চার
সে কিছুদিন থেকেই লক্ষ করছিল ব্যাপারটা। দেখছিল, বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই রাখীর কেমন গা-ছাড়া ভাব। যখন কথা বলছে দুজনে, তখনও রাখী কী যেন ভাবে, কিছু যেন বিচার করে। আর সবচাইতে বড় কথা সে নিজের কথা বলে না কখনো। শৈশবের কথা, মায়ের কথা, তার আব্বার কিংবা বোনের কথা— কিছুই বলে না। সবসময় জিজ্ঞেস করতে হয়, জেনে নিতে হয়। একেক সময় সে টের পেয়ে যায়, রাখী কী যেন গোপন করে রাখছে। জিজ্ঞেস করলে তখন হাসে। বলে, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে দেখছি, গোপন করার মতো কী থাকতে পারে আমার, বলো?
মুখোমুখি জিজ্ঞেস করতে পারে না। রাখীকে অসম্ভব পবিত্র মনে হয়। মনে হয়, রাখীকে কিছুই জিজ্ঞেস করা উচিত নয় তার। জামানের এরকম কৌতূহল দেখে রাখী কখনো কখনো একটুখানি হাসে। তারপর আবার গম্ভীর হয়ে কাজের কথাটুকু বলে। কিন্তু ঐ যে কাজের কথা— ঐটুকু বলার মধ্যে কোথায় যেন একটা দূরত্ব তৈরি করে নেয় সে। যে দূরত্ব, জামানের মনে হয়, সে কোনোদিনই পার হয়ে যেতে পারবে না।
কতদিন রাতের বিছানায় স্ত্রীকে জাগিয়ে তোলবার সময় সে বারবার বলতে চেষ্টা করেছে, রাখী তুমি দূরে কেন, কেন এখনো এত দূরে- আমার ভালো লাগে না।
রাখী তখন সেই উত্তেজনার মুখেই ঘন ঘন নিশ্বাস নিতে নিতে বলেছে, এই তো আমি, আমার আর কী বাকি রয়েছে বলো?
রাখীর মুখের কথা। কিন্তু মনে হয়েছে, রাখী নয়, রাখীর শরীর যেন কথা বলছে। কিংবা শরীরও যেন নয়, অন্য কেউ। তারপর একদিন চরম মুহূর্তটিতে হঠাৎ চোখে পড়েছে জামানের- রাখীর চোখ বোজা, ভ্রূর ওপর কুঞ্চন, আর মুখের ওপর যেন অন্যকিছুর ছায়া।
এমনই কি হয়? দেহদানের সময় মেয়েরা কি এমনই করে সবাই? মনে- মনে খুঁজতে গিয়ে সে আর এগোতে পারে না। তার নিজের অতীত, যে অতীতকে সে চিরকালের জন্য চাপা দিয়ে সবকিছু নতুন করে আরম্ভ করতে চেয়েছিল— সেই অতীত যেন নড়েচড়ে উঠতে চাইছে বলে তার মনে হয়। একেক দিন সুষমার মুখ মনে পড়ে। শুধু কি সুষমা? নাসরিন, মেরী, মিনু- চারজনের কথাই তার মনের ভেতরে একসঙ্গে পাক দিয়ে ওঠে। সেই শারীরিক উল্লাসের মুহূর্তগুলো যেন সে স্পষ্ট দেখতে পায় মনের ভেতরে। তার মনে হয়— ওরা শরীর দিতে জানত- সম্পূর্ণ নিবেদন বোধহয় ঐরকমই হয়। ওদের সবাইকে পুরোপুরি পাওয়া যেত- কিন্তু রাখীকে পাওয়া যায় না।
ঠিক কোনদিন থেকে, সে বলতে পারবে না। কিন্তু একসময় তার মনে হয়েছে-রাখীকে সে পুরোপুরি পায়নি— কখনো রাখী নিজেকে দেয় না। নিজেকে সে আড়াল করে রাখে। শরীর ভেসে যায় ঠিকই, আবেগ উচ্ছ্বসিত হয় ঠিক, কিন্তু সে তো রাখী নয়- রাখীর শরীর শুধু।
আর এইরকমের চিন্তার ভেতরে থেকে একদিন তার মনের ভেতরে কূট সন্দেহটার জন্ম হয়েছে। সন্দেহ হয়েছে, রাখী তাকে মন দিয়ে গ্রহণ করতে পারেনি। তার ভালো লাগার, তার ইচ্ছার, তার খুশি, কিংবা দুঃখের মধ্যে সে নেই। রাখীর মনের সেইসব জায়গায় সে কখনো ঠাঁই পাবে না। রাখীর মনে সে কেন ঠাঁই পায় না? তাহলে কি সেখানে অন্য কেউ আছে? অন্য কোনো অভিজ্ঞতা কি রাখীর ছিল?
এই এক অসুস্থ চিন্তা জামানকে যেন ধাক্কা মেরে পেছনে ঠেলে দেয়। জামান সহজভাবে এগোতে পারে না। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে সে। রাখী ক্রমেই যেন অদৃশ্য একটা দূরত্ব তৈরি করে চলেছে। তারপর রাখীর পেটে এই বাচ্চা আসবার ঘটনাটা। খবরটা জানবার পর তার রাগ হয়েছিল। রাগ না অপমান, ঠিক বুঝতে পারে না। মনে হয়েছিল রাখী শেষপর্যন্ত তার সঙ্গে একটা চালাকি করল। মনে হয়েছিল, তাকে জব্দ করবার জন্যেই রাখীর এই চালাকি।
ওদিকে তখন ওর ব্যস্ততা বাড়ছে। রিসার্চের কাজটায় ঢিলে দিয়েছিল, ওপর থেকে এখন চাপ আসছে, কাজটা শেষ করো। কিন্তু জামান কাজ করবে কী- এখন কিছুই তার ভালো লাগে না। নিজেকে ভারি পরাজিত মনে হয়। মনে হয়, নিজের নিয়তির চক্রে সে বাঁধা। অতীত থেকে মুক্তি পাওয়ার আর পথ নেই তার। পুরনো পাপ তাকে তাড়া করে ফিরছে। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই পাপ, পাপ ছাড়া আর কী। যে পাপকে সে পাশ কাটিয়ে এসেছে, যে পাপকে সে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল, ভুলে যেতে চেয়েছিল, সেই পাপ যেন এখন মুখোমুখি দাঁড়াতে চাইছে। ভেবেছিল অন্ধকার থেকে একেবারে আলোকময় পবিত্রতায় এসে পৌঁছেছে সে, পুরনো অতীতকে সে ঝেড়ে ফেলতে পেরেছে। কিন্তু দেখছে, পাপ ছাড়ে না। অতীতের সেই পাপই সম্ভবত এবার শোধ নিচ্ছে।
রাখীকে খুলে বলতে চায়নি সে। যখন প্রথম রাখীকে ভালো লেগেছিল, তখন তো সে রাখীকে ভাবছে শুভ্রতম, পবিত্রতম একটা কিছু। মনে হয়েছিল রাখী তার জীবনে এলেই সে পাপ আর গ্লানি থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। ভালোবাসা সবকিছু ঢেকে দেবে। ভেবেছিল, রাখীর কাছে সে ক্ষমা চেয়ে নেবে। বলবে, আমি তোমার যোগ্য নই, আমাকে তুমি ক্ষমা করো, তুমি ক্ষমা করলেই আমি যোগ্য হয়ে উঠতে পারব।
কিন্তু রাখীকে সেকথা বলতে পারল কই? বিয়ের রাতে কথাটা বলতে গিয়ে সে থেমে গেছে। কেউ যেন তার গলা চেপে ধরেছিল। তখন সম্ভবত তার হিশেবি বুদ্ধি, তার চতুর কৌশল, তার স্বার্থবোধ আপনা থেকে সজাগ হয়ে উঠেছিল সেই মুহূর্তে। আর ঐদিনই প্রথম বুঝতে পেরেছিল, আসলেই সে ভয়ানক দুর্বল।
শরীরের লোভ আর আকর্ষণ যখন ফিকে হয়ে আসছে, যখন দুজনের আপন হয়ে উঠবার সময়- তখন তার মনের ভেতর ভয় এসে ঢুকেছে। এই বুঝি বেরিয়ে আসবে তার অতীত। এই বুঝি অতীতের পাপ এসে তার শেষ ছোবলটা দেবে। ভয়ানক আতঙ্ক পেয়ে বসেছিল তখন। আশঙ্কা হচ্ছিল, কখন রাখীর সঙ্গে তার পুরনো বন্ধুদের কারো দেখা হয়ে যাবে আর সবকিছু তার ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। রাখীর সামনে সে দাঁড়াতে পারবে না। এইরকম সে যখন ভেতরে ভেতরে ভয়ানক এলোমেলো হয়ে আছে ঐ সময়েই হঠাৎ কোত্থেকে যেন ধূমকেতুর মতো উদয় হল কায়সার।
কায়সার সদ্য তখন বিলেত ঘুরে এসেছে। তার জানা ছিল, কায়সার দেশে ফিরবে না। কিন্তু দেখে, তার ধারণা ভুল। কায়সার বাউণ্ডুলেপনা না-ছেড়েও দেশে দিব্যি ফিরে এল এবং সে পুরনো বন্ধুদের খোঁজখবর নিয়ে আসর জমাবার জন্যে উদ্যোগী হয়ে উঠল। সে একদিন য়ুনিভার্সিটি ক্লাবে এসে জামানকে ধরে নিয়ে গেল ওদের ক্লাবে। সেখানে ওর বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। মনসুরকে দেখে সে আরো অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেল। একসময় মনসুর তার সবচাইতে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। ঐ আসরে আরো দেখে হাসানকে, নার্গিসকে, মাজহারকে। পুরনো আর নতুন, অতীত আর বর্তমান— একাকার হয়ে উঠল তার চোখের সামনে।
ক্লাবে গিয়ে প্রথমেই তার মনে হয়েছিল, এখান থেকে সে কেটে পড়বে। এ জায়গা তার জন্যে নয়। যে জীবন সে ছেড়ে গিয়েছে, সেখানে তার ফিরে যাওয়া উচিত নয়। কিন্তু তিনদিন পরই, মাত্র তিনটি দিন, তারপরই কায়সার আর মনসুর এসে তাকে আবার পাকড়াও করল, দোস্ত তুমি কিন্তু বেজায় সংসারী হয়ে উঠেছ, এতটা ভালো না, সংসার আমরাও করি। জামান অপ্রস্তুত হয়ে অন্য কথা পাড়ে। বলে, না তুমি যা ভাবছ, তা নয়- আমি আসলেই ব্যস্ত। স্কলারশিপের একটা ব্যাপার আছে। হতে-হতে মাঝখানে ঝুলে আছে- তাই…
কায়সার হেসেছে জামানের কথা শুনে। বলে, আমাদের এখানে না-যাওয়ার জন্যে ওটা কোনো যুক্তি নয়। নাউ গেটাপ, লেটাস সি স্কলারশিপটা কোন্ সন অফএ বীচ ঠেকিয়ে রেখেছে।
কায়সার অসাধারণ রিসোর্সফুল। ক্লাবে যখন পৌঁছল তখন দুপুর। ক্লাব থেকেই সে গভর্নর হাউসে টেলিফোন করল দুবার, বার তিনেক সেক্রেটারিয়েটে, তারপরই বলল, দোস্ত তুমি কিন্তু ভালো করোনি কাজটা। কী কাজ? কোন্ কাজটা? জামান উদ্বিগ্ন হয়।
আরে, তোমাদের ঐ য়ুনিভার্সিটির দলাদলির ব্যাপারটা। তোমার সম্পর্কে ওদের রিপোর্ট ভালো নয়।
কেন, বাহ্! আমি তো সরকারের পক্ষে স্টেটমেন্ট দিয়েছি।
যাই করো। কাগজে-পত্রে তোমার কেসটা খুব শক্ত নয়।
ঐদিনের পর থেকে কায়সারকে এড়িয়ে চলবার কথা তার আর মনে হয়নি। মনে হলেও সে নিজের কাছ থেকে সময় চেয়েছে। ভেবেছে, এখন নয়, সে কায়সারের প্রভাবটা কাজে লাগাতে চায়। স্কলারশিপটা তার হোক আগে, তারপর সে কেটে পড়বে। আর কোনোদিন সে তার পুরনো জীবনের সঙ্গে সামান্যতম সম্পর্কও রাখবে না।
ভাবে, কিন্তু ঐ ভাবা পর্যন্তই। যখন ভাবে- তখন নিজেকে ধিক্কার দেয়, ছি ছি এতই দুর্বল সে, স্কলারশিপের মোহটা কাটাতে পারছে না। স্কলারশিপ না পেলে কী হয়! এইরকম নিজেকে ধিক্কার দেবার পর হতাশা পেয়ে বসে তাকে। কেমন মনে হয়, তার নিজের কিছু করণীয় নেই। কতগুলো ঘটনা যেন অনিবার্যভাবে ঘটবে আর সেইসব ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে হবে তাকে। না-থেকে তার উপায় নেই। এ যেন তার নিয়তি।
তার সবকিছু উল্টেপাল্টে যেতে লাগল রাখীকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে। দেখে ভয়ানক করুণ লাগে, কাছে গিয়ে যখন শুধায়, শরীরটা কি খারাপ লাগছে?
চোখ বুজেই থাকে, যেন শুনতেই পায়নি এমন ভাব করে। কিংবা যদি শোনেও চোখ খোলে না, চোখ বোজা অবস্থাতেই মাথা নাড়ায়। কোনোদিন যদি জামান জোর করে, এই শোনো, বলো না তোমার কেমন লাগছে? ডাক্তারের কাছে যাই আজ, চলো।
এই কথার পর রাখী চোখ খুলে দেখে স্বামীর মুখের দিকে, তারপর ভয়ানক ম্লান হাসে। বলে, না আমি আজ ভালো আছি।
জামান বুঝতে পারে না-অভিমান নাকি অস্বীকার। রাখী কি তাকে অস্বীকার করছে? সে আর কথা বলতে পারে না। বাসা থেকে বেরিয়ে আসে। বাইরে এসেই তার রাগ হয়। মনে হয়, রাখী ভয়ানক জেদি মেয়ে। অসম্ভব ওর অহংকার। স্বামীর কাছ থেকে কিছুই যেন নেবে না বলে ঠিক করে রেখেছে।
সম্ভবত এইজন্য কেমন যেন এক পা এক পা করে দূরে সরতে লাগল জামান। অল্প ক’দিনের ব্যাপার, দুমাসও নয়, কিন্তু এরই মধ্যে একদিন সে লক্ষ করল, রাখীর কাছে সে পৌঁছতে পারছে না। রাখী সংসারের কথা বলে দুটি একটি— কিন্তু তারপর চুপ হয়ে যায়। যদি বলে, চলো আজ বাইরে যাই কোথাও, রাখী মাথা নাড়ায়। বলে, আমার ইচ্ছে করছে না, অন্যদিন যাব, আজ থাক।
ঐ কথার পর আর কথা বলা যায় না। জামানের মনে হয় একেক সময়, রাখীর ঐ অহংকারের আবরণটা যদি সে ভেঙে দিতে পারত, তাহলে যেন সে স্বস্তি পেত। কেন অত উঁচু থেকে কথা বলে ও? কেন জামানের পাশাপাশি থাকতে পারে না? কিসের অহংসার ওর অত।
ঠিক এইরকম সময় একদিন মাজহার একাকী টেবিলে বসে জামানকে জিজ্ঞেস করল, আপনার মিসেস একদিনও এলেন না? কী ব্যাপার? জামান জানত, মাজহারের অফিসে রাখী কাজ করত। ধরে নিল, সাধারণ সৌজন্যমূলক প্রশ্নই করছে মাজহার। সে জবাব দিল, ওর শরীরটা আজকাল ভালো যাচ্ছে না, না হলে আসত নিশ্চয়ই।
শরীর খারাপ? ইজ শি সিক?
মাজহারের প্রশ্ন শুনে চোখ তুলে তাকায় জামান, আর সঙ্গে সঙ্গে কেমন অস্বাভাবিক লাগে লোকটাকে। মনে হয়, লোকটা অন্যরকম। যাকে সে ক’দিন ধরে দেখে আসছে এ যেন সে নয়।
মাজহার কী যে ভাবে কে জানে। সে হঠাৎ বলে ওঠে, শি ইজ এ ডেলিকেট থিং জামান, ডোন্ট ট্রিট হার রাফ।
মাজহারের ঐ কথায় কী যেন চমকে উঠল জামানের মনের ভেতরে। কেবলই মনে হতে থাকে, কেন এমন কথা বলল মাজহার? রাখীর ব্যাপারে কেন ওর এইরকম গায়ে-পড়া উপদেশ? তবে কি এই লোকটা তার বন্ধু নয়? কোনো গোপন শত্রু? এর কথা রাখী কখনো বলেনি তার কাছে? তার মনে সন্দেহ গাঢ়তর হয়ে ওঠে। মনে হয়, এই লোকটা নিশ্চয়ই রাখীর সঙ্গে কোনো-না-কোনোভাবে সম্পর্কিত।
কেন যে ঐ সন্দেহটা তখন তার মনের ভেতরে জেগে উঠেছিল, সে বলতে পারবে না। তবে গেল না সন্দেহটা। ক্রমেই জাঁকিয়ে বসল মনের ভেতরে।
ক’দিন পরের কথা। কায়সারের সঙ্গে ক্লাবে বসে আছে, এমন সময় একটি মেয়েকে ক্লাবে ঢুকতে দেখে জামান। কায়সারের সেদিন মন খারাপ। তার বন্ধু জাফর ইলাহী ব্যবসা গুটিয়ে লাহোরে ফিরে যাচ্ছে। সেই দুঃখে সে পর পর কয়েক পেগ মদ খেয়ে উদাস-উদাস ভাব নিয়ে চারদিকে তাকাচ্ছিল। এমনি সময় এল মেয়েটি। দূর থেকেই উজ্জ্বল মুখে ডাকল, হাই কায়সার।
বুঝল এবার কায়সারের মুড ফিরবে, মনখারাপ ভাবটা কাটবে। সে কায়সারের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে শুধু। কায়সার মেয়ে-পাগল মানুষ, রাজ্যির মেয়ের সঙ্গে জানাশোনা। মেয়েটি কাছে আসতেই বুঝল, বাঙালি নয়। কাছাকাছি এসে দাঁড়াতেই কায়সার মেয়েটির কোমর ধরে কাছে টানল, একটুখানি আদর করল, তারপর কুশল জিজ্ঞাসা করে ছেড়ে দিল। মেয়েটি একটু দূরের এক টেবিলে একাকী বসল। বলল, বড় ভালো মেয়ে, এ গোল্ডেন সোল।
জামানের কিছুই বলার ছিল না। খারাপ লাগছিল না, ভালো লাগছিল না- এমনি একটা গা-ছাড়া ভাব তাকে তখন ক্রমেই পেয়ে বসছিল। বাসায় ফিরবে না আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে ভাবছিল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছিল মাঝে মাঝে। মেয়েটির দিকেও তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছিল। একটুখানি অন্যায় কৌতূহলও জেগে উঠছিল।
কায়সারের তখনো পুরো নেশা হয়নি। কিন্তু তবু কীরকম একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, ভেরি স্যাড, কী অদ্ভুত জীবন ওদের। ওরাই হচ্ছে বোধহয় সেই লোক যাদের জন্যে কবিতা লেখা হয়েছে— দেশে দেশে ঘর আছে মোর, সেই ঘর মরি খুঁজিয়া। অ্যাংলোদের মতো এমন একটা জাত কোথাও খুঁজে পাবে না— দে আর ডেস্টাইন্ড টু লুজ। জীবনে যত সাধ, সাধ্য নেই তার এক কণাও। কিন্তু জানো, খুব অনেস্ট মেয়ে ও। স্ট্রেট কথাবার্তা বলে। পয়সার জন্যে ও ফ্রেন্ড জোটায়-কিন্তু সেও স্রেফ পয়সারই জন্যে। পয়সার ওর বড্ড দরকার, পয়সা না হলে ওর চলে না। ওর ব্যাপারে সবচাইতে যেটা ইম্পর্ট্যান্ট সেটা কি জানো? ও কক্ষনো কাউকে ঠকায় না। তুমি যদি ওর কাছে যাও, রাত কাটাবার পর বলবে, নেভার কাম এগেন, যদি যথেষ্ট পয়সা না থাকে। তবে যদি ওড়াবার মতো যথেষ্ট টাকা থাকে, তাহলে আবার এসো, য়ু আর ওয়েলকাম।
জামান একটা পেগ নিয়েছিল, সেটা তখনও হাতে ধরা আছে। কায়সারের মুখের দিকে সে দেখছে আর কায়সার তখন ইভা মরিসের গল্প শোনাচ্ছে। জানো, ওর বোনটা বিছানায় শুয়ে থাকে চব্বিশ ঘণ্টা। কোমর থেকে নিচের অংশটা প্যারালাইজ্ড। আর বোনের স্বামীটি রত্ন একেবারে। এমনিতে ওস্তাদ মাতাল, ওদিকে আবার পাঁড় জুয়াড়ি। ওকে এখন বোনকে টানতে হয়, বোনের ছেলেমেয়েদের দেখতে হয়। ভারি দুঃখী মেয়ে ও।
জামান মন দিয়ে শোনে। শোনে, এমন যে ইভা মরিস, সেই ইভা মরিসেরও প্রেম হয়েছিল। আর প্রেম হয়েছিল কার সঙ্গে জানো? ঐ স্কাউন্ড্রেল মাজহারের সঙ্গে।
কোন্ মাজহার? জামান যেন সহসা চিনতে পারে না।
আরে ঐ আমাদের মাজহার, ওভারসিজ-এর মাজহার। শালা ওকে অনেকদিন মিস্ট্রস করে রেখেছিল। ওকে চাকরিও দিয়েছিল নিজের অফিসে। ইভা তখন মাজহারকে আঁকড়ে ধরতে চাইল। কেননা, ওর বয়স হচ্ছে তখন। জানত শরীরটুকুই ওর পুঁজি। ঐ পুঁজিটুকু কাজে লাগাতে না পারলে ওর পুরো ভবিষ্যৎ একেবারেই অন্ধকার। তাই শরীরের ঐ পুঁজিটুকু থাকতে থাকতেই সে মাজহারকে গেঁথে ফেলতে চাইছিল। শি ওয়ান্ডেট টু সেল।
কায়সার দার্শনিকের মতো হয়ে ওঠে ইভা মরিসের কথা বলতে বলতে। বলে, লাইফ বোধহয় এরকমই দোস্ত, তুমি যা চাইছ আমি তা কোনোভাবেই চাইব না।
কায়সার কিছুটা ঈশ্বর-প্রসঙ্গও এনে ফেলে তার মন্তব্যে। বলে, মানুষ যা প্ল্যান করে তার কিছুই ঘটে না, তোমাদের ঐ বিধাতা নামক ওপরঅলাটি বেজায় রসিক দোস্ত। তাঁর নিজের দুনিয়ায় কোনোকিছুই ঠিক ঠিক নিয়মমতো ঘটান না।
জামান গল্পের শেষটা শোনার জন্যে উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছিল। বলল, নো ফিলসফি প্লিজ, গো অ্যাহেড, বলো, শেষে কী হল।
কায়সার গ্লাসের শেষটুকু উপুড় করে গলায় ঢেলে কেমন যেন গা-ঝাড়া দিয়ে নড়েচড়ে বসল। বলল, কী আর হবে। গল্পে যেমন হয়ে থাকে। মাজহার লেট হার ডাউন, সে তখন মজেছে আরেক মেয়ের প্রেমে, ইভাকে চাকরি থেকে তাড়িয়ে দিল, ইভা কাঁদল, কেঁদে কেঁদে নিজেকে সামাল দিল। শি ওয়াজ ইন রিয়েল লাভ।
জামান এই পর্যন্ত শুনে স্থির হয়ে যায়। কী একটা সন্দেহের পর্দা দোল খাচ্ছে কোথায়। দেখা যাচ্ছে না, বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু সে অনুভব করতে পারছে। সে অপেক্ষা করে অধীর হয়ে। আরো জানতে চায় সে। বলুক কায়সার, আরো কী বলতে পারে। মাজহারকে দেখে সেদিন যে অস্পষ্ট সন্দেহটা পাক খেয়ে উঠেছিল মনের ভেতরে, তার মনে হয়, ইভার গল্প যেন সেই সন্দেহের একটা দিক।
জামান একবার ভাবে উঠে যাবে। উঠে চলে যাবে বাসায়। কিন্তু পরক্ষণে মনে হল, বাসায় গিয়ে তো তাকে আবার সেই স্ত্রীকেই দেখতে হবে। শাদা পাথরের মূর্তির মতো, ঠাণ্ডা, স্থির, আর অনেক দূরের জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় না। তবু জিজ্ঞেস করে, মাজহারের সেই মেয়েটি কে জানো? নাম বলেনি ইভা?
ও নো, শি নেভার ডাজ দ্যাট। যে কেউ ওর ক্ষতি করুক না কেন, শি ফরগেটস। শুধু নিজের ভালোবাসাটাই ও ভুলতে পারে না, এই যা দুঃখ। জামান দূরের টেবিলে ইভাকে দেখল। অল্পবয়সী এক ছোকরার সঙ্গে বসে মদ খাচ্ছে। জামান দূর থেকেই দেখে ওর শুভ্র ঘাড়, শরীরের সঙ্গে আঁটো পোশাক, ব্র্যার বাঁধুনি পোশাকের ভেতরে থেকে ফুটে বেরুচ্ছে। ইভার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কায়সার মৃদু ধমক দিল। বলল, ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন গেঁয়ো ভূতের মতো! দেখবার ইচ্ছে থাকলে বল্, কাছে ডাকি, আলাপ করিয়ে দিই।
জামান অপ্রস্তুত হয় কায়সারের কথায়। হেসে বলে, না ভাই আমার ওসব চলবে না। আমি এখন অন্য জগতের মানুষ। ইচ্ছে থাকলেও পারব না। না-পারাই ভালো দোস্ত, কায়সার নিচু হয়ে মাথা দোলায়। ও পথ ভারি বিচ্ছিরি- কেউ মানুষ থাকতে পারে না- সবাই অমানুষ হয়ে যায়। ওয়ান্স য়ু আর ইন, য়ু কান্ট হেলপ ইট দেন। তুমি কেন খামোকা ওসবের মধ্যে যাবে, তোমার বউ আছে, সংসার হয়েছে এখন।
কায়সারকে ঐ কথার পর মনে হয়েছিল ভীষণ ক্লান্ত, ক্লান্ত আর অবসন্ন। যেন টেবিল ছেড়ে আর উঠবে না কোনোদিন। একেক জনের হয় ঐরকম, মাতাল হলে ক্লান্ত, অবসন্ন আর দুঃখী বলে মনে হয়।
তারপর জামান উঠে এসেছে। মনের ভেতরে সন্দেহটা এখন এপাশ- ওপাশ ফিরছে। আর থেকে-থেকে মনের ভেতরে কেউ যেন বলছে, এবার, এবার কী বলবে রাখী?
রাখীর না বড় অহংকার?
যেন একরকমের আনন্দ। সে বাসায় ফিরল না তক্ষুনি। এলোমেলো ঘুরল রাস্তায় রাস্তায়। সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে তখন। তোপখানার ওপারে প্রেসক্লাবের সামনে গাড়ির ভিড়। সায়ীদকে দেখে, রিকশ চেপে বেরিয়ে যাচ্ছে। একবার ভাবল ডাকে, কিন্তু ডাকল না।
থেকে-থেকে কেবলই নিজেকে প্রতারিত মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, ইচ্ছে করলেই কেউ পাপকে অতিক্রম করে যেতে পারে না। স্ত্রীকে সে পবিত্রতম, শুভ্রতম কত কিছু না-ভেবে রেখেছিল? কিন্তু এসব কী জানছে সে?
রাখী কেন তাকে গ্রহণ করতে পারছে না? কেন তাকে আবার সেই পুরনো জটিলতার মধ্যে গিয়ে পড়তে হচ্ছে?
নাকি এ সবই তার পাপের প্রতিশোধ! ভাগ্য এখন প্রতিশোধ নিচ্ছে। গত ক’বছরে একেবারে সবকিছু নতুন করে আরম্ভ করেছিল সে। তার প্রেম, তার প্রতিষ্ঠা, তার নিরাপত্তা, সব তো সে একটু একটু করে তৈরি করে আনছিল। কিন্তু এখন? এখন কোথায় থাকবে তার প্রেম, তার প্রতিষ্ঠা আর বহু সাধে গড়ে তোলা সুখের জীবন? তার অতীত কি এতকাল পরে আবার অন্ধকার থেকে লাফিয়ে বাইরে চলে এসেছে আর এসেই তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে তাকে? আবার তাকে ঠেলে দিচ্ছে একটা দিশেহারা স্রোতে। বড় হিশেব করে সে পা রেখেছিল প্রত্যেকটা ধাপে। সর্বনাশ থেকে উঠে এসেছিল একের পর এক সিঁড়ি বেয়ে। কিন্তু এখন?
কলেজে পড়বার সময় সে বাবার পাঠানো টাকা দুহাতে উড়িয়েছে। কখনো ভাবেনি, বাবা না থাকলে কী হবে। য়ুনিভার্সিটিতেও তার বিলাসিতা ছিল চূড়ান্ত। বাবা শয্যাশায়ী হলে প্রথম বুঝতে পারে, টাকা শুধু খরচ করলেই চলে না, রোজগারও করতে হয়। কিন্তু সে যোগ্যতায় পৌঁছতে তার তখনও অনেক দেরি। কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে তেমন সম্পর্ক হয়নি। কিন্তু য়ুনিভার্সিটিতে ঘনিষ্ঠ বন্ধু জুটল। তাদের একজন কল্যাণ মজুমদার, আর ঐ কল্যাণের বড়বোন হল সুরমা মজুমদার। তারপর কলেজে চাকরি করার সময় একের পর এক এল শাহেদারা, দুটি ছাত্রী মেরী আর মিনু, অল্পবয়সী বিধবা ইস্কুলের টিচার সুফিয়া হক। কী ভয়ানক ধূর্ত হয়ে উঠেছিল সে। ধূর্ত আর লম্পট।
মোহনপুর থেকে পালিয়ে আসতে হল পাবনায়। শেষে পাবনা থেকেও প্রাণ নিয়ে কোনোক্রমে বেঁচে ফিরে এল ঢাকায়। ঢাকায় ফিরে এসে বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াতে হল তাকে দুটো বছর। তারপর অনেক হাতেপায়ে ধরে প্রথমে ফেলোশিপ এবং সেই সুবাদে পরে এই লেকচারারের চাকরি। তার এই সময়ের মধ্যে সে বড় হিশেব করে চলেছে। পুরনো বন্ধুদের সংসর্গ বাদ দিয়েছে। বড় কষ্টে সে লোভকে শাসন করেছে। মাঝখানে দুটি-একটি ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু সে তো নিজেকে শাসনের বাঁধবার জন্যেই দরকার ছিল। কী যেন নাম মেয়েদুটির? এখন তার মনেও নেই। তবে নিজেকে ভেসে যেতে দেয়নি। যে স্রোত তাকে টানত, তার উল্টোদিকে গিয়েছে সে। মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করেছে, জীবনকে নতুনভাবে সে গড়ে তুলবে। পড়াশোনায় মনোযোগ দিয়েছিল, ভালো পড়াতে পারত, আর ঐসময়ই এল রাখী। রাখীকে যেদিন প্রথম দেখে, এখনো মনে আছে, শান্ত ধীর মেয়ে- হ্যাঁ, ধীর এবং গম্ভীর।
ওর চারপাশে শুভ্র একটা পবিত্রতার আভা যেন দেখতে পেত। অন্তত তখন তা-ই মনে হয়েছিল।
অনেক পেছনে ফেলে এসেছিল সে কায়সারদের। অনেক পেছনে ফেলে এসেছিল সে নিজের লাম্পট্য আর প্রতারণাময় অতীতকে। কিন্তু এখন? সেই ফেলে-আসা দূরের অতীতই তো তার গড়ে তোলা জীবনের ছকটাকে তছনছ করবার জন্যে একসঙ্গে দশখানা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সে না প্রেমে সুখী হতে চেয়েছিল? রাখীকে ধরে নিয়েছিল বহু ক্লান্তি, বহু গ্লানি আর অস্থিরতার পরে সুস্নিগ্ধ, পবিত্র আর সুস্থির আশ্রয়। কিন্তু কী হল শেষপর্যন্ত? রাখীকে তো পায়নি সে। রাখীর যেটুকু পাওয়া যায়, সে তো শুধু তার বাইরের খোলসটুকু? এইটুকু পাওয়ার জন্যে কি সে এত হিশেবি হয়েছিল? এইজন্যেই কি তার এত কৃচ্ছ্রতার সাধনা?
নাকি সে যা ভেবেছে, তা কখনো হয় না। সে যা করে এসেছে, তার সবটাই অর্থহীন। পবিত্র বলে কিছু নেই, পাপ সবাইকে স্পর্শ করে যায়। প্রতারণাই হল জীবনের সারকথা। আমি প্রতারণা করছি আমার স্ত্রীর সঙ্গে, আমার স্ত্রী প্রতারণা করছে আমার সঙ্গে— এইই হয়ে আসছে। এইই হয়ে থাকে। বরং জীবনকে তার সহজভাবেই গ্রহণ করা উচিত।
নিজের মনের ভেতরে এইসব চিন্তার ফাঁকে ফাঁকে আপনা থেকে দীর্ঘশ্বাস পড়ল বারবার। রাখী, এবার? এবার তুমি কী বলবে? খুব না পবিত্র ছিলে তুমি?
জামান সেদিন বাসায় ফিরে দেখে, রাখী শুয়ে আছে, স্থির নিস্পন্দ, করুণ। চোখ খুলে স্বামীকে দেখতে পেয়ে উঠে বসল। বলল, অনেক দেরি করলে যে আজ?
উদ্বেগ ফুটল? নাকি অনুযোগ? স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে জামান। কুটিল মিথ্যার ছায়া খোঁজে সেখানে। রাখীও কি তারই মতো নিজের অতীতকে লুকিয়ে রেখেছে কোথাও? সে রাখীর চোখের দিকে তাকায় আর বারবার মনে হয়, আছে, সেখানে মিথ্যার চিহ্ন আছে, পাপের ছায়া আছে, নিশ্চয়ই আছে। সে মূর্খ, তাই তার চোখে পড়ে না। তার মনে হল, রাখীর একটু আগের অন্তরঙ্গ জিজ্ঞাসা, আসলেই বানানো। তার ভাবনায় তার সে-ই থাক, অন্তত জামান থাকে না। যদি থাকত, তাহলে রাখীর আচরণ অন্যরকম হত। অন্তত এমন আচরণ হত, যাতে তার সন্দেহ, সংশয় সব ঘুচে যেত।
জামান আজ স্ত্রীর কপালে হাত রাখল না অন্যদিনের মতো। রাখী খেতে ডাকলে জানাল, বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে। তারপর একসময় বলল, জানো, আজ ইভা মরিসের সঙ্গে দেখা হল, তুমি চিনতে ওকে?
রাখী চমকাল না। মনে-মনে যেন খুঁজল, ইভা মরিস কে? তারপর শুধাল, আলাপ হয়েছে?
না, দেখলাম শুধু, কায়সারের কাছ থেকে শুনলাম ওর গল্প। আর জানো, মাজহার সাহেবের সঙ্গে আমার অনেক কথা হল।
জামান তখন ভয়ানক উল্লাস বোধ করছে মনে-মনে- আহা দেখি তোমাকে, দেখি। তোমার ছলনার কী চেহারা, দেখি কতখানি তুমি লুকোতে পারো।
রাখী স্বামীর দিকে তাকিয়ে রয়েছে তখন, কিছু বলছে না।
আচ্ছা, জামান একটু থেমে আবার শুধাল, মাজহার খান তো তোমার বন্ধু ছিল, তাই না?
রাখী দেখল স্বামীকে। যে লোকটাকে সে কিছুকাল ধরে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখে আসছে, তাকেই আবার নতুন করে দেখল। যার আবেগ-কাঁপা গলার স্বর তার কানের কাছে জীবনের কথা, ভালোবাসার কথা, বিশ্বাসের কথা, বহুবার উচ্চারণ করেছে, সেই লোকের মুখে কি আজ অন্যরকম চেহারা ফুটে উঠতে চাইছে? সে ভালো করে না দেখে পারল না। জামানের বুকের ভেতরে তখন উল্লাস লাফাচ্ছে। যেন সে বাগে পেয়েছে রাখীকে। হাসতে হাসতে, যেন খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার কোনো, জানতে চাইল, ও তোমাকে বোধহয় ভালোবাসত, তাই না?
রাখী ভাবে একবার, বলবে কি বলবে না। তারপর বলল, আমি ঠিক জানি না।
আর তুমি?
রাখীর ভ্রূ কুঁচকে উঠল। বুকের ভেতরে কষ্ট হল। পরের মুহূর্তেই মনে হল, বিশ্রী স্থূল একটা মানুষ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কী দারুণ নোংরা একটা লোক। সে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইল। সোজাসুজি তাকিয়ে বলল, দ্যাখো, এসব কথার এখন আর কোনো মানে হয় না। তোমার বোধহয় নেশা হয়েছে, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।
জানালাটা বন্ধ, ঘরের ভেতরে এমনিতেই গুমোট। রাখী পর্দা সরিয়ে জানলা খুলে দিল। ঝিরঝির করে বাইরের বাতাস বয়ে এল ঘরের ভেতরে।
তারপর মুখ ফেরাতেই দেখে, জামান তখনও দাঁড়িয়ে আছে, দেখছে তাকে। ঐভাবে দাঁড়িয়ে সে আবার বলল, কই বললে না?
রাখীর অবিশ্বাস লাগে। বলে, কী বলব?
তুমি ওকে ভালোবাসতে?
রাখীর তখন আর সহ্য হল না। ইচ্ছে হল, তীব্র গলায় চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু শেষে সেরকম কিছুই না করে জবাব দিল না। শান্তস্বরেই জবাব দিল। বলল, না ওর সঙ্গে আমি কখনো প্রেম করিনি, করলে হয়তো ওকেই বিয়ে করতে হত, তোমার সঙ্গে তাহলে আর আমার বিয়ে হত না।
রাখীর বলবার ভঙ্গিতে কী ছিল কে জানে। জামান চুপ হয়ে যায়। বিশ্বাস হয় না রাখীর কথা, কিন্তু তবু চুপ করে থাকে। দেখে, রাখীর চোখ-মুখ শরীর সবকিছুতে পাথরের মতো একটা ভাব ফুটে উঠেছে। সে কেমন ভয় পেয়ে গেল। ভয় পেল কিন্তু তার মনের উল্লাসটা দমন করতে পারল না। একটু পর আবার বলল, আমাকে যদি আগে একটুখানিও জানতে দিতে, তাহলে মাঝখানে আমি এভাবে এসে পড়তাম না।
রাখী সে রাতে স্বামীর ঐ কথার কোনো জবাব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। তার পরের দিনই সকালে সে শান্তিনগরে চলে এল।
বুবু বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, রাখীকে দেখে অবাক। শুধু অবাক নয়, রাখীর মনে হল, বুবু যেন ভয় পেয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করল, সে কী রে, তুই এভাবে হঠাৎ-
হ্যাঁ, চলে এলাম, রাখী বড়বোনের দিকে তাকিয়ে হাসতে চেষ্টা করল। বলল, একা থাকতে ভালো লাগছিল না, তাই চলে এলাম, আব্বা কোথায়?