ত্রয়ী উপন্যাস -প্ৰথম পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - দ্বিতীয় পৰ্ব
ত্রয়ী উপন্যাস - তৃতীয় পৰ্ব

কুলায় কালস্রোত – ১০

দশ

সে বোঝে, ফিরে আসা নয়- আসলে পাশ কাটানো। কিন্তু আর কতদিন? রাখী একাকী ঘরে শুয়ে শুয়ে নিজেকে প্রশ্ন করে। আর কতদিন পাশ কাটাবে রাখী, শুধু তো পাশ কাটিয়েই এল। কোনোকিছুর মুখোমুখি হল না। সোজাসুজি দাঁড়াতে তার ভয়, মুখোমুখি হতে তার ভয়। কিন্তু জীবন তো এমন হয় না কখনো। চাকরি করতে গিয়ে তুমি মাজহারকে পাশ কাটালে, নিজেকে পাশ কাটাতে গিয়ে তুমি বিয়ে করলে। জামানকে পাশ কাটাতে গিয়ে একাকী হলে, এখন আবার ঐ পাশই কাটাতে চাও? হাসান ভাইকে, বুবুকে, আব্বাকে- এরপর পাশ কাটিয়ে তুই কোথায় যাবি, রাখী? রাখী নিজেকে ডেকে ডেকে জিজ্ঞেস করে।

একেক দিন রাখীর ভীষণ কষ্ট হয় বুকের ভেতরে। কোথাও যাবার নেই, কিছু করার নেই, কিছু বলার নেই। সুমিতা রাখীর ঐরকম কষ্টের দিনে বলে, রাখী, তুই পালা এবার- ঢাকায় থাকিস না, ঢাকায় থাকলে তুই মরে যাবি।

রাখী কিছু বলে না। হায় রে, সুমি তাকে মরণের ভয় দেখায়। মরে গেলে যেন কারো খুব ক্ষতি হবে। সুমিতার কথার জবাব দেয় না রাখী। সুমিতা আজকাল ভারি আপন হয়ে উঠেছে। এমনিতেই ও খুব ভালো মেয়ে। কিন্তু ওরই বা সময় কোথায়? ওর কাজ নেই? হাসপাতালে ডিউটি, তার ওপর আবার নিউমার্কেটে এক ওষুধের দোকানে সন্ধেবেলা বসছে। অবসর নেই জেনেও সুমিতার কাছে যেতে হয় রাখীকে। সুমিতাও আসে রাখীর কাছে একেক দিন।

কিন্তু সে আর কতক্ষণ। সুমিতার যে অনেক কাজ। আর সে নিজে? সে কোন্ কাজে যাবে? তার কি কোনো কাজ বাকি রয়েছে কোথাও?

তুই বরং সংসার কর্ মনোযোগ দিয়ে। সুমিতা উপদেশ দেয়।

সংসার? রাখী বুঝে উঠতে পারে না ঠিক। পরে বোঝে, বোঝে যে জামানের কাছে ফিরে যেতে বলছে সুমিতা।

রাখী কথাটা চিন্তা করে। না রাগ নয়, ক্ষোভ নয়, ঈর্ষাও নয়। কার ওপর ঈর্ষা করবে রাখী? নার্গিস যদি জামানের প্রেমে পড়ে যায়, তাহলে কার কী করার আছে? শুধু নার্গিস কেন, জামানের সঙ্গে যদি আরো কোনো মেয়ের সম্পর্ক থাকে, তাহলেও রাখীর কিছু করার নেই। তাছাড়া কোনোকিছু করা-না-করাতেই কি খুব কিছু যায় আসে? কত মেয়ে সতীনের সঙ্গে দিব্যি সংসার করছে। তাদের কাছে জীবন কি অস্বাভাবিক কিছু? সবার সংসার কি একরকম হয়? তাহলে জামানের কাছে ফিরে যেতে দোষ কী?

রাখীর কাছে শেষপর্যন্ত না-যাওয়াটা যেমন অর্থহীন, আবার ফিরে আসার ব্যাপারটাও অর্থহীন বলে মনে হয়।

সুমিতা বোঝায়। বলে, দ্যাখ্ রাখী, জীবন চিরকাল এমনি থাকবে না। উদ্দেশ্যহীন বেঁচে থাকবার অর্থই হল বোঝা বয়ে বেড়ানো। একসময় দেখবি— তুই আর পারছিস না। তখন সবকিছু ভাসিয়ে দিয়ে হয় পথে নামবি, নইলে মারা পড়বি। তোর ফিরে যাওয়াই ভালো।

সুমিতার কথার উত্তরে বলতে পারত, জামানের বউ হয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়ার জন্যেই কি তার জন্ম হয়েছিল? জামানের বিছানায় শুয়ে, তার দেখাশোনা করে সংসা গোছালেই কি জীবনের মহৎ উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া যাবে?

বলতে পারত, কিন্তু বলেনি। সুমি ঐরকমই— কেন যে ডাক্তার হল? ওর মাস্টার হওয়া উচিত ছিল। সবাইকে শুধু ও উপদেশ দিতে চায়। রাখী আর বুঝতে চায় না। বুঝে কোনো লাভ নেই। আসলেই তো ব্যাপারটা জীবনের সঙ্গে নিজেকে জড়ানো। কিন্তু জীবনের কোন্ অংশের সঙ্গে সে নিজেকে জড়াবে? জামান কিংবা জামানের সংসার, তার ভালোবাসা- কোনোকিছুই আর আকর্ষণ করে না এখন। ফিরে গেলেও তো নিঃসঙ্গ, উন্মুল, নিরবলম্ব একটা অস্তিত্ব নিয়ে তাকে ভেসে থাকতে হবে। তাহলে লাভটা কী হল? রাখী তাই ভাবে না আর বুঝতে চেষ্টা করে না আর।

কিন্তু তাই কি পারে মানুষ? ভাবনার দুয়ার বন্ধ করে কে কবে থাকতে পেরেছে? রাখীকে তখন দুয়ার খুলে দিতে হয়- ঘরেরও, ভাবনারও। বাইরে বাইরে ঘোরে সে।

কিন্তু বাইরে বা কতক্ষণ? আবার ফিরতে হয়। আবার মুখোমুখি হতে হয় ভাবনার সঙ্গে।

এও এক লুকোচুরি খেলা যেন। কখনো বাইরেটাকে এড়াবার জন্যে ঘরে আসা, আবার কখনো ঘরকে এড়িয়ে বাইরে চলে যাওয়া।

এমন অবস্থায় একদিন রাখী সেজানের রেখে যাওয়া ব্যাগটা খুলল।

ব্যাগের ভেতরে কিছু ইশতাহারের মুসাবিদা, একটা লিস্ট, তাতে কিছু কিছু নাম-ঠিকানা লেখা, এবং কয়েকখানা চিঠি। এছাড়াও দেখল কয়েখানা চটি চটি বই। বিপ্লব, বিপ্লবের পরিস্থিতি আর আন্দোলনের পদ্ধতি সম্পর্কে লেখা বই। একেবারে অচেনা নয়। এ-ধরনেরই কাগজপত্র সে মনি ভাইয়ের ড্রয়ারে দেখত। সেসব কাগজপত্রগুলো উল্টেপাল্টে দেখেও তার কোনো কৌতূহল হয় না। কৌতূহল না হলেও হয়তো চিঠিপত্রগুলো দেখত। কিন্তু ঠিক ঐসময়ই পারভিন ঘরে এল। কিছুক্ষণ চুপচাপ দেখে শেষে জিজ্ঞেস করল, এ যে দেখছি রাজনীতির ব্যাপার। রাখী আপা, তুমি কি পলিটিক্স আরম্ভ করেছ না কি?

রাখী তাকায় এবং তখনকার মতো ব্যাগটা বন্ধ করে রাখে।

বন্ধ করে রাখে কিন্তু মনকে তো বন্ধ করে রাখা যায় না। ঘুরেফিরে কেবলই প্রশ্ন জাগে।

কী থাকে রাজনীতির মধ্যে? মনি ভাই কেন এমন করে জড়িয়ে পড়েছিল? সেজান কেন এমনভাবে নিজেকে রাজনীতির মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছে? সুনাম, অর্থ, প্রতিপত্তি কোনোটাই তো এ পর্যন্ত জুটল না। কিন্তু তবুও কেন ঐ একটা ব্যাপারের সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে লেগে থাকতে পারে মানুষ! প্রতিপত্তি, টাকা, বিলাসিতা, স্বাচ্ছন্দ্য, এসবের জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠার কারণ বোঝা যায়, কিন্তু শুধুই রাজনীতির জন্যে মানুষ কেমন করে দিনের পর দিন বেঁচে থাকতে পারে? ব্যাপারটা তার মগজে ঢোকে না।

ত্যাগ, দেশপ্রেম, আদর্শ- এসব কথা ছেলেবেলা থেকে সে শুনে আসছে। কিন্তু এসব কথার অর্থ কি শুধু ব্যর্থ হয়ে যাওয়া? যে ত্যাগ কোনোকিছু সৃষ্টি করতে পারবে কি না কেউ জানে না, আদর্শ বাস্তবে কোনোদিন দেখা যাবে না- সে আদর্শের যে কী দাম থাকতে পারে, সেকথা রাখী একদম বুঝতে পারে না। মানুষকে সুখী করার জন্য মানুষকে সত্যিই কোনোরকম প্রেরণা অনুভব করে? নাকি ব্যাপারটা আসলেই নেশা, মানুষ যেমন মদ জুয়া ছাড়তে পারে না, এও তেমনি। নাকি ব্যাপারটা আর্টের মতো কিছু। একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট— কিছু উপলব্ধি ফুটিয়ে তোলার জন্যে বিরতিহীন চেষ্টা। সুমিই আজকাল একমাত্র বন্ধু। সুমিকে জিজ্ঞেস করলে বলে, রাখী তুই কি পাগল হয়ে যাচ্ছিস? এত লেখাপড়া শিখেও বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মতো প্রশ্ন করিস?

না, ঠিক করে বল্, রাখী ভয়ানকভাবে চেপে ধরে— যদি কিছু জানিস, সত্যি করে বল্? বইয়ের কথা নয়, জ্ঞান নয়— তোর নিজের কথা বল্।

দ্যাখ্ রাখী, কথা খুঁজে পায় না তবু বলে সুমিতা। বলে, এ জিনিস কেউ কাউকে বোঝাতে পারে না। আমি একটা বাচ্চার মৃত্যু দেখেছিলাম। বাচ্চাটা শুয়েছিল, চোখ কোটরে ঢোকানো, মুখের রঙ কেমন ছাইয়ের মতো হয়ে উঠেছিল। বাচ্চাটা মায়ের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছিল। কথা বলতে শেখেনি, কিন্তু কী আকুলি-বিকুলি! হাতের শুকনো আঙুলগুলো দিয়ে আঁকড়ে ধরতে চাইছিল মায়ের বুক- ওর মা কাঁদছিল আর আমি দেখছিলাম। সেই মুহূর্তে ভুলে গেলাম, আমি কে, সে ওয়ার্ডে আমার ডিউটি আছে কিনা। ওষুধ বার করলাম, ইঞ্জেকশন দিলাম- নিজেই ছুটলাম অন্য ডাক্তারের কাছে— জুটিয়ে আনলাম একসঙ্গে চার-পাঁচজনকে। ওরা সবাই অবাক হচ্ছিল আমার পাগলামি দেখে। কিন্তু আমি কিছুই বলিনি। সারারাত বাচ্চাটার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ঠাণ্ডা হাতদুটি ধরে রেখেছিলাম। নাড়ির স্পন্দন ক্ষীণ হয়ে আসছিল। চোখের তারাটা উঠে যাচ্ছিল ওপরের দিকে। হাত-পা ঠাণ্ডা, হিম হয়ে আসছিল শরীর। দেখছিলাম আর ভয়ানক আতঙ্ক বুকের ওপরে ক্রমেই চেপে বসছিল। ওষুধের পর ওষুধ, ইঞ্জেকশনের পর ইঞ্জেকশন, একের পর এক দিয়ে যাচ্ছি। প্রাণপণে আশা করছি, এক্ষুনি হয়তো মোড় ফিরবে, মৃত্যুকে ঠেকানো যাবে। কিন্তু হল না, বাচ্চাটাকে বাঁচানো গেল না।

যখন ফিরলাম, ভারি পরাজিত, অপমানিত আর অক্ষম বলে মনে হল নিজেকে। মনে হল, আমার কোনো মূল্য নেই— আমি একেবারেই অপ্রয়োজনীয়, মানুষের কোনো কাজে আসতে পারি না আমি।

রাখী সুমিতার গল্প শুনছিল। দেখছিল, গল্পটা শোনবার সময় সুমিতার গলার স্বর বদলে যাচ্ছে। যেন চোখের সামনে বাচ্চাটার মুখ দেখতে পাচ্ছে ও। এবং শেষে সে ভারি অস্বাভাবিক গলায় তার গল্প শেষ করল। মনে হচ্ছিল, সত্যিই সুমিতা সেদিন সর্বস্ব পণ রেখেও চূড়ান্তভাবে হেরে এসেছে।

আর ঐদিন থেকে আমি ফিল করি, সুমিতা বলে, আমার কিছু করণীয় আছে। কী সেটা জানি না। হয়তো রোগ সারানো, হয়তো মানুষকে সাহায্য করা, কিংবা সান্ত্বনা দেয়া— মোটকথা কিছু একটা করবার আছে আমার। ব্যাপারটা ত্যাগ কি না জানি না, আন্তরিকতা কি না জানি না, আদর্শ কি না তাও জানি না- কিন্তু মনে হয়, এরকম কিছু একটা থাকা দরকার মানুষের। অন্তত আমার মতো মানুষের জন্যে তো খুব বেশি দরকার। এরকম কিছু একটা না থাকলে জীবনের গোটা ব্যাপারটা অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। রাজনীতির মধ্যেও এরকমই কোনো ব্যাপার আছে।

রাখী শুনল, বুঝতে চেষ্টা করল, কিন্তু শেষপর্যন্ত বুঝল না। মনের ভেতরে নিজেকে প্রশ্ন করল, এমন কি হয়েছে আমার কখনো, ঠিক এমন? একেবারে সুমির অভিজ্ঞতার মতো কিছু কি ঘটেছে তার? মনে পড়ে না। কেমন অস্পষ্ট মনে পড়ল, মিছিল করে যাচ্ছে- য়ুনিভার্সিটি থেকে বেরিয়েছে সবাই। চিৎকার, স্লোগান, আকাশ কাঁপিয়ে দিচ্ছে। একটু পরই ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল। দেখতে দেখতে টিয়ার গ্যাসে চারিদিককার বাতাস হয়ে উঠল ভারী— চোখ মেলে থাকা যায় না। একটু পর শোনা গেল গুলি চলছে— চারজন জখম- একটি বাচ্চাছেলেকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলছে— রক্তাক্ত জামা দেখা যাচ্ছে ছেলেটার।

তখন? তখন কি মনে হয়েছিল কিছু? হ্যাঁ, মমতা জেগেছিল বাচ্চাছেলেটার জন্যে। আহা, ছেলেটা বোধহয় মারা যাবে। আর পুলিশ দেখলেই রাগ হচ্ছিল কিছুটা। ছেলেরা যখন পুলিশের দিকে ইট পাটকেল ছুড়ছিল তখন তার মজা লাগছিল। কিন্তু সে তো ঐ পর্যন্তই। ঐ রাগ, ঐ মমতা ঝাপসা হয়ে এসেছে নিজেরই মনের ভেতরে। এখন কোনো জ্বালা নেই, দংশন নেই, আক্রোশ নেই। একুশে ফেব্রুয়ারিতে গান হয়— ঐদিন মন দিয়ে গান শুনতে ইচ্ছে করে, সশ্রদ্ধ একটা ভাব জাগে, দল বেঁধে ফুল দিতে যায় গোরস্থানে। কিন্তু সব তো মানানসই, ছকে বাঁধা, পরিচ্ছন্ন, নিটোল সাংসারিকতার মতোই। এসবের সঙ্গে কি সুমির ঐ ব্যাপারের তুলনা হয়? আচ্ছা, তুই কবিতা পড়িসনি কখনো?

সুমিতার প্রশ্ন শুনে রাখী আরো অবাক হয়ে বলে, কবিতার সঙ্গে এসবের কী সম্পর্ক?

রাখী হাল ছেড়ে দিয়ে বলে, তুই আমাকে ছাত্রী ভেবেছিস নাকি? গোটা ব্যাপারটা অনুভূতির সেকথা কে না জানে, কিন্তু সায়াইম অনুভূতির ব্যাপার যা বললি ও তো সাময়িক ব্যাপার। কিন্তু আমি জানতে চাই, কেমন করে পারে মানুষ এইরকম একটানা কমিটেড থাকতে।

সুমিও শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে বলে, রাখী তোর কপালে অনেক দুঃখ আছে। তুই এমন হয়ে যাচ্ছিস কেন, জীবন তো এক্সপেরিমেন্টের ব্যাপার নয়।

আবার ঘুরেফিরে আসে সেই পুরনো কথা— জীবন। কেন মানুষ ঐ একই কথা ঘুরেফিরে বারবার বলে। ঐ কথা কবিতায় থাকে, গানে থাকে— বিষাদে, আনন্দে, চিন্তায়, আলোচনায় বারবার করে উচ্চারিত হয়। মনি ভাই ঐ জীবনেরই বিশ্বাস খুঁজতে গিয়েছিল। তখন বুঝত না, এখন কিছুটা অস্পষ্ট বোঝে। বোঝে, আর সেজন্যেই সম্ভবত কষ্ট হয়। জীবন এক্সপেরিমেন্টের ব্যাপার নয়। যদি এক্সপেরিমেন্টের ব্যাপার নয়, তাহলে জীবন কী? জীবন কি ছকে বাঁধা ঘটনা? জীবন কি সংসারধর্ম পালন করা? বাজার খরচার হিশেব, শাড়ি-গয়নার শখ, স্বামীকে বিছানায় তুষ্ট করা – এইই কি জীবন? যদি এইই জীবন হয়, তো সে জীবন তো তাকে ধরে রাখতে পারল না। তাহলে আর কী?

সেদিন বাসায় ফিরছিল। রাস্তার মোড়ে জয়নালকে দেখল। সে উত্তেজিত স্বরে যা জানাল, তাতে রাখীর বুকের ভেতরে অস্থিরতা দপদপ করে উঠল। অল্প কথায় শুনল, পুলিশ বাড়ি সার্চ করেছে এবং রাখীর ঘর থেকে একটা ব্যাগ বার করেছে। সেই ব্যাগ নিয়ে বসে আছে; রাখীর সঙ্গে কথা বলবে। রাখী ভয়ানক দিশেহারা বোধ করে। কী করবে ভেবে পায় না। তার কেবলি মনে হচ্ছে সে শেষপর্যন্ত বিশ্বাসঘাতকতা করল, সেজানকে সে ধরিয়ে দিল। নিজেকে ধিক্কার দিতে দিতে স্কুটারে চেপে সে সুমিতার ঘরে পৌছল। সুমিতা তখন ডিউটিতে বেরুচ্ছে। শুনে সুমিতা যেন খেপে উঠল। বলল, করেছিস কী মুখপুড়ি, এভাবে কাউকে ডোবাতে হয়? তুই সাবধান হবি না? কী দরকার ছিল ব্যাগটা রাখার? এখন কী করবি, কারো ঠিকানা জানিস?

রাখী নির্বোধের মতো মাথা নাড়ায়। কেমন করে জানব, কোনোদিন এসব নিয়ে আলোচনা হয়নি, রাজনীতির ব্যাপারে আমার আগ্রহ কীরকম, সে তো জানিস?

তাহলে রাখতে গেলি কেন? সুমি রীতিমতো ধমকে ওঠে। তারপর অস্পষ্ট মন্তব্য করে- ইশ্ কতজন যে ধরা পড়বে কে জানে।

সুমিতা হাসপাতালে এসে রাতের ডিউটি থেকে ছুটি নিল। তারপর বেরুল। প্রথমে মেডিক্যাল হোস্টেলের মাহবুব। আনিস মাহবুবের বন্ধুদের দু’তিন জায়গায় টেলিফোন করল। শেষে যেতে হল দৈনিক আহ্বান অফিসের সাদেক সাহেবের কাছে।

সাদেক সাহেব সেজানের নাম শুনে গম্ভীর হলেন। তাকে খবরটা দেয়া হলে ভদ্রলোক তীব্র চোখে তাকালেন রাখীর দিকে। জিজ্ঞেস করলেন, দুনিয়াময় রাষ্ট্র করে দিয়েছেন বোধহয়, ব্যাগ আর পুলিশের কথাটা?

রাখী তখন অস্থির, প্রায় মিনতি করে বলল, দয়া করে সেজান সাহেবের কাছে খবরটা দেয়ার ব্যবস্থা আগে করুন- পরে আমাকে যা-খুশি বলবেন। সাদেক সাহেব তক্ষুনি ছুটলেন, যাবার মুখে শুধু বললেন, পুলিশের কাছে কিছু বলবেন না।

ফেরার সময় রাখী একাকী। দুজন, কিন্তু সে তখন নিজের মনের ভেতরে একাকী হয়ে রয়েছে। সুমিতা রিকশয় পাশে বসে বলল, রাখী বি সিরিয়াস, এসব বিপজ্জনক ব্যাপারে হাত দিবি না কক্ষনো। শুধু তোর একার নয়, অনেকের জীবনের অনেককিছু জড়ানো এসব ব্যাপারের সঙ্গে।

রাখী শুনল কি-না জানে না। রাতের ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। আকাশে তারা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না, বোধহয় মেঘ করেছে। সুমি আবার বলল, রাখী, লক্ষ্মীটি, এসবের সঙ্গে নিজেকে জড়াস না আর, মারা পড়বি।

রাখী শুনল এবার। শুনল আর হাসল। বলল, আমি তো কখনোই জড়াইনি কোথাও, কিন্তু কী করব বলতে পারিস? কেউ যদি এভাবে চাপিয়ে দেয়?

সুমি শেষ কথা বলল সেদিন, রাখী তুই এবার পালা, ঢাকা শহর তোর জন্যে এখন বিপজ্জনক হয়ে উঠছে, বাইরে কোথাও চলে যা।

রাখী দূরে মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা একটা তারা দেখতে দেখতে আপন মনে বলল, হ্যাঁ দেখি— এখানে থাকার তো আমার আর দরকার নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *