ত্রয়ী উপন্যাস -প্ৰথম পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - দ্বিতীয় পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - তৃতীয় পৰ্ব

কুলায় কালস্রোত – ২

দুই

রাখী ভাবতে চায় না। না, ভাববে না সে। জীবন যদি এরকমই হয় তো তার কী করবার আছে। বুবুর কথা মনে হলে আজকাল ভীষণ কষ্ট পায় সে। শুধু বুবু কেন, আব্বার কথা মনে পড়লেও বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে, কান্না পায়। মনি ভাই সেই-যে শেষ সময়ে বলত, জীবন কাকে বলে আব্বা? এই কি জীবন? এরকমই কি ঘটে থাকে সবার জীবনে? রাখী বাসায় ফেরে। রিকশয় পাশে বসে জামানের বকবকানি শুনতে হয়। মানুষ এত বকবক করতেও পারে। কত যে কথা ওর। বুবুর কথা, হাসান ভাইয়ের কথা, আব্বার কথা। একসময় বলে, বুবুর দু-একটি ছেলেপুলে থাকলে বেশ হত। বেচারা এত লোনলি! জামানকে ঐরকম সমবেদনা জানাতে দেখেও রাখী বিরক্তি হয় না, ক্ষুব্ধ হয় না। কী লাভ? তার কি বিরক্ত হওয়া সাজে! জীবনকে তো সে কখনো মুখোমুখি দেখতে চায় নি কখনো লড়াই করতে দাঁড়ায়নি। স্রোত যেদিকে টেনেছে সে ভেসেছে সেইদিকে। বুবুর জন্যে জামানের এইরকম করুণা হতে দেখে তার কেন ক্ষোভ হবে, কেন বিরক্তি লাগবে?

সুস্পষ্ট চিন্তা নয়, কেমন একটা অস্পষ্ট ধারণা ছিল রাখীর। ধারণা ছিল, মেয়েরা বড় হয়, লেখাপড়া শেখে, তাদের প্রেম হয়, বিয়ে হয়, শেষে ছেলেপুলে নিয়ে সংসার পাতে। জীবনের মোটামুটি চেহারা এ-ই। এই রকমেরই একটা স্রোতের মতো জীবন বয়ে যায়। সবার জীবন এমন। তার জীবনও শেষপর্যন্ত এমনই হবে। সে নিজেও ঐরকম স্রোতেরই একটা অংশ। কখনো ভাবেনি স্রোতের মুখোমুখি তাকে কোনো সময় দাঁড়াতে হবে। সে না শান্তি আর সুখ চেয়েছিল জীবনের কাছে? স্রোতের মুখোমুখি দাঁড়ালে কি শান্তি থাকে, না সুখ পাওয়া যায়?

এখন তার জীবন তো শান্তই। আর সুখও হয়েছে তার।

সুখ কি এমন নয়? সুখ তো বোধহয় এমনই হয়। এ জীবন তো তার সুখেরই জীবন। রাখী নিজের মনের দিকে তাকায় আর ঘুরেফিরে নিজেকেই বলে।

বিয়ের রাতে কান্না ফুলে ফুলে উঠছিল বুকের ভেতরে। স্বামীর বিছানায় শোয়ার সময়ও কান্না গুমরে মরছিল। জামান তখন বুকের কাছে টেনে নিয়েছে। সান্ত্বনার হাত রেখেছে পিঠে। করুণায় অসহায় হয়ে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়েছে কতবার। বাইরের জানালা খুলে দিয়ে ঘরের ভেতরে ঠাণ্ডা বাতাস আসতে দিয়েছে। না, লোভ নয়, মমতাই বলবে রাখী। জামান লোভীর মতো ব্যবহার করেনি সেদিন। সেদিনের প্রথম চুম্বনেও শুধু গভীর মমতাই ছিল।

তারপর একসময় বুকের ভেতরকার কান্নার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি আপনা থেকে মিলিয়ে গিয়েছে। একটু একটু করে স্মৃতি, শব্দ, কান্না সবকিছু মুছে গেছে কখন। আর রাখীর শান্ত চোখ গিয়ে পড়েছে বিছানার ওপর। দেখতে পেয়েছে বিছানার ওপরকার রজনীগন্ধা ফুল, বালিশের কাছে বকুলমালা। নিজেরই হাতে মেহেদির রঙ। নিজেরই ওড়নার জরি চিকচিক করছে। গলার কাছে চিকটা লাগছিল, একবার ভাবছিল খুলে ফেলে। কিন্তু কী মনে করে খোলেনি। বুবু বলে দিয়েছিল, কোনো গয়না খুলিস না সাতদিন, খুলতে নেই।

বালিশে মাথা পেতে শুয়েছিল আর জামান ঝুঁকে পড়ে দেখছিল স্ত্রীর দিকে। রাখী জানে না কেমন করে হল। এসময় মনের ভেতরকার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি সব মিলিয়ে গিয়ে কীরকম একটা অস্পষ্ট প্রতীক্ষা জেগে উঠল। কেবলই মনে হতে লাগল সে যেন কতকাল ধরে এই বিছানায় শুয়ে আছে। বাইরে নিঃশব্দ রাতের শিশির ঝরছিল, ঘরের ভেতরে চাঁদের আলো। আর একটু একটু করে জামান কাছে টানছিল তাকে। আবেগের কথা বলছিল। জিজ্ঞেস করছিল দুটি একটি কথা- জবাবও দিচ্ছিল সে। জামান যখন বলল, তুমি খুশি হওনি? তখন রাখীর হঠাৎ কথা যোগায়নি মুখে। পরমুহূর্তে মনে হয়েছে, তার বলা উচিত সে খুশি হয়েছে। আর তাই উচ্চারণ করে জানিয়েছে সে। জামান কেবলি বলছিল সে ধন্য হয়ে গেছে। তার মতো ভাগ্যবান আর কেউ নেই। অনেক পাপের মধ্যথেকে সে উঠে এসেছে, অনেক গ্লানি থেকে তাকে মুক্ত হতে হয়েছে— তার অতীতে শুধুই পাপ আর অন্ধকার। রাখী যেন তাকে গ্রহণ করে। রাখী যেন তাকে ধরে রাখে।

জামানের কথার যে কী মানে, রাখীর বুঝবার ক্ষমতা নেই তখন। জামানের মুখ আর ঘনঘন নিশ্বাস তখন তার মুখের ওপর এসে পড়ছে। হাত এসে পড়েছে বুকের ওপর। জামান কাঁপা কাঁপা হাতে বোতাম, হুক, স্ট্র্যাপ সব খুলেছে একে একে। উত্তেজিত চুম্বনের মাঝখানে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়। তবু ঐ অবস্থার মধ্যেই রাখীর ক্ষণিকের জন্যে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়েছিল— এই কি চেয়েছিল জামান? তাকে এইভাবে কাছে পাওয়ার জন্যেই কি সে অমন অস্থির হয়ে উঠেছিল? কিন্তু জিজ্ঞাসা করা হয়নি। ঠিক ঐসময় রাখীর রক্তের ভেতরে যেন কলকল করে বান ডেকে ওঠে শরীরময় কী যেন ঝনঝন করে বাজতে থাকে সেতারের ঝালার মতো। বুকে, কোমরের নিচে, পিছনে, সর্বত্র জামানের হাত বিচরণ করছে তখন। আর থেকে থেকে রাখীর শরীর শিউরে শিউরে উঠছে। এবং সবার শেষ যখন বুকের হৃৎপিণ্ড বেসামাল, যখন রাখীর মুখেও অস্ফুট স্বর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, তখনই হঠাৎ একসময় রাখীর অনুভব হল, জামান তার শরীরের ভেতরে ঢুকে গেল। তার মনে হল, সে নিজেই যেন জামানকে গিলে ফেলেছে। সেই মুহূর্তে সে তীক্ষ্ণ আর তীব্র যন্ত্রণাটা তার মর্মমূলকে চিরে দুটুকরো করে দিল, রাখী সে যন্ত্রণার নাম জানে না।

এরই নাম তা হলে সম্ভোগ। শরীরের ভেতরে তাহলে এরকমই জোয়ার লুকানো থাকে। অনুভূতিতে আরেকটি নতুন জগতের সঙ্গে রাখীর পরিচয় ঘটল। আর কী ভয়ানক রাক্ষুসে এই লোভটা। শরীরটা কীরকম জানোয়ার। ভাবলে রাখীর অবাক লাগে। অল্প কয়েকদিনেই জামানের শরীর ভয়ানক আকর্ষণের বস্তু হয়ে উঠল তার কাছে। সেক্স যখন প্রথমে আসে তখন বোধহয় এরকমই তীব্র আকর্ষণ থাকে তার। আর সেই সময় নিজেকে গভীর পরিতৃপ্ত মনে হত রাখীর। শরীরময় গভীর আলস্য। দেহের অণুতে অণুতে ঘুম যেন জড়িয়ে জড়িয়ে থাকত। রাত-দিনের হিশেব পর্যন্ত রাখা যায় না-এমনই দিন সেসব।

আব্বা দেখতে এলে লজ্জার চেয়ে খুশি লেগেছে বেশি। নার্গিসের সঙ্গে দেখা হলে ওকে বলেছে, দ্যাখ্ বিয়ে করে ফ্যাল্। বিয়েটা ভারি মজার জিনিস। ঐসময় একটুখানি বেহায়াও হয়ে উঠতে পেরেছিল রাখী।

কিন্তু তারপর? তারপর কেমন যেন ফিকে হতে থাকল শরীরের সেই তীব্র তারের ঝনঝন। দেখত, বিছানায় শোয়ার আয়োজন করার জন্যে জামানের কী আকুল আগ্রহ। তার অনাবৃত শরীর দেখবার জন্যে কী দুরন্ত লোভ। বোতাম, হুক আর স্ট্রাপের ফাঁস খোলবার জন্যে কী অস্থির তার আঙুলগুলো। বুকের ওপর হাত রেখেছে যখন, যখন উত্তেজিত করার জন্যে চেষ্টা করছে, তখন রাখী লক্ষ করে দেখেছে জামানকে। জামান নয়, যেন অন্য কেউ, এ যেন কোনো অচেনা লোক। একেক সময় মনে হয়েছে, এরকমই হয়তো করত মাজহার খান। কিংবা সেই ছেলেটি, যার গালে একদা সে চড় মেরেছিল। যখন বিরক্তি প্রকাশ করে রাখী, তখন ভয়ানক করুণ চোখে তাকায় জামান। আর সেই দৃষ্টিও কেমন চেনা-চেনা মনে হয় তার। মাজহারের চোখে ছিল অমন দৃষ্টি। ঐরকম দৃষ্টি থাকে ভিখারিদের চোখে। জামান একেক দিন পাগল হয়ে উঠত। কী তীব্র চুমু খেত। মনে হত মুখ দিয়ে যেন রাখীর সমস্ত রক্ত চুষে নেবে। ঐরকম একদিন জামান যখন পাগলের মতো ভোগ করছিল, কঠিন মুঠোতে বুকের মাংস ডলছিল, সেই সময় রাখীর নজরে পড়েছিল জামানের হাতের মুঠো উপচে পড়া নিজের বুকের শাদা চামড়ার ওপর। সেখানে একটা টকটকে লাল দাগ ফুটে উঠতে দেখেছিল। আগে কখনো লক্ষ করেনি। সেদিনই কেমন করে যেন হঠাৎ তার নজরে পড়ে যায়। আর সঙ্গে সঙ্গে সে জামানের মুখের দিকে তাকিয়েছিল। চকিতে কী যেন দেখেছিল, সে বলতে পারবে না। শরীরের ভেতরে তখন উত্তেজনার জোয়ার নেমেছে। হঠাৎ সেই মুহূর্তে চোখ বুজে প্রাণপণে নিজের উত্তেজনাকে রুখতে চাইল সে।

জামান তখন ভয়ানক অধীর হয়ে উচ্চারণ করে চলেছে— আই’ভ নেভার ফাউন্ড এ মোর সুইটার বডি। ওহ্ হেভেন, ওহ্ গোল্ডেন ব্লিস! রাখী দাঁতে দাঁত চেপে ধরেছে তখন আর মনে-মনে বলছে, আমি নিজেকে ভাসাব না। নিজেকে ছেড়ে দেব না।

কিন্তু হায় শরীর! সেই মুহূর্তে কি শরীর কথা শোনে! মুহূর্তে জোয়ার ঠিকই উথলে উঠল। আর তখন রাখীর ভীষণ ইচ্ছে হল, জামানকে লাথি মেরে ফেলে দেয় বিছানা থেকে। শেষে, সেই মুহূর্তটিও পার হয়ে গেলে রাখী ক্লান্ত মনের ভেতর থেকে কালো কালো ঘেন্না উঠে আসতে আরম্ভ করল। না, দুঃখ-অপমান নয়, শুধু ঘেন্না।

নিজেকে কেমন ঘেন্না হল তার!

উন্মথিত সময়ের সেইসব দিন-রাত্রি। জামান তাকে খুশি করবার জন্যে যখন-তখন একসঙ্গে বাইরে বেরুচ্ছে। ফিলিম দেখছে, রেস্তরাঁয় যাচ্ছে। জোছনা রাতে হেঁটে বেড়াচ্ছে য়ুনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের রাস্তায় রাস্তায়।

রাখী কোনো ব্যাপারে ‘না’ বলছে না। তাছাড়া ‘না’ বলার কোনো অর্থও তো হয় না। কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। ঐরকমই তো হয় সবার জীবনে। এমনই তো করে সবাই। একেই বোধহয় বলে সুখী হওয়া। এছাড়া রাখীর জীবনে অন্যকিছু আর কী হতে পারত।

বলে, বোঝে, নিজেকে বোঝায়। কিন্তু তবু রাতে বিছানায় স্বামীর সঙ্গে শোবার চরম মুহূর্তটিতে মনের কোনো গর্ত থেকে যেন লাফিয়ে ওঠে ঘেন্নার সাপ।

আর সেই থেকে রাখী মনের ভেতরকার সেই পুরনো খোলসে ঢুকতে লাগল। সংসারের কাজ, রান্নাবান্না, কাপড়ের হিশেব, ঝি-চাকরের ওপর খবরদারি, সবই চলল। এমনকি প্রতিবেশীরা কেউ এলে মুখের হাসিটুকু যেমন ফুটিয়ে তোলা দরকার সেটুকু পর্যন্ত হল। কিন্তু তবু রাখী যেন আর খোলামেলা থাকতে পারে না। কোথায় যেন সে ক্রমেই আড়াল হচ্ছে। জামান ওদিকে থেকে-থেকেই বলে, জানো রাখী, আমার মতো সুখী কেউ কখনো হয়নি। রাখী শোনে, কথাগুলো যেন ছোঁয় না তাকে। জামানের ওপর কেমন মায়া হয় একেক দিন। তখন হেসে একটুখানি ঠাট্টার কথা বলে— সেই পুরনো মেয়েলি কথা। বলে, অন্য কাউকে বিয়ে করলেও তুমি এই কথাই বলতে না? যদি নার্গিসের সঙ্গে বিয়ে হত তোমার? ঠিক এইরকম সময় যাচ্ছে যখন রাখীর, তখনই সেদিন নিউমার্কেটের সামনে বুবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বুবুকে দেখে যেন রাখী নিজেকে ভালো করে দেখতে পেল। বুবুর না বড় সুখ ছিল! সবাই বুবুকে সুখী দেখত। বুবুর সেই সুখের চেহারাটা এখন কোথায়? বুবুর মুখের দিকে তাকিয়ে রাখী সেদিন স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল, বুবু যেন সবকিছু পেছনে ফেলে বেরিয়ে এসেছে। নিজেকে হারিয়ে ফেলে বসে আছে, কে জানে কোন্ সর্বনাশের মুখে গিয়ে এখন পড়বে। বুবুর মুখে সেদিন এইসব দেখেছিল রাখী। দেখেছিল আর বুকের ভেতরে কেমন একটা ভয় দুরুদুরু কেঁপে উঠেছিল ঐ মুহূর্তে।

হ্যাঁ, ঐ এক ভয়, অচেনা অজানা ভয় থেকে-থেকে চমকে উঠতে থাকে মনের ভেতরে।

জামান কন্ট্রাসেপটিভের পক্ষপাতী। প্রত্যেক মাসে কৌটোভর্তি ওষুধের পিল নিয়ে আসত। হিশেব করে করে খেতে বলত। ক্যালেন্ডারের চৌকো ঘরে লাল লাল দাগ দিয়ে কিসের যেন হিশেব রাখত। রাখী আপত্তি করেনি কিছুতে। ভাবত, বেশ তো, জামান যখন বলছে, তখন বাচ্চা নাই-বা এল কিছুদিন।

কিন্তু ঐ যে ভয়, কালো কালো ঘেন্নার ভয়। অচেনা, কারণহীন ঘেন্না আর অজানা পরিচয়হীন ভয়— সেটা তো মন থেকে মুছল না। আর এইরকম সময়েই একদিন যেন রাখীর হঠাৎ মনে হল, সে বদলে যাচ্ছে। কিছু হিশেব করে নয়। হঠাৎ মনে হল একদিন। হিশেব করতে হল তখন। শেষে বোঝা গেল, চিন্তাটা একেবারে অমূলক নয়। মাস শেষ, কিন্তু কৌটোর মধ্যে তখনো তিন-চারটে পিল পড়ে রয়েছে। বাড়তি পিল ক’টা দেখে সে কিছুটা নিশ্চিত বোধ করল। যাক, এবারে তাহলে মা হতে যাচ্ছে সে।

ঐরকম নিশ্চিত বোধ করার পর রাখী যেন আরেক ধাপ ডুবল নিজের মধ্যে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *