ত্রয়ী উপন্যাস -প্ৰথম পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - দ্বিতীয় পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - তৃতীয় পৰ্ব

কুলায় কালস্রোত – ১২

বারো

নার্গিস ক্লাব থেকে বেরুবে বলে মনে-মনে তৈরি হচ্ছিল। মাজহার সেই যে বসিয়ে রেখে গিয়েছে, তারপর আর পাত্তা নেই। মিসেস হাসানের সঙ্গে কী একটা কথা হল, তারপরই দুজনে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় বলে গেল, তুম জরা সা ঠারো হানি, ময় আবভি আয়া। তখন থেকে সে বসেই আছে। এসেই যে গেল আর খবর নেই! মিসেস হাসানকে পৌঁছে দিতে যাবার অত তাড়া কেন হয়েছিল, নার্গিস একেবারে বোঝেনি তা নয়। মাজহার কিছুদিন ধরেই বিলকিস হাসানকে লক্ষ করছে। আগে একসময় ভাবী বলে ডাকত, এখন আর সে পাট নেই। একদিন বলেও ফেলেছে-ও গড শি হ্যাজ এ টেরিল ফিগার।

মাজহারের ঐ এক ব্যারাম। নতুন মেয়েমানুষ দেখলে আর রক্ষে নেই। ব্যারামটা ছিল আগে থেকেই, কিন্তু সম্প্রতি বেশ বেড়েছে। তবে ও নিয়ে নার্গিস মাথা ঘামায় না, বিশেষত বিলকিস হাসানের ব্যাপার যেখানে। অন্য কেউ হলে কথা ছিল। কিন্তু বিলকিসকে তো সে চেনে, ফিগার যতই ভালো হোক, যতই স্মার্ট হতে চেষ্টা করুক, আসলে সে তো রাখীরই বোন। গিন্নি গিন্নি টাইপের মেয়ে ছিল- হঠাৎ কে জানে কেন রাতারাতি মডার্ন হবার জন্যে পাল্লা জুড়ে দিল। সম্ভবত হাসানের জন্যেই বেচারাকে অমন হতে হয়েছে। কিন্তু ও তো জানে না, স্বামীটি তার আসলে কী জিনিস। এমন ধুরন্ধরও মানুষ হতে পারে! নার্গিস ভেবে থই পায় না, কেমন করে পারে লোকটা অত। দেখতে দেখতে য্যাকব্‌স অ্যান্ড ওয়াল্টারের সঙ্গে জুটে গেল। পঞ্চাশ লাখ টাকার কাজ, কাপ্তাই এলাকায় পঞ্চাশ মাইল হাইওয়ে গড়বে। ঢাকায় লোকের কানে খবরটা পৌঁছবার আগেই তার কাজ বাগানো সারা। কী লোক কী হয়ে উঠছে দ্যাখো। সেই হাসান, পরনে শাদা জিনের ট্রাউজার্স, শাদা পপলিনের হাফশার্ট আর পায়ে কাবলি স্যান্ডেল থাকত। জিপে করে রাখীকে একেক দিন য়ুনিভার্সিটি পৌছে দিত। এখন সেই লোকের দ্যাখো তিনটে বাঘা বাঘা ফার্মে পার্টনারশিপ। সে এখন ধাঁ ধাঁ করে ওপরে উঠছে। মাজহারকে টোপ গিলিয়ে একটা পার্টনারশিপ করে নতুন ব্যবসা আরম্ভ করেছে— ক’দিন মাজহারের সঙ্গে একেবারে গলায় গলায় লেপ্টে রইল। দলিল সই হবার পর হাসানকে আর পাওয়া যায় না। শোনা যাচ্ছে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের ক্ষমতায় সে এখন মাজহারের টাকা ঢালছে য্যাকব্‌স অ্যান্ড ওয়াল্টারের কাজে। নতুন কোম্পানি হয়েছে ঢাকায়- ওয়াল্টার য্যাকব্‌স অ্যান্ড হাসান কর্পোরেশন। মাজহার কিছু বলতেও পারে না। কেননা তার কাজ এগোচ্ছে খুব ধীরে ধীরে। এখনও কাগজপত্রই তৈরি হয়নি সব। বর্ষা ফুরিয়ে সেই শীতের মাঝামাঝি আসল কাজে হাত দেবে। সুতরাং এত তাড়া কিসের? ঐ এককথাতেই মাজহারের মুখ বন্ধ হয়ে আছে। অথচ এদিকে দেখতে হচ্ছে, মাজহারের দেয়া টাকার ওপর চেকের পর চেক কেটে যাচ্ছে হাসান। বেচারা ক্ষুব্ধ হয়, কিন্তু কোনো উপায় নেই। একেক দিন দুঃখ চেপে রাখতে পারে না। সেদিন নেশার ঘোরে বলেই ফেলল, দ্যাট সন অফ এ বিচ ড্রেইনিং মাই মানি, এবার আর কান্টিনেন্ট যাওয়া হচ্ছে না ডার্লিং।

ঐ হাসানের ব্যাপারটা আসলে কী সেটা জানবার জন্যেই সে বিলকিসের সঙ্গে খাতির জমাতে চায়। হাসান এমন নিভাঁজ ভদ্রলোকের মতো ব্যবহার করে যে বেচারা মুখোমুখি কিছু বলতে পারে না। বলতে পারে না, আবার সইতেও পারে না।

তবে একেবারে নিঃসন্দেহ নয় সে। শুধু হাসানের মতলব আঁচ করার জন্যেই বিলকিসকে পৌঁছে দিতে গেল মাজহার, এমন তার মনে হয় না। মাজহারের একটা জেলাসি আছে বিলকিসের ওপর। তার স্পষ্ট মনে আছে, একদিন বলেছিল, য়ু নো হানি, দ্যাট বিচ, দ্যাট রোকেয়া রাশেদ হ্যাড লেট মি ডাউন— যখনই ওদের কাউকে দেখি, ম্যায় ভুল নেহি সকতা, দেখনা এক রোজ, ম্যায় পুরা উসুল কর লুঙ্গা। বিলকিস ইয়া পারভিন, যো ভি হো- তুম দেখ লেনা- আই’ল ট্রিট দেম লাইক পেইড হোরস।

নার্গিস এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে সময় পার করে নিচ্ছিল। তারপর একসময় বিরক্তি লাগাতে আরম্ভ করল সবকিছুতে। ভাবল, আর না, এবার ওঠা যাক।

কিন্তু উঠতেও সাহস হচ্ছিল না ওর। কে জানে বাপু মাজহার আবার রাগে ফুলতে আরম্ভ না করে। একটুতেই আজকাল রেগে যায়। সেদিন তো বলেই ফেলল, হানি, জামানের সঙ্গে তোমার মেলামেশাটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে- আই ডোন্ট লাইক দ্যাট পিগ। বিয়েটা হয়ে গেলে এখন সে বাঁচে। বিয়ের কথা মনে হলেই নার্গিস আজকাল বিমনা হয়ে যায়। বিয়ে ব্যাপারটা যে এমনি জটিল, কল্পনাও করেনি সে। সে নিশ্চিত ছিল, সিরাজ, কায়সার নয়তো শাফায়াত- তিনজনের একজন কেউ হবে। কিন্তু কীরকম মিন সবগুলো। এত ইনিয়ে-বিনিয়ে প্রেম, এত এত চিঠি, সব বেমালুম ভুলে গিয়ে একেকজন টপাটপ বিয়ে করে ফেলল। সে জানতেও পারল না! এদিকে শরীফ যে আমেরিকা থেকে কবে ফিরবে, তারও ঠিক নেই কিছু। কে জানে, ওখানেই সে কারো সঙ্গে লটকে গেল কি না।

নার্গিস ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিল অবস্থাটা দেখে। সে কল্পনাও করতে পারেনি, এরকম একটা পরিস্থিতি তার জীবনেও আসবে। আয়নার সামনে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিজের চেহারা দেখেছে বারবার। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করেছে শরীর, মুখ, চোখের কোল। দেখে নিজেকে আশ্বস্ত করবে চেষ্টা করেছে, না এখনো সময় বয়ে যায়নি— শরীর এখনো অনেকদিন তাকে ঠকাতে পারবে না। তবু খারাপ লাগে। কী ভাগ্যি যে চাকরিটা নিয়েছিল সে। মাজহারের সঙ্গে পরিচয় না হলে কী যে হত, সে ভাবতেও পারে না। অবশ্যি জামানও কিছুটা আকর্ষণ করেছিল। বউকে তাড়িয়ে দেবে বলে মনেও হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল, লোকটা যেমন লোভী তেমনি ভিতু। তার চেয়ে মাজহার কত ভালো। মাজহারকে সে ছাড়ছে না। যেমন করে হোক, শেষপর্যন্ত সে দেখবে।

কিন্তু না হলে?

ধক করে ওঠে বুকের ভেতরে। মাজহার যদি ফস্কে যায় তাহলে কী করবে সে? নাকি আবার জামানের কাছে যেতে হবে তাকে। যার লোভ প্রচুর কিন্তু ভালোমানুষ হবার জন্য উৎসাহেরও অন্ত নেই, মেয়েমানুষের সঙ্গে শেয়ার পর যার চোখমুখ ক্লিষ্ট হয়ে ওঠে— সেই জামানকেই কি তাহলে শেষপর্যন্ত ধরতে হবে?

এইসব ভাবনায় পড়লে নার্গিস দিশেহারা হয়ে যায়। একেক দিন ভীষণ ভয় লাগে। চারদিকের সবকিছু কেমন জটিল হয়ে যাচ্ছে। মনে হয় সবকিছুই যেন গলে চলে যাচ্ছে হাতের নাগালের বাইরে, কিছুই ধরে রাখা যাবে না। চারদিকের সবকিছু অনিশ্চিত।

ঘণ্টাখানেকের ওপর বসে থাকার পর সে উঠল, আর নয়, এবার যাওয়া দরকার। উঠতে যাবে, এমন সময় দেখল, কায়সার আসছে জামানের সঙ্গে। জামান নার্গিসকে দেখে হাসতে চেষ্টা করে, কী খবর, একা যে?

হ্যাঁ একাই, দোকা কোথায় পাব?

কায়সার মাথা নিচু করে বলে, অলওয়েজ অ্যাট ইয়োর সার্ভিস ম্যাডাম, ইফ য়ু উইশ—

নার্গিস হাসে না এই রসিকতায়। জামান কাছাকাছি থাকলে আজকাল ও সহজ হতে পারে না।

কায়সার হঠাৎ অন্যস্বরে ডাকে, নার্গিস!

নার্গিস মুখোমুখি তাকায়।

একটা কথা বলব?

একটা কেন, একশোটা বলতে পারেন।

থ্যাঙ্ক য়ু ভাই, প্রমিজ, রাগ করবে না?

রাগ কেন করব, কী বলছেন আপনি- নার্গিস ঈষৎ বিব্রত হয় কায়সারের অমন বিনয়ে।

আমার মনে হয়, মাজহার ইজ এ লস্ট কেস- তুমি এখন পথ দেখতে পারো।

কী বলছেন আপনি? নার্গিসের রাগ হয়। বলে, আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে-

আহা, এইতো রাগ করে ফেললে। কায়সার হেসে ওঠে। বলে, য়া বলতে ইচ্ছে হল, বললাম, তোমার ভালোর জন্যেই বললাম- যা ভবিষ্যতে দেখতে পাচ্ছি, ওয়েলউইশার হিসেবে বলব না? য়ু নীড এ ম্যান হু আর্নস এনাফ অ্যান্ড হু’জ় ওবিডিয়েন্ট— কিন্তু মাজহারকে দিয়ে ঐ শেষের কম্মোটি কক্ষনো হবে না।

নার্গিস উঠে পড়েছিল, সে আর দাঁড়াল না। বলল, মাতালের প্রলাপ শোনার মতো সময় নেই আমার। বলেই সে বেরিয়ে এল। নার্গিসের পেছনে পেছনে জামানও বেরিয়ে গেলে কায়সার পেছন থেকে হা হা করে মাতালের হাসি হেসে উঠল

পারভিন আর হাসান এল একটু পরে। হাসান বুলুর খোঁজ করল।

বেয়ারাকে ডাকল, মিসেস হাসান নেই?

জি না, উনি চলে গেছেন অনেকক্ষণ হল।

সঙ্গে কেউ ছিল? কোথায় গেছেন জানো?

কোথায় গেলেন, বললেন না কিছু, তবে মাজহার সাহেবের সঙ্গে বেরুতে দেখেছি।

নার্গিস ছিলেন না? পারভিন জিজ্ঞেস করে।

জি ছিলেন, এইমাত্র চলে গেলেন।

বোঝো তাহলে, হাসান মুখোমুখি হয় পারভিনের। বলে, কীরকম দায়িত্ববোধ সেটাই দ্যাখো। মাজহারের সঙ্গে ভেগেছে, একটু দেরি সইল না। আমরা তো এসেই যাচ্ছিলাম।

একটু থেমে আবার বলে, মাজহার কীরকম লোক তা তো জানো, তুমি না বলো, বুলু খুব ভালো, ফ্লার্ট করতে পারবে না কখনো— এসব ও করছে আমার জন্যে- ও নাকি দারুণ ইনোসেন্ট- বলতে তো এসব। দ্যাখো এখন নিজের চোখে, নিজের কানে শুনে রাখো। হয়তো কালই খবর পাব, মাজহারের কাছে ও আমার সব গুমোর ফাঁক করে দিয়েছে। তুমি তো জানো না, ও কীরকম জটিল মেয়ে। ওরকম পারভার্ট আর জটিল মেয়েকে নিয়ে সংসার করা যায়? তুমিই বলো?

কী বলবে পারভিন, সে কি জানে? এসব ব্যাপার আজকাল দারুণ ক্লান্তিকর লাগে তার। কেবলি ভয়ানক অর্থহীন একটা শূন্যতা যেন দুলতে থাকে চোখের সম্মুখে। এতক্ষণ সে য্যাকব্‌স অ্যান্ড ওয়াল্টারের চিফ এঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে ডিনারে ছিল। একটু একটু করে খাবার তুলছিল মুখে। মিসেস সোহেল বাইরুটের গল্প বলছিলেন— তাই শুনছিল পারভিন। ওদিকে বিলি থর্নডাইক রাজনীতির কথা বলছিল। বলছিল, য়ু মাস্ট গিভ এ চান্স টু ইয়োর পিপ্‌ল। ইয়োর মুজিব হ্যাজ এ গ্রেট চান্স। কিন্তু একটা কথা, ন্যাশনাল ইন্ট্রেগ্রিটি যদি না রাখতে পারো, তাহলে কিন্তু মারা পড়বে- ঝগড়া করো, নিজের পাওনা আদায় করো, বাট ডোন্ট ফাইট। তাহলেই কিন্তু মরবে। য়ু হ্যাভ রিসোর্সেস, অ্যান্ড য়ু মাস্ট ইয়ুজ দোজ ফর ইয়োর পিপ্‌ল— হোয়াই ডু য়ু অ্যালাউ দিজ পাঞ্জাবিজ। দে আর গ্র্যাবিং এভরিথিং— হোয়াই, আই ওয়ান্ডার, ইট ডাজন্ট মেক এনি সেন্স।

হাসান থেকে-থেকে মাথা নাড়াচ্ছিল। আসলে তো নজর তার টনি হাওয়ার্ডের ওপর। সে ও. কে. করলেই- হাসানের সামনে এগোবার রাস্তা একেবারে খোলা। টনি সাইটে ঘুরে এসেছে। আসা অবধি তার নানা ধানাই পানাই। বলছে, কংক্রিট ভেঙে দেখব আমি, কীরকম লোহা দিয়েছ— চীপস্-এর কী দশা তাও দেখা দরকার, য্যাকব্‌স অ্যান্ড ওয়াল্টারের নাম এত সস্তা নয়।

আজ ঐসব কাজের প্রসঙ্গে আলাপে আসতেই দেয়া হচ্ছে না। বিলি রাজনীতির গল্প করছিল, ওদিকে রায়হানের শালা সাজ্জাদ থেকে-থেকে ফিলিমের কথা বলছিল। পারভিন বুঝতে পারছিল না কীভাবে আরম্ভ করবে। আগে একদিন টনি রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে কৌতূহল দেখিয়েছিল। আজকে সেই লোক কথাই বলছে না। থেকে-থেকে খালি হাসছে। অবশেষে মরিয়া হয়ে হাসানই আরম্ভ করল, টনি য়ু ওয়ান্টেড টু নো অ্যাবাউট ট্যাগোর পেইন্টিংস। ডিডিন্ট য়ু?

পারভিন নড়েচড়ে বসল, এবার তার পালা— সে তৈরি হল মনে-মনে। কী বলতে হবে তার জানা। দেয়ার আর এলিমেন্টস অফ ভায়োলেন্স অ্যান্ড ডার্কনেস্ উয়িথ ডিসটরশন অব ফর্মস-

টনি, কে জানে কেন, হঠাৎ হেসে ফেলল। একবার পারভিনের দিকে তারপর হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল, অলরাইট হাসান, আই’ল মেক দ্যাট ও. কে. ফর য়ু- ফরগেট দ্যাট ননসেন্স।

ঘাম ছুটে গিয়েছিল একেবারে। লোকটা শেষে করুণা করল। তা করুক, কাজ নিয়ে কথা। হাসান থ্যাংক য়ু থ্যাংক য়ু- বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলল একবারে।

তা ওদিকটা এইভাবে সামাল দিয়ে তবে আসতে হয়েছে। বুলুর ওপর শুধু এইটুকু দায়িত্ব ছিল যে সে যেন মাজহারকে ক্লাবে কিছুক্ষণ আটকে রাখে। শুধু এইটুকু জানানো যে হাসান এক্ষুনি আসছে, ঐজন্যেই বুলুর অপেক্ষা করার কথা।

কিন্তু ব্যাপারটা গোলমাল হয়ে গেল। কোথায় পারভিন ভাবছিল বুলু আপাকে সারপ্রাইজ দিয়ে বলবে, কী নেবে বলো বুলু আপা, হাসান ভাই আজ দারুণ খুশি।

কিন্তু সব উল্টেপাল্টে গেল। কেন যে হয় এমন!

দখো তুমি ভিনু, ও আমাকে ডোবাবে। ভীষণ জেদি মেয়ে ও। গুষ্টিসুদ্ধই ঐরকম— একটা তো মরে আপদ বিদায় হয়েছে, আরেকটা দেখছ না, একটা রাসকেলকে বিয়ে করে এখন কেমন পস্তাচ্ছে- শুনছি এখন নাকি আবার একটা পলিটিক্যাল গুণ্ডাকে নিয়ে মেতে উঠেছে। দ্যাখো তুমি, বুলুরও কপালে দুঃখ আছে, ও তো ডুববেই, আমাকেও ডোবাবে।

পারভিন কিছু বলে না। কিছুই বলার নেই তার। যেখানে সে জড়িয়ে পড়েছে সেখান থেকে কিছু বলা যায় না। কাউকে কিছু বলতে পারছে না সে। বলতে পারত— হ্যাঁ সেদিন, যেদিন ব্যাগের মধ্যে কিছু কাগজ ঘাঁটতে দেখেছিল রাখী আপাকে! বলতে পারত, যাও তুমি রাখী আপা, বুবু কামরান ইলাহীর সঙ্গে বাইরে যাচ্ছে, তুমি বুবুকে ফেরাও। বলতে পারত, কিন্তু বলেনি। কী ভাষায় বলবে, কেমন করে বললে— বললে রাখী আপা বিশ্বাস করবে কেন।

বসবে কিছুক্ষণ, একটা কিছু দিক? বেয়ারাকে ডাকি। হাসান প্রস্তাব করে। না, পারভিন বলে, চলুন বাড়ি ফেরা যাক, আর না, অনেক রাত হয়েছে। পারভিনের মনে হচ্ছিল, অনিবার্য বিপর্যয়টাকে বোধহয় আর এড়ানো যাবে না। এখনো কোথায় যেন একটা বাঁধন আছে— ক্ষীণ একটা বাঁধন, যা সবকিছু ছাত্রখান হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে।

এতসব আগে কখনো ভাবেনি। কিন্তু আজকাল এইসব চিন্তা হচ্ছে তার। আগে বুলু আপার ঘরকুনো স্বভাব দেখে খারাপ লাগত। ভাবত, বুলু আপাটা বোকা, নিজের সুখ সে পায়ে ঠেলছে। কিন্তু এখন? যখন বুলু আপা হাসান ভাইয়ের সঙ্গে সমান তালে পা ফেলতে চাইছে- এই এখন? কী মনে হয়? এখন তো দেখছে সে আগের ব্যবস্থাটাই ভালো ছিল। বাইরে বেরুনোতে লাভটা কী হয়েছে বুলু আপার? পারভিন মনে-মনে হিশেব করে। তার মনে হত, বুলু আপা স্বামীকে সাহায্য করছে— তার বেশি কিছু নয়। কিন্তু এখন স্বামীকে তার ঐ সাহায্যদান কোথায় এনে ফেলেছে তাকে? স্বামীর জন্যে পথে নেমে স্বামীকে তো পেলই না, মাঝখান থেকে এখন নিজেকেই হারিয়ে ফেলবে কিনা কে জানে। বড় কষ্ট হয় পারভিনের।

ভিনু-

হাসান ডাকল একসময়, আজকাল ঐ নতুন নামে ডাকে সে।

কী?

আমি কিছুদিন থেকেই একটা কথা সিরিয়াসলি ভাবছি, হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে গাড়ি থামায় হাসান। বলে, ইট্স টুমাচ— লাইফ আমার হেল হয়ে উঠেছে।

পারভিন বিমূঢ়— ভাবতে পর্যন্ত পারছে না সে। তাহলে সেটাই ঘটতে যাচ্ছে? যে ব্যাপারটা সে এড়িয়ে যেতে চেয়েছে, সেই ব্যাপারটাই কি সাপের মতো ফণা তুলে এখন পথ আগলে দাঁড়াবে? বুঝতে পারে না পারভিন। শুধু ভয় লাগে, কেরলি ভয় কেঁপে কেঁপে উঠতে চায় মনের ভেতরে।

জানো ভিনু, আমার মনে হয়,ও আমার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে পারবে না-

কেন বলছেন ও কথা, পারভিন বাধা না দিয়ে পারে না। বলে বুলুআপা দিব্যি বাইরে বেরুচ্ছে, আগের মতো ঘরকুনো তো আর নেই।

আরে সেই কথাই তো বলছি আমি। বাইরে বেরিয়ে তো বিপদ হয়েছে। এত খারাপ লাগে যখন ও হাত বাড়িয়ে কোনো লোকের সঙ্গে কথা বলার জন্যে এগিয়ে যায়। দেখেছ তুমি? মনে হয় পয়সার জন্য যেন বাজে মেয়েমানুষ খদ্দেরকে আপ্যায়ন করছে।

ও আপনার দেখার ভুল।

ও দেখার ভুল নয়। ও সত্যি সত্যি নিজেকে এখন তাইই মনে করে। হাসান জানায়, স্যাডিস্ট হলে ওরকম হয়, আমাকে অপমান করে ও আনন্দ পায়। ভীষণ জেদি মেয়ে ও, সেই গোড়া থেকেই, নইলে বোঝো, বাপ- ভাই-বোন কোনোকিছুর দিকে না-তাকিয়ে আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, তখন কত বয়স ওর? ওর সঙ্গে সংসার করা অসম্ভব, তো আমার মান- সম্মান বলে একটা জিনিস আছে।

পারভিন বলবে না কিছু। কিছু বলা সাজে না তার। শুধু বলল, চলুন ফিরি আর দেরি নয়।

আমি যে-কথাটা বলতে চাইছিলাম, ইগনিশন চাবিতে হাত দিয়েও চাবি ঘোরায় না হাসান। বলে, ওর সঙ্গে আমি একটা বোঝাপড়া করতে চাই। কাঁপল কি পারভিন? কে জানে। পারভিন জানত একথা হাসান ভাই একদিন বলবে। জানত বলেই হয়তো কাঁপল কোথাও বুকের ভেতরে। শুধু এইটুকুই নয়, এর পরেরটুকুও তার জানা।

তবে সত্যি সত্যি যে হাসান সেটুকুও বলে ফেলবে সে ধারণা করেনি- অন্তত এত শিগগির সে কল্পনা করেনি। হাসান বলল, ওকে ডিভোর্স আমি করবই, তবে তার আগে আমি তোমার কথা চাই— কথা চাই আমাকে বিয়ে করতে তোমার আপত্তি নেই।

পারভিন চুপ করেছিল। কী বলবে ভাবছিল। হাসান তাগিদ দিল, কই কিছু বলো তুমি?

পারভিনকে হাসতে হল। সে যেন জানত ঐ কথার জবাবে তাকে একটুখানি হাসতে হবে প্রথমে। সে হাসিমুখে কৌতুকের স্বর ফোটাল একটুখানি। বলল, আপনার জবাব কি সঙ্গে সঙ্গে দেয়া যায়? আমাকে ভাববার সময় দিন।

হাসান খুশি হয়ে, না আশ্বস্ত হয়ে, নাকি নিশ্চিত হয়ে— বোঝা গেল না ঠিক— ইগনিশন ঢাবি ঘোরাল। মৃদু গর্জন করে উঠল মার্সিডিস। তারপর প্রায় মধ্যরাতের নির্জন রাস্তার ওপর দিয়ে মেঘলা আকাশে দুটি-একটি তারা দেখতে দেখতে বাসায় ফিরল দুজনে।

বুলু তখনও সোফায় বসে ঝিমুচ্ছিল। ঘোরটা কাটছে না তখনও। মদ এখনো রপ্ত করে উঠতে পারেনি সে, টিস্যুপেপার হাতেই রয়ে গেছে, এখনো লিপস্টিক পুরো ঘষে তোলেনি। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়তে পারে কিন্তু শোবার ইচ্ছেটাকে দমন করে রেখেছে সে। শোবে সে, কিন্তু একাকী নয়, হাসানকে নিয়েই শোবে।

এই এক অদ্ভুত মানসিক অবস্থায় তাকে পেয়ে বসে আজকাল। কেন যে, বুলু খুঁজে দেখতে চায় না। ব্যাপারটা বোধহয় সেইদিন প্রথম হয়েছিল, যেদিন কামরানের সঙ্গে হোটেলে মদ্যপানের পর হাসান বুলুকে রেখে কাজের ছুতোয় বেরিয়ে যায়। যাবার সময় শুধু কানের কাছে বলে গিয়েছিল, কামরানকে চটিও না, ওর হাতে আমার জীবনকাঠি মরণকাঠি- যেভাবে হোক ম্যানেজ করো- ওকে আমার ভীষণ দরকার।

বুলু কিছু বলেনি। শুধু আঁচ করেছিল। কিন্তু আগের দিনের পারভিন আর হাসানের নিবিড় সান্নিধ্যের দৃশ্যটা তখনও মনের ভেতরে জ্বলজ্বল করছিল। সে দাঁতে দাঁত চেপে জানিয়েছিল, ঠিক আছে, দেখব আমি, তুমি কিন্তু দেরি কোরো না।

না, দেরি করেনি কামরান, বোধহয় ঐরকম পরিস্থিতিতে সে খুবই অভ্যস্ত। গায়ে হাত দেবার সময় বুলু পাথরের মতো শক্ত হয়ে উঠেছিল। কামরান গ্রাহ্য করেনি। বুলু মনের ভেতরে কেঁদেছিল কি না জানে না। শুধু মনে হয়েছিল, সে নয়, কামরান যার দেহভোগ করছে সে বুলু নয়, সে অন্য কেউ। অন্য কারো শরীরের ওপর থাবা বসাচ্ছে— অন্য কারুর শরীর এবং মন ছিন্নভিন্ন হচ্ছে। তখন তার যন্ত্রণা হচ্ছে, কান্না পাচ্ছে, কেউ যেন মাথা কুটে মরে যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে, কিন্তু তবু তার মুখে কিছুই ছিল না- ঘৃণা না, ক্ষোভ না, অপমান না, কান্না না— কিছুই ছিল না তার চেহারায়। সে যেন নির্বিকার দর্শকমাত্ৰ।

কিন্তু তারপর রাতে, সেই রাতেই বুলু যেন খেপে উঠেছিল। সাফল্যের আনন্দে হাসান যখন তাকে আদর করছিল তখন সে হাসানকে ছাড়েনি। জীবনে বোধহয় সেই প্রথম সে স্বামীর কাছ থেকে সেক্স আদায় করে নিয়েছে।

সেই থেকে যতবার কেউ তার শরীরে হাত দিয়েছে, ততবার হ্যাঁ, গুনে গুনে ঠিক ততবার সে হাসানকে বাধ্য করেছে তার শরীর গ্রহণ করতে।

মাজহার তার শরীরে আজ ইচ্ছেমতো হাত দিয়ে গেল। হ্যাঁ, আদর করছিল তাকে, হাসানের গোপন খবরটা জানবার জন্যেই অমন করছিল লোকটা। শুধু বিছানায় শোয়নি, হয়তো শুত, কিন্তু যেই শুনল হাসান য্যাকব্‌স ওয়াল্টারের চিফ এঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে ডিনার খাচ্ছে, অমনি সে পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে গেল। আর সেজন্যেই এই মাঝরাত পর্যন্ত বুলুকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। হাসানই তো মাজহারকে সামাল দিয়ে রাখতে বলেছিল। যার সূচনা করেছে হাসান তার প্রতিটি পর্যায় তারই তো শেষ করা উচিত।

বুলু ঘোর-ঘোর অবস্থায় শুনতে পেল, হাসান পারভিনের ঘরে ঢুকছে। আর তখন, ঐ অবস্থায়, ঐরকম এলোমেলো কাপড়ে সে ভেজানো দরজা খুলে একেবারে দুজনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

যাও তুমি, আমি ঘরে আসছি, হাসান বলে।

না, তুমি যাবে না, তুমি পারভিনের সঙ্গে শুতে যাচ্ছ, আমি জানি।

আহ, কী ছেলেমানুষি হচ্ছে, ঘরে যাও, হাসান হুকুম করে।

না, যাব না, কেন যাব— একটু আদুরে গলায় বলে, আচ্ছা পারভিন কি বেশি আরাম দেয় তোমাকে, বলো না গো!

বুলুর ঐরকম কথা শুনে পারভিনের ভয় হয়। সে অস্ফুট চিৎকার করে ওঠে, বুলু আপা!

বুলু হাসে, না রে, আমি চিৎকার করব না। চিৎকার করলে আব্বা আর রাখী জেগে উঠবে। রাখীকে ভয় নেই, সেও কি কম যায় আমাদের থেকে? শুধু আব্বা জেগে উঠবেন, চেঁচামেচি করবেন— এটাই ভয়। সেজন্যেই আমি চিৎকার করব না। আমি শুধু হাসানকে নিতে এসেছি, আমাদের কতদিনের বিয়ে, চিন্তা করে দ্যাখো, আচ্ছা, সেসব দিন তোমার মনে পড়ে না হাসান?

হাসান রেগে উঠলেও রাগারাগি করতে পারে না। শুধু চাপা গলায় বলে, খুব মদ গিলেছ তুমি। পাগলামি কোরো না, যাও লক্ষ্মীটি, ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো, তোমার আব্বা জেগে উঠবেন

বুলু হাসে খিলখিল করে। আব্বাকে কিন্তু ভয় করা উচিত নয় তোমার- আর আব্বা জেগে উঠলেও তোমাকে কিছু বলবেন না, প্লিজ চলো, আর দেরি করতে পারছি না।

বুলুর নেশা ছিল হয়তো— তবু তার বুকের ভেতরে ভয়ানক কষ্ট হচ্ছিল- অপমান, কান্না, প্রতিশোধ, ঘেন্না সব একসঙ্গে মথিত করছিল তাকে। কিন্তু তবু লজ্জা, ভয়, হতাশা, পরাজয় সবকিছু একাকার করে সে হাসছিল আর ভারী চোখে তাকিয়ে দেখছিল স্বামীর দিকে। থেমে থেমে বলছিল, রাতে তুমি বিছানায় না থাকলে আমার যে ঘুম হয় না, বলো আমি কী করব? ঠিক আছে, এখন চলো, আমি ঘুমিয়ে পড়লে তখন নাহয় আবার চলে এসো পারভিনের কাছে, প্লিজ এখন চলো— পারভিন, বলে দে ভাই, বলে দে, শেষরাতে তোর কাছে আসতে।

পারভিন তখন দাঁতে দাঁত চেপে আছে। ঘেন্না হচ্ছে তার। জীবনের এ কোন চেহারা দেখতে পাচ্ছে সে?

বুলুআপা হাসানকে ঘর থেকে নিয়ে চলে যাবার পরও সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। সে না ভেবেছিল, জীবনের আনন্দ আর উল্লাসটাকে গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ— সে না ভেবেছিল, নিজেকে লুকিয়ে রাখাটা বোকামি। কিন্তু এখন? এখন কী করবে সে? হাসান ভাই বুলুআপাকে ছেড়ে দেবে আর সে হাসান ভাইয়ের ঘর সাজাবে নতুন করে! হবে তার সুখ-দুঃখের সঙ্গিনী! কিন্তু কোন্ ধরনের দুঃখের সঙ্গিনী হতে পারবে সে তাঁর কোন্ সুখেই বা হবে সুখী। পারভিনকে সেদিন সারারাত জেগে থাকতে হল।

তার পরদিন পারভিনকে বাসায় আর কেউ দেখল না। তবে শোনা গেল, জয়নাল জানাল, পারভিন আপা দেশে চলে গেছেন, বলে গেছেন আর বোধহয় আসতে পারবেন না।

পরের দিন রাখী জানতে চাইল, পারভিন কিছু বলেনি বুবু? বুলু হাসল, ও কী বলবে, ওর লজ্জা করছিল বোধহয়, হাজার হলেও বড়বোনের স্বামীকে বিয়ে করতে লজ্জা হবে না?

বুবুকে খুশি হতে দেখে রাখীর খারাপ লাগল। মনে হল, একটা ভয়ানক জটিল ব্যাপার ইতিমধ্যে কোথাও ঘটে গিয়েছে— সে তার কিছুই জানে না। তার কৌতূহল হওয়া উচিত ছিল কিন্তু হতে পারল না। শুধু বারবার করে বুবুর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল আর কষ্ট হল তার। বুবু তো এমন ছিল না। বুবু বিছানায় গড়াচ্ছে, ন্যুড ছবির বই দেখছে, এদিক-সেদিক টেলিফোন করছে— হাই সুইটি, হাই ডার্লিং বলে সম্বোধন করছে কাকে কাকে কেন। যতই দেখল, ততই রাখীর কান্না পেতে লাগল। এ কী হয়ে গেছে বুবু। আব্বার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে বললেন, তবু যাক পারভিনটা বোধহয় বেঁচে গেছে। তুই আর এখানে থাকিস না মা তুইও চলে যা। এ আপনি কী বলছেন আব্বা। রাখী আব্বার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়। দেখতে পায়, এ কী হয়েছে আব্বার, মুখ-চোখ শুকিয়ে একাকার, যেন কতকাল ঘুমোননি। রাখী আব্বাকে পাশ কাটাতে দিল না। কেমন যেন শক্তপায়ে মুখোমুখি দাঁড়াল। শুধাল, কী হয়েছে আব্বা, যে বুবুকে কিছু বলবেন না, কেন বলবেন না?

রাশেদ সাহেব স্থিরচোখে তাকান ছোটমেয়ের দিকে। বলেন, কী হবে বলে? কী বলব, আমি, আমার তো বলার কিছু নেই। বুলু মরবে, আমি সেই অপেক্ষাতেই বসে আছি।

কিন্তু —

রাখী কি কাঁদবে? কে জানে। রাখী একসময় হয়তো কাঁদত, এখন কান্না পেল না। সে বুঝল, বুলু পাগল হয়ে যাচ্ছে। বলল, বুবুকে ডাক্তার দেখান আব্বা, ওর মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

রাশেদ সাহেব হাসলেন, তোর খারাপ লাগছে রাখী, কিন্তু আমি দেখেও বসে আছি। বুলুকে সুস্থ করে কোথায় রাখব? ও তো মরবেই, ওর বেঁচে থাকবার মতো তো কোনো জায়গা নেই। এখন যে ক’টা দিন বাঁচে, পাগল হয়ে বাঁচাটাই ওর জন্যে ভালো। আব্বা শেষে বললেন, দেখি আরো ক’টা দিন, নাহয় আমিই হাসানকে বলব।

আব্বা হাসান ভাইকে বলবেন, যদিও সে বলায় কী লাভ হবে জানেন না। তবু বলবেন। কিন্তু রাখী, রাখী কাকে বলবে? জীবন তাকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত ছুটে চলে যাচ্ছে। ফাঁকি দিচ্ছে তাকে। তার সুখ, তার সাধ, ইচ্ছে, বাসনা, কোনোকিছুই সে ধরে রাখতে পারছে না। কিছুই করার নেই এখন। শুধু নিরবলম্ব ভেসে থাকা। বিশ্বাস কী বস্তু? কাকে বিশ্বাস করবে সে, নিজেকে? কোনো মানে হয় না। নিজের মতো বিপজ্জনক আর কেউ নয়। তাহলে কি সংসারকে? আব্বাকে? কে জানে আব্বা কী করতেন। হয়তো দেখে-শুনে বিয়ে দিতেন রাখীর। কিন্তু তাতে কী হত? জামানকে তো আব্বাও পছন্দ করেছিলেন। জীবন তো আব্বারও হাতের বাইরে। আর সংসার? ঘরের আশ্রয়? বুবুর সংসার ছিল না কি? ঘরের আশ্রয় ছিল না কি?

ক’দিন যেতে-না-যেতেই রাখী শুনল, বুবু ভাঙাগলায় চিৎকার করছে, শরীরে কাপড়চোপড় রাখছে না, অশ্লীল ভাষায় সবাইকে গালাগাল করে যাচ্ছে। ঘরের জিনিস ছুড়ে ছুড়ে বাইরে ফেলছে।

সুমিতা ডাক্তার ডেকে নিয়ে এল। হাসান ভাইয়ের অত সময় কোথায়? ডাক্তাররা একবাক্যে সবাই জবাব দিলেন- এখানে কিছুই করার নেই। মেন্টাল হসপিটাল ছাড়া চিকিৎসা সম্ভব নয়। আব্বাকেই নিয়ে যেতে হল পাবনায়। রাখী শুধু দেখল।

বুবু যাওয়ার আগে কিছুক্ষণের জন্যে বোধহয় স্বাভাবিক হয়েছিল। রাখীকে জড়িয়ে ধরে কী কান্না- রাখী রে, আমাকে বাঁচা, আমাকে মরে যেতে দিস না। রাখী তখন আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছিল।

আব্বা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ঠোঁট নড়ছিল একটু একটু, বোধহয় দোয়া পড়ছিলেন, কিংবা স্বগত ভাষণও হতে পারে, নিজেকেই হয়তো কোনো কথা শোনাচ্ছিলেন। হয়তো ভাবছিলেন, কাউকে তাঁর কিছু বলবার নেই। যাবার আগে, রাখীকে ডাকলেন, তুই নিজে বেঁচে থাকবার মতো একটা ব্যবস্থা কর্ রাখী মা, যেখানে হোক চলে যা- আমার ঐ বাড়িতে আর থাকিস না, ও বাড়িতে অভিশাপ লেগেছে। আমার ফিরতে দেরি হবে, কিন্তু আমি ফিরে এসে তোকে যেন ও বাড়িতে আর না দেখি।

ট্রেন ছেড়ে দেয়ায় আব্বার সব কথা শোনা হয়নি রাখীর। তবে ট্রেনটা চলে গেলে রাখীর হঠাৎ মনে হল, তবে কি সবাই চলে গেল?

সবাই, একে একে, তারই জীবন থেকে শুধু? মা, মনি ভাই, বুবু, আব্বা-সবাই, একাকী শুধু তাকেই থেকে যেতে হবে?

চোখ দিয়ে পানি পড়েনি। কিন্তু কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ফিরছিল রাখী। সুমিতাও সারাক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসেছিল পাশে। শেষে ঘরে ফিরে এসে রাখীকে বিছানায় শুয়ে পড়তে দেখে বলেছিল, রাখী অমন ভেঙে পড়ছিস কেন বল্? তোকে তো শেষপর্যন্ত বেঁচে থাকতে হবে?

রাখী জবাবে শুধু বলেছিল, কেন, বেঁচে থাকায় আমার কী দরকার? সুমিতা রাখীর প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়নি, সত্যিই তো রাখী কেন বাঁচবে? একসময় রাখী আপন মনেই বলে যায়, সুমি আমি বড় বেশি শান্ত ছিলাম, জীবনকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে চাইনি- যা সহজ মনে হয়েছে, যার মধ্যে জটিলতা নেই, শুধু সেদিকেই আমি পা রেখেছি। ভাবতাম, সুখী হব। সেজন্যে প্রেম করলাম, বিয়েও হল— অধ্যাপক স্বামী, নিরিবিলি জীবন, খুব বড়কিছু অ্যাম্বিশন আমি কখনোই করিনি— ভেবেছিলাম সংসার পাতলেই বুঝি জীবন আমার ভরে উঠবে, আমি সুখী হব কিন্তু কী হল শেষে? দ্যাখ্, কোথায় আমার সুখ, তুই জানিস সুমি, মানুষ কেমন করে সুখী হয়? আমি তো পথ খুঁজে পেলাম না।

সুমিতা হাত বুলায় রাখীর মাথায়, চুলে বিলি করে দেয়। বলে, আর ভাবিস না ওদের কথা, মন খারাপ করবে-অন্য কথা বল্।

কোন্ কথা বলব? কার কথা বলব? সবার কথাই তো ঘুরেফিরে নিজের কথা হয়ে যায়। ঘুরেফিরে সেই জীবনেরই কথা— সেই শান্তি আর সুখেরই কথা চলে আসে— যা মায়াহরিণের মতো, কেবলি হাতছানি দিয়ে যায়। কিন্তু ধরা যায় না কোনোভাবেই।

হতাশ হোস নে রাখী, হতাশ হওয়া পাপ, খুঁজে দ্যাখ্, ভেবে দ্যাখ্- সবকিছুর পরও জীবন থেকে যায়- কোথায়ও কিছু-না-কিছু অবশিষ্ট থাকে মানুষের জন্যে। তোর মতো মেয়ের জীবন এইভাবে অর্থহীন হয়ে যেতে পারে না। কিছু একটা নিশ্চয়ই পাবি তুই— ভেবে দ্যাখ্, নিশ্চয় কিছু তোকে করতে হবে।

রাখীর মনে হয়, সুমি খালি বইয়ের কথা বলতে চায়। ওর শুধু উপদেশ, উপদেশ আর আশা, অত আশা কেমন করে যে করে ও!

সুমিতা চলে গেল না সেদিন, সারাক্ষণ কাছাকাছি থাকল। রাখী ওর কথা শুনছে, শোনার মতো মন নেই, তবু শুনতে হচ্ছে। নানান প্রসঙ্গ, নানা গল্প। বারান্দায় দাঁড়াবার সময় বুবুর কথা মনে পড়ে। বুবু একেক দিন বিকেলে আনমনা দাঁড়িয়ে থাকত। তারও আগে কোনো-কোনোদিন ত্বরিত পায়ে নিজের ঘর থেকে বেরুত, মুখে চাপা হাসি, পেছনে ভয়ানক অপ্ৰস্তুত এবং বিব্রত হাসান ভাই।

আব্বার ঘরের দরজার কাছে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল বাঁধানো গীতবিতান, পাশ-টেবিলের ওপর অধোমুখে পড়ে আছে। মনে হল ঘরের ভেতরের কেউ যেন গুনগুন করছে— আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন। রাখী বাড়িময় শুধু স্মৃতির করুণ ছবি দেখে চলল সারাদিন। একসময় সুমিকে বলতে ইচ্ছে হল, সুমি তুই চুপ কর্, একা থাকতে দে আমাকে— আমি কাঁদব না— তুই এবার যা। বলতে চাইল— কিন্তু সেকথা মুখ দিয়ে বেরুল না। সুমির মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে সাহস হল না রাখীর। সুমির দুচোখে যে অতল সমবেদনা।

সুমিতা একসময় রাখীকে টানল, চল্ বাইরে যাই এখন।

বিকেলবেলাটা এদিক-ওদিক ঘুরে হাসপাতালের গেটে সুমিতা নেমে গেলে রাখী একাকী হল।

আর সেই মুহূর্তে রাখী অনুভব করল তার চারদিকটা ভীষণ ফাঁকা। কোথাও তাকে যেতে হবে না, কোথাও তার ফেরার তাগিদ নেই। কেউ তার জন্যে অপেক্ষা করবে না, কেউ তার খোঁজ করবে না। অতীত তাকে ডাকে না, বর্তমান তো পথের মধ্যেই ধরা, আর ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যতের কথা সে জানে না। ডাইনে-বাঁয়ে তাকিয়ে রাস্তার দুপাশের গাছের সারি দেখল চুপচাপ। শেষে হাঁটতে আরম্ভ করল।

তার অতিচেনা পথ। পুরনো য়ুনিভার্সিটি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বারবার করে থামতে হল, এখানেই ছিল ওরা— কত কোলাহল, কত উল্লাস, কত ভালোবাসা— বিক্ষোভ বিদ্রোহ কত। তবু এক জায়গায় জুটেছিল সবাই। এই তো সেদিন এই গেট দিয়ে বার হয়ে এসেছিল সে, তখন সকালবেলা, পেছনে কতজনের স্বর ভেসে আসছিল- কারা কারা যেন ডাকাডাকি করছিল। এখন, এখন সে যে কোথায়, কেউ কি জানে? টুটু কি জানে, রাখী আপা একাকী রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছে?

রাখীর তখন নানান কথা মনে পড়ছে— আব্বার কথা, মনি ভাইয়ের কথা, বুবুর কথা। বুবু একবার বলেছিল, রাখী তোর কী হবে আমি সেই কথা ভাবি- আমাদের আপনজন বলতে কেউ নেই- আর সেজন্যেই তোর বিয়ে হওয়া দরকার। সেই বিয়ে তো হয়েছিল রাখীর, কিন্তু কী হল পরিণতিতে? কেউ কি আপন আছে তার? আর বুবুই কি ভাবতে পারছে তার কথা! আব্বা না বলেছিলেন, রাখীবাঈ, তোর যা ভালো লাগবে তাই করিস, নিজের ইচ্ছের বাইরে যাস না- তা নিজের ইচ্ছেতেই তো সবকিছু করেছে সে, কিন্তু তাতে লাভ কী হল? জীবনের বাইরে চলে আসতে হয়েছে তাকে। হায় রে! ইচ্ছের বাইরে চলে যাবার মতো অবস্থা হয়েছে তার।

রাখী সেদিন সন্ধ্যার পরও পথে-পথে ঘুরল অনেকক্ষণ। আর কেবলি ঘুরেফিরে তার মনে পড়ল, সে একা, আর কী ভয়ানক রকমের একা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *