশ্বাস নেয়। দেখে, বাইরের আকাশ কীরকম বিপুল। রাখী, আসলে তো তুই এইই চেয়েছিলি, তাই না? বল্ তুই এখন সুখী হোসনি? রাখী ঘুরেফিরে নিজেকে শুধায় আর নিঃসন্দেহ হতে চায়।

একেক দিন নিঃসঙ্গ ঘরে হঠাৎ মনে হয়, তার চারপাশে কে একজন ঘুরঘুর করছে, হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলেই ছুটে পালাবে। মনে হয়, দরজার ওপারে ছোট ছোট পায়ের আওয়াজ যেন শুনতে পেল সে। মনের ভেতরে কখনো কখনো হঠাৎ একটা অচেনা শিশুর মুখ দেখতে পায়।

আর এইসব মিলিয়ে একেক দিন ভীষণ হাসি পায় রাখীর। নিজেরই অবাক লাগে, কীরকম করে মেয়েরা অদ্ভুত বদলে যায়, টেরই পাওয়া যায় না। যেসব ভাবনা কস্মিনকালেও ভাবেনি, সেইসব ভাবনায় আজকাল মন ডুবে থাকে। আব্বা, বুবু, হাসান ভাই কারো কথা মনে আসে না। দুঃখ বেদনা হতাশা কোনোকিছুই এখন মনকে স্পর্শ করে না। বুবু যে একাকী অনেক রাত পর্যন্ত জেগে বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, পারভিন যে আজকাল বাথরুমে বিলিতি গানের সুরে শিস দেয়, হাসান ভাই যে একেক রাতে বাসায় ফেরেই না- এসব ঘটনা যেন সে দেখতে পায় না। আর দেখলেও তার মনে কোনো প্রশ্ন জাগে না, ক্ষোভ হয় না, ভয় লাগে না। বিপুল একটা শূন্যতার মধ্যে যেন সে নিশিদিন ভাসছে।

কিন্তু ঐ শূন্যতা একেবারে নিঃসাড় নয়। মাঝে মাঝে কীরকম একটা কোমল কান্নায় ভরে যায় মন। কখনো মনে হয়, কারো জন্যে বোধহয় প্রতীক্ষা করছে সে। আর ঐসময় নিজেরই অগোচরে হাতটা তার পেটের কাছে চলে যায়। স্পষ্ট নয়, তবু বুঝতে পারে, এই ভয়ানক উদ্দেশ্যহীন দীর্ঘ আর একাকী শূন্যতার ঠিক ওপারেই যেন কিছু একটা আয়োজন শুরু হয়েছে। আর সেজন্যেই তাকে অপেক্ষা করতে হবে।

আর ঠিক ওই সময়ে একদিন জামান তার সামনাসামনি এল। রাখী এ বাড়িতে চলে আসার পর বেশ ক’দিন জামান এসেছে, কিন্তু রাখীর কাছে আসেনি। বসবার ঘরে বসে আব্বার সঙ্গে নয়তো বুবুর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে বিদায় নিয়েছে। রাখীর সঙ্গে মুখোমুখি হলে হয়তো জিজ্ঞেস করেছে, আজ কেমন আছ? ব্যস্ ঐ পর্যন্তই। রাখীর ইচ্ছে হলে ঐ ঘরে বসেছে, নইলে সরে গিয়েছে। জামান রাখীর সঙ্গে একাকী হবার চেষ্টা করেনি।

কিন্তু সেদিন জামান রাখীর ঘরে এল। এসে মুখোমুখি হয়ে রাখীর হাত ধরল। চোখের দিকে তাকিয়ে ডাকল, রাখী!

অপেক্ষা করল কিছুক্ষণ, তারপর হাত টানল। তার হাতদুটো জামানের হাতের মুঠো থেকে অতিসহজেই খসে পড়ল। জামানকে তখন ভয়ানক বিভ্রান্ত দেখতে লাগছিল। তবু জামান ডেকে বলল, রাখী আমাকে ক্ষমা করো।

রাখীর হাসি পাচ্ছিল তখন। না, বিদ্রূপ কিংবা ঈর্ষার হাসি নয়। ভয়ানক অর্থহীন হাসছিল সে মনের ভেতরে। কোনো কথা তার বলবার ছিল না। জামান আরেকবার হাত ধরলে শেষে বলল, কী পাগলের মতো কথা বলছ তুমি, কিসের ক্ষমা করব আমি?

রাখীর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল জামান। তার কেবলি মনে হচ্ছিল, রাখী অনেক দূরের মানুষ, তার মুখ যেন পাথরের তৈরি, সেখানে কোনোরকম ছায়া পড়ে না। তবু জামান রাখীর হাত ছাড়ল না। বলল, রাখী আমার কথা শোনো একটিবার।

রাখী আর পারে না, এবার পাশ কাটায়। একটুখানি হাসতে হয় তাকে। তারপর বলে, আমার একটু কাজ আছে, তোমাকে বরং চা দিতে বলি। জামান হতাশ হয়, ধিক্কার দেয় নিজেকে, রাগ হয় তার। তারপর অস্থির হয়ে বলে, আমার কোনো কথা শুনবে না তুমি?

রাখীর বিরক্তি লাগে। বলে, খামোকা চ্যাচাচ্ছ কেন? কে বলেছে তোমার কথা শুনব না? বললাম তো, যা বলবার একটু পরে বলো।

জামান স্পষ্ট বুঝল, এসবই রাখীর চালাকি— রাখী তাকে নিয়ে এখন খেলতে চাইছে, শুধুই সে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। এরপর সে আর থাকতে পারে না। তাকে সেদিনের মতো ফিরতে হয়।

না, ঐরকম কথার পর রাখীর মনে কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় না। কৌতূহলী হয়ে নিজেকে কখনো প্রশ্ন করে না- জামান তার কাছে কী বলতে এসেছিল। সে অনায়াসে নিজের নিঃসঙ্গ একাকীত্ব আর শূন্যতার মধ্যে ফিরে যায়।

শেষে একদিন জামান চিঠি লিখল।

রাখী, শেষপর্যন্ত আমাকে চিঠি লিখতে হল। কী করব বলো, যদি সেদিন আমার কথা শুনতে, তাহলে এ চিঠি লেখার দরকার হত না। কিন্তু শুনলে না। আমাকে কষ্ট দিতে তোমার আনন্দ লাগে বোধহয়।

সে যাক, আমাকে কষ্ট দিয়ে যদি তোমার আনন্দ হয়, তাহলে আমি সে আনন্দে আর বাধ সাধতে যাব না।

দ্যাখো, আমরা বোধহয় আর ছেলেমানুষ নই। আমার ছেলেমানুষি হয়েছে সেদিন ঐভাবে পুরনো প্রসঙ্গ টেনে আনার আর তোমার ছেলেমানুষি হয়েছে আমাকে শাসন না করে ঐভাবে সেদিন চলে যাওয়ায়। আমরা ছেলেমানুষ নই রাখী। জীবনের একটা স্তর আমরা পার হয়ে এসেছি। অতীতে মানুষের জীবনে অনেককিছু ঘটে গিয়ে থাকতে পারে, ঘটাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ঐসব ঘটনাই কি জীবনের সব? মানুষকে একসময় স্থির হতে হয়, ঘর বাঁধতে হয়, বিশ্বাসে পৌঁছতে হয়। আমি জানি, মাজহারের ব্যাপারটা তুমি ভীষণ তুচ্ছ বলে মনে করো। কিন্তু আমার মনে হয়, ব্যাপারটা আসলেই তুচ্ছ ছিল না। যদি তুচ্ছ হত, তাহলে আমাকে ব্যাপারটা তুমি জানাতে পারতে। আর তাহলেই সবকিছু চুকেবুকে যেত। তুমি তো জানো, আমি একেবারে অবুঝ নই। আমার স্ত্রীর জীবনে একসময় প্রেম এসেছিল বলে এখন আমি মাথা খারাপ করব— এমন মূর্খ আমি নিশ্চয়ই হব না, অন্তত রুচি আমার ওরকম হবে না- এ ধারণাটুকু তোমার হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। আমি সেদিন ছেলেমানুষি করেছিলাম মানি, কিন্তু তুমি কেন আমার ভুল ভাঙিয়ে দিলে না। কেন বললে না যে, মাজহারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকলেও সেই সম্পর্ক অস্বীকার করেই তুমি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছ। যদি বলতে, তাহলে এমন অবস্থা হত না। রাখী আমি স্বীকার করছি, একশোবার স্বীকার করছি, আমার দোষ হয়েছে, তুমি আমাকে ক্ষমা করো।

দ্যাখো আমাদের সন্তান হতে যাচ্ছে। এখন আর আলাদা হয়ে কোনো লাভ নেই। যে জন্যে আজ আমরা আলাদা হয়ে যাব, কে জানে, সেই একই কারণ আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনে আরো বড় হয়ে দেখা দেবে কি না-

এই পর্যন্তই পড়তে পারল রাখী। বাকিটুকু পড়ল না, পড়তে ইচ্ছে করল না। ঐ পর্যন্ত অর্ধেক চিঠি পড়ে সে নিজের ঘরে পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে বসল।

জানালার ওপারে আকাশ দেখল অনেকক্ষণ ধরে। দেখল ঘুরে ঘুরে চিল উড়ছে নভেম্বরের করুণ আকাশে। ওদিকে চৌধুরীদের য়ুক্যালিপটাস গাছের নম্র ডাল ভারি ধীরে দোল খাচ্ছে। কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে চারদিকে। একসময় মনে হল, যেন কত যুগ ধরে সে এইভাবে জানালার পাশে বসে আছে। মনি ভাই দুড়দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠছে, নাকি পাশের ঘরে কবিতা শোনা যাচ্ছে, হায় চিল, সোনালি ডানার চিল- কিংবা ওদিকেরই কোনো ঘরে আব্বা গুনগুন করে উঠেছেন— সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে তোমায় করব নিবেদন। রাখী, রাখী-ঈ— কেউ যেন চিৎকার করে ডাকল অনেক পেছনে থেকে।

একসঙ্গে রাখী অনেক শব্দ শুনল মনের ভেতরে। আর ঘুরেফিরে মনে পড়ল জামানের কথাগুলো। জামান ভয়ানক রেগে আঘাত করতে চেয়েছে তাকে, ঈর্ষায় বেচারা কষ্ট পাচ্ছে। কেন যে এমন হয়। বারবার অতীত ঘুরেফিরে আসে। এখন সে নিজে কোথায় যাবে? একদা সে বাইরে থেকে ছুটে এসেছিল আব্বার কাছে। শুধু কি আব্বার কাছে? এখন বোঝে রাখী, আব্বা নয়, আসলে সে জামানের কাছেই ছুটে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন? জামানই তো সবচাইতে বড় অপমান করেছে তাকে। এখন কার কাছে যাবে সে? কার কোলে মুখ ডুবিয়ে সে চিৎকার করে কেঁদে উঠবে? রাখী একসময় ধীরপায়ে ঘর থেকে বেরুল। ভাবল একবার টেলিফোন করবে জামানকে। টেলিফোনের কাছে গিয়ে ডায়াল করল। কিন্তু রিসিভার কানে তুলল না। সে ভেবে পেল না জামানকে কী বলবে। সত্যিই তো কী বলব? নিজের মনের ভেতরে রাখী কথা খুঁজে পায় না। বলব কী, তোমার কথাই ঠিক জামান, আমি মাজহারকেই আসলে ভালোবেসেছিলাম— নাকি বলবে, যা হবার হয়েছে, এসো আমরা আবার আগের মতো সহজ হয়ে যাই— নাকি শেষ কথা জানিয়ে দেবে, আর আমার খোঁজ নিতে এসো না, তোমার কাছে আমি আর যাচ্ছি না।

রাখীর টেলিফোন করা হয় না। কী ক্লান্তিকর সবকিছু। ঘরের ভেতরে কী অসহ্য গুমোট। রাখীর হঠাৎ ভীষণ খারাপ লাগল। নিজেকে কেমন অদ্ভুত আর অবান্তর মনে হতে লাগল। জামান, জামানের চিঠি, সে নিজে, সব মিলিয়ে প্রকাণ্ড একটা অবান্তর ব্যাপার যেন।

আর তক্ষুনি রাখীর মনে হল, সে একবার বাইরে যাবে। ঘরের বাইরে কোথাও চলে যাবে, অল্প কিছুক্ষণের জন্যে হলেও।

নিচে নেমেছে, হঠাৎ একটা স্বর শুনতে পেল। আর ঐ স্বর শুনতে পেয়ে তাকে দাঁড়াতে হল। শেষ বিকেলের ম্লান আলোয় বারান্দা হয়ে ভেসে আসছে সেজানের গলা। কী বলছে, বোঝা যায় না। কিন্তু ভারি ধীর সেই গলার স্বর। আর ঐ মুহূর্তে হঠাৎ, হ্যাঁ, মনে হল, কবে যেন এইরকম ভাবেই সে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় সে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। সেদিনও এমনি শেষ বিকেলের ম্লান আলো এসে পড়েছিল বারান্দায়।

আরে তুমি! দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তার কানে এল।

সেজানের কাছে যেন সে অপ্রত্যাশিত। স্পষ্ট বোঝা গেল, রাখীকে দেখে সে খুশি হয়েছে। ওদিকে রাশেদ সাহেব উঠে দাঁড়িয়েছেন। মেয়েকে ডেকে বললেন, তোরা গল্প কর্, আমাকে একটু বেরুতে হবে।

সেজান তখনো মুখ তুলে তাকিয়ে রয়েছে। রাখী দেখল, সেই একই রকম চেহারা- কালো ছাই ছাই— শুকনো চুল, চোখের কোণে লালচে ভাব, তামাকের গন্ধ বেরুচ্ছে গা থেকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সেজান কথা বলল, ভালো ছিলে?

রাখীর সেই মুহূর্তে ইচ্ছে হল, চিৎকার করে বলে, না ভালো ছিলাম না আমি- আমি ভীষণ অসুখী। কিন্তু বলতে পারল না। জানাল, হ্যাঁ ভালোই ছিলাম, আপনি?

আমি? একটু হাসতে হল সেজানকে। বলল, হ্যাঁ, আমিও ভালোই ছিলাম। তবে কাজকম্মো বেড়েছিল মাঝখানে, বাইরে বাইরে থাকতে হচ্ছিল— এখন অবশ্যি সেসব আপাতত নেই—

নিজের কথা শেষ না করে সেজান প্রসঙ্গ পাল্টাল। বলল, তোমাকে কিন্তু চেনাই যায় না, অনেক বদলেছ তুমি।

অন্য সময় হলে কথাটা শুনে রাখীর হয়তো খারাপ লাগত। কিন্তু এখন তেমন কিছু মনে হল না। কথা নয়, বরং অন্যকিছুর দিকে যেন তার মনোযোগ। শুধু আপন মনে হাসল একটুখানি। তারপর শুধাল, এখনো কি ঐ বাসাতেই আছেন?

নাহ্, সেজান চেয়ারের পিঠে হেলান দিয়ে মাথা নাড়ায়, সে বাসায় থাকা গেল না। বাড়িঅলা অন্য পার্টি করে, সে আমাকে তার বাড়িতে থাকতে দেবে কেন? রাজনীতির ব্যাপার বোঝোই তো-

না, কিছু বোঝে না রাখী। সেজানের অন্তরঙ্গ আর সহজ হবার চেষ্টা রাখীকে কেমন যেন অস্থির করে দিল। একবার ইচ্ছে হল বলে, না, রাজনীতির ব্যাপার কিছু বোঝে না সে, ও-ব্যাপারে কোনোদিন তার কৌতূহল ছিল না। কিন্তু কথাটা কেন যে মুখ দিয়ে বেরুল না, সে বলতে পারবে না। বরং একটুখানি হাসল। কিংবা হয়তো হাসলও না। জামানের কথা মনে হল চকিতে। সেজন্যেই সম্ভবত হাসির ভান করল। পরিপূর্ণ চোখ তুলে সেজানকে আরেকবার দেখল।

ছাইছাই কালো শুকনো চেহারা। খসখসে হাত, হাতের পিঠে শিরা জেগে উঠেছে। জামা-কাপড়ে মলিন ধূসরিত একটা ভাব। দেখতে দেখতে একসময় মনে হল, লোকটা ভণ্ড আর ধড়িবাজ। হ্যাঁ, ধড়িবাজ আর ভিতু। আসলেই জীবন থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, কিন্তু বাইরে ভাবখানা দেখাচ্ছে যেন-বা ভীষণ সাহস ওর। আর ঐরকম কথা মনে হওয়ার পর লোকটাকে তার করুণা করতে ইচ্ছে হল। শেষে একেবারে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করে বসল, তা আপনি হঠাৎ এদিকে যে?

সেজান রাখীর কথা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। বিমূঢ় হয়ে তাকায়। আর রাখী তার বিমূঢ় ভাব দেখে মনের ভেতরে কোথায় যেন জ্বলতে থাকে। বলে, দরকার ছাড়া তো আপনার দেখা পাবার কথা নয় কারুর। সেজান রাখীকে দেখছে তখনো। আর ঐরকম নির্বাক বিমূঢ় সেজানকে দেখে রাখীর ভীষণ রাগ হল। জানে না কেন, কিন্তু তবু রাগ হতে লাগল। বলল, আব্বার কাছে খুব দরকারি কাজ ছিল নিশ্চয়ই?

সেজান তখনো চুপ, কী বলবে বুঝতে পারছে না। কষ্ট হচ্ছিল কোথাও, তবু সহজ হতে চাইল সে। কিছুটা নির্বোধের মতো বলতে চাইল – না, কাজ নয় ঠিক, তবে-

কোনো বন্ধু নিশ্চয়ই হাসপাতালে?

সেজান রাখীর চোখের দিকে তাকায়, রাখীর গলায় তীব্র বিদ্রূপ? সে হাসছে তখন। বলল, নাকি কেউ জামিন পাচ্ছে না?

সেজানের ভ্রূ কুঁচকে উঠল মুহূর্তের জন্যে। রাখীর নজরে পড়ল লোকটার মুখ আরো কালো হয়ে উঠেছে। আর ঐরকম একটা কালো চেহারা নিয়ে সে স্থিরচোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেজানের ঐ চেহারা দেখে রাখী আবার হাসল।

সেজান হাসতে পারত, হাসলে সেটাই শোভন হত। কিন্তু হাসল না। খুব ধীরস্বরে বলল, না রাখী, এখানে আজ আমি টাকার জন্যে আসিনি। টাকার জন্যে তোমার কাছে দুবার হাত পাততে হয়েছে তা ঠিক, কিন্তু আজ এখানে আমি সত্যিই টাকা চাইতে আসিনি।

রাখীর হাসি তখনো থামেনি। তার মনের ভেতরে আরো কে একজন ভয়ানক উল্লাসে লাফাচ্ছে তখন। বলল, ওমা, তাই নাকি? আমি ভাবলাম, নিশ্চয়ই জরুরি দরকারে এসেছেন আব্বার কাছে। আপনি যা কাজের লোক- সেজান গম্ভীর হয়েছিল মুহূর্তের জন্যে। রাখীর কাছ থেকে এমন বিদ্রূপ সে আশা করেনি কখনো। কিন্তু পরক্ষণে সে নিজেই হেসে ফেলল। বলল, তোমার কথায় আমার রাগ করা উচিত, কিন্তু-

কিন্তু কী?

কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে কখনো রাগ করি না।

শান্ত, ভারি, ধীর গলা সেজানের। রাখী ভয়ানক অস্থির বোধ করছে। তখন সেজানের চোখের ভেতরে, কপালের ভাঁজে, চিবুকের কাঠামোতে সে বারবার করে নজর ফিরিয়ে দেখতে লাগল। যত দেখল, ততই মনের ভেতরে জ্বলতে লাগল সে। মনে হল, লোকটার অহংকারের সীমা নেই একেবারে, প্রকাণ্ড একটা দম্ভের মুখোশ পরে বসে আছে তার সামনে। রাখীর আর সহ্য হল না। বলল, আপনি রাগ করলেন কি করলেন না, তাতে কার কী বয়ে গেল? আপনার কিসের জন্যে এত অহংকার। কেন রাগ করেন না আপনি? নিজেকে আপনি কী মনে করেন?

সেজান এবার উঠে দাঁড়াল। বলল, আমি উঠি রাখী, এবার যাই। আজ তোমার মন ভালো নেই, খুব রেগে আছ মনে হচ্ছে।

সেজান উঠে দাঁড়াতেই রাখী কেমন হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে লাফিয়ে উঠল। মনে হল সে ভীষণ অপমানিত হচ্ছে- এখানে তার আর একমুহূর্তও থাকা উচিত নয়। সে খুব দ্রুত দরজার দিকে ছুটে গেল। আর যাবার ঐ মুহূর্তটিতেই যেন তার সারাজীবনের ভয়ঙ্কর আক্রোশ ফেটে পড়ল, কেন আসেন আপনি এখানে? কোন্ অধিকারে আসেন? মনি ভাইয়ের জীবন নষ্ট করেছেন,– আরো কী চান?

কথাটা বলেই সে ছুটে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গেল আর তক্ষুনি মনে হল, দেয়ালটা কেমন দুলে উঠল। হলুদ হয়ে এল চোখের সামনেটা। একবার মনে হল কে যেন হাঁটুতে বাড়ি মারল। আর ঐসময় বুকের ভেতর থেকে একটা দলা ঠেলে উঠল ওপর দিকে। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার হয়ে গেল সবকিছু।

সেজান দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল প্রায় ঠিক ঐ মুহূর্তেই দেখেছিল রাখী হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছে। অধীর, বিপন্ন গলায় তার চিৎকার বেরিয়ে এসেছিল- রাখী! তারপরেই তার নজরে পড়েছিল রাখী সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছে সিঁড়িতে।

টেলিফোন বাজল কয়েকবার। বুলু কয়েকজন ডাক্তার জুটিয়ে ফেলল। রাশেদ সাহেব পাগলের মতো কোথায় কোথায় ছুটে বেড়ালেন নিজেই বলতে পারবেন না। পারভিন ছুটে গিয়ে ডেকে আনল জামানকে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বিছানা, ডাক্তাররা কিছুই করতে পারছেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *